১১. রুমু দেখল কিছুতেই কিছু হয় না

রুমু দেখল কিছুতেই কিছু হয় না গুণমণির; ছাই দিয়ে চাপা পড়ে যায়, বৃষ্টির তোড়ে শুয়ে পড়ে, পরদিন সকালে আবার মাথা তুলে দাঁড়ায়, জোড়া জোড়া পাতার কুঁড়ি ফুটে যায়। দিনে দিনে গুণমণি বাড়তে থাকে।

কিন্তু ভুলো আর আসে না।

দাদা, ভুলো একদিন কাদা পায়ে তোমার খাটে উঠেছিল বলে তুমি ওকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলে কেন? রুমু খুব কাঁদতে থাকে।

ঝগড়ু এসে বলে, ও কী, খালি খালি চোখের জল! তবে আর সুখনের কথা কাকে বলি?রুমু চোখ মুছে বলে, কে সুখন, বলো ঝগড়ু।

ঝগড়ু বলে, আমার ছোটো ঝমরু, তার ছোটো সুখন, তার ছোটো নানকু। সুখনও মাটিতে শেকড় গাড়লে না।

মাটিতে কেন শেকড় গাড়বে, ঝগড়ু?

ফেরারি হয়ে রইল, দিদি, ঘর বাঁধল না কোথাও। আগে কিন্তু ভারি সুখের প্রাণ ছিল তার। ভালোটি খাবে, ভালোটি পরবে, এ চাই, ও চাই। সেই লোভে সর্দারের বোবা মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে ফেলল সুখন, কারো মানা শুনল না। এমন সময় ভারি জলের কষ্ট হল সেবার।

আমাদের গাঁয়ের লোকে চাঁদা করে বড় ইদারা কাটাবে ঠিক করল। জল-খোঁজারা এল।

জল-খোঁজা কারা, ঝগড়ু?

তারা বেদেনি, বোগিদাদা। হাতে একটা তিনমুখো কাঁচা লাঠি নিয়ে ঘুরতে লাগল, পাহাড়ের কোলের কাছে এসে লাঠির মুখ বেঁকে মাটিতে ঠেকে গেল। বেদেনিরা সর্দারকে বলল, এইখানেই খোড়ো, সর্দার, এইখানে জল আছে।

অমনি আমাদের গাঁ-সুন্ধু লোকে, পুরুষ-মেয়ে, ছেলে-বুড়ো কোদাল নিয়ে লেগে গেল। খুঁড়তে খুঁড়তে এক মানুষ, দুই মানুষ মাপ করে করে যায়। আট মানুষ হয়ে গেল, তবু আর জল বেরোয় না।

বেদেনিদের আবার ধরে আনা হল। তারা তবুবলে, আছেই জল, ঝরনার মুখে কিছু বেধে আছে, বের করে ফেলো, জল পাবেই।

সেদিন বিকেলে খুঁড়তে খুঁড়তে সুখনের কোদালে কী একটা জিনিস লাগল। বের করে দেখে, পাথরের মতো শক্ত একটা বাঁশের চোঙ। কিছুতেই খুলতে পারল না, কোদাল দিয়ে ভেঙে ফেলতে হল। খানিকটা কাঠের গুঁড়োর মতো কী জিনিস ঝুরঝুর করে মাটিতে ছড়িয়ে পড়ল, আর পড়ল একটা ফিকে হলদে পাথরের মূর্তি।

আধ হাত লম্বা হবে দিদি, পাতলা ফিনফিন করছে, লতাপাতার মাঝখানে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, চোখ নীচু করে। পড়ন্ত রোদে সুখন তাকে হাতে করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। আমি কাছে যেতেই বলল, দেখো, দাদা, ওর বন্ধ চোখের তারা দিয়ে আমার বুকের ভিতর পর্যন্ত দেখে নিচ্ছে।

ঘরে নিয়ে গেলাম মূর্তিটাকে। গা-সুন্ধু সবাই দেখতে এল। সর্দার বলল, ওর পুজো না দিলে খারাপ হবে সুখন, মাটি থেকে না তুললেই ভালো ছিল। বন্ধ চোখে দৃষ্টি থাকে এমন তো কখনো শুনিনি।

সর্দার বলল, সুখন, পুজো না দাও, কাল আমাকে সদরে যেতে হবে, ওকে সরকারের কাছে জমা দিয়ে আসি। এসব জিনিস ঘরে রাখতে নেই, সুখন।

তারপর কী হল, ঝগড়ু?

তারপর কী হল? সেই রাত্রেই মূর্তিটাকে নিয়ে সুখন কোথায় চলে গেল। আর তাকে দেখিনি।

মরে গেছে তা হলে।

সবাই মরবে কেন, বোগিদাদা? সুখন মোটেই মরেনি, মাঝে মাঝে দেশে টাকা পাঠায়। তবে ওর শেকড় কেটে গেছে।

তাহলে দেশকে ভালোবাসে না বোধ হয়।

দেশে না থাকলেই দেশকে ভালোবাসা যায় না? ভালোবাসার জিনিসকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে হবে নাকি?

আচ্ছা, আচ্ছা। আর ইঁদারার কী হল?

ইদারায় সে কী মিষ্টি জল উঠল, দিদি। এখনও আমাদের গাঁয়ের লোক ওই ইঁদারার জল খায়, ফটিকের মতো পরিষ্কার, মধুর মতো মিষ্টি। জষ্টিমাসে দারুণ খরার সময়ও ওই কুয়োতে দু-মানুষ জল থাকে। কিন্তু সুখনকে আর দেখলাম না।

তোমাদের বাড়ি কীরকম বলোনা ঝগড়ু।

মাটির বাড়ি বোগিদাদা, শীতের ভয়ে ছাদগুলো নীচু করে তৈরি। তবে চারদিকে ঘুরে উঁচু মেটে দাওয়া, গোবর দিয়ে নিকিয়ে আমার মা তকতকে করে রাখে। জানালার চাটাইয়ে, দোরের দুই পাশে আমার মা নিজের হাতে ফুল লতাপাতা মাছ শাঁখ এইসব এঁকে রাখে। সে দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়, বোগিদাদা, মনে হয় মনের পাখি ডানা ঝাঁপটানি বন্ধ করে বাসায় এসে বসুক। আমার মা রাঁধে ভালো, রুমুদিদি, মেয়েমানুষকে রাঁধা-বাড়া শিখতে হবে।

দিদিমা আমাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেয় না।

আঃ, রুমু, চুপ করো। বলল, ঝগড়ু, তুমি এতকাল দেশে যাও না, তোমাদের বাড়ি কেমন দেখতে হয়েছে জানলে কী করে?

বাঃ, তা জানব না, আমার চোখের মণিতে গাঁথা হয়ে থাকে, কেমন দেখতে জানব না?

দিদিমাকে বলে একবার যাও-না কেন ঝগড়ু? তোমার বুড়ি মা কত খুশি হবে।

নানকুর বিয়ে দিতে যাব মনে ঠাউরেছি। কী জান, দিদি, আমাদের গুষ্টির ছেলেরা যে ধানের চাল খাবে সে হেথা-হোথা কত দূর দূর দেশে বোনা হয়েছে।

তা কেন, ঝগড়ু? তোমার বাবা, ঠাকুরদা তো দেশে থাকত।

চিরকাল কি আর দেশে থাকত, বোগিদাদা? আমার বাবা সে একরকম ছিলেন। আর জন্তুজানোয়াররা ছিল তাদের ঘরের লোক। একবার দুমকার ঘোর জঙ্গলে কাঠের খোঁজে গিয়েছিলেন, দেখেন কিনা গাছের গোড়ায় একটা এতটুকু বনবেড়ালের বাচ্চা মিউমিউ করে কাঁদছে। বাবাকে দেখে সে দারুণ খুশি,দু-পা তুলে নেচে-টেচে একাকার। বাবা তাকে কোলে তুলে নিয়ে তার চোখের দিকে চাইলেন। মনে হল তার হলদে চোখের পিছনে আলো জ্বলছে। বুকে করে বাবা তাকে ঘরে নিয়ে এলেন।

সে-রাত্রে আমাদের গায়ের কেউ ঘুমুতে পারল না, নেকড়ে বাঘ এসে সারা রাত দাপিয়ে বেড়াল। বাবা বনবেড়ালের বাচ্চাকে বুকে নিয়ে শুয়েছিলেন, শেষ রাত্রে মনে হল বাঘ বুঝি উঠোনে এসে কেঁদে বেড়াচ্ছে। জানলার ঝাঁপি খুলে বাবা তখন বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিলেন, অমনি নেকড়েও তাকে মুখে করে তুলে নিয়ে এক ছুটে চলে গেল।

তাহলে বনবেড়ালের বাচ্চা নয়, ঝগড়ু, নেকড়েরই বাচ্চা।

কী জানি, রমুদিদি, ওদের জাতই আলাদা। ওরা মানুষের বাচ্চাও পোষে তা জান? আমাদের। গাঁয়ের একটা ছোট্ট ছ-মাসের ছেলে হারিয়ে গিয়েছিল, তার গলায় মোটা রুপোর কণ্ঠি ছিল। দশ বছর বাদেও নেকড়ের দলে একটা মানুষের ছেলেকে চার হাত-পায়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত, তার গলায় রুপোর কণ্ঠি।

ওর বাবা-মা ওকে ধরে আনল না কেন?

সে কি আর চেষ্টা করেনি, দিদি, মানুষ দেখলেই সে কামড়াতে আসত, ঝোঁপের মধ্যে মিলিয়ে যেত। যে মানুষের রক্তে নেকড়ের দুধ মিশেছে সে কি আর অন্য মানুষের মতো হয় কখন?

ঝগড়ু, তোমার বাবা চিরকাল দেশে থাকেননি বললে, কোথায় গেছিলেন?

বর্মা, জান বোগিদাদা? সমুদুরের ওপারে বর্মা আছে, সেইখানে।

বলো তোমার বাবার বর্মা যাওয়ার গল্প। এখন তার সময় কোথায় দিদি? ওই দেখো নাথু এল কাপড়ের গাঁটরি নিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *