মহাভারত স্রষ্টার অন্তর্দ্বন্দ্ব
মহাভারতে আপাত-নিষ্ক্রিয় এক সন্ন্যাসীর মতো চরিত্র হলেন ভীষ্ম। মনুষ্যজন্মের পূর্বে ইনি স্বর্গের অষ্ট বসুর অন্যতম দ্যু-নামের বসু ছিলেন। ভাইদের একদিন ইনি বশিষ্ঠের কামধেনু চুরি করার প্ররোচনা দেন। বশিষ্ঠ প্রথমে সকলকেই শাপ দেন মানুষ হয়ে পৃথিবীতে জন্মাবার; পরে সেটা প্রত্যাহার করে শুধু দ্যু-কেই শাপ দেন। এই শাপে বসুরা গঙ্গা ও শান্তনুর পুত্ররূপে জন্মান। গঙ্গা জন্মমাত্রেই প্রথম সাতটি পুত্রকে জলে নিক্ষেপ করেন। পূর্ব-শর্ত মতো শান্তনু প্রতিবাদ করেননি; কিন্তু অষ্টম সন্তানের বেলা প্রতিবাদ করতেই গঙ্গা সন্তানটিকে নিয়ে শান্তনুকে ত্যাগ করে যান। গঙ্গা এই পুত্রের নাম দেন দেবব্রত এবং বশিষ্ঠ ও গঙ্গা একে শিক্ষিত করে তোলেন। বত্রিশ বছর পরে একদিন শান্তনু দেখেন এক কুমার বাণবর্ষণে নদীর স্রোতকে রুদ্ধ করছেন; রাজার সন্দেহ হতে গঙ্গাকে স্মরণ করতেই তিনি এসে পুত্রকে প্রত্যর্পণ করেন ও জানান যে পুত্রটির কোনও সন্তান হবে না এবং তিনি যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করবেন।[১] রাজা দেবব্রতকে নিয়ে এসে যৌবরাজ্যে অভিষেক করেন। চার বছর পর দাশরাজ-কন্যা সত্যবতীকে দেখে শান্তনু আসক্ত হলেন কিন্তু দাশরাজ শর্ত করেন যে, সত্যবতীর গর্ভজাত পুত্রকেই রাজ্য দিতে হবে। পিতার বিমর্ষতার কারণ জানতে পেরে, দেবব্রত দাশরাজের কাছে ও শান্তনুর কাছে অঙ্গীকার করেন যে তিনি চিরকুমার থাকবেন, রাজ্য নেবেন না। এর পরিবর্তে তিনি অক্ষয় স্বর্গলাভের বর প্রার্থনা করেন। শান্তনু সন্তুষ্ট হয়ে, তাঁকে ইচ্ছামৃত্যুর বরও দেন।[২] এই ভীষণ প্রতিজ্ঞার জন্যে তাঁর নাম হয় ভীষ্ম। কিছু দিন পরে তিনি ঋষি পুলস্ত্যর কাছে তীর্থমাহাত্ম্য শুনে তীর্থে যান।
শান্তনুর পুত্র ভীষ্মের অনুজ সত্যবতীর পুত্র চিত্রাঙ্গদ তিন বছর ধরে গন্ধর্বদের সঙ্গে যুদ্ধে রত ছিলেন। সর্বশাস্ত্রজ্ঞ ভীষ্ম তাঁকে তখন কোনও রকমে সাহায্য করেননি; চিত্রাঙ্গদের মৃত্যুর পরে তিনি তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদন করেন।[৩] স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, ভীষ্ম অনুজের বিপদে উদাসীন রইলেন কেন? এর একটা উত্তর হল ঔদাসীন্য ভীষ্ম চরিত্রের একটি প্রধান লক্ষণ। যিনি পিতার দাম্পত্যসুখের ব্যবস্থা করতে নিজের দাম্পত্য সম্ভাবনা রহিত করে দিলেন তাঁর চরিত্রে শৌর্য ছিল না— এ কথা বলা চলে না। অথচ গন্ধর্বদের হাতে ভ্রাতার মৃত্যু ঘটলেও তিনি ক্ষত্রিয় নীতি অনুসারে তার কোনও প্রতিশোধ নেননি; এটি কতকটা স্ববিরোধী আচরণ। বিচিত্রবীর্য রাজা হলে সত্যবতীর সাহায্যে ভীষ্মই প্রকৃতপক্ষে রাজ্য চালনা করতেন যদিও নিজে রাজ্য প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অর্থাৎ রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, কিন্তু সুখবিলাসটা ভোগ করেননি। মনে পড়ে রামচন্দ্রের কথা— পিতার প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য বনে আসবার পর তাঁকে আর একবার প্রলোভিত করা হয়, যখন ভরত এসে তাঁকে রাজ্য নিবেদন করেন; রামচন্দ্র সংকল্পে অবিচল ছিলেন। কিন্তু ভীষ্মকে বারে বারে প্রলোভনের সম্মুখীন হতে হয়। রামচন্দ্রের মতো তাঁরও জ্যেষ্ঠপুত্র হিসেবে সিংহাসনে অধিকার ছিল, কিন্তু পিতার দাম্পত্য সুখের জন্য তা অনায়াসে ত্যাগ করলেন। কিন্তু ভীষ্মের ত্যাগ শুধু সিংহাসন নয়, দাম্পত্য জীবন, সন্তান সব কিছুই। দু-পুরুষের সুখ সম্ভাবনা তিনি ত্যাগ করলেন পিতার সুখের জন্যে। সে তুলনায় রামচন্দ্র বনবাসে সীতার সাহচর্য ও লক্ষ্মণের সেবা সবই পেয়েছিলেন, এবং চতুর্দশ বৎসরের পরে সিংহাসনও ফিরে পেয়েছিলেন।
অম্বা যখন ভীষ্মকে বললেন যে তিনি মনে মনে শাল্বরাজকে পতিত্বে বরণ করেছেন তখন ভীষ্ম তৎক্ষণাৎ অম্বাকে শাল্বরাজের কাছে পৌঁছে দিলেন।[৪] এ আচরণের মধ্যে রাজপুত্রসুলভ সৌজন্য ও ক্ষত্রিয়-সুলভ ন্যায়বোধ প্রকাশ পেয়েছে। শাল্বরাজ অম্বাকে প্রত্যাখ্যান করলে পরশুরাম বলেন ভীষ্মের উচিত অম্বাকে বিবাহ করা। আবার সেই প্রলোভন; কৌমার্যব্ৰত থেকে স্খলিত হওয়ার নির্দেশ, কিন্তু অবিচলিত ভীষ্ম তেইশ দিন পরশুরামের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাঁকে পরাজিত করেন। এখানেও ওই নির্লিপ্ত ঋষিকল্প মানুষটির ক্ষত্রিয়সুলভ আচরণ।
বিচিত্রবীর্যের মৃত্যুর পর সত্যবতী এবং প্রজারা ভীষ্মকে অম্বিকা ও অম্বালিকাকে বিবাহ করে আপদ্ধর্মনীতি অনুসারে সংসার-ধর্ম পালন করতে বলেন; আবার সেই প্রলোভন এবং আবার নির্দ্বিধায় প্রলোভন জয়। এখানে স্মরণ করতে হবে, শাস্ত্র এবং দেশাচারের নির্দেশ ছিল অপুত্রক জ্যেষ্ঠের মৃত্যু হলে কনিষ্ঠ ভ্রাতৃবধূদের বিবাহ করে সন্তান উৎপাদন করবেন। কিন্তু ভীষ্মের কাছে শাস্ত্রনির্দেশের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল নিজের অঙ্গীকারের কাছে খাঁটি থাকা।
অবশেষে বেদব্যাসের ঔরসে ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু জন্মালেন এবং তাঁদের দুজনের একশো পাঁচ পুত্রের অস্ত্রশিক্ষার প্রাথমিক দায়িত্ব ভীষ্ম একাই বহন করেন।[৫] পরে যথাক্রমে দ্রোণ ও কৃপাচার্যকে নিযুক্ত করেন রাজকুমারদের অস্ত্রশিক্ষার জন্য; অর্থাৎ পিতামহের কর্তব্য তিনি অনেকটাই করেছিলেন এবং এই রাজকুমারদের সুবাদেই মহাকাব্যে তাঁর পরিচিতি ‘পিতামহ ভীষ্ম’ হিসেবে। এর পর তিনি পিতামহের ভূমিকায় আসীন। জতুগৃহদাহে পাণ্ডবদের মৃত্যু হয়েছে ভেবে এই ক্ষত্রিয়বীর অশ্রুপাতও করেছিলেন।[৬] সেখানে তিনি নেহাৎই স্নেহাতুর পিতামহ।
ভীষ্মের শৌর্য বোধহয় সবচেয়ে বেশি প্রকাশ পেয়েছে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে। সেখানে ভীষ্ম কৃষ্ণকে শ্রেষ্ঠ অতিথির অর্ঘ্য দেওয়ার প্রস্তাব করলে শিশুপাল ভীষ্মকে যৎপরোনাস্তি অপমান করে; ক্রুদ্ধ ভীষ্ম প্রত্যুত্তর দেওয়ার সময়ে বহু কটুকথার সঙ্গে এও বলেন যে, শিশুপাল ও তাঁর দলের লোকদের মস্তকে তিনি পদাঘাত করবেন।[৭] কৌরবপক্ষীয় হয়েও ভীষ্ম বারে বারেই দুর্যোধনকে পরামর্শ দেন পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ না করে মিত্রতা করতে। ভীষ্মের চরিত্রের দুর্বলতম দুটি অধ্যায় হল, কৌরবসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ ও লাঞ্ছনা নিষ্প্রতিবাদে বসে দেখা। এটি ক্ষত্রিয় ধর্মে অপরাধ: দুর্বল, আক্রান্ত, শিশু, বৃদ্ধ ও নারীর রক্ষা ক্ষত্রিয়ের অবশ্য-কর্তব্য। এর পরে পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসকালে যখন চর এসে বলে যে পাণ্ডবরা নিরুদ্দিষ্ট, তখন কৌরবদের কী করণীয় সে বিষয়ে যে পরামর্শসভা বসে সেখানে উপস্থিত থেকেও ভীষ্ম নীরব ছিলেন, কোনও পরামর্শই দেননি। কৃষ্ণ যখন কৌরবরাজ-সভায় পাণ্ডব পক্ষ থেকে সন্ধি প্রস্তাব আনেন তখন দুর্যোধন কৃষ্ণকে বন্দি করতে চাইলে ভীষ্ম বাধা দেন, কেন না দূত অবধ্য।[৮] কিন্তু তাঁর এ কাজটি পাণ্ডবদের অনুকূলেই যায়, যেমন আরও অনেক অন্য কাজও কৌরব-স্বার্থবিরোধী ছিল।
যুদ্ধের ঠিক পূর্বমুহূর্তে যুধিষ্ঠির ছুটে এসে ভীষ্মের পায়ে পড়ে যুদ্ধ বন্ধ করতে মিনতি করলেন। ভীষ্ম উত্তর দিলেন: ‘মানুষ অর্থের দাস, অর্থ কখনও মানুষের দাস নয়। এ কথা সত্য, মহারাজ, অর্থের জন্যেই আমি কৌরবপক্ষে আবদ্ধ। তাই এখন ক্লীবের মতো বলছি যুধিষ্ঠির, এ ছাড়া অন্য কিছু চাও।’[৯] এখানে সবচেয়ে মর্মান্তিক স্বীকারোক্তি হল, ‘অর্থের জন্যে আমি কৌরবপক্ষে বাঁধা পড়ে আছি, আমি কৌরবদের অন্নদাস, তাই ন্যায় হোক অন্যায় হোক ওই পক্ষেই আমাকে যুদ্ধ করতে হবে।’ নিজেই বলছেন ‘ক্লীবের মতো বলছি’ অর্থাৎ ভীষ্ম সচেতন যে, ক্ষত্রিয়োচিত নয়, এ সিদ্ধান্ত দাসোচিত। ভীষ্ম কৌরব পাণ্ডব উভয়েরই প্রথম শাস্ত্রগুরু। আচার্য যেখানে শিষ্যদের শিক্ষা দেন, সেখানে তাঁর তো দাবিই থাকে ভরণপোষণে। সে দাবি তাঁর প্রদত্ত শিক্ষার বিনিময়ে, ঘটনাচক্রে এ ভরণপোষণ তাঁকে নিতে হয়েছিল কৌরবদের ভাণ্ডার থেকে; কিন্তু এতে তাঁর ঋণ থাকবে কেন? তিনি যোগ্যতা ও পরিশ্রমের দ্বারা যা অর্জন করেছেন সে সম্বন্ধেও এই দীন উচ্চারণ, এটা পাঠককে দ্বিধায় ফেলে। বিশেষ করে এই কারণে যে, এই কল্পিত ঋণ তিনি শোধ করেছেন সজ্ঞানে অন্যায় সমরে যুদ্ধ করে। তাঁর দ্বিতীয় পাপ দেহে-মনে-অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের সভাসদ হয়ে দুর্যোধনের ওই নারকীয় পাপ— প্রকাশ্য রাজসভায় রাজকুলবধূর নির্মম অবমাননা তা নীরবে সহ্য করা। ধৃতরাষ্ট্রের অন্নগ্রহণ করা ভীষ্মের নিজের বিবেকের কাছে তাঁর আদিম ও অন্তিম অপরাধ তার জন্য কঠিন মূল্য দিতে হয়েছিল আপন বিবেককেই বধ করে। যুদ্ধে কৌরবপক্ষের প্রথমে সেনাপতি হওয়া এরই অনিবার্য পরিণতি। যুযুৎসু বা বিদুর কৌরবের অন্নপালিত হয়েও বিবেকের বিরুদ্ধাচরণ করেননি, যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। ভীষ্ম সে সৎসাহসের পরিচয় দিতে পারেননি।
ভীষ্মের চরিত্রে এ দ্বিধা একান্তই মৌলিক ও নিরতিশয় জটিল। কৌরবকুল প্রধান ও সৈন্যধক্ষ্য প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, পাণ্ডবদের তিনি বধ করবেন না; প্রত্যহ দশ হাজার সৈন্য ও এক হাজার রথ বিনষ্ট করবেন কিন্তু পাণ্ডবদের আঘাত করবেন না।[১০] নবম দিনের রাত্রে ইচ্ছামৃত্যু-বরে অবধ্য ভীষ্মকে বধ না করতে পেরে বিপর্যস্ত ও বিপন্ন পাণ্ডবরা ভীষ্মের সঙ্গে দেখা করে তাঁর মৃত্যুর উপায় জানতে চাইলে তিনি অর্জুনকে বলেন, শিখণ্ডীকে রথের সামনে রাখতে। এটিও সেনাপতির অকর্তব্য। পরদিন, যুদ্ধের দশম দিনে তিনি দশ হাজার হাতি, অযুত রথারোহী সৈন্য ও এক লক্ষ পদাতিক সৈন্যকে বধ করেন, কিন্তু প্রধান প্রতিপক্ষ পাণ্ডবদের কোনও ক্ষতি করেননি।[১১] সে-জন্মে শিখণ্ডী পূর্ণ পুরুষ জেনেও পূর্বজন্মে তার নারীত্বের সুবাদে ভীষ্ম অর্জুনের বিরুদ্ধে শরনিক্ষেপ করলেন না। দুর্যোধনের দুর্বাক্যে মর্মাহত হয়ে একবার অর্জুনের দিকে ধাবিত হলে কৃষ্ণ সুদর্শনচক্র দিয়ে অর্জুনকে বাঁচান। সেদিনই সূর্যাস্তের আগে সমস্ত দেহে অর্জুনের শরে জর্জরিত অবস্থায় ভীষ্ম রথ থেকে পড়ে যান। অর্জুন বাণ দিয়ে তাঁর উপাধান নির্মাণ করেন এবং ভীষ্মের তৃষ্ণা নিবারণের জন্যে শরনিক্ষেপ করে ভূগর্ভ থেকে প্রস্রবণ সৃষ্টি করেন যা ভীষ্মের ওষ্ঠের সামনে জলধারা বর্ষণ করে। ওই শরশয্যায় ভীষ্ম আটান্ন দিন কাটান, তার পরে সূর্য উত্তরায়ণে গেলে নিজের ইচ্ছায় মৃত্যুবরণ করেন।[১২] মৃত্যুর পূর্বে দুর্যোধনকে পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করতে উপদেশ দেন।
লক্ষ্য করলে দেখি, ভীষ্মচরিত্রটি সাংঘাতিক ভাবে দ্বিধাখণ্ডিত। কৌরবের আশ্রয়ে থেকে কৌরবদের পক্ষেই যুদ্ধ করবেন, এটা বোঝা যায়। কিন্তু কৌরবপক্ষে যুদ্ধ করে পদে পদে কৌরব-স্বার্থের হানি ঘটাবেন এইটেই সেই মৌলিক দ্বিধার প্রকাশ। প্রথমত, দ্রৌপদীর অপমান নিষ্প্রতিবাদে সহ্য করাই বীরধর্ম থেকে বিচ্যুতি; তার পরে বারবার দুর্যোধনকে পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করতে বলা তো কৌরবদের বিরুদ্ধাচরণই। যুদ্ধে কোনও মতেই পাণ্ডবদের কোনও ক্ষতি না করা সেনাপতির কর্তব্যে প্রবল ত্রুটি, কৌরবদের প্রতি ঘোরতর বিশ্বাসঘাতকতা। অথচ এই মানুষটি শান্তিকামী যুধিষ্ঠিরকে প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে, তিনি কৌরবদের কাছে ঋণবদ্ধ। এই কি তাঁর ঋণশোধ? যুদ্ধে যিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী বীর, নিজের ইচ্ছা না হলে যাঁকে বধ করা যাবে না তেমন সেনাপতি তাঁর দীর্ঘতম সৈনাপত্যের দশ দিনে অজস্র সৈনিক, রথারূঢ় ও পদাতিককে বিনষ্ট করলেন, কিন্তু মুখ্য প্রতিদ্বন্দ্বী পাণ্ডব ভ্রাতাদের কোনও ক্ষতিই করলেন না। সেনাপতি হিসেবে এ তো চরম অধর্ম।
প্রতিন্যাসে মনে পড়ে বিভীষণকে, তাঁর বিবেকের দ্বন্দ্ব তিনি কত সহজে, কত বেশি সরলরৈখিক ভাবে নিরসন করেছিলেন। রামের পক্ষে যোগ দেওয়া তাঁর রাক্ষসজন্ম এবং রাজভ্রাতার কর্তব্যের নিরিখে কৃতঘ্নতা; কিন্তু তিনি সরাসরি পক্ষত্যাগ করেছিলেন। রাবণ অন্যায়কারী, পরস্ত্রী-অপহারক, অতএব তার স্বপক্ষে থাকা অন্যায়। তাই তিনি রামের শরণাগত হয়ে অনুমতি চেয়ে নিলেন তাঁর পক্ষেই যুদ্ধ করার। এর পরে আর একবারও পিছনে ফিরে চাইলেন না, দ্বিধাগ্রস্তের মতো কোনও আচরণই করেননি। সে তুলনায়, ভীষ্মের চরিত্রে এবং কাজে সাড়া দেওয়া পাঠকের পক্ষে অনেক বেশি দুরূহ, কারণ ভীষ্ম পদে পদে বিবেক এবং অন্নদাসের কৃত্যের মধ্যে দ্বন্দ্বে জর্জরিত। প্রভূত সংখ্যায় রথী, রথ ও পদাতিককে প্রত্যহ বধ করবেন, কিন্তু সেনাপতির যা মুখ্য করণীয়— প্রতিপক্ষের প্রধান বীরদের ধরাশায়ী করা— যা তাঁর সাধ্যের মধ্যেই ছিল, তা তিনি ভুলেও করতে উদ্যত হলেন না। এর মধ্যে খুব মোটা দাগের একটা বিশ্বাস হনন আছে। পাণ্ডবদের ক্ষতিসাধন করা, ধ্বংসসাধন করাই যে-যুদ্ধের প্রকৃত উদ্দেশ্য, সেই যুদ্ধে ভীষ্ম অন্ন-ঋণ শোধ করতে সৈন্যপত্য গ্রহণ করলেন, অথচ সেনাপতির প্রধান কর্তব্যে সম্পূর্ণ বিমুখ রইলেন। ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য, সেনাপতির কর্তব্য, অন্নদাসের কর্তব্য, এ সবই ভীষ্ম জানতেন কিন্তু তার সঙ্গে তাঁর বিবেকের অন্তঃস্থলে বিরোধ জাগাল প্রকৃত মানবধর্মের প্রতি কর্তব্য। সেখানে তিনি অনুক্ষণ অবহিত যে কৌরবরা, যারা দ্রৌপদীর অন্যায় অপমানের দ্বারা গভীর ভাবে কলঙ্কিত, তাদের পরাজয়ই বাঞ্ছনীয়। এই বোধ তাঁকে নিয়ে গেল সেই দুঃসহ নরকযন্ত্রণার মধ্যে যেখানে পরস্পরবিরোধী দুটি কর্তব্যের মধ্যে কোনও আপোস নেই। তাই ভীষ্ম মর্মান্তিক যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে হতে দশম দিনে অস্ত্র ত্যাগ করে অর্জুনের শরধারা সমস্ত অঙ্গ পেতে গ্রহণ করতে লাগলেন: ‘যেমন করে উষ্ণার্ত জন গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহের পর প্রথম বারিধারা সর্বাঙ্গে গ্রহণ করে।[১৩] মৃত্যু আসছে এবার মুক্তির রূপ ধরে।
হয়তো এই অনুক্ষণ নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগই তাঁকে অধিকার দিয়েছিল সুদীর্ঘ শান্তিপর্বের মোক্ষধর্ম, রাজধর্ম, আপদ্ধর্ম ও তীর্থধর্ম সম্বন্ধে উপদেশ দেওয়ার। বোঝা কঠিন নয়, এই বিপুল উপদেশমালা প্রক্ষিপ্ত; তৎকালীন সমাজ ও যুগোপযোগী কিছু কিছু নীতি ও ধর্মের কথা মহাভারত স্থায়ী ভাবে ধরে রাখতে চেয়েছিল। তাই কৃত্রিম ভাবে ভীষ্মের শরশয্যানির্মাণ পানীয় জল ও মস্তকের উপাধান রচনা, কৃষ্ণের বরে আসন্নমৃত্যু বৃদ্ধের বাক-শক্তিলাভ ও আটান্ন দিন ধরে উপদেশবর্ষণ। যুদ্ধের প্রাক্ষণে সুদীর্ঘ ভগবদ্গীতা যেমন প্রক্ষিপ্ত, মৃত্যুর পূর্বাহ্নে ভীষ্মের এই সুদীর্ঘ উপদেশবাণীও তেমনই প্রক্ষিপ্ত। হয়তো বীজাকারে অল্প কিছু উপদেশ ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে দিয়েছিলেন, কিন্তু শান্তিপর্ব তাঁকে যে-রূপে উপস্থাপিত করছে স্পষ্টতই তা কৃত্রিম ও কষ্টকল্পিত। কিন্তু যেটা লক্ষ করার বিষয় তা হল, মহাভারতকার ভীষ্মকে উপদেশ দেওয়ার অধিকারী বলে বিবেচনা করেছেন। এ কথা ভুললে চলে না যে, প্রাচীন ভারতবর্ষে জীবনের সব পর্বে আচরণীয় নীতি সম্বন্ধে যাঁরা শাস্ত্র রচনা করেছেন তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই সংসারত্যাগী ঋষি। এক অর্থে ধর্ম, অর্থ, কাম, রাজধর্ম, বর্নাশ্রমধর্ম, ইত্যাদি সম্বন্ধে উপদেশ দেওয়ার পক্ষে তাঁরা অনধিকারী। কারণ, তাঁরা সংসারের বাইরেই জীবনযাপন করেছেন, ফলে, এ সব বিষয়ে তাঁদের কোনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই। অপরপক্ষে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় জড়িত মানুষ নির্লিপ্ত ভাবে এ সব বিষয়কে অনুধাবন করতে পারে না, যেহেতু জড়িত থাকায় তাঁদের দৃষ্টি আবিল— নির্মোহ নয়। তাই দূর থেকে নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখতে পারেন যে-মানুষ, প্রাচীন ভারতবর্ষ তাঁদেরই শাস্ত্রকার আচার্যের আসনে বসিয়েছে। তাই শান্তিপর্বের অধিকাংশই প্রক্ষিপ্ত হলেও সংসার জীবন, রাজত্ব, মানসিকতা, আতিথ্য, ইত্যাদি নানা বিষয়ে কথা বলার গৌরব ভীষ্মকে দেওয়া হয়েছে এবং এ গৌরবের অন্যতম সত্য এক উৎস হল, তাঁর নিরন্তর যন্ত্রণাভোগ।
চিরকুমার, এক অর্থে অ-সংসারী, এই ঋষিকল্প মানুষটি ক্ষত্রিয়ধর্মের কাছ থেকে পলাতক, সেনাপতির কর্তব্যে বিশ্বাসহন্তা, কৌরবদের অন্ন-ঋণ শোধ করছেন গোপনে তাদের বঞ্চনা করে, এই সব পরস্পরবিরোধী কৃত্য সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়া তাঁর পক্ষে সহজ হয়নি। চিত্তের গোপনে একটি ক্রূর, দুঃসহ আততি বহন করেছেন দীর্ঘকাল। যে মানুষ পিতাকে সুখী করবার জন্যে অনায়াসে আমরণ জীবনের অপূর্ণতা, অতৃপ্তি বরণ করেছেন, এবং তা বহন করেছেন অনায়াসে বারংবার প্রলুব্ধ হওয়া সত্ত্বেও, সেই মানুষই ক্ষত্রিয়ধর্ম, কৌরবদের প্রতি আনুগত্য, বীরকৃত্য ও সৈনাপত্য কর্তব্য থেকে কি গভীর ভাবে স্খলিত! প্রথম ত্যাগটা ছিল ব্যক্তিজীবনের সুখ বিসর্জন দেওয়া, সেটা তিনি সহজে পেরেছিলেন; কিন্তু দ্বিতীয়টার মধ্যে জীবনের গভীরতর তাৎপর্যের কাছে খাঁটি থাকার প্রশ্ন ছিল। এর সমাধান সহজ হয়নি, এটি আদর্শের প্রশ্ন, ধর্ম-রক্ষার প্রশ্ন। এর মূল্য প্রতি পদে, প্রত্যেক অবস্থাচক্রে স্বতন্ত্র ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে দিতে হয় মর্মমূলে অবিরত রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে। সেই যন্ত্রণা সহ্য করার এবং তার মধ্যে দিয়ে ধর্মনিরূপণ করে চলাই ভীষ্মকে তাঁর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইচ্ছামৃত্যু সূর্যের উত্তরায়ণের সঙ্গে ততটা যুক্ত ছিল না যতটা ছিল দশম দিনে পরস্পরবিরোধী কৃত্যের সমাধানে ক্ষতবিক্ষতচিত্ত বৃদ্ধের জীবন সম্বন্ধে চূড়ান্ত, যথার্থ অনীহা জাগার লগ্নের সঙ্গে। অন্তরে শেষ বিন্দু রক্ত ক্ষরিত হওয়ার পর তিনি নিজেকে জীবনের কাছে ঋণমুক্ত বলে দাবি করতে পারলেন, জীবিত থাকার দায় থেকে মুক্তি পেলেন— নিজেরই কাছে।
মহাভারতের রচয়িতা বেদব্যাস ও তাঁর পুত্র শুকের বিবরণ আছে মহাভারতের শান্তিপর্বে।[১৪] দেবীভাগবত পুরাণে পড়ি ঋষি পরাশরের পুত্র কৃষ্ণদ্বৈপায়ন— জন্মক্ষণেই পিতামাতার আশ্রয়চ্যুত। তিনি হিমালয়ে দীর্ঘকাল তপস্যা করেন। একবার দেখতে পান কলবি পক্ষী দম্পতি তাদের শাবকদের খাওয়াচ্ছে। দেখে তাঁর অপত্যলাভের বাসনা হয়; কিন্তু স্ত্রী নেই, কী করে সন্তান পাবেন তাই ভাবতে থাকেন। সেই সময় অপ্সরা ঘৃতাচীকে দেখে কামার্ত হন, সেই স্খলিত বীর্য থেকে পুত্র শুকের জন্ম। শুক বৃহস্পতির কাছে বিদ্যালাভ করেন, পিতার কাছে আসেন এবং বিবাহ করে পিতার সঙ্গেই বাস করেন। কিন্তু এক সময়ে তপস্যা করতে করতে সশরীরে আকাশে উঠে যান। ব্যাস খোঁজাখুঁজি করেন, কিন্তু প্রতিধ্বনি মাত্র শুনতে পান, শুককে আর পান না। তখন শিব এসে সান্ত্বনা দিলে ব্যাস আশ্রমে ফিরে যান। অর্থাৎ ব্যক্তিগত জীবনে ব্যাস পিতা, মাতা, ভ্রাতা, ভগিনী, বন্ধু, স্ত্রী কিছুই পাননি। অলৌকিক ভাবে এক পুত্র লাভ করেন, সে তার বিবাহোত্তর জীবনে কিছুকাল পিতার সঙ্গে বাস করে, কিন্তু কিছুকাল পরে ব্যাস তাকেও হারান
মহাভারতে ব্যাসের মাতা সত্যবতীর সঙ্গে শান্তনুর বিবাহ হলে চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য দুই ভাই জন্মায়। তাদের সঙ্গে ব্যাসের সাক্ষাৎ সম্পর্ক ছিল না। সত্যবতীকে বলেছিলেন, তিনি স্মরণ করলে ব্যাস উপস্থিত হবেন। হলেন যখন চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য মৃত এবং দুই বিধবা অম্বিকা অম্বালিকার কোনও পুত্র নেই। হস্তিনাপুর সিংহাসনে উত্তরাধিকারী হবেন সত্যবতীর পুত্র— রাজমাতা হওয়ার এই উদগ্র কামনায় শান্তনুর জ্যেষ্ঠ সন্তান গঙ্গার পুত্র দেবব্রতকে নির্মম ভাবে বঞ্চিত করেন, কঠোর চিরকৌমার্যের প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হন ভীষ্ম। কিন্তু তাঁর দুই পুত্রেরই নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যু ঘটেছে, অতএব যে সন্তানকে জন্মক্ষণে বিসর্জন দিয়েছিলেন এই একান্ত প্রয়োজনের মুহূর্তে তাকেই স্মরণ করলেন সত্যবতী। তাপস ব্যাস দেখা দিতে সত্যবতী বললেন ভ্রাতৃবধূ দুটিতে পুত্র উৎপাদন করতে। এ নিয়োগ শাস্ত্রসম্মত, কিন্তু ব্যাস জানতেন কৃষ্ণদ্বৈপায়নের কুৎসিত আকৃতি বিকর্ষণ ঘটাবে ওই রাজবধূ দুটির চিত্তের। তাই সত্যবতীকে বললেন, তারা যেন এক বৎসর শুচিব্রতা হয়ে থাকেন। কিন্তু সত্যবতী বিলম্বে অসম্মত, তখন ব্যাস ঘৃণার্হ, অবাঞ্ছিত পুরুষরূপে দুটি নারীর গর্ভাধান ঘটালেন। পরে এক দাসী তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করলেন। জন্ম হল অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র, বিবর্ণ পাণ্ডু এবং শান্ত, দান্ত ধার্মিক বিদুরের।
কলবিঙ্ক শাবকদের প্রতি মা-পাখি বাবা-পাখির অপত্যস্নেহের প্রকাশ দেখে যাঁর অপত্যবাসনা জাগে তিনি বিনা দাম্পত্যে অপত্যের জনক হলেন; অলৌকিক ভাবে শুকের এবং দুই অনিচ্ছুক রমণীর ও একটি নম্রমধুর দাসীর সঙ্গে স্বল্পক্ষণের সংযোগে। পত্নীপ্রেম তাঁর ভাগ্যে জোটেটি; পুত্র শুকের দাম্পত্য জীবন কাছে থেকে কিছুকাল দেখেছিলেন মাত্র, তা সে শুককেও অকালে হারালেন।
গান্ধারী যখন একটি মাংসপিণ্ড প্রসব করেন এবং কুন্তির পুত্রভাগ্যে ঈর্ষান্বিতা হয়ে সে পিণ্ডটিকে নষ্ট করতে উদ্যত হন তখন ব্যাস সেটিকে একশত এক খণ্ডে ভাগ করে শত কৌরব পুত্র ও কন্যা দুঃশলার ভ্রূণে বিন্যস্ত করেন। নিজে অপত্নীক। কলবিঙ্ক শাবকদের দেখার পর থেকে অপত্যস্নেহ তিনি ইতস্তত বিতরণ করেছিলেন। স্নেহমমতা তাঁর সহজাত বৃত্তিই ছিল। পাণ্ডুর অকালমৃত্যু ও মাদ্রীর সহমরণের পরে ব্যাস এসে কুন্তিকে সান্ত্বনা দেন। বনবাসকালে পাণ্ডবদের একচক্রা নগরীতে বাসের ব্যবস্থা করে দেন এবং দ্রৌপদী-স্বয়ংবরে যাওয়ার জন্যে তাদের পরামর্শ দেন।[১৫] যুধিষ্ঠিরের রাজসভায় ব্যাস উপস্থিত থাকতেন এবং রাজসূয় যজ্ঞ সমাধা হলে পর যুধিষ্ঠিরকে রাজ্যে অভিষিক্ত করেন।[১৬] পাণ্ডবদের বনবাসকালে যখন দুর্যোধন পক্ষ তাদের বিনাশে বদ্ধপরিকর, তখন ব্যাসই দুর্যোধনদের নিরস্ত করেন।[১৭] যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে যুদ্ধের ধারাবিবরণী শোনাবার জন্যে তিনিই সঞ্জয়কে দিব্যদৃষ্টি দেন।[১৮] ভীষ্ম যখন শরশয্যায় শায়িত, তখন ব্যাস এসে কিছুক্ষণ ভীষ্মের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলাপ করে যান।[১৯] যুদ্ধে এক সময় যুধিষ্ঠির খুব উদভ্রান্ত বোধ করলে ব্যাস এসে তাঁকে নানা সান্ত্বনাবাণী শোনান। যুদ্ধান্তে যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞের জন্য যখন প্রচুর বিত্তের প্রয়োজন হল; তখন ব্যাসই এসে রাজা মরুত্তের গোপন বিত্তরাশির সন্ধান দেন।[২০]
ঘটোৎকচের মৃত্যুর সংবাদে যুধিষ্ঠির যখন নিরতিশয় ব্যাকুল, তখনও ব্যাস এসে যুধিষ্ঠিরকে নানা ভাবে আশ্বস্ত করেন। স্ত্রীপর্বে পুত্র-শোকাতুরা গান্ধারী সকল পাণ্ডবকে অভিসম্পাত দিতে উদ্যত হলে ব্যাস এসে তাঁকে নিরস্ত করেন।[২১] যুদ্ধান্তে যে পাপবোধে যুধিষ্ঠির ভারাক্রান্ত বোধ করছিলেন তার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে ব্যাসই যুধিষ্ঠিরকে অশ্বমেধ যজ্ঞ করে পাপনাশ করার পরামর্শ দেন।[২২] ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তি, ও বিদুর যখন বনগমনে উদ্যত, তখনও ব্যাস এসে তাঁদের সান্ত্বনা ও আশ্বাস দেন।[২৩] অলৌকিক শক্তির প্রয়োগে সমস্ত মৃত সৈনিকদের এক রাতের জন্যে পরলোক থেকে মর্তে নিয়ে আসেন ও বহু ক্ষত্রিয় নারী তখন গঙ্গায় প্রাণত্যাগ করে স্বামীদের সান্নিধ্যে চলে যান।[২৪] যদুবংশ যখন ধ্বংস হচ্ছিল তখন অর্জুন ব্যাসের কাছেই আসেন কী করণীয় সে বিষয়ে পরামর্শ করতে।[২৫] অনুশাসন পর্বে দেখি একটি কীট শকটের নিচে চাপা পড়তে যাচ্ছিল, ব্যাস তাকে বাঁচান ও সে পরজন্মে ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মায়। জীবের প্রতি মমতা ব্যাসের সহজাত বৃত্তি এবং মহাকাব্য রচয়িতার পক্ষে এটি যে একটি অপরিহার্য গুণ তা দেখবার জন্যেই যেন এ ঘটনার উল্লেখ। শেষ জীবনে ব্যাস আবার তাঁর প্রথম সাধনস্থান হিমালয়েই ফিরে যান এবং তপস্যায় মগ্ন হন। ব্যাসের মৃত্যুর কথা শাস্ত্রে লেখে না।
চারটি বেদের বিভাজন, সমস্ত মহাভারত ও অষ্টাদশ পুরাণের রচনা ব্যাসেরই কৃতি— এ কথা বলা হয়। স্পষ্টই বোঝা যায়, কোনও একজন মানুষকে এতগুলি কাজ করতে হলে তাঁকে প্রায় আড়াই হাজার বছর বেঁচে থাকতে হয়, এবং ব্যাস যে তেমনই বেঁচে ছিলেন তার কোনও উল্লেখ কোথাও নেই। তা হলে দাঁড়ায়, ব্যাস একটি সংজ্ঞা মাত্র, যিনি বেদভাগ না করলেও মহাভারতের রচয়িতা বলে তাঁকে স্বীকার করা হয়ে থাকে। আমরা জানি, মহাভারত মূল রচনা ও অন্তত দু-তিনটি প্রক্ষিপ্ত অংশের সংকলনে নির্মিত, এর শেষতম রূপায়ণের সঙ্গেই রচয়িতা হিসেবে ব্যাসের যোগ। বেদ এবং পুরাণের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক না থাকাই সম্ভব, যদি না বেদবিভাজন ব্যাপারটি মহাভারতের সমকালীন হয়ে থাকে।
এতগুলি গ্রন্থের রচয়িতা বলে ব্যাসকে চিহ্নিত করবার উদ্দেশ্য স্পষ্ট; তাঁর পাণ্ডিত্য সম্বন্ধে পাঠকের শ্রদ্ধা জাগানো। মহাভারত পড়ে পাঠক শ্রদ্ধায় অভিভূত হন, কিন্তু সে শুধু তাঁর পাণ্ডিত্যে নয়, তাঁর প্রজ্ঞায়, তাঁর ভূয়োদর্শিতায়। পাঠকের এই ব্যাপারে একটা দ্বিধা থেকে যায়: যে মানুষটি বিবাহ করেননি, সংসারের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা যাঁর পুত্র শুকের সংসার মাত্র কিছুকালের জন্যে কাছ থেকে দেখা, যিনি রাজপ্রাসাদে থেকে মূলত অসম্পৃক্ত, কেননা ব্যক্তিগত কোনও বন্ধনই তাঁর ছিল না, তিনি কেমন করে জীবনের এত বৈচিত্র্যের সন্ধান দিলেন? মহাভারত নিজের সম্বন্ধে বলেছে, ‘যা এখানে নেই তা কোথাওই নেই।[২৬] এ কথা বহু দূর পর্যন্ত আক্ষরিক অর্থেই সত্য। কিন্তু ব্যাস কেমন করে এত গভীর এবং এত ব্যাপক ভাবে জীবনকে জানলেন? তিনি শোকে সান্ত্বনা দিয়েছেন বার বার, এমনকী শোকে আপ্লুত হয়ে অশ্রুপাতও করেছেন, পাণ্ডবদের মঙ্গল কামনা করে পরামর্শ দিয়েছেন বারে বারে, কৌরবদের বলেছেন সর্বনাশের পথে না গিয়ে পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করতে। অর্থাৎ তিনি কৌরব-পাণ্ডবদের ভাগ্যভবিষ্যৎ সম্বন্ধে উদাসীন ছিলেন না। কিন্তু এগুলি ত মানবহিতৈষা, তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলি সম্বন্ধে মহাভারত প্রায় নীরব। পরাশরকে তিনি চোখেই দেখেননি, সত্যবতীর সঙ্গে মাতাপুত্র সম্পর্ক ধরে এমন কোনও আলাপ নেই যার থেকে সত্যবতীর অপত্যস্নেহ বা ব্যাসের মাতৃভক্তির কোনও নিদর্শন পাই। তিনি জননীর আজ্ঞা পালন করেছেন, কিন্তু সেটা ত কৰ্তব্য, জননীকে ভালবেসে বা ভক্তি করে তা করেছেন এমন কোনও প্রমাণ নেই। শুকের সম্পর্কেও খবর মেলে দেবীভাগবত পুরাণে— মহাভারত তাঁর সম্পর্কে প্রায় নীরব। সেখানে শুধু শুনি আর পাঁচজন শিষ্যের সঙ্গে শুকও তাঁর কাছে বিদ্যালাভ করেছেন ও মহাভারত শুনেছেন।[২৭] পিতাপুত্রের ব্যক্তিগত সম্পর্ক কোথাও চিত্রিত হয়নি। তা হলে ব্যক্তিগত, পারিবারিক মানবিক সম্পর্কগুলির মধ্যে ব্যাসকে দেখানোই হয়নি, অথচ ব্যাস সারা মহাভারত জুড়ে বিস্তর মানবিক সম্পর্কের আলেখ্য আঁকলেন। পাঠক বিব্রত বোধ করেন: ব্যাসের জীবন এমন নিরালম্ব রূপে দেখানো হল কেন? রামায়ণের শুরুতে এবং গোটা উত্তরকাণ্ডে বাল্মীকি স্পষ্ট এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় বর্তমান এবং সেখানে তিনি কঠোর তপস্বী, সীতার স্নেহপরায়ণ পালকপিতা, লবকুশের আচার্য এবং সীতা ও তাঁর সন্তানদের প্রতি মর্মান্তিক অবিচার করার জন্যে কঠিন শপথ করে রামকে ধিক্কার দিচ্ছেন। এখানে কোথাও কোনও বিরোধ নেই। সীতা ও লবকুশ ছাড়া কোনও মানবিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে উপস্থাপিত করা হয়নি, যেখানে তিনি দেখা দিচ্ছেন সেখানে তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণ অবিভক্ত।
ব্যাস কিন্তু নানা ভাবেই জটিল। কী ভাবে ব্যাসকে দেখব? তাঁর জীবনের দীর্ঘকাল কেটেছে তপস্যায়। জীবনের নানা পর্ব সম্বন্ধে তাঁর উপদেশ, কিন্তু জীবনকে তিনি ব্যক্তিজীবনের পরিসরে তো দেখলেনই না, সে সম্বন্ধে এত উপদেশ দেওয়ার অধিকার তাঁর জন্মাল কী ভাবে? তখন পাঠককে মনে করতে হয়, অসম্পৃক্ত থাকলে প্রবহমান সংসারের জীবন থেকে যে দূরত্ব থাকে সত্যকার চক্ষুষ্মান ব্যক্তিকে তা এক ধরনের তৃতীয় নেত্র দেয়; সে এক পূর্ণতর দৃষ্টি পায়, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় যা আবিল হয়নি। দূর থেকে অন্যদের জীবন দেখে মনের গভীরে তাকে বিশ্লেষণী উপলব্ধির দ্বারা ব্যাখ্যা করতে পারলে যে দেখা, সে শুধু সত্য দেখা নয়, ব্যাপ্তিমান স্থায়ী দেখা, তাৎক্ষণিকের দ্বারা সীমিত নয়। শাস্ত্রে তাই বলে ‘কবিঃ ক্রান্তদর্শী’– কবির দৃষ্টি বর্তমান কাল ও অব্যবহিত পরিস্থিতিকে পেরিয়ে দেখতে পায়।
ব্যাসের চরিত্রে অন্য যে ব্যাপারটি পাঠকের প্রতিক্রিয়াকে দ্বিধার মধ্যে আনে তা হল ব্যাসের দুটি আচরণ। প্রথম, ব্যাস ঋষির পুত্র, স্বয়ং তপস্বী। কিন্তু রাজপ্রাসাদের, অন্যায় পাশা খেলায় যুধিষ্ঠির একের পর এক যা যা বাজি রেখে হারছেন তার অনেকটাই যে যুধিষ্ঠিরের অনধিকারের সীমায় তা তিনি নির্দেশ করলেন না। এর ফলে প্রকাশ্য রাজসভায় রাজনন্দিনী, রাজকুলবধূর মর্মান্তিক লাঞ্ছনা ঘটল, ঋষির বিবেক তা নিষ্প্রতিবাদে দেখল। এইখানে ব্যাসের প্রথম ও প্রধান অপরাধ, বাকি অপরাধগুলি এর থেকেই এসেছে। কৌরবদের তিনি ভর্ৎসনা করেছেন, কিন্তু যুদ্ধ নিবারণ করতে প্রয়াসী হননি। সারা যুদ্ধকাণ্ড ব্যাপ্ত করে দেখি, ব্যাস দ্বিমনা, তাঁর আনুগত্যও যেন দ্বিধাগ্রস্ত। তাঁর অন্তরের পক্ষপাতিত্ব যে পাণ্ডবদের পক্ষে, এতে কোনও সন্দেহ থাকে না; কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডু দুজনেই তাঁর ঔরস সন্তান (নিয়োগের বলে)। এদের মধ্যে তিনি পক্ষপাতশূন্য আচরণ করতে চেষ্টা করেছেন কিন্তু পারেননি, যা বিবেকবান ঋষির পক্ষে অন্যায়। যুযুৎসু বা বিদুর যে নিরপেক্ষতা দেখিয়েছেন ব্যাস তা পারেননি। তাঁর বিবেক দ্বিধাগ্রস্ত। মহাভারত-প্রণেতা ঋষিকবি সম্বন্ধে পাঠকের কী প্রতিক্রিয়া হবে? তাঁকে বিচারে অপরাধী সাব্যস্ত করবে, না তাঁর বিচারে বিমুখ থাকবে? এই ব্যাপারটা পাঠককে রীতিমত ব্যাকুল করে এবং ধীরে ধীরে চরম এক প্রত্যয়ে পৌঁছে দেয়; তা হল: কেবলমাত্র মর্মান্তিক আততি থেকেই মহৎ সৃষ্টি সম্ভব। ব্যাস যদি সরলরৈখিক চরিত্র হতেন, বাল্মীকির মতো শুধু শেষ পর্বে অপমান ও প্রত্যাখ্যান পেতেন তা হলে তাঁর সৃষ্টিও রামায়ণের মতোই সরল হত, পাঠকের প্রতিক্রিয়াতে এত জটিলতা বা যন্ত্রণা থাকত না। কিন্তু ব্যাসের জীবন, উপলব্ধি, আন্তর-সংঘাত সবই তাঁকে ধীরে ধীরে মহৎ সৃষ্টির স্রষ্টায় পরিণত করেছিল, তাই পাঠকের পক্ষে তাঁর জীবন বা সৃষ্টি কোনওটারই প্রতি সাড়া দেওয়া সহজ হয় না— এত মহৎ, এত দুরূহ, এত ঐশ্বর্যবান মহাকাব্যে সাড়া দেওয়াও সে জন্যে বহু মর্মযন্ত্রণা, বোধ ও বোধির বহু যাতনাময় স্তর পেরিয়ে তবেই সম্ভব। এ মহাকাব্যের জনপ্রিয় হওয়ার কথাই ওঠে না: মানস ক্লেশে দীর্ণ, জীবনের উপলব্ধিতে ঋদ্ধ, ধর্মবোধে ভাস্বর যে পাঠক এ মহাকাব্য তারই প্রিয়। সংখ্যায় তারা অল্প, কিন্তু তাৎপর্যে তারা গরীয়ান।
***
১. স্বর্গারোহণপর্ব; (৩:১৪)
২. স্বর্গারোহণপর্ব; (৩:১১, ৩৫)
৩. আদিপর্ব; (১১:২১, ৯৩:৩৮, ৯৪:৬২)
৪. আদিপর্ব; (৯৪:৯৪); হরিবংশ (১৬:২৯)
৫. আদিপর্ব; (১৬:৪৮-৫১)
৬. আদিপর্ব; (১২০:২৯, ১২২:৪০)
৭. আদিপর্ব; (১১৭:১৬)
৮. সভাপর্ব; (৪১:৩১)
৯. উদ্যোগপর্ব; (৮৬:১৯-২২)
১০. ভীষ্মপর্ব; (৪:৪১, ৪২)
১১. ভীষ্মপর্ব; (১১৪:১২)
১২. ভীষ্মপর্ব; (১০০:৩০-৩২)
১৩. অনুশাসনপর্ব; (১৫৩:২৭, ২৮)
১৪. শান্তিপর্ব; (৩১১-৩১৪] অধ্যায়)
১৫. আদিপর্ব; (১৫৭:১৫)
১৬. সভাপর্ব; (৪৯:১০) ১৭. আরণ্যকপর্ব; (৮:২৩)
১৮. ভীষ্মপর্ব; (২:৮, ৯)
১৯. শান্তিপর্ব; (৪৭:৫)
২০. আশ্বমেধিকপর্ব; (৩:২০) ২১. স্ত্রীপর্ব; (১৩:৭)
২২. আশ্বমেধিকপর্ব; (৩:৯)
২৩. আশ্বমেধিকপর্ব; (২:২০; ৩:১-৫)
২৪. আশ্রমবাসিকপর্ব; (৪১:২১-২৪)
২৫. মৌষলপর্ব, পুরো অধ্যায়
২৬. যদিহাস্তি তদন্যত্র যন্নেহাস্তি ন তৎ ক্বচিৎ। আদি (৫৬:৩৩)
২৭. দেবীভাগবত (১:১৪), হরিবংশ (১:১৮:৫১)