বিহারী পর্ব

১২. ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার

“ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার”

ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েই সোজা বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। বাড়ি বলতে তখন চট্টগ্রমের সেই টি ৩৭/বি রেলওয়ের কলোনিকেই বুঝতাম। সেখানেই পাড়ার বন্ধুবান্ধবদের সাথে বেশ গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াতে লাগলাম, কিন্তু মনের গভীরে একটা ধুকপুক চলছিল— হবে তো পাশ? ধুকপুকটা ছিল বিশেষ করে স্ট্রাকচার সাবজেক্ট নিয়ে। আবার ভরসাও ছিল স্যারের ওপর, সাধারণত অঙ্কের উত্তর নিয়ে তিনি কখনো মাথা ঘামাতেন না-ড. হাসনাত। তিনি ছিলেন তখনকার সময়ের দেশের বড় বড় সব ব্রিজের ডিজাইনার। তিনি দেখতেন ছাত্রের অঙ্কের পদ্ধতি ঠিক মত হয়েছে কিনা।

হাসনাত স্যারের একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল এই সূত্রে। পাশ করে বেরুবার বেশ কিছুদিন পর বুয়েটে গেছি কোনো একটি কাজে, স্যারের সাথে দেখা। তাঁর সেই আমেরিকা থেকে নিয়ে আসা বিশাল প্লাইমাউথ গাড়িটা নিয়ে এসে নামলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ভবনের সামনে।

সালাম দিতে হেসে উত্তর দিয়ে বললেন-

“সাইড বিজনেস তো ভালই চলছে হে, অ্যাঁ?’

তখন প্রায় প্রতিদিন আমাকে বিটিভিতে দেখা যেত, সেই জন্যেই বলা।

স্যার আসলে ছিলেন মাটির মানুষ। সেইরকম লম্বা শরীর। গঠনটা সুন্দর টানটান। শ্যামলা বর্ণের চেহারাটায় সব সময়ই একটা হাসি লেগে থাকতো দেখতাম। মায়াময় হাসি।’ একবার মিডটার্ম স্ট্রাকচার পরীক্ষার খাতা দিতে স্যার খুব দেরি করছিলেন। অন্য সব সাবজেক্টের নম্বর আমরা পেয়ে গেছি অথচ স্যারের নম্বরের খবর নেই। কেউ একজন ক্লাসে স্যারকে বলে—

‘স্যার, আমাদের খাতা কবে দেবেন, অন্যগুলো তো সব পেয়ে গেছি।’

‘দাঁড়াও হে, এখন মন-মেজাজ ভাল নেই। এখন খাতা দেখলে তো ফেল করে যাবে সবাই।’

এমনি ছিলেন হাসনাত স্যার।

তো আমার এই স্ট্রাকচারের উপরই ভয়টা ছিল-যে রেফার্ড না হয়ে যায়।

তবে কারো সাথে পরীক্ষার ফল নিয়ে আলাপ করতে চাইতাম না। আব্বা বোধহয় একদিন জানতে চাইলেন—

‘কবে তোমার রেজাল্ট হবে?’

‘জানি না ঠিক, যখন হবার তখন হবে, তাড়া কিসের?’

হেসেছিলেন শুধু আব্বা। তাঁর ট্রেডমার্ক হাসি।

হাসলেও তাঁর মনের মধ্যেও একটা তাড়া ছিল, কারণ তাঁর অবসর অত্যন্ত নিকটে তখন, ক’দিন পরই যাবেন অবসরকালীন ছুটিতে।

বাসায় তখন পত্রিকা একটা রাখা হতো, ইংরেজি। পাকিস্তান অবজাভার, কখনো শুক্রবারে চিত্রালী, আব্বার নির্দেশেই, ইংরেজি শেখার জন্যে। যদিও আমি আজও সেই আগের মতই ইংরেজিতে কাঁচা। তাই বলে বাংলাতে যে পাকা তাও মোটেও না। সে দাবী করার ক্ষমতা নেই আমার। তবে হ্যাঁ বাংলা ভাষা বা সাহিত্য যতটুকু যা শিখেছি তার কৃতিত্ব থিয়েটারের। আসলে থিয়েটার একটা শিক্ষালয়।

ছোটবোন মমতাজ এক দুপুরে ঠিক খাবার সময় অবজারভার পত্রিকাটা হাতে নিয়ে এসে উত্তেজিত ভঙ্গিতে জানালো-

“ভাই, তোমার রেজাল্ট বেরিয়েছে।’

ঢাকা থেকে পত্রিকা যেতে যেতে দুপুর হয়ে যেত তখন।

‘কথাটা শুনেই বুকের ভেতরটা ধুক করে উঠলো। গলায় খাবার আটকায় প্রায়।

‘কই দেখি।’

তখন ঘামছি আমি। চোখ প্রথমেই চলে গেল রেফার্ড লিস্টের দিকে, নেই, সেখানে আমার রোল নম্বর নেই। ততক্ষণে চোখ চলে গেছে দ্বিতীয় বিভাগের তালিকায়।

ওহ! আছে, আছে!

ততক্ষণে আব্বা-আম্মা দুজনেই পড়েছেন কাগজের ওপর হুমড়ি খেয়ে—

কি রেজাল্ট?

তারপর আর কি? মহা উৎসবে দিন পার হলো। আমার চেয়ে বেশি.. লাফালাফি করলো মমতাজ আর পুতুল। ভাই ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে, ভাই ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে বলে চিৎকার করতে করতে ছুটলো প্রতিবেশিদের জানাতে। আহ্ কী শান্তি তখন আমার। পড়াশোনার ঝক্কি থেকে মুক্তি।

পরদিনই রওয়ানা হলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। হলের সিট তখনও দখলে ছিল, থাকার কোনো সমস্যা হয়নি।

হাজির হলাম রেজিস্ট্রার অফিসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জোগাড়ে। দেখা হলো বন্ধু ইকবালের সঙ্গে। আমার কাছের বন্ধু। সে এখন প্রয়াত। কুয়েতে চাকরি করতে গিয়ে রাতে একা ঘরে হার্ট এ্যাটাকে ইন্তেকাল করেছে।

আমার খুব ঘনিষ্ঠ ক’জন বন্ধুদের মাঝে একজন ছিল ইকবাল। বামপন্থী রাজনীতিতে ছিল উদ্বুদ্ধ। ভীষণ ভালো মনের মানুষ একজন। থিয়েটারেও জড়িত হয় এক সময়। ইকবাল জানাল, সে রেজাল্ট বের হবার আগেই ঢাকা ওয়াসায় চাকরিতে যোগ দিয়েছে এবং সেখানে আরও কিছু ইঞ্জিনিয়ার জরুরি ভিত্তিতে নেয়া হবে, সে শুনেছে।

পরদিনই আমরা কয়েক বন্ধু মিলে আবেদনপত্র নিয়ে দেখা করলাম ঢাকা ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মুজিবর রহমান খানের সঙ্গে। তিনি শুধু জানতে চাইলেন-

ডিগ্রি ইঞ্জিনিয়ার?

ব্যাস হয়ে গেল, দরখাস্ত নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারভিউও হয়ে গেল। চিঠি দিয়ে ফলাফল জানানো হবে শুনে আহ্লাদে আটখানা হয়ে সেই রাতেই চলে গেলাম চট্টগ্রাম।

বলা দরকার, আমি বা আমার মতন যারা সে বৎসর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছিল তাদের সকলকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে ওয়াপদা’র চিফ ইঞ্জিনিয়ার বলেছিলেন— তোমাদের সবাইকে আমি এক্ষুনী চাকরি দিয়ে দিলাম। আমার অনেক ইঞ্জিনিয়ার লাগবে। আসলে তখন দেশে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের ছিল ভীষণ চাহিদা। চাকরির বাজারে তো অবশ্যই। সেই সাথে বিয়ের বাজারেও। ওয়াসার চাকরির বিষয়ে আমার প্রধান উৎসাহটা ছিল অন্য রকম।

আমি ঢাকায় থাকতে চাই।

মনে আছে চট্টগ্রামে গিয়ে আব্বাকে যখন জানালাম উনি খুব খুশি হলেন আর বললেন-‘তোমার চাকরি রেলে সহজে হয়ে যাবে, কিন্তু আমি চাই না তুমি রেলে চাকরি করো।’ ‘কেন?’

‘কারণ রেল একটা বাজে ডিপার্টমেন্ট।

পরে অবশ্য আমার একটি উপলব্ধি হয়েছিল যে, যে প্রতিষ্ঠানে বা অফিসে যে চাকরি করে, সেটাই তার কাছে সবচেয়ে বাজে প্রতিষ্ঠান।

আমি আবার ক’দিন আনন্দ ফূর্তি করে কাটালাম। পাড়া প্রতিবেশীর আদরযত্নও পাওয়া গেল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার কারণে।

মনে পড়ে আমার এক প্রতিবেশি খালা তাঁর নষ্ট হয়ে যাওয়া রেডিওটা সেরে দেবার জন্য বিশেষ অনুরোধ জানিয়েছিলেন-

অনেক কষ্টে তাঁকে বোঝানো গিয়েছিল যে আমি রেডিওর ইঞ্জিনিয়ার না। দালানকোঠার ইঞ্জিনিয়ার। উত্তরে খালা খুশি হননি মোটেই।

দিন দশকের মধ্যে নিয়োগপত্র চলে এল ঢাকা ওয়াসার সেক্রেটারির সই করা। সাতজন ইঞ্জিনিয়ার তাঁরা নিয়োগ দিয়েছেন। আমি তার অন্যতম একজন। অনুমতি চাইলাম আব্বার কাছে। যোগ দেব কিনা!

‘অবশ্য যোগ দেবে। ভাল না লাগলে পরে অন্য কিছু ভেব।’

তিন শ’ পঞ্চাশ টাকা স্কেলের বেতনে চাকরি, চারটে অগ্রিম ইনক্রিমেন্ট, বাড়ি ভাড়া, মেডিকেলসহ পাঁচশ পয়ষট্টি টাকা মাসে।

আসবার আগে আব্বা শুধু বললেন-

‘মন দিয়ে কাজ করবে। আর একটা কথা সব সময় মনে করবে সততা আর নিষ্ঠার সাথে কাজ করাটা তোমার দায়িত্ব। সে জন্যেই তারা তোমাকে মাইনে দেবে। এমন ধারার কথা সব বাবাই হয়তো বলেন— কিন্তু আমি আব্বাকে চিনি। তাঁর কথার মূল্য আমার কাছে অপরিসীম। সেই নীতি মেনে চলার চেষ্টা করেছি আজীবন।

আম্মা শুধু মাথা জড়িয়ে ধরে আয়াতুল কুরসী পড়ে ফুঁ দিয়ে ছিলেন। মধ্যবিত্ত সংসারের পাঁচ ভাই বোনের একজনকে ইঞ্জিনিয়ার করা যে কতটা কষ্টসাধ্য, সে যাদের হয় তারাই বলতে পারে। ধার দেনা, টানা হেঁচড়া তো নিত্যদিনের ব্যাপার ছিল। আব্বার একার বেতনে সংসার টানতে কী পরিমান কষ্ট করতে হয়েছে বুঝতে পারি এখন। আর সংসার টেনেছেন আম্মা। নীরবে, সহ্য করেছেন নানান দুঃখ কষ্ট।

মমতাজ আর পুতুল খুব খুশি। ওরা শুধু দোয়া করলো। চাওয়া টাওয়া ছিল না ওদের। ওদের শুধু কষ্ট ভাইটা কাছে থাকবে না। আবদার করবে কার কাছে। আসলে মধ্যবিত্ত সংসারে এভাবেই তো মানুষ হয়েছি আমরা। ভাইবোন ডিম ভাগ করে খাওয়া নিত্যদিনের ব্যাপার ছিল। তারপরও একমাত্র ছেলে হিসেবে বাবা-মা’র যেমন একটু বেশি প্রশ্রয় ছিল সব ব্যাপারে বোনদেরও তাই, ভাইদের প্রতি তাদের যত্ন-আদরের শেষ ছিল না তাদের। সত্যি আমি বড়ই ভাগ্যবান, এমন পরিবারের সদস্য হতে পেরে। বড় বোন দুটো কবেই প্রয়াত হয়েছেন। ছোট দু’জন আমাকে নিয়ে আনন্দ করার সময় বেশি না পেলেও শিরী তাদের সব আদর আহ্লাদ পুষিয়ে দেয়। ওরা এখন বলে-ভাবী যদি না থাকতো আমাদের ভাইকে আমরা হারিয়ে ফেলতাম। শুনে আমি সত্যি গর্ব বোধ করি-এমন জীবনসাথী পাওয়াটাও ভাগ্যের ব্যাপার।

ফেব্রুয়ারি ৫, ১৯৬৮ সকাল সাড়ে সাতটায় সেগুনবাগিচায় ঢাকা ওয়াসার সিউয়ারেজ ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী জনাব আব্দুর রাজ্জাকের হাতে যোগদানপত্র দিলাম। তিনি অভিনন্দন জানিয়ে পত্রের ওপর ‘কেরানি সাহেব, ব্যবস্থা নিন’ লিখে তার সাথে আমাকে অন্য রুমে পাঠিয়ে দিলেন। হাল্কা পাতলা ঢ্যাংগা চিররুগ্ন বড়বাবু মিজান সাহেবের চেহারাটাও এই মুহূর্তে আমার চোখে ভেসে উঠলো।

আমি হয়ে গেলাম সরকারি চাকুরে, সেই মুহূর্ত থেকে। যে কারো চরিত্রের প্রত্যয়নপত্র দেয়ার অধিকারী তখন থেকে আমি। বেশ মজাই পেলাম অবশ্যি। কারণ একাজটির জন্য আব্বার অফিসের ওয়েল ফেয়ার অফিসার আর.এন.বাগচি সাহেবের দ্বারস্থ হতে হয়েছে আমাকে বহুবার। এবার থেকে সবাই আসবে আমার কাছে!

এবার আমার জীবনের প্রথম বস্ আব্দুর রাজ্জাক সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন। কারণ সরকারি কাজকর্মের নিয়মনীতি, আইনকানুন যতটুকু যা শিখেছি, তার হাতে-খড়ি এই মানুষটির হাত দিয়ে। তখন ওঁর বয়স কত হবে? পঞ্চাশের কিছু বেশি হয়তো। ডিপ্লোমা পাস, পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অফিসার, প্রেষণে ছিলেন ঢাকা ওয়াসায়। তাঁর বিশেষত্ব ছিল যে খাস মাউতাইলের ভাষায় কথা বলতেন। সপ্তাহে শেভ করতেন বড়জোর একদিন। আর কেমন যেন সব সময় বেখেয়ালে থাকতেন একটু। শুনেছি, সংসারে কিছু সমস্যা ছিল। বিশেষ করে পুত্রের কারণে তাঁর মেজাজটাও বেশি সময় থাকতো তিরিক্ষি। প্রতিদিনই অফিসের লোকজন গায়ে পড়ে তাঁর সম্পর্কে সাবধান করতেন আমাকে। কিন্তু পোষাকে, চালচলনে অত্যন্ত সাদাসিধে এই মানুষটা নিজেই কেন জানি খুব পছন্দ করলেন আমাকে। স্যার আপনাকে সালাম।

পরদিন সকালে তিনি আমাকে অফিস অর্ডার করে বেশ কঠিন একটি দায়িত্ব দিলেন। সাথে আলাদা রুম, টেলিফোন এবং টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার জীপগাড়ির দায়িত্বও। এসবের দায়িত্ব যাঁর ছিল তিনি বদলী হয়ে অন্য ডিভিশনে যাচ্ছেন বিধায়, আমার কাঁধে এ দায়িত্ব। এ

সমস্ত সুযোগ সুবিধা পেয়ে আমি যতটা না খুশি, তার চেয়ে অনেক বেশি আতঙ্কিত হলেন অফিসের অন্য মানুষজন।

কারণটা বুঝতে অবশ্য দেরি হয়নি আমারও। পরদিন সকালে অফিসে এসে প্রথম যে ফোনটা ধরেছিলাম তার কথোপকথনটা শুনুন। আমি ফোন ধরে বলি—

‘হ্যালো স্লামালেকুম।’

‘ক্যাঠা, ইঞ্জিনিয়ার সাব নি?’

‘জ্বি বলছি।’

‘আবে ওই পুঙ্গির পো, অহনো অফিসে বইয়া রইছস আর আমগো বাথরুমে গু ভাইসা যাইতেছে!

এরপর আর শোনা হয়নি। খট করে ফোন রেখে দিলাম। পিয়ন রুস্তম আলী (তাকেও আমি একই সূত্রে পেয়েছিলাম) ব্যাপারটা বুঝে আমাকে সাবধান করে দেয়, আমি যেন ফোন না ধরি, অন্যেরা ধরে প্রয়োজনে আমাকে দেবে।

এতক্ষণে নিশ্চয় বোঝা গেছে, আমার দায়িত্বটা কী ছিল। হ্যাঁ পুরো ঢাকা শহরের পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণ। তো এইসব উপসর্গ নিয়ে আমার চাকরি জীবনের যাত্রা শুরু হলো। তবে একটা কথা বলতেই হয়— রাজ্জাক স্যার আমাকে বিপদে ফেলবার জন্য এ দায়িত্ব দেননি, বরং আমার মধ্যে কেন যেন একটা বিশ্বাস এবং আস্থার আভাষ তিনি পেয়েছিলেন। ক’দিন পর ২০০ টাকার পেটি ক্যাশের দায়িত্বও চলে এলো আমার কাছে, যদিও আমার সিনিয়ার আর একজন সহকারী প্রকৌশলী সেখানে বিদ্যমান ছিলেন। তিনি ছিলেন নতুন সুয়ার প্রজেক্টের দায়িত্বে। তখন ওয়াসায় নতুন প্রজেক্ট শুরু হয়েছিল— শহর থেকে পাগলা আউটফল পর্যন্ত মাস্টারসুয়ার নির্মাণের।

এ ডিভিশনে প্রায় আট বছর সহকারী প্রকৌশলী হিসাবে কর্মরত ছিলাম আমি। মাঝে একবার নির্বাহী প্রকৌশলী বদল হলেও আবার রাজ্জাক সাহেবই এলেন আমাদের বিভাগে— তখন সেটা হয়েছিল সুয়ার প্রজেক্ট ডিভিশন-১। তখন সুয়ারেজ ব্যবস্থা বিস্তৃত হয়েছিল ধানমন্ডি, তেজগাও ও গুলশান এলাকায়ও।

বুয়েট থেকে বেরোনোর পর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যোগাযোগটা ছিল গোপীবাগস্থ ‘আমরা ক’জনার’ মাধ্যমে। এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম, আমরা কয়েক বন্ধু, সেই থার্ড ইয়ারে পড়ার সময়। জাফর, মন্টু, অলি, মঞ্জুর, নাসির আর আমি এই ক’জন গিয়ে যোগ দিই ‘আমরা ক’জনায়’। কে যোগাযোগ করিয়েছিল ঠিক মনে নেই, তবে এটুকু মনে আছে যে তখন ‘আমরা ক’জনা’ থেকে কবিগুরুর রক্তকবরী নাটক মঞ্চায়নের চিন্তাভাবনা থেকে অভিনয় শিল্পী খোঁজা হচ্ছিল, সেই সূত্রেই আমাদের যোগাযোগ।

সে নাটক আর হয়নি, তবে আমরা নিয়মিত সদস্য হয়ে যাই ‘আমরা ক’জনার’। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিয়মিত হতো তখন। বিভিন্ন উপলক্ষ্যে। সভাপতি স্বনামধন্য পটুয়া কামরুল হাসান, সহ-সভাপতি গায়ক অভিনেতা আরিফুল হক। সাধারণ সম্পাদক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কাজী মদিনা, রায়হানা পারভীন ক্যাশিয়ার। বাংলার সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে স্মরণ করে যেমন অনুষ্ঠান হতো আমাদের, তেমনি দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণও ছিল দায়িত্ব। ওই সমস্ত অনুষ্ঠানে আমরা গানের কোরাসে গলা মিলাতাম মহানন্দে। কখনো কখনো আমাকে আবৃত্তিও করতে হতো মদিনা আপার অনুরোধে যদিও সেটা আমি কখনো পারতাম না, আজও পারি না। আমরা ক’জনায় তখন আরও ছিলেন, বিশেষ করে মনে পড়ে নজরুল সংগীতের ওস্তাদ জুলহাস উদ্দীন। গোপিবাগে ছিল মূল কেন্দ্র। এখন প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত।

চাকরিতে যোগ দেয়ার পর প্রথম যে অনুষ্ঠানটি সামনে এলো তাতে আমন্ত্রণ জানালাম রাজ্জাক স্যারকে। খুব সম্ভবত বর্ষবরণ, কিংবা রবীন্দ্রজয়ন্তীও হতে পারে।

‘এইটা কিসের কার্ড?’

আমন্ত্রণপত্র হাতে নিয়ে প্রথম জিজ্ঞাসা তাঁর।

‘একটা অনুষ্ঠানের স্যার।’

‘তো এইখানে আপনে কী?’

‘আমি সদস্য এই প্রতিষ্ঠানের, আসবেন তো স্যার।’

‘দেখি, আসতে পারি।’

ব্রিটিশ কাউন্সিলেই হয়েছিল মনে হয় অনুষ্ঠানটা। কালের আবর্তনে অনেক কিছু মনে নেই, আর যেহেতু ডায়েরি তখনো লেখার অভ্যাস ছিল না, দিন কাল পাত্রের মধ্যে কিন্তু হেরফের হতেই পারে। সেজন্যে ক্ষমাপ্রার্থী আমি। স্মৃতিই আমার ভরসা এখন।

অনুষ্ঠানের পরদিন সকালেই আমার ডাক পড়লো বসের রুমে। সকাল বেলাতেই। অফিসে সময়মত যাওয়াটা তখন খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। কিন্তু রাজ্জাক স্যার সাতটার মধ্যেই পৌঁছে যেতেন। সবাই বলতো বাড়িতে ‘ক্যাচাল’ বেশি থাকায় আগেই চলে আসতেন তিনি। পিয়নকে বলে রেখেছিলেন আমি আসলেই যেন তাঁর রুমে পাঠানো হয়।

রুমে ঢুকতেই সাদরে অভ্যর্থনা পেলাম।

‘আসেন, আসেন হায়াত সাব। আরে আপনে তো দেখি শিল্পী মানুষ। বহুত ভালো লাগছে আপনাদের অনুষ্ঠান।

আমি একটু লাজুক হাসি দিয়েছিলাম, এমন অভ্যর্থনার জবাবে। আসলে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে দলে বসে কোরাসে গান গাওয়া আর মাঝে মধ্যে দুচার লাইন আবৃত্তি করা, এই ছিল আমার ‘শিল্পী’-কর্ম।

সেদিন থেকে রাজ্জাক স্যারের কাছে আমার মূল্য আরও বেড়েছিল একথা বলতেই হয়। আমার অভিনয় ব্যাপারটা তিনি জেনেছিলেন, অনেক পরে। টেলিভিশনে প্রথম অভিনয় ছিল নাগরিকের ইডিপাস নাটকে ১৯৬৯ সনে। দর্শক সংখ্যা অনেক সীমিত ছিল, কারণ টেলিভিশনের সংখ্যাই ছিল তখন মাত্র হাজার খানেক, তাও শুধু ঢাকা শহরে, অন্যত্র নয়। স্বাধীনতার পর যখন প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আমাকে টেলিভিশন নাটকে দেখা যেত, তখন স্যার বদলী হয়ে অন্য ডিভিশনে-একদিন হেড অফিসে দেখা হতেই হাত চেপে ধরেন-

‘আরে হায়াত সাব, আপনে দেখি অভিনয়ও করেন। আমারে আগে কন নাই তো।

‘আপনি দেখেছেন?’

‘না, আমার তো টিভি নাই। পত্রিকায় দেখলাম আপনার ছবি।’

তখন নিয়মিত মঞ্চ, টিভি, চলচিত্র, রেডিও সব মাধ্যমেই ব্যস্ত আমি। ছবি-টবি বের হতো ঘনঘন।

রাজ্জাক স্যারকে ভোলার নয়। তিনি আমাকে দেখতেন পুত্রস্নেহে। অফিসের কার্যক্রম তিনি শিখিয়েছেন, এক সময় এমনি হলো যে, অফিসটাই আমি চালাতাম, তিনি শুধু স্বাক্ষর দিয়েই শেষ, শুধু জিজ্ঞাসা করতেন-

‘হায়াত সাব সই দিছে?’

জানি না তাঁর বিশ্বাস এবং আস্থার প্রতিদান কতটা দিতে পেরেছিলাম, তবে আমিও খুব ভক্তিশ্রদ্ধা করতাম আর ভালোবাসতাম মানুষটাকে। তিনি আবার একসময় বদলী হয়ে আমাদের বিভাগে এলেন, আমি তখনও সেখানেই। তবে তার কদিন পরই পদোন্নতি (নির্বাহী প্রকৌশলী) নিয়ে অন্য বিভাগে (ওয়াটার প্রজেক্ট ডিভিশন) চলে গেলাম আমি। সম্ভবত ১৯৭৭ সনে। তিনি আমার জন্য বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করলেন এবং সেদিন তিনি খুব ছোট্ট একটা বক্তৃতা দিয়ে নিজেও কাঁদলেন, অফিসের প্রত্যেকটি মানুষকে কাঁদালেন।

হায়াত সাব যাইতেছেন আমি খুব খুশি। তেনার প্রমোশন হইছে, তার জন্য অনেক দোয়া করি। কিন্তু তিনি আমারে অথর্ব কইরা দিয়ে যাইতেছে। তারে পাইয়া আমি কামই ভুইলা গেছি। খালি সইটা দিয়া কাম সারি, বেবাক কাম তিনিই করতো, এখন আমার কি হইবো।’

বলে ঝরঝর করে কাঁদতে থাকেন রাজ্জাক স্যার। অফিসের লোকের মধ্যে ও সংক্রমিত হয় কান্নাটা। সবাই আসলে হতবাক, কঠিন কর্কশ মানুষটার ভেতরে যে একটি সহজ সরল পিতৃস্নেহের ব্যক্তি বিরাজ করছে এটা সবাই প্রথম জেনেছিল সেদিন।

৭৮-এ আমি চাকরিতে প্রেষণ নিয়ে চলে যাই লিবিয়া। তিন বছর পর ফিরে এসে আর স্যারের দেখা পাইনি। ততদিনে তিনি চলে গিয়েছিলেন অবসরে।

স্যারকে নিয়ে এত কথা বলার প্রয়োজন বোধ করলাম এই কারণে যে আমি এই মানুষটির নিকট ঋণী। তাঁর পাথরের মত আপাত নির্বিকার মুখাবয়বের অভ্যন্তরের মানুষটিকে চিনেছিলাম, যিনি সযত্নে আমাকে দাপ্তারিক কাজকর্ম শিখিয়েছিলেন। সালাম স্যার। যেখানে থাকেন, ভাল থাকবেন।

মরি হায় চলে যায়
বসন্তের দিন চলে যায়…

যে বছর চাকরিতে প্রবেশ করলাম সে বছরই লৌহমানব আয়ূব খানের রাজত্বের দশ বছর চলছিল। সেটা উদযাপনের তৎপরতা চলছিল দেশ জুড়ে। অদ্ভুত এক মৌলিক গণতন্ত্রের দেশ ছিল তখন পাকিস্তান। তার প্রমাণ তো চলছিল আয়ুব সাহেবের বেতনভুক্ত সব বুদ্ধিজীবীদের লেখায়, বক্তৃতায়।

আর সরকারি অফিস-গুলোতে উন্নয়নের পতাকা উড়াচ্ছিল তাঁর তাঁবেদারেরা। অফিসের সব ফাইলে দেখা গেল নতুন ছাপ। ‘DECADE OF DEVELOPMENT” অথবা ‘DECADE OF PROGRESS’ আমাদের অফিসে দেখলাম সামরিক ব্যক্তিদের আলোচনা সভা নাকি তদন্ত কমিটির সভা। তদন্ত হচ্ছিল উন্নয়নের জোয়ারে কে কতটা সাহায্য করেছে আর কারা সহযোগিতার হাত বাড়ায় নি ইত্যাকার সব ব্যাপার স্যাপার নিয়ে। অফিস আদালতে যখন এই উন্নয়ন জোয়ার চলছে, তখন সারা দেশে শুরু হয়ে গেছে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ এবং শাসনের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ফুঁসে উঠছে। নেতৃত্বে রয়েছেন প্রধানত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের ব্যক্তিরা আর পিছিয়ে থাকেন কিভাবে? তাঁরাও ক্রমে ক্রমে শরিক হয়ে পড়েন এই আন্দোলনে। পশ্চিমারা আমাদের বাংলা বর্ণমালা পরিবর্তনের ষড়যন্ত্রে মেতেছে তখন। ভাড়া করা বাহিনীরা বলছেন-আরবি হরফে বাংলা লেখা প্রয়োজন আর রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করো, নজরুলকে কাটছাঁট করে পাক্কা মুসলমান বানিয়ে ব্যবহার করো। বড়বড় গুরুত্বপূর্ণ সব কর্মপদে নিয়োগ করা শুরু হয় পশ্চিমাদের, সেই সূত্রে ঢাকা ওয়াসার ওপর তলায় এল পরিবর্তন।

বাঙালী প্রতিথযশা ইঞ্জিনিয়ার সালাম সাহেবের বদলে চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয়া হলো অবাঙালী সি.এস.পি এম. জে. আর খানকে। তিনি এসেই বেশ রদবদল করলেন প্রশাসনে, বিশেষ ক’রে বিল পরিশোধ ব্যবস্থাপনায়। প্রকৌশলীদের বিল পাশ করার ক্ষমতার ওপর হস্তক্ষেপ শুরু করলেন তিনি। শোনা যায় এর পেছনে ইন্ধন যুগিয়েছেন, প্রেষণে আসা এক বাঙালী সেক্রেটারি সাহেব। সকল বিল হিসাব বিভাগে যাওয়ার আগে তাঁর হাত ঘুরে চেয়ারম্যানের অনুমোদন হয়ে যেতে হবে; জারি হলো নির্দেশ।

এ ঘটনার অবতারণা করলাম বিশেষ একটি কারণে। আমার চাকরি জীবনের প্রথম একটা ধাক্কার কারণ হয়েছিলো এই নিয়মটা। আগেই বলেছি আমি ছিলাম সম্পূর্ণ ঢাকা অঞ্চলের পয়ঃপ্রণালী রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে। একই সাথে নতুন প্রকল্পের কাজও চলতো এই বিভাগ এবং অন্যান্য বিভাগ থেকে। ওয়াসার অন্যতম প্রধান কাজ ছিল পয়ঃনিষ্কাষণ পাইপ এবং পানির পাইপ মাটির নীচে বসানো। সেটা করতে গিয়ে প্রচুর গভীর খাদ করে মাটিকে উঠিয়ে, পাইপ বসিয়ে বালি ভরাট করা হতো। এখন অতিরিক্ত এই মাটি সরানোর জন্যে আর একটি প্রকল্প নেয়া হয় যার দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। প্রতিটি সাইট থেকে ট্রাক ভর্তি করে মাটি নিয়ে গুলশানে ওয়াসার জমিতে থাকা একটি পুকুরে ফেলতে হবে। এভাবে পুকুরটি ভরাট করে, সেখানে চেয়ারম্যানের জন্যে ভবন নির্মাণ করা হবে।

মোহাম্মদ আলী নামের এক ঠিকাদার কাজটির বরাদ্দ পেলেন। আমি কূপন সিস্টেম করে দিলাম। সাইট থেকে ট্রাক মাটি নিয়ে যাবার সময় কুপনের উভয় অংশে স্বাক্ষর দেবে সাইটের স্টাফ এবং ঠিকাদারের প্রতিনিধি। কাজ শেষে উভয়ের কার্ডের কুপনের হিসাব মিলিয়ে বিল হবে।

শেষ হলো কাজ। বিলও তৈরি করে আমার নির্বাহী প্রকৌশলীর হাত হয়ে পৌঁছাল সেক্রেটারির টেবিলে। সেখান থেকে এল আপত্তি। আপত্তি মানে ইঞ্জিনিয়ারিং স্টাফদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ-এত ট্রাক মাটি বহন করা হয়নি তবে মাটি নিশ্চয় অন্যত্র বিক্রয় করেছে ঠিকাদার প্রকৌশলীর সাথে যুক্তি করে। ফাইল ফেরৎ এল আমার কাছে। রাজ্জাক

সাহেব বললেন-

‘এখন কী করবেন?’

আমি বললাম-

‘ফাইট করতে হবে, চুরি তো আমার লোক বা আমি করিনি।’

কড়া নোট লিখলাম। মূল কথা ছিল-পুকুরের মাটি মাপা হোক। মাপা হলো, কিন্তু আমাদের উপস্থিতি ছাড়া। এবং আবারও রিপোর্ট এল মাটি অনেক কম-অর্থাৎ প্রায় বিল করার চেয়ে অর্ধেক। এবার চেয়ারম্যান লিখলেন ‘Fix up responsibility’-অর্থাৎ চোর ধর!

ফাইল প্রথামত আমার টেবিলেই এল আবার। আমি সোজাসুজি ঠিকাদারকে ডাকলাম— ‘মোহাম্মদ আলী বিষয় কী বলতো?’

‘বিষয় আর কী? ট্যাকা চায়!

মাস্তান লোক, অনেকটা ঠ্যাটামো আছে ওর মধ্যে।

‘কত চেয়েছে?’

‘হেইডা শুইনা আপনে কী করবেন?’

হেসে ফেলি আমি।

‘দিয়েছ?’

‘না, এত কম টাকায় কাম নিছি, ওরে দিলে আমার থাকবো কী?

ব্যাপারটা বুঝতে আর বাকী রইলো না আমার। সেক্রেটারি সম্পর্কে এর মধ্যেই নানান কানাঘুষা শোনা যাচ্ছিল, হয়তো চেয়ারম্যানেরও ভাগ থাকতে পারে।

এবার আবার দিলাম কড়া নোট-

‘আমি যেহেতু দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী, পুরো দায়িত্বই আমার। আমাদের বিভাগ কর্তৃক প্রত্যায়িত পরিমাপ সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। সবচেয়ে বড় কথা পুনঃমাপ গ্রহণের সময় আমাদের কোনো প্রতিনিধিকে খবর না দেয়াটা উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে মনে হচ্ছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’

নোট তখনও বাংলায় লেখা শুরু হয়নি আমাদের। ইংরেজিতে লিখলাম। রাজ্জাক স্যার সই করলেন। আমি বলি, স্যার ফাইল পাঠান তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর কাছে— যাতে প্রধান প্রকৌশলীর মাধ্যমে সোজা সেক্রেটারিকে পাশ কাটিয়ে চেয়ারম্যানের কাছে যায়। সেই ভাবেই ফাইল গেল। কাজও হলো যথাযথ। চেয়ারম্যান নোট দিলেন-

I want to measure the quantity of filled earth in the pond next Sunday morning at 7.30 am. Assistant engineer to be present there.

এ রকমই ছিল নোটটি। ওপর থেকে সই হতে হতে রাজ্জাক স্যারের টেবিলে এল। এর মধ্যে সেক্রেটারি আমার বসকে ফোন করে বলেছেন-আমি যেন গাড়ি নিয়ে চেয়ারম্যানের বাসা থেকে (সেটাও গুলশানে) তাঁকে তুলে নিয়ে যাই।

‘স্যার আপনি যাবেন না?’

আমি বললাম রাজ্জাক স্যারকে।

‘আমারে তো যাইতে বলে নাই, আপনেই যান।’

হেসে বলেন তিনি, বুঝলাম বিষয়টা এড়িয়ে যেতে চান।

২০ জুলাই সকাল সাতটায় আল্লার নাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমার জ্বীপ গাড়ি নিয়ে। আমি তখন নিজেই চালাই। ড্রাইভিংটা শিখে নিয়েছি প্রথম সুযোগেই। ড্রাইভার ছিল বিহারি একটা ছেলে— নাঈম। তাকে নিয়মিত দুএক টাকা বকশিষ দিয়ে শিখেছিলাম গাড়ি চালানো। টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার (হার্ড টপ) গাড়িটা ছিল আমার নিয়ন্ত্রণে। রবিবার বলে নাঈমকে আর ডাকলাম না, নিজেই ড্রাইভ করে পৌঁছালাম চেয়ারম্যান সাহেবের বাসায়, গুলশানে।

প্রসঙ্গত বলা যায়, আগের রাতে আমেরিকার নভোযান চাঁদে অবতরণ করেছে দু’জন নভোচারী নিয়ে। নিল আর্মস্ট্রং এবং এডউইন অলড্রিনকে নিয়ে। সকলের মধ্যেই উত্তেজনা কাজ করছিল ক’দিন থেকে। আসলেই নামতে পারে কিনা। সবাই শেষমুহূর্ত পর্যন্ত রেডিও ধরে বসে। আমরাও বাসায় রাত তিনটে পর্যন্ত ভয়েস অব আমেরিকা শুনেছি।

আমার এখনও মনে পড়ে সেই রাত দুটো সতের নাকি চৌদ্দ মিনিটে লুনার মডিউল চাঁদের মাটি স্পর্শ করে, আর নভোচারির কণ্ঠ শুনতে পায় গোটা বিশ্ববাসী The Eagle has landed. তারপরই শোনা যায় নাসার বৈজ্ঞানিকদের উল্লাস ধ্বনি। এটা ছিল রাশিয়াকে টেক্কা দেওয়ার জন্যে আমেরিকান একটা প্রকল্প। কেন রাশিয়া আগে চাঁদে নভোযান পাঠালো— তার জওয়াব এটা— আমরা প্রথম মানুষ পাঠালাম। এবার দেখ কে বড়!! সে যাই হোক, নিল আর্মস্ট্রং-এর সেই ভাষ্যটা ছিল আসল কথা—

A small step of man, great leap for mankind-

গাড়ি চেয়ারম্যান সাহেবের গেটে গিয়ে হর্ন দিতে না দিতেই দেখি গেট খুলে বেরিয়ে এলেন স্বয়ং চেয়ারম্যান জামিলুর রহমান খান। আমি দ্রুত নামবার চেষ্টা করতেই তিনি গাড়ির দরজা খুলে আমার পাশের সিটে বসে পড়লেন।

‘Good morning Mr. Hayat.’

‘Good Morning Sir.’

‘I am happy that you are on time.’

‘Thank you sir.’

আমার সাথে কিন্তু তাঁর এই প্রথম দেখা। কথা শুনেছি তাঁর সম্পর্কে, কিন্তু এক দেখায় সব জল হয়ে গেল। আমি মুগ্ধ তাঁর ব্যবহারে।

একটু পরই খেয়াল করলাম, গুনগুন করে বনি এমের গান ভাঁজছেন তিনি। খুব মুডে আছেন ভদ্রলোক। ভাবলাম সাইটে যাওয়ার পর এই মুড থাকলে হয়। হঠাৎ গান থামিয়ে জিজ্ঞেস করেন তিনি-

‘রাত কো রেডিও সুনা আপনে?’

‘জি’ উত্তর করি।

“The Eagle has landed!’ আহ! গ্রেট।

‘জি স্যার।

‘ব্লাডি আমেরিকান! কেয়া কর লিয়া, দেখা।

জি স্যার বলা ছাড়া আর কী বা বলবো। আমার মাথায় তখন অন্য চিন্তা কাজ করছে, এত বড় মুখ করে ফাইলে কড়া নোট দিয়েছি, যদি চেয়রম্যান ভুল পান কী হবে!

সাইটে গিয়ে দেখি আমার উপসহকারী প্রকৌশলী হাযির আর ওদিকে সেক্রেটারিয়েটের একজন কর্মচারি দুজন শ্রমিক নিয়ে এসেছেন। চেয়ারম্যান সাহেবের পূর্ব নির্দেশ অনুযায়ী তাঁরা একটি বরাক বাঁশ এনেছেন যাতে ফুট হিসাবে মার্ক করা। চেয়ারম্যান সাহেবের নির্দেশে শ্রমিক দুজন পানিতে নেমে নির্দেশমত স্থানগুলোতে বাঁশ পানিতে ডুবিয়ে ডুবিয়ে পানির গভীরতা জানাল যা খাতায় লেখা হলো। পুকুরের মাটি ভরার আগের গভীরতার মাপ তো ছিল আগে থেকে।

ঘণ্টাখানেক কাজটা করে চেয়ারম্যান বললেন-

‘চলিয়ে হায়াত সাব।’

আর কিছুই শোনা গেল না তাঁর মুখ থেকে। কিন্তু মুড খুবই ভাল। ইংরেজি গানের কলি তখনও ফুটছে তাঁর ঠোঁটে।

গাড়ি থেকে নামিয়ে দিতেই-

Thank you very much. You are a good driver Mr. Hayat.

বলে হেসে চলে গেলেন।

দু’দিনের মাথায় ফাইল আমার টেবিলে। I don’t find anything wrong while measuring at site. জীবনস্মৃতি লেখায় এসব ঘটনার উল্লেখ প্রাসঙ্গিক হলো কিনা জানি না, তবে মনে ভেসে ওঠে ছোটছোট ঘটনাগুলি কোনো না কোনো কারণে। তখন নিজেকে নিবৃত করা কঠিন হয়ে পড়ে।

আয়ূব খান সাহেবের ‘উন্নয়নের দশক’-এর সাথে সাথে তাঁর শাসনের আয়ুও যে শেষ হয়ে আসছিল সেটা তিনি বুঝতে পারননি। দেশে তখন প্রবল আন্দোলন চলছে আয়ুব বাহিনীর বিরুদ্ধে। মিটিং, মিছিল, হরতাল কারফিউ, আর সেই সাথে মাঠে ঘাটে পথে শহীদ মিনারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ঢল নেমেছে চতুর্দিকেই। ১৯৬৬ সনে লাহোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ছয় দফা পেশ করেছিলেন-তার বাস্তবায়নের জন্য বাঙালীরা জোর আন্দোলন শুরু করে। যেটা থামাতে গিয়ে আয়ূব সরকার শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করে। ১৯৬৯ এর ২৪ শে জানুয়ারি সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে সাধারণ মানুষ মিছিল বের করে। মিছিলে গুলিতে নিহত হন কিশোর মতিউর। শুরু হয় সামরিক শাসক উৎখাতে গণ আন্দোলন-ছাত্র নেতা তোফায়েল আহম্মেদ এতে মূল নেতৃত্বে চলে আসেন এক সময়।

আমি চাকরিতে ঢোকার পর কিছুদিন ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো জুনিয়র ছাত্র বন্ধুদের সাথে ডাবলিং করে, তখনই যোগাযোগ হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য সহযাত্রী প্রকৌশলী গোলাম রাব্বানীর সাথে। উনি ১৯৬৪তে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছিলেন। তখনও ব্যাচেলর। বাসা খুঁজছেন। আমিও থাকার যায়গার সন্ধানে খোঁজাখুঁজি করছি ইতিউতি। জানতে পারলাম আমার কয়েকজন সহপাঠী আজিমপুর রোডে একটি বাসা ভাড়া নিয়েছে সেখানে খালি আছে রুম। অর্থাৎ আরও মেম্বার দরকার।

প্রকৌশলী রাব্বানী আর আমি গিয়ে সেখানে উঠলাম। পরে গোলাম রাব্বানীর বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার গায়ক মঞ্জুর আহমেদ উঠলেন। এখান থেকেই শুরু হলো আমার জীবনের আর এক যাত্রা। জড়িয়ে পড়লাম থিয়েটার গ্রুপের সাথে। জড়িয়ে পড়লাম দেশের গণআন্দোলনে সম্পৃক্ত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে। সে কথায় আসবো পরে। আবার একটু ততক্ষণে ঘুরে আসি অফিস।

চাকরি জীবনে আমার প্রথম ঠিকাদার আলী আহম্মদ। ইনি ঢাকারই বাসিন্দা। একদিন বিরাট সালাম দিয়ে আমার রুমে প্রবেশ করেন তিনি। পিছন পিছন আমার পিয়ন, হাতে একটা ফাইল। ফাইলটা রাখে সে আমার টেবিলে।

‘স্যার আমার ফাইলটা।’

‘কিসের ফাইল?’

‘একটা বিল ছিল স্যার।’

বলে পিয়নের নিয়ে আসা ফাইলটা এগিয়ে আমার সামনে আনলেন আলি আহমেদ।

আমার এ্যাস্ট্যিান্ট ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তো বদলি হইয়া গেছেন, আপনেই চার্জে। সইটা দিলে উপকার হইতো।

রাজ্জাক স্যার আমাকে রক্ষা করলেন। কাজটা ছিল ঢাকা শহরের একটি অঞ্চলের চুরি হয়ে যাওয়া ম্যানহোল কাভার ফিট করা এবং কিছু ম্যানহোল কাভারকে উঁচু করে রাস্তার লেভেলে উঠানো। কাজ আগেই শেষ হয়ে গেছে, শুধু ফাইনাল চেকিংটা করে সই দিতে হবে। স্যার উপসহকারীকে দিলেন আমার সাথে, ওকে বুঝিয়ে বললেন ‘স্যারকে ভাল করে রাস্তার কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আমার কাছে ফাইল নিয়ে আসবে।’

গেলাম সাইটে। সঙ্গে ঠিকাদার এবং উপসহকারী প্রকৌশলী সিদ্দিকুর রহমান। ইনি আবার খাস ঢাকার কুট্টি। বিখ্যাত সরদার ফ্যামিলির মানুষ। বয়স্ক মানুষ, কিন্তু কাজের ব্যাপারে তুখোড়। মুখে পান ভরা সবসময়। ইনিও পাবলিক হেলথের স্টাফ ছিলেন একসময়-সেখান থেকে হয়েছেন WASAর স্টাফ। আসলে পুরো পয়ঃপ্রণালীই পাবলিক হেলথের ছিল। ১৯৬২তে WASA সৃষ্টির পর সেটা অন্তর্ভূক্ত হয় WASA’য়।

পুরো এক বেলা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলাম ওদের সাথে। যা বোঝালো ওরা বুঝলাম! কিছুক্ষণ পরপর ঠিকাদার সাহেব 555-এর প্যাকেট বের করে সামনে ধরেন-

‘স্যার।’

আমিও টেনে নিয়ে অগ্নিসংযোগ করি। ছাত্রজীবনে আগাগোড়াই ক্যাপস্টান চালিয়েছি। দশ আনা প্যাকেট। পয়সার টানাটানি হলে King stork চলতো দেদারসে। এবার জাতে উঠে গেলাম-

হয় 555 না হয় Benson & Hedges.

অফিসে ফিরলে রাজ্জাক স্যারের প্ৰশ্ন-

‘দেখছেন?’

‘জি।’

‘কি বুঝলেন?’

‘কাজ সম্পর্কে কিছুই তো ধারণা নেই, সিদ্দিক সাহেব যা বোঝালেন, তাই বুঝতে হলো। হাসলেন রাজ্জাক স্যার। নোটটা লিখে দিলেন আমাকে—

যার সারমর্ম হলো— কাজটা যেহেতু আমার তত্ত্বাবধানে হয় নাই, সুতরাং যাঁর দায়িত্বে ছিল তাঁর সার্টিফিকেট দরকার। তবে আপাতত ঠিকাদারকে ৭৫% শতাংশ বিল দেয়া যেতে পারে। সাইট ভিজিটে আপাতত ঠিকই মনে হচ্ছে।

নোট লেখার কায়দাকানুনগুলো এভাবেই আস্তে আস্তে আয়ত্বে আনা শুরু হলো। এর মধ্যে একদিন সাইটে গেছি কাজী সালাউদ্দিন রোডে। সেখানে আমার কন্ট্রাকটর কাজ করছে— Cleaning of Sewer, কিন্তু সে একটা ম্যানহোলের অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছে না। আমি সিদ্দিক সাহেবকে বললাম— চলেন আমি দেখে আসি। তিনি বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও গেলাম। কারণ এলাকা থেকে নিয়মিত কয়েকবার করে ফোন আসে, লাইন বন্ধ, পায়খানার ওপর পানি উঠে গেছে, তারপর গালাগালি। এখন ওই ম্যানহোলের হদিস পাওয়াটা জরুরি, Cleaning machine বা বাঁশের বাখারী প্রবেশ করানোর জন্যও একটা ওপেনিং দরকার। ফোনে অস্থির হয়েই গেলাম, কেন পাওয়া যাবে না ম্যানহোল? ড্রইং-এ আছে যখন, বাস্তবেও থাকতে বাধ্য।

গাড়ি থেকে নামতেই লোক জমে গেল। সবারই এক অভিযোগ। ‘আমরা বাসাতে থাকতে পারছি না।’ সিদ্দিক সাহেবের সাথে আমি এ গলি, ও গলি অসখ্য গলি ঘুরে দেখেছি— লোকজন পিছু পিছু আছে। এক সময় সিদ্দিক সাহেব আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলেন-

‘স্যার’ আপনে যানগা, মানুষ চেইতা রইছে, কহন কী কইরা ফালায়।’

ইশারা বুঝে ফেলেছি আমি, তাকিয়ে দেখি সবাই ক্ষিপ্ত— ক্ষিপ্ত হবারও কথা, সবার বাথরুমে হাঁটু পানি উঠে রয়েছে বেশ কিছু দিন থেকে।

সিদ্দিক সাহেব ইশারা করেন আমাকে-আমি ধীরে ধীরে তাঁর পাশে পাশে চলতে শুরু করি। এক সময় দেখি গাড়ির কাছে এসেছি, নঈম আমাদের পেছনে এক দল লোক দেখে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফেলেছে। সিদ্দিক সাহেব গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়ালেন, “উডেন স্যার।’ উঠতে যতটুকু দেরী। নঈম গাড়ি টান দিল। পেছনে চিৎকার চেঁচামেচি শুনলাম,

‘ধর হালারে ধর, ইঞ্জিনিয়ার মারাইতে আইছে।’

নঈম খুব বিজ্ঞের মত বললো—

‘বাঁচ গিয়া স্যার, ‘ইয়ে লোগ বহুত হারামী হায়।’

হ্যাঁ, সেদিন বেঁচে গেছি, সময় মত বেরিয়ে আসতে না পারলে নির্ঘাৎ মার খেতে হতো।

অফিসে রাজ্জাক স্যার থেকে শুরু করে আমার পিয়ন রুস্তম আলি পর্যন্ত প্রত্যেকেই আমাকে উপদেশ দিয়ে বলে-এভাবে সব সাইটে যাবার প্রয়োজন নেই। সিদ্দিক সাহেব স্থানীয় মানুষ, সবাই তাকে চেনে জানে, তিনিই দেখা শোনা করতে পারবে।

এ যন্ত্রণা অবশ্য খুব বেশি দিন সইতে হয়নি। বছর দুয়েকের মধ্যেই ঢাকা ওয়াসার দুটো পয়:প্রণালী প্রকল্প ডিভিশন খোলা হলো। আমি ডিভিশন-১ চলে গেলাম, মতিঝিল অফিসে। রক্ষণাবেক্ষণের কবল থেকে মুক্তি হলো।

এর মধ্যে আমার জীবনে একটি বিপর্যয় নেমে এল। তার আগে, আবারও বলি, আমরা একেবারে মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। মুর্শিদাবাদে নিজেদের জমি বাড়ি পুকুর সবই ছিল। স্বচ্ছলতাও ছিল। কিন্তু এখানে বাবার বেতনে সংসার চলে। দুটো বোনের বিয়ে দিতে আব্বার ধারদেনা হয়েছে, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা অনেকটাই ফাঁকা লোনের কারণে— ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে— সেখানেও মাসে ১০০টি টাকা করে দিয়েছেন, তাছাড়াও আবার বড় বোনের সংসার টানতে হয়েছে আব্বাকে বহুদিন। এর পরে আমার এক ফুপু হঠাৎ গোটা পরিবার নিয়ে এসে হাজির হন মুর্শিদাবাদ থেকে চট্টগ্রাম— তাঁরও বিরাট সংসার টেনেছেন আব্বা। বেশ বিধ্বস্ত অবস্থা তখন তাঁর, যখন আমি পাশ করে বেরোই। কিন্তু আব্বা ছিলেন জীবনীশক্তিতে ভরপুর একজন মানুষ। অফিস, স্কুল পরিচালনা, ক্লাব পরিচালনা, কনট্যাক্ট ব্রিজ, বন্দুক নিয়ে শিকার করা, মাছ ধরা, বন্ধুবান্ধবদের ছেলে মেয়েদের বিয়ের দিন কাচ্চি বিরানীতে বাবুর্চি হিসাবে যোগ দেয়া-এসব নিয়ে থাকতেন, বুঝতে দিতেন না কষ্টটা।

তবে একটা স্বপ্ন ছিল, আমি জানতাম। প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা পেলে একটা জমি কিনবেন, পুকুর কাটাবেন, অবসর কাটাবেন বই পড়ে আর মাছ ধরে। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হলে নিশ্চয় সবই সম্ভব হবে, এমনই ভাবতেন নিশ্চয়, যদিও মুখে ব্যক্ত করেননি কোনো দিন।

আমার পাশ করার কিছুদিনের মধ্যেই অবসর নিলেন, ছ’মাস অবসরকালীন ছুটি। ভবিষ্যত পরিকল্পনা করার জন্য। বয়স তখন কত ৫৬/৫৭ হবে। চাকরি পেয়ে গেলেন একটা এ.কে. খান কোম্পানিতে। এ্যাডমিন্সিট্রেটিভ অফিসার। ভাল বেতনে। টাইগারপাসে বাসার পেছনেই ছিল এ কে খান সাহেবদের অফিস। সুখের সময় শুরু আব্বার। নতুন চাকরির বেতন, অবসরপ্রাপ্ত পদের ছুটিকালীন বেতন, আব্বার আমার মাইনে-সব মিলিয়ে আব্বাকে ভালভাল সব স্বপ্ন দেখালো। কিন্তু ওই ওপরে আছেন একজন যিনি সকল কাজের কাজী, আল্লাহরাব্বুল আলামীন, তিনি ভেবে রেখেছেন অন্যরকম।

ফোনটা পিয়ন রুস্তম আলী ধরেছিল। চট্টগ্রাম থেকে এসেছে। টাইগারপাস রেলওয়ে এমপ্লয়িজ গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা রোকেয়া বেগম করেছেন ফোন। স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আব্বা, সে কথা অন্যত্র লিখেছি আমি। পুরো এলাকার এই একটি টেলিফোনে আব্বা আম্মা কখনো কদাচিৎ খুলনায় আমার মেজো বোনের সাথে কথা বলতেন। আমাকে কখনো নয়।

স্যার আপনের ফোন, বাড়ির থিকা।

অবাক হবারই কথা আমার। এরকম ফোন তো কখনো আসে না। ধরলাম ফোনটা একটু অবাক হয়ে।

ঘটনা আসলে সিরিয়াস। আব্বা খুবই অসুস্থ। আমার চট্টগ্রাম যাওয়া প্রয়োজন। আপনার আসাটা প্রয়োজন হায়াত সাহেব।

হেড মিস্ট্রেস রোকেয়া বেগম জোর দিয়েই বলেন।

আব্বার শরীর এমনিতেই ভাল আমি জানি, ব্যতিক্রম একটু শীত কাতুরে। ঠান্ডা-কাশি সার্দি তাঁর শীতকালের সাথী সারা জীবন। এ ছাড়া একদম চোস্ত আব্বা আমার। মাস ছয়েক আগে একদিন গোসলখানায় পড়ে গিয়ে এক পা আর কোমরের জয়েন্টে ব্যথা পেয়েছিলেন। তাই মাঝে মধ্যে লাঠি নিয়ে চলতেন। তাও বলবো সুস্থই ছিলেন আব্বা। তাহলে হলো কী?

বসে বসে নানান দুশ্চিন্তা আচ্ছন্ন হয়ে কখন নিশ্বব্দে কাঁদতে শুরু করেছি নিজেও জানি না। ‘কান্দেন ক্যান স্যার?’

পিয়ন রুস্তম আলীর কণ্ঠ।

‘আব্বার খুব অসুখ।’

‘কাইন্দা কী হইবো। বাড়িত যান।’

বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারে সে খুবই পটু। কারণে অকারণে যখন তখন সে বাড়ি যায়। কখনো বলে যায়, কখনও না বলে যায়। কখনো দরখাস্ত দেয় কখনো বা দেয় না। নোয়াখালীর মানুষ রুস্তম। ওখানেই থাকে পরিবার।

‘একস সিএন সারকে কইয়া যান গা।’

সেই রাতেই চট্টগ্রাম মেইল ধরে চলে গেলাম। সকালে বাসায় পৌঁছিয়ে দেখি— না, সিরিয়াস কিছু হয়েছে বলে তো মনে হয় না। আব্বা বিছানায় শুয়ে বই পড়ছেন। সবাই যার যার কাজ করছেন। আমাকে দেখে সবাই অবাক। মমতাজ পুতুল খুশিতে লাফাতে লাফাতে এল— ভাই তুমি হঠাৎ?

কী হয়েছে আব্বার? খুব শরীর খারাপ বলে?

কে বললো?

হেসে কথাটা বলেছিলেন আব্বা। সবাই অবাক আমার কথায়।

হেড মিস্ট্রেস আপা।

ও, রোকেয়া? দেখ দেখি কাণ্ড।

যাই হোক আমি আসাতে বাড়িতে বেশ একটা স্বস্তির ভাব দেখা গেল। শুনলাম, আবা টয়লেটে বসতে গিয়ে প্রচণ্ড ব্যথায় চিৎকার দিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। সেই ব্যথা পাওয়া জয়েন্টেই সমস্যা। হসপিটাল যেতে হয়েছিল-ইত্যাদি। কিন্তু ভালই আছেন।

এখন ঠিক আছি, কদিন রেস্ট নিলেই ভাল হয়ে যাবে।

একটু বেলা হয়ে গেল, স্কুলে গেলাম আমি হেড মিস্ট্রেস আপার সাথে দেখা করতে। আমাকে তাঁর রুমে বসিয়ে রেখে তিনি তাঁর স্বামী চট্টগ্রাম বেতারের প্রোগ্রাম প্রডিউসার শামসুল হুদাকে খবর দিলেন আসবার জন্য। বাসাটা স্কুলের পাশেই রেলওয়ে কোয়ার্টারে, আমার পরিবারের খুবই ঘনিষ্ঠ এঁরা।

বেশ অনেকক্ষণ ধরে একটা আলোচনা সভা হলো আমাদের। আব্বার সেই পুরোনো জখম হওয়া পায়ের জয়েন্টে ক্যানসার হয়েছে, সেখানে হাড় ভেঙ্গে গেছে। X-ray তে ক্যানসার ধরা পড়েছে— আরও দু-একটা যায়গায় ও স্পট পাওয়া গেছে। এখন ভর্তি করা প্রয়োজন হাসপাতালে। Radio থেরাপি দিতে হবে প্রায় এক মাস, প্রতিদিন। বাসায় অন্য কাউকে ক্যানসারের খবর দেননি রোকেয়ারা। একমাত্র পুত্র হিসেবে শুধু আমাকেই জানালেন। তবে ভর্তিটা অবিলম্বে প্রয়োজন।

আর এক দফা কান্নাকাটি করলাম আমি। এবং এটা নিশ্চিত জেনে যে অচিরেই আব্বকে হারাবো। স্বজন হারানোর ব্যথা জানা নেই তখন অবধি আমার। ব্যথায় বুকটা ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হলো— ক্যানসার সম্পর্কে কতটুকই বা জানা ছিল তখন আমার, তাঁরপরও জানতাম ক্যানসার হ্যাজ গট নো আনসার।

মনে পড়ে গেল একটি দিনের কথা। তখন চট্টগ্রামে কলেজে পড়ি। সেদিন কোনা কারণে ছুটি ছিল কলেজের। বাসায় ছিলাম। দুপুরে আব্বা আসলেন অফিস থেকে, গেট দিয়ে ঢুকতেই পিয়ন এসে একটা পোস্টকার্ড ধরিয়ে দিলো ডাক-পিয়ন আব্বার হাতে। ইন্ডিয়া থেকে এসেছে চিঠিটা। আমি বাগানে রোদে বসে ছিলাম তখন, চিঠিটায় চোখ বুলিয়েই আব্বার চেহারাটা বদলে গেল, খেয়াল করলাম। আব্বা ভেতরে ঢুকে যাওয়ার কয়েক মুহূর্ত পরে আমিও ভেতরে গেলাম— দেখি আব্বা পোস্টকার্ডটা হাতে নিয়ে বসে রয়েছেন বারান্দার চেয়ারে— আম্মা আর ছোট বোনরা রান্নাঘরে ব্যস্ত।

আব্বার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। কাঁদছেন তিনি। অবাক আমি, এই মানুষটিকে জীবনে চোখের পানি ফেলতে দেখিনি আমি। কারণ জিজ্ঞেস করতেই পোস্টকার্ডটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন-

দাদীর মৃত্যু সংবাদ চিঠিতে। লিখেছেন আমার চাচা আব্দুল মালেক। ‘মাজান আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন….’। দেশভাগের কারণে মার মৃত মুখটাও দেখার উপায় ছিল না আব্বার।

হ্যাঁ, আব্বাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি করে রেডিও থেরাপির ব্যবস্থা করে ঢাকায় ফিরে গেলাম। আর একটা কাজ করেছি, ভাল কি মন্দ জানি না-ক্যানসারের সংবাদটি আব্বাসহ কাউকে জানতে দিইনি। এতে রোকেয়া-হুদা দম্পত্তি আমাকে সাহায্য করেছিলেন। তাঁরা সহমত ছিলেন আমার সঙ্গে যে এ সংবাদে রোগী সহ সবারই মনোবল ভেঙ্গে যাবে। আসলেই তাই আব্বা প্রায় দু’বছর ছিলেন আমাদের মাঝে।

ঢাকায় এলাম ফিরে খুবই ব্যথিত হৃদয়ে। প্রথমত আব্বার চিকিৎসার অর্থ চিন্তায়। চাকরি কেবল শুরু, আব্বারও জমানো কিছু নেই, পেনশন ছাড়া। তাও কি এক জটিল সিস্টেমে ক্ষতি হয়ে গেছে বিরাট– প্রথমেই পেয়েছিলেন খানিক টাকা যা দিয়ে বেশিরভাগ ধার দেনা শোধ করেছেন— বাকিটা পেতে তাঁর প্রয়োজন ছিল মেডিকেল ফিট সার্টিফিকেট— যা আর কোনোদিনই পাওয়া হয়নি।

শুরু হল কঠিন জীবন সংগ্রাম। আমাকেও ধারদেনায় নামতে হলো বন্ধুবান্ধবের দ্বারে। বাবার হসপিটাল খরচ, পরে প্রতিদিন হাসপাতালে নিয়ে রেডিও থেরাপি দেয়া, ওষুধপত্র, এ্যাম্বুলেন্স খরচ, বিশেষত ডাক্তারের ফি ইত্যকার খরচ জোটানো আমাদের মত মধ্যবিত্তদের জন্য যে কী কঠিন তা তখনই টের পেয়েছি আমি। তবু চেষ্টার শেষ পর্যন্ত গিয়েছি আব্বার জন্য, আমার ক্ষমতা অনুযায়ী।

এর মধ্যে আমার যে জন্য ঢাকায় চাকরি নেয়া, তার ফল ফলতে শুরু করেছে। ঢাকায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান থেকে (নাম মনে নেই) ডাক পেলাম একটি মঞ্চ নাটকে অভিনয়ের জন্য। ডাক পেলাম প্রকৌশলী গোলাম রাব্বানীর মাধ্যমে। নাটক-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিসর্জন। চরিত্র : রাজা গোবিন্দ মানিক্য)। এর আগে রবীন্দ্রনাথের একটি নাটকেই অভিনয় করার সুযোগ হয়েছিল— শেষ রক্ষা, বুয়েটের বার্ষিক নাটক, আমার ফাইনাল ইয়ারে পড়ার সময়। মঞ্চ ছিল— ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ার্স। এই অডিটোরিয়ামের মঞ্চেই আমার ঢাকায় প্রথম অভিনয় ছিল। প্রথমবর্ষের ছাত্র হিসেবে সুযোগ পেয়েছিলাম অভিনয়ে ধনঞ্জয় বৈরাগীর লেখা এক মুঠো আকাশ নাটকে। পরিচালনা করেছিলেন তখনকার সময়ের নামী পরিচালক ও অভিনেতা ওবায়দুল হক সরকার। ওই সময় ঢাকা ওয়াসার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারসন্স কর্পোরেশন। তাদের অফিসটি ছিল মতিঝিলের সিরাজ বিল্ডিং-এর চার তলায়। প্রজেক্টের কাজের আলাপ আলোচনায় প্রায়ই আমাকে সেখানে যাতায়াত করতে হতো, তা ছাড়া আমাদের প্রধান কার্যালয়ও ছিল সেখানে।

পারসন্সে বড়ুয়াবাবু বলে একজন সিনিয়র প্রকৌশলী কাজ করতেন— তিনিই গোলাম রাব্বানীর মাধ্যমে আমাকে বিসর্জন নাটকে অভিনয়ের জন্য আহ্বান করেছিলেন। এসময়ই আবার যোগাযোগ ঘটলো আর এক প্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়া কিছু বিশেষ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে।

‘আমরা একটা নাটক করছি, তুমি করবে?’

গোলাম রাব্বানী আমাকে একদিন বললেন।

তাঁর সাথে গিয়ে দাঁড়ালাম এ দেশের বৃহত্তর সংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের প্রবেশদ্বারে, বাংলাদেশের পথিকৃত নাট্যদল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের জন্মলগ্নের সিদ্ধান্ত সভায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *