১১. হোটেল লুমুম্বা

১১

আমি আধ ঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে নিলাম। ফেলুদা বলেছিল নীচে থাকবে, যাতে টেলিফোন এলে তৎক্ষণাৎ রিসেপশন থেকেই কথা বলতে পারে। গিয়ে দেখি ও পায়চারি করছে। বলল, ‘এখনও ফেরেনি ডাঃ দিবাকর। মুশকিল হচ্ছে কী, কোথায় যে গেছেন, সেটাও বাড়ির লোকে জানে না।’

‘আর বাটরা?’

‘বাটরার লাইনটা পাচ্ছি না। আরও বার-দুয়েক দেখি। না হলে ব্রেকফাস্টের পর সোজা চলে যাবো ওর আপিসে। এমনিতেও একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে।’

মিনিট তিনেকের মধ্যেই লালমোহনবাবু এসে হাজির। কোনও তাপ-উত্তাপ নেই, যেন অস্বাভাবিক কিছুই ঘটেনি। তবে আমার সঙ্গে যে সামান্য কথাবার্তা হল তাতে বুঝলাম যে চিনি এখনও সম্পূর্ণ হজম হয়নি।

রিসেপশনের দেওয়ালে টাঙানো একটা নেপালি মুখোসের নাকের উপর বার তিনেক হাত বুলিয়ে বললেন, ‘ইংলন্ডের রাজপ্রাসাদের নামটা কী যেন ভাই তপেশ?’

‘বাকিংহাম প্যালেস?’

‘ইয়েস,’ বললেন লালমোহনবাবু, তবে এর সঙ্গে বোধহয় কমপ্যারিজন হয় না।’

‘কার সঙ্গে?’

‘আমাদের এই হোটেল লুমুম্বা।’

‘লুম্বিনী।’

‘লুম্বিনী।’

তারপর একটুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘এইখানেই তো জন্মেছিলেন, তাই না?’

‘কে?’

‘গৌতম বুদ্ধ?’

‘এই হোটেলে নয় নিশ্চয়ই।’

‘কেন, বিফোর ক্রাইস্ট হোটেল ছিল না বলছ?’

এই অদ্ভুত আলোচনা আর বেশিক্ষণ চলল না, কারণ ফেলুদা এসে বলল যে চটপট ব্রেকফাস্ট সেরে বাটরার আপিস সান ট্র্যাভেলসে যাওয়া দরকার, ওদের টেলিফোনে পাওয়া যাচ্ছে না।

ফেলুদার দেখাদেখি আমরাও শুধু কফিতে ব্রেকফাস্ট সারলাম। মন বলছে আজ অনেক কিছু ঘটবে, কিন্তু কী ঘটবে সেটা বুঝতে পারছি না।

আমাদের হোটেল থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ মিঃ বাটরার আপিস। বেশি বড় না হলেও, বেশ ছিমছাম আপিস, দেখেই বোঝা যায় বয়স বছরতিনেকের বেশি না। এক দেওয়ালে নেপালের রাজা-রানীর ছবি, আর অন্য দেওয়ালে যার ছবি—বুঝলাম সে-ই এই আপিসের মালিক মিঃ রাণা।

আপিসে এসে যে খবরটা পেলাম সেটাকে একটা বমশেল বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না।

বাটরার ঘরে গিয়ে দেখি তিনি নেই, রয়েছেন তাঁর সেক্রেটারি মিঃ প্রধান। তাঁর কাছেই জানলাম যে মিঃ বাটরাকে হঠাৎ বেরিয়ে যেতে হয়েছে।

‘এ ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট পারসন আজ সকালে ফোন করলেন মিঃ বাটরাকে,’ বললেন মিঃ প্রধান। ‘বললেন তেরাইতে আমাদের নতুন বাংলোটা দেখার খুব ইচ্ছা। তাই মিঃ বাটরাকে ওঁর সঙ্গে চলে যেতে হল। অবিশ্যি উনি ইনস্ট্রাকশন দিয়ে গেছেন যে আপনার গাড়ি লাগলে যেন তার ব্যবস্থা আমরা করে দিই। তার কোনও ডিফিকাল্টি হবে না।’

‘এই ইস্পর্ট্যান্ট পারসনটির নাম জানতে পারি কি?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

‘সার্টেনলি। মিঃ মেঘরাজ। ওবেরয় হোটেলে আছেন। ভেরি বিগ আর্ট ডিলার।’

লালমোহনবাবু আমার হাতটা খপ্ করে ধরলেন। বুঝলাম মেঘরাজের নামেই ওর নেশা ছুটে গেছে। সত্যিই, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়। মিঃ বাটরা যে এত সহজেই মগনলালের ফাঁদে পড়ে যাবেন সেটা ভাবতে পারিনি।

‘এখান থেকে আপনাদের বাংলোয় যেতে কতক্ষণ লাগে?’ ফেলুদা জিগ্যেস করল।

‘আপনাকে যেতে হবে ত্রিভুবন রোড দিয়ে হেতাওরা—১৫০ কিলোমিটার। হেতাওরা ইজ এ টাউন—ওখানে আপনি লাঞ্চ করে নিতে পারেন। কারণ আমাদের বাংলো নতুন, সেখানে কিচেন চালু হয়নি এখনও। টাউন থেকে ডাইনে ঘুরে রাপ্তি নদীর পাশ দিয়ে তিন কিলোমিটার গিয়ে আরও ডাইনে দু’ ফার্লং গিয়েই বাংলো। জঙ্গলের মধ্যে—বিউটিফুল স্পট।’

ফেলুদা আধঘণ্টা পরে হোটেলে গাড়ি পাঠাতে বলে দিল। ওকে একবার নাকি চট করে দরবার স্কোয়ারের দিকে ঘুরে আসতে হবে। বলল, ‘তোরা হোটেলে ফিরে গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা কর। আমার বিশ-পঁচিশ মিনিটের বেশি লাগবে না।’

গাড়ি এল কুড়ি মিনিটের মধ্যে, আর ফেলুদা পঁচিশে। বলল, ওকে নাকি একবার ফ্রিক স্ট্রিট যেতে হয়েছিল। ‘সেটা আবার কোথায়?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘কাছেই,’ বলল ফেলুদা, ‘বলা যেতে পারে হিপি-পাড়া।’

পাঁচ মিনিটের মধ্যে শহর ছাড়িয়ে ত্রিভুবন রোড ধরল আমাদের ট্যাক্সি। ফেলুদার হাতে খাতা, চোখে ভ্রূকুটি, বাইরের দৃশ্য সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন। লালমোহনবাবুর নেশা ছুটে গেলেও, একটা আশ্চর্য মোলায়েম ভাব লক্ষ করছি ওঁর মধ্যে যেটা আগে কখনও দেখিনি। মনে হয় যেন এ সব সাময়িক উত্তেজনার অনেক ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন তিনি। জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখে শুধু একটা মাত্র মন্তব্য করলেন—

‘কাল সব ডবল দেখছিলাম, আজ সিঙ্গল।’

ফেলুদা কথাটা শুনে খাতা থেকে মুখ তুলে লালমোহনবাবুর দিকে কেমন যেন অন্যমনস্কভাবে চেয়ে থেকে বলল, ‘এটাও যেমন ঠিক, তেমন এর উল্টোটাও ঠিক।’

কথাটা আমার কাছে ভীষণ রহস্যজনক বলে মনে হল।

কাঠমাণ্ডুর চার হাজার ফুট থেকে আরও অনেক উপরে উঠে এসেছি। তিন পাশ ঘিরে বরফের চুড়ো দেখা যাচ্ছে। আগেই জানতাম যে সাড়ে সাত হাজার ফুট অবধি উঠতে হবে তাই ঝোলাতে করে গরম মাফলার নিয়ে নিয়েছিলাম। ঘণ্টা দেড়েক চলার পর সেগুলোর প্রয়োজন হয়ে পড়ল। সঙ্গে ফ্লাস্কে কফি ছিল, গাড়ি চালু অবস্থাতেই তিনজন খেয়ে নিলাম।

অল্পক্ষণের মধ্যেই নামা শুরু হয়ে গেল। ন্যাড়া মহাভারত পর্বতশ্রেণী ছাড়িয়ে আমরা এখন ঘন সবুজে ঢাকা শিবালিক পর্বতশ্রেণীর দিকে চলেছি। অত দূর যেতে হবে না আমাদের, কারণ মাঝপথেই পড়বে রাপ্তি উপত্যকায় নদীর পাশে হেতাওরা শহর। সেইখান থেকে ত্রিভুবন রাজপথ ছেড়ে ডানদিকে ঘুরব আমরা।

‘তোপসে—বাটরার পুরো নামটা জানিস?’

হাতের খাতাটা বন্ধ করে হঠাৎ প্রশ্ন করল ফেলুদা।

আমি বললাম, ‘না তো, উনি তো কোনওদিন বলেননি।’

‘না বললেও তোর জানা উচিত ছিল,’ বলল ফেলুদা, ‘ওর আপিসের ঘরে ওর টেবিলের উপর একটা প্লাস্টিকের ফলকে লেখা ছিল পুরো নামটা। অনন্তলাল বাটরা।’

হেতাওরা যখন পৌঁছলাম তখন দুটো বেজে গেছে। খিদে পাবার কথা, কিন্তু পায়নি। একেকটা অবস্থায় পড়লে মানুষ খিদে-তেষ্টা ভুলে যায়, এটা সেই অবস্থা। লালমোহনবাবুকে জিজ্ঞেস করাতে বললেন, ‘ফুড ইজ নাথিং।’

ড্রাইভার রাস্তা জানে, সে ত্রিভুবন রোড ছেড়ে ডানদিকে ঘুরল। একটা সাইন বোর্ড দেখে বুঝলাম যে, এই রাস্তা দিয়েই ট্রি-টপস হোটেলে যায়, যেখানে গাছের মাথায় বসানো হোটেলের বারান্দায় বসে তেরাই-এর বন্য জানোয়ার দেখা যায়। আমাদের বাংলো অবিশ্যি পড়বে তার অনেক আগেই।

বাঁদিক দিয়ে রাপ্তি নদী ছুটে চলেছে পাথর ভেঙে দু’ দিকের ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। আমাদের রাস্তারও ডানদিকে ঘন শালবন। মন বার বার বলছে, এই হল সেই তেরাই, সেই গায়ে কাঁটা দেওয়া অরণ্যভূমি, হিংস্র জানোয়ারের ডেরা হিসেবে যার আর জুড়ি নেই। সিপাহি বিদ্রোহের পর নানাসাহেব তার দলবল নিয়ে ভারতবর্ষ থেকে পালিয়ে এসে এই তেরাইয়েরই এক অংশে গা ঢাকা দিয়ে ছিল।

রাস্তা আবার ডাইনে মোড় নিল। এটা কাঁচা, হালে তৈরি হয়েছে।

এই রাস্তা ধরে মিনিট তিনেক চলেই লাল টালির ছাতওয়ালা কালো কাঠের বাংলোটা চোখে পড়ল। বনের গাছ কেটে বেশ কিছুটা জায়গা সাফ করে কম্পাউন্ডে ঘেরা বাংলোটা তৈরি হয়েছে।

ডাইনে ঘুরে বাংলোর গেট দিয়ে ঢুকে নুড়ি ফেলা পথের উপর দিয়ে শব্দ তুলে আমাদের গাড়ি বাংলোর বারান্দার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বাঁয়ে কিছুটা দূরে কম্পাউন্ডেরই ভেতর দুটো পাশাপাশি গ্যারাজের সামনে আর একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।

গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গে জায়গাটার আশ্চর্য নিস্তব্ধতার একটা আন্দাজ পেয়েছি। ঝিঁঝির শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। না, সেটা ঠিক না। একটা সামান্য খুটখাট শব্দ কোথেকে আসছে সেটা বুঝতে পারছি না।

আমাদের গাড়ির ড্রাইভার অন্য গাড়িটার দিকে চলে গেল, আমরা তিনজন তিন ধাপ সিঁড়ি ভেঙে জাল দেওয়া দরজাটা খুলে বারান্দায় গিয়ে ঢুকলাম।

‘ভিতরে আসুন মিঃ মিত্তর!’

সামনের ঘরটাই বৈঠকখানা, তার ভিতর থেকেই ডাকটা এসেছে। মগনলালের পালিশ করা গম্ভীর গলাটা চিনতে অসুবিধা হয় না।

আমরা তিনজন গিয়ে বৈঠকখানায় ঢুকলাম।

ঘরের তিন দিকে সোফা, মাঝখানে একটা বড় গোল টেবিল, দেওয়ালে বাঁধানো নেপালের দৃশ্য, মেঝেতে তিব্বতি কার্পেট। এ ছাড়া পাশে একটা টেবিলের উপর একটা রেডিয়ো রয়েছে। আর এক কোণে একটা বুক শেলফে কিছু বই আর পত্রিকা।

আমাদের ঠিক সামনের সোফাটায় এক ধারে বসে মগনলাল একটা টিফিন ক্যারিয়ার থেকে পুরি আর তরকারি খাচ্ছে। একজন চাকর পাশে দাঁড়িয়ে আছে জলের জাগ আর গামলা হাতে নিয়ে।

এ ছাড়া আর কোনও তৃতীয় ব্যক্তি নেই।

‘আমি জানতাম আপনি আসবেন,’ খাওয়া শেষ করে ভেজা তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে বললেন মগনলাল। আমরা তিনজনে ইতিমধ্যে বসে পড়েছি।

‘আপনি কী ব্যাপারে এসেছেন, সেটা আমি জানি মিঃ মিত্তর। বাট দিস টাইম ইট ইজ মাই টার্ন। ঘুঘুতে বার বার খাবে না দানা, খাবে কি?’

ফেলুদা নির্বাক।

‘বেনারসে আপনি যে বেইজ্জত করলেন আমাকে,’ বললেন মগনলাল, ‘সে তো আমি ভুলিনি মিঃ মিত্তর। বদলা নেবার মওকা যদি আপনি দিয়ে দেন, বদলা আমি নেব না?’

একটা ধপ ধপ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি মাঝে মাঝে এই বাংলোরই কোনও অংশ থেকে। মনে হচ্ছে, ডানদিকের কোনও ঘর থেকে আসছে। কীসের শব্দ বোঝা মুশকিল।

‘মিঃ বাটরা কোথায় সেটা জানতে পারি কি?’

মগনলালের হুমকি অগ্রাহ্য করে শান্তভাবে জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।

মগনলাল আপসোসের ভঙ্গিতে চুক্ চুক্ করে শব্দ করে বললেন, ‘ভেরি স্যাড, মিঃ মিত্তর। আমি তো কাল বললাম আপনাকে—জগ্‌দীশ আমার রাইট হ্যান্ড ম্যান। রাইট হ্যান্ড তো একটাই থাকে মানুষের—দোনো কা কেয়া জরুরত?’

‘আপনি কিন্তু আমার কথার জবাব দিলেন না। আমি জানতে চাই সে ভদ্রলোক কোথায়?’

‘বাটরা জিন্দা আছে মিঃ মিত্তর,’ শেরওয়ানির পকেট থেকে পানের ডিবে বার করে দুটো পান মুখে পুরে দিয়ে বললেন মগনলাল—‘ডে টাইমে হি উইল বি সেফ। তেরাই-এর বেপার তো আপনি জানেন। গরমিন্ট ল আছে কী এখানে ওয়াইলড লাইফ মারা চলবে না, লেকিন ওয়াইলড লাইফ যদি মানুষ মারে, দেন হোয়াট? সেটার এগনেস্টে কোনও ল আছে কি?’

‘আপনি যে এখানে চলে এলেন, কাঠমাণ্ডুতে আজ কী হচ্ছে সেটা আপনি জানেন?’

‘কী হচ্ছে মিঃ মিত্তর?’

‘আপনার পাটনের কারখানা আর কাঠমাণ্ডুর শুয়োর গলির গুদোম আজ তছনছ হয়ে যাচ্ছে।’

মগনলাল সমস্ত দেহ দুলিয়ে অট্টহাসি করে উঠলেন।

‘আপনি কি ভাবেন আমি এত বুদ্ধ মিঃ মিত্তর? পোলিস উইল ফাইন্ড নাথিং, নাথিং। পাটনে দেখবে হ্যান্ডিক্রাফট তৈয়ার হচ্ছে, আউর শুয়ার গলিতে দেখবে গুদাম খালি! সব মাল লরিতে করে আমি সঙ্গে নিয়ে এসেছি মিঃ মিত্তর। হেতাওরা দিয়ে লরিতে মাল যায় ইন্ডিয়া। টিম্বার। সেই লরিতে করে সব দাওয়াই চলে যাবে বিহার, ইউ পি। ওষুধের অনেক কাম তো আমার ইন্ডিয়াতেই হয়। লেবেল, ক্যাপসুল, অ্যামপুল, ক্যাপ, ফায়াল, সবই তো ইন্ডিয়া থেকে আসে। বাকি কাম হয় এখানে, বিকজ এখানের লোক ইন্ডিয়ার লোকের চেয়ে কাম করে বেশি। অ্যান্ড বেটার।’

আমার কানটা খুব ভাল বলেই বোধহয় ঝিঁঝির ডাক ছাপিয়ে আরেকটা আওয়াজ শুনতে পেলাম। ফেলুদার ঘাড়টা এক মুহূর্তের জন্য একবার সামান্য বাঁদিকে ঘুরতে বুঝলাম সেও আওয়াজটা পেয়েছে।

‘জগ্‌দীশ!’

বুঝলাম মগনলাল কথা শেষ করে কাজে চলে এসেছেন।

ডান পাশের ঘর থেকে ফুলকারি করা পর্দা ফাঁক করে যিনি আমাদের ঘরে এসে ঢুকলেন, তার বাঁ হাতে ধরা রিভলভারটা সোজা ফেলুদার দিকে তাগ করা রয়েছে।

‘উঠুন আপনারা তিনজন!’ মগনলাল হাঁকিয়ে হুকুম দিলেন।

আমরা উঠলাম।

‘হাত তুলুন মাথার উপরে।’

তুললাম।

‘গঙ্গা! কেস্‌রী!’

আরও দু’জন লোক—তাদের ঠিক ভদ্র বলা যায় না—পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে সোজা আমাদের তিনজনকে সার্চ করে ফেলুদার পকেট থেকে ওর কোল্ট রিভলভারটা বার করে মগনলালের কাছে দিয়ে দিল।

রিভলভারধারী জগদীশ ভদ্রলোকটিকে দিনের আলোতে দেখেও বাটরার সঙ্গে যে তফাতটুকু পেয়েছিলাম, তার চেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে না।

ডানদিক থেকে আবার সেই ধুপ ধুপ শব্দটা শোনা গেল। এবার মগনলাল সেদিকে একটা বিরক্ত দৃষ্টি দিয়ে বললেন, ‘ভেরি স্যরি মিঃ মিত্তর, আপনার আর একজন ফ্রেন্ডকেও এখানে নিয়ে এসেছি আমি। উনি আমাদের ওষুধ নিয়ে ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করে ঝামেলা করছিলেন। ন্যাচারেলি ওনাকে রোকে দিতে হল।’

‘উনিও কি বাঘের পেটে যাবেন?’

‘নো নো মিঃ মিত্তর,’ হেসে বললেন মগনলাল, ‘ওনাকে দিয়ে আমার অন্য কাম হবে। একজন ডকটর হাতে রাখলে সুবিধা হবে আমার, মিঃ মিত্তর। আমার নিজের হার্ট খুব ভাল নেই, সেটা আপনি বোধহয় জানেন না।’

‘তা হলে চরণামৃততে কাজ দিল না?’

মগনলাল এ কথার কোনও উত্তর দেবার আগেই গঙ্গা ও কেশরী নামে দুটো ষণ্ডা মাকা লোক লম্বা লম্বা দড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকে সোজা আমাদের দিকে এগিয়ে আসতেই পর পর এমন কতকগুলো ঘটনা ঘটে গেল যে সেগুলো লিখে বোঝানো খুবই কঠিন। তাও আমি চেষ্টা করছি—

প্রথমে বাইরে একটা গাড়ির শব্দতে জগদীশ ভদ্রলোক খচ্‌ শব্দে রিভলভারটার সেফ্‌টি ক্যাচ্‌টা খুলে ফেলুদার দিকে টান করে বাড়াতেই কিছু বোঝার আগেই দেখলাম ফেলুদার ডান পা-টা একটা হাই কিক্ করে রিভলভারটাকে ভদ্রলোকের হাত থেকে ছিটকে বার করে দিল, কিন্তু তার আগে ট্রিগারের চাপ পড়ে যাওয়াতে তার থেকে সশব্দে একটা গুলি বেরিয়ে বন্ধ সিলিং ফ্যানের ব্লেডের কিনারে লেগে সেটাকে ঘোরাতে আরম্ভ করে দিল।

এরই মধ্যে কখন যে ঘরে এত লোক ঢুকে পড়েছে জানি না। এদের কাউকেই চিনি না, কিন্তু বুঝতে, পারছি এরা সবাই পুলিশের লোক। আর তার মধ্যে কিছু নেপালের আর কিছু আমাদের পশ্চিমবাংলার। এদেরই একজন খপ করে ধরে ফেললেন জগদীশকে, যিনি পিছনের দরজা দিয়ে পালাতে গিয়েছিলেন।

মগনলাল সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, তার চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে।

‘খবরদার! আমার গায়ে কেউই হাত দিবেন না! খবরদার!’

‘আপনার ব্যাপারে পরে আসছি মগনলালজি,’ বলল ফেলুদা, ‘আগে এনারটা ফয়সালা হয়ে যাক।’

ফেলুদার দৃষ্টি ঘুরে গেছে পুলিশের হাতে বন্দি জগদীশের দিকে।

‘আপনার বাঁ হাতের তর্জনীটা এতক্ষণ রিভলভারের ট্রিগারে ছিল বলে দেখতে পাইনি,’ বলল ফেলুদা, ‘এখন দেখছি তর্জনীতে বেগুনি কালির দাগ। আপনি কি এখনও সেই লিক-করা কলমটাই ব্যবহার করছেন, মিঃ বাটরা?’

‘আপনি মুখ সামলে কথা বলবেন মিঃ মিত্তর,’ ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে উঠলেন মগনলাল, ‘জগ্‌দীশ ইজ মাই—’

‘জগদীশ না, বাটরা—অনন্তলাল বাটরা—ইজ ইওর রাইট হ্যান্ড ম্যান। জগদীশ বলে কেউ নেই, নকল বাটরা নেই, লোক একজনই। একটু চাপ দিলেই উনি চোখের কনট্যাকট লেনস্ দুটো খুলে ফেলবেন, তা হলেই কটা ভাবটা চলে যাবে। আর মিঃ বাটরা বোধহয় জানেন না যে তিনি আজ ভোরে চলে আসার পর তার বাড়িতে সার্চ হয়েছিল, এবং একটি চোরা কুঠরি থেকে বেশ কিছু জাল একশো টাকার নোট পাওয়া গেছে—যেগুলো আপনার ওই জাল ওষুধের কারখানাতেই ছাপানো হত।’

নেপাল পুলিশের একজন অফিসার এক বাণ্ডিল একশো টাকার নোট বার করে ধরলেন আমাদের সামনে। বাটরার মুখ ব্লটিং পেপার। ফেলুদা বলল—

‘আপনি একটা কাঁচা কাজ করে ফেলেছিলেন কলকাতায়, মিঃ বাটরা। আপনি যে জাল নোটটা দিয়েছিলেন সেই কুকরির দোকানে, সেটা আর ফেরত নেননি। কারণ একবার যখন বলেছেন সেটা আপনি দেননি, তখন আর সেটা ফেরত নেওয়া যায় না। ফলে সেটা দোকান থেকে পুলিশের হাতে চলে আসে। এখন দেখা যাচ্ছে সে নোটের নম্বর আর আজ আপনার বাড়িতে পাওয়া নোটের নম্বর এক!’

বাটরার শেষ অবস্থা, কিন্তু মগনলাল এখনও তম্বি করে চলেছে।

‘আমি ফের বলছি মিস্টার মিত্তর, আমি—’

‘আপনি বড্ড বেশি বকছেন,’ বাধা দিয়ে বলল ফেলুদা, ‘আপনার বুকনিটা বন্ধ করা দরকার। তোপসে, তোরা দু’জনে চেপে ধর তো লোকটাকে।’

আমি তো এ সব পারিই, কিন্তু লালমোহনবাবুর মধ্যেও যে হঠাৎ এতটা এনার্জি এসে যাবে সেটা ভাবতে পারিনি। দুই রাজ্যের পুলিশ হল দর্শক, আর তার মধ্যে আমাদের এই নাটক।

দু’জনের কম্বাইন্ড ঠেলা আর চাপে মগনলাল সোফার সঙ্গে সিঁধিয়ে গেলেন। ফেলুদা এর মধ্যে ওর পকেট থেকে দুটো জিনিস বার করেছে, তার একটা ভদ্রলোকের হাঁসফাঁসানির ফাঁকে তার মুখের ভেতর চলে গেল। এটা হল একটা শুগার কিউব। বুঝলাম এটা আজই সকালে ফ্রিক স্ট্রিটের হিপিদের কাছ থেকে জোগাড় করে এনেছে ফেলুদা। দ্বিতীয় জিনিসটা হল একটা স্কচ টেপ, যেটা থেকে চড়াৎ করে খানিকটা অংশ ছিঁড়ে ফেলুদা সেটা দিয়ে মগনলালের ঠোঁট দুটো সিল করে দিল।

সব শেষে একটা সিগারেট কেসের মতো দেখতে জিনিস বার করে নেপাল পুলিশ অফিসারের হাতে দিয়ে ফেলুদা বলল, ‘এই মিনি-ক্যাসেট রেকর্ডারটা এই ঘরে ঢুকবার আগেই আমি পকেটে চালু করে দিয়েছিলাম। এতে আপনারা এই ভদ্রলোকের জাল ওষুধের কারবার সম্বন্ধে ওঁর নিজেরই বলা অনেক তথ্য পাবেন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *