১১. অবিনাশ ফোনে

এগারো

অবিনাশ ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছিল। আর সোফায় বসে একটা অচেনা লোক চিমনির মত ধোঁয়া বের করে সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছিল। অবিনাশ আমাদের দেখে হাত নাড়ল। তারপর “ও.কে., আজ রাতে তা হলে দেখা হবে, বাই,” বলে ফোনটা ছেড়ে দিল।
ফোন নামাতেই প্রমথ চেঁচিয়ে উঠল, “হোয়াট দ্য হেল, কোথায় ছিলে তুমি এতদিন?”
উত্তরে অবিনাশ যেটা বলল, সেটা বিশ্বাস করা কঠিন। ও নাকি পাঁচ দিন আগে ওর আঙ্কল, কিরিট প্যাটেলের কাছ থেকে খুব জরুরি ফোন কল পায়, নেক্সট ফ্লাইটেই আমেরিকাতে চলে আসার জন্য। কেন, কিরিট প্যাটেল জানাতে চান নি। তবে গলার স্বর শুনে অবিনাশ অনুমান করেছিল যে, ব্যাপারটা বেশ গুরুতর। নিউ ইয়র্কের কেনেডি এয়ারপোর্টে নামতেই কিরিট প্যাটেল ওকে হল্যাণ্ড টানেলের পাশে যে ‘হলিডে ইন’ হোটেলটা আছে, সেখানে নিয়ে যান। কিরিট প্যাটেল ওকে বলেন যে, কয়েকজন বিজনেস অ্যাসোসিয়েটের সঙ্গে ওঁর বেশ রকমের একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। ভুল বোঝাবুঝির মাত্রাটা এত চরমে পৌঁছেছে যে, উনি নিজের বাড়িতে থাকতে খুব নিরাপদ বোধ করেন নি। কাউকে না জানিয়ে ‘হলিডে ইন’-এ এসে আছেন। কিন্তু এ-ভাবে লুকিয়ে থাকায় ওঁর বিজনেসের খুব ক্ষতি হচ্ছে। পরের ক’দিন কানেকটিকাট, নিউ জার্সি, আর পেনসিলভ্যানিয়ার বেশ কয়েকটা দোকানে ওঁর মাল ডেলিভারির ডেট। উনি সেটা মিস করতে চান না। এই ব্যবসায় একবার সুনাম নষ্ট হলে সেটা ফিরে পাওয়া কঠিন। আবার নিজেও মালগুলো নিয়ে যেতে ভয় পাচ্ছেন, নিরাপত্তার কথা ভেবে। অচেনা অজানা কাউকে ভারটা দেওয়া যায় না, লাখ-লাখ টাকার টাকার জিনিস! তাই ওঁর অবিনাশের সাহায্য দরকার।
“কার সঙ্গে গণ্ডগোলটা হয়েছিল সেটা বলেছিলেন?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।
“না।”
“তুমি জানতে চাইলে না?”
“কি হবে জেনে!”
“হোয়াট ড্যু ইউ মিন – কি হবে জেনে! এরকম একটা লাইফ থ্রেটেনিং সিচুয়েশন দেখেও তুমি কিছু বললে না?”
“ওয়েল আই টোল্ড হিম, ইফ দেয়ার ইজ এ ফিয়ার ফর লাইফ, তাহলে ইমিডিয়েটলি পুলিশে খবর দেওয়া উচিত।”
“উনি কী বললেন?”
“হি ওয়াজ ভেগ।এটুকু বুঝেছিলাম যে, ব্যাপারটা একটু গোলমেলে। পুলিশে খবর দিলে সবাই ঝামেলায় পড়বে, আঙ্কলও বাদ যাবেন না!”
“উনি কি বলেছিলেন যে, প্রাণহানির কোনও আশঙ্কা আছে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“নট রিয়েলি।”
“ওয়েট এ মিনিট,” প্রমথ বলল, “তাই যদি হয়, তাহলে তুমি ওঁকে বললে কেন, ইফ দেয়ার ইজ এ ফিয়ার ফর লাইফ!”
“আই ডোণ্ট নো। আই মে জাস্ট হ্যাভ গেসড!”
“ইউ আর জাস্ট অ্যাজ ভেগ অ্যাজ ইওর আঙ্কল,” প্রমথ মন্তব্য করল।
অবিনাশ ঘাড় ঝাঁকাল, “কাণ্ট হেল্প ইট।”
প্রমথ আর অবিনাশের মধ্যে কম্যুনিকেশনটা বরাবরই অত্যন্ত বাজে। তাই আমি একটু চেষ্টা করলাম, যদি আর দু’ একটা পয়েণ্ট উদ্ধার করা যায়। জিজ্ঞেস করলাম, “কি ধরনের ঝামেলা, সে-সম্পর্কে কোনও হিণ্ট পাও নি মিস্টার প্যাটেলের কাছ থেকে ?”
“অল আই নো যে, একটা লোক ঝামেলাটা পাকিয়ে উধাও হওয়ায় আঙ্কলের ঘাড়ে দোষটা এসে পড়েছিল। আঙ্কল জাস্ট নিডেড সাম টাইম টু গেট হিমসেলফ ক্লিয়ারড।”
“উনি এখানে এলেন কেন?” প্রমথ আবার প্রশ্ন শুরু করল। প্রমথর প্রশ্ন করার ভঙ্গিটা বেশ অ্যাটাকিং। একবার মনে হল অবিনাশ চটে গিয়ে আর উত্তর দেবে না। কিন্তু ও মাথা ঠাণ্ডা রেখেই উত্তর দিল।
“হোটেল লবিতে হঠাত্ একজন পরিচিত লোকের সঙ্গে আঙ্কলের দেখা হয়ে যায়। উনি ভয় পান যে, খবরটা ছড়িয়ে যাবে। তখন আমিই ওঁকে সাজেস্ট করি, অন্য কোন হোটেলে না গিয়ে তোমাকে ফোন করতে।”
“ওঁকে ফাঁসিয়ে যে উধাও হয়েছিল, তার নামটা উনি বলেছিলেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“না।”
“তুমি কখন জানলে যে, তোমার আঙ্কল মারা গেছেন?” প্রমথর প্রশ্ন।
“আজ সকালে, ‘ইণ্ডিয়া অ্যাব্রড’ পড়ে। সঙ্গে-সঙ্গে আমি ব্রিজ আঙ্কেলকে ফোন করি। ব্রিজ আঙ্কেলও আমার খোঁজ করছিলেন। উনি বললেন…।
“ব্রিজ শাহর কথা বাদ দাও,” প্রমথ অবিনাশকে থামিয়ে দিল, “তুমি পুলিশকে এ বিষয়ে কিছু জানিয়েছো?”
“কোন বিষয়?”
“তুমি যা এতক্ষণ আমাদের বললে!”
“না”
“কেন?”
অবিনাশ একটু থতমত খেল। আমতা-আমতা করে বলল, “আমি ব্রিজ আঙ্কলকে এ-নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি বললেন, ‘সেটা তোমার ডিসিশন। তবে আনঅফিশিয়ালি তোমাকে বলি, যে চলে গেছে তাকে তো তুমি আর ফিরিয়ে আনতে পারবে না। সুতরাং এটা নিয়ে আর ঘাঁটিও না’।”
“আর তুমিও সেটা দিব্বি মেনে নিলে!” বেশ ব্যঙ্গ করেই কথাটা বলল প্রমথ।
প্রমথর সঙ্গে অবিনাশে প্রায়ই খটাখটি লাগে, আর আমি সাধারণত তাতে মাথা ঘামাই না। কিন্তু আজ মনে হল, মিস্টার প্যাটেলের হত্যার সঙ্গে অবিনাশ যদি জড়িত থাকে, তাহলে প্রমথর একটু সতর্ক হওয়া উচিত। ওয়ানস এ মার্ডারার ইজ অলওয়েস এ মার্ডারার! আমি প্রমথকে বললাম, “যাঃ, তার নিশ্চয় কোনও একটা রিজন আছে।”
“সমাদ্দারকে সেটা কে বোঝাবে!” অবিনাশ আমার সমর্থন পেয়ে প্রমথকে ঠুকল। তারপর একটু চুপ করে থেকে কিছুটা কৈফিয়তের সুরে বলল, “আমি ব্রিজ আঙ্কেলকে বলেওছিলাম যে, আমি পুলিশকে জানাতে চাই। তখন উনি বললেন কেন উনি আমার খোঁজ করছিলেন। আমার আঙ্কলের উইল অনুসারে তাঁর সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী হচ্ছি আমি। ‘এবারে ভেবে দ্যাখো,’ উনি বললেন, ‘তুমি এদেশে হঠাৎ চলে এসে কাউকে না জানিয়ে একটা হোটেলে লুকিয়ে রইলে। আর তোমার আঙ্কল তোমার অ্যাপার্টমেণ্টে গিয়ে মিস্টিরিয়াসলি মারা যাওয়ার পর-পরই তুমি উদয় হলে। আমার তো মনে হয়, তুমিই হবে পুলিশের প্রাইম সাসপেক্ট।’ ব্যাপারটার গুরুত্ব তখনই আমি প্রথম রিয়্যালাইজ করলাম।
প্রমথর মুখ দেখে বুঝলাম, এই কথটা আদায় করার জন্যই ও অবিনাশকে খোঁচাচ্ছিল। বলল, “এখন বুঝেছি, চাচা আপন বাঁচা! ভালকথা, তুমি কী করছিলে পরশু সন্ধ্যার সময়?”
“পরশু!”
“হ্যাঁ, বুধবার সন্ধ্যায়, যখন তোমার আঙ্কল মার যান!”
“হোটেলে বসে টিভি দেখছিলাম।”
“একা?”
“হ্যাঁ, কিন্তু এরকম প্রশ্ন করার অর্থ?”
“সিম্পল, শুধু দেখছিলাম তোমার কোনও অ্যালিবাই ছিল কিনা!”
প্রমথটা মাঝে-মাঝে ভব্যতার সীমা ছাড়িয়ে যায়! কিন্তু অবিনাশকেও বলিহারি! মামার মৃত্যুর খবরে এতটুকু বৈকল্য নেই! প্রমথর কথার পিঠে বলল, “কিন্তু এটা তো আত্মহত্যা!”
“ওয়ান কুড নেভার বি সিওর,” আমি বললাম। “সাপোজ ইট ইজ এ মার্ডার। সেক্ষেত্রে যারা ওঁকে মার্ডার করেছে, তুমিও তো তাদের টার্গেট হতে পারো। তারা ভাবতে পারে যে, যেটা তারা খুঁজছে, সেটা এখন তোমার কাছে আছে!”
“আই ডোণ্ট আণ্ডারস্ট্যাণ্ড, কে কি খুঁজছে?” অবিনাশ একটু যেন সন্দেহ নিয়ে আমার দিকে তাকাল।
আমি সঙ্গে-সঙ্গে চেপে গেলাম। শুধু বললাম, “তাও আমার মনে হয়, তোমার পুলিশকে সব কিছু জানানো উচিত।”
অবিনাশ কোনও জবাব দিল না।
প্রমথ দুম জিজ্ঞেস করে বসল, “আচ্ছা, তোমার আঙ্কল কি শুক্রবার-শুক্রবার কোথাও যেতেন?”
“আই ডোণ্ট নো। হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?” এখন আর সন্দেহ নেই, অবিনাশ বেশ একটু সাসপিশাস।

আমি চট করে আর-একটা প্রশ্ন করে আবহাওয়াটা ক্লিয়ার করার চেষ্টা করলাম, “তোমার আঙ্কলকে স্যাম বলে একজন ফোন করেছিল। বিশেষ দরকারে মনে হল। তুমি তাঁকে চেন?”
উত্তরে ‘না’ বা ওই জাতীয় কিছু শুনব ভেবেছিলাম। কিন্তু অবিনাশ সোফায়-বসা লোকটাকে দেখিয়ে বলল, “ইনিই হচ্ছেন স্যাম ওয়াকার।”