৬
প্লেন নাগপুরে সাড়ে আটটার সময় পৌঁছে, সেখান থেকে দশটা পঞ্চাশের প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে ছিন্দওয়ারা পৌঁছতে প্রায় ছ’টা বেজে গেল। স্টেশনে শেভরোলে গাড়ি নিয়ে হাজির ছিলেন ভূদেব সিং-এর লোক। হাসিখুশি হৃষ্টপুষ্ট মাঝবয়সী এই ভদ্রলোকটির নাম মিঃ নাগপাল। চারজন গাড়িতে রওনা দিয়ে পৌনে সাতটার মধ্যে পৌঁছে গেলাম ভগওয়ানগড়ের রাজবাড়ি।
নাগপাল বললেন, ‘আপনাদের জন্য ঘর ঠিক করা আছে, আপনারা হাত-মুখ ধুয়ে নিন, সাড়ে সাতটার সময় রাজা আপনাদের মীট করবেন। আমি এসে আপনাদের নিয়ে যাব।’
ঘরের চেহারা দেখেই বুঝলাম যে আজ রাতটা আমাদের এইখানেই থাকার জন্য ব্যবস্থা হয়েছে। বিছানা, বালিশ, লেপ, মশারি, বাথরুমে তোয়ালে সাবান —সবই রয়েছে। যে কোনো ফাইভ-স্টার হোটেলের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। লালমোহনবাবু বললেন, এখানকার বাথরুমে নাকি তাঁর গড়পারের বাড়ির পাঁচটা বেডরুম ঢুকে যায়। ‘নেহাৎ টাইম নেই, নইলে টবে গরম জল ভরে শুয়ে থাকতুম আধ ঘণ্টা।’
কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে সাতটার সময় মিঃ নাগপাল আমাদের রাজার সামনে নিয়ে গিয়ে হাজির করলেন। শ্বেতপাথরের মেঝেওয়ালা বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে আছেন ভূদেব সিং। চেহারা যাকে বলে সৌম্যকান্তি। বয়স সাতাত্তর, কিন্তু মোটেও থুত্থুড়ে নন।
আমরা নিজেদের পরিচয় দিয়ে রাজার সামনে তিনটে বেতের চেয়ারে বসলাম। হাসনাহানা ফুলের গন্ধে বুঝতে পারছি বারান্দার পরেই বাগান, কিন্তু অন্ধকারে গাছপালা বোঝা যাচ্ছে না।
কথাবার্তা ইংরিজিতেই হল, তবে আমি বেশির ভাগটা বাংলা করেই লিখছি। জটায়ু বলেছিলেন পার্টিসিপেট করবেন। কতদূর করেছিলেন সেটা যাতে ভালো বোঝা যায় তাই নাটকের মতো করে লিখছি।
ভূদেব—আমার লেখাটা কেমন লাগল?
ফেলুদা—খুবই ইন্টারেস্টিং। ওটা না পড়লে এরকম একজন শিল্পীর বিষয় কিছুই জানতে পারতাম না।
ভূদেব—আসলে আমরা নিজের দেশের লোকদের কদর করতে জানি না। বিদেশ হলে এ রকম কখনই হত না। তাই ভাবলাম—আমার ত বয়স হয়েছে, সেভেনটি-সেভেন—মরে যাবার আগে এই একটা কাজ করে যাব। চন্দ্রশেখরের বিষয় জানিয়ে দেব দেশের লোককে। আমার ছেলেকে পাঠিয়ে দিলাম বৈকুণ্ঠপুর। চন্দ্রর সেল্ফ- পোর্ট্রেট আমার কাছে ছিল না। সে আমাকে ছবি তুলে এনে দিল।
ফেলুদা—আপনার সঙ্গে চন্দ্রশেখরের আলাপ হয় কবে?
ভূদেব—দাঁড়ান, এই খাতাটায় সব লেখা আছে।…হ্যাঁ, ৫ই নভেম্বর ১৯৪২ সে আমার পোর্ট্রেট আঁকতে আসে এখানে। তার কথা আমি শুনি ভূপালের রাজার কাছ থেকে। রাজার পোর্ট্রেট চন্দ্র করেছিল। আমি দেখেছিলাম। আমার খুব ভালো লেগেছিল। চন্দ্র হ্যাড ওয়াণ্ডারফুল স্কিল্।
জটায়ু—ওয়ান্ডারফুল।
ফেলুদা—আপনার লেখায় পড়েছি তিনি ইটালিতে গিয়ে একজন ইটালিয়ান মহিলাকে বিয়ে করেন। এই মহিলা সম্বন্ধে আরেকটু কিছু যদি বলেন।
জটায়ু—সামথিং মোর…
ভূদেব—চন্দ্রশেখর রোমে গিয়ে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে ভর্তি হয়। ওর ক্লাসেই ছিল কার্লা ক্যাসিনি। ভেনিসের অভিজাত বংশের মেয়ে। বাবা ছিলেন কাউন্ট। কাউন্ট আলবের্তো ক্যাসিনি। কার্লা ও চন্দ্রশেখরের মধ্যে ভালোবাসা হয়। কার্লা তার বাবার সঙ্গে চন্দ্রশেখরের পরিচয় করিয়ে দেয়। এখানে বলে রাখি, চন্দ্রশেখর আয়ুর্বেদ চর্চা করেছিল। ইটালি যাবার সময় সঙ্গে বেশ কিছু শিকড় বাকল নিয়ে গিয়েছিল। কার্লার বাপ ছিলেন গাউটের রুগী। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ভুগতেন। চন্দ্রশেখর তাঁকে ওষুধ দিয়ে ভালো করে দেয়। বুঝতেই পারছ, এর ফলে চন্দ্রর পক্ষে কাউণ্টের মেয়ের পাণিগ্রহণের পথ অনেক সহজ হয়ে যায়। ১৯১৭-তে বিয়েটা হয়, এবং এই বিয়েতে কাউন্ট একটি মহামূল্য উপহার দেন চন্দ্রকে।
ফেলুদা—এটাই কি সেই ছবি?
জটায়ু—রেনেসাঁস?
ভূদেব—হ্যাঁ। কিন্তু এই ছবিটা সম্বন্ধে কতটা জানেন আপনারা?
ফেলুদা—ছবিটা দেখেছি, এই পর্যন্ত। মনে হয় রেনেসাঁস যুগের কোনো শিল্পীর আঁকা।
জটায়ু—(বিড়বিড় করে)—বত্তিজোত্তো…দাভিঞ্চেল্লি…
ভূদেব—আপনারা ঠিকই ধরেছেন, তবে যে-কোনো শিল্পী নয়। রেনেসাঁসের শেষ পর্বের অন্যতম সবচেয়ে খ্যাতিমান শিল্পী। টিনটোরেটো।
জটায়ু—ওফ্ফ্ফ্ফ!
ফেলুদা—টিন্টোরেটোর নিজের আঁকা ত খুব বেশি ছবি আছে বলে জানা যায় না, তাই না?
ভূদেব—না। অনেক ছবিই আংশিক ভাবে টিনটোরেটোর আঁকা, বাকিটা এঁকেছে তার স্টুডিও বা ওয়র্কশপের শিল্পীরা। এটা তখনকার অনেক পেণ্টার সম্পর্কেই খাটে। তবে কাজটা যে উঁচুদরের তাতে সন্দেহ নেই। সে ছবি চন্দ্র এনে আমাকে দেখিয়েছিল। টিনটোরেটোর সব লক্ষণই রয়েছে ছবিটায়। ষোড়শ শতাব্দী থেকেই ক্যাসিনি প্যালেসে ছিল ছবিটা।
ফেলুদা—তার মানে ওটা ত একটা মহামূল্য সম্পত্তি।
ভূদেব—ওর দাম বিশ-পঁচিশ লাখ হলে আশ্চর্য হব না।
জটায়ু (নিশ্বাস টেনে)—হিঁ ই ই ই ই ই!
ভূদেব—সেই জন্যেই ত আমি পেন্টারের নামটা বলিনি প্রবন্ধটায়।
ফেলুদা—কিন্তু তাও বৈকুণ্ঠপুরে লোক এসে খবর নিয়ে গেছে।
ভূদেব—কে? ক্রিকোরিয়ান এসেছিল নাকি?
ফেলুদা—ক্ৰিকোরিয়ান? কই না ত। ও নামে ত কেউ আসেনি।
ভূদেব—আর্মেনিয়ান ভদ্রলোক। আমার কাছে এসেছিল। ওয়লটার ক্ৰিকোরিয়ান। টাকার কুমীর। হংকং-এর ব্যবসাদার এবং ছবির কালেকটর। বলে ওর কাছে ওরিজিন্যাল রেমব্রান্ট আছে, টার্নার আছে, ফ্রাগোনার আছে। আমাদের বাড়িতে একটা বুশের-এর ছবি আছে, আমার ঠাকুরদাদার কেনা। সেটা কিনতে এসেছিল। আমি দিইনি। তারপর বলল ও আমার লেখাটা পড়েছে। জিগ্যেস করছিল নিয়োগীদের ছবিটার কথা। ও নিজে এত বড়াই করছিল যে আমি উল্টে একটু বড়াই করার লোভ সামলাতে পারলাম না। বলে দিলাম টিনটোরেটোর কথা। ও ত লাফিয়ে উঠেছে চেয়ার থেকে। আমি বললাম, ও ছবিও তুমি কিনতে পাবে না, কারণ পয়সার লোভের চেয়ে প্রাইড অফ পোজেশন আমাদের ভারতীয়দের অনেক বেশী। এটা তোমরা বুঝবে না। ও বললে, সে ছবি আমার হাতে আসবেই, তুমি দেখে নিও। বলেছিল নিজেই যাবে বৈকুণ্ঠপুরে। হয়ত হঠাৎ কোনো কাজে ফিরে গেছে। তবে ওর এক দালাল আছে—
ফেলুদা—হীরালাল সোমানি?
ভূদেব—হ্যাঁ।
ফেলুদা—ইনিই গিয়েছিলেন বৈকুণ্ঠপুরে।
ভূদেব—অত্যন্ত ঘুঘু লোক। ওকে যেন একটু সাবধানে হ্যান্ডল করে।
ফেলুদা—কিন্তু ও ছবি ত চন্দ্রশেখরের ছেলের সম্পত্তি। সে ত এখন বৈকুণ্ঠপুরে।
ভূদেব—হোয়াট! চন্দ্রর ছেলে এসেছে? এতদিন পরে?
ফেলুদা—তাকে দেখে এলাম আমরা।
ভূদেব—ও। তাহলে অবিশ্যি সে ছবিটা ক্লেম করতে পারে। কিন্তু টিনটোরেটো তার হাতে চলে যাচ্ছে এটা ভাবতে ভালো লাগে না মিস্টার মিট্রা!
ফেলুদা—এটা কেন বলছেন?
ভূদেব—চন্দ্রর ছেলের কথা ত আমি জানি। চন্দ্রকে কত দুঃখ দিয়েছে তাও জানি। এসব কথা ত নিয়োগীরা জানবে না, কারণ চন্দ্র আমাকে ছাড়া আর কাউকে বলেনি। পরের দিকে অবিশ্যি ছেলের কথা আর বলতই না, কিন্তু গোড়ায় বলেছে। ছেলে মুসোলিনির ভক্ত হয়ে পড়েছিল। মুসোলিনি তখন ইটালির একচ্ছত্র অধিপতি। বেশির ভাগ ইটালিয়ানই তাকে পূজো করে। কিন্তু কিছু বুদ্ধিজীবী—শিল্পী, সাহিত্যিক, নাট্যকার, সংগীতকার—ছিলেন মুসোলিনি ও ফ্যাসিস্ট পার্টির ঘোর বিরোধী। চন্দ্র ছিল এদের একজন। কিন্তু তার ছেলেই শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়। তার এক বছর আগে কার্লা মারা গেছে ক্যানসারে। এই দুই ট্র্যাজিডির ধাক্কা চন্দ্র সইতে পারে নি। তাই সে দেশে ফিরে আসে। ছেলের সঙ্গে সে কোনো যোগাযোগ রাখেনি। ভালো কথা, ছেলেকে দেখলে কেমন? তার ত ষাটের কাছাকাছি বয়স হবার কথা।
ফেলুদা—বাষট্টি। তবে এমনিতে শক্ত আছেন বেশ। কথাবার্তা বলেন না বললেই চলে।
ভূদেব—বলার মুখ নেই বলেই বলে না। …স্ত্রীর মৃত্যু ও ছেলের বিপথে যাওয়ার দুঃখ চন্দ্র কোনোদিন ভুলতে পারেনি। শেষে তাই তাকে সংসার ত্যাগ করতে হয়েছিল। এই নিয়ে অবশ্য তার সঙ্গে আমার কথা কাটাকাটিও হয়। তাকে বলি—তোমার মধ্যে এত ট্যালেন্ট আছে, এখনও কাজের ক্ষমতা আছে, তুমি বিবাগী হবে কেন? কিন্তু সে আমার কথা শোনেনি।
ফেলুদা—আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন কি?
ভূদেব—মাঝে মাঝে একটা করে পোস্টকার্ড লিখত, তবে অনেকদিন আর খবর পাইনি।
ফেলুদা—শেষ কবে পেয়েছিলেন মনে আছে?
ভূদেব—দাঁড়াও, এই বাক্সের মধ্যেই আছে তার চিঠিগুলো। হ্যাঁ, সেপ্টেম্বর ১৯৭৭। হৃষিকেশ থেকে লিখেছে এটা। ফেলুদা—অর্থাৎ পাঁচ বছর আগে। তার মানে ত আইনের চোখে তিনি এখনো জীবিত।
ভূদেব—সত্যিই ত! এটা ত আমার খেয়াল হয়নি।
ফেলুদা—তার মানে রুদ্রশেখর এখনো তার সম্পত্তি ক্লেম করতে পারেন না।
পরদিন ভূদেব সিং গাড়িতে ঘুরিয়ে ভগওয়ানগড়ের যা কিছু দ্রষ্টব্য সব দেখিয়ে দিলেন আমাদের। গড়ের ভগ্নস্তূপ, ভবানীর মন্দির, লক্ষ্ণীনারায়ণ গার্ডেনস, পিথৌরি লেক, জঙ্গলে হরিণের পাল—কিছুই বাদ গেল না।
কথাই ছিল এবার শেভরোলে গাড়ি আমাদের একেবারে নাগপুর অবধি পৌঁছে দেবে, যাতে আমাদের আর প্যাসেঞ্জার ট্রেনের ঝক্কি পোয়াতে না হয়। গাড়িতে ওঠার আগে ভূদেব সিং ফেলুদার কাঁধে হাত রেখে বললেন—
‘সী দ্যাট দ্য টিনটোরেটো ডাজন্ট ফল ইনটু দ্য রঙ হ্যাণ্ডস।’
মিঃ নাগপালকে আগেই বলা ছিল; তিনি ওই আর্মেনিয়ান ভদ্রলোকের নাম ঠিকানা একটা কাগজে লিখে ফেলুদাকে দিলেন, ফেলুদা সেটা সযত্নে ব্যাগে পুরে রাখল।
পরদিন এগারোটায় বাড়ি ফিরে এক ঘণ্টার মধ্যে বৈকুণ্ঠপুর থেকে নবকুমারবাবুর টেলিফোন এল।
‘চট করে চলে আসুন মশাই। এখানে গণ্ডগোল।’