১০. সংসার ভারী আজব জায়গা

১০.

সংসার ভারী আজব জায়গা। এ চেরাপুঞ্জি নয়, যে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে থাকবে সর্বক্ষণ। আবার গোবি সাহারাও নয়, যে এখানে মেঘের আবির্ভাব একান্তই অপ্রত্যাশিত। এ মরুপ্রদেশও নয়, নিরক্ষীয় অঞ্চলও নয়। অনন্ত শৈত্য বা ধরাবাঁধা বৃষ্টির আবর্তে আটকে থাকে না চিরকাল। এখানে বুঝি ছয় ঋতুই বাস করে একত্রে। গ্রীষ্ম বর্ষা শীত বসন্ত, কে যে কখন দখল নেবে সংসারের আগাম ঠাহর করা দায়। অবশ্য কোনও ঋতুই সংসারে পাকাপাকি গেঁড়ে বসতে পারে না। তবে প্রত্যেকেরই ছাপ রয়ে যায় সংসারে। কোথাও না কোথাও।

পারমিতার সঙ্গে শ্বশুর-শাশুড়ির মন কষাকষিও টিকল না বেশি দিন। তিন-চার দিন গোমড়া রইল পারমিতা, ভাববাচ্যে কথা বলছে মানসী, প্রয়োজন বিনা শুভেন্দু-পারমিতার বাক্যবিনিময় নেই, তাতারকে দূতের ভূমিকা পালন করতে হচ্ছিল অহরহ। হঠাৎ রাজার এক বালুরঘাটের পিসি এসে পড়ায় ভাঙল বরফ। ঘণ্টা তিন-চার ছিল পিসি, তখন তো তার সামনে খুশি খুশি মুখে অবতীর্ণ হতেই হয়। দেখাতেই হয় একটা সুখী পরিবারের ছবি। অবশেষে পিসি যখন বিদায় নিল, কী করে যেন ফের স্বাভাবিকতার প্রলেপ পড়ে গেছে সংসারে। যা চাপা পড়ল, তা বোধহয় এখনই আর হুট করে বেরিয়ে আসবে না।

তারপর তো পুজোই এসে গেল। মহালয়ার পর থেকেই বাতাসে উত্সব উত্সব ভাব। আর তার ছোঁয়ায় পারমিতার শ্বশুরবাড়ি ফের প্রাণচঞ্চল। রাজার গাড়ি নিয়ে শাশুড়ি-বউ মিলে একদিন বাজার করল গড়িয়াহাটে। অষ্টমীর দিন ঠাকুর দেখল সারারাত। তাতারকে নিয়ে নবমী-দশমী বাপের বাড়িতে কাটাল পারমিতা।

এদিকে শুভেন্দু-মানসীর বেঙ্গালুরু যাত্রার প্রস্তুতিও চলছে পুরোদমে। শুধু পারমিতার প্রসঙ্গটা ভুলেও উচ্চারণ করছে না কেউ। সংসারের কোনও খাঁজে চোরকাঁটার মতোই নয় লুকিয়ে থাকুক ঘটনাটা, আপাতত তা নিয়ে খোঁচাখুঁচিতে বুঝি প্রত্যেকেই নারাজ।

নির্দিষ্ট দিনে তলপিতলপা গুছিয়ে মানসীরা উড়ে গেল বেঙ্গালুরু। পারমিতা গিয়েছিল তুলে দিতে। তাতারকে পইপই করে শেখাল, যেন সে বাধ্য হয়ে থাকে, একা একা বাবার ফ্ল্যাট ছেড়ে যেন বেরিয়ে না যায়…। তাতার মায়ের উপদেশ শুনবে কী, সে তো প্লেনে চড়ার উত্তেজনায় তিড়িংবিড়িং লাফাচ্ছে। মাকে টা-টা করে তাড়াতাড়ি সে পালাতে পারলে বাঁচে।

গড়িয়ায় ফিরে সেদিন যে কী ভীষণ একা লাগছিল পারমিতার। শুনশান বাড়ি, বাইশ-তেইশ দিনের আগে তাতারকে দেখতে পাবে না… সব মিলিয়ে বুকের ভেতর একটা খাঁ খাঁ ভাব। গোটা সন্ধেটাই মন খারাপ করে শুয়ে রইল বিছানায়। তাতাররা পৌঁছোনোর পর রাজা যখন ফোন করল, একা বাড়িতে নিজেকে কেমন পরিত্যক্ত পরিত্যক্ত লাগছিল তখন। স্বেচ্ছাতেই তো রয়ে গেছে সে, তবুও। শেষে রাতে রানার সঙ্গে দু’-চারটে কথা বলে খানিকটা যেন শান্ত হল মন।

হ্যাঁ, গড়িয়াতেই থেকে গেল পারমিতা। সুমিতা তাকে যাদবপুর চলে আসতে বলেছিল, গেলে পারমিতার সুবিধেই হত, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তো ও বাড়ি থেকে হাঁটা-পথ, তবু পারমিতা রাজি হয়নি। বড়জোর এক-আধদিন এখন বাপের বাড়িতে থাকা সম্ভব, তা বলে গোটা ছুটিটা? বাড়িতে রানা আছে, অণিমা-সরস্বতী সকালে কাজে আসবে… পারমিতা না থাকলে চলে? তা ছাড়া রানার রাতে ফেরার কোনও স্থিরতা নেই, হয়তো এলই না, বাড়ি সম্পূর্ণ অরক্ষিত থাকবে, এও তো কাজের কথা নয়।

আর একটা অদৃশ্য বাধাও আছে বই কী। হয়তো বা সেটাই মোক্ষম। শুধুমাত্র পড়াশোনার কারণেই যে পারমিতা এখন কলকাতায়, বাপের বাড়িতে ছুটি কাটাতে নয়, রাজার কাছে এটাও তো প্রমাণ করা জরুরি। বুঝি বা নিজের কাছেও। নয় কি?

তবে ছুটিটা পারমিতার কাটছে বটে। ঝড়ের গতিতে। কোর্স শুরু হওয়ার পর থেকে তো চোখেমুখে দিশা পাচ্ছে না। সাড়ে দশটায় ক্লাস শুরু, চলে সেই সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত। মাঝে মিনি ব্রেক। এভাবে রোজ ছ’-সাত ঘণ্টা ক্লাস করা কি মুখের কথা! পড়ানো আর পড়ায় যে আশমান জমিন ফারাক। ছাত্রী হয়ে ঠায় বসে থাকা এখন কী যে কঠিন! তাও এক-দু’দিন নয়, চলবে টানা তিন সপ্তাহ! আগের রিফ্রেশার কোর্সটা পারমিতা করেছিল রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে। সেখানে এত কড়াকড়ি ছিল না। যারা পড়াচ্ছে, তারাও অধিকাংশ পরিচিত। দিব্যি একটা সামার ক্যাম্প করার ঢঙে কেটেছিল দিনগুলো। কিন্তু এবার যেন নিংড়ে নিচ্ছে শরীরের শক্তি। শেষের দিকের পিরিয়ডগুলোয় চোখ যেন জড়িয়ে আসে, টনটন করে শিরদাঁড়া। শনিবারের অফ ডে গন, রবিবারেও রেহাই নেই, রাশি রাশি বই উলটোতে হচ্ছে, এই ওয়েবসাইট খোলো, ওই পেপার খোঁজো…। মগজ খানিক টনকো হচ্ছে ঠিকই, পুরোনো অনেক কিছু ফের জানছে নতুন করে, গভীরভাবে, খারাপও লাগে না… তবু এক এক সময়ে পারমিতার মনে হয়, ধুৎতেরি, নিকুচি করেছে প্রোমোশানের, বেঙ্গালুরু পাড়ি জমালেই বুঝি ভাল হত।

কেনই বা মনে হবে না? যা আমোদ-আহ্লাদের গল্প শুনছে রোজ! এই তো সেদিন দাদু-ঠাকুমার সঙ্গে ব্যানেরঘাটা ন্যাশনাল পার্ক ঘুরতে গিয়েছিল তাতার, খোলা মাঠে বাঘ-সিংহ দেখে তাতারের কী উল্লাস! টেলিফোনে মাকে সেই গল্প যে কতবার করে শোনাচ্ছিল! ছেলের ওই উত্তেজনা চাক্ষুষ করতে পারমিতার কি সাধ জাগে না? কিংবা শাশুড়ি যখন জানায়, কীভাবে সে হাল ধরেছে ছেলের অগোছালো সংসারের— বুকটা কি একটু চিনচিন করে না পারমিতার? যতই হোক, সে একটা মানুষ তো, রোবট তো নয়!

পারমিতা তো ফোন করছেই বেঙ্গালুরুতে। সন্ধেবেলা। রোজই দিনান্তে একবার অন্তত তাতারের গলা না শুনলে মন হুহু করে যে। রাজার ফোনও আসে, রাজার সময় মতো। বাবা-মা-ছেলেকে পেয়েই হোক, কিংবা নিজের জেদ বজায় রাখতে পেরে, তার মেজাজ এখন অনেক স্বাভাবিক। অন্তত সেরকমটাই তো মনে হয় পারমিতার। শ্বশুর-শাশুড়ির খবর নেয়, ভাইয়ের খোঁজ করে, পারমিতার ছাত্রী বনে যাওয়া নিয়ে রঙ্গরসিকতা করে টুকটাক। সঙ্গে মা প্রতিদিন কী রান্নাবান্না করছে, তাও জানিয়ে দেয় কথার ছলে। কে জানে, হয়তো বা এটাও রাজার একটা কৌশল। পারমিতার ওপর পরোক্ষ চাপ তৈরি করার। তা এই সবের মধ্যেই একটা বড় কাজ সেরে ফেলল পারমিতা। একদিন কোর্স ডুব মেরে বাবার ব্রেন স্ক্যানিংটা করিয়ে আনল। টুটানকে পায়নি, সে ছিল অফিসট্যুরে, রানাকেই পটিয়ে পাটিয়ে নিয়ে গেল সঙ্গে। রিপোর্ট ভালই বেরিয়েছে। মস্তিষ্কে হেমারেজের চিহ্নমাত্র নেই। শুধু কোষগুলো একটু শুকিয়েছে, এই যা। তা ডাক্তারবাবু বলল, এমনটা নাকি হতেই পারে। শুনে মা আশ্বস্ত খানিকটা। পারমিতাও নিশ্চিন্ত। করছে কোর্স, যাচ্ছে বাপের বাড়ি, সামলাচ্ছে মানসীর সংসার।

কিন্তু মানুষের স্বস্তির মেয়াদ তো নেহাতই অস্থায়ী। জানে বিশ্বসংসার। জানে পারমিতাও। তবে কতটা ক্ষণস্থায়ী, পারমিতার তা ধারণাতেই ছিল না।

কালীপুজোর দু’দিন আগে একটা ফোন এল সোনালির। তখন সবে পারমিতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাপেরবাড়ি হয়ে গড়িয়া ফিরেছে।

বেশ ক্লান্ত ছিল পারমিতা। হাই তুলে বলল,— কী খবর রে তোর? ফোন টোন করিস না কেন?

এই তো করলাম। তুই এখন কোথায়?

বাড়িতে।

শ্বশুরবাড়ি? না বাপের বাড়ি?

অবশ্যই শ্বশুরবাড়ি।

ঢুকে গেছিস?… আমি আর শমীক তা হলে আসছি। উইদিন ফিফটিন মিনিটস।

পারমিতা পোশাক বদলে ভাল করে মুখ-হাত ধোয়ারও সময় পেল না, শমীক-সোনালি মোটরবাইকে হাজির। শমীকের হাতে একজোড়া হেলমেট, সোনালির ট্যাঁকে টুসকি।

গাবলুগুবলু টুসকিকে দেখে পারমিতার শ্রান্তি উবে গেছে। সোনালির কোল থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিল বাচ্চাটাকে, চটকাতে চটকাতে বলল,— কী সুইট হয়েছে রে।… অ্যাই, একে হেলমেট পরাসনি কেন?

শমীক কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,— ওর কী লাগবে? ও তো মধ্যিখানে থাকে।

তো? পারমিতা টুসকির গাল নেড়ে দিল,— অ্যাই মেয়ে, বাবাকে পুলিশের কবিতাটা শুনিয়ে দে তো। বাবার মাথা বেজায় দামি, তাই বাবার মাথা ঢাকা… মেয়ের কোনও দাম নেই, তাই মেয়ের মাথা ফাঁকা…!

পারমিতার সুর করে করে বলার ধরনে সোনালি হেসে লুটিয়ে পড়েছে। হাসতে হাসতে সোফায় গিয়ে বসল। বসেছে শমীকও। টুসকিকে কোল থেকে নামাল পারমিতা, তাকে হাত ধরে ধরে হাঁটাচ্ছে। পারমিতার হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে মা’র কাছে চলে গেল টুসকি। ঘুরে জুলজুল দেখছে মাসিকে।

পারমিতা ভুরু নাচিয়ে বলল,— তোর মেয়ে তো বেশ সাব্যস্ত হয়ে গেছে রে!

সে আর বলতে। এখন একটুও স্থির থাকে না। আয়ামাসিকে সারাদিন নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে।

এবারের মহিলাটি কেমন? ভাল?

ওই আর কী। চলেবল।

তা তোরা এদিকে ছিলি কোথায়? এত ঝটপট চলে এলি?

বাইপাসের মলটায় এসেছিলাম। ভাবলাম, অনেক দিন দিদিটার বাড়ি যাওয়া হয় না… একটা রাউন্ড মেরে আসি।

বেশ করেছিস। বোন-ভগ্নিপতির মুখোমুখি বসল পারমিতা,— তা কী খাবি বল?

সোনালি ভুরু নাচাল,— কী খাওয়াবি?

তেমন কিছু নেই অবশ্য। এখন তো আমার টুটাফুটা সংসার। তবে প্যানকেক ভেজে দিতে পারি।

থাক, ব্যস্ত হোস না। আমরা ফুডকোর্টে হাবিজাবি প্রচুর সাঁটিয়েছি। সোনালি এদিক ওদিক তাকিয়ে গলা নামাল,— তোর পেঁচামুখো দেওরটা কোথায় রে?

গড নোজ। রাত এগারোটার আগে তার তো দর্শন মেলা ভার।

মাঝে দেখেছিলাম এক ছমকছল্লুর সঙ্গে খুব ঘুরছে! মেয়েটা বোধহয় আমাদের অফিসপাড়াতেই চাকরি টাকরি করে। তোর দেওর তো তখন খুব যেত ওদিকটায়!

রঞ্জাবতীকে মনে পড়ল পারমিতার। মেয়েটা আরও বার দুয়েক ফোন করেছিল পারমিতাকে। দেবর্ষি যে তাকে চায় না, এটা যেন সে মানতেই পারছে না। পারমিতা কী করে বোঝায়, অতি আধুনিকাদের দেখে ছেলেরা যতই পতঙ্গের মতো ধেয়ে যাক, শেষমেশ একটি ঘরোয়া মেয়েকেই গৃহিণী হিসেবে খোঁজে।

এড়িয়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে পারমিতা বলল,— কী যে করে বেড়ায় কে জানে!… তোরা তা হলে সত্যিই কিছু খাবি না? বিজয়ার পর এলি, একটু মিষ্টিমুখ অন্তত কর। ফ্রিজে পান্তুয়া আছে…

কেন ফর্মালিটি করছিস মিতুদি? বোস তো চুপ করে। জিন্‌স কুর্তি পরা সোনালি সোফায় হেলান দিয়েছে। শমীকের জিম্মায় মেয়েকে গছিয়ে দিয়ে বলল,— তোর কথা বল। কতটা বোর হচ্ছিস একা একা?

তুৎ, আমার বোর হওয়ার ফুরসত কোথায়!

কেন? শমীক জিজ্ঞেস করল,— কীসের ব্যস্ততা?

কোর্সটা বেজায় খাটাচ্ছে। দেড়েমুশে। এই তো, কালই একটা সেমিনার লেকচার আছে। এখনও তৈরি হইনি। রাতে খেয়েদেয়ে বই-কম্পিউটার নিয়ে বসব।

এই বাম্বুটা কিন্তু তুই যেচে নিয়েছিস মিতুদি। সোনালি ফিকফিক হাসছে,— রাজাদার কাছে পালিয়ে গেলেই ল্যাটা চুকে যেত।

তারপর…? আমার প্রোমোশানটার কী হত?

গুলি মার প্রোমোশানে। …পারিসও বটে তুই, বর ছেড়ে কী করে যে রয়েছিস?

সাধ করে আছি নাকি? বাবাকে ছেড়ে যাওয়া যায়?

দূর, মেসো তো এখন অনেক ফিট। বিজয়া করতে গিয়ে তো দেখে এলাম… দিব্যি হুইলচেয়ারে ঘুরছে…

চেয়ারটা এখনও কারওকে ঠেলতে হয় রে। নিজে চালাতে পারে না।

তার জন্য তো মাসি আছে। মেসোর এখন যা ফিজিকাল কন্ডিশান… ম্যানেজ করার জন্য মাসিই কাফি। আর মাসিকে তুই মোটেই দুবলা ভাবিস না।

পারমিতা মনে মনে বলল, আসল দুর্বল লোক তো আমি। মা’র হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে, দূর থেকে খোঁজখবর নিয়ে, যদি মনকে বুঝ দিতে পারতাম, তা হলে তো অপার শান্তি বিরাজ করত সংসারে। কিন্তু সেটা পারমিতা পারবে না। কেন যে পারবে না, সেটা সোনালিকে বোঝানো যাবে কি? সুতরাং মুখ নষ্ট করে তো লাভ নেই।

স্বরে একটা হালকা ভাব এনে পারমিতা বলল,— আর আমার কলেজের পাকা চাকরিটার কী হবে শুনি? অত খেটেখুটে পরীক্ষা দিয়ে, ইন্টারভিউয়ের বেড়া টপকে, কাজটা পেলাম…

সিম্পলি ছেড়ে দিবি। বর বাচ্চা আগে? না চাকরি?

হঠাৎই এণাক্ষীদির আক্ষেপগুলো মাথায় ঝিলিক দিয়েছে। গলায় ঠাট্টার সুরটা বজায় রেখে পারমিতা বলল,— আর যদি প্রশ্নটা উলটো দিক দিয়ে করি? তোর বরের কাছে কোনটা বেশি ইম্পর্ট্যান্ট? বউ-বাচ্চা? না চাকরি?

অফকোর্স বউ-বাচ্চা। সোনালি শমীকের পানে দৃষ্টি হানল,— কী গো, ঠিক বলিনি?

একশো পারসেন্ট। কারণ বউ-বাচ্চা তো আমার সঙ্গেই থাকবে।

মানে? পারমিতার দৃষ্টি তেরচা হল,— তুমি যদি অন্যত্র যাও, তোমার বউও চাকরি বাকরি ছেড়ে তোমার লেজ হয়ে ঘুরবে?

অ্যাই মিতুদি, ফেমিনিস্টদের মতো বাতেলা দিস না তো। সোনালি ছদ্ম কোপে চোখ পাকাল,— হ্যাঁ, লেজ হয়েই নয় যাব। নিজের বরেরই তো লেজ হব, এতে লজ্জার কী আছে?

বলিহারি ঢং! আত্মমর্যাদার লেশমাত্র নেই! বর ঘাড়ের কাছে ফোঁসফোঁস করে বলে এই মেয়ে নাকি বিরক্ত হয়!

পারমিতা মাথা নেড়ে বলল,— বাদ দে। তোর সঙ্গে আমার মতে মিলবে না।

তাও…তুই একটু তলিয়ে ভাব… সম্পর্কটা বাঁচিয়ে রাখতে হলে…

সে দায়টা বুঝি শুধু মেয়েদেরই? আজ তুই যদি কেরিয়ারে একটা বড় ওপেনিং পেয়ে দিল্লি চলে যাস, তোর বর কেন চাকরি ছেড়ে তোর পিছন পিছন যাবে না?

যাহ, এমন বাজে কথা বলিস…! হয় নাকি?

কেন হয় না? তুই আমায় বুঝিয়ে বল। হতে বাধাটা কোথায়?

আহা, তোমরা হঠাৎ একটা ফালতু তর্ক শুরু করলে কেন বলো তো? শমীক তড়িঘড়ি থামাতে চাইছে দু’জনকে। সোনালিকে বলল,— টুসকিটার হালৎ দেখেছ? কেমন ঢুলছে?

তাই তো। এবার তো উঠতে হয়। সোনালি ঘড়ি দেখে বলল,— তোর সঙ্গে ডিবেটটা বাকি রইল রে মিতুদি। …কালীপুজোর দিন কী করছিস?

কেন? শক্তিপুজোর দিন ফের রণরঙ্গিনী হবি?

আরে না। সন্ধেবেলা বাড়িতে একটা গেট-টুগেদার করছি। বন্ধু-বান্ধবরাই থাকবে। অনেককেই তুই চিনিস। চলে আয় না।

পারমিতা মুচকি হাসল,— খুব মাল টানাটানি হবে বুঝি?

কালীপুজোয় কারণবারি তো মাস্ট মিতুদি। শমীকও হাসছে,— ইচ্ছে না হলে তুমি খেয়ো না। কিন্তু হুল্লোড়পার্টিটা মিস কোরো না, প্লিজ।

দেখি। একবার বাবার কাছে তো যাবই। যদি পারি তো ওখান থেকেই…

রাতে থেকে যেয়ো। ফেরার তাড়া না থাকলে মজা আরও জমবে।

মেয়েকে সাপটে তুলে বেরিয়ে গেল সোনালিরা। মোটরসাইকেলে গর্জন বাজিয়ে। দরজা বন্ধ করতে করতে পারমিতা ভাবছিল, গেলে হয়। রাজা যাওয়ার পর আর তো সেভাবে কোনও আড্ডা ফাড্ডায় যায়নি। একটা সন্ধে একটু অন্যভাবে কাটালে মনটাও তো খানিক ঝরঝরে লাগে। তারা তো ওদিকে দিব্যি ফুর্তিতে মশগুল, একা পারমিতা কেন যোগিনী পারা হয়ে বইয়ে দেবে গোটা ছুটিটা!

হ্যাঁ, যাবে পারমিতা। মন স্থির করে পারমিতা কাজে বসল। কম্পিউটারে কালকের বক্তৃতার পয়েন্টগুলো টাইপ করে নিচ্ছে। মিনিট পনেরো পরে থামল একবার। খেয়াল হয়েছে সময়টা। প্রায় দশটা বাজে। মোবাইলটা টানল। আজ তো ওদের উটি যাওয়ার কথা!

ফোন করতেই ওপারে রাজা নয়, মানসী। বিগলিত স্বরে বলল,— ওমা, তুমি? রাজা তো বাথরুমে গো।

ও। আপনারা কখন পৌঁছোলেন?

সন্ধের মুখে মুখে। বাঙ্গালোর থেকে বেরোতে একটু দেরি হয়েছিল…

কেমন লাগছে জায়গাটা?

অন্ধকারে আর দেখতে পেলাম কোথায়! তবে বড্ড শীত, ঘর থেকে বেরোলেই হাড়ে কাঁপুনি ধরছে। তোমার শ্বশুরমশাই তো সেঁধিয়ে গেছে কম্বলে।

হোটেলটা পছন্দসই হয়েছে?

শুধু পছন্দ…? যা জমকালো ব্যাপার-স্যাপার! সুইমিং পুল, ইন্ডোর গেমের জায়গা, কী আছে আর কী নেই!

তাতার খুব খুশি?

ভীষণ। তবে জার্নির একটা ধকল গেছে তো, খেয়ে উঠেই ঘুমিয়ে পড়ল। …বাড়ির কী খবর? অণিমা আসছে তো সকাল সকাল?

হ্যাঁ। তবে পরশু-তরশু ছুটি নেবে।

আর সরস্বতী?

জানি না। এখনও বলেনি কিছু।

দু’জনকেই একটু চাপে রেখো। …রানা নিশ্চয়ই এখনও ফেরেনি?

এবার এসে যাবে।

বাজার টাজার করে দিচ্ছে তো?

পারমিতার বলতে ইচ্ছে হল, সে তো কাটাপোনা ছাড়া অন্য মাছ খায় না, অতএব তাই আসছে রোজ। নয়তো গাদাখানেক মাংস এনে স্তূপ করছে ডিপফ্রিজে। তাও মাটন নয়, ঘাস ঘাস ব্রয়লার। অতিষ্ঠ হয়ে পারমিতা নিজেই দু’-চার দিন সবজি টবজি কিনে এনেছে। কিন্তু মানসীকে ওসব শোনানোর কী দরকার? তিনি এখন বড় ছেলের দৌলতে প্রেমসে মৌজ করছেন, অকম্মা ছোট ছেলের কাহিনি কি তাঁর কানে রুচবে!

পারমিতা দায়সারা ভাবে বলল,— হ্যাঁ। করছে।

অভ্যেসটা হোক। কদ্দিন আর ওর বাবা থলি বইবে!… বেয়াইমশাইয়ের শরীর কেমন?

ভালই।

কাল আমরা সকাল সকাল বেরোচ্ছি। ব্রেকফাস্ট সেরেই। রাজা কোন একটা বাঁধের ধারে নিয়ে যাবে। সেখানে নাকি একখানা চমৎকার লেক আছে। বোটে চড়ব…

শোনাচ্ছে মানসী?

পারমিতা ঝাং বলে উঠল,— রাজা কি এখনও বাথরুমে, মা?

হ্যাঁ। বেরোয়নি তো। আচমকা ঠোক্করে মানসীও ক্ষণিক খেইহারা। একটু থমকে থেকে বলল,— বোধহয় স্নান করছে। বারণ করলাম, তবু…। এই শীতেও কী করে যে…! বেরোলেই তোমায় ফোন করতে বলছি।

ছাড়ি তা হলে।

মোবাইল মুঠোয় চেপে পারমিতা দু’-চার সেকেন্ড ঝুম বসে রইল। তারপর ঝট করে সেলফোনের সুইচ অফ করে দিয়েছে। করুক রাজা ফোন যত বার খুশি, পারমিতাকে আজ আর পাচ্ছে না। ল্যান্ডলাইনের রিসিভারও নামিয়ে রাখবে? থাক, দেখা যাক পারমিতাকে কতখানি চায় রাজা! কী সব লোকজন! নিজেদের ভ্রমণবৃত্তান্ত শোনাতেই মশগুল, কখনও একবার জিজ্ঞেস করে না পারমিতার রিফ্রেশার কোর্স চলছে কেমন! যাক, মহিলার দেমাকি উচ্ছ্বাসে একবার তো অন্তত পিন ফোটাতে পারল পারমিতা!

জ্বালা খানিকটা জুড়োতে পারমিতা উঠল। বিকেলে কেউ থাকে না বলে সকালে আটা মেখে যায় অণিমা, পারমিতাই এখন বানিয়ে নেয় রুটি। ঝটপট খানআষ্টেক রুটি সেঁকে ফেলল পারমিতা, গরম করল মুরগির মাংস, শসা-টোম্যাটো কাটল। একা একা নৈশাহার সারার বিশ্রী পর্বটি সেরে, রানার খাবার ঢাকা দিয়ে, ফের ফিরেছে ঘরে। আবার কম্পিউটার। এবার খানকয়েক গ্রাফ আর ছবি ডাউনলোড। কাজের মাঝেই কান খাড়া সারাক্ষণ। নাহ, বাড়ির টেলিফোন বাজল না। পারমিতার সেলফোন বন্ধ রাখার মর্মার্থ কি অনুভব করল না রাজা? নাকি বুঝেই পালটা তির হানল নৈঃশব্দ্যের?

ভাল লাগছে না। পারমিতার আর কিচ্ছু ভাল লাগে না।

কষটে মেজাজে গোটা লেকচারটার একটা সিডি বানাল পারমিতা। পুরে রাখল ব্যাগে। তারপর আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে। কানার মধ্যে ঝাপসা, একটাই সান্ত্বনা, কাল বেশি খাটতে হবে না ক্লাসে। কালীপুজোর আগের দিন, অনেকেই বাঙ্ক করছে, সুতরাং প্রশ্নোত্তর পর্বটা বোধহয় নির্বিবাদে উতরে যাবে পারমিতা।

শেষরাতে ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমে পারমিতা একটা স্বপ্ন দেখছিল। ঘন নীল আকাশ… সার সার পাহাড়… পাইন-ইউক্যালিপ্টাসে গাঢ় সবুজ হয়ে আছে পাহাড়ের ঢাল… চড়াই উতরাই বেয়ে চেক চেক শার্টটা পরে হাঁটছে রাজা… আগে আগে তাতার… পারমিতা একদম পিছনে… হঠাৎ মেঘে ঝাপসা হয়ে এল চারদিক… পারমিতা রাজা-তাতারকে আর দেখতে পাচ্ছে না… ধোঁয়া সরিয়ে ছুটছে… ছুটছে…

সকালে ঘুম থেকে উঠেও মনে ছিল স্বপ্নটা। কখন যেন ভুলেও গেল। অণিমা কাজে এসেছে, তাকে রান্না বুঝিয়ে পারমিতা বসল টেবিলে। এককাপ চা নিয়ে। উষ্ণ পানীয়তে চুমুক দিতে দিতে চোখ বোলাচ্ছে খবরের কাগজে। প্রায় একই ধরনের সংবাদ। রাজনীতির চাপান-উতোর, খুন-জখম-সন্ত্রাস…। পিছনের পাতায় এসে হঠাৎই চোখ আটকেছে। পা বিহীন এক পঙ্গু মেয়ে পার হয়েছে ইংলিশ চ্যানেল, তারই এক সাক্ষাৎকার। কী ভয়ংকর ঠান্ডায় সাঁতার কাটতে হয়েছিল মেয়েটাকে, হাঙর ছাড়াও কত অজস্র জলচর প্রাণী তাকে ঘিরে ঘিরে ধরছিল, মাঝপথে কেন সে জল ছেড়ে উঠে আসেনি, সাঁতার শেষে কেমন অবশ হয়ে গিয়েছিল তার সর্বাঙ্গ— প্রতিটি অভিজ্ঞতা জানিয়েছে মেয়েটি।

পড়তে পড়তে পারমিতা আবিষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, রানার ডাকে সংবিৎ ফিরল,— গুডমর্নিং ভাবিজি। প্রভাতী চা শেষ?

পারমিতা অবাক মুখে বলল,— সূর্য কি আজ পশ্চিমে উঠল? তোমার না এখন মাঝরাত?

গায়ে পড়ে রায়মশাই বনেছি। এক বন্ধুর আসার কথা। তার সঙ্গে বেরোব।যাচ্ছ কোথাও?

হুঁ। কোলাঘাট। একটা ফিস্ট মতন আছে। রাত্তিরে ওখান থেকে স্ট্রেট অফিস ঢুকে যাব।

অণিমাকে আর এক কাপ চায়ের নির্দেশ ছুড়ে পারমিতা বলল,— কাল রাতে কিন্তু বাড়ি থেকো। আমি হয়তো নাও ফিরতে পারি।

কেন? যাদবপুরে রাত্রিবাস?

পারমিতা জবাব দেওয়ার সময় পেল না, টেলিফোন বাজছে। উঠে গিয়ে পারমিতা ফোনটা ধরল,— হ্যালো?

ও মিতু, তোর মোবাইল অফ কেন? কত বার চেষ্টা করছি…

সুমিতার স্বর কাঁপছে থরথর। পারমিতা উদ্বিগ্নভাবে বলল,— কী হয়েছে মা?

তোর বাবা হঠাৎ সকালে… চা-বিস্কুট খেতে খেতে… কীরকম একটা হেঁচকি তুলল… তারপর আর নড়ছে না, চোখটা কেমন হয়ে আছে…

পারমিতার মাথায় যেন কেউ ডাঙশ মারল সহসা। দু’-এক পল নিশ্চল। হতবুদ্ধি। একটু পরে ঠোঁট নড়েছে,— আমায় এক্ষুনি ওবাড়ি যেতে হবে।

রানাও যেন ঘ্রাণ পেয়েছে বিপর্যয়ের। কাছে এসে বলল,— এনিথিং রং?

বোধহয় এভরিথিং ইজ রং। আমার ব্রেন আর কাজ করছে না রানা।

আমি যাব সঙ্গে?

চলো।

বাড়ি বন্ধ করে যাদবপুর পৌঁছোতে বড়জোর আধঘণ্টা। পারমিতা গিয়ে দেখল, আশঙ্কাটা বর্ণে বর্ণে মিলে গেছে। মা বিছানায় পাথরের মতো বসে। বাবা শয্যায় নিথর। চিরতরে। পারমিতা চোখ বুজে ফেলল। এত পরিশ্রম, এত চেষ্টা, তিলে তিলে গড়ে ওঠা আশা, সব এক লহমায় ধূলিসাৎ। এমনও হয়?

.

১১.

দাদাভাই কেন মরে গেল গো দিদান?

ভগবান ডাক পাঠাল যে।

কেন ডাক পাঠাল?

তাঁর ইচ্ছে। ভগবানের মতিগতি আমি কী করে বুঝব বলো?

তা হলে দাদাভাই এখন ভগবানের কাছে?

হ্যাঁ সোনা। ভগবান তোমার দাদাভাইকে আকাশের তারা করে দিয়েছেন।

কোন তারাটা গো? রাত্তিরে দেখা যাবে?

যেতেই পারে। খুঁজতে হবে।

যে মরে, ভগবান তাকেই আকাশের তারা বানিয়ে দেয়?

হ্যাঁ তো। সেটাই তো নিয়ম।

তা হলে আকাশটা তো একদিন তারা দিয়েই ঢেকে যাবে? আমরা আর কেউ আকাশই দেখতে পাব না?

কেন সোনা? দিনের বেলায় দেখবে। দিনের বেলা তো আকাশে তারা থাকে না।

পারমিতা অনেকক্ষণ ধরে দিদা-নাতির কথোপকথন শুনছিল। তাতার এখন এখানে, যাদবপুরে। প্রণবের মৃত্যুসংবাদে ভ্রমণ অর্ধসমাপ্ত রেখে চলে এসেছিল রাজারা। দিন তিনেকের বেশি অবশ্য রাজা থাকতে পারল না। অফিসের ডাকে ফিরতেই হয়েছিল বেঙ্গালুরু। আবার সে পরশু রাতে এসেছে। গতকাল প্রণবের পারলৌকিক ক্রিয়া গেল, পারমিতাই করল সব কিছু, রাজা সারাদিন ছিল পাশে পাশে। রাতেও হয়তো এখানেই থাকত। তবে ও বাড়িতে আজ নাকি শুভেন্দু রাজমিস্ত্রিকে ডেকেছে, কী সব আলোচনা আছে। তাই সে চলে গেল গড়িয়ায়। এ বাড়িতে ছোটাছুটির জায়গা কম, সারাক্ষণ বকবক করে আক্ষেপটা সুদে আসলে পুষিয়ে নিচ্ছে তাতার। কানের পোকা খেয়ে ফেলছে দিদানের।

তা বাচ্চারা তো এমনটা করেই থাকে। কিন্তু মা? এত সহজ সুরে মা কথা বলছে কী করে? এবং তাও কিনা সদ্য বিগত স্বামীকে নিয়ে! মাকে যেটুকু চেনে পারমিতা, এ হেন আচরণ যেন মা’র সঙ্গে খাপ খায় না। নাতির তালে তাল মেলানোর জন্যই সংলাপ চালাতে হচ্ছে না তো মাকে?

পারমিতা ছেলেকে বকুনি দিল,— কী হচ্ছে কী তাতার? দিদানকে জ্বালিয়ো না। চুপটি করে শুয়ে থাকো।

তাতারের একটি ঠ্যাং সুমিতার গায়ের ওপর। নাতির পায়ে হাত বোলাতে বোলাতে সুমিতা বলল,— কেন ওকে বকছিস মিতু? বলুক না কথা।

মুখ চললে ও কিন্তু জেগে থাকবে। আর সন্ধেবেলা লাগাতার ঘ্যানঘ্যান করবে। তখন মানুষজন আসে… তাদের সামনে….

তখন দেখা যাবে। এখন আমাদের শান্তিতে গল্প করতে দে তো। তুই তোর কাজ কর।

আবার সেই স্বছন্দ স্বর! চোখ কুঁচকে মাকে একবার দেখে নিয়ে কাগজ-কলম টানল পারমিতা। কাল নিয়মভঙ্গের অনুষ্ঠান, জনা তিরিশেক লোক খাবে, আনুমানিক খরচের মোটামুটি একটা ধারণা করে নিচ্ছিল। নিছকই অবান্তর ব্যয়। এসব শ্রাদ্ধশান্তি, নিয়মভঙ্গ, কোনওটাতেই পারমিতার তেমন বিশ্বাস নেই। তবু মা যখন চাইছে….। মা’র ভাল লাগা মন্দ লাগার একটা গুরুত্ব আছে বই কী। তা ছাড়া লোকজনের আনাগোনা, নানারকম কথাবার্তা, এতে পারমিতার মনটাও তো একটু হালকা হয়। আর এত দিন সব কর্তব্য যখন পালন করেছে, এটুকু আর ফাঁক থাকে কেন!

হিসেব বন্ধ করে পারমিতা একটা শ্বাস ফেলল। এখন আর ইচ্ছে করছে না। সন্ধেবেলা টুটান আসবে, তার সঙ্গে বসে নয়….। উঠে বাইরে যাচ্ছে, পিছনে সুমিতার গলা,— কী রে, ও ঘরে চললি নাকি?

হ্যাঁ। কেন?

বলছিলাম, তোর ওপর দিয়ে যা যাচ্ছে…. গিয়ে একটু গড়িয়ে নে। তোর বিশ্রাম দরকার।

হুঁ।

বেরোনোর আগে আর একবার ঘুরে মাকে দেখল পারমিতা। মা যেন বড্ড স্বাভাবিক হয়ে আছে। একটু বেশি রকমের। সেই যে সেদিন নিঝুম বসে ছিল, তারপর বাবাকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার সময়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদল— ব্যস, আর সেই ভেঙে পড়া ভাবটা নেই। নিজেকে কেমন শক্ত করে ফেলল মা। গত দু’-তিন দিন ধরে কথাও যেন বেশি বলছে। কাল শ্রাদ্ধ চলাকালীন এমনভাবে ঘোরাফেরা করছিল, ডেকে ডেকে খোঁজ নিচ্ছে এর-ওর-তার, দেখে বোঝাই যায় না কী ভয়ানক বিপর্যয় সহ্য করেছে মা! সেই মা যে কিনা বাবাকে সুস্থ করতে প্রাণপাত করছিল। অতি তুচ্ছ কারণেও উতলা হয়ে বারবার ফোনে অস্থির করে তুলত পারমিতাকে। মা অশিক্ষিত নয়, বোধহীন নয়, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছে কী নিদারুণ একা হয়ে গেল! তা হলে?

নাহ্, কষ্টটা আছে। অবশ্যই আছে। ভেতরে ভেতরে। কারওকেই সেই যন্ত্রণার ভাগিদার করতে চায় না মা।

নিজের ঘরে এসে পারমিতা শুয়ে পড়ল। চোখ বুজেছে। ওমনি কত যে টুকরো টুকরো স্মৃতির ভিড়! আসছে, যাচ্ছে, আসছে, যাচ্ছে…., বাবাকে নিয়ে, মাকে নিয়ে। অফিস থেকে ফিরে মা পারমিতাকে পড়াতে বসেছে…. বাবা খানিক দেরিতে ফিরল… বাবাকে চমকে দেবে বলে পারমিতা ছুট্টে দরজার আড়ালে…. চোখের ইশারায় মেয়েকে ধরিয়ে দিল মা।….! মেয়ে বলতে কী যে পাগল ছিল বাবা! পারমিতা মাধ্যমিক দিচ্ছে, হায়ার সেকেন্ডারি দেবে… বাবা সেন্টারের গেটে দাঁড়িয়ে! মেয়ের রেজাল্ট দেখে চোখ দিয়ে আলো ঠিকরোচ্ছে যেন! পারমিতা একটা ছেলের প্রেমে পড়েছে, তাকে বিয়ে করবে, মা’র মুখে সমাচারটা পেয়ে বাবা কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল! বিয়ের পরদিন তো পারমিতা শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময়ে বাবা সামনে এলই না! মেয়ের চাকরি পাওয়ার সংবাদে বাবার সে কী শিশুর মতো উচ্ছ্বাস! তাতার যখন হল, তখন যেন বাবাকে পায় কে! সেই বাবা মাত্র ক’দিন আগেও ছিল। এখন আর নেই। কোত্থাও নেই। পারমিতার মগজ এখনও কি ধাতস্থ করতে পেরেছে ঘটনাটা? মনে হয় না কি, এখনই ও ঘরে গিয়ে দেখবে মা-তাতার নয়, বাবা-ই শুয়ে আছে? একটা হাত বুকে, অন্য হাত নেতিয়ে পড়ে, অসহায় দৃষ্টি ঘুরন্ত পাখায়…!

অথচ মা কিনা দিব্যি মেনে নিল? অজস্র স্মৃতি আর দুঃসহ কষ্ট উপেক্ষা করে? এ কি সম্ভব? কী প্রমাণ করতে চাইছে মা?

ভাবনাগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে কখন যেন চোখ দুটো জড়িয়ে এল পারমিতার। দুপুরে এমনটা তো তার হয় না সচরাচর। কাল কাজটা চুকে যাওয়ার পর থেকে শরীর যেন ছেড়ে যাচ্ছে। কত উদ্বেগ, ব্যস্ততা আর ছটফটানির যেন অবসান ঘটল হঠাৎ। যেন লম্বা একটা দুর্গম পথ ধরে হাঁটছিল, গন্তব্যে পৌঁছোনোর আগে আচমকা ফুরিয়ে গেল রাস্তা। এতে কোনও মুক্তির আনন্দ নেই, বুক ভরে ফুসফুসে বাতাস ভরার স্বস্তি নেই, এ যেন সহসা এক শূন্যতার গহ্বরে পতন। মানসিক প্রস্তুতি ছিল না, বরং বিপরীত একটা আশাতেই মন বাঁধছিল, বলেই বুঝি বেশি ঝিমিয়ে পড়ছে স্নায়ু….

পারমিতার চটকা ভাঙল সুমিতার ডাকে,— মিতু….? অ্যাই মিতু?

ধড়মড়িয়ে উঠে বসেছে পারমিতা। মুহূর্তের বিভ্রমে বুকটা ছ্যাঁৎ। স্বর ঠিকরে এল,— কী হয়েছে? কী হল?

কী আবার হবে? সুমিতা বুঝি পলকের জন্য থমকেছে। পরক্ষণে সহজ গলায় বলল,— তোর কলেজ থেকে কে একজন এসেছে।

ও। পারমিতা ফোঁস করে শ্বাস ফেলল,— বসিয়েছ তো?

হ্যাঁ রে বাবা, হ্যাঁ। আমার কি ওইটুকু আক্কেল নেই?

মলিনাদি এসেছে?

সে তো আজ সন্ধেয় আসবে। রান্নাবান্না সেরে দিয়ে যাবে। ….আমি চা বসাচ্ছি। তুই আয়।

দ্রুত হাতে মুখ-চোখ-চুল ঈষৎ বিন্যস্ত করল পারমিতা। বাড়িতে যখন তখন লোকের আনাগোনা, তাই শাড়ি পরেই থাকছে এখন। আঁচল গুছিয়ে নিয়ে বাইরে এসে দেখল, কণাদ। হাতে রজনীগন্ধার তোড়া।

আলতো হেসে কণাদ বলল,— সরি। কাল আসতে পারিনি। এমন একটা ঝামেলায় কলেজে আটকে গেলাম….

জানি তো। শুনেছি। আপনাদের ডিপার্টমেন্টে কাল সেমিনার ছিল।

সত্যি, কী যে এক ন্যাকের চক্করে পড়েছি…। অনেকে এসেছিল কাল, তাই না?

হ্যাঁ। প্রিন্সিপালও ফোন করেছিলেন। ….দাঁড়ালেন কেন, বসুন।

আধো অন্ধকার ছোট ড্রয়িং হলের এক ধারে টেবিলে প্রণবের বাঁধানো ফোটোগ্রাফ। বছর চারেক আগে তোলা। ফুল-মালায় ঢেকে আছে মধ্যবয়সি হাস্যমুখ প্রণব। পাশে রাখা হুইলচেয়ারটিতেও ফুলের স্তূপ। ধূপ আর ফুলের সুবাস মিলেমিশে কেমন একটা মৃত্যু মৃত্যু গন্ধ ছড়াচ্ছে জায়গাটা থেকে। অন্তহীন বিষাদের মতো।

কণাদ রজনীগন্ধার তোড়াখানা রেখে এল ছবির সামনে। সোফায় বসে বলল,— কাজকর্ম সব ঠিকঠাক মিটেছে তো?

মোটামুটি।

কণাদ একটুক্ষণ নীরব থেকে জিজ্ঞেস করল,— হঠাৎ আবার স্ট্রোকটা হল কেন? আপনি তো বলতেন মেসোমশাই রিকভার করছেন….?

কী জানি! আগের দিন সন্ধেতেও তো কোনও সিম্পটম্ ছিল না। সন্দেশ এনেছিলাম, ভালবেসে খেল…

হঠাৎ প্রেশার বেড়ে গিয়েই কি….?

তাই হবে। এমনিতে তো ব্লাড প্রেশার স্টেডিই থাকত। বলেই পারমিতার মনে হল, একসময়ে রোজই একবার রক্তচাপ পরীক্ষা করাত বাবার। তারপর কবে যেন সেটা সপ্তাহে এক দিনে ঠেকল। ইদানীং তো পনেরো দিনের ব্যবধানে…। এটাকে কি পারমিতার গাফিলতি বলা যায়? গা-ছাড়া মনোভাব? পরক্ষণে নিজেকেই যেন সান্ত্বনা দিয়ে বলল,— মিসহ্যাপের দিন সাতেক আগেই তো বাবার ব্রেন স্ক্যান করালাম। তখনও তো সেভাবে কিছু….

শরীর ভারী জটিল যন্ত্র। কোত্থেকে যে কী হয়ে যায়!

সুমিতা চা এনেছে। সঙ্গে প্লেটে মিষ্টি। মা’র সঙ্গে কণাদের পরিচয় করিয়ে দিল পারমিতা। বলল,— কণাদ লেখাপড়ায় দারুণ ব্রিলিয়ান্ট। কলেজে খুব পপুলার। ভীষণ ভাল পড়ান তো…

কেন লজ্জা দিচ্ছেন? কণাদ মেপে হাসল,— আপনিও কম যান নাকি? সায়েন্সের মধ্যে কেমিস্ট্রির লোড সবচেয়ে বেশি। কীভাবে যে একা ম্যানেজ করছেন!

একা কোথায়! আমাদের এখন পাঁচজন গেস্ট লেকচারার। তারাও কম খাটে নাকি?

ছাড়ুন তো। অতিথি অধ্যাপক দিয়ে প্র্যাকটিক্যাল বেসড্ ডিপার্টমেন্ট থোড়াই চলে! সায়েন্সের স্টুডেন্টরা তো কেমিস্ট্রি বলতে শুধু পারমিতা ম্যাডামকেই বোঝে।

সুমিতা ফস করে বলে উঠল,— হ্যাঁ, ও তো কলেজঅন্ত প্রাণ। দিনরাত কলেজ কলেজ করেই গেল।

আহ্ মা, মেয়ের গান গেয়ে লোক হাসিয়ো না তো। পারমিতা তাড়াতাড়ি কথা ঘোরাল,— তাতার কী করছে গো?

এতক্ষণ পর ঘুমোল।

বিচ্ছুটাকে আপনার দেখা হল না। ও ছেলে সন্ধের আগে আর জাগছে না। পারমিতা মিষ্টির প্লেট এগিয়ে দিল,— নিন… প্লিজ।

একটা শোনপাপড়ি শুধু তুলল কণাদ। ছোট্ট কামড় দিয়ে বলল,— কোর্সটা তো তা হলে আপনার শেষ হল না?

কপালে নিশ্চয়ই সেরকমই লেখা ছিল। পারমিতার আগে সুমিতা জবাব দিয়েছে,— যে কারণে ছুটিতে বরের কাছে গেল না, সেটাই বরবাদ। আর নাকি মাত্র পাঁচ দিন বাকি ছিল।

এসব কেন বলছে মা? আগ বাড়িয়ে? পারমিতা বিরক্ত হলেও প্রকাশ করল না। সামান্য মুখভঙ্গি করে বলল,— ঠিক আছে, হয়নি তো হয়নি। নেক্সট ইয়ারে কলকাতাতে ফের একটা কোর্স পাব, ওটাই নয় ট্রাই করব।

কিন্তু এবারকার ক্লাসগুলো তো বেকার গেল।

একেবারে ফালতু যায়নি। ইউনিভার্সিটির স্যারদের সঙ্গে আমাদের কেমিস্ট্রির সেমিনার নিয়ে আলোচনা করেছি। দু’জন রাজি হয়েছেন যেতে। একজন বলবেন, জলে আর্সেনিক দূষণ নিয়ে। আর একজনের টপিক, ইনঅরগ্যানিক সারের কুফল।

বাহ্, দুটোই বেশ রেলিভ্যান্ট বিষয়। ডেট কিছু ভাবছেন?

ইচ্ছে আছে একটা বড়দিনের আগে নামাব। অন্যটা জানুয়ারির এন্ডে।

দেখবেন তারিখগুলো যেন আমাদের সঙ্গে না ক্ল্যাশ করে।

নিশ্চয়ই। ডেট ফাইনাল করার আগে আপনাদের সঙ্গে তো বসবই।…. ফিজিক্সের ম্যাগাজিন বেরোল?

হ্যাঁ, কালই….। ইস, হাতে করে আনলে হত।

দু’জনের কেজো আলাপচারিতার মাঝে কখন যেন উঠে গিয়েছিল সুমিতা। আরও খানিকক্ষণ গল্প করে কণাদও বিদায় নিচ্ছে। দরজায় গিয়ে জিজ্ঞেস করল,— আপনি তা হলে কবে নাগাদ জয়েন করছেন?

ভাবছি এই উইকেই…

তাড়াহুড়োর দরকার কী! না হয় আরও দু’-চার দিন…। মাসিমা এখন খুব লোনলি ফিল করবেন, আপনি ক’দিন কাছে থাকলে….

হুঁ। ওদিকে আমার ছুটিও যে বাড়ন্ত। দেখি কী করা যায়।

সদর বন্ধ করে পারমিতা ফের সোফায় এসে বসল। মাকে নিয়ে সত্যিই চিন্তা হচ্ছে। মা’র এই আকস্মিক একাকিত্বে কী ভূমিকা থাকতে পারে পারমিতার? শুধু সঙ্গ পেলেই কি অন্তরের ক্ষতে প্রলেপ পড়ে? কাল তো জেঠিমা বারবার মাকে বলছিল, ক’টা দিন চেতলায় কাটিয়ে আসতে। টুটানও অনেক করে বলল। মা তো মোটেই আগ্রহ দেখাল না। বরং এই ফ্ল্যাটেই নাকি বেশ থাকবে, বলছিল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। তবে মা নিজেকে যতই শক্ত দেখাক, সত্যি সত্যি একা থাকতে পারবে তো? এত দিন মা বাবাতেই সম্পৃক্ত ছিল, এখনও লোকজনের আসা-যাওয়া চলছে, এরপর সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়ে যাবে বাড়ি…. সারাদিন নির্জন ঘরে, হাতে আর কোনও কাজ নেই, কথা বলার সঙ্গী নেই, কারওকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হচ্ছে না…. এই দুঃসহ পরিবেশ যে মা কীভাবে গ্রহণ করবে? পারমিতা নয় এখনকার মতো কলেজফেরতা এল, এক-আধ ঘণ্টা রইল, চাট্টি গল্পগাছা করল… তাতেও কি সমাধান হবে সমস্যার? কী যে হবে কে জানে!

অঘ্রান মাস পড়ে গেছে। এসেই যাই যাই করে বিকেল। ফ্যানের হাওয়ায় চোরা হিমের ছোঁয়া। গরম-ঠান্ডার এই সন্ধিক্ষণটায় মশা বাড়ে খুব। সুমিতা জানলাগুলো বন্ধ করছিল। আওয়াজ পেয়ে পারমিতাও হাত লাগাল। মশকনিবারণী যন্ত্র চালু করেছে ঘরে ঘরে। বাবার ছবির সামনে নতুন ধূপও জ্বেলে দিল। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে বাবার উজ্জ্বল মুখখানা।

সুমিতা খাবার টেবিলে। পারমিতার ওই তাকিয়ে থাকা যেন লক্ষই করেনি, এমনভাবে বলে উঠল,— হ্যাঁ রে, তাতার উঠে কী খাবে?

পারমিতা ঈষৎ অন্যমনস্ক স্বরে বলল,— বাড়িতে তো প্রচুর ফল জমেছে, আঙুর-আপেল দেবখ’ন।

ফল তোর ছেলে মুখেই তুলবে না।

তা হলে দুধ খাবে।

শুধু দুধ? মলিনা এলে দুটো লুচি ভেজে দিতে বলি?

ঝামেলা বাড়িয়ো না মা। বাড়িতে আরও লোক আসবে….

তো কী? ও বাচ্চা ছেলে….। চাইলে ম্যাগিও খেতে পারে।

উঠুক তো, তারপর দেখা যাবে।

তাতার জাগল আরও আধ ঘণ্টাটাক পরে। মলিনা তখন এসে গেছে। তাকে রাতের জন্য পরোটা আর কপিচচ্চড়ি বানাতে বলে ছেলেকে আগে দুধের কাপ ধরাল পারমিতা। চকোলেট নেই, তাতার দুধ ছোঁবে না, তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে খাওয়াচ্ছে পারমিতা, তখনই রাজা এল। আলিগড়ি পাজামার সঙ্গে লম্বা-ঝুল মেরুন পাঞ্জাবি পরেছে রাজা, দেখতে বেশ লাগছে।

এসেই আগে শাশুড়ির পাশে বসেছে। গলায় একটা গ্রাম্ভারি ভাব এনে বলল,— একটা কথা বলব মা?

কী?

আপনার শরীরটা কিন্তু বেশ ভেঙে গেছে। এবার আপনার একটা থরো চেক-আপ দরকার।

সুমিতা সেভাবে আমল দিল না। বলল,— কই, আমি তো দিব্যি আছি।

কিন্তু দেখে তো মনে হচ্ছে….

তোমাদের চোখের ভুল। অসুস্থ মানুষের সঙ্গে থাকতে থাকতে এমনিই তো মুখে একটা ছাপ পড়ে….

পারমিতা বলল,— না মা। রাজা ঠিকই বলেছে। সামনের সপ্তাহেই আমি তোমার সব টেস্ট করাব।

বকিস না তো। সুস্থ মানুষকে বিছানায় শোওয়াতে চাস নাকি? প্রসঙ্গটা যেন উড়িয়ে দিল সুমিতা। রাজাকে জিজ্ঞেস করল,— তা হ্যাঁগো, সকালে তোমাদের বাড়ি নিয়ে কথাবার্তা হল?

হুঁ। বাবা তো দোতলা তুলতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

ভালই তো। কাজটা শেষ করে ফেলো।

আমি কিন্তু কোনও যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না মা। মিছিমিছি টাকা ঢালা।

কেন গো?

কে থাকবে বলুন? আমার পক্ষে তো পাকাপাকি ফিরে আসা সম্ভব নয়। যদি হয়ও, তো সেই বুড়ো বয়সে….। থাকছে শুধু রানা। তার জন্যে পুরো একতলা রইল…। অবশ্য ও যদি বিয়ে থা-র পর একটু হাত-পা ছড়িয়ে বাস করতে চায়, তা হলে অবশ্য দোতলাটা কাজে লাগবে। আমি মাঝে মাঝে কলকাতায় এলে আমার ওই একটা ঘরই তো যথেষ্ট।

পারমিতার কেমন ধন্দ লাগছিল। বলে কী রাজা? পারমিতার অস্তিত্ব কি ভুলে গেল নাকি? তাতার বড় হলে তারও তো একটা আলাদা ঘর লাগবে….!

সুমিতা ঘাড় নেড়ে নেড়ে শুনছিল। বলল,— বটেই তো। ঠিকই তো। তা কী স্থির হল শেষ পর্যন্ত?

কাঁহাতক বাবার সঙ্গে তর্ক করা যায়! মেনে নিলাম। আফটার অল, একটা পার্মানেন্ট অ্যাসেট তো। পরে যদি থাকি, কিংবা বেচে দিই, কোনওটাতেই তো লোকসান নেই।

দোতলার প্ল্যান তো তা হলে করতে হবে?

হয়ে আছে। বাবার কাজ সব পাক্কা। আগেই করে রেখেছে। সেই বাড়ি বানানোর সময়েই। দোতলার ঘরদোর একটু অন্যরকম হবে… রাজমিস্ত্রির সঙ্গে সেই সব নিয়েই কথা হচ্ছিল…। ওরা একটা এস্টিমেটও দিয়েছে।

বেল বাজছে। টুটান। বৈষয়িক আলোচনাটা আপাতত চাপা পড়ে গেল। মলিনা চা বানিয়ে দিল, আগামী কালের অনুষ্ঠান নিয়ে শুরু হল কথাবার্তা। ক’টা নাগাদ কেটারার খাবার দিয়ে যাবে, মেনুতে কী সামান্য রদবদল হয়েছে, প্রণবের প্রিয় গলদা চিংড়ি কাল পাওয়া যাবে কি যাবে না, এই সব। তার মাঝেই বেহালার মাসি এল, সঙ্গে ছেলের বউ, তাদের নিয়ে ঘরে গেল সুমিতা। এদিকে কলকাতার সঙ্গে বেঙ্গালুরুর কতখানি তফাত বোঝাচ্ছে রাজা। অফিসট্যুরের অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছে টুটান মজা করে করে। একটা মানুষের মৃত্যুর তেরো দিন পর শোকের বাড়ির চেহারা বুঝি এমনটাই হয়।

বাড়ি ফাঁকা হল ন’টা নাগাদ। সুমিতা আবার জামাইকে নিয়ে পড়েছে। জিজ্ঞেস করল,— তোমার তো কাল ভোরেই যাওয়া?

হ্যাঁ মা। পাঁচটার মধ্যে বেরোতে হবে।

কালকের দিনটা তুমি থাকতে পারলে খুব ভাল হত।

আমারও কি ইচ্ছে করছে না, মা? কিন্তু এমন একটা প্রোজেক্ট চলছে… টাইমের মধ্যে শেষ করতেই হবে।

খুব খাটুনি যায় তোমার। তাই না?

না খাটলে কোম্পানি রাখবে কেন।

তা খাওয়া দাওয়া করো তো ঠিকমতো?

ওই আর কী। পেট ভরানো নিয়ে ব্যাপার….

বুঝতে পারছি। তোমার খুব অসুবিধে হয়।

উত্তরে রাজা কী বলল, শোনা হল না পারমিতার। মোবাইল ঝংকার দিয়েছে, ছোটঘরে গিয়ে ধরতে হল ফোনটা। শর্বরীদি। কুশল প্রশ্ন করছে। কণাদ আজ এসেছিল শুনে খুশি হল। তারপর বলছে এ কথা, সে কথা। কোন এক দিদির নাকি ক্যান্সার ধরা পড়েছে, তাই নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে….! সন্তানসম্ভবা মেয়ের শরীরস্বাস্থ্য নাকি সুবিধের নয়, তাকে এবার কাছে এনে রাখতে হবে…! শুনতে শুনতেই পারমিতা দেখতে পাচ্ছিল, রাজা গিয়ে বসল ডাইনিং টেবিলে। বাবার ব্ল্যাকবেরি নিয়ে গেমস্ খেলছিল তাতার, তাকে ধরে আনল মা, দু’জনকেই খেতে দিচ্ছে। নাতিকে খাওয়াতে খাওয়াতে গল্প জুড়ল জামাইয়ের সঙ্গে….

মা’র মুখখানাই নজরে আসছিল পারমিতার। ভুরু কুঁচকে শুনছে, পরক্ষণেই উৎসাহ নিয়ে বলছে কিছু, আঁচল দিয়ে তাতারের মুখ মুছিয়ে দিল, ঘাড় নাড়ছে মাঝে মাঝে। ঘোর বাস্তব দৃশ্য, তবু এই মুহূর্তে কেমন অলীক মনে হয়। অলীক? না কৃত্রিম? হ্যাঁ, পারমিতার মনশ্চক্ষু তো তাই বলছে।

মোবাইল পাশে রেখে পারমিতা বসেছিল বিছানায়। রাজা ঢুকল ঘরে। রুমালে মুখ মুছতে মুছতে বলল,— কী হল? এভাবে বসে কেন?

পারমিতা মৃদু গলায় বলল,— এমনিই।

উঁহু। রাজা পাশে বসেছে। পারমিতার কাঁধে হাত রেখে বলল,— আমাকে ফাঁকি দিতে পারবে না। কিছু একটা চলছে মনের মধ্যে।

ভাল লাগছে না।

এখনও মন খারাপ? …আরে বাবা, রিয়েলিটিটাকে তো মানতেই হবে। জন্মানো মানেই এক পা, এক পা করে মৃত্যুর দিকে হেঁটে চলা। নয় কি? রাজা অল্প ঠোঁট ছড়াল,— তুমিই তো বলো, লাইফ একটা রাসায়নিক বিক্রিয়া। এক জায়গা থেকে শুরু হয়, একটা পয়েন্টে গিয়ে তার সমাপ্তি ঘটে।

সে তো জানি। আমি অন্য কথা চিন্তা করছিলাম।

কী?

মা।

কী হল মা’র? উনি তো বেশ নরমাল আছেন! আমি তো ভাবতে পারিনি, এত তাড়াতাড়ি এমন একটা শক্ উনি সামলে নেবেন!

সত্যি কি সামলেছে? মা’র হাবভাব তোমার আনন্যাচারাল ঠেকছে না? এই যে, এত বেশি বেশি কথা বলছে, বাবার প্রসঙ্গ উঠলেও নির্বিকার থাকছে…. এটাই তো অস্বাভাবিক। সামথিং স্ট্রেঞ্জ! সামথিং ইজ ভেরি মাচ স্ট্রেঞ্জ!

কয়েক পল স্থির চোখে পারমিতার দিকে তাকিয়ে রইল রাজা। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বলল,— জানতাম, তুমি এরকম কিছু একটা বলবে।

কী বললাম আমি?

বুঝতে পারছ না? রাজার স্বরে যেন ব্যঙ্গ,— আমি দেখতে চাইছিলাম, পরবর্তী বাহানাটা এবার কীভাবে শুরু হয়।

কীসের বাহানা?

জোরে জোরে মাথা নাড়ল রাজা। একটা শ্বাস ফেলে বলল,— থাক না পারমিতা। এই মুহূর্তে কথাটা আমাকে দিয়ে না হয় নাই বলালে!

পারমিতা পড়তে পারছিল রাজাকে। কিংবা পারছিল না।

.

১২.

ক্লাসের ফাঁকে পারমিতা একমনে প্রুফ দেখছিল। সামনের বৃহস্পতিবার সেমিনারের দিন ধার্য হয়েছে, তখনই প্রকাশিত হবে বিভাগীয় পত্রিকা। ছাত্রছাত্রীরা এন্তার লেখা জমা করেছিল, অনেক ছাইভস্ম কাটছাঁট করে, সাজিয়ে গুছিয়ে, গত সপ্তাহে পাঠিয়েছিল প্রেসে। প্রুফটা দিল আজ। হাতে সময় নেই, সংশোধনের কাজ যথাশীঘ্র সারতে হবে। ছাপাখানাটা অপদার্থ, ডিটিপি-তে কমপোজ করেও কী করে যে এত ভুল থাকে! নাহ্, আর এক দফা বোধহয় দেখা দরকার। বেশি ভুলভাল থাকা মানেই তো অন্য ডিপার্টমেন্টের হাসির খোরাক বনে যাওয়া। তা ছাড়া কলেজের পত্রিকা তো যতটা সম্ভব নিখুঁত হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

ব্যাগে টুং বাজল। সংক্ষিপ্ত বার্তা। সকাল থেকেই পাচ্ছে টুকটাক। আজকের বিশেষ দিনটা অনেকেই স্মরণে রেখেছে। ইদানীং যাদের সঙ্গে কালেভদ্রে যোগাযোগ হয় তাদেরও কেউ কেউ। এমনকী বর্তমানে কানপুরবাসিনী সৃজা পর্যন্ত….

সদ্যপ্রেরিত সমাচারটি দেখে পারমিতা হেসে ফেলল। ওফ্, সোনালি পারেও বটে। কী বিদ্‌ঘুটে একখানা পিকচার টেম্প্‌লেট পাঠিয়েছে। দু’পিস ন্যাড়া-নেড়ি পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে হাপুস নয়নে কাঁদছে! সঙ্গে রোমান হরফে বাংলা। বিরহতাপিত বিবাহবার্ষিকীর জয় হোক। অনেক অনেক শুভেচ্ছা। দু’জনকেই।

মহা ফাজিল মেয়ে তো! দেখা হলে একটা গাঁট্টা লাগাতে হবে। পারমিতা মোবাইল ব্যাগে পুরতে গিয়েও থামল। আবার ঢুকেছে বারতাভূমিতে।

রাজার এস-এম-এসখানা আবার খুলল পারমিতা। সকাল সাতটা কুড়িতে পাঠানো। দুটো মাত্র ইংরিজি শব্দ। মিসিং ইউ। ভোরবেলা ফুলও এসেছে এক ফ্লোরিস্টের দোকান থেকে। রাজারই বৈদ্যুতিন নির্দেশে। একরাশ রঙিন জারবেরা। সঙ্গে কার্ডে ওই দুটিই শব্দ-মিসিং ইউ।

শব্দ দু’খানা ধক ধক বাজছে বুকে। সেই সকাল থেকেই। কী তীব্র আহ্বান! প্রতিবারই পাঠের পর মনটা উদাস হয়ে যায়। বুঝি বা বিষণ্ণও। পালটা এস-এম-এস একটা পাঠানো হয়ে ওঠেনি পারমিতার। যত বার লিখতে যায়, আঙুল সরে না যে। মনে হয় ভাষাটা কেমন কেতাবি হয়ে যাচ্ছে। কিংবা বড় বেশি ছেলেমানুষি আবেগে মাখামাখি….। ঠিক কী লিখলে যে হৃদয়টা তার মেলে ধরা যাবে?

মাথা অল্প ঝাঁকিয়ে পারমিতা ফের কাজে ফিরল। পাঁচটা লাইনও বোধহয় এগোয়নি, সামনে সেকেন্ড ইয়ারের অরিজিৎ।

পারমিতা ভুরুতে পলকা ভাঁজ ফেলল,— আবার কী হল তোমার? নতুন কোনও প্রবলেম?

না, না। মোটা লেন্স চশমা অরিজিৎ ঘটঘট ঘাড় নাড়ল। ঈষৎ কুণ্ঠিতভাবে জিজ্ঞেস করল,— আমার আর্টিকেল্‌টা দেখা হয়ে গেল ম্যাডাম?

কেন?

বুকপকেট থেকে একটা কাগজ বের করেছে অরিজিৎ,— লেখাটায় একটা প্যারা যোগ করতে চাই।

এখন? অসম্ভব।

কিন্তু আর্টিকেল্‌টা যে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে ম্যাডাম। চিকিৎসায় রেডিয়ো অ্যাক্টিভিটির ব্যবহারটা পুরো বলা হয়নি। কাল ইন্টারনেটে দেখছিলাম….

এ তো মহা জ্বালা হল। আজ রাত্তিরে আবার নতুন কিছু দেখবে, কাল এসে ঢোকাতে চাইবে… এরকম করলে তোমাদের ম্যাগাজিনটা বেরোবে কী করে?

তবু ম্যাডাম…. জেনেশুনে একটা হাফ-ডান লেখা…

এক কাজ করো। পুরো লেখাটাই নিয়ে যাও। মনোমতো ফিনিশ হলে জমা কোরো, পরের ইস্যুতে ছাপব।

আচ্ছা… তা হলে থাক…

বলেও শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে অরিজিৎ। এখন করুণ চোখে ঘুরঘুর করবে অনবরত। পারমিতা ঠোঁট টিপে বলল,— ঠিক আছে, দাও। আর কিন্তু আমায় ডিসটার্ব করবে না।

কাগজখানা পারমিতাকে ধরাতে পেরে বত্রিশ পাটি দাঁত বেরিয়ে গেছে ছেলেটার। ওই আনন্দটুকু দেখতে কী ভাল যে লাগে! খেটেখুটে যখন তৈরি করেছে লেখা, একেবারে নিরুৎসাহ করলে কি চলে!

ঘণ্টা পড়ল থার্ড পিরিয়ডের। দুই অতিথি অধ্যাপক ফিরল ক্লাস সেরে। বিদিশার হাত থেকে অ্যাটেন্ডেন্স রেজিস্টার নিয়ে দৌড়োল পারমিতা। থিয়োরি ক্লাস সমাপ্ত হতেই বায়ো-সায়েন্সের প্র্যাকটিক্যাল শুরু। চালাতে চালাতে ফের দেখছে প্রুফটা। শেষ হতে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। ডেকে বুঝিয়ে দিল সজলকে। প্রেসে পৌঁছে দিতে বলল কাগজগুলো।

সাড়ে চারটে নাগাদ চেয়ার ছাড়ল পারমিতা। স্টাফরুমে গিয়ে সই টই করল, এর-ওর সঙ্গে হাই-হ্যালো, দেঁতো হাসি, তারপর বেরিয়ে পড়েছে। রিকশায় চেপে ফের মনে পড়েছে রাজাকে। এবং সেই দুটি শব্দ-মিসিং ইউ!

একটা স্যাঁতসেঁতে বাতাস বইছে বুকের গভীরে। হঠাৎ পারমিতা বার করল মোবাইল। যন্ত্রের মতো টিপছে কি-প্যাড। ইস, ওই দুটো শব্দই তো যথেষ্ট! মিসিং ইউ!

এস-এম-এসটা পাঠিয়ে মনের ভার যেন লাঘব হয়েছে খানিকটা। চোখ মেলে দেখছে পথের দু’ধার। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড গাছ, বাড়িঘর, দোকানপাট, পথবাতি…। বহু দূরের সেই শহরটাও যেন ভেসে উঠছে হঠাৎ হঠাৎ। আনমনা হয়ে যাচ্ছিল পারমিতা।

প্ল্যাটফর্মে পা রাখার আগেই চমক। বিশেষ রিং-টোনটি বেজে উঠেছে।

ওভারব্রিজ ধরে এগোচ্ছিল পারমিতা, পলকে স্থাণু! ঝটিতি ফোন কানে চাপল।

ওপারে রাজার গমগমে গলা,— যাক, এতক্ষণে তাও সাড়া মিলল! ভাবছিলাম হয়তো আজকের দিনটাকেও তুমি….

অ্যাই পাজি, সকালে আমার ফুল পাওনি? বেছে বেছে অত সুন্দর একটা তোড়া পাঠালাম….?

দিয়ে গেছে। অবশ্য সাত দিন আগেও অর্ডার প্লেস করলে তো রুটিন মাফিক পৌঁছোত।

না গো মশাই, আমি কালই দিয়েছি অর্ডার। …আজ সকালে তোমার জারবেরাগুলো দেখে যা মন কেমন করছিল!

তাই আট-ন’ ঘণ্টা পর একটা জবাব দিলে? তাও কিনা আমারই ভাষায়?

আর অন্য কথা মনে এল না যে।

সত্যি তুমি আমায় মিস করছ?

খুউব।

তা হলে কষ্ট করে পড়ে আছ কেন? চলে এলেই তো পারো।

যাচ্ছি তো। কেটেছি তো চব্বিশ তারিখের টিকিট। এবার ক্রিসমাসটা আমরা তিনজন কিন্তু চুটিয়ে এনজয় করব।

আমার সৌভাগ্য। ওটুকুও যদি জোটে….। রাজা কয়েক সেকেন্ড চুপ। তারপর বলল,— এত হট্টগোল কীসের? তুমি এখন কোথায়?

ব্যারাকপুর স্টেশনে। একে মানুষের কলকল, তার ওপর পায়রাগুলো যা ক্যাচরম্যাচর জুড়েছে…

হুঁ। বহুৎ ডিসটার্বেন্স। ছাড়ছি। …আই লাভ ইউ, পারো।

শেষ কথাটা যেন ভারী যান্ত্রিক শোনাল। ফোন অফ করে পারমিতা নামল সিঁড়ি বেয়ে। এখনও ট্রেন দেয়নি, বসেছে সিমেন্টের ধাপিতে। হঠাৎই পোড়া মনে এক প্রশ্নের উদয়। রাজা লিখেছিল, মিসিং ইউ। পারমিতাও। পড়ে পারমিতার মনে হয়েছিল, রাজা তাকে ডাকছে। কিন্তু একই শব্দ পাঠ করে রাজা কেন বুঝল না, পারমিতাও তাকে চাইছে কাছে? এবং ‘মিসিং ইউ’য়ের সমাধান যেন পারমিতারই যাওয়া, রাজার চলে আসা নয়? পরস্পরের প্রতি একই আহ্বান কেন যে ভিন্ন অর্থ তৈরি করল? নাকি এ দৃষ্টিভঙ্গির তফাত? যা গড়ে ওঠে নিজের অজান্তে?

তুৎ, পারমিতা এসব ভাবছেই বা কেন? সহজ একটা ব্যাপারকে অকারণ পেঁচানো। রাজা যে সেই হঠাৎ একদিন এল… বলেনি তখন, পারমিতাকে মিস করছে বলেই তার চকিত আগমন?

ভাবনাটায় এক ধরনের আরাম আছে। কিছুটা বা আত্মতুষ্টিও। হালকা মনেই ট্রেনে উঠল পারমিতা। ফেরার পথে নেমেছে যাদবপুরে। অভ্যেস মতো। মনে পড়ল, গত বছর এই দিনে সে আর রাজা একসঙ্গে গিয়েছিল যাদবপুর। বাবার জন্য মিষ্টি নিয়ে। আজ মা’র জন্য কিছু নিয়ে যাবে কি? বিরিয়ানি টিরিয়ানি? থাক। এই সবে বাবা চলে গেল, এখন গিয়ে মাকে নিজেদের বিবাহবার্ষিকী জাহির করা বোধহয় মানায় না।

শীত পড়ছে। এখনও তেমন কামড় নেই, তবে সূর্য ডুবলে গা বেশ শিরশির করে। রাস্তায় অনেকেই সোয়েটার পরছে। রাতে আর পাখা চালানো যাচ্ছে না, ভোরের দিকে পাতলা একটা কম্বল তো টানতেই হয়।

পারমিতাও গুজরাতি চাদরখানা চড়িয়েছিল গায়ে। বেশ গরম হয় চাদরটায়, ফ্ল্যাটে ঢুকে খুলে রাখল। সোফায় বসতে বসতে নজরে এল, মা’র পরনে বাইরের শাড়ি। জিজ্ঞেস করল,— কোথাও বেরিয়েছিলে নাকি?

ওই যে…শীলাদের ওখানে গিয়েছিলাম। দুপুর-বিকেলটা কাটিয়ে এলাম।

শীলা সমাদ্দার সুমিতার পুরনো বান্ধবী। অনেক দিন ধরেই পথশিশুদের নিয়ে একটা এন জি ও চালায়। আজকাল মাঝে মাঝেই শীলাদের অফিসে যাচ্ছে সুমিতা।

পারমিতা মৃদু হেসে বলল,— তুমি কি শীলামাসিদের টিমে জয়েন করে গেলে?

হ্যাঁ। কিছু তো একটা করি।

ভাল লাগছে তোমার?

মন্দ কী। দু’-দুটো বছর তো একটা রুগ্‌ণ মানুষকে নিয়ে থাকলাম…। তখন অবিরাম বুক ধুকপুক করত। সারাক্ষণ মনে হত, এই বুঝি মানুষটা মরে গেল, এই বুঝি চলে গেল…। আজ যখন সে নেই, এবার না হয় একটু অন্যরকম ভাবে বাঁচি। একটা-দুটো বাচ্চাকেও যদি সুস্থ জীবনের দিশা দেখাতে পারি…

একদম সঠিক ভাবনা। পারমিতা বুড়ো আঙুল তুলে মাকে তারিফ করল,— এরকম একটা ইনভল্‌ভমেন্ট তোমার বড্ড জরুরি ছিল। একা একা বাড়িতে ভূতের মতো বসে থাকা মোটেই কাজের কথা নয়।

জানি রে। আমার কী উচিত, আমি যথেষ্ট বুঝি। …চা খাবি তো?

করো।

সুমিতা গেছে রান্নাঘরে। সেখান থেকেই বলল,— তোদের তো আজ বিয়ের দিন….! রাজা শুনলাম প্রচুর ফুল পাঠিয়েছে?

খবর পৌঁছে গেছে! শাশুড়ির যেন পেট ফোলে!

পারমিতা গলা ওঠাল,— আমিও তো পাঠিয়েছি মা।

তোদের সম্পর্ক বুঝি এখন শুধু ফুল পাঠানোতে?

মন্তব্যটা সম্যক অনুধাবন করতে পারল না পারমিতা। উঠে বাথরুম ঘুরে এল। সুমিতা চায়ের সঙ্গে মুড়ি-চানাচুর মেখে এনেছে, খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল,— ওভাবে বললে কেন?

এমনিই। মনে হল। সুমিতাও এক মুঠো মুড়ি তুলেছে। হাতে রেখে বলল,— তোকে একটা প্রশ্ন করব মিতু? সত্যি জবাব দিবি?

কী?

তোর আর রাজর্ষির মধ্যে কি কোনও অশান্তি চলছে?

না তো! হঠাৎ এমন উদ্ভট ধারণা?

তা হলে তুই রাজর্ষির কাছে যাচ্ছিস না কেন?

ওমা, বড়দিনেই তো যাচ্ছি। তারপর ও সময় পেলে আসবে… আবার আমি যাব… আবার…

ওরকম দু’-পাঁচ দিনের বুড়ি ছোঁয়াছুঁয়ির খেলা নয়। আমি তোর পাকাপাকি যাওয়ার কথা বলছি।

পারমিতার কেমন সন্দেহ হল। দৃষ্টি সরু করে বলল,— শাশুড়ি বুঝি তোমায় কিছু বলেছেন?

তাকে টানছিস কেন? ধর, আমিই বলছি।…তোর বাবা যদ্দিন ছিল, সেবাযত্নের জন্য তুই রইলি, সেটা তাও মানায়। কিন্তু এখন তো আর সেই পিছুটানও নেই।

মাকে যে এক এক সময়ে কী পাগলামিতে ধরে! পারমিতা ফিক করে হাসল। মজা করে বলল,— বা রে, এখন তো তুমি আছ…। মা কি আমার ফেলনা?

সুমিতা দুম করে গোমড়া হয়ে গেল। নিঃশব্দে চুমুক দিচ্ছে চায়ে। প্রৌঢ় মুখমণ্ডলে তরঙ্গ খেলছে, কপালে পুরু হচ্ছে ভাঁজ।

হঠাৎ বলল,— আমার কিন্তু একটুও ভাল লাগছে না মিতু।

কী?

তুই যা করছিস।

আমি কী করলাম?

না বোঝার ভান করিস না। সুমিতার মুখ থমথমে,— কেন তুই আমায় যন্ত্রণা দিচ্ছিস? পাঁচজনে পাঁচকথা বলছে…। তোর জেঠিমাই তো পরশু ফোনে শুনিয়ে দিল, মিতু নয় বাবা-মা অন্ত প্রাণ, কিন্তু তুমি কোন আক্কেলে ওকে আঁকড়ে ধরে আছ? তোমার মেয়ের তো নিজের ঘরসংসার আছে, এবার ওকে ওর বরের কাছে যেতে দাও।

জেঠিমা…. এ কথা বলল?

সবাই বলছে। বলবে নাই বা কেন? এই যে তোর রোজ হাঁচোরপাচোর করে এখানে আসা… এ তো আমারই জন্যে! কত বার তো তোকে বলছি, আমি বেশ আছি, আমি খাসা আছি… আমার পেছনে তোকে আর লেগে থাকতে হবে না…। শুনছিস কথা? মাঝখান থেকে তোর শ্বশুর-শাশুড়ি অসন্তুষ্ট হচ্ছে…

ও। তারাই তোমায়…

ভুল তো কিছু বলে না। তাদেরও তো খারাপ লাগে। তুই এখানে দিব্যি আছিস, ওদিকে তাদের ছেলেটার হতচ্ছাড়া দশা… দেখাশোনা করার কেউ নেই…! রাজর্ষি অত্যন্ত ভাল ছেলে, তাই মুখ বুজে আছে। তাকে পাত্তা না দিয়ে তুই তাতারের স্কুলে ভরতির ফর্ম নিয়ে এলি… এতে রাজর্ষির অপমান হল না? ছেলের পড়াশোনা, ফিউচারের ব্যাপারে বাবার কোনও মত নেই? সব কিছু অগ্রাহ্য করে তুই কিনা এখানে ম্যা ম্যা করতে আসিস?

পারমিতা হতবাক। কান ঝাঁ ঝাঁ করছে। তিতকুটে স্বরে বলল,— তোমার জন্য আমি বাঙ্গালোর যাচ্ছি না?

তাই তো দাঁড়ায়। লোকে তো তাই ভাবছে।

আশ্চর্য, আমার কি এখানে চাকরি বাকরি নেই? কলেজে পড়াচ্ছি, সেটা কিছু নয়?

এমন কোনও হাতিঘোড়া ব্যাপারও তো নয়। সংসারের প্রয়োজনে মেয়েরা চাকরি করে, আবার সংসার চাইলে চাকরি ছেড়েও দেয়। সুমিতা একটু দম নিল,— ইচ্ছে হলে সেখানে গিয়ে কিছু করবি। রাজর্ষি কখনই তোকে বাধা দেবে না।

এ যেন মা নয়, অবিকল শাশুড়ির কণ্ঠস্বর! পারমিতা ক্ষণকাল স্তব্ধ থেকে বলল,— কিন্তু তার পর?

কী তার পর?

ধরো ওখানে গিয়ে নতুন করে কিছু শুরু করলাম… রাজর্ষি আর একটা অফার পেয়ে অন্য কোথাও চলে গেল…! দিল্লি… মুম্বই… কিংবা ধরো বিদেশ…।

যাবি তুই সঙ্গে। সেটাই তো নিয়ম।

আজব তো! পারমিতা যেন মাকে নয়, নিজেকেই শোনাল,— আমার বুঝি জীবনে নিজের মতো করে কিছু হতে ইচ্ছে হয় না?

নিজের সাধআহ্লাদ মেটাতে সংসারটা ভাসিয়ে দিবি? কেমন বউ তুই? কেমন মা?

একটা নিজস্ব জগৎ খোঁজার আকাঙ্ক্ষা কি তা হলে নিছকই সাধআহ্লাদ? শুধু বউ আর মা হয়ে টিঁকে থাকাতেই মেয়েদের অস্তিত্ব? পারমিতা নিজে কিচ্ছু নয়? হায় রে!

পারমিতা ফিরছিল। শিথিল পায়ে। চাদরটা গায়ে জড়িয়েও শীত শীত করছে। হাড় অবধি কনকন কনকন। কী যে সে করে এখন?

হাঁটতে হাঁটতে, কে জানে কেন, হঠাৎ সরস্বতীকে মনে পড়ল। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েও যাকে কিনা প্রতি পদে বরের মর্জিমাফিক চলতে হয়। পারমিতা কি সরস্বতীর দলে পড়ে গেল? সম্পর্কটা তো সে ছিঁড়েও ফেলতে পারে।

সে তো সরস্বতীও পারে। আবার পারেও না।

পারমিতারাও কি পারবে? পারে? বোধহয় না। ভালবাসারও তো একটা সাজা আছে। সেটা পেতে হবে বই কী।

———

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *