বিকেলে ঝগড়ু, একটা ভাঙা মাটির ভাঁড়ে করে কী যেন নিয়ে এল।
কী রে ঝগড়ু? কী এনেছিস?
উঠেই দেখো-না, এ সেই আমাদের দুমকার জাদুকরি মাঞ্জা, ঘুড়ির সুতোয় লাগিয়েছ কী দেখো কী কাণ্ড হয়।
কোথায় পেলি রে?
আরে দুমকা থেকে কত কষ্ট করে আমার শালা এনে দিয়েছে। আহা, হাত দিয়ো না দিদি, মাঞ্জায় কাচের গুঁড়ো দেয়া থাকে জান না?
তুমিই তো বলেছ দুমকায় কাচ পাওয়া যায় না বলে জানলায় তোমরা চাটাই বুনে দাও, কাচ কোথায় পেল তোমার শালা? রোজ রোজ উলটোরকম কথা বল!
বেশ, বিশ্বাস না হয় আমি কুসিদিদিদের বাড়িতে দিয়ে আসছি, জগুরাও সুতোলাটাই কিনেছে দেখে এলাম। তা ছাড়া দুমকায় কাচ নেই বলে থাকতে পারি, কাচ হয় না তা তো বলিনি। জাদুকরি মাঞ্জায় দুমকার সেই কাচের গুঁড়ো না দিলে অন্য মাঞ্জা থেকে কোনো তফাতই থাকে না।
রুমু বোগি বিছানা থেকে উঠে এসে বলল, কীরকম কাচ, ঝগডু?
তোমরা তা হলে হাত-মুখ ধুয়ে, জলখাবার খেয়ে, জামাকাপড় পরে আমার সঙ্গে চলো, শালবনে ফুল ফুটেছে দেখবে চলো। তাহলে জাদুকরি মাঞ্জার কথা বলব।
সত্যি গল্প তো ঝগড়ু? তুমি কিন্তু ভীষণ গুল মার।
ইচ্ছে না হয় বিশ্বাস কোরো না, আমি আর কী করতে পারি। তবে এই কথা মনে রেখো, দরকার না হলে আমি কখনো মিছে কথা বলি না।
শালবন থেকে রেলের লাইন দেখা যায় না, কিন্তু ট্রেনের শব্দ শোনা যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় কত দূর থেকে আসছে, আবার তারপরেই মনে হয় একেবারে কানের গোড়ায়, কিন্তু যেই না মুখ ফিরিয়ে দেখতে গেছ, অমনি আবার মনে হবে কত দূরে সরে গেছে।
শাল বনে থেকে থেকে দমকা দমকা হাওয়া দেয়, সাদা গুঁড়োর মতো রেণু ওড়ে, শাল ফুলের সোঁদা গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে।
ভুলো এলে বেশ হত, না দাদা? গাছের গোড়ায় ঢিপি ঢিপি ফুল জমেছে, ভুলো থাকলে ওর মধ্যে নাক ঢুকিয়ে নেচে-কুঁদে একাকার করত।
বোগি বলল, ঝগড়ু, আর চালাকি নয়। বলো শিগগির দুমকার কাচের কথা। না, চুপ করে থাকলে চলবে না ঝগড়ু।
চুপ করি কি সাধে! দুমকার কাচের কথা ভাবলেও আমার মনটা উদাস হয়ে যায়। দুমকা কীরকম জায়গা জান তোমরা? শুকনো খরখর করে চারদিক, আর যেই শীত পড়ো-পড়ো হয়ে আসে, অমনি শিরশির করে একরকম বাতাস বইতে থাকে। আর গাছে গাছে পাতাগুলো সব আলাদা আলাদা হয়ে বাতাসে গা মেলে দেয়! রাত্তিরে শুয়ে শুয়ে ওই বাতাসের শব্দ আর পাতা খসার আর দূরে কাঁদের বাড়িতে শীত-লাগা কুকুরের ডাক শোনা যায়। দুমকার লোকেরা কুকুর ভালোবাসে, বোগিদাদা–
এই অবধি বলে টুক করে একবার রুমুর মুখের দিকে তাকিয়ে ঝগড়ু তাড়াতাড়ি বলতে লাগল, আর শুধু কুকুর কেন–কুকুরদের পেজোমির কথা তো তোমরা জানই–দুমকার লোকরা মুরগি ভালোবাসে, শুয়োর ভালোবাসে বেড়াল বাদে সব জন্তুজানোয়ার ভালোবাসে
কেন, বেড়াল বাদে কেন?
খোলা শত্তুর ভালো, রুমুদিদি, যাদের নখ ঢাকা থাকে আর আলো লাগলে যাদের চোখ ছোটো হয়ে যায়, তাদের ভালোবাসতে নেই। দুমকার লোকেরা তাই বেড়াল ভালোবাসে না।
বোগি বলল, আঃ, কী বেড়াল বেড়াল করছ, কাচের কথাটা বলো না।
এই বলি শোনো। চাটাই দিয়ে জানলা বন্ধ করে ঝাপিকুঁপি হয়ে শুয়ে থাকি, শরীরটা গরমের মধ্যে আরামে শুয়ে থাকে কিন্তু মনটা ওই বাইরে বাইরে শীতের মধ্যে পাতা খসার শুকনো গন্ধের মধ্যে, ঝোড়ো বাতাসের মধ্যে হু হু করে বেড়ায়।
কেন?
আরে চারিদিকে অন্ধকার হয়ে গেলে শরীরের চোখ তো বন্ধ হবেই, আর শরীরের চোখ বন্ধ হলে মনের চোখ খুলবেনা? যাই হোক, আমার বুড়ো ঠাকুরদা ভাবলেন ঘরে আলো আনতে হবে। জানলায় কাচ দিয়ে দিনে আলো আনতে হবে, প্রদীপের চারদিকে কাচ দিয়ে রাতে আলো আনতে হবে। কিন্তু দুমকায় কাচ কোথায়, কাচের বড়ো দাম। তখন আমার বুড়ো ঠাকুরদা শাল গাছ, মহুয়া গাছ আর হাজার হাজার মৌচাকসুষ্ঠু একটা গোটা বন বেচে দিয়ে, শহর থেকে এক বাবু ভাড়া করে আনলেন, সাহেবদের লেখা কেতাব দেখে কাচ তৈরি করে দেবে। তাকে নিজের ঘর ছেড়ে দিলেন, বিরাট চুল্লি তৈরি করে দিলেন, মালমশলার পাহাড় বানিয়ে ফেললেন, মুরগি আর গাওয়া ঘি খেয়ে খেয়ে রোগা বাবু মোটা হয়ে গেল, কিন্তু কাচ আর হল না।
কেন হল না ঝগড়ু?
আরে আজ নয় কাল নয় করে করে বছর ঘুরে গেল, শেষটা বুড়ো ঠাকুরদা একদিন রেগেমেগে তাকে যা নয় তাই বলে বকাবকি করলেন। তারপর সে ঘোর রাত্রে পায়ে হেঁটেই দুমকা থেকে চলে গেল। সারা দিন তাকে খোঁজাখুঁজির পর গভীর রাতে ঠাকুরদা বড়ো চুল্লিটা জ্বেলে, তার মধ্যে ওই পাহাড় পাহাড় মালমশলা আর রাশি রাশি সাহেবদের বই সব ঢেলে দিয়ে, রাগে-দুঃখে সারা রাত বনে বনে ঘুরে বেড়ালেন।
ওরে বাবা! বাঘে খেল না?
আরে তোমরা যে কিছুই জান না দেখছি। রাগী মানুষদের আর পাগলদের কেউ কিছু বলে না, তাও জান না?
যাই হোক, সকালে উসকোখুসকো চুল আর লাল ভাঁটার মতো চোখ নিয়ে বাড়ি ফিরে দেখেন, চুল্লির সেই গনগনে আগুনে সব জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে, আর তার জায়গায় চুল্লিতে ঠেসে রয়েছে পরত পরত কাচ, আর সবার নীচে উনুনের ছাঁচে ঢালাই হয়ে আছে এই বিশাল এক দলা সবুজ কাচ। কাচ কাটে যারা তারা এল, জানলা হল, প্রদীপের ঢাকনি হল, সব হল, দুমকার দুঃখ তখনকার মতো ঘুচল, আর ফালতু কাচ গুঁড়িয়ে জাদুকরি মাঞ্জায় দেওয়া হল।
দুমকার দুঃখ ঘুচল তো তুমি কেন দুমকা ছেড়ে এখানে এলে চাকরি করতে?
বললাম-না, তখনকার মতো ঘুচল। দুঃখ কি আর চিরকালের মতো ঘোচে, বোগিদাদা? সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো বারে বারে ফিরে আসে। তবে হ্যাঁ, এই জাদুকরি মাঞ্জাটাও কিছু কম যায় না!
কেন কী হয় ওতে?
সেই কথাই তো বলছি, তা তোমাদের কিছুতেই তর সয় না।
আচ্ছা ঝগডু, সব জানলায় কাচ হল, তবে তোমরা চাটাই লাগাও কেন?
সেও এক কাহিনী, রুমুদিদি। ষাট বছর আগে যে বড়ো ভূমিকম্প হয়েছিল, তাতে দুমকার একটি বাড়িও দাঁড়িয়ে ছিল না, কাচটাচ সব গুঁড়ো। এই মাঞ্জা তো সেই গুঁড়ো দিয়েই তৈরি। আমাদের দুমকায় ঘরে ঘরে কৌটো করে সেই কাচের গুঁড়ো তুলে রাখে। মাঞ্জার সঙ্গে একটু করে দেয়া হয়, ফুরিয়ে গেলে আর তো পাওয়া যাবে না, দিদি! চলো, এখন না ফিরলে আঁধার হয়ে যাবে, সূর্য ডোবার পর এ জায়গাটাও অন্যরকম হয়ে যায়, চলো এখন ফেরা যাক।
তাহলে রাত্রে শোবার সময় মাঞ্জার কথা বলবে তো ঠিক?
ঝগড়ু দু-জনার কনুই ধরে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলল, হ্যাঁ, হা, সে হবেখন!
রাত্রে মাংস রান্না হয়েছিল। মোটা হাড়গুলো কে খাবে? তার উপর রমুর খুব পা কামড়াচ্ছিল। দিদিমা ঝগড়ুকে বকলেন, কী দরকার ছিল ওদের শাল বন অবধি হাঁটাবার, ঝগড়ু? বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তোমার দেখি বুদ্ধি বাড়ছে।
ঝগড়ু কিছু বলল না। ঝগড়ু বোধ হয় খুব বুড়ো, কানের চুলগুলো সব সাদা হয়ে গেছে, হাতের অনেকগুলো নখ ভাঙা, শিরাগুলো উঁচু উঁচু হয়ে রয়েছে। রুমু একটা আঙুল দিয়ে ঝগড়ুর শিরায় হাত বুলিয়ে দিল। বোগি বলল, ঝগড়ু, তুমিও চলো, আমরা শোব, তুমিও আমাদের সঙ্গে চলো৷
হাত ধুতে গিয়ে রুমু একবার কানা-তোলা থালাটার কাছে গেল। বোগির রাগ ধরল, কী করে আসবে সে? তুই এত বোকা কেন রুমু? হাড়গুলো তুলে এনে থালায় ফেললি?
রুমু পা দিয়ে থালাটাকে একটু সরিয়ে বলল, ঝগড়ুর বউ সন্ধে বেলা ছেলেটাকে কলা চটকে খাওয়াচ্ছিল। আমার বড্ড পা কামড়াচ্ছে, দাদা। রুমু মহা কান্নাকাটি লাগিয়ে দিল।