১১. মথুরবাবুকে খুঁজে বের করতে

১১.

মথুরবাবুকে খুঁজে বের করতে দিন-দুই সময় গেল। উনি থাকেন গিরিবাবু লেনে। বাইরে থেকে বাড়ির চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই ভেতরের ছাঁদ-ছিরি কেমন। ঘরে ঢুকেও বোঝা যায় না, তবে কথাবাতার থেকে, তাঁর। খাস বসার ঘরের দু-তিনটে সেফের বহর দেখে আন্দাজ করা যায়–মানুষটি লেনদেন ভালই করেন।

জগন্নাথ একা আসেনি। সঙ্গে কিকিরা আর তারাপদ। চন্দন বাড়ির ভেতরে ঢোকেনি। বাইরে আছে।

মথুরবাবুর বয়েস বছর পঞ্চান্ন। চেহারার বাঁধুনি আছে। গায়ের রং তামাটে। মাথার চুল ছোট-ছোট। চোখ দুটি ওপরে যত শান্ত মনে হয়, তেমন নয়। নজর করলে বোঝা যায় উনি শুধু চতুর নন, নিষ্ঠুর।

জগন্নাথ নিজের পরিচয় দিল।

মথুরবাবুর খাস বসার ঘরে চেয়ার নেই, ফরাস পাতা। এক ফরাসে তিনি বসেন। অন্যরা বসে আলাদা ফরাসে।

মথুরবাবু সিগারেট খেতে-খেতে বললেন, “ও! তুমি অতুলদার ছেলে! কোথায় ছিলে এতদিন?”

জগন্নাথ বলল, “আপনার কথা আমি জানতাম না।”

“তোমার মা জানতেন।”

“মা নেই।”

“জানি।…তোমার সঙ্গে এঁরা কে?”

জগন্নাথ কিকিরাকে দেখিয়ে বলল, “ইনি আমার উকিল!” বলে তারাপদকে দেখাল। “আমার বন্ধু!”

মথুরবাবু কিকিরাকে দেখলেন। “উকিল কেন?”

“আমি ওঁকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি।”

“কেন?”

জগন্নাথ যেন হাসল একটু। কিকিরা যেমনটি শিখিয়ে দিয়েছিল সেইভাবেই কথা বলছিল সে। কিকিরা না থাকলে জগন্নাথ আজ এখানে আসতে পারত না।

“আপনার সঙ্গে লেখাপড়া করতে হবে।”

“কিসের?”

“আমি সেই চাবি আর কাগজ নিয়ে এসেছি।”

মথুরবাবু যেন সজাগ হলেন, নড়েচড়ে বসলেন। “কোথায় পেলে?”

“মায়ের বাঁধানো লক্ষ্মীর পটের পেছন দিকে।“

“সে কী! এতদিন..”

“লক্ষ্মীর বাঁধানো ছবিটার পেছন দিকটা অ্যালুমিনিয়াম শিট দিয়ে ঢাকা ছিল। ছবির পেছনে কাগজ থাকে, বোর্ড থাকে। পোকা ধরার ভয়ে অনেকে টিন দিয়ে মুড়ে নেয়। মায়ের এই লক্ষ্মীর পট আমাদের তিন পুরুষের। মা পটটিকে যত্ন করে রাখতেন। পুজো করতেন রোজ।”

“আচ্ছা, তা হলে তোমার মা লক্ষ্মীর পটের মধ্যে–মানে বাঁধানো ছবির মধ্যে চাবি রেখেছিলেন। অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে ছবির পেছনটা ঢাকা রেখেছিলেন।…তোমার মায়ের বুদ্ধি তো ভীষণ।…যেভাবে রেখেছিলেন চাবিটাবি তাতে কার বাপের সাধ্যি ওর খোঁজ পাবে।”

জগন্নাথ জানে, লক্ষ্মীর পটের পেছনে চাবি আর কাগজের টুকরো খুঁজে পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ভাগ্যিস কিকিরা সেদিন বাড়িতে গিয়ে তন্নতন্ন করে সব দেখেছিলেন–তাই না পাওয়া গেল।

 “এই চাবিটা…”

“আমার এখানে একটা সিন্দুক আছে। সেকেলে সাবেকি আমলের সে। তার তিনটে ভাগ। তিন দরজা। শেষ ডালাটার দুটো আলাদা চাবি। একটা চাবিতে ডালা খোলা যাবে না। ডাবল লক সিস্টেম। একে বলত, পারসন্ কোম্পানির দুশো বারো নম্বর আয়রন সেফ। তোমার বাবা সেখানে কিছু জিনিস জমা রেখে গিয়েছেন। আমি একটা চাবি রেখেছি, অন্যটা তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন। …চাবিটা তুমি এনেছ?”

“হ্যাঁ।“

“কিন্তু একটা কথা কি তুমি জানো? ওর মধ্যে যা আছে তার অর্ধেক তোমার, বাকি আমার?”

“জানি।”

“আরও একটা কথা আছে হে! আমরা দুজনে একটা কাগজে বখরার শর্ত লিখে নিজেদের নাম সই করেছিলাম। সেই কাগজের অর্ধেকটা ছিঁড়ে আমার কাছে রেখেছি। বাকিটা তোমার বাবার কাছে ছিল। সেই কাগজটাও যে চাই।”

কিকিরা এবার কথা বললেন, “কাগজটাও আপনি পাবেন। কিন্তু একটা কথা আপনি বলুন? জগন্নাথের বাবা যেদিন চাবি আর কাগজ নিয়ে ফিরছিলেন সেদিনই কি তিনি মোটর সাইকেলের ধাক্কা খাননি?”

মথুরবাবু নিজের কপাল দেখালেন। “বরাত! একেই বরাত বলে উকিলবাবু! আহা, বেচারি অতুলদা…কী বলব…এমন করে তিনি চলে যাবেন…।”

“তিনি গেছেন? না, তাঁকে আপনি যাওয়াবার চেষ্টা করেছিলেন?”

মথুরবাবু চমকে উঠলেন, “এ কী কথা বলছেন আপনি!”।

“উনি চলে যাবার পর আপনি লোক লাগিয়ে সেই দিনই ওঁর কাছ থেকে চাবি আর কাগজটা হাতিয়ে নেবার চেষ্টা করেছিলেন। আপনি চোর, ডাকাত, খুনি…”।

মথুরবাবু রাগের মাথায় সোজা হয়ে বসলেন। তাঁর চোখ জ্বলছিল যেন। বাঁধানো দাঁত আলগা হয়ে উঠে যাচ্ছিল। “আপনাকে আমি চাবকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে পারি, জানেন।”

“আপনাকে আমি জেলে ভরতে পারি! চোর, জোচ্চোর আপনি?”

“আমি চোর, না, জগন্নাথের বাবা চোর! চোরাই মাল বোঝেন, স্মাগণ্ড, মাল। সেই মালহীরে, চুনি, নীলা আমার জিম্মায় রেখে যে চলে যায় তাকে আপনি ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির বলবেন! লাখ দুই আড়াই টাকার জিনিস। আজ তার বাজার দর…”

জগন্নাথ উঠে দাঁড়াল। “আমার বাবা চুরি করেছিলেন। পাপের ফল তিনি ভোগ করেছেন। আপনি কিন্তু বেঁচে আছেন?” বলতে বলতে জগন্নাথ পকেট থেকে একটা বড় চাবি বার করল। করে দেখাল চাবিটা। বলল, “নিন, আপনার চাবি।” বলে চাবিটা মথুরবাবুর দিকে ছুঁড়ে দিল।

মথুরবাবুর কপালে এসে লাগল চাবিটা।

“এই কাগজটা কিন্তু আপনি পাবেন না। আমি ছিঁড়ে ফেললাম।” জগন্নাথ পুরনো ময়লা ছেঁড়া একটা কাগজ কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলল।

মথুরবাবু চাবি কুড়িয়ে নিলেন।

কিকিরাও উঠে দাঁড়ালেন। তারাপদ উঠে পড়ল।

কিকিরা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “চলি মথুরবাবু। নাকি শুদ্ধানন্দ প্রেতসিদ্ধর মালিক মহারাজ!”

মথুরবাবু আঁতকে উঠলেন।

কিকিরা বললেন, “আপনি পাকা লোক। অনেকে মন্দির-চন্দির বসিয়ে ভাল রোজগারের পথ করে নেয়। আপনি বন্ধক তেজারতি চুরি জোচ্চুরির কারবারের সঙ্গে আর-একটি ভাল কারবার ফেঁদেছেন। কিন্তু আপনার চেলাটি–প্রেসিদ্ধ একেবারে নবিশ। কিস্যু জানে না।”

“জা-জা…জানে না?”

“আজ্ঞে না। ওর খেলায় অনেক খুঁত। গন্ধকের গুঁড়ো ছড়িয়ে কি বোকা বানানো যায়! আপনার নাক থাকলে গন্ধ পাবেন। আর ওই মরা কাক, মড়ার খুলির মাথায় আলোর পিটপিট করে জ্বলে ওঠা মশাই, বাচ্চাদের যে জ্ঞানের আলো’ খেলনা পাওয়া যায়–এ তো তাই, ব্যাটারি আর তার নিয়ে বসে খেলা। দেখানো! বলবেন। আত্মা এলে যে আলোর কাঁটা ছোটে–সেটা কী? ঘড়িতে রেডিয়াম দেখেননি? ছি ছি–এগুলো কি খেলা! নবিশ একেবারে!…আরও একটা কথা মথুরামোহনমশাই! জগন্নাথের মা বলে যে জিনিসটিকে প্রেসিদ্ধ হাজির করেছিলেন, তার জন্যে দুটো বেশি পয়সা খরচ করলে পারতেন। কারিগর ভাল নয়; মামুলি ডামিও করতে পারে না। নাইলনের পরদা ফেলে কত আর সামলানো যাবে। টেপ-রেকর্ডটাও খারাপ। জগন্নাথের মায়ের গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছিল বাজে টেপ…।”

মথুরবাবু উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। ভয়ে কাঠ। ঘামছিলেন। “চলি, প্রেতসিদ্ধ বাবামশাই। একটা কথা বলে যাই। জোয়ারদারসাহেব পুলিশ নিয়ে আপনাদের আখড়ায় গিয়েছেন। নিচে আমাদের সঙ্গে এসেছেন এক অফিসার, লালবাজার থেকে। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের কোনো ক্ষতি হলে…”

মথুরবাবুর গলা উঠছিল না। “আপনি কে?”

“কিকিরা দি ম্যাজিশিয়ান। ওরফে বিভুপদ হাঁস।”

“আপনি এত জানলেন কেমন করে?”

“সর্দি, রুমাল, ইনফ্রা রেড চশমা। একসময় স্নাইপারস্কোপিক বাইনোকুলার বলা হত যাকে, তারই একটা লেটেস্ট মডেল। আমি ওই মজার চশমাটি পরে নিতাম ঘরে বসে। প্রেতসিদ্ধর চেলারা ভাবত, আমার সর্দি হয়েছে বলে নাকে রুমাল চাপা দিচ্ছি। এ-হল আমাদের রুমালের খেলা! চশমা বদল করে নিতাম ঘরে ঢুকে। অন্ধকারে আপনার প্রেসিদ্ধর বাহাদুরি প্রায় সবই দেখতে পেতাম।..যাক, চলি। চলো হে জগন্নাথ, চলো তারাপদ।“

ওরা উঠে দাঁড়িয়েছিল।

মথুরবাবু হতভম্ব হয়ে বললেন, “এই চাবিটা..?”

জগন্নাথ বলল, “ওটা মামুলি চাবি। নকল। আসলটা গঙ্গার জলে ফেলে দেব।”

মথুরবাবু মাথার চুল ছিঁড়ে পাগলের মতন দাপাতে লাগলেন।

কিকিরা হাসতে-হাসতে বললেন, “একটু মাথা ঠাণ্ডা করে নিন। পুলিশ এলে দুটো কথা তো বলতেই হবে।”