০৮. পুরনো অ্যাডভেঞ্চারগুলো সম্বন্ধে আলোচনা

কলকাতায় আমাদের বাড়িতে বসে আমি আর ফেলুদা অনেক সময় আমাদের পুরনো অ্যাডভেঞ্চারগুলো সম্বন্ধে আলোচনা করেছি, বিশেষ করে তাদের সম্বন্ধে, যাদের শয়তানি বুদ্ধি ফেলুদাকেও মাঝে মাঝে প্যাচে ফেলে দিয়েছিল। লখ্‌নউ-এর বনবিহারী সরকার, কৈলাসের মূর্তি চোর, সোনার কেল্লার বর্মন আর মন্দার বোস, মিঃ গোরে, কাশীর মগনলাল মেঘরাজ—এরা সব কোথায়? কী করছে? ভোল পাল্টে সৎপথে চলছে, না শয়তানির মওকা খুঁজছে? নাকি অলরেডি আরম্ভ করে দিয়েছে শয়তানি?

এসবগুলো এত দিন শুধু প্রশ্নই ছিল; শেষে কাঠমাণ্ডুতে এসে এই পুরনো আলাপীদের একজনের সঙ্গে দেখা হয়ে নেগেটিভ-পজিটিভের ঠোকাঠুকিতে যে বিস্ফোরণের সৃষ্টি হবে, সেটা কে জানত?

পাটন থেকে ফিরে ইন্দিরা রেস্টোরান্টে লাঞ্চ খেয়ে (এদের মেনুতে মোমো ছিল না) প্রায় তিনটে নাগাদ হোটেলে ফিরে দেখি ফেলুদা খাটে শুয়ে সদ্য-কেনা একটা ইংরিজি বই পড়ছে, নাম ‘ব্ল্যাক মার্কেট মেডিসিন’। আমাদের দিকে চোখ পড়তেই চোখ কপালে উঠে গেল।

‘ব্যাপার কী? খুব ধকল গেছে বলে মনে হচ্ছে?’

দু’জনে ভাগাভাগি করে পাটনের পুরো ঘটনাটা বললাম। জানতাম ফাঁকে ফাঁকে অনেক প্রশ্ন গুঁজে দেবে ফেলুদা। বেশ বুঝতে পারছি আমরা দু’জনে মিলে আজ একটা জবরদস্ত কাজ করে এসেছি। কেন তা ঠিক বলতে পারব না, সমস্ত বাড়িটার মধ্যে যেন জালিয়াতির একটা গন্ধ ছড়িয়ে ছিল। অথচ বাইরে থেকে দেখলে প্রাচীন পাটনের ইমারতি আর কাঠের কাজের তারিফ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।

সব শুনে-টুনে ফেলুদা ‘সাবাস’ বলে আমাদের দু’জনেরই পিঠ চাপড়ে দিল।

‘গোয়েন্দাগিরিতে বীরচক্র থাকলে আমি তোদের দু’জনেরই নাম রেকমেন্ড করতাম। কিন্তু আপনি যে জিনিসটা দিয়ে বাজিমাত করলেন, সেটা একবার দেখান!’

লালমোহনবাবু হালকা মেজাজে থলি থেকে জপযন্ত্রটা তুলে ধরে দেখালেন।

‘ওর মধ্যে মন্ত্র পোরা আছে কি না সেটা দেখেছেন?’

‘আজ্ঞে?’

‘ওম্ মণি পদ্মে হুম্।’

আজ্ঞে?’

‘ওম্—মণি—পদ্মে—হুম্। তিব্বতি মহামন্ত্র। এই মন্ত্রটা একটা কাগজে হাজার বার লিখে অথবা ছেপে প্রত্যেকটা জপযন্ত্রে পুরে দেবার কথা।’

‘পুরে দেবে? কোথায় পুরে দেবে?’

‘ওই ওপরের জিনিসটা তো একটা কৌটো। ওটার মাথাটা তো ঢাকনার মতো খুলে যাবার কথা।’

‘তাই বুঝি?’

লালমোহনবাবু একটা মোচড় দিতেই মাথাটা খুলে এল।

‘উঁহু—নো সাইন অফ মন্ত্র।’

‘ভেতরে কিচ্ছু নেই?’

লালমোহনবাবু আর একবার ভেতরটা দেখলেন আলোর কাছে এনে।

‘নাথিং। —না না, দেয়ার ইজ সামথিং। কীসের যেন গুঁড়ো চক্‌চক্‌ করছে।’

‘কই দেখি!’

এবার ফেলুদা ভাল করে দেখল ভেতরটা। তারপর ল্যাম্পের পাশে বেডসাইড টেবিলের উপর উপুড় করে ধরল কৌটোটা।

‘কাচ। কাচের টুকরো।’

‘একটা বড় টুকরো রয়েছে, ফেলুদা।’

‘দেখেছি।’

‘মনে হয় একটা ছোট্ট পাইপ জাতীয় কিছুর অংশ।

ফেলুদা মাথা নাড়ল।

‘পাইপ নয়। অ্যামপুল। অসাবধানে ভেঙে ফেলাতে এই পুরো জিনিসটাকে বাতিল করে দিয়েছে।’

‘তার মানে বলছেন এই জপযন্ত্রের মধ্যে জাল ওষুধ চালান হত?’

‘কিছুই আশ্চর্য না। জপযন্ত্রের ভিতর পুরে প্যাকিং কেসে করে জমা হত পিগ অ্যালির তিব্বতি দোকানের দোতলায়। সেখান থেকে নিশ্চয়ই চলে যেত হোলসেলারদের কাছে। তারপর সেখান থেকে দাওয়াখানায়। যে বাক্সগুলো কাল ওই হোটেলের ঘর থেকে দেখেছিলি, আর আজ টেম্পোতে যে বাক্সগুলো তুলছিল—সে কি একই রকম?’

‘আইডেনটিক্যাল,’ উত্তর দিলেন জটায়ু।

‘বুঝেছি’—ফেলুদার কপালে ত্রিশূলের মতো দাগ—‘সাপ্লাইয়ের ব্যাপারটা তদ্বির করছে নকল বাটরা। আর ব্যাপারটা যদি বড় স্কেলে হয়, তা হলে হয়তো বেশ কিছু মাল চলে যাচ্ছে সীমানা পেরিয়ে ভারতবর্ষে। বিহার, ইউ পি-র ছোট ছোট শহরে কত লোক এই ভেজাল ওষুধ খায় আর ভেজাল ইনজেকশন ব্যবহার করে তার হিসেব কে রাখছে? ডাক্তারের সন্দেহ হলেও সে যে সোরগোল তুলবে না সে তো দেখাই গেল। এই যুগটাই যে ওই রকম। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা!’

ফেলুদা খাট থেকে উঠে কিছুক্ষণ বেশ তেজের সঙ্গে পায়চারি করে নিল। লালমোহনবাবু আবার জপযন্ত্রে ঢাকনা পরিয়ে সেটা হাতে নিয়ে ঘোরাচ্ছেন। ফেলুদার অ্যাডভেঞ্চারে অনেক সময়ই তিনি কেবল দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন; আজ তিনি যাকে বলে স্বয়ং রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ।

ঘড়িতে দেখি পৌনে চারটে। আমি লালমোহনবাবুকে মনে করিয়ে দিলাম যে এতক্ষণে তাঁর প্যান্ট রেডি হয়ে থাকার কথা।

‘এইদ্দ্যাখো! ভুলেই গেস্‌লাম।’

ভদ্রলোক এক লাফে সোফা থেকে উঠে পড়লেন। ‘আজ ক্যাসিনো যাচ্ছি তো আমরা? ট্রাউজারটা কিন্তু সেই উদ্দেশ্যেই করানো।’

ফেলুদা পায়চারি থামিয়ে একটা তালি মেরে মন থেকে যেন সমস্ত চিন্তা দূর করে দিয়ে বলল, ‘গুড আইডিয়া। আজকে উই ডিজার্ড এ হলিডে। ডিনারের পরে এক ঘণ্টা ক্যাসিনোয় যাপন।’

অবিশ্যি ক্যাসিনো-পর্ব এক ঘণ্টায় শেষ হয়নি। কেন হয়নি সেটা জানতে হলে আর একটু ধৈর্য ধরতে হবে।

সাড়ে আটটার মধ্যে ডিনার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ক্যাসিনো খোলা থাকে নাকি ভোর চারটে অবধি, আর আসল ভিড়টা হয় এগারোটার পর থেকে। এখন গেলে খানিকটা খালি পাওয়া যাবে।

হোটেলটা শহর থেকে খানিকটা বাইরে। বাসে যেতে যেতে বেশ বুঝতে পারছিলাম যে আমরা লোকালয় ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছি, কারণ রাস্তার আলো ছাড়া আর বিশেষ আলো চোখে পড়ছে না।

মিনিট পনেরো চলার পর খানিকটা চড়াই উঠে একটা গেট পড়ল। তারপর ডাইনে বেশ বড় একটা লন ও সুইমিং পুল পেরিয়ে আবার ডাইনে ঘুরে বাসটা গিয়ে থামল হোটেলের পোর্টিকোর ঠিক আগে একেবারে ক্যাসিনোর প্রবেশদ্বারের সামনে। পেল্লায় হোটেলের এক পাশটায় এই ক্যাসিনো। বুঝলাম যারা বাইরে থেকে আসবে তাদের আর আসল হোটেলে ঢুকতেই হবে না।

আমাদের আজকের হিরো—অন্তত এখন পর্যন্ত—হলেন লালমোহনবাবু। বিদেশি ফিল্মে দেখা আদব-কায়দার কোনওটাই বাদ দেবেন না এমন একটা সংকল্প নিয়েই যেন তিনি ক্যাসিনোতে এসেছেন। অবিশ্যি এসব আদব-কায়দা যে তিনি সব সময় ঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন তা নয়। যেমন, সুইং ডোর দিয়ে ঢুকেই বাঁয়ে কাউনটারের পিছনে যে দুটি বো-টাই পরা ভদ্রলোক বসেছিলেন—যাদের কাছে হোটেল থেকে পাওয়া পাঁচ ডলারের কার্ডটা দেখিয়ে তবে ক্যাসিনোয় ঢুকতে হয়—তাদের দিকে চেয়ে রীতিমতো গলা তুলে ‘হেল্‌লো’ বলাটা ঠিক বিলিতি কেতার মধ্যে বোধহয় পড়ে না। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে যে কাঠমাণ্ডুর টেলার ভদ্রলোকের প্যান্ট বেশ ভালই বানিয়েছে। তার সঙ্গে নিউ মার্কেটে কেনা হালকা সবুজ জার্কিন আর মাথায় নেপালি ক্যাপ—সব মিলিয়ে ভদ্রলোকের মধ্যে বেশ একটা স্মার্টনেসের ভাব এসেছে সেটা স্বীকার করতেই হবে।

কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে গিয়ে তবে আসল ক্যাসিনো। এক জাপানি ভদ্রমহিলা উঠছিলেন সিঁড়ি দিয়ে হ্যান্ডব্যাগ খুলে টাকা ভরতে ভরতে, আর লালমোহনবাবুর দৃষ্টি হাতের কার্ডের দিকে; ফলে দু’জনের মধ্যে একটা কোলিশন লাগত যদি না আমি ভদ্রলোকের জার্কিনের আস্তিনটা ধরে ঠিক সময়ে একটা টান দিতাম। লালমোহনবাবু মহিলার দিকে চেয়ে যেভাবে হেসে। “হেহেকসখিউজ মিহিহি’ বললেন, সেটার দামও লাখ টাকা।

অবিশ্যি যতই কনফিডেনস্-এর ভাব করুন না কেন, খোদ ক্যাসিনোয় ঢুকে চারিদিকের ব্যাপার-স্যাপার দেখে ভদ্রলোককে ফেলুদার শরণাপন্ন হতেই হল। ফেলুদাও তৈরি ছিল ওঁকে উদ্ধার করার জন্য।

‘হাতের কার্ডটায় দেখুন পাঁচ রকম খেলার জন্য পাঁচটা কুপন রয়েছে। আপনার দ্বারা জ্যাকপট ছাড়া আর কিছু খেলা চলবে না: অন্যগুলোর তল পাবেন না। আপনি জ্যাকপটের কুপনটি ছিঁড়ে ওই কাউন্টারে দিন। ওটা হল ক্যাসিনোর ব্যাঙ্ক। আপনাকে এক ডলারের হিসেবে যত টাকা হয় দিয়ে দেবে। বোধহয় এগারো টাকার মতো হবে—নেপালি টাকা। তাতে আপনি এগারোটা চান্স পাবেন জ্যাকপটে। তাতে যদি কিছু মূলধন হয়, তা হলে আরও খেলতে পারবেন। যদি টাকাগুলো যায়, তবে আরও খেলতে হলে ট্যাঁক থেকে দিতে হবে। কখন থামবেন সেটা সম্পূর্ণ আপনার মর্জি। বেশি হারলে কী হয় তার একটা বড় নজির তো রয়েইছে—যুধিষ্ঠির।’

একটা বড় হলঘর আর তার ডানদিকে একটা মাঝারি ঘর মিলিয়ে ক্যাসিনো। বড়টায় পনটুন, ব্ল্যাকজ্যাক, ফ্লাশ আর আসল খেলা রুলেট ছাড়াও কিছু জ্যাকপটের মেশিন রয়েছে, আর ছোটটায় রয়েছে কিনো আর জ্যাকপট। ফেলুদা দেখলাম রুলেটের দিকে এগিয়ে গেল: আমরা গিয়ে ঢুকলাম ডাইনের ঘরে। আমরা দু’জনেই কুপন ভাঙিয়ে টাকা নিয়ে নিয়েছি।

তিনদিকের দেয়ালের সামনে পর পর দাঁড়িয়ে আছে বারো-চোদ্দটা জ্যাকপট মেশিন।

‘ব্যাপারটা খুব সোজা,’ একটা মেশিনের সামনে নিয়ে গিয়ে বললাম লালমোহনবাবুকে, ‘এই দেখুন স্লট। ওয়েইং মেশিনের মতো করে এর মধ্যে টাকা গুঁজে দেবেন। তারপর এই ডাইনের হাতল ধরে টান। তারপর যা হবার আপনিই হবে।’

‘মানে?’

‘জিত হলে মেশিন থেকে টাকা বেরিয়ে এই পাত্রটায় পড়বে, যেমন ওজনে কার্ড পড়ে। হার হলে কিছুই বেরুবে না।’

‘হুঁ…’

‘আপনি একবার ফেলে দেখুন।’

‘দেখব?’

‘হ্যাঁ। গুঁজুন টাকা।’

‘গুঁজলাম।’

একটা ঘড়ঘড় শব্দের পর বোঝা গেল টাকাটা একটা জায়গায় গিয়ে পড়ল, আর সঙ্গে সঙ্গে মেশিনের গায়ে এক লাইন লেখা জ্বলে উঠল—‘কয়েন অ্যাক্সেপটেড।’

‘এবার হাতল টানুন। জোরে।’

লালমোহনবাবু মারলেন টান।

মেশিনের সামনে একটা চৌকো কাচের জানালার পিছনে পাশাপাশি তিনটে তিন-রকম ছবি ছিল—হল্‌দে ফল, লাল ফল, ঘণ্টা। হাতলে টান দিতেই মেশিনের ভিতর থেকে একটা ঘড়ঘড় করে ঘোরার শব্দ শুরু হল আর চোখের সামনে কাচের পিছনের ছবিগুলো বদলাতে বদলাতে সেকেন্ড পাঁচেক পরে ঘট ঘট ঘট শব্দে একটা নতুন কম্বিনেশনে এসে দাঁড়াল। হলদে ফল, হলদে ফল, নীল ফুল।

আর তার পরমুহূর্তেই ঝনাৎ ঝনাৎ করে দুটো টাকা এসে পড়ল পাত্রের মধ্যে।

‘জিতলুম নাকি?’ চোখ গোল গোল করে জিজ্ঞেস করলেন লালমোহনবাবু।

‘জিতলেন বইকী। একে দুই। সে-রকম ভাগ্য হলে একে একশোও হতে পারে। এই দেখুন চার্ট। কোন কম্বিনেশনে কত লাভ হবে এটা দেখালেই বুঝতে পারবেন। ঠিক হ্যায়?’

‘ঔক্কে!’

আমি দুটো মেশিন পরে আমার মেশিনে চলে গেলাম। আরও সাত-আটটা মেশিনের সামনে দেশি-বিদেশি মেয়ে-পুরুষ দাঁড়িয়ে খেলে যাচ্ছে। ঘরের এক পাশে কাউন্টারে একজন লোক বসে আছে, তার কাছে চাইলেই একটা প্লাসটিকের বাটি পাওয়া যায় টাকা রাখার জন্য। আমি দুটো চেয়ে নিয়ে একটা লালমোহনবাবুকে দিয়ে এলাম।

এমন জমাটি ব্যাপার যে, খেলার সময় অন্য কোনও দিকে চাওয়া যায় না, অন্য কিছু ভাবা যায় না, মনে হয় বেঁচে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য হল এই জ্যাকপট। তাও একবার বাঁদিকে আড়চোখে চেয়ে দেখলাম লালমোহনবাবু বাটিতে করে বেশ কিছু টাকা কাউন্টারে নিয়ে গিয়ে সেগুলোর বদলে নোট নিয়ে এলেন।

আমারও জিতই হচ্ছিল, রোখও চেপে গিয়েছিল, এমন সময় ফেলুদা পাশের ঘর থেকে এসে হাজির, সঙ্গে একজন বছর পঁচিশেকের মহিলা।

‘আপাতত কিছুক্ষণের বিরতি,’ বলল ফেলুদা।

‘হোয়াই স্যার?’

বুঝলাম লালমোহনবাবুর মোটেই ভাল লাগল না ফেলুদার প্রস্তাবটা।

‘চারশো তেত্রিশ থেকে ডাক এসেছে।’

‘মানে?’

ভদ্রমহিলাই বুঝিয়ে দিলেন পরিষ্কার বাংলায়।

‘ফোর থাটিথ্রিতে আপনাদের একজন বন্ধু রয়েছেন। তিনি বিশেষ করে অনুরোধ করেছেন একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে।’

‘হু ইজ দিস ফ্রেন্ড?’

লালমোহনবাবু এখনও পুরো ক্যাসিনোর মেজাজে রয়েছেন।

‘নাম বললেন না, তবে বললেন আপনারা তিনজনেই খুব ভাল করে চেনেন?’

‘চলুন চট্ করে দেখাটা সেরে আসি,’ বলল ফেলুদা, ‘কৌতূহলও হচ্ছে, তা ছাড়া মিনিট দশেকের বেশি থাকার তো কোনও প্রয়োজন নেই।’

অগত্যা খেলা থামিয়ে রওনা দিলাম এই অজানা বন্ধুর উদ্দেশে। ভদ্রমহিলা লিফ্‌টের মুখ অবধি এসে নমস্কার করে চলে গেলেন।

চার তলায় লিফ্‌ট থেকে বেরিয়ে বাঁয়ে কার্পেট মোড়া প্যাসেজ ধরে একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে ডানদিকে ৪৩৩ নম্বর ঘর। ফেলুদাই বেল টিপল।

‘কাম ইন।’

দরজাটা লক্ করা ছিল না; ঠেলতেই খুলে গেল। ফেলুদাকে সামনে নিয়ে ঢুকলাম আমরা।

বিশাল বৈঠকখানায় একটা মাত্র ল্যাম্প জ্বলছে। ঘরের এক প্রান্তে একটা সোফায় যিনি বসে আছেন, তার ঠিক পিছনেই ল্যাম্পটা জ্বলছে বলে ভদ্রলোকের মুখ ভাল করে বোঝা যাচ্ছে না। বাইরে থেকে মনে হয়েছিল ঘরে আরও লোক, কারণ কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছিলাম। এখন দেখলাম ভদ্রলোকের উল্টেদিকে একটা টেলিভিশনের পাশে আরেকটা যন্ত্র। রঙিন অ্যামেরিকান ছবি হচ্ছে টিভিতে, দেখে বুঝলাম ভিডিও চলছে। ফিল্মের কথাবার্তাই শোনা যাচ্ছিল বাইরে থেকে।

‘আসুন মিঃ মিত্তর, আসুন আঙ্কল।’

আমার মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে, গলা শুকিয়ে গেছে, পেটের ভিতরটা খালি খালি লাগছে।

এ গলা যে আমাদের খুব চেনা! ফেলুদা বলেছিল এর মত ধুরন্ধর প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে লড়েও আনন্দ। পুণ্যতীর্থ কাশীধামে এর সঙ্গে মোকাবিলা হয়েছিল ফেলুদার।

মগনলাল মেঘরাজ।

যার মাইনে করা নাইফ থ্রোয়ার লালমোহনবাবুকে টার্গেট করে খেলা দেখিয়ে ওঁর আয়ু কমিয়ে দিয়েছিল অন্তত তিন বছর।

কাঠমাণ্ডুতে কী করছে এই সাংঘাতিক লোকটা?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *