নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়
The mutual presence of performers and audience in the same space sharing the same air
১৯৬৮ সনের কোনো এক বৈকালে প্রকৌশলী গোলাম রাব্বানীর হাত ধরে মতিঝিলের কোনো এক বাসায় গেলাম কোনো একটি সভায় যোগ দিতে। আসলে ঠিক সভায় যাইনি— গিয়েছিলাম নাটকে অভিনয় করতে। দেখলাম মেলা লোক সেখানে। বিখ্যাত লোকজন সব— আমার সাথে ছিলেন রাব্বানী আর ইনামুল হক। তিনি তখনও ডক্টর হননি। উপস্থিত বিশিষ্টদের মাঝে ছিলেন— জিয়া হায়দার, আতাউর রহমান, ফজলে লোহানী, সৈয়দ আহসান আলী সিডনি, বুলবুল আহমেদ, ফিরোজ ইফতেখার, চিত্রশিল্পী মোস্তফা কামাল, নৃত্যশিল্পী আমানুল্লাহ আমান প্রমুখ।
আমি এবং ইনাম ভাই আমরা নভিসের মত শুধু শুনলাম। নাটক হবে ইডিপাস। থিয়েটার গ্রুপের ব্যানারে। নাম দেয়া হয়েছে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়। কিন্তু নাটকটি থিয়েটারে হবে না, হবে টেলিভিশনে। জিয়া হায়দার তখন ঢাকা টেলিভিশনের প্রযোজক। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সদ্য মাস্টার্স করে এসেছেন নাটকের ওপর। তিনি একজন কবিও। মোস্তফা মনোয়ার পরিচালনা করবেন। কথাবার্তায় আমরা যতটুকু বুঝলাম-নাটকটি করতে সম্মত সবাই, তবে ইডিপাস চরিত্রে কে অভিনয় করবেন তা নিয়ে মতপার্থক্য যথেষ্ট, প্রধান প্ৰতিযোগী দু’জন, আতাউর রহমান এবং বুলবুল আহমেদ। আতাউরকে আমি চিনতাম কিছুটা। চট্টগ্রাম কলেজিয়েটে পড়ার সময় দেখেছি আমার দু’ক্লাস ওপরের ছাত্র ছিলেন। বুলবুল আহমেদকে দেখেছি, টিভি নাটকে, তিনি তখন জনতা ব্যাংকে (United ব্যাংক তখন) চাকরি করতেন।
প্রথম দিন তেমন কোনো সিদ্ধান্তের কথা জানতে পারলাম না। আমরা তো চুনোপুঁটি। শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে দেখেছি। চেঁচামেচি শুনেছি আর নানান মন্তব্য।
ক’দিন বাদে মহড়া শুরু হলো ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (বর্তমান বুয়েটের) খুব সম্ভবত ইনামুল হকের ব্যাচেলর কোয়ার্টারে। পরে অবশ্য নতুন স্থাপত্যকলার বিল্ডিং-এর একটি কক্ষে চলে মহড়া।
আতাউরই করলেন ইডিপাস। আমি পেলাম ছোট একটি পার্ট। একটা— মন্দিরের পুরোহিত। ইনাম ভাই মেষ পালক, রাব্বানী-ক্রেয়ন, সুলতানা কামাল— অন্যতম কোরাস নাসিমা খান মজলিশ, আরও বেশ কিছু চরিত্রের নাম মনে করতে পারছি না এখন। জিয়া ভাইয়ের কড়া খবরদারীতে রিহার্সাল চলল বেশ দীর্ঘ সময়। তিনি ছিলেন হিটলার ডিরেকটর। সব ব্যাপারেই পারফেকশন চাই তাঁর। সত্যিকার অর্থে শিখেছি অনেক তাঁর কাছে। ও হ্যাঁ, জোকাস্টা মানে নাটকে প্রধান নারী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপিকা।
প্রথম সভায় যাঁদের দেখেছিলাম তাঁদের অনেককেই আর দেখিনি পরে, বলা যায় জন্মের পূর্বেই বিভাজনের হয়েছিল সূত্রপাত। তাতে অবশ্য নাটক তৈরিতে সমস্যা হয়নি কোনো। নাটক একদিন ধারণ করাও হলো ডি.আই.টি স্টুডিওতে। আমার জীবনের প্রথম টিভি-অভিনয়। আমাদের অনেকেরই ছিল তাই। বেশ আলাদা উত্তেজনা কাজ করেছিল সবার মাঝেই।
প্রচারও হলো নাটকটি এক সময়। সুধী সমাজে হলো প্রশংসিত। সত্যি বলতে কি দর্শক সংখ্যা ছিল মাত্র কয়েক হাজার। ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্র যখন ১৯৬৪’র ডিসেম্বরে চালু হয় তখন ঢাকায় টিভি সেট ছিল নাকি মাত্র হাজার বারোশো। এই বারোশোর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো পেয়েছিল বিশেষ সুবিধা।
আবার একদিন দেখি নাগরিকের সভা বসলো। একদিন, দুদিন, তিনদিন-তারপর কদিন জানি না। আগের সবাই আসেন সে সভাগুলোতে। আমি মনে হয় সব সভায় যাইনি। একদিন হঠাৎ খবর পেলাম নাগরিক প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে তবে অনেকেই ত্যাগ করে গেছেন এই হবু প্রতিষ্ঠানকে। আমার কাছে প্রস্তাব এল— খুব সম্ভবত ইনাম ভাইয়ের মাধ্যমে— জিয়া হায়দার এবং আতাউর রহমান নাগরিক প্রতিষ্ঠা করছেন আমি তাদের সাথে আছি কিনা। দেখলাম ইনাম ভাই আর রাব্বানী ভাই দুজনাই আছেন এই দলে— ভিড়ে গেলাম আমিও। হয়ে গেলাম নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।