১১
ইয়ুং কী রেস্টোরান্টে আমাদের দুর্দান্ত ভালো চীনে খাবার খাইয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে পূর্ণেন্দুবাবু বললেন, ‘আপনাদের তিনটের আগে যখন হোটেলে যাবার দরকার নেই তখন কিছু কেনাকাটার থাকলে এই বেলা সেরে নিন। অবিশ্যি কালকেও সময় পাবেন। আপনাদের ফ্লাইট ত সেই রাত দশটায়।’
‘কিনি বা না কিনি, দু’একটা দোকানে অন্তত একটু উঁকি দিতে পারলে ভালো হত,’ বলল ফেলুদা।
‘আমার দোকানে নিয়ে যেতে পারতাম, কিন্তু সে ত ভারতীয় জিনিস। আপনাদের ইন্টারেস্ট হবে না বোধহয়।’
লালমোহনবাবুর একটা পকেট ক্যালকুলেটার কেনার শখ—বইয়ের বিক্রীর হিসেবটা নাকি চেক করতে সুবিধে হয়—তাই ইলেক্ট্রনিক্সের দোকানেই যাওয়া স্থির হল।
‘আমার চেনা দোকানে নিয়ে যাচ্ছি,’ বললেন পূর্ণেন্দুবাবু, ‘জিনিসও ভালো পাবেন, দামেও এদিক ওদিক হবে না।’
ফেলুদা আর লালমোহনবাবু দুজনেই তাদের প্রাপ্য পাঁচশো ডলার নিয়ে এসেছেন সঙ্গে করে। তাই হংকং-এর মতো জায়গা থেকে কিছু কেনা হবে না এটা হতেই পারে না।
লী ব্রাদারসে ইলেক্ট্রনিক্স-এর সব কিছু ছাড়াও ক্যামেরার জিনিসপত্রও পাওয়া যায়। আমার সঙ্গে ফেলুদার পেনট্যাকস, তার জন্য কিছু রঙীন ফিল্ম কিনে নিলাম। আজ আর সময় হবে না, কিন্তু কাল মা-বাবার জন্যে কিছু কিনে নিতে হবে। লালমোহনবাবু যে ক্যালকুলেটারটা কিনলেন সেটা এত ছোট আর চ্যাপ্টা যে তার মধ্যে কোথায় কী ভাবে ব্যাটারি থাকতে পারে সেটা আমার মাথায় ঢুকল না। ফেলুদা একটা ছোট্ট সোনি ক্যাসেট রেকর্ডার কিনে আমাকে দিয়ে বলল, ‘এবার থেকে মক্কেল এলে এটা অন করে দিবি। কথাবার্তা রেকর্ড করা থাকলে খুব সুবিধে হয়।’
দোকানের পাট সেরে তিনটে নাগাদ আবার পূর্ণেন্দুবাবুকে বাড়িতে গিয়ে আমাদের মালপত্র তুলে রওনা দিলাম। পূর্ণেন্দবাবুকে একবার দোকানে যেতে হবে, এবং সেটা আমাদের হোটেলের উলটো দিকে, তাই আমরা ট্যাক্সিতেই যাব পার্ল হোটেলে।
‘আমি কিন্তু চিন্তায় থাকব মশাই’, বললেন পূর্ণেন্দুবাবু। ‘কী হল না-হল একটা ফোন করে জানিয়ে দেবেন।’
রাস্তায় বেরিয়ে সামনেই একটা ট্যাক্সি পাওয়া গেল। মাথাটা রূপোলী, গা-টা লাল—এই হল হংকং ট্যাক্সির রং। লম্বা আমেরিকান গাড়ি, তিনজনে উঠে পিছনে বসলাম।
‘পার্ল হোটেল,’ বলল ফেলুদা।
ট্যাক্সি ফ্ল্যাগ ডাউন করে চলতে আরম্ভ করল।
লালমোহনবাবুর কিছুক্ষণ থেকেই একটা ঝিম-ধরা নেশা-করা ভাব লক্ষ করছিলাম। জিগ্যেস করাতে বললেন সেটা অল্প সময়ে মনের প্রসার প্রচণ্ড বেড়ে যাওয়ার দরুন। আর বাড়লে নাকি সামলানো যাবে না।–‘কলকাতায় কেবল চীনে ছুতোর মিস্ত্রি আর চীনে জুতোর দোকানের কথাই শুনিচি। তারা যে এমন একখানা শহর গড়তে পারে সেটা চাক্ষুষ না দেখলে বিশ্বাস করতুম না মশাই।’
পূর্ণেন্দুবাবু বলেছিলেন পায়ে হেঁটে পার্ল হোটেলে যেতে লাগে পাঁচ মিনিট। অলি গলি দিয়ে দশ মিনিট চলার পরেও যখন পার্ল হোটেল এল না, তখন বেশ ঘাবড়ে গেলাম। ব্যাপার কী? ফেলুদা আরেকবার গলা চড়িয়ে বলে দিল, ‘পার্ল হোটেল। উই ওয়ণ্ট পার্ল হোটেল।’
উত্তর এল—‘ইয়েস, পার্ল হোটেল।’ কালো কোট, কালো চশমা পরা ড্রাইভার, ভুল শুনেছে এটাও বলা চলে না, আর একই নামে দুটো হোটেল থাকবে সেটাও অবিশ্বাস্য।
প্রায় কুড়ি মিনিট চলার পর ট্যাক্সিটা একটা রাস্তার মোড়ে এসে থামল।
এটা যে একেবারে চীনে পাড়া তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রাস্তার দুদিকে সারবাঁধা আট-দশ তলা বাড়ি। সেগুলোর প্রত্যেকটির জানালায় ও ছোট ছোট ব্যালকনিতে কাপড় শুকোচ্ছে, বাইরে থেকেই বোঝা যায় ঘরগুলোতে বিশেষ আলো বাতাস ঢোকে না। দোকান যা আছে তার মধ্যে টুরিস্টের মাথা-ঘোরানো হংকং-এর কোনো চিহ্ন নেই। সব দোকানের নামই চীনে ভাষায় লেখা, তাই বাইরে থেকে কিসের দোকান তা বোঝার উপায় নেই।
‘পার্ল হোটেল—হোয়্যার?’ ফেলুদা জিগ্যেস করল।
লোকটা হাত বাড়িয়ে বুড়ো আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল সামনের ডাইনের গলিটায় যেতে হবে।
মিটারে ভাড়া বলছে হংকং ডলারে, সেটা হিসেব করে দাঁড়ায় প্রায় একশো টাকার মতো। উপায় নেই। তাই দিয়ে আমরা তিনজন মাল নিয়ে নেমে পড়লাম। আমি আর লালমোহনবাবুর দিকে চাইছি না, জানি তাঁর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, হংকং-এ ক্রাইমের বাড়াবাড়ি সম্বন্ধে যা কিছু শুনেছেন সবই এখন বিশ্বাস করছেন।
যে গলিটার দিকে ড্রাইভার দেখিয়েছে সেটায় সূর্যের আলো কোনোদিন প্রবেশ করে কিনা জানি না; অন্তত এখন ত নেই।
আমরা মোড় ঘুরে গলিটায় ঢুকলাম, আর ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কোত্থেকে কারা যেন এসে আমাদের ফিরে ফেলল, আর তার পরমুহূর্তেই মাথায় একটা মোক্ষম বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে ব্ল্যাক-আউট।
যখন জ্ঞান হল তখন বুঝতে পারলাম একটা ঘুপচি ঘরের মেঝেতে পড়ে আছি। ফেলুদা আমার পাশে একটা কাঠের প্যাকিং কেসের উপর বসে চারমিনার খাচ্ছে। একটা অদ্ভুত গন্ধে মাথাটা কিরকম ভার ভার লাগছে। পরে জেনেছিলাম সেটা আফিং-এর গন্ধ। বৃটিশরা নাকি ভারতবর্ষের আফিং চীনে বিক্রী করে প্রচুর টাকা করেছিল, আর সেই সঙ্গে চীনেদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিল আফিং-এর নেশা।
লালমোহনবাবু এখনও অজ্ঞান, তবে মাঝে মাঝে নড়ছেন-চড়ছেন, তাই মনে হয় এবার জ্ঞান ফিরবে।
আমাদের মালপত্র? নেই।
ঘরে গোটাপাঁচেক ছোট বড় প্যাকিং কেস, একটা কাত হয়ে পড়ে থাকা বেতের চেয়ার, দেয়ালে একটা চীনে ক্যালেণ্ডার—ব্যস, এছাড়া কিচ্ছু নেই। বাঁ দিকের দেয়ালে প্রায় দেড় মানুষ উঁচুতে একটা ছোট্ট জানালা, তাই দিয়ে ধোঁয়া মেশানো একটা ফিকে আলো আসছে। বোঝা যাচ্ছে দিনের আলো এখনো ফুরোয়নি। ডাইনে আর সামনে দুটো দরজা, দুটোই বন্ধ। শব্দের মধ্যে মাঝে মাঝে একটা পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছি। চীনেরা খাঁচায় পাখি রাখে এটা অনেক জায়গায় লক্ষ করেছি, এমন কি দোকানেও।
‘উঠুন লালমোহনবাবু,’ বলল ফেলুদা, ‘আর কত ঘুমোবেন?’
লালমোহনবাবু চোখ খুললেন, আর সঙ্গে সঙ্গে চোখ কুঁচকোনোতে বুঝলাম মাথার যন্ত্রণাটা বেশ ভালো ভাবেই অনুভব করছেন।
‘উঃ, কী ভয়ংকর অভিজ্ঞতা!’ কোনোমতে উঠে বসে বললেন ভদ্রলোক। ‘এ কোথায় এনে ফেলেছে আমাদের?’
‘গুম ঘর,’ বলল ফেলুদা। ‘একেবারে আপনার গল্পের মতো, তাই না?’
‘আমার গল্প? ছোঃ!’
ছোঃ বলতেই বোধহয় মাথাটা একটু ঝন্ঝন্ করে উঠেছিল, তাই নাকটা কুঁচকে একটু থেমে এবার গলাটা খানিকটা নামিয়ে নিয়ে বললেন—
‘যা ঘটল তার কাছে গপ্প কোন ছার? সব ছেড়ে দোব মশাই। ঢের হয়েছে। হনডুরাস ড্যাড্যাংড্যাং, ক্যাম্বোডিয়ায় কচকচি আর ভ্যানকুভারের ভ্যানভ্যানানি—দুর্, দুর্!’
‘আর লিখবেন না বলছেন?’
‘নেভার।’
‘আপনার এই স্টেটমেন্ট কিন্তু রেকর্ড হয়ে গেল। এর পরে আবার লিখলে কিন্তু কথার খেলাপ হবে।’
ফেলুদার পাশেই রাখা আছে তার নতুন কেনা ক্যাসেট রেকর্ডার। আর কিছু করার নেই তাই ওটা নিয়েই খুটুর খাটুর করছে। রেকর্ডিং-এর কথাটা যে মিথ্যে বলেনি সেটা ও প্লে-ব্যাক করে জানিয়ে দিল।
‘এ তো সোমানিরই কীর্তি বলে মনে হচ্ছে’, বললেন লালমোহনবাবু।
‘নিঃসন্দেহে। এখন আমাদের লাগেজটা ফেরত পেলে হয়। রিভলভারটা গেছে। কী ভাগ্যি রেকর্ডারটা নেয়নি।’
‘দুটো যে দরজা দেখছি, দুটোই কি বন্ধ?’
‘সামনেরটা বন্ধ। পাশেরটা খোলা যায়। ওটা বাথরুম।’
‘ওটাতেও পালাবার পথ নেই বোধহয়?’
‘দরজা একটা আছে। বাইরে থেকে বন্ধ। জানালা দিয়ে মাথা গলবে, ধড় গলবে না।’
লালমোহনবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতের উপর মাথা রেখে আবার শুয়ে পড়লেন।
মিনিট খানেক পরে দেখি ভদ্রলোক গুনগুন করে গান গাইছেন। অনেক কষ্টে চিনতে পারলাম গানটা। হরি দিন ত গেল সন্ধ্যা হল পার কর আমারে।
‘কড়িকাঠের দিকে চেয়ে কী ভাবছেন মশাই?’
‘মাথায় ঘা খেয়ে অজ্ঞান হয়েও যে লোকে স্বপ্ন দেখে সেটা এই এক্সপেরিয়েন্সটা না হলে জানতুম না।’
‘কী স্বপ্ন দেখলেন?’
‘এক জায়গায় ডজনখানেক বাঁদর বিক্রী হচ্ছে, আর একটা লোক ডুগডুগি বাজিয়ে বলছে—রেনেসাঁসকা সুবাসিত বান্দর—রেনেসাঁসকা সুবাসিত বান্দর—দো দো ডলার—দো দো—’
ঘরের বাইরে পায়ের শব্দ। সিঁড়ি দিয়ে উঠছে লোক। তার মানে বাইরে বারান্দা।
সামনের দরজা চাবি দিয়ে খোলা হল।
একজন কালো সুট পরা ভদ্রলোক এসে ঢুকলেন। পিছনে আবছা অন্ধকারে আরো দুটো লোক রয়েছে দেখতে পাচ্ছি। তিনজনেই ভারতীয়।
যিনি ঢুকলেন তিনি হচ্ছেন হীরালাল সোমানি। চোখে মুখে বিশ্রী একটা বিদ্রূপের হাসি।
‘কি মিস্টার মিত্তির? কেমন আছেন?’
‘আপনারা যেমন রেখেছেন।’
‘আপনি ঘাবড়াবেন না। আপনাকে লাইফ ইম্প্রিজনমেণ্ট দিইনি আমি। আমার কাম হয়ে গেলেই খালাস করে দেব।’
‘আমাদের মালগুলো সরিয়ে রাখার কী কারণ বুঝতে পারলাম না।’
‘দ্যাট ওয়জ এ মিসটেক। কান্হাইয়া! কান্হাইয়া!’
দুজন লোকের একজন কোথায় চলে গিয়েছিল, সে ডাক শুনে ফিরে এল। এতক্ষণে বুঝতে পারছি যে অন্য লোকটি সোমানির পিছনে দাঁড়িয়ে রিভলভার উঁচিয়ে রয়েছে।
‘ইনলোগকা সামান লাকে রখ্ দো ইস্ কামরেমে’, কান্হাইয়াকে আদেশ করলেন হীরালাল। তারপর ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, ‘এখানে ডিনারের অ্যারেঞ্জমেন্ট একটু মুশকিল হবে। আজ রাতটা ফাস্ট করুন। কাল থেকে আবার খাবেন, কেমন?’
কান্হাইয়া লোকটা আমাদের ব্যাগগুলো এবার ঘরের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
‘বেশি ঝামেলা করবেন না মিস্টার মিত্তির। রাধেশ্যাম হ্যাজ ইওর রিভলভার। উয়ো আলতু ফালতু আদমী নহী হ্যায়। গোলি চালাতে জানে। আর মনে রাখবেন কি হংকং ইজ নট ক্যালকাটা। প্রদোষ মিটার ইজ নোবডি হিয়ার। আমি চলি। কাল সকালে দশটার সময় এসে এরা আপনাদের ফ্রী করে দেবে। গুড নাইট।’
ঘরের আলো ইতিমধ্যে অনেক কমে গেছে। বুঝতে পারছি সূৰ্য ডুবে গেছে। এ ঘরে বাল্বের হোলডার আছে, কিন্তু বাল্ব নেই।
হীরালাল চলে গেলেন। কান্হাইয়া এগিয়ে এসে দরজাটা বন্ধ করার জন্য পাল্লাটা টানল।
‘কান্হাইয়া! কান্হাইয়া!’
মনিবের ডাক শুনে কান্হাইয়া ‘হুজুর’ বলে ডাইনে বেরিয়ে গেল, রাধেশ্যাম এগিয়ে এল তার কাজটা শেষ করে দেবার জন্য, আর সেই মুহূর্তে ঘটে গেল এক তুলকালাম কাণ্ড।
ফেলুদার সামনে ওর কাঁধের ব্যাগটা পড়ে ছিল, ও সেটাকে চোখের নিমেষে তুলে প্রচণ্ড বেগে ছুঁড়ল দরজার দিকে, আর সেই সঙ্গে এক লাফে ঝাঁপিয়ে পড়ল রাধেশ্যামের উপর।
ফেলুদার সঙ্গে থেকে আমারও একটা প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব এসে গেছে, আমিও লাফিয়ে এগিয়ে গেছি।
ইতিমধ্যে ফেলুদা জাপটে ধরেছে রাধেশ্যামকে, তার হাত থেকে রিভলভার ছিটকে পড়ে গেছে মেঝেতে। ফেলুদা ‘ওটা তোল’ বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি রিভলভারটা হাতে নিয়ে নিয়েছি—আমার হাতের রিভলভার তার দিকে তাগ করা। ছেলেবেলা এয়ার গান চালিয়েছি, পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে মিস করার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না।
রাধেশ্যাম লোকটা তাগড়াই, সে প্রাণপণে চেষ্টা করছে ফেলুদার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে। এমন সময় হঠাৎ দেখি লালমোহনবাবু ঘর থেকে একটা মাঝারি গোছের প্যাকিং কেস তুলে এনে সেটা দুহাতে ধরে তিড়িং তিড়িং এদিক ওদিক লাফাচ্ছেন রাধেশ্যামের মাথায় সেটাকে মারার সুযোগের জন্য।
সুযোগ মিলল। প্যাকিং কেসের একটা কোনা রাধেশ্যামের ঘন কালো চুল ভেদ করে তার ব্রহ্মতালুতে এক মোক্ষম আঘাতে তাকে ধরাশায়ী করে দিল। এক ঝলকে দেখলাম লোকটার চুল থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে মেঝের উপর।
ফেলুদা আমার হাত থেকে রিভলভার নিয়ে নিল। সেটা কানহাইয়ার দিক থেকে এক চুলও নড়েনি।
‘ব্যাগগুলো বাইরে আন। আমার ছোট ব্যাগটা আমার কাঁধে ঝুলিয়ে দে। বড়টা তুই হাতে নে।’
আমি আর লালমোহনবাবু মিলে আমাদের মাল বাইরে নিয়ে এলাম।
রাধেশ্যাম মেঝেতে পড়ে আছে; এবার ফেলুদার একটা আপার কাটে কানহাইয়াও তার পাশেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। যতক্ষণে এদের জ্ঞান হবে ততক্ষণে আমরা আউট অফ ডেনজার।
আমরা এতক্ষণ ছিলাম তিনতলায়। সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাস্তায় বেরিয়ে এসে দেখি চারিদিক জ্বলন্ত নিয়নে ছেয়ে আছে। চীনে ভাষার দশ হাজার অক্ষরের সব অক্ষরই যেন আমাদের গিলে ফেলতে চাইছে চতুর্দিক থেকে। তবে এটা কোনো মেন রোড নয়। পিছন দিকের একটা মাঝারি রাস্তা। এখানে ট্রাম নেই, বাসও নেই; আছে ট্যাক্সি, প্রাইভেট গাড়ি আর মানুষ।
আমরা প্রথম দুটো ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে তৃতীয়টায় উঠলাম। উঠেই ফেলুদাকে প্রশ্নটা করলাম।
‘কান্হাইয়াকে ডাকার ব্যাপারটা কি তোমার ক্যাসেটে বাজল?’
‘ঠিক ধরেছিস। হীরালাল আসতেই রেকর্ডারটা আবার অন করে দিয়েছিলাম। কান্হাইয়া বলে যখন দুবার ডাকল, তার পরেই বন্ধ করে দিয়েছিলাম। মন বলছিল ডাক দুটো কাজে লাগতে পারে। আর সত্যিই তাই হল।’
‘আপনার জবাব নেই’, বলল লালমোহনবাবু।
‘আপনারও’, বলল ফেলুদা। আমি জানি ফেলুদা কথাটা অন্তর থেকে বলেছে।
পার্ল হোটেল পৌঁছাতে লাগল দশ মিনিট, ভাড়া উঠল সাড়ে সাত ডলার।
আমাদের ঘরে গিয়েই পূর্ণেন্দুবাবুকে একটা ফোন করল ফেলুদা। ভদ্রলোক জানালেন ফেলুদাকে নাকি অনেক চেষ্টা করেও পাননি।—‘হোটেলে বলল আপনারা নাকি আসেনইনি। আমি ত চিন্তায় পড়ে গেসলাম মশাই।’
‘একবার আসতে পারবেন?’
‘পাবি বৈ কি। তাছাড়া আপনাদের জন্য খবর আছে।’
পনের মিনিটের মধ্যে পূর্ণেন্দুবাবু চলে এলেন। ফেলুদা সংক্ষেপে আমাদের ঘটনাটা বলল।
‘এইসব শুনলে বাঙালীর জন্য গর্বে বুকটা দশ হাত হয়ে ওঠে মশাই। যাক্গে, এখন আমার খবরটা বলি। সেই ক্ৰিকোরিয়ান কোথায় থাকে সেটা ত টেলিফোনের বই দেখেই বেরিয়ে গেল। কিন্তু হীরালাল সোমানির হদিসও পেয়েছি।’
‘কী করে?’
‘এখানে আরো পাঁচজন সোমানি থাকে। তাদের এক-এক করে ফোন করে বেরিয়ে গেল হীরালাল হচ্ছে কেশব সোমানির খুড়তুতো ভাই। কেশবের কাপড়ের দোকান আছে কাউলূনে। কাউলূনেই তার বাড়ি, আর হীরালাল সেখানেই উঠেছে। আপনার আর্মেনিয়ান ত সন্ধ্যেবেলা আসছে। তাইওয়ানের প্লেন এসে গেছে এতক্ষণে। হীরালাল নিশ্চয়ই আজই ছবি পাচার করবে। আমি ওয়াং শূ-কে পাঠিয়ে দিয়েছি সোমানির বাড়ির উপর চোখ রাখতে। আমাদের আপিসের এক ছোকরা। খুব স্মার্ট। তাকে বলা ছিল সোমানির বাড়ি থেকে কোনো গাড়ি বেরোতে দেখলেই যেন আমাকে ফোন করে।’
‘ক্রিকোরিয়ান কোথায় থাকে?’
‘ভিকটোরিয়া হিল। হংকং-এ। অভিজাত পাড়া। সোমানি রওনা হবার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা রওনা দিলে ওর আগেই ভিকটোরিয়া হিল পৌঁছে যাব। তখন আপনি ইচ্ছে করলে ওকে মাঝপথে রুখতে পারেন। অবিশ্যি আপনার নিজের প্ল্যানটা কী সেটা আমার জানা ছিল না।’
ফেলুদা পূর্ণেন্দুবাবুর পিঠ চাপড়ে দিল।
‘আপনি ত মশাই সাংঘাতিক বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন। আপনার রাস্তা ছাড়া আর রাস্তাই নেই। কিন্তু সেই ছোকরার কাছ থেকে ফোন পেয়েছেন কি?’
‘আমি এখানে আসার ঠিক আগেই করেছিল। অর্থাৎ মিনিট কুড়ি আগে। গাড়ি রওনা হয়ে গেছে। যিনি আসছেন তাঁর হাতে একটা ফ্ল্যাট কাগজের প্যাকেট।’
তিন মিনিটের মক্যেু আমরা পূর্ণেন্দুবাবুর গাড়িতে করে রওনা দিয়ে দিলাম।
মিনিট দশেকের মধ্যে গাড়ি প্যাঁচালো রাস্তা দিয়ে ঘুরে ঘুরে পাহাড়ে উঠতে শুরু করল। যেন হিল-স্টেশনে যাচ্ছি। হংকং এখন আলোয় আলো, আর যত উপরে উঠছি ততই সমুদ্র পাহাড় রাস্তা গাড়ি হাইরাইজ সমেত সমস্ত শহরটা আরো বেশি বেশি করে দেখা যাচ্ছে, আর লালমোহনবাবু খালি বলছেন, ‘স্বপ্ন রাজ্য, স্বপ্ন রাজ্য’।
আরো কিছুক্ষণ যাবার পর পূর্ণেন্দুবাবু বললেন, ‘এইবার বাড়ির নম্বরটা দেখে নিতে হবে।’
গাছপালা বাগানে ঘেরা দারুণ সুন্দর সুন্দর সব পুরোনো বাড়ি, দেখলেই মনে হয় সাহেবদের জন্য সাহেবদেরই তৈরি। তারই একটা বাড়ির গেটের সামনে এসে নম্বর দেখে বুঝলাম ক্ৰিকোরিয়ানের বাড়িতে এসে গেছি। আর এসেই দেখলাম ভিতরে পোর্টিকোর এক পাশে একটা কালো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে যেটা আমাদের চেনা। আমরা যখন সকালে পূর্ণেন্দুবাবুর গাড়ি থেকে নামছি, তখন এই গাড়িটাই আমাদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল।
হীরালাল সোমানির গাড়ি।
আমাদের গাড়িটা আরেকটু এগিয়ে নিয়ে গিয়ে রাস্তার ধারে একটা গাছের তলায় পার্ক করে পূর্ণেন্দুবাবু বললেন, ‘সাহেবের বাড়িটার দিকে চোখ রাখার জন্য একটা গোপন জায়গা বার করতে হবে।’
সেরকম একটা জায়গা পেয়েও গেলাম। তবে বেশিক্ষণ আড়ি পাততে হল না।
মিনিটখানেকের মধ্যেই বাড়ির সামনের দরজাটা খুলে যাওয়াতে তার থেকে একটা চতুষ্কোণ আলো বেরিয়ে পড়ল বাগানের ঘাসের উপর, আর তার পরেই নেপথ্যে বলা গুড নাইটের সঙ্গে সঙ্গে হীরালাল নিজেই বেরিয়ে এসে তাঁর গাড়িতে উঠলেন, আর গাড়িও রওনা দিয়ে দিল বিলিতি এঞ্জিনের মৃদু গম্ভীর শব্দ তুলে।
‘এবার কী করবেন?’ ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করলেন পূর্ণেন্দুবাবু।
‘সাহেবের সঙ্গে দেখা করব,’ বলল ফেলুদা।
আমরা আড়াল থেকে বেরিয়ে এগিয়ে গিয়ে সাহেবের গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম।
পোর্টিকোর দিকে এগোচ্ছি এমন সময় হঠাৎ এক অদ্ভুত ব্যাপার হল।
বাড়ির দরজা আবার খুলে গিয়ে উদ্ভ্রান্ত ভাবে সাহেব স্বয়ং বেরিয়ে এসে আমাদের সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে দৌড়ে এগিয়ে গেলেন গেটের দিকে। সাহেবের হাতে গিল্টিকরা নতুন ফ্রেমে বাঁধানো টিনটোরেটোর যীশু।
গেট থেকে বেরিয়ে রাস্তার দিকে একবার চেয়ে মাথায় হাত দিয়ে সাহেব চেঁচিয়ে উঠলেন—‘স্কাউন্ড্রেল! সুইন্ডলার! সান-অফ-এ-বিচ!’
তারপর আমাদের দিকে ফিরে দিশেহারা আধ-পাগলা ভাব করে বললেন, ‘হি হ্যাজ জাস্ট সোল্ড মি এ ফেক—অ্যাণ্ড আই পেড ফিফ্টি থাউজ্যাণ্ড ডলারস ফর ইট!’
অর্থাৎ লোকটা আমাকে এক্ষুনি একটা জাল ছবি বিক্রী করে গেল, আর আমি ওকে তার জন্য পঞ্চাশ হাজার ডলার দিলাম।
আমরা কে, কেন এসেছি তার বাড়িতে, এসব জানার কোনো প্রয়োজন বোধ করলেন না সাহেব।
‘তুমি কি টিনটোরেটোর ছবিটার কথা বলছ?’ ফেলুদা জিগ্যেস করল। সাহেব আবার বোমার মতো ফেটে পড়লেন।
‘টিনটোরেটো? টিনটোরেটো মাই ফুট! এস, তোমাকে দেখাচ্ছি, এস!’
সাহেব দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন পোর্টিকোর দিকে। আমরা চারজন তাঁর পিছনে।
পোর্টিকোর আলোতে সাহেব ছবিটা তুলে ধরলেন।
‘লুক অ্যাট দিস্! থ্রী গ্রীন ফ্লাইজ স্টিকিং টু দ্য পেন্ট—থ্রী গ্রীন ফ্লাইজ! এই পোকা আমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল কলকাতার গ্র্যান্ড হোটেলে! সেই পোকা আটকে আছে এই ছবির ক্যানভাসে। আর লোকটা বলে কিনা ছবিটা জেনুইন!—হি ফুলড মি, বিকজ ইটস এ গুড কপি—বাট ইটস এ কপি!’
‘ঠিক বলেছ’, বলল ফেলুদা, ‘ষোড়শ শতাব্দীতে ইটালিতে এ পোকা থাকা সম্ভব না।’
পোর্টিকোর আলোতে দেখতে পাচ্ছি সাহেবের সাদা মুখ লাল হয়ে গেছে। —‘দ্যাট ডার্টি ডাব্ল ক্রসিং সোয়াইন! লোকটার ঠিকানাটা পর্যন্ত জানি না।’
‘ঠিকানা আমি জানি,’ বললেন পূর্ণেন্দুবাবু।
‘জান?’ সাহেব যেন ধড়ে প্রাণ পেলেন।
‘হ্যাঁ, জানি। কাউলূনে থাকেন ভদ্রলোক। হ্যানয় রোড।’
‘গুড। দেখি ব্যাটা কী ভাবে পার পায়। আই’ল স্কিন হিম অ্যালাইভ।’
তারপর সাহেব হঠাৎ ফেলুদার দিকে চেয়ে বললেন, ‘হু আর ইউ?’
‘আমরা জানতাম ছবিটা জাল, তাই আপনাকে সাবধান করে দিতে আসছিলাম’—অম্লানবদনে মিথ্যে কথা বলল ফেলুদা।
‘কিন্তু তাকে ত ধরা যেতে পারে’ হঠাৎ বললেন পূর্ণেন্দুবাবু, ‘এক্ষুনি চলুন না। আমার গাড়ি আছে। লোকটা এখনো বেশি দূর যায়নি।’
সাহেবের চোখ জ্বল-জ্বল করে উঠল।
‘লেট্স গো!’
আসবার সময় চড়াই বলে বেশি স্পীড দেওয়া সম্ভব হয়নি; উৎরাই পেয়ে পূর্ণেন্দুবাবু দেখিয়ে দিলেন তারাবাজি কাকে বলে। সোমানির পকেটে পঞ্চাশ হাজার ডলারের চেক, তার কাজ উদ্ধার হয়ে গেছে, তার আর তাড়া থাকবে কেন? পাঁচ মিনিটের মধ্যে একটা মোড় ঘুরেই দেখতে পেলাম চেনা গাড়িটাকে।
পূর্ণেন্দুবাবু আরেকটু স্পীড বাড়িয়ে গাড়িটার একেবারে পিছনে এসে পড়লেন। তারপর বার কয়েক হর্ন দিতেই সোমানির গাড়ি পাশ দিল। পূর্ণেন্দুবাবু ওভারটেক করে নিজের গাড়িটাকে টেরচাভাবে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে দিলেন।
ব্যাপারটা দেখে সোমানি গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে, ক্ৰিকোরিয়ানও নেমেছেন ছবিটা হাতে নিয়ে, আর সেই সঙ্গে ফেলুদাও।
‘এক্সকিউজ মি!’
ফেলুদা ক্ৰিকোরিয়ানের হাত থেকে ছবিটা নিয়ে নিল। ক্ৰিকোরিয়ান যেন বাধা দিতে গিয়েও পারল না।
তারপর বড় বড় পা ফেলে সোমানির দিকে এগিয়ে গিয়ে কী হচ্ছে সেটা বোঝার আগেই দেখলাম ছবি সমেত ফেলুদার হাত দুটো মাথার উপর উঠল, আর সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড বেগে নেমে এল সোমানির মাথার উপর।
দিশি ক্যানভাস ফুঁড়ে সোমানির মাথাটা বেরিয়ে এল বাইরে, আর ছবির গিল্টিকরা ফ্রেমটা হয়ে গেল হতভম্ব ভদ্রলোকের গলার মালা।
‘এবার উনি আপনাকে আপনার চেকটা ফেরত দেবেন।’
ফেলুদার হাতে এখন রিভলভার।
সোমানির হতভম্ব ভাবটা এখনো কাটেনি, কিন্তু ফেলুদার কথা বুঝতে ওঁর কোনো অসুবিধে হল না।
কাঁপা হাত পকেটের মধ্যে ঢুকিয়ে চেকটা বার করে ক্ৰিকোরিয়ানের দিকে এগিয়ে দিলেন ভদ্রলোক।
সাহেব যখন চেকটা ছিনিয়ে নিয়ে পকেটে পুরছেন, তখন সোমানির হাঁ করা মুখ আরো হাঁ করিয়ে দিয়ে ফেলুদা বলল—
‘এই যে আপনার সর্বনাশটা হল, হীরালালজী, এর জন্য কিন্তু আমি দায়ী নই, দায়ী তিনটি সবুজ পোকা।’