১৩. অতি গোপনীয় ডায়রি
কয়েক সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হলো হারমিওনকে। তার অদৃশ্য হওয়া সম্পর্কে গুজবের আকস্মিক দমক বয়ে গেল যখন স্কুলের বাকী সবাই ক্রিস্টমাস ছুটির পর ফিরে এলো, কারণ সবাই ভেবেছে যে সেও আক্রমণের শিকার হয়েছে। তাকে এক নজর দেখার জন্য হাসপাতাল রুমের পাশ দিয়ে এ ছাত্র যেতে শুরু করল, যে, পশম ভর্তি মুখ দেখার লজ্জা থেকে তাকে রক্ষা করার জন্য মাদাম পমফ্রেকে আবার তার বিছানার চারপাশে পর্দা দিতে হলো।
হ্যারি আর রন প্রতি সন্ধ্যায় তাকে দেখতে যেত। নতুন টার্ম শুরু হওয়ার পর, ওর রোজকার হোমওয়ার্ক নিয়ে আসত।
আমার যদি নতুন গোঁফ গজায় তাহলে আমি কাজে ভঙ্গ দেব, বলল রন, এক সন্ধ্যায় হারমিওনের বিছানার পাশে একগাদা বই রাখতে রাখতে।
বোকার মতো কথা বলো না রন, আমাকে ক্লাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে, হারমিওনের চটপট জবাব। ওর উৎসাহ আবার ফিরে এসেছে। কারণ মুখ থেকে সব লোম চলে গেছে আর চোখ জোড়া আবার ধীরে ধীরে বাদামী রঙ ফিরে পাচ্ছে। আমার মনে হয় না তোমরা নতুন কিছু জানতে পেরেছ, মাদাম পমফ্রে যেন শুনতে না পায় ফিস ফিস করে বলল হারমিওন।
একেবারেই না, বলল হ্যারি বিষণ্ণভাবে।
একশতবারের মতো বলল রন, আমি এত নিশ্চিত ছিলাম যে ম্যালফয়ই।
ওটা কি? জিজ্ঞাসা করল হ্যারি, হারমিওনের বালিশের নিচে থেকে সোনালী কি একটা বেরিয়ে রয়েছে দেখিয়ে।
একটা ভাল–হয়ে–যাও কার্ড, তাড়াতাড়ি বলে হারমিওন কার্ডটাকে বালিশের নিচে ঠেলে দিতে চেষ্টা করল, কিন্তু রন তার চেয়ে দ্রুত। ও সেটা টেনে বের করে আনল, খুলে জোরে জোরে পড়তে শুরু করল।
মিস গেঞ্জারের প্রতি, তোমার দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি, চিন্তিত শিক্ষকের কাছ থেকে, প্রফেসর গিল্ডরয় লকহার্ট, অর্ডার অফ মারলিন, থার্ড ক্লাস, ডার্ক ফোর্স ডিফেন্স লীগের অবৈতনিক সদস্য এবং পাঁচবার উইচ উইকলির সবচেয়ে–মনোহর–হাসি পদক প্রাপ্ত।
রন হারমিনের দিকে তাকাল বিরক্তি নিয়ে।
এটা বালিশের নিচে রেখে তুমি ঘুমাও?
কিন্তু মাদাম পমফ্রের সান্ধ্য ওষুধ দেয়ার জন্য আগমনে হারমিওন জবাব দেয়া থেকে রেহাই পেয়ে গেল।
তুমি যত লোকের সঙ্গে মিশেছ তার মধ্যে লকহার্ট কি খাতির জমাতে সবচেয়ে বেশি তোষামোদকারী এমন কোন ব্যক্তি, না অন্য কিছু? ডর্মিটরি থেকে গ্রিফিল্ডর টাওয়ারের দিকে যেতে রন জিজ্ঞাসা করল হ্যারিকে। স্নেইপ এত হোমওয়ার্ক দিয়েছে যে, হ্যারি ভাবছে ওগুলো শেষ করতে করতে সে ষষ্ঠ বর্ষে পদার্পণ করবে। রন বলছিল ওর হারমিওনকে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করছিল চুল–খাড়া–হওয়া পোশনের মধ্যে কয়টা ইঁদুরের লেজ দিতে হবে, ঠিক সেই সময় ওপর তলা থেকে একটা ক্রুদ্ধ গর্জন ওদের কানে পৌঁছালো।
ওটা ফিলচ, বিড় বিড় করে বলল হ্যারি, সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত উঠে আড়ালে থামল, যেন দেখা না যায়, কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো ওরা।
তোমার কি মনে হয় আবারও কেই আক্রান্ত হয়েছে? উত্তেজিত রন জিজ্ঞাসা করল।
ওরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওদের মাথা ফিলচের গলার স্বরের দিকে কাত করা। খুব হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মনে হচ্ছে ফিলচকে।
…আমার জন্যে আরো কাজ! সারারাত মোছা, যেন আমার আর কোন কাজ নেই! না, এবারই শেষ, আমি ডাম্বলডোরের কাছে যাচ্ছি..।
ওর পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল এবং ওরা শুনতে পেলো দূরে একটা দরজা দড়াম করে বন্ধ হলো।
কোনা দিয়ে মাথা বের করল ওরা। স্বাভাবিকভাবেই ফিলচ ওর নজরদারিটা চালিয়ে যাচ্ছে: ওরা আবার সেই যায়গায় এসে পড়েছে যেখানে মিসেস নরিস আক্রান্ত হয়েছিলেন। এক নজরে ওরা দেখল কি নিয়ে ফিলচ চিৎকার করছিল। করিডোরের অর্ধেকটা পানিতে ভেসে গেছে, এবং মনে হচ্ছে। এখনও মোনিং মার্টলের বাথরুম থেকে পানি চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। এখন ফিলচ থেমেছে, বাথরুমের দেয়াল থেকে প্রতিধ্বনিত মাৰ্টলের ফোপানী ওরা শুনতে পাচ্ছে।
এখন ওকে নিয়ে আবার কি হয়েছে? বলল রন।
চলো দেখি গে যাই, বলল হ্যারি এবং গোড়ালীর ওপর পা তুলে ওরা পানি ভেঙ্গে বাথরুমটার দরজা পর্যন্ত গেল যেখানে লেখা রয়েছে অকেজো, সব সময়ের মতো ওটাকে উপেক্ষা করল এবং ভেতরে গেল।
মোনিং মার্টল কাঁদছিল, যদি সম্ভব হয়, আরো জোরে আরো শব্দ করে আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। মনে হয় সে তার নিয়মিত টয়লেটটাতেই লুকিয়ে রয়েছে। ভেতরটা অন্ধকার, কারণ পানির তোড়ে মোমবাতি নিভে গেছে এবং দেয়াল আর মেঝে দুটোই সিক্ত।
কি হয়েছে মার্টল? জিজ্ঞাসা করল হ্যারি।
ওটা কে? ফোঁস ফোঁস করল মার্টল বিমর্ষভাবে। আমার দিকে অন্য একটা কিছু ছুঁড়ে দেয়ার জন্য এসেছে?
পানি ভেঙ্গে হ্যারি ওর কিউবিকলের দিকে হেঁটে গেল হ্যারি, বলল, আমি তোর ওপর কোন কিছু ছুঁড়ে মারব কেন?
আমাকে জিজ্ঞাসা করো না, মার্টল চিৎকার করে উঠল, আরো বেশি পানিসহ উঠল, ইতোমধ্যে ভেজা মেঝে আরো ভিজে গেল। এই যে আমি, আমার কাজ নিয়েই ব্যস্ত, এবং কেউ কেউ ভাবে আমার উপর বই ছুঁড়ে মারাটা মজার কোন ব্যাপার…
কিন্তু কেউ যদি তোমার দিকে কিছু ছুঁড়েও মারে, তোমার তো লাগবার কথা নয়, যুক্তি দেখাবার চেষ্টা করল হ্যারি। আমি বলছি, ওটাতো ওর একেবারে তোমার ভেতর দিয়ে চলে যাবে, যাবে না?
ও ভুল কথাটা বলেছে। মার্টল নিজেকে আরো ফুলিয়ে তুলল এবং চিৎকার করল, সবাই মাৰ্টলের উপর বই ছুড়ক, কারণ তার ওটা লাগে না! ওর পেটের মধ্যে দিয়ে পাঠাতে পারলে দশ পয়েন্ট! মাথার ভেতর দিয়ে গেলে পঞ্চাশ পয়েন্ট! বেশ, হাহা হা! কি চমৎকার একটা খেলা, আমি মনে করি না!
সে যাই হোক, কে তোমার দিকে বই ছুঁড়েছে? জিজ্ঞেস করল হ্যারি।
আমি জানি না…আমি ইউ–বাঁকটায় বসে ছিলাম, মৃত্যু সম্পর্কে ভাবছিলাম, এবং বইটা একেবারে আমার মাথার উপর দিয়ে পড়ল, বলল মার্টল, ওদের দিকে চোখ পাকিয়ে। ওই যে ওখানে রয়েছে ওটা, ভিজে গেছে।
হ্যারি আর রন সিঙ্কের নিচে তাকাল, যেদিকটায় মার্টল দেখাচ্ছিল। ওখানে একটা ছোট পাতলা বই পড়ে রয়েছে। ময়লা কালো মলাট এবং বাথরুমের আর সব কিছুর মতোই ভেজা। হ্যারি পা বাড়ালো ওটা তোলার জন্যে, কিন্তু রন হঠাৎ হাত বাড়িয়ে ওকে বাধা দিল।
কি? বলল হ্যারি।
তুমি কি পাগল? বলল বুন। এটা বিপদজনক হতে পারে।
বিপদজনক? বলল হ্যারি হেসে। সরো, ওটা বিপদজনক হবে কি ভাবে?
তুমি শুনলে অবাক হবে, বলল রন, বইটার দিকে শঙ্কা নিয়ে তাকাল। মন্ত্রণালয় যে সব বই বাজেয়াপ্ত করেছে–ড্যাড বলেছেন–তার মধ্যে একটা রয়েছে যেটা চোখ পুড়িয়ে ফেলে। এবং যারাই সনেটস অফ আ সসারার পড়েছে তারা বাকী জীবন লিমেরিকে কথা বলেছে। এবং বাথ-এ কোনো এক বুড়ি ডাইনীর একটা বই ছিল যেটা তুমি কখনই পড়া থামাতে পারবে না! ওটার মধ্যেই নাক খুঁজে তোমাকে ঘুরে বেড়াতে হবে, একহাতে সব কাজ করার চেষ্টা করতে হবে। এবং–
ঠিক আছে, আমি তোমার যুক্তি বুঝলাম, বলল হ্যারি।
ছোট বইটা মেঝেতে পড়ে রইল, অদ্ভূত এবং ভেজা।
বেশ, আমরা যদি ওটা না পড়ি তাহলে বুঝতে পারব না বইটা কিসের, বলল হ্যারি। এবং রনের পাশ ঘুরে ঝুঁকে বইটা তুলে নিল মেঝে থেকে।
হ্যারি দেখল ওটা একটা ডায়রি, এবং মলাটের প্রায় মুছে যাওয়া বছরটা ওকে জানাল যে ডায়রিটা পঞ্চাশ বছর পুরনো। সে আগ্রহের সাথে ওটার পাতা ওল্টালো। প্রথম পাতায়ই ও দেখল লেপটে যাওয়া কালিতে লেখা টি,এম, রিডল।
দাঁড়াও, বলল রন, যে সাবধানে এগিয়ে হ্যারির কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি মারছিল। আমি নামটা জানি…টি,এম,রিল পঞ্চাশ বছর আগে স্কুলকে বিশেষ সার্ভিস দেয়ার জন্যে পদক পেয়েছিলেন।
তুমি এত সব জানলে কিভাবে? বিস্মিত হ্যারি জিজ্ঞাসা করল।
জানলাম কারণ, শান্তির সময় ফিলচ ওরই পদকটা আমাকে পঞ্চাশবার পলিশ করিয়েছে, বিরক্ত হয়ে বলল বন। ওটার ওপরই আমি স্লাগ ফেলেছিলাম। তোমাকে যদি একটা নামের উপর থেকে এক ঘন্টা ধরে আঠাল পদার্থ ঘষে তুলতে হয় তবে তুমিও নামটি মনে রাখবে।
ভেজা পাতাগুলো ছাড়ালো হ্যারি। একেবারে ফাঁকা ওগুলো। একটার মধ্যে লেখার সামান্যতম চিহ্ন নেই, এমনকি আন্ট মেকে-এর জন্মদিন, বা ডাক্তার, সাড়ে তিনটায় ধরনের কোন লেখাও নেই।
কোন কিছুই লেখেননি দেখছি, হতাশ হ্যারি বলল।
আমি ভাবছি তাহলে এটাকে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করবে কেন কেউ? বলল রন কৌতূহলে।
হ্যারি ডায়রিটার পেছনের কাভার ওল্টালো এবং দেখল লন্ডনের ভক্সহল রোডের দোকানের নাম।
তিনি নিশ্চয়ই মাগল–জাত, চিন্তিত ভাবে বলল হ্যারি, ভক্সহল রোড থেকে না হলে ডায়রি কিনবে কেন….
তাহলে, এটা তোমার কোন কাজেই লাগছে না, নিচু স্বরে বলল রন। তবে, ওটা যদি মাৰ্টলের নাকের উপর দিয়ে ওটা পার করতে পারো তবে পঞ্চাশ পয়েন্ট পাবে।
হ্যারি, অবশ্য, ওটা পকেটেই পুরল।
***
ফেব্রুয়ারির শুরুতে হারমিওন হাসপাতাল ছাড়ল, গোঁফ, লেজ এবং পশম ছাড়া। গ্রিফিল্ডর টাওয়ারে ফিরে আসার পর প্রথম সন্ধ্যায়ই হ্যারি ওকে, টি.এম. রিল-এর ডায়রিটা দেখালো এবং ওটার পাওয়ার ঘটনাটা বলল।
উউউহ, এটার নিশ্চয়ই গোপন ক্ষমতা রয়েছে, বলল হারমিওন উৎসাহের সঙ্গে। ডায়রিটা নিয়ে নিবিষ্ট ভাবে দেখছে ও।
এটার যদি সে রকম কোন ক্ষমতা থাকে, তবে এটা ভাল করেই গোপন করে রেখেছে, বলল রন। হয়তো এটা লাজুক। আমি বুঝতে পারছি না তুমি ওটা ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছ না কেন, হ্যারি।
আমি যদি জানতে পারতাম কেউ একজন ওটা ছুঁড়ে ফেলে দেয়ারই বা চেষ্টা করেছিল কেন, বলল হ্যারি। রিডল হোগার্টস-এর জন্য বিশেষ কাজ করে পদক পেয়েছিলেন সেটা জানতেও আমার আপত্তি নেই।
যে কোন কারণেই হতে পারে, বলল রন। হয়তো তিনি তিরিশটি ও.ডব্লিউ, এল, পেয়েছিলেন অথবা দৈত্যাকার কোন স্কুইড়ের হাত থেকে কোন শিক্ষককে বাঁচিয়ে ছিলেন। হয়তো তিনিই মার্টলকে হত্যা করেছিলেন, এটা অবশ্য সকলেরই উপকার করা হলো…
কিন্তু হারমিওনের চেহারার স্থির ভাব দেখে হ্যারি বলে দিতে পারে, সে যা ভাবছে হারমিওনও তাই ভাবছে।
কি হলো? বলল রন একজনের চেহারা থেকে অন্যজনের দিকে তাকিয়ে।
আচ্ছা, চেম্বার অফ সিক্রেটস পঞ্চাশ বছর আগে খোলা হয়েছিল, ঠিক কি? সে বলল। এ কথাই তো ম্যালফয় বলেছে।
হ্যাঁ….রন বলল ধীরে ধীরে।
ডায়রিটার ওপর টোকা দিতে দিতে হারমিওন বলল,আর ডাইরীটাও পঞ্চাশ বছরের পুরনো।
তাতে কি? ওই, রন, জেগে ওঠো বোঝার চেষ্টা করো, চট করে বলল হারমিওন। আমরা জানি যারা চেম্বার খুলেছিল তাঁদেরকে পঞ্চাশ বছর আগে স্কুল থেকে বহিস্কার করা হয়েছিল। আমরা টি.এ.রিডল, স্কুলকে বিশেষ সার্ভিস দেয়ায় তাকে পদক দেয়া হয়েছিল, তাও পঞ্চাশ বছর আগে। আচ্ছা, রিডল যদি স্লিথারিনের বংশধরকে ধরার জন্যেই সেই বিশেষ পদকটা পেয়ে থাকে? তার ডায়রিটা আমাদেরকে সব কিছুই জানাবে: চেম্বারটা কোথায়, ওটা কি ভাবে খোলা যায়, এবং ওখানে কি ধরনের জীব বাস করে। এখনকার আক্রমণগুলি যে করছে সে নিশ্চয়ই চাইবে এই ডায়রিটা এখানে ওখানে পড়ে থাকুক, চাইবে?
ওটা একটা চমৎকার তত্ত্ব হারমিওন, বলল রন। শুধু একটিমাত্র ছোট্ট সমস্যা, ডায়রিটাতে কিছুই লেখা নেই।
কিন্তু হারমিওন তার ব্যাগ থেকে জাদুদণ্ডটা বের করছে।
হয়তো অদৃশ্য কালি দিয়ে লিখেছে! ফিসফিস করে বলল সে।
জাদুদণ্ড দিয়ে ডায়রিটাকে তিনটি টোকা দিল এবং বলল,অ্যাপেরেসিয়াম!
কিছুই হলো না। অদম্য হারমিওন, আবার তার ব্যাগে হাত ঢোকাল। এবার সে যা বের করে আনল সেটা উজ্জ্বল লাল ইরেজার।
এটা একটা প্রকাশি, ডায়গন অ্যালীতে পেয়েছিলাম, বলল সে।
জোরে ঘষল, জানুয়ারি এক তারিখ-এর ওপর। কিছুই হলো না।
আমি তো বলছি তোমাদের, এখানে পাওয়ার মতো কিছুই নেই, বলল রন। ক্রিস্টমাস উপলক্ষে রিডল একটা ডায়রি পেয়েছিল কিন্তু ওটাতে কিছু লেখার চেষ্টা করেনি।
হ্যারি নিজেও পরিষ্কার নয়, কেন সে রিডল-এর ডায়রি ছুঁড়ে ফেলে দেয়নি। ব্যাপার হচ্ছে সে জানে যে ওটা ফাঁকা তারপরও অন্যমনস্কভাবে সেটা হাতে নিয়ে পাতা ওল্টাতে, যেন একটা অসম্পূর্ণ গল্প সে শেষ করতে চাচ্ছে। এবং যদিও সে নিশ্চিত যে টি.এম. রিডল নামটা কখনো শোনেনি, তারপরও মনে হয় ওটার যেন কোনো মানে রয়েছে তার কাছে। যেন রিডল কোন এক বন্ধু ছিল যখন সে খুব ছোট এবং তার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। কিন্তু এটা অসম্ভব। হোগার্টস-এর পূর্বে তার কোন বন্ধু ছিল না, ডাডলি অন্তত এটা নিশ্চিত করেছে।
যাই হোক, রিডল সম্পর্কে আরো কিছু জানতে হ্যারি একেবারে উঠে পড়ে লাগল, পরদিন বিরতির সময় সে ট্রফি রুমের দিকে গেল রিডল-এর বিশেষ পদকটা পরীক্ষা করতে। সঙ্গে গেল আগ্রহী হারমিওন এবং সম্পূর্ণ ভিন্নমতাবলম্বী রন, যে তাদের বলেছে যে, ট্রফি রুমটা এত দেখেছে, সারা জীবন আর না দেখলেও চলবে।
রিডল-এর বার্ণিশ করা সোনার শীল্ডটা কোনার একটা ক্যাবিনেটে রাখা আছে। ওকে কেন ওটা দেয়া হয়েছিল, এ ব্যাপারে কোন বিশদ বিবরণ ওখানেই নেই ভালই হয়েছে, তা না হলে ওটা আরো বড় হতো এবং এখন পর্যন্তু ওটা আমার পলিশ করতে হতো, বলল রন। অবশ্য, তারা পেল একটা পুরনো মেডেলে, ম্যাজিক্যাল মেরিটের জন্য দেয়া হয়েছিল, এবং সাবেক হেড বয়দের তালিকায়।
মনে হচ্ছে সে পার্সির মতোই, বলল রন, বিরক্তিভরে নিজের নাক মুছে। প্রিফেক্ট, হেড–বয় সম্ভবত সব ক্লাসেরই শীর্ষে।
তুমি এমন ভাবে বলছ যেন ওটা কোন খারাপ কাজ, বলল হারমিওন, মনে আঘাত পেয়েছে সে।
***
হোগার্টস-এ সূর্য কিরণ আবার দূর্বল হতে শুরু করেছে। দূর্গ–প্রাসাদের ভেতরের মন আশাবাদী হয়ে উঠেছে। জাস্টিন এবং প্রায় মাথাবিহীন নিকের পর আর কোন আক্রমণ হয়নি, এবং মাদাম পমফ্রে সন্তুষ্ট চিত্তে রিপোর্ট করেছেন মেড্রেসগুলো খেয়ালী এবং রহস্যপূর্ণ হয়ে উঠছে, তার মানে হচ্ছে ওগুলোর দ্রুত শিশুকাল পার হয়ে আসছে।
যে মুহূর্তে ওদের ব্রনগুলো পরিস্কার হয়ে যাবে, তখন থেকেই ওগুলোকে আবার পটে লাগানো যাবে, হ্যারিকে বিকেলে শুনেছে, সহানুভূতির সাথে ফিলচকে বলতে। এরপর, আর খুব বেশি সময় লাগবে না কেটে ওগুলোকে জ্বাল দিয়ে রস বার করতে। মিসেস নরিসকে ফিরে পাবেন আপনি অল্প দিনের মধ্যেই।
বোধহয় স্লিথারিনের বংশধর সাহস হারিয়েছে, ভাবল হ্যারি। স্কুল এত সতর্ক এবং সন্দেহপ্রবণ যে চেম্বার অফ সিক্রেট খোলাটা ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। হয়তো রাক্ষস, বা যাই হোক ওটা এখন আরো পঞ্চাশ বছর লুকিয়ে থাকার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করছে…
আর্নি হাফলপাফ অবশ্য এই খুশির দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করলো না। সে এখনও বিশ্বাস করে যে, হ্যারিই আপরাধী, সে ভুয়েলিং ক্লাবে নিজেকে প্রকাশ করে ফেলেছে। পিভস অবশ্য সমস্যার সুরাহায় কোন সাহায্য করছে নাঃ জনাকীর্ণ করিডোরগুলোতে হঠাৎ হঠাৎ মাথা তুলে সে গেয়েই যেতে থাকল, ওহ পটার, তুমি বঁটার (পচা)… এর সঙ্গে ইদানীং যোগ হয়েছে একটা লাগসই নাচের মুদ্রা।
গিল্ডরয় লকহার্ট অবশ্য ভাবছেন তিনি একাই আক্রমণ বন্ধ করে দিয়েছেন। ট্রান্সফিগিউরেশনের জন্য যখন গ্রিফিল্ডররা লাইনে দাঁড়াচ্ছিল তখন এমনই একটা কিছু তাকে বলতে শুনেছে হ্যারি প্রফেসর ম্যাকগোনাগলের কাছে।
আমার মনে হয় না আর কোন সমস্যা হবে, মিনারভা, বললেন তিনি, সবজান্তার মতো নিজের নাকে টোকা দিতে দিতে চোখ টিপলেন তিনি। আমার মনে হয় এবার স্থায়ীভাবেই চেম্বারটা তালা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। অপরাধীগুলো নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে ওদেরকে ধরা আমার কাছে মাত্র সময়ের ব্যাপার ছিল। আমি ওদেরকে ধ্বংস করার আগে এখনই থেমে যাওয়া ভাল।
জানো তো, এখন স্কুলের যেটা দরকার সেটা হচ্ছে নৈতিক সাহস বৃদ্ধি। গত টার্মের সব স্মৃতি ধুয়ে মুছে সাফ করে ফেলা দরকার! এখন আর আমি কিছু বলছি না, কিন্তু মনে হয় আমি জনি সঠিক জিনিসটি…
নাকে টোকা দিতে দিতে চলে গেলেন তিনি।
ফেব্রুয়ারির চৌদ্দ তারিখ সকালে নাস্তার টেবিলে লকহার্টের নৈতিক সাহস বৃদ্ধির চেহারাটা পরিস্কার হলো। অনেক রাত পর্যন্ত কিডি প্র্যাকটিসের জনা হ্যারি খুব বেশি ঘুমাতে পারেনি, সকালে তাড়াহুড়া করে এসেও সে নাস্তার টেবিলে দেরী করে ফেলল। ঢুকে ভাবল সে ভুল দরজা দিয়ে ঢুকে পড়েছে।
বড় বড় ভয়ংকর গোলাপী ফুল দিয়ে দেয়ালগুলি সব ঢাকা। আরো খারাপ হচ্ছে হৃদয়াকৃতির মিঠাই পড়ছে বিবর্ণ নীল রঙের সিলিং থেকে। হ্যারি গ্রিফিল্ডর টেবিলে গেল, রন বসেছিল মনে হচ্ছে অসুস্থ, হারমিওন যেন একটু ফিক ফিক করেই হাসছে।
কি হচ্ছে? বসল হ্যারি। নিজের বেকনের ওপর থেকে মিঠাই তুলে নিয়ে বলল সে।
রন টিচারের টেবিলের দিকে দেখালো, দৃশ্যত এতই বিরক্ত যে কথা বলতে পারছে না। লকহার্ট, ভয়ংকর গোলাপী রঙের একটা পোশাক পরেছেন, হলের ডকোরেশনের সঙ্গে ম্যাচ করে, হাত নেড়ে সবাইকে চুপ করতে ইশারা করলেন। ওর দুপাশের শিক্ষকগণ পাথরের মতো মুখ করে বসে আছেন। যেখানে সে বসে আছে সেখান থেকে হ্যারি দেখতে পেল প্রফেসর ম্যাকগোনাগলের গালের একটি পেশি। স্নেইপকে দেখাচ্ছে এমন যে কেউ যেন এই মাত্র ওঁকে বড় এক গ্লাস স্কেলে-এগ্রো খাইয়েছে।
হ্যাপি ভেলেন্টাইনস ডে! চিৎকার করে উঠলেন লকহার্ট। এবং যে ছেচল্লিশ জন আমাকে শুভেচ্ছা কার্ড পাঠিয়েছেন তাদেরকেও আমার ধন্যবাদ। হ্যাঁ, আমি তোমাদের সবার জন্য এই ছোট্ট অপ্রত্যাশিত বিস্ময়ের আয়োজন করেছি এবং এখানেই এটা শেষ হচ্ছে না!
হাততালি দিলেন লকহার্ট, দরজা দিয়ে এনট্রেন্স হলে সার্চ করে ঢুকল এক ডজন বদমেজাজি বামন। যেমন তেমন বামন নয়, লকহার্ট তাদের সবাইকে সোনালি ডানা পরিয়েছেন এবং হাতে দিয়েছেন বীণা।
আমাদের মিত্র, কার্ড বহনকারী কিউপিড! হাসিতে উজ্জ্বল লকহার্ট। এরা আজ স্কুলে ঘুরে ঘুরে তোমাদের ভ্যালেন্টাইনস ডেলিভারি দেবে! এবং এখানেও মর্জা শেষ হচ্ছে না! প্রফেসর স্নেইপকে কেন জিজ্ঞাসা করা হবে না লাভ–পোশন বানানোর পদ্ধতি এবং তোমরা যখন এত ব্যস্ত, তখন, প্রফেসর ফ্লিটউইক আমার দেখা যে কোন জাদুকরের চেয়ে এনট্রানন্সিং এনচান্টমেন্ট সম্পর্কে বেশি জানে, বুড়ো চালকি কুকুর!
প্রফেসর ফ্লিটউইক দুহাতে মুখ ঢাকলেন। প্রফেসর মেইপকে দেখে মনে হচ্ছে প্রথম যে ব্যক্তি ওঁকে লাভ–পোশন চাইবে সে হবে জোর করে খাওয়ানো বিষ।
প্লিজ, হারমিওন, আমাকে বলো ওই ছেচল্লিশ জনের একজন তুমি নও, প্রথম ক্লাসের জন্য বেরিয়ে আসতেই রন জিজ্ঞাসা করল! হারমিওন তার রুটিনের জন্য হঠাৎ ব্যাগ খোঁজায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল এবং জবাব দিল না।
সারা দিন ধরেই, বামনগুলো ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে ভ্যালেন্টাইন বিলি করছে, শিক্ষকরা বিরক্ত, এবং সেদিন বিকেলে যখন তারা সিঁড়ি দিয়ে উঠছে, একজন তো হ্যারিকে পেয়ে বসল।
অয়, তুমি! অ্যারি পটার! চিৎকার করল বিশেষ করে ভয়ানক দেখতে একটা বামন, হ্যারির কাছে যাওয়ার জন্যে একে ওকে কনুই দিয়ে গুতিয়ে সরানোর চেষ্টা করছে।
এক দল প্রথম বর্ষীয়দের সামনে, যাদের মধ্যে জিনি উইসলিও রয়েছে, ভ্যালেন্টাইন পাওয়ার চিন্তায় হ্যারির মাথা গরম হয়ে গেল, পালাবার চেষ্টা করল ও। বামনটা অবশ্য ছাত্রদের পায়ে লাথি মেরে জায়গা করে নিয়ে ওর কাছে চলে এলো দুই কদম যাওয়ার আগেই।
আমার কাছে হ্যারি পটারের হাতে হাতে দেয়ার জন্যে একটা মিউজিক্যাল মেসেজ রয়েছে, বলল বামনটা, বীণার তারে টান দিল হুমকি দেয়ার ভঙ্গিতে।
এখানে না, হ্যারি বলল চাপা গলায়। পালাবার চেষ্টা করছে।
স্থির হয়ে দাঁড়াও! ঘোঁত করে উঠল বামন, হ্যারির ব্যাগ খামছে দরে ওকে পেছনে টানবার চেষ্টা করল।
আমাকে যেতে দাও! হ্যারি খিঁচিয়ে উঠল, ব্যাগ টানল।
জোরে একটা কিছু ছেঁড়ার শব্দ হলো, ওর ব্যাগটা ছিঁড়ে দুই ভাগ হয়ে গেলো। ওর বই, জাদুদণ্ড, পার্চমেন্ট এবং পালকের কলম সব মেঝেতে পড়ে একাকার, কালির দেয়াতটা সবগুলোর উপর পাড়ে ভেঙ্গে গেলো।
হ্যারি হামাগুড়ি দিয়ে সবকিছু গুছিয়ে তোলার চেষ্টা করছে, বামনটা গান শুরুর আগে। করিডোরে সবাইকে দাঁড়িয়ে পড়তে হলো যেন এই ঘটনাটা সবাইকে জিম্মি করেছে।
ওখানে কি হচ্ছে? ড্র্যাকো ম্যালফয়ের শীতল কণ্ঠে টেনে টেনে বলা কথাগুলো ভেসে এলো। অতি ব্যাকুলভাবে হ্যারি সব গোছাতে চেষ্টা করছে ওর ছেঁড়া ব্যাগে, ম্যালফয় ওর মিউজিক্যাল ভ্যালেন্টাইন শোনার আগেই পালানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে সে।
এখানে এত ঝামেলা কিসের? আরেকটি পরিচিত স্বর বলল, পার্সি উইসলিও এসে হাজির।
দিশেহারা হয়ে হ্যারি দৌড়ই দিতে চেয়েছিল, কিন্তু বামনটা ওর হাটু জড়িয়ে ধরে সজোরে মেঝেতে পেড়ে ফেলল।
ঠিক আছে, বলল সে হ্যারির গোড়ালীর উপর বসে, এখন শোন তোমার গানের ভ্যালেন্টাইন।
ওর চোখ জোড়া সদ্য জাগরিত কোলাব্যাঙের মতো সবুজ,
ওর চুল ব্ল্যাকবোর্ডের মতো কালো।
আমি আশা করি ও যদি আমার হতো, সে সত্যিই স্বর্গীয়,
বীর, যে অন্ধকারের প্রভুকে
জয় করেছে।
এখানে বাস্প হয়ে হয়ে গায়েব হয়ে যাওয়ার জন্য হ্যারি উপায়ন্তর না দেখে, গ্রিংগটের তার সব সোনা দিয়ে দিতে পারে।
সাহসের সাথে অন্যদের মতোই হাসবার চেষ্টা করতে করতে হ্যারি উঠে দাঁড়ালো। বামনের ওজনে ওর পা দুটো অবশ হয়ে পড়েছে। পার্সি উইসলি সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করছে, ভীড় ভেঙ্গে দিতে, কেউ কেউ চিৎকার করছে উল্লাসে।
যাও যাও, সব যাও, পাঁচ মিনিট আগে ঘন্টা পড়ে গেছে, এখন সব ক্লাসে যাও, সবাইকে ক্লাসে পাঠাবার চেষ্টা করছে পার্সি, কয়েকটি প্রথম বর্ষীয়কে তাড়া করে পাঠিয়ে দিল। এবং তুমি, ম্যালফয়।
হ্যারি ওই দিকে তাকিয়ে দেখল, ঝুঁকে কিছু একটা তুলে নিচ্ছে ম্যালফয়। চতুর একটা কটাক্ষ করে সে ওটা বে আর গয়লকে দেখাল। এবং হ্যারি দেখল ও রিডলস-এর ডায়রিটা পেয়েছে।
ওটা ফেরত দাও, শান্ত স্বরে বলল হ্যারি।
ভাবছি এটাতে পটার কি লিখেছে? বলল ম্যালফয়, কিন্তু মলাটের বছর লেখাটা ও খেয়াল করেনি, এবং ভাবল ওর হাতে হ্যারির নিজের ডায়রি। দর্শকদের মধ্যে নিরবতা নেমে এলো। জিনি বারবার ডায়রি থেকে চোখ সরিয়ে হ্যারির দিকে তাকাচ্ছে, ভয় পেয়েছে সে।
ওটা ফিরিয়ে দাও, কঠোরভাবে বলল পার্সি।
আমার দেখা শেষ হওয়ার পর, বলল ম্যালফয়, ঠাট্টার ছলে ডায়রিটা হ্যারির দিকে নাড়ছে।
পার্সি বলল, স্কুল প্রিফেক্ট হিসেবে। কিন্তু হ্যারি ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে। সে তার জাদুদণ্ড বের করে ম্যালফয়ের দিকে তাক করে চিৎক্কার করল, এক্সপেলিয়ারমাস? এবং যেখাবে স্নোইপ লকহার্টকে অস্ত্রচুত করেছিলেন, তেমনি ম্যালফয় দেখল ডায়রিটা তার হাত থেকে বেরিয়ে গেল। একটা চওড়া হাসি দিয়ে ওটা ধরে ফেলল রন।
হ্যারি! বলল পার্সি জোরে, করিডোরে ম্যাজিক নিষিদ্ধ। আমাকে এটা রিপোর্ট করতে হবে, তুমি জান?
হ্যারি পরোয়া করে না, ম্যালফয়ের ওপর এক দফা বিজয় হয়েছে, এবং সেটা গ্রিফিল্ডরের জন্য একদিনে পাঁচ পয়েন্ট অর্জনের সমান। ক্ষিপ্ত দেখাচ্ছিল ম্যালফয়াকে এবং জিনি যখন ওকে পেরিয়ে ক্লাসে যাচ্ছিল, আক্রোশে সে চিৎকার করল, তোমার ভ্যালেন্টাইনটা পটার খুব পছন্দ করেছে।
হাতে মুখ ঢেকে জিনি দৌড়ে ক্লাসে ঢুকে গেল। ক্ষেপে গিয়ে রনও তার জাদুদণ্ড বের করতে গিয়েছিল, হ্যারি ওকে টিনে সরিয়ে দিল। রনের আর শ্লাগ উগরে দিন কাটানোর প্রয়োজন নেই।
প্রফেসর ফ্রিটউইকের ক্লাসে না পৌঁছানো পর্যন্ত হাৰি বুঝতেই পারেনি যে বিড়ালের ডায়রিতে অস্বাভাবিক কিছু রয়েছে। তার অন্য সব বই টকটকে কালিতে লেপটে গেছে। কিন্তু ডায়রিটা, ওটার উপর কালির বোতল ভেঙ্গে পড়বার আগের মতোই একেবারে পরিষ্কার, একটুও কালির ফোঁটার চিহ্ন নেই। রনকে বলার চেষ্টা করল ব্যাপারটা, কিন্তু রনের জাদুদণ্ডটা আবার ঝামেলা করছে; ওটার মাথা দিয়ে বেগুনী–লাল রঙের বুদ্বুদ বেরোচ্ছে, এবং অন্য কিছুতে এখন আর উৎসাহ নেই তার।
***
সে রাতে অন্য সকলের চেয়ে আগে শুতে গেল হ্যারি। এর কারণ অংশত হচ্ছে সে ফ্রেড আর জর্জের মুখে ওই গানটা তার চোখ…ব্যাঙের মতো সবুজ আরেকবার শুনতে চায় না, এবং অংশত সে রিডললের ডায়রিটা আবার পরীক্ষা করে দেখতে চায়, এবং জানে যে রন বলবে, সে তার সময় শুধু শুধু নষ্ট করছে।
হ্যারি তার বিছানায় বসে ডায়রিটা দেখছে পাতা উল্টিয়ে, একটি পাতায়ও লাল কালি ও একটুও দাগ নেই। তারপর সে নতুন একটা দেয়াত বের করল, পাখার কলমটা নিয়ে ডায়রির প্রথম পাতায় একটা ফোঁটা ফেলল।
কালিটা এক সেকেন্ডর জন্যে উজ্জ্বলভাবে জ্বলজ্বল করলো ডায়রির পাতায় এবং তারপর, যেন পাতার ভেতর শুষে নেয়া হয়েছে, অদৃশ্য হয়ে গেলো। উত্তেজিত, স্যরি আবার কলমটা দেয়াতে ডোবালো, লিখল ডায়রির পাতায়, আমার নাম হ্যারি পটার।
শব্দগুলো মুহূর্তের জন্য বইয়ের পাতায় জ্বলজ্বল করলো, তারপর অদৃশ্য হয়ে গেলো। এরপর, এরপর, অবশেষে একটা ব্যাপার ঘটলো।
হ্যালো, হ্যারি পটার। আমার নাম টম রিডল। তুমি আমার ডায়রি পেলে কিভাবে?
এই শব্দ গুলোও অদৃশ্য হয়ে যেতে শুরু করল, কিন্তু হ্যারি আবার লেখা শুরু করার আগে নয়।
কেউ একজন এটা টয়লেটে ফ্লাশ করতে চেয়েছিল।
সে আগ্রহের সঙ্গে রিডলস-এর জবাবের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
ভাগ্য ভাল যে কালির চেয়ে স্থায়ী উপায়ে আমি ডায়রিটা লিখেছিলাম। কিন্তু আমি এও জানতাম যে এমন লোকও রয়েছে যারা চায় না আমার ডায়রি পড়া হোক।
কি বলতে চাচ্ছ? হ্যারি লিখল, উত্তেজনায় ব্লটিং পেপার দিয়ে নিজেই লেখাগুলি ব্লট করল।
আমি বলতে চাইছি এই ডায়রিতে ভয়াবহ দিনগুলির স্মৃতি রয়েছে। সেই সমস্ত বিষয় যেগুলো ধামা চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। সেই সব ঘটনা, যেগুলো হোগার্টর্স স্কুল অফ উইচক্র্যাফট অ্যান্ড উইজারডিতে ঘটেছিল?
সেখানেই আমি এখন রয়েছি, দ্রুত লিখল হ্যারি। আমি এখন হোগার্টস এ, এবং ভয়ঙ্কর সব ঘটনা ঘটছে। তুমি কি চেম্বার অফ সিক্রেটস সম্পর্কে কিছু জান?
হ্যারির হৃৎপিন্ডে হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে। রিডলস-এর জবাব এলো দ্রুত, ওর হাতের লেখা খারাপ হতে শুরু করেছে, যেন তাকে তাড়াতাড়ি এসব বলে ফেলতে হবে।
নিশ্চয়ই আমি চেম্বার অফ সিক্রেটস সম্পর্কে জানি। আমাদের সময় বলা হতো ওটা একটা জনশ্রুতি, ওটার কোন অস্তিত্ব নেই। কিন্তু ওই কথা মিথ্যা ছিল। আমার ফিফখ ইয়ারের সময়, চেম্বারটা খোলা হয়েছিল এবং রাক্ষসটা বেরিয়ে এসেছিল, কয়েকজন ছাত্রকে আক্রমণ করেছিল, অবশেষে একজনকে হত্যাও করেছিল। যে লোকটি চেম্বার খুলেছিল আমি তাকে ধরে ফেলেছিলাম এবং তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। কিন্তু হেডমাস্টার, প্রফেসর ডিপেট, হোগার্স-এ ঘটায় পৃজ্জিত হয়ে আমাকে সত্য বলতে বারণ করেছিলেন। একটা গল্প চালু করে দেয়া হয়েছিল যে মেয়েটি উদ্ভট এক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। আমাকে ওরা একটি ছোট্ট চকচকে পদকও দিয়েছিল আমার কষ্ট্রের স্বীকৃতি স্বরুপ এবং মুখ বন্ধ করে রাখার জন্যও সতর্ক করে দেয়া হয়। কিন্তু আমি জানতাম এটা আবার ঘটতে পারে। রাক্ষসটা বেঁচে রয়েছে এবং যে ব্যক্তির ক্ষমতা রয়েছে ওটাকে ছেড়ে দেয়ার তা জেলে আটক করে রাখা হয়নি।
তাড়াহুড়া করতে গিয়ে হ্যারি তার কালির বোতলটা প্রায় ফেলে দিয়েছিল।
আবার ওই ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। তিনটা আক্রমণ হয়েছে এবং কেউ মনে হয় কিছু জানে না এর পেছনে কে রয়েছে। সেবার কে ছিল?
আমি তোমাকে দেখাতে পারি, যদি তুমি চাও, রিডললির জবাব পাওয়া গেল। আমার কথায় বিশ্বাস করবার দরকার নেই। আমি তোমাকে ঘটনার রাতে, যে ঘটনায় অমি তাকে ধরেছিলাম, সেই রাতের স্মৃতির ভেতর নিয়ে যেতে পারি।
হ্যারি ইতস্তত করল, ওর কলমটা ডায়রির উপর রাখা। রিডল কি বোঝাতে চাচ্ছে? তাকে কি ভাবে আরেকজনের স্মৃতির ভেতর নেয়া সম্ভব? নার্ভাস হ্যারি ডর্মিটরির দরজাটার দিকে তাকাল, অন্ধকার। আবার যখন ডায়রিটার দিকে তাকাল হ্যারি, দেখল নতুন শব্দ লেখা হচ্ছে।
চলো, তোমাকে দেখাই।
মুহূর্তের ভগ্নাংশের জন্য থামল হ্যারি, তারপর ডায়রিতে দুটো শব্দ লিখল।
ঠিক আছে।
ডায়রির পাতাগুলি উড়ছে, যেন পাগলা বাতাসে পেয়েছে, জুন মাসের মাঝামাঝি একটা পাতায় গিয়ে থামল হ্যারির মুখ হা হয়ে গেছে, দেখল সে জুনের তেরো তারিখ যে চৌকো ঘরে লেখা রয়েছে, সেটা একটা টিভি পর্দা হয়ে গেছে। ওর হাত কাঁপছে আস্তে আস্তে, ও ডায়রিটা চোখের কাছে তুলে ধরল, এবং কি হচ্ছে বোঝার আগেই, সে সামনের দিকে কাত হতে শুরু করল। জানালাটা বড় হচ্ছে, সে টের পেলো তার শরীরটা বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে এবং মাথা আগে পাতার খোলা যায়গাটা দিয়ে, রঙ এং ছায়ার ঘূর্ণির মধ্যে।
সে টের পেল শক্ত মাটিতে পড়েছে তার পা, এবং দাঁড়াল, কাপল, চারদিকের আবছা মূর্তিগুলি হঠাৎ চোখের সামনে চলে এলী।
সঙ্গে সঙ্গে এও বুঝতে পারল কোথায় আছে সে। ঘুমন্ত ছবির এই বৃত্তাকার রুমটা হচ্ছে ডাম্বলডোরের অফিস–কিন্তু ডেস্কের পেছনে যিনি বসে আছেন তিনি ডাম্বলডোর নন। বয়স্ক এবং দূর্বল দেখতে একজন জাদুকর, কয়েক গাছি সাদা চুল ছাড়া পুরো মাথা জুড়ে টাক, মোমের আলোয় একটা চিঠি পড়ছেন।
আমি দুঃখিত, কম্পিত স্বরে বলল হ্যারি, অনাহুত আমি মাঝখানে ঢুকে পড়তে চাইনি…
কিন্তু তাকালেন না লোকটি। পড়ে যেতে লাগলেন, সামান্য কোচকানো। ডেস্কের কাছে চলে এলো হ্যারি, এবং তোতলাচ্ছে সে, মানে আমি চলে যা–যা–যাব?
তারপরও লোকটি তাকে উপেক্ষা করলেন। মনে হয় ওর কথা শুনতে পাচ্ছেন না। কালা হতে পারে ভেবে, হ্যারি গলার স্বর চড়ালো।
দুঃখিত, আপনাকে ডিস্টার্ব করার জন্যে, আমি এখন চলে যাবো, প্রায় চিৎকার করল ও।
জাদুকর একটা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে চিঠিটা ভাঁজ করলেন, উঠে দাঁড়ালেন, হ্যারিকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন, ওর দিকে তাকালেন না পর্যন্ত এবং গেলেন জানালার পর্দাগুলো সরিয়ে দেয়ার জন্যে।
জানালার বাইরে আকাশটা চুণীর মতো লাল; মনে হচ্ছে সূর্য ডুবছে। জাদুকর আবার টেবিলে ফিরে গেলেন, বসলেন বুড়ো আঙুল মোচড়ালেন, খেয়ালটা দরজার দিকে।
হ্যারি অফিস ঘরটার চারদিক দেখছে। ফোক্স নামক ফিনিক্স পাখিটা নেই; শব্দ করা রূপার কল নেই। এটা রিডল-এর দেখা হোগার্টস, তার মানে হচ্ছে এই অপরিচিত জাদুকর হচ্ছে হেডমাস্টার, এবং ডাম্বলডোর নন, এবং সে, হ্যারি, হলো প্রায় অলীক এক মূর্তি, পঞ্চাশ বছরের আগের মানুষের কাছে সম্পূর্ণ অদৃশ্য।
অফিসের দরজায় টোকা পড়লো।
এসো, বললেন হেডমাস্টার ক্ষীণ কণ্ঠে।
ষোল বছরের এক কিশোর ঢুকল, ওর সূচালো হ্যাট হাতে। ওর বুকে প্রিফেক্টের রূপালি ব্যাজটা চকচক করছে। হ্যারির চেয়ে অনেক লম্বা, কিন্তু ওরও কালো চুল।
আস রিডল, বললেন হেডমাস্টার।
আপনি আমাকে দেখা করতে বলেছেন প্রফেসর ডিপেট? বলল রিডল। ওকে নার্ভাস দেখাচ্ছে।
বসো, বললেন ডিপেট। তোমার পাঠানো চিঠিটা আমি এই মাত্র পড়া শেষ করলাম।
ওহ, বলল রিডল। হাত দুটো মুঠো করে শক্ত হয়ে বসল।
মাই ডিয়ার বয়, নরমভাবে বললেন ডিপেট, আমি সম্ভবত তোমাকে গ্রীষ্মের ছুটিতে স্কুলে থাকতে দিতে পারি না, নিশ্চয়ই তুমি ছুটিতে বাড়ি যেতে চাও?
না, সঙ্গে সঙ্গে বলল রিডল, আমি বরং হোগার্টস-এই থেকে যাবো তবুও ওই–ফিরে যাওয়ার চেয়ে
আমার মনে হয়, ছুটির সময় তুমি একটা মাগল এতিমখানায় থাকো? বললেন ডিপেট কৌতূহলী হয়ে।
জি, স্যার, বলল ডিপেট, লাল হয়ে গেছে সে অল্প।
তুমি মাগল–জাত?
মিশেল, স্যার, বলল সে। বাবা মাগল, মা ডাইনী।
এবং তোমার পিতা–মাতা দুজন?
আমার জন্মের ঠিক পরেই মা মারা যান, স্যার। এতিমখানায় ওরা আমাকে রেখেছে, আমার নামকরণ করতে যতটা সময় লেগেছে ঠিক ততক্ষণই তিনি বেঁচে ছিলেন। আমার নাম রেখে গেছেন তিনি–টম আমার বাবার নামে, মারভোলো আমার দাদির নামে।
সহানুভুতি জানিয়ে জিধ দিয়ে স্বাদ করলেন ডিপেট।
বিষয়টা হচ্ছে, টম, দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি, তোমার জন্যে হয়তো বিশেষ ব্যবস্থা করা যেতো, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে…
আপনি আক্রমণগুলির কথা বলছেন, স্যার? বলল রিডল, এবং হ্যারি আরো এগিয়ে গেলো, পাছে কোন শব্দ মিস হয়।
ঠিক ধরেছ, বললেন হেডমাস্টার। মাই ডিয়ার বয়, তুমি ভেবে দেখো টার্ম শেষ হলে তোমাকে এখানে থাকতে দেয়া কত বড় বোকামী হবে। বিশেষ করে এই সময়ের ট্র্যাজিক ঘটনাবলীর আলোকে…ওই মেয়েটার মৃত্যু…তুমি তোমার এতিমখানায় অনেক বেশি নিরাপদে থাকবে। বস্তুত, ম্যাজিক মন্ত্রণালায়ও এখন স্কুল বন্ধ রাখারই কথা ভাবছে। আর আমরা আক্রমণকারীর হদিশ বের করার মানে এই সব আক্রমণের উৎস কোথায়…
রিডললের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো।
স্যার–ওই লোকটিকে যদি ধরা যায়…যদি সব অঘটন থেমে যায়…
তুমি কি বলতে চাচ্ছো? বললেন ডিপেট, স্বরে তীক্ষ্ণতা এনে, চেয়ারে খাড়া হয়ে বসলেন। রিডল, তুমি কি বলতে চাচ্ছো যে এই সব আক্রমণ। সম্পর্কে কিছু জান?
না, স্যার, তাড়াতাড়ি জবাব দিল রিডল।
তবে, হ্যারি নিশ্চিত যে, সে ডাম্বলডোরকে যেমন না বলেছিল, এটাও সেই ধরনের না।
ডিপেট আবার হেলান দিলেন চেয়ারে, সামান্য হতাশ হয়েছেন তিনি।
তুমি যেতে পারো, টম…
রিডল ওর চেয়ার থেকে নেমে রূম থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল, ওকে অনুসরণ করল সারি।
চলন্ত গোলাকার সিঁড়ি দিয়ে ওরা নামল, অন্ধকার করিডোরে ছাদের পানি বাইরে পড়বার পাইপটার পাশে। রিড় থামল, হ্যারিও থামল, ওকে লক্ষ্য করছে হ্যারি। হ্যারি বুঝতে পারছে ও সিরিয়াসলি কিছু ভাবছে। ঠোঁট কামড়ে ধরেছে। কপালে বলিরেখা।
এরপর, যেন হঠাৎ করেই সে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছে, সে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল, হ্যারি শব্দহীনভাবে চলেছে ওর পেছনে। এন্ট্রান্স হলে না পৌঁছানো পর্যন্ত তারা আর কাউকে দেখতে পেলো না। পিঙ্গল বর্ণের চুল এবং দাড়ি মন্ডিত লম্বা একজন জাদুকর রিডলকে ডাকলেন মার্বেল পাথরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে।
এতো রাতে কি করছ, ঘুরে বেড়াচ্ছো কেন টম?
জাদুকরকে দেখে হ্যারির মুখ হা হয়ে গেল। তিনি আর কেউ নন পঞ্চাশ বছরের আগের ডাম্বলডোর।
হেডমাস্টার আমাকে ডেকেছিলেন স্যার, বলল রিডল।
বেশ, জ্বলদি গিয়ে শুয়ে পড়ো, বললেন ডাম্বলডোর, হ্যারির দিকে সেই একই অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকিয়ে যার সঙ্গে হ্যারি খুব ভালভাবে পরিচিত। এখন করিডোরে ঘুরে না বেড়ানোই সবচেয়ে ভাল,। বিশেষ করে যেহেতু…
গভীরভাবে শ্বাস ছাড়লেন তিনি, রিডলকে বিদায় জানিয়ে হেঁটে চলে গেলেন। ওঁকে দৃষ্টির বাইরে চলে যেতে দেখল রিডল এবং তারপর, দ্রুত সোজা পাতালের কারাকক্ষগুলোর দিকে রওয়ানা দিল, পেছনে অনুসরণ করছে হ্যারি।
কিন্তু হ্যারি হতাশ হলো, রিডল ওকে কোন লুকোনো পথ বা গোপন সুড়ঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে না, ওকে নিয়ে গেল ওই সেই প্রকোষ্ঠে যেখানে স্নেইপের সঙ্গে হ্যারির পোশন ক্লাস হয়। টর্চগুলো জ্বালানো হয়নি, এবং রিডল যখন দরজাটা প্রায় বন্ধ করে দিল ঠেলে, হ্যারি তখন শুধু মাত্র রিডলকেই দেখতে পেলে, দরজার পাশে কাঠের মতো স্থির হয়ে আছে, বাইরের পথটার দিকে লক্ষ্য রাখছে।
হ্যারির মনে হলো ওরা ওখানে প্রায় একঘন্টা ধরে রয়েছে। ও শুধু দেখতে পাচ্ছে দরজায় রিডললের অবয়বটা, ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে, মূর্তির মতো অপেক্ষা করছে। এবং যখন হ্যারি আশা ছাড়ল, চাপা উত্তেজনাও কমে গেলো, এবং বর্তমানে ফিরে আসার ইচ্ছা জাগতে শুরু করল, ও শুনতে পেলো দরজার ওপারে কিছু একটা নড়ছে।
কেউ একজন পা টিপে টিপে আসছে। সে শুনল, যেই হোক ও আৰু রিডল যেখানে লুকিয়ে রয়েছে সেই দরজাটা পেরিয়ে গেল। রিডল ছায়ার মতো নিঃশব্দ, দরজা দিয়ে চুপিসারে বের হলো এবং অনুসরণ করতে লাগল। হ্যারিও অনুসরণ করছে পা টিপে টিপে, ও ভুলে গেছে ওর শব্দ কেউই শুনতে পাবে না।
সম্ভবত পাঁচ মিনিট ওরা পায়ের শব্দ অনুসরণ করল, যে পর্যন্ত না রিডল হঠাৎ থেমে দাঁড়ালো, ওর মাথাটা নতুন শব্দের উৎসের দিকে কাত করা। হ্যারি শুনল কাঁচ ক্যাচ করে একটা দরজা খোলার শব্দ হলো, তারপর কেউ একজন ভাঙ্গা গলায় ফিস ফিস করছে।
এসো…এখান থেকে বার করতে হবে তোমাকে…এসো…বাক্সের ভেতরে এসো…
গলার স্বরটা পরিচিত পরিচিত ঠেকল হ্যারির কাছে।
হঠাৎ রিডল কোনা থেকে লাফিয়ে উঠল। হ্যারি গেল পেছন পেছন। ও দেখতে পেলো বিশালদেহী একটা ছেলের কাঠামো একটা খোলা দরজার সামনে উবু হয়ে আছে, পাশে একটা বিরাট বাক্স।
ইভিনিং, রুবিয়াস, বলল রিডল তীক্ষ্ণ কণ্ঠে।
ছেলেটি দড়াম করে দরজা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো।
তুমি এখানে নিচে কি করছ, টম?
রিডল আরো কাছে গেলো।
খেল খতম, বলল সে। তোমাকে আমার ধরিয়ে দিতে হবে, রুবিয়াস। ওরা বলছে হোগার্টস বন্ধ করে দেয়া হবে যদি হামলাগুলো বন্ধ না হয়।
তুমি কি
আমি মনে করি না তুমি কাউকে হত্যা করতে চেয়েছ। কিন্তু দানব কখনো ভালো পোষ মানে না। আমি মনে করি তুমি হয়তো এটাকে শুধু হাত–পা নেড়ে চেড়ে বেড়াবার জন্যে ছেড়েছে এবং
এটা কখনো কাউকে হত্যা করেনি! বলল বিশালদেহী ছেলেটি, বন্ধ দরজাটাকে আড়াল করে ওর পেছন থেকে একটা অদ্ভুত ধরনের নড়াচড়া আর ক্লিকিং শব্দ শুনতে পেলো হ্যারি।
বুঝতে পারছ রুবিয়াস, বলল রিডল, আরো কাছে চলে গেলো সে। আগামীকাল মৃত মেয়েটির বাবা-মা এখানে আসছেন। কম সে কম হোগার্টন্স তো এটা করতে পারে যে, যে দানবটা ওদের মেয়েকে হত্যা করেছে সেটার হত্যা নিশ্চিত করা।
ও, করেনি! গর্জন করে উঠল ছেলেটি, অন্ধকার করিডোরে ওর প্রতিধ্বনি শোনা গেল সে কখনো করবে না! সে না!
সরে দাঁড়াও, বলল রিডল, ওর জাদুদণ্ড বের করল।
হঠাৎ ওর মন্ত্র করিডোরটাকে জ্বলন্ত বাতিতে আলোকিত করল। বিশালদেহী ছেলেটির পেছনের দরজাটা এত জোরে খুলে গেলো যে ও উল্টো দিকে দেয়ালে গিয়ে আছড়ে পড়লো। এবং ওর ভেতর থেকে বের হয়ে এলো এমন একটা জন্তু, যা দেখে হ্যারি একটা দীর্ঘ তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে করে উঠল, যেটা অবশ্য সে ছাড়া আর কেউই শুনতে পেলো না।
একটা বিশাল, সামনের দিকে ঝুঁকে আছে এমন, রোম সর্বস্থ দেহ, এবং কালো পায়ের একটা জুট, অনেক চোখের দ্যুতি এবং এক জোড়া তীক্ষ্ণ ব্লেডের মতো ধারালো সাড়াশি–রিড় তার জাদুও আবার তুলল, কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। জিনিসটা ওর উপর দিয়ে গড়িয়ে দ্রুতবেগে চলে গেলো, করিডোরটা ভেদ করে এবং দৃষ্টির বাইরে। রিডল উঠে দাঁড়ালো, ওটার পেছনে তাকিয়ে রয়েছে; ওর জাদুদণ্ড আবার তুলল, কিন্তু বিশালদেহের ছেলেটা লাফ দিয়ে ওর উপর পড়ল, দণ্ডটা ওর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ওকে ফেলে দিল, চিৎকার করে উঠল, নোওওওওওওও!
দৃশ্যটা আবার ঘুরল, অন্ধকার সম্পূর্ণ হলো, হ্যারির মনে হচ্ছে ও উপর থেকে পড়ছে, এবং ধপ করে সে পড়ল, ঈগলের মতো হাত–পা ছড়িয়ে ওর বিছানায় গ্রিফিন্ডর হোস্টেলে। ওর পেটের উপর রিডললির ডায়রিটা খোলা পড়ে রয়েছে।
দম ফিরে পাওয়ার আগেই দরজাটা খুলে গেল এবং ভেতরে একা রন।
এই যে তুমি, বলল সে।
হ্যারি উঠে বসল, ও ঘামছে আর কাঁপছে।
কি হয়েছে? জিজ্ঞাসা করল রন, ভয় পেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে।
হ্যাগ্রিড, রন। পঞ্চাশ বছর আগে স্থহ্যাগ্রিড খুলেছিল চেম্বার অফ সিক্রেটস।