০১. বড়সড় ড্রয়িং হলখানা

অর্ধেক আকাশ  -সুচিত্রা ভট্টাচার্য

.

আদরের পুপসি ও আশুতোষ-কে

.

বড়সড় ড্রয়িং হলখানা সাজাচ্ছিল পারমিতা। শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে। নাতির জন্মদিন বলে কথা, শুভেন্দু আজ উৎসাহে ভরপুর। নিজেই সকালে কিনে এনেছে রঙিন কাগজের শিকলি, প্যাকেট প্যাকেট বেলুন, গাদাখানেক লজেন্স-চকোলেট…। বিকেলের চা-টুকু খেয়েই শুরু হয়েছে কর্মযজ্ঞ। দ্যাখ না দ্যাখ সিঁড়ির তলা থেকে ঘড়াঞ্চি হাজির, তাতে চড়ে ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা স্ট্রিমার টাঙাচ্ছে শুভেন্দু। পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে। পারমিতা হ্যাপি বার্থ ডে লেখা ঝিলমিলে বোর্ডখানা লাগিয়ে এল দরজায়। এবার বেলুন ফোলানোর পালা। বেজায় ঝকমারির কাজ। ফুসফুস উজাড় করে ফুঁ দাও, হাওয়া বোঝাই বেলুন ঝটপট বাঁধো সুতোর ফাঁসে, এভাবে ফুলিয়েই চলো একের পর এক। এরপর থোকায় থোকায় ঝোলাতে হবে জায়গামতো।

পাখা বন্ধ। বাইরে জ্যৈষ্ঠের প্রখর অপরাহ্ণ। অন্দরেও তাপ নেহাত কম নয়। শুভেন্দু দরদর ঘামছিল। ঘড়াঞ্চি থেকে নেমে দাঁড়াল ক্ষণিক। পাতলা হাফ পাঞ্জাবিতে কপাল-মুখ মুছতে মুছতে বলল,— ওফ্, বহুৎ থকে গেছি।

পারমিতারও চুল-মাথা ঘামে বিজবিজ। তবু হেসে বলল,— এবার আপনি রেস্ট নিন বাবা। বাকিটুকু আমি সেরে ফেলছি।

খেপেছ? আমি না থাকলে তাতার দস্যু তোমায় শান্তিতে কাজ করতে দেবে?

সত্যি, দস্যুই বটে। আসন্ন অনুষ্ঠানের উত্তেজনায় এখন বাড়িময় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তাতার। দুপুরে চেপে ধরে ঘুম পাড়ানো হয়েছিল, জেগে উঠে সে যেন অপার শক্তির আধার। এই সাঁ করে একবার দাদু-ঠাকুমার ঘরে ঢোকে, তো পরক্ষণে বেরিয়ে কাকার বন্ধ দরজায় দুম লাথি, তার পরেই ড্রয়িংহলে চোঁ চোঁ চক্কর মারছে…। আর সুযোগ পেলেই পুটুস ফাটিয়ে দিচ্ছে বেলুন। পারমিতা কটমট তাকালেও পরোয়া নেই, উলটে চোখ বড় বড় করে ভেংচাচ্ছে মাকে।

ছেলেকে টেরিয়ে দেখে নিয়ে পারমিতা বলল,— আজ বড্ড হাইপার হয়ে আছে।

বুঝতে শিখছে যে। আগের দুটো জন্মদিনে ব্যাটা তো একদম ভেবলে ছিল।

হুঁ। প্রথমবার তো সারা সন্ধেটা কেঁদে ভাসাল।

স্বাভাবিক। অত ভিড়ভাট্টা…এ একবার গাল টেপে, ও কোলে নিয়ে চটকায়…

কথার মাঝেই রান্নাঘর থেকে মানসীর ডাক,— মিতা, একবার দেখে যাও তো…

কী মা?

বুঝছ না? নির্ঘাত এ বেলার পায়েসটা টেস্ট করাবে। হালকা চোখ টিপে শুভেন্দু গলা ওঠাল,— আমাকে দিয়ে হবে?

মোটেই না। যতই ছোঁকছোঁক করো, মিষ্টি তুমি পাচ্ছ না।

গিন্নির কড়া ঘোষণায় পলকে মিইয়ে গেছে শুভেন্দু। শ্বশুরের মুখখানা দেখে অতি কষ্টে হাসি চাপল পারমিতা। মিষ্টির জন্য শুভেন্দু যেন মরে যায়। রাতে খাওয়ার পর আগে তো একটা রসের মিষ্টি বাঁধা ছিল রোজ। বছরখানেক হল সুগার ধরা পড়েছে, তারপর থেকে বেচারার শৃঙ্খলিত দশা। ওষুধ তো চলছেই, ইদানীং মর্নিং ওয়াকেও বেরোয় নিয়মিত, দুয়ে মিলে রক্তে শর্করার মাত্রা এখন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে। গত মাসেই তো টেস্ট হল। ফাস্টিং-এ একশো পঞ্চান্ন। তবে রিপোর্ট দেখে রাশ আলগা করবে, মানসী সে ধাঁচের মহিলাই নয়।

ফোলানো বেলুনগুলো কোণে স্তূপ করে পারমিতা রান্নাঘরে এল। বড় ডেকচিতে ধীর লয়ে হাতা ঘোরাচ্ছিল মানসী, অল্প একটু পায়েস কাচের প্লেটে তুলে খুঁতখুঁতে গলায় বলল,— দ্যাখো তো, চিনি মনে হচ্ছে বেশি হয়ে গেল!

চামচেতে নিয়ে জিভে ছোঁয়াল পারমিতা। ঠোঁট চাটতে চাটতে বলল,— ঠিকই তো লাগছে। বরং একটু যেন কম কম…

তাই? তিলেক ভাবল মানসী। ঘাড় দুলিয়ে বলল,— তা হলে চিন্তা নেই। ঠান্ডা হলে মিষ্টি ভাব তো বাড়বে।

মিছিমিছি টেনশান করছেন মা। পায়েস আপনার হাতে চমৎকার হয়।

প্রশংসায় খুশি হয়েছে মানসী। ঈষৎ গর্বিত কণ্ঠে বলল,— তাও…এতটা পায়েস একসঙ্গে করা… অনেক দিন প্র্যাক্টিস নেই…। পরিমাণ কেমন দেখছ? কুলিয়ে যাবে তো?

হ্যাঁ, হ্যাঁ। পারমিতার চোখ ডেকচিতে,— হয়ে বেশি থাকবে।

শেষ পর্যন্ত মোট ক’জন হল?

ধরুন… বাড়ির লোক নিয়ে জনা পঁচিশ।

তোমার মাসতুতো বোনকে বলেছ তো? সোনালি?

ওরা তো আসবেই।

আর তোমার জেঠার ছেলে?

টুটান তো ট্যুরে। ফিরতে পারলে বউ নিয়ে ঠিক হানা দেবে।

ছেলেটা কিন্তু খুব লাইভলি। আসর জমিয়ে দেয়। ডেকচিতে আর একটু এলাচের গুঁড়ো ছড়াল মানসী। গ্যাস নিভিয়ে বলল,— খাবার এলে তোমার মা-বাবারটা কিন্তু সরিয়ে রেখো।

এমন একটা বিশেষ দিনে মা-বাবাকে তো কিছু পাঠাতে ইচ্ছে করেই পারমিতার। সকালেও তো মা ফোনে তাতারকে কত আদর জানাল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পারমিতাকে জিজ্ঞেস করছিল বিকেলের অনুষ্ঠানের কথা। মুখ ফুটে বলেনি, কিন্তু গলা শুনে বোঝা যায় নাতিকে আজ দেখার জন্য মা রীতিমতো ব্যাকুল। বেচারা গৃহবন্দি মা। পারমিতা তো আজ কলেজ ছুটি নিয়ে বসে, সকালে একবার তাতারকে ঘুরিয়ে আনতেই পারত। গড়িয়া থেকে যাদবপুর কী বা এমন দূর। তবু কেন যে গেল না?

খচখচানিটা গোপন কুঠুরিতে রেখে পারমিতা বলল,— খাবার রেখে কী হবে মা? কে যাবে পৌঁছোতে?

রাজাই দিয়ে আসবে।

সে কখন অফিস থেকে ফেরে তার ঠিক আছে? আজ তো তার আবার চেয়ারম্যান এসেছে…

তা হলে রানাকে বলো। ওর তো নাইট ডিউটি, অফিস যাওয়ার পথে নামিয়ে দিয়ে যাক।

ছোট ছেলেকে দিয়ে কাজটা করানো কী কঠিন, মানসী ভাল মতোই জানে। তবু যে কেন বলে? নিয়মরক্ষা? ভালমানুষি? রাস্তা দিয়ে টিফিন কেরিয়ার বয়ে নিয়ে যাওয়া রানার ধাতেই নেই। এই ধরনের পেটি কাজে প্রভাতীর সাব-এডিটারের মান খোওয়া যাবে না? খবরের কাগজের অফিসে ঢোকার পর থেকেই তো সে মাটির ছ’ইঞ্চি ওপর দিয়ে হাঁটে। প্রস্তাবটা পাড়ামাত্র এমন মুখ ভেটকাবে…ভাবলেই গা কিশকিশ করে পারমিতার। তার চেয়ে বরং কাল বিকেলে তো কলেজফেরতা ও বাড়ি যাবেই, তখন না হয় তাতারের নাম করে ভালমন্দ কিছু…।

জোর করে ঠোঁটে একটা হাসি টেনে পারমিতা বলল,— ওকে ব্যস্ত করার প্রয়োজন নেই মা। আমি দেখছি কী করা যায়।

দ্যাখো।… তোমাদের ডেকরেশান কদ্দুর?

প্রায় শেষ। আর তো শুধু বেলুনগুলো সেট করা…। ও হ্যাঁ, সোফাগুলোও তো দেওয়ালের দিকে সরাতে হবে। মাঝখানে তো অনেকটা ফাঁকা জায়গা দরকার।

খইব্যাগ ঝোলাবে বুঝি?

না মা। বাবা ওটাই আনতে ভুলে গেছেন।

যাহ্, খইব্যাগ ছাড়া বাচ্চাদের জন্মদিনের পার্টি জমে নাকি? বলতে বলতে আলগা হাতে রান্নাঘর গোছাচ্ছে মানসী। চিনির ডাব্বা র‍্যাকে তুলে বলল,— রাজা ছোটবেলায় খইব্যাগ বলতে যা পাগল ছিল! শুধু নিজের জন্মদিনে নয়, বন্ধুবান্ধব যার অনুষ্ঠানে যাবে, ওই খইব্যাগের দিকে সারাক্ষণ শ্যেন নজর। কখন ব্যাগ ফুটো হবে, খেলনা ঝরবে, লজেন্স পড়বে…! কুড়োনোতেও ওস্তাদ ছিল বটে। সব্বাইকে ঠেলে সরিয়ে ঠিক তুলে নিত আসল জিনিসগুলো। রানাটা ছিল বোকা, হাঁ হাঁ করত, কিন্তু কিচ্ছুটি পেত না। ওই রাজাই ভাইয়ের কান্না থামাতে নিজেরগুলো দিয়ে দিত। একবার হল কী…

পারমিতা প্রমাদ গুনল। মানসীর এই এক স্বভাব, পুত্রদের গুণকীর্তন শুরু করলে আর থামতে চায় না। বিশেষত বড় ছেলের। রাজার বাল্যলীলা বর্ণনার সময়ে মহিলার মুখচোখ যেন উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সম্ভবত স্মরণে থাকে না, রাজা পারমিতারই বর, টানা আড়াই বছর তার সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করেছে পারমিতা, বিয়েও নয় নয় করে সাড়ে চার বছর গড়াল, এবং এই সাত বছরে শ্রীমান রাজার আগাপাশতলা পারমিতার নখদর্পণে। কিংবা হয়তো মনে থাকে বলেই শোনায়। রাজার শৈশবে পারমিতার কোনও ভূমিকা নেই, এবং ছেলেকে বড় করার পূর্ণ কৃতিত্ব মানসী দেবীরই প্রাপ্য, সেটাই বুঝিয়ে দেয় গল্পের ছলে।

আজ অবশ্য অল্পেই রেহাই মিলল। রান্নাঘরের তাতে হোক, কি পায়েস রান্নার ধকলে, মানসীর কাহিনি সংক্ষিপ্ত হয়েছে। বেরিয়ে এল্ শেপের খাওয়ার জায়গাটায় পাখা চালিয়ে চেয়ার টেনে বসল। আঁচলে ঘাম মুছছে।

পারমিতাও ফিরেছে ড্রয়িং হলে। দাদু-নাতি নেই, সম্ভবত দুজনে এখন শুভেন্দুদের ঘরে। তাদের বদলে রানা সোফায় আসীন। পরনে হাঁটুঝুল শর্টস আর হাতাবিহীন খাটো টিশার্ট। ভুরু কুঁচকে দেখছে ঘরখানা।

পারমিতা হালকা সুরে বলল,— বাবুর নিদ্রাভঙ্গ হল?

ঘুমোনোর জো আছে? যা এক পিস বাড়িতে ছেড়ে রেখেছ! রানার দৃষ্টি ফের একবার পাক খেল,— কে করল এত সব? তু্মি?

উঁহু। আপনাআপনি হল। আর একটু ওয়েট করো, দেখবে বেলুনগুলোও নিজে নিজে উঠে ঝুলতে শুরু করবে।

চিমটি গায়ে লেগেছে। রানা পলকের জন্য গোমড়া। পরক্ষণে বাঁকা হেসে বলল,— মুখ ফুটে বললেই হয়।…লাগিয়ে দিচ্ছি।

তোমার কিন্তু আর একটা কাজও আছে।

কী?

সোফাগুলো ঠেলতে হবে। একেবারে দেওয়াল পর্যন্ত।

কেন?

বা রে, লোকজন ঘোরাফেরা করবে…বাচ্চারা এদিক ওদিক ছুটবে…জায়গা লাগবে না?

কেন যে তোমরা কিপটেমি করো? আজকাল তো গাদাগুচ্ছের পার্টিহল…। দুটো পয়সা খরচা করলে আর ট্রাবলটা নিতে হয় না। এই সাজানো-গোছানোও তো তারাই করে দেয়।

বাড়ির কোনও খবরই রাখে না রানা। কোন জগতে যে বাস করে! অমন একটা প্রস্তাব পারমিতা তো পেড়েছিল। রাজা ভাল করে শুনলই না, চালান করল বাবা-মা’র ঘাড়ে। তাদের দু’জনেরই ঘোরতর আপত্তি। বিশ-পঁচিশটা লোকের জন্য হলভাড়া নাকি অর্থহীন! আসবে তো দু’-চারটে তাতারের প্লে-হোমের গেঁড়িগুগলি আর গোনাগুনতি ক’জন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়…বাড়িতেই তো দিব্যি আয়োজন সম্ভব। এ হেন মতামতের পর পারমিতা আর কীভাবে এগোয়!

পারমিতা বলল,— যা হয়নি, তা ভেবে তো লাভ নেই। তুমি কি হাত লাগাবে?

সোফা সরানো? এই গরমে? রানা গা মোচড়াচ্ছে,— তোমার প্রমীলা সোলজার তো এক্ষুনি আসবে, তাকে দিয়ে করাও না।

আহা, এ কি মেয়েদের কাজ?

কাজের আবার ছেলেমেয়ে কীসের? মেয়েরা মোটেই দুবলা নয় ভাবিজান। স্পেশালি তোমাদের সরস্বতী। ঘর মুছে মুছে কীরকম মাস্‌ল বানিয়েছে দেখেছ?

বুঝেছি। পারমিতা মুখে গ্রাম্ভারি ভাব ফোটাল,— তোমার ডিউটিটুকু করেছ নিশ্চয়ই?

কোনটা?

যে একমাত্র দায়িত্বটা তুমি নিয়েছিলে। কেক?

ও শিয়োর। কাঁটায় কাঁটায় ছ’টায় ডেলিভারি। তাতারবাবুর পছন্দের মিকিমাউস।

থ্যাঙ্ক ইউ।

এবার তা হলে এক কাপ চা পেতে পারি?

দিচ্ছি।

রান্নাঘরে এল পারমিতা। শুধু চা নয়, তাতারের দুধও গরম করে ফেলল। চকোলেট আর চিনি গুলে রাখল খাবার টেবিলে। বিস্তর হাঁকাহাঁকির পর এসেছে তাতার। দুধ দেখেই পালাচ্ছিল, কোনওমতে চেপে তাকে চেয়ারে বসাল পারমিতা। লম্বাটে কাপখানা ধরিয়ে দিল হাতে। রানা শিস বাজিয়ে বেলুন টাঙাচ্ছিল, তাকে চা দিয়ে এসেছে নিজেদের ঘরে। এবার তৈরি হওয়া উচিত। কী পরবে আজ? একে গরমকাল, তায় আমন্ত্রিতরা সবই তো প্রায় ঘরোয়া লোকজন, মোটামুটি মানানসই গোছের একটা শাড়ি হলেই যথেষ্ট। সঙ্গে একটা-দুটো গয়না…

মোবাইল বাজছে। বিশেষ রিংটোন। রাজা।

বিছানা থেকে সেলফোন তুলে কানে চাপল পারমিতা,— হ্যাঁ, বলো।

পার্টির প্রস্তুতি চলছে তো জোর কদমে?

জেনে কী করবে? পারমিতার স্বরে মৃদু অভিমান,— তুমি নিশ্চয়ই কেক কাটার আগে পৌঁছোচ্ছ না?

এখনও চটে আছ? আরে বাবা, তাতারের জন্মদিনে অফিস করতে আমারও ভাল লাগে নাকি? মিস্টার কুলকার্নি না এলে কখন কেটে পড়তাম।

ছেঁদো সান্ত্বনা। আজ নয় চেয়ারম্যানের দোহাই পাড়ছে, আগের দুটো বছরে কি ছুটি নিয়েছিল? তাতারের অন্নপ্রাশনটা ভাগ্যিস পড়েছিল রবিবারে, না হলে হয়তো সেদিনও…। কবে কোন কাজে ঠিক সময়ে ফেরে রাজা? সোনালির বিয়েতে পৌঁছোল রাত দশটায়। কী এক জটিল সমস্যার নাকি গিঁট ছাড়াচ্ছিল! নিজের মামাতো ভাইয়ের বউভাতের দিনও তো বাবু নিপাত্তা। একমাত্র ম্যারেজ অ্যানিভার্সারির দিনগুলো এখনও ঝোলায় না, এটুকুই যা বাঁচোয়া। অন্তত সন্ধে সন্ধে ফেরে।

পারমিতা অবশ্য প্রসঙ্গটা নিয়ে খোঁচাখুঁচিতে গেল না। ফালতু কথা বাড়িয়ে কী লাভ? ছেলের জন্মদিনে অফিসে ব্যস্ত থাকাটা বাবাকে মানায়। এবং যত কাজই থাক, মাকেই নিতে হয় ছুটিটা।

সহজ সুরেই পারমিতা বলল,— তা এখন করছটা কী?

প্রতীক্ষা। মিস্টার কুলকার্নি ফিনান্স স্টাফদের সঙ্গে মিটিং-এ বসেছেন। শেষ হলে আবার আমাদের নিয়ে পড়বেন।

আবার মিটিং?

ইয়েস। আজ তো মিটিং-এ মিটিং-এ নাকাল। কয়েক সেকেন্ডের বিরতি, ফের রাজার গলা,— তবে একটা স্কুপ দিতে পারি। দিনটা বৃথা যায়নি। সুখবর আছে।

কীরকম?

পরে শুনো। এখনও ব্যাপারটা ফাইনাল হয়নি।

লিফট পাচ্ছ বুঝি?

কুল বেবি, কুল। নো কৌতূহল। বাড়ি গিয়ে বলব।…খাবার-দাবার সব বলে দিয়েছ তো ঠিকঠাক?

আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার।

দেবে কখন?

সাড়ে সাতটা। বাচ্চাদের ব্যাপার তো…আটটার মধ্যে ডিনার স্টার্ট করে ফেলব।

দ্যাটস গুড।…তাতার কোথায়?

নেচে বেড়াচ্ছে। ডাকব? কথা বলবে?

থাক। আমি ফেরার চেষ্টা করছি। যত তাড়াতাড়ি পারি।

ফাঁপা আশ্বাস। জানে পারমিতা। ফোন ছেড়ে শ্বাস ফেলল ছোট একটা। ঢুকেছে লাগোয়া বাথরুমে। ভাল করে ধুল গা-হাত-মুখ। বেরিয়ে সোজা ড্রেসিং টেবিলের সামনে। নিরীক্ষণ করছে নিজেকে। তার একত্রিশ বছরের ত্বক সতেজ, সপ্রাণ। কিন্তু চোখের নীচে যেন কালির আভাস? পরিশ্রমের ছাপ পড়ছে নাকি? হতে পারে। নিত্যদিন গড়িয়া থেকে ব্যারাকপুর ট্রেন বদলে যাতায়াতের ধকল কি কম? গরমের ছুটিতেও তো তেমন বিশ্রাম মিলল না, একটার পর একটা পরীক্ষার পাহারাদারি চলছে। সম্প্রতি আর একটা দায়ও চেপেছে কাঁধে। প্রিন্সিপালের কী যে হল, পারমিতাকে কিনা ঢুকিয়ে দিল অ্যাডমিশান কমিটিতে! ঠেলা বোঝো এখন! গত সপ্তাহে হায়ার সেকেন্ডারির রেজাল্ট বেরিয়েছে, কলেজে এখন ভরতির মরসুম, সুতরাং রোজ মিটিং, রোজ মিটিং। আজও ছিল, এ দিকে পারমিতা গা ঢাকা দিয়ে বসে। কলেজে এখন তার কী শ্রাদ্ধ হচ্ছে কে জানে! আরও একটা দুশ্চিন্তা তো রয়েছেই সঙ্গে। অসুস্থ বাবাকে নিয়ে। উফ্, এক এক সময়ে পারমিতার যেন দিশেহারা লাগে। তাও কপাল ভাল, ছেলের ঝক্কিটা পোহাতে হয় না, শ্বশুর-শাশুড়ি সামলে দেয় মোটামুটি। না হলে পারমিতা যে কী গভীর গাড্ডায় পড়ত।

বাইরে এখনও বিকেল। রোদ মরে গেছে, তবে তার সোনালি আভা পুরোপুরি মিলোয়নি। এ বাড়ির অন্দরে অবশ্য তা টের পাওয়ার উপায় নেই, ঘরে ঘরে দ্রুত দখল নিচ্ছে অন্ধকার। শহরের এই উপকন্ঠ এখন কংক্রিটের জঙ্গল, সর্বত্র বাড়ি বাড়ি আর বাড়ি। পারমিতার বিয়ের সময়ে তাও পুব দিকটা খোলা ছিল, বছরখানেক হল সেখানে জি প্লাস থ্রির সদম্ভ উপস্থিতি। খাড়া পাঁচিল যেন বুক চিতিয়ে আলো-বাতাসকে শাসায়।

পারমিতা টিউবলাইট জ্বেলে নিল। চটপট সাজগোজ সেরে পাকড়াও করল তাতারকে। আজ বোধহয় ছেলেকে রেডি করার ভারটা শাশুড়ির ওপর চালানো ঠিক নয়। কিন্তু তাতারকে দু’ দণ্ড সুস্থির রাখা যে কী দুঃসাধ্য! ক্ষণে ক্ষণে ছিটকে যায়, অবিরাম লাফায় তিড়িংবিড়িং। তারই মাঝে কেক এল, ওমনি তাতার দে ছুট। ফের তাকে টানতে টানতে এনে গায়ে পাউডার মাখাও, প্যান্ট-জামা ছাড়িয়ে নতুন পোশাক পরাও, চেপে ধরে চুল আঁচড়াও…। অবশেষে তাতার যখন ধোপদুরস্ত, পারমিতার প্রায় গলদঘর্ম দশা।

তারপর দু’-আড়াই ঘন্টা যে কীভাবে কাটল! একের পর এক অভিভাবক-সহ বাচ্চাদের আগমন, উপহার পেয়ে তাতারের উল্লাস, কেক কাটা, গান, হুটোপুটি, পুটপাট বেলুন ফাটছে, রাংতার কুচি উড়ছে, প্যাঁ পোঁ ভেঁপু, ক্যামেরায় ফ্ল্যাশ-শুভেন্দুর একতলা বাড়িখানা যেন পুলকে মাতোয়ারা। পেল্লাই পেল্লাই ডেকচিতে সময় মতো বিরিয়ানি-চাঁপও হাজির। আইসক্রিম-মিষ্টিও। মানসী ভাঁড়ারের জিম্মায়, সরস্বতীকে সহকারী করে আহার বিতরণে পারমিতা, তাসের আড্ডা মুলতুবি রেখে শুভেন্দুও আজ গৃহকর্তার ভূমিকায়। ফাঁক বুঝে টুপুস হাওয়া মারল রানা। শুরু হল নৈশভোজ, বড়দের হাহা হিহি। রাজাও এসে পড়ল, তবে আসর তখন ভাঙার মুখে। শেষ লগ্নে বার্থ-ডে বয়ের বাবা হয়ে সেও খানিক মাতল হল্লাগুল্লায়।

বাড়ি ফাঁকা হয়েছে। এবার আসল কাজ। চতুর্দিকে এঁটো মাখা থার্মোকোলের প্লেট-বাটি-গ্লাস, যত্রতত্র খাবারের টুকরো, সোফায় কেকের ক্রিম, মেঝে জুড়ে রাংতা, থার্মোকোলের খুদে খুদে বল, ভাঙা চকোলেট, মরা বেলুন…। সরস্বতী ন’টা নাগাদ কেটে পড়েছে, পারমিতা আর মানসীর পক্ষে গোটা বাড়ি সাফসুতরো এখন সম্ভবও নয়, তবু দু’জনে মিলে করল যথাসাধ্য। রান্নাঘরে জড়ো হল জঞ্জাল, বেঁচে যাওয়া খাবার দাবার ঢুকল ফ্রিজে, মোটামুটি ভদ্রস্থ হল ঘরদোর। এখন শুধু আলুথালু ঝুলছে স্ট্রিমারগুলো, পাখার হাওয়ায় আন্দোলিত হচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে মানসী আর পারমিতা চোখ চাওয়া-চাওয়ি করল একটুক্ষণ, তারপর হাত উলটে দিয়ে দু’জনেই যে যার ঘরে।

শ্রান্ত তাতার অকাতরে ঘুমোচ্ছে। পাশে বিছানায় রাজা। কানে মোবাইল, কোলে ল্যাপটপ। এবং এসি মেশিন চালু। গত গ্রীষ্মে কেনা হয়েছে যন্ত্রটা। পারমিতার লাগে না বড় একটা। কিন্তু দিনভর ঠান্ডাঘরে কাজ করা রাজা আজকাল একটুও গরম সইতে পারে না।

এখন অবশ্য হিম হিম ভাবটা পারমিতার বেশ লাগছিল। শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। আয়নার সামনে বসল মোড়া টেনে। হাই তুলতে তুলতে খুলছে গলার হার, কানের দুল…। ড্রয়ারে রেখে বাথরুমে গেল। নিজেকে নাইটিতে বদলে ফিরেছে শাড়ি-ব্লাউজ হাতে। ভাঁজ করছে শাড়িখানা। হঠাৎই বলে উঠল,— এবার ড্রয়িং হলেও একটা এসি দরকার। আজ যা কষ্ট হচ্ছিল গরমে…বেলুন ফোলাতে গিয়ে নাকের জলে-চোখের জলে অবস্থা। যতক্ষণ না কেক কাটা হল, লোকজনেরও…

রাজার ফোনালাপে ব্যাঘাত ঘটছে। চুপ করতে বলল ইশারায়। থেমে গেল পারমিতা। নির্ঘাত কনফারেন্স কল। বিদেশের সঙ্গে। প্রায়ই চলে এরকম। আমেরিকাতে রাজাদের অনেক কাজকারবার, কথা চালাচালি চলে তাই রাতের দিকেই। কেন যে ওখানকার লোকরা বোঝে না, এ দেশে এখন শোওয়ার সময়? সারাদিন খাটাখাটুনির পর নিশ্চিন্ত নিদ্রা না জুটলে পরদিন কলকাতা-বেঙ্গালুরু-হায়দরাবাদের রাজারা টনকো হয়ে কাজে যাবে কী করে?

ওয়ার্ড্রোবের হ্যাঙারে শাড়ি ঝুলিয়ে নিজের মোবাইলখানা টানল পারমিতা। মনিটারে দুটো মিসড করল। দুটোই শর্বরীদির। কোনও জরুরি প্রয়োজন? নাকি স্রেফ কলেজের ঘোঁট? হোক গে যা খুশি, কাল দেখা যাবে। বরং মাকে একটা ফোন করবে কি? বাবার রাতের আয়াটি পরশু ডুব মেরেছিল, আজ এসেছে তো? দুৎ, সাড়ে এগারোটা বাজে, এখন আর জেনে কী লাভ? সন্ধেবেলাই খবর নেওয়া উচিত ছিল। এমন আমোদ-আহ্লাদে মত্ত রইল, একবার মনেও পড়ল না…!

রাজার কান থেকে নেমেছে ব্ল্যাকবেরি। ল্যাপটপে আঙুল বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করল,— এসির কথা কী বলছিলে?

ড্রয়িং হলটা সামারে ফারনেস হয়ে যাচ্ছে। বাবা আজ যা ঘামছিলেন…

এসি লাগালে প্রবলেম মিটবে? ফুঃ। বাবা থোড়াই চালাতে দেবে।

আহা, কেন? বাবার কি গরমের বোধ নেই?

এটা গরম-ঠান্ডার প্রশ্ন নয়, মেন্টালিটির ব্যাপার। বাবা-মা’র ঘরে তো এসি বসানো হল, আদৌ কাজে লাগছে কি? মা কাঁইমাই করলে বড়জোর আধ ঘণ্টার জন্য চলল, ব্যস ঘর একটু ঠান্ডা হলেই অফ্। এজি বেঙ্গলের অডিটে চাকরি করেছে তো, প্রতিটি স্টেপে হিসেব করার হ্যাবিটটা হাড়েমজ্জায় ঢুকে গেছে। কিছুতেই বাবাকে বোঝাতে পারবে না, জীবনটা শুধু কষ্ট করার জন্য নয়! এখন আমরা অ্যাফোর্ড করতে পারছি, সুতরাং চুটিয়ে আরাম করে নাও!

তুমি বলো না বুঝিয়ে। বাবা তো তোমার কথাকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দেন।

খামোখা মুখ নষ্ট করায় আমি নেই। ল্যাপটপ বন্ধ করে ছোট্ট একটা আড়মোড়া ভাঙল রাজা। খাটের বাজুতে হেলান দিয়ে বলল,— আমার থিয়োরি কী জানো? যে যার ফিলজফি নিয়ে বাঁচুক।

সেটা কীরকম?

আমরা নয় আমাদের মতো থাকলাম। উইথ আওয়ার ওউন আউটলুক। বাবা-মাও থাকুক, যেভাবে তারা চায়। রানাও চলুক রানার পছন্দ মতো। কেউ কারও লাইফে ইনট্রুডও করব না, অকারণ ভেবে ভেবে চুল পাকানোরও কোনও দরকার নেই। আবার প্রয়োজনের সময়ে সবাই সবার পাশে রইলাম। যে যার সাধ্য মতো। রাজা হাসল,— বুরা বাত বোলা হ্যায় কুছ?

কী জানি! পারমিতা ঠোঁট উলটোল,— এ ধরনের তত্ত্বকথা আমার মগজে ঢোকে না।

এই জন্যই তো বলি, বেশি কেমিস্ট্রি পড়লে ব্রেন থিক হয়ে যায়। পড়ালেও। রাজা হ্যা হ্যা হাসছে,— বাঁধা ছকের ইকুয়েশান ছাড়া কিচ্ছুটি বোঝো না।

অ্যাই খবরদার, আমার সাবজেক্ট তুলে কথা নয়।

ও-কে। ও-কে। এবার কাজের কথা শোনো। রাজা গুছিয়ে বসল,— মিস্টার কুলকার্নি আজ একটা দুর্দান্ত অফার দিয়েছেন।

পারমিতার চোখ বড় বড় হল,— তখন যেটা বলতে গিয়ে চেপে গেলে?

ইয়েস। তবে তখনও ব্যাপারটার কংক্রিট শেপ ছিল না।

পারমিতা পায়ে পায়ে বিছানায় এল,— খুব বড় লিফট পাচ্ছ বুঝি?

শুধু বড় নয়, আনইম্যাজিনেবল্। ধবল কুলকার্নি আমার পারফর্ম্যান্সে দারুণ ইমপ্রেসড। কোম্পানি বাঙ্গালোরে আর একটা নতুন ডিভিশান খুলছে। পুরো নতুন নয়, বলতে পারো বাইফার্কেশান। আমাদের কম্পিউট্রনিক্সকে দুটো অংশে ভেঙে দিচ্ছেন ডি-কে। একটা ডিল করবে সিস্টেমস আর সলিউশানস নিয়ে। ওই ডিভিশানের এন্টায়ার টেকনিক্যাল সাইডটা আমাকে হেড করতে বলছেন। অফ কোর্স উইথ আ ফ্যাবুলাস জাম্প ইন স্যালারি অ্যান্ড পার্কস। তার মধ্যে কম্পিউট্রনিক্সের শেয়ারও আছে।

ওমা, তাই? আনন্দে রাজাকে জড়িয়ে ধরেছে পারমিতা। গালে নাক ঘষে দিয়ে বলল,— এ তো গ্র্যান্ড নিউজ! ইস, আমার নাচতে ইচ্ছে করছে।

বউয়ের উচ্ছ্বাস আর আদর, দুটোই খানিক উপভোগ করল রাজা। হঠাৎই চোখ পিটপিট করে বলল,— লেকিন পারো, আমাকে যে বাঙ্গালোরে মুভ করতে হবে। পার্মান্যান্টলি!

ও হ্যাঁ, তাই তো! এতক্ষণে বুঝি কথাটা খেয়াল হয়েছে পারমিতার। একটু থমকে থেকে অস্ফুটে বলল,— কবে…যাচ্ছ…?

সম্ভবত সামনের মাসেই।

এত তাড়াতাড়ি?

মিস্টার কুলকার্নি চাইছেন…। রাজার ভুরুতে পলকা ভাঁজ,— তুমি তো বোধহয় এখন যেতে পারবে না…

পারমিতা ঢোক গিলল,— না মানে… এক্ষুনি কী করে…? মাকে তো দেখছ, বাবাকে নিয়ে কেমন হাবুডুবু খাচ্ছে। এখন আমি না থাকলে…প্লাস, আমার কলেজ…

হুম্। সমস্যা। চোখ-মুখ কুঁচকে পলক কী যেন ভাবল রাজা। তারপর পারমিতার পিঠে হাত রেখেছে,— এনি ওয়ে, আপসেট হওয়ার কিছু নেই। আমি একলাই চলে যাব।

পারবে থাকতে?…অসুবিধে হবে না তো?

ম্যানেজ করে নেব। তা ছাড়া বাঙ্গালোর তো পাশের বাড়ি। ফ্লাইটে জাস্ট দু’-আড়াই ঘণ্টা। চাইলে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করা যায়। পারমিতার চুলে বিলি কাটছে রাজা। চোখ নাচিয়ে বলল,— তোমারই তো কলেজ যাতায়াতে তিন ঘণ্টা লাগে, নয় কী?

তবু…দুটো কি এক…?

ভেবে নিলেই হয়। শোনো, আজকের দুনিয়ায় ওই সব তবু টবু আর চলে না। যখন যেরকম পরিস্থিতি আসবে, ফেস করতে হবে। এটা নিশ্চয়ই বোঝো, কলকাতায় এখন আর কোনও প্রসপেক্ট নেই? এখানে থাকা মানে বদ্ধ জলায় আটকে পড়া?

হ্যাঁ, সে তো বটেই।

আর তুমি নিশ্চয়ই চাও না, এমন সুযোগটা আমি হাতছাড়া করি? হুইচ মে বিল্ড মাই হোল ফিউচার…?

আমি কি তাই বলেছি একবারও?

তা হলে মুখ ভার কেন? হাসো, মোমেন্টটা এনজয় করো। রাজা আরও কাছে টানল পারমিতাকে। নিটোল ফরসা ঘাড়ে ছোট্ট চুমু খেয়ে বলল,— নো প্রবলেম বেবি। আমি মাসে এক-দু’বার এলাম, তুমিও হুস করে উড়ে গেলে…। তারপর তো ধরো, গভর্নমেন্টের কৃপায় তোমাদের অনেক ছুটিছাটা, তখন তাতারকে নিয়ে টানা থেকে আসতে পারো। ঠিক কি না?

পারমিতা অস্পষ্টভাবে ঘাড় নাড়ল। তাও যেন চোরা অস্বস্তি হচ্ছে একটা। ধুস, ভাল্লাগে না।

.

০২.

ফিজিয়োথেরাপিস্ট এসেছিল আজ?

হ্যাঁ। দু বেলাই ম্যাসাজ করে গেছে। তবে ছেলেটা কিন্তু বড্ড পেশাদার। এসেই শুধু ঘড়ি দেখে।

কাজটুকু ঠিকমতো করে তো?

সে আমি কী করে বুঝব বল? উন্নতির তো তেমন লক্ষণ দেখি না।

সময় লাগবে মা, সময় লাগবে। ডাক্তার কী বলেছে মনে নেই? ধৈর্যই এই রোগের সবচেয়ে বড় চিকিৎসা।

বলতে বলতে সোফায় শরীর ছেড়ে দিল পারমিতা। কাঁধের ভারী ব্যাগখানা রাখল পাশে। হাতের চেটোয় কপাল মুছে বলল,— ফ্রিজ থেকে একটা বোতল দাও তো। ঠান্ডা দেখে।

সুমিতা জল এনেছে। ঢকঢক গলায় ঢালল পারমিতা। আহ্, শান্তি! ভেতরটা যেন শুকিয়ে খাক হয়ে ছিল। কলেজ ছাড়ার আগে রোজ ছোট বোতলটা ভরে নেয়, আজ একদম ভুলে গেছে। ব্যারাকপুর লোকাল ধরার জন্য যা তাড়াহুড়ো করতে হল শেষ মুহূর্তে। ট্রেনটা পেলে তাও শেয়ালদা অবধি বসে আসা যায়। নইলে সেই ঠেলেঠেলে ওঠা, বিশ্রী ভিড়, ধাক্কাধাক্কি…। এমনিই তো সাউথ সেকশানের গাড়িতে গড়িয়া-যাদবপুর এক নরকযন্ত্রণা। অতএব ওই সামান্য আরামটুকুর লোভ সামলানো মুশকিল। কিন্তু আজ কপাল মন্দ, বেরোনোর সময় ম্যাথমেটিক্সের দীপন সান্যালের মুখোমুখি, এবং সেই লোকালও মিস। বড় ভ্যাজর ভ্যাজর করে লোকটা। পারমিতারা এ বছর কীরকম ছেলেমেয়ে পাচ্ছে… কেমিস্ট্রিতে ক’টা দরখাস্ত পড়ল…হাইয়েস্ট মার্কস কত… ক’টা লিস্ট বেরোবে… কাউন্সেলিং-এ কে কে থাকছে…আজই যেন জ্ঞানপিপাসা উথলে উঠল হঠাৎ। সঙ্গে লম্বা লম্বা বুকনি। অত হুটোপুটি করে দৌড়োচ্ছেন কেন…! সারাক্ষণ সংসার সংসার করলেই চলবে, কর্মস্থানের কথাও তো ভাবতে হবে…! ওফ্, কী কষ্টে যে পারমিতা মাথা ঠান্ডা রেখেছিল!

একটুখানি বরফশীতল জল আঁজলায় নিয়ে মুখে বোলাল পারমিতা,— খুব খিদে পেয়েছে কিন্তু। খাবার-দাবার আছে কিছু?

আগে এক গ্লাস শরবত দিই?

সেই আমপান্না? এখনও ফুরোয়নি?

এনে এনে তো রাখিস। খায় কে?

কেন, তুমি তো লাইক করো!

আর আমার পছন্দ অপছন্দ! সুমিতা ফোঁস করে শ্বাস ফেলল,— বাসনা-রসনা আমার ঘুচে গেছে।

মা ইদানীং প্রায়ই বলে কথাটা। কোন হতাশা থেকে যে উচ্চারণ করে, বুঝতে অসুবিধে নেই পারমিতার। একটা সুস্থ সবল মানুষ যদি আচমকা পঙ্গু হয়ে পড়ে, তা দেখারও একটা অভিঘাত থাকে বই কী। দিব্যি তো ছিল বাবা। দশটা-পাঁচটা অফিস করছিল, কোনওদিন তেমন অসুখ বিসুখেও ভোগেনি, কিন্তু রিটায়ারমেন্টের পর কী যে হল…! আগাম কোনও উপসর্গ ছাড়াই দুম করে সেরিব্রাল অ্যাটাক। নার্সিংহোমে দিতে দেরি হয়নি বলে প্রাণ বাঁচল বটে, তবে ডান-অঙ্গ পড়ে গেল পুরোপুরি। রোগীর দেখভাল করতে মাকেও স্বেচ্ছা-অবসর নিতে হল চাকরি থেকে। গত ষোলো-সতেরো মাস ধরে মা’র জীবন তো বাবাতেই থমকে আছে। কত ঘুরতে-বেড়াতে, বাজারহাট করতে ভালবাসত মা, এখন ফ্ল্যাটের গণ্ডি ছেড়ে বেরোতেই পারে না। সুতরাং আক্ষেপ তো থাকবেই।

পারমিতার বুকটা চিনচিন করে উঠল। মাকে প্রফুল্ল করার জন্য গলায় ঈষৎ মজা এনে বলল,— রামপ্রসাদী ধুনটা এবার বন্ধ হোক।…আমি তো বাসনা ভুলিনি মা, আমায় খেতে দাও।

সুমিতা হেসে ফেলেছে। বলল,— আগে হাত-মুখ তো ধুবি। পরোটা-চচ্চড়ি বানিয়ে রেখেছি, চলবে নিশ্চয়ই?

দৌড়োবে।

বাথরুম ঘুরে এসে পারমিতা দেখল, মা রান্নাঘরে। বোধহয় পরোটা গরম করছে। পায়ে পায়ে বাবার ঘরের দরজায় গেল পারমিতা। প্রণব বিছানায় শুয়ে, যেমন থাকে দিনভর। কোনও কালেই তেমন তাগড়াই ছিল না প্রণব, কিন্তু এখন যেন খাটে মিশে গেছে শরীর। বয়স কতই বা, এখনও বাষট্টি পোরেনি, দেখে মনে হয় জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ। পরনে সাদা পাজামা, পাতলা গেঞ্জি। বাঁ হাত পেটের ওপর, ডান হাত নেতিয়ে আছে বিছানায়। একটু যেন ধারে চলে এসেছে না? পাশে বালিশ আছে বটে, তবু…। রাজা ফাউলার্স বেড কেনার কথা বলেছিল। রেলিং-এর বন্দোবস্ত থাকত, রোগীর পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা নেই, আবার মাথার দিকটা তুলে বসিয়ে রাখারও সুবিধে। কিন্তু এ ঘরে ঢোকাবে কোথায়? ডবল বেড খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল আর একখানা বইয়ের র‍্যাকেই তো ঘর জবরজং। তবু একটা হসপিটাল কট থাকলে দুশ্চিন্তা কমত একটু।

খাটের পাশে বেঁটে টুলে মধ্যবয়সি আয়া। চোখ কোণের তেপায়া টেবিলে বসানো আদ্যিকালের ছোট টিভিটায়। রঙিন পোর্টেবল টিভিখানা দীর্ঘ দিন বাতিল হয়ে পড়ে ছিল, এখন আয়াদের মনোরঞ্জনের কাজে লাগছে। বিনোদনের ওইটুকু উপকরণ এ ঘরে না রাখলেও মুশকিল, লিভিং হলে সুমিতা টিভি খুললেই রোগী ফেলে চলে আসে যখন তখন।

পারমিতা গলা খাঁকারি দিল,— কী গো বিমলা, একটু পেশেন্টকেও দ্যাখো।

চমকে বাংলা সিরিয়াল থেকে দৃষ্টি ফেরাল বিমলা। সামান্য অপ্রস্তুত মুখে বলল,— কেন দিদি, উনি তো আজ ঠিকই আছেন। এই খানিক আগে ইউরিনাল দিলাম।

কতটা ধারে সরে এসেছে, দেখেছ?

হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমার নজর আছে। বিমলা ঝিরিঝিরি ছবিওয়ালা টিভি বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। হাসি হাসি মুখে বলল,— আজ চা খাওয়ানোর পর উনি অনেকক্ষণ বসেছিলেন। সেই থেরাপিশের আসা পর্যন্ত।

গায়ে পাউডার টাউডার লাগাচ্ছ তো ভাল করে?

আজকাল বাবু আমার হাতে মাখতে চান না। মাকে ডাকেন।

এ তথ্যটা নতুন। শুনে ঈষৎ রোমাঞ্চিত হল পারমিতা। যত সামান্যই হোক, এও তো উন্নতি। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের পর প্রথম ক’দিন অচেতন ছিল বাবা, কিন্তু তার পর থেকে সারাক্ষণই জ্ঞান আছে। তবে এই ইচ্ছে-অনিচ্ছের ব্যাপারটা ছিল না। কেমন অসহায়ের মতো অন্যের হাতে পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছিল নিজেকে। সেদিক দিয়ে ভাবলে এটা অন্তত এক পা এগোনো। আরোগ্যের পথে।

প্রণব মেয়ের আগমন টের পেয়েছে। চঞ্চল দৃষ্টি ঘুরছে পারমিতায়।

বিছানার ধারে এল পারমিতা। ঝুঁকে বলল,— তোমাকে আজ বেশ ফ্রেশ দেখাচ্ছে বাবা।

ঠোঁট সামান্য নড়ল কি? বোঝা গেল না। তবে চোখের পাতা কাঁপছে তিরতির।

পারমিতা বাবার কপালে হাত রাখল,— দুপুরে কী খেয়েছ? মাছ, না চিকেন?

অস্ফুট এক ধ্বনি বাজল শুধু। গোঙানির মতো। ওই আওয়াজে পারমিতার বুকটা ভারী হয়ে আসে। কী চমৎকার গল্প বলত বাবা, কথনের জাদুতে বিস্তার করত সম্মোহন। পারমিতা বড় হওয়ার পরও যখন বাবা বই পড়ে পড়ে শোনাত, আনমনা হওয়ার জো ছিল না। এ কি সেই একই মানুষ? সামান্য একটা শব্দও সঠিক বেরোয় না কণ্ঠ দিয়ে! কেন যে বাবারই এমনটা হল? চাকরি থেকে সকলেরই তো রিটায়ারমেন্ট হয়, এটাই জগতের নিয়ম, অথচ বাবা যেন মন থেকে মানতেই পারল না ঘটনাটা। মুখে খুব বলত, এই লাইব্রেরির মেম্বার হব, ওই বই কিনব, সারাদিন পড়াশোনা করব প্রাণের সুখে, ট্যুরিং পার্টির সঙ্গে ইচ্ছে মতন বেরিয়ে পড়ব…। কিন্তু কিছুই পারল না। বউ খেয়েদেয়ে অফিস বেরিয়ে যাচ্ছে, নিজে একা একা বাড়িতে সারাদিন কর্মহীন, এই মানসিক চাপই কি বাবাকে…?

জানার তো আর উপায় নেই। বাবা কি আর বলতে পারবে কোনও দিন?

পারমিতার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। এ কী আজেবাজে চিন্তা? বাবা সুস্থ হবে না কেন? একটু আগে নিজেই না মাকে বলছিল…!

প্রণবের বাঁ হাতখানা ছুঁয়েছে পারমিতাকে। ছুঁয়েই আছে। পারমিতা জিজ্ঞেস করল,— কিছু বলবে?

কিছু বুঝি জানতে চাইছে প্রণব। মুখ বেঁকে গেছে ডানদিকে। গলায় ফের গঁ গঁ ধ্বনি। চোখের কোল চিকচিক। আজকাল এরকম কেঁদে ফেলে হঠাৎ হঠাৎ। এও হয়তো শুভ লক্ষণ। আবেগ-টাবেগগুলো ফিরছে বোধহয়। ধীরে ধীরে।

পারমিতা হাসি হাসি মুখে বলল,— কী? কী হল?

সুমিতা কখন যেন ঘরে ঢুকেছিল। খানিক তফাত থেকেই বলল,— বুঝতে পারছিস না? তাতারের কথা বলছে।

এও এক আশ্চর্য ব্যাপার। মা আজকাল ঠিক পড়ে ফেলে বাবার ভাষা। চব্বিশ ঘণ্টা পাশে পাশে আছে বলেই কি পারে? নাকি এ এক অজানা রসায়ন?

পারমিতা তাড়াতাড়ি বলল,— আনব আনব, তাতারকে আনব। এই রোববার সবাই আসব। রাজাও তোমার সঙ্গে দেখা করে যাবে।

সুমিতা কাঁধ ধরে টানছে। অনুচ্চ স্বরে বলল,— অ্যাই, তোর পরোটা কিন্তু টেবিলে দিয়েছি।

যাই।

বাবার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে ঘর থেকে বেরোল পারমিতা। বসেছে ডাইনিং টেবিলে। প্লেটে দৃষ্টি পড়তেই বলল,— চচ্চড়ির সঙ্গে এটা কী?

মলিনা আজ বাজার থেকে এঁচোড় এনেছিল। হালকা হালকা করে বানিয়েছি।

ভাল। মাঝে মাঝে মুখবদল হোক। তুমি শুধুমুধু বারো মাস বাবার রান্না খাবে কেন? রোজ রোজ পেঁপে, ট্যালটেলে মাঝের ঝোল, সেদ্ধসেদ্ধ মুরগি…

নিজের জন্য আলাদা কিছু রাঁধতে ইচ্ছে করে না রে। তা ছাড়া অভ্যেসও তো বদলে গেল। এখন আর আগের মতো ঝালমশলা শরীর নিতে পারে না। তাতারের নাম করে তুই সেদিন কত ভাল দোকানের মাটন-চাঁপ আনলি, খেয়ে সারারাত কী অম্বল! বলেই বুঝি খারাপ লেগেছে সুমিতার। হেসে বলল,— তোর বাবা কিন্তু রসমালাইটা খুব ভালবেসে খেয়েছে।

কেকও তো দিয়েছিলে বাবাকে?

সামান্য। বেশি দিতে ভয় করে। যদি গ্যাস ট্যাস হয়ে যায়! মুখে তো বলতে পারবে না…

উম্। এক টুকরো এঁচোড় তুলে চিবোচ্ছিল পারমিতা। তারিফের সুরে বলল,— ফার্স্ট ক্লাস হয়েছে। হালকা একটা গরমমশলার গন্ধ…

তোর বাবারটা সরিয়ে তার পরে অল্প ঘি-গরমমশলা দিয়েছি। তাতেও তো সে বেশ তৃপ্তি করে খেল।

পলকের জন্য বাবার আহারের দৃশ্য চোখে ভেসে উঠল পারমিতার। চটকে চটকে মণ্ড মতো করে মুখে পুরে দেয় মা। পাকলে পাকলে গলাধঃকরণের সময়ে ডান চোয়ালখানা বিশ্রী রকম বেঁকে যায় বাবার। ইস, ওইটুকুও যদি আগের মতো স্বাভাবিক হয়!

বিমলা শাড়ি বদলে উঁকি দিচ্ছে দরজায়। সুমিতা ঘাড় ঘোরাল,— কিছু বলবে?

আজ একটু আগে আগে যাব ভাবছিলাম…

এখন? পারমিতা ঘড়ি দেখল,— সবে তো সাতটা দশ?

নাতিটার জ্বর দেখে এসেছি, মনটা আনচান করছে গো।

সুমিতা গলা খাদে নামিয়ে বলল,— কালকেও কিন্তু তাড়াতাড়ি গেছে। আমি আর বলে পারি না, তুই একটু বক।

পারমিতাও যথাসাধ্য গলা নামাল,— আজকাল আর বকাবকির দিন নেই মা। তোয়াজ করেই কাজ চালাতে হয়। বলেও স্বর সামান্য শক্ত করেছে,— এক-দু’দিন অসুবিধে থাকতেই পারে বিমলা। কিন্তু আমাদের দিকটাও ভাবো। মা একা পারে না বলেই তো তোমাদের রাখা। সেন্টারের সঙ্গে কথা হয়েছিল রাতের জন আসা অবধি তোমায় থাকতে হবে। যদি কোনও কারণে সে অ্যাবসেন্ট করে, তোমাকে তা হলে নাইটটাও…! তার জন্য বাড়তি পয়সাও তো দিই। কী গো, দিই না?

বিমলা ঢক করে ঘাড় নাড়ল,— আমি তো সাধ্যমতো করি দিদি। শুধু কাল আর আজ…

বেশ, যাও। বলছ যখন তোমার নাতির অসুখ…। তবে এটাও তো বোঝো, একজন কেউ না থাকলে মা খুব অসহায় বোধ করে? ধরো শ্যামা আজ ডিউটিতে এল না…যদি বাবাকে ধরে বাথরুমে নিতে হয়, খাওয়ানোর সময়ে বসাতে হয়…মা একা পারবে?

শ্যামা আসবে। আমার সঙ্গে মোবাইলে কথা হয়েছে। আটটার মধ্যে ঢুকে যাবে।

পারমিতা হেসে ফেলল,— নাহ্, তোমার মোবাইল ফোন সার্থক!…তা যাওয়ার আগে আমাদের একটু চা খাওয়াবে না?

আবদারে বিশেষ প্রীত হল না বিমলা। তবে দ্বিরুক্তি না করে গেছে রান্নাঘরে। মোটাসোটা চেহারার মহিলাটি এমনিতে খারাপ নয়, ডিউটি করছে মাস আষ্টেক, ইদানীং সংসারের কাজেও হাত লাগায় টুকটাক। বাবার মেজাজমর্জিও এখন বিমলার চেনা। শয্যাক্ষতর আশঙ্কায় অতি সাবধানে রাখতে হয় বাবাকে। জামাকাপড় চাদর— তোয়ালে নিয়মিত কাচাধোওয়া করো, বারে বারে রোগীকে পাশ ফেরাও, বসাও ওঠাও, ক্রিম-পাউডার মাখাও…। সবই করে বিমলা, তবে বড্ড বলতে হয়। ঘরের কাজেও এগোয় না নিজে থেকে, ডাকলে করে। কেমন যেন আন্তরিকতার অভাব। তাও যেটুকু করে, আজকালকার দিনে সেটুকুই বা কম কী!

তবু মা যেন বিমলার ওপর তেমন তুষ্ট নয়। শুধু বিমলা কেন, শ্যামা, ফিজিয়োথেরাপিস্ট, এমনকী এত কালের পুরনো মলিনা সম্পর্কেও মা অনুযোগ করে ইদানীং। মা কি খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে? একে ঘরে ওই রোগী, তায় নিজের হাজার রকম চিন্তা। চাকরিটা ছাড়ল, অথচ পাওনাগন্ডার বেশিটাই এখনও আটকে। সার্ভিস বুকে নাকি কী সব গন্ডগোল আছে। অন্তর্বর্তী পেনশান পায় একটা, পরিমাণ যৎসামান্য। জমানো ছুটির টাকা মেলেনি, গ্র্যাচুয়িটিও না। এদিকে খরচ তো বিশাল। স্বামী-স্ত্রীর সঞ্চয়ের অনেকটাই নিঃশেষ হয়েছিল মেয়ের বিয়েতে, তারপর এত বড় একটা অসুখের ধাক্কা…। যেটুকু যা পড়ে, তাতে আর এখন হাত ছোঁয়াতে দিচ্ছে না পারমিতা। মেয়ের ওপর এই নির্ভরশীল হয়ে পড়াটাও বুঝি খোঁচায় মাকে। পারমিতা লক্ষ করেছে, যখনই সে ব্যাগ থেকে আয়া-ফিজিয়োথেরাপিস্টের টাকা বার করে, মা’র মুখচোখ কেমন শুকনো হয়ে যায়। চিরকাল স্বনির্ভর ছিল বলেই কি পরনির্ভরতা যন্ত্রণা দেয়?

কিংবা সমস্যা অন্য জায়গায়। পারমিতা যদি মেয়ে না হয়ে ছেলে হত, মা’র একই প্রতিক্রিয়া হত কি? তার ওপর বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়ে! সংকোচের মাত্রা তো আরও বাড়ে!

পারমিতার পরোটা শেষ। গলা উঠিয়ে জিজ্ঞেস করল,— কই গো বিমলা, তোমার চা কোথায়?

দিচ্ছি। ভিজিয়েছি।

চটপট দাও। আমাকেও তো বাড়ি ফিরতে হবে।

সুমিতা রান্নাঘরে প্লেট রাখতে গিয়েছিল। এসে ফের বসেছে মেয়ের মুখোমুখি। হঠাৎই বলল,— হ্যাঁরে, রাজর্ষি তা হলে সত্যিই যাচ্ছে?

প্রশ্নের আকস্মিকতায় পারমিতা থতমত। বলল,— মানে?

বলছি…বাঙ্গালোর যাওয়া তা হলে ফাইনাল?

স্ট্রেঞ্জ! লাস্ট সাত দিনে তোমাকে অন্তত সতেরো বার বললাম, কোম্পানি খুব বড় অফার দিয়েছে, সামনের মাসে ওখানে জয়েন করবে…!

ওখানে পাকাপাকি থাকবে?

অবশ্যই। বললাম তো, ওখানে ওদের হেড অফিস। আজ না হলেও কাল ওকে যেতেই হত।

এখন তোর কী হবে তা হলে?

আহ্ মা, এমন এক একটা কথা বলো না…! আমি কি নাদান বাচ্চা? নাকি বেঘর বেসাহারা? পারমিতা কাঁধ ঝাঁকাল,— যেমন আছি, তেমন থাকব। শ্বশুর, শাশুড়ি, তাতার, তুমি, বাবা, কলেজ… আমার কি কাজ কম?

আর রাজর্ষি ওখানে একা থাকবে?

কোথায় একা মা? ঘুম থেকে উঠে অফিস, আর ফিরেই বিছানায় ধপাস। ওর তো ভালই হল। নো ট্যাকট্যাক, নো ডিস্ট্রাকশান, মহা আনন্দে শুধু অফিস করে যাও।

সুমিতার মোটেই মনঃপূত হল না কথাটা। গোমড়া হয়ে গেছে। বিমলা চা দিয়ে গেল। কাপ টানাতেও উৎসাহ নেই কোনও। চটি গলিয়ে বিমলা বেরিয়ে যাওয়ার পর গুমগুমে গলায় বলল,— তুই তা হলে এখন রাজর্ষির সঙ্গে যাচ্ছিস না?

কী করব গিয়ে? ও তো এখন কোম্পানির গেস্ট হাউসে উঠবে। সেখানে তো সারাদিন ভ্যারেন্ডা ভাজা ছাড়া আমার কোনও কাজ নেই।

তবু…মানসীদি বলছিলেন…

শাশুড়ি তোমায় ফোন করেছিল নাকি?

হ্যাঁ। দুপুরে অনেকক্ষণ আলোচনা হল। সুমিতা এবার কাপ তুলেছে। চুমুক দিয়ে বলল,— মনে হল উনি বেশ আপসেট।

স্বাভাবিক। ছেলে দূরে চলে গেলে কোন মা না ব্যথিত হয়!

লঘু স্বরেই বলল বটে পারমিতা, সঙ্গে সঙ্গে মনেও পড়ল তার মুখ থেকে প্রথম খবরটা পেয়ে পলকের জন্য হতচকিত হলেও পরক্ষণে উচ্ছ্বাসই দেখিয়েছিল মানসী। বরং শুভেন্দুরই যেন কিঞ্চিৎ ভাবান্তর ঘটেছিল। ঝুম হয়ে বসে রইল খানিকক্ষণ। তারপর অবশ্য সেও যথেষ্ট আহ্লাদিত। সগর্বে জানাল, তার বড় ছেলের মতো মেধাবী আর পরিশ্রমী আর দুটি নেই। ছেলের সেই হায়ার সেকেন্ডারির পর থেকে শুভেন্দু নাকি নিশ্চিত, রাজা একদিন চড়চড়িয়ে উঠবেই। মানসী রানার মেধার প্রসঙ্গও তুলেছিল, শুভেন্দু উড়িয়ে দিল ফুৎকারে। রানার মধ্যে নাকি একটা আলস্য আছে, রাজার আদৌ তা নেই। খানিক তর্কবিতর্কের পর মানসীও মানল, উচ্চাকাঙ্ক্ষার ব্যাপারে রানা তার দাদার চেয়ে ঢের ঢের পিছিয়ে।

তা সে যাই হোক, বেশি সফল সন্তানকে নিয়ে মা-বাবা তো মাতামাতি করেই। তাতার যখন পটাপট রাইম মুখস্থ বলে, পারমিতার কি বুক চলকে চলকে ওঠে না? কিন্তু সমাচার প্রাপ্তির সাত দিন পরে মানসী দেবী হঠাৎ কাঁদুনি গায় কেন?

পারমিতা জিজ্ঞেস করল,— উনি আর কী বললেন?

তেমন কিছু নয়। তবে উনি বোধহয় আশা করছেন, অন্তত প্রথমবার তুই রাজর্ষির সঙ্গে যাবি।

আশ্চর্য, আমাকে তো বলেননি!

আমাকেও ডাইরেক্টলি বলেননি। তবে কথার ভঙ্গিতে মনে হল।

আজগুবি এক্সপেক্টেশান। …আচ্ছা, একটু ভাবো তো, কেন আমাকে যেতে হবে? বাঙ্গালোর কি রাজার অচেনা? আমার হাত ধরে চিনবে? না হোক, বিশ বার ও হেডঅফিস গেছে। ওই গেস্ট হাউসেই নাইট-স্টে করেছে অন্তত বার সাতেক। বড় একটা চুমুকে চা শেষ করল পারমিতা। আঙুলে ঠোঁটের কোণ মুছে বলল,— তা ছাড়া তখন আমার কলেজে পরীক্ষা। প্র্যাক্টিক্যাল। মাত্র বছর পাঁচেকের তো চাকরি…যে ক’টা ছুটি জমেছিল, বাবার অসুখে সব গন্। এখন ইচ্ছেমতো কামাই করা সম্ভব?

মেডিকেল লিভ নে। তোর তো জ্বরজারিও হতে পারে।

সেটাও কি অঢেল, মা? তাতারের হাম হল, তখন আট দিন মেডিকেল নিলাম। শাশুড়ির ইউটেরাস অপারেশান…আমাকেই বাড়িতে থাকতে হল। বিপদ-আপদের জন্য কয়েকটা তো বাঁচিয়ে রাখা দরকার, নয় কি?

চাকরি করা মেয়েদের ওভাবে একটু কায়দা করে ছুটি নিতে হয় মিতু। আমরাও নিয়েছি।

আর চাকরি করা ছেলেদের বুঝি ছুটি নেওয়ার কোনও দায় নেই? পারমিতা হেসে ফেলল,— সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এখনই বাঙ্গালোর যাওয়ার জন্যে আমি মেডিকেল লিভ নেব কেন? ফুটফাট ডুব মারলে আমার কেরিয়ারে অসুবিধে নেই? প্রোমোশানে আজকাল আমাদের কত রকম ফ্যাকড়া থাকে জানো?

বুঝি না বাবা তোমাদের কী চিন্তাভাবনা! আমার তো মনে হচ্ছে তোমার যাওয়া উচিত।

শোনো মা, রাজার সঙ্গে আমার এ নিয়ে কথা হয়েছে। রাজা নিজেও চায় না আমি এখন যাই।

তা হলে তো চুকেই গেল। সুমিতার মুখে তাও অসন্তোষ,— তবে একটা কথা তোমায় বলে রাখছি মিতু। তোমার শ্বশুর-শাশুড়ি যেন কখনও না ভাবেন, আমাদের মুখ চেয়ে তুমি যাচ্ছ না…

আরে না। ওঁরা অত অবুঝ নন। কমন সেন্স যথেষ্টই আছে। পারমিতার ঠোঁটে ফের হাসি ফুটেছে,— আমি যাব। নিশ্চয়ই যাব। রাজা গিয়ে আগে ওখানে সেট্‌ল করুক। আমারও ছুটিছাটা পড়ুক একটু…

দ্যাখ, যা ভাল বুঝিস। আমি কিন্তু এখনও বলছি…

হুম্। পারমিতা ঘড়ি দেখল। তড়াক উঠে দাঁড়িয়ে বলল,— ওরে বাবা, সাতটা পঁয়ত্রিশ! আজ কাটি। তাতারের আজকাল নতুন ভ্যানতাড়া হয়েছে, রাতে আমার হাতে ছাড়া খায় না।

আয় তা হলে।

বেরোনোর আগে বাবার ঘরে একবার ঘুরে এল পারমিতা। একই ভঙ্গিতে শুয়ে আছে বাবা, কোনও নড়াচড়া নেই। দৃষ্টি ঘুরন্ত পাখায় স্থির। কিছু ভাবছে কি? হয়তো পুরনো স্মৃতি…হয়তো বর্তমান…। সেরিব্রাল পেশেন্টদের ব্রেনে কীভাবে খেলে চিন্তার তরঙ্গ?

আনমনা পায়ে ফ্ল্যাটের দরজায় এসেও পারমিতা থামল পলক। দ্রুত নিজের ঘরটায় ঢুকে আলো জ্বালিয়েছে। খাট, আলমারি, বইপত্র, সবই স্বস্থানে বিরাজমান। আগের মতোই। সুমিতা সেভাবেই রেখেছে। তাতারকে নিয়ে পারমিতা এসে থাকে মাঝে মাঝে। অবরেসবরে রাজাও। এখানে রাত্রিবাসে রাজার একটাই অসুবিধে, নীচে গাড়ি রাখার সমস্যা হয়।

সুমিতা এসেছে পিছন পিছন। ব্যস্ত মুখে বলল,— কী খুঁজছিস রে?

বইয়ের তাকে চোখ চালাচ্ছিল পারমিতা। বলল,— পালিতের একটা ফিজিকাল কেমিস্ট্রি ছিল…

সে তুই জানিস। কোনটা নিয়ে গেছিস, কী আছে…

পাচ্ছি না তো ও বাড়িতে। পারমিতা মাথা দোলাল,— এখানেও তো দেখছি না। কাউকে দিয়েছিলাম বোধহয়। মনে করতে হবে।… পারলে তুমি একবার খুঁজো তো।

দেখব।

আসি তা হলে? কাল দেখা হচ্ছে।

রোজ রোজ তোর কষ্ট করে আসার কী দরকার মিতু?

আমি আমার বাবাকে দেখতে আসি মা। আমার কষ্ট আমায় বুঝতে দাও।

বলে আর সময় নষ্ট করল না পারমিতা। রাস্তায় নেমে একটা রিকশা ধরেছে। যাদবপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে বাড়িটা অনেকটা দূর, রিকশাতেই ছ’-সাত মিনিট লাগে। ইউনিভার্সিটির গেটের সামনে এসে দাঁড়াল অটোর জন্য। হঠাৎই মস্তিষ্কে ঝিলিক। মাকে একা রেখে এল। যদি শ্যামা না আসে…? বিমলা তো তাড়াতাড়ি পালানোর জন্য গুলও মারতে পারে! নাহ্, ভুল হয়ে গেছে। শ্যামা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত ছিল। কিন্তু ওদিকে তাতার যে…!

দুৎ, কেন টেনশান করছে? এসে পড়বে শ্যামা। নয়তো মা ম্যানেজ করে নেবে একটা রাত্তির। করতেও তো হয় মাঝেমধ্যে। হয় না?

অটো এসেছে। একজন যাত্রী নামতেই ঝটাক উঠে পড়ল পারমিতা। ড্রাইভারের পাশে সিট, বসেছে কোনওমতে। বাড়ি ফিরে তাতারকে খাইয়েই বসতে হবে পরীক্ষার খাতাগুলো নিয়ে। জমা দেওয়ার দিন এসে গেল প্রায়, এবার হেড-এগজামিনারের ফোন শুরু হবে। সত্যিই কি তার রাজার সঙ্গে বেঙ্গালুরু যাওয়া উচিত? মুখে না বলছে বটে রাজা, কিন্তু মনে মনে কি চাইছে না? এক-আধ দিনের ট্যুর তো নয়, এবার বেঙ্গালুরু গমন একেবারেই আলাদা, সিঁড়ির দু’-তিন ধাপ উঁচুতে রাজা পা ফেলছে…পাশে এখন পারমিতা না থাকলে কি দৃষ্টিকটু দেখাবে? শাশুড়িও ক্ষুণ্ণ হবেন হয়তো! কিন্তু কলেজে অ্যাডমিশান চলছে, তারও তো খানিকটা দায়িত্ব আছে পারমিতার কাঁধে। সেটা ফেলে কেটে পড়া কি সংগত? শ্যামা এল কি?

একটা ভাবনার ওপর আর একটা চেপে জট পাকিয়ে যাচ্ছে। চিন্তাগুলো পৃথক করতে পারছিল না পারমিতা।

.

০৩.

আষাঢ় প্রায় ফুরিয়ে এল। প্রকৃতি এ বছর এক আজব খেলায় মেতেছে যেন। মাসের প্রথম দিকটায় বেজায় গরম ছিল। সূর্য দাপাচ্ছিল খুব। তার পরই হঠাৎই আকাশ ঢেকে গেল মেঘে। আবহাওয়া দপ্তর গলার শির ফুলিয়ে ঘোষণা করল, দেরিতে হলেও মৌসুমি বায়ু ঢুকেছে পশ্চিমবঙ্গে। তাদের মান রাখতেই বুঝি ক’দিন বৃষ্টি হল জোর। ব্যস, তার পরেই মেঘেরা উধাও। আকাশ ঝকঝকে নীল, যেন বর্ষা পেরিয়ে শরৎ হাজির। তিন-চার দিন হল আবার দর্শন মিলছে মেঘের। চেহারায় ওজনদার, কিন্তু বারিধারার নামটি নেই। ফলে যা হয়, গরম বেড়ে দ্বিগুণ। সঙ্গে একটা বিচ্ছিরি প্যাচপেচে ভাব। সারাদিন ঘামে থসথস করছে মানুষ, প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত হওয়ার জোগাড়।

পারমিতার কলেজের পরিবেশও বেশ তপ্ত এখন। ছাত্রভরতি নিয়ে একটা না একটা ঝামেলা লেগেই আছে। রোজ বিক্ষোভ, রোজ স্লোগান…এক এক সময়ে যেন কান ঝালাপালা।

আজও কলেজে পা রেখে পারমিতা টের পেল, হাওয়া যথেষ্ট থমথমে। ইউনিয়নের ছেলেমেয়েদের করিডরে উত্তেজিত ঘোরাফেরা, একে ওকে হাঁক পেড়ে ডাক, রাগ রাগ চাউনি, নির্ভুলভাবে বলে দেয়, ঝড় উঠল বলে।

অন্য দিনের মতো সরাসরি নিজেদের বিভাগে না গিয়ে পারমিতা আগে স্টাফরুমে এল। তেমন কেউ নেই ঘরে। শুধু বাংলার অপরাজিতা চক্রবর্তী চোখ বোলাচ্ছে খবরের কাগজে, আর তিনজন অতিথি অধ্যাপক নিজেদের মধ্যে কথায় মগ্ন। হাজিরা খাতা টেনে নিয়ে অপরাজিতার পাশের চেয়ারে বসল পারমিতা। সই করতে করতে জিজ্ঞেস করল,— আজ কী নিয়ে টেনশান গো অপাদি?

বছর পঁয়তাল্লিশের অপরাজিতা কাগজ থেকে মুখ না তুলেই বলল,— তোর তো জানা উচিত। তোদের ডিপার্টমেন্টেরই তো কেস।

মানে?

তোরা নাকি কাউন্সেলিং-এর নিয়ম না মেনে কোন একটা মেয়েকে অনার্সে অ্যাডমিশান করিয়েছিস! অথচ লেজিটিমেট কারণ থাকা সত্ত্বেও একজন ক্যান্ডিডেট নাকি বাতিল হয়েছে!

যাহ্, বাজে কথা। এমন কিছু ঘটেইনি।

তুই বললেই হবে? ইউনিয়ন তো এদিকে মাসল ফোলাচ্ছে। যে মেয়েটা ভরতি হয়েছে, সে বোধহয় অপোজিট ক্যাম্পের কারও ঘনিষ্ঠ। তোরা নাকি পার্শিয়ালিটি করে…

এই এক নতুন উত্পাত শুরু হয়েছে এ বছর। কলেজটা তৈরি হয়েছে বছর কুড়ি। গোড়া থেকেই ছাত্র-ইউনিয়নে নির্বাচন বস্তুটির বালাই ছিল না, এক পক্ষই দাপটে চালাত সংসদ। গত বছর থেকে পরিস্থিতির বদল ঘটেছে। বিরোধী পক্ষও এখন রীতিমতো জোরদার, তাদের ছাত্র সংগঠন হইহই করে ঢুকে পড়েছে মঞ্চে। এবার ভোটেও তারা অংশ নিল। নমিনেশান পেপার জমা দেওয়ার সময়ে গন্ডগোলও হয়েছিল এক প্রস্ত। নির্বাচনের দিন তো পুলিশ ডাকতে হল। শেষমেশ বিরোধীরা অবশ্য জয় হাতাতে পারেনি, তবে এবারের ছাত্রসংসদে তাদের প্রতিনিধির সংখ্যা নেহাত কম নয়। দু’পক্ষের প্রায় তুল্যমূল্য অবস্থান। সুতরাং এত কাল যাদের মৌরসিপাট্টা ছিল, তারা একতরফা ছড়ি ঘোরাতে পারছে না। এর কোনও ফাঁক পেলে ও রে রে করে ঝাঁপায়। এক পক্ষ চেঁচালে অন্য পক্ষ চিলচিৎকার জোড়ে। বাইরে থেকে ইন্ধন জোগানোরও কামাই নেই। রাজনৈতিক দলগুলো মেঘনাদ হয়ে চালনা করছে ছেলেমেয়েদের। পরিণাম, কলেজে নিরবচ্ছিন্ন শান্তির কাল খতম!

কিন্তু পারমিতারা কী পক্ষপাত দেখাল?

শেষ কাউন্সেলিং-এর দিনটাকে ভাবার চেষ্টা করল পারমিতা। দুপুর দুটো অবধি তো চলেছিল, যেমনটা চলার কথা। তাদের কেমিস্ট্রি অনার্সে মোট পঁচিশটা সিট, তিনটে মাত্র ফাঁকা ছিল, সেদিনই পূর্ণ হল পুরোপুরি। যারা চান্স পেল না তাদের অনেকে ঝুলোঝুলি করছিল বটে, দু’-চারজনের অভিভাবকও এসে ধরল…। কিন্তু তাদের তো বুঝিয়ে-শুনিয়ে ফেরত পাঠানো গিয়েছিল। কী করবে পারমিতারা, তাদের হাত-পা যে বাঁধা। বাড়তি ছেলেমেয়ে নিলে ইউনিভার্সিটি যদি তাদের রেজিস্ট্রেশান না দেয়, তখন তো আর এক বিপত্তি।

পারমিতা কষ্টে মুখে বলল,— অকারণ গন্ডগোল পাকিয়ে কী লাভ বলো তো?

গন্ডগোলের আবার কারণ অকারণ! অপরাজিতা কাগজ মুড়ে পাশে রাখল,— যারা ঝঞ্ঝাট চায়, তারা কারণটাও খুঁজে নেয়।

আমাদের ক্ষেত্রে কিন্তু কিস্যুটি পাবে না। যারা যারা অ্যাপিয়ার করেছে, প্রত্যেকের নাম, মার্কস, টাইম নোট করে, যারা আসেনি তাদের লিস্ট বানিয়ে, টোটাল রিপোর্ট প্রিন্সিপাল স্যারকে জমা করে দিয়েছি। ইউনিয়ন হল্লা করলে সোজা সব দেখিয়ে দেব।

তাদের দেখতে ভারী বয়ে গেছে। তাদের তো উদ্দেশ্য, স্টুডেন্টদের সামনে নিজেদের প্রতিপত্তি জাহির করা। যাতে নতুন ছেলেমেয়েরা ভাবে ওরাই তাদের বিপদ-আপদের ত্রাতা। চান্স পেলেই অপোনেন্টদের সম্পর্কে খানিক কুৎসা গেয়ে দেবে।

তার মানে বলছ, যার ভরতি নিয়ে ঘোঁট, সে অন্য ক্যাম্পের ঘনিষ্ঠ নাও হতে পারে?

ছাড় তো। কে কার বন্ধু, কে কার আত্মীয়…অত যাচাই করে দেখা যায় নাকি? ওরা তো জাস্ট ছুতো খুঁজছে। অপরাজিতা মুখ বেঁকাল,— ছেলেগুলোর মগজেরও বলিহারি। বোঝেও না, ওরা শুধুমাত্র রাজনীতির বোড়ে। শুধু পলিটিক্যাল ধান্দায় ওদের নাচানো হয়।

ভাল লাগে না, পারমিতার একটুও এসব ভাল লাগে না। সাধে কি অ্যাডমিশান কমিটিতে ভিড়তে চায়নি! তার কি এমনিতেই টেনশান কম, যে যেচে আর একটা উটকো অশান্তি মাথায় নেবে? অন্য যারা কমিটিতে আছে, তারা যথেষ্ট উপযুক্ত। প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে তাদের ভালই যোগাযোগ। এই ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলা করায় তারা অনেক বেশি দড়। পারমিতা তো সাতেও নেই, পাঁচেও নেই। তার মতো একটা আন্‌খা পাবলিককে এমন এক স্পর্শকাতর কমিটিতে ঢুকিয়ে কী যে মোক্ষলাভ হল প্রিন্সিপালের? সরে আসাও তো আর এক বিড়ম্বনা। ওমনি আওয়াজ উঠবে, দেখেছ তো মেয়েরা দায়িত্ব নিতে কেমন ভয় পায়!

যাক গে, এখন আর ঢোক গেলা অর্থহীন। যেমন যেমন পরিস্থিতি আসবে, তেমন তেমন ফেস করতে হবে। কে যেন সেদিন বলল কথাটা? রাজা…? হ্যাঁ, রাজাই তো।

সত্যি, রাজার বাস্তববুদ্ধির তারিফ করতে হয়। দুই মায়ের যতই ইচ্ছে জাগুক, এক্ষুনি এক্ষুনি পারমিতার বেঙ্গালুরু যাওয়াটা রাজাই তো কাঁচিয়ে দিল। তার সাফ কথা-আগে ফ্ল্যাট নিই, তখন ওরা আসবে। উফ, কত অস্বস্তির যে অবসান!

চেয়ার ছেড়ে উঠল পারমিতা। লম্বা করিডর ধরে চলেছে সায়েন্স বিল্ডিং অভিমুখে। একটু যেন উদাস। বেঙ্গালুরু উড়ে গেছে রাজা। এয়ারপোর্টে তাকে বিদায় জানিয়ে ফেরার পথে পারমিতার কী মনখারাপ! যদিও অনুভূতিটা একান্তই হাস্যকর। এবারই যে প্রথম তাকে ফেলে রাজা কোথাও গেল, এমন তো নয়। তাতার হওয়ার আগে আগে প্রায় দেড় মাস ছিল নিউজার্সিতে। গত বছর সিঙ্গাপুরে তিন সপ্তাহ। কই, তখন তো অমনটা হয়নি? রাজা যে সত্যি সত্যি কলকাতার পাট চোকাল, এই বোধটাই কি বিষণ্ণ করে দিচ্ছিল পারমিতাকে? তাই হবে। একই যাত্রা সময়বিশেষে ভিন্ন মাত্রা পায় বই কী। দু’বছর আগে কলেজ ফেরতা মাঝেসাঝে যাদবপুর যাওয়া, আর এখন প্রায় রোজ হাঁচোড়পাঁচোড় করে সেখানে ছোটা কি অবিকল এক? প্রতিদিনই একটা উদ্বেগ বুকে নিয়ে…

ভাবনায় ছেদ পড়ল। ডিপার্টমেন্টে জনা দশ-বারো ছেলেমেয়ে জোর ক্যালোর ব্যালোর জুড়েছে। ফার্স্ট ইয়ারের ব্যাচটা না? যাদের সবে থিয়োরি পেপার শেষ হল? হঠাৎ দল বেঁধে হানা দিয়েছে যে বড়?

রসায়ন বিভাগে ডিপার্টমেন্ট বলে আলাদা ঘরটর নেই। ল্যাবরেটারির একাংশকে সামান্য সাজিয়ে গুছিয়ে, আলমারি টালমারি বসিয়ে ওই গোছের একটা চেহারা দেওয়া হয়েছে মাত্র। রয়েছে প্রকাণ্ড টেবিল আর খানচারেক হাতলওয়ালা চেয়ার। মাঝের কুর্শিটিতে বিভাগীয় প্রধান অনিমেষ দত্ত হাত ছড়িয়ে বসে এবং তাকে ঘিরেই জটলা। ছাত্রছাত্রীরা সমস্বরে কী যেন বলেই চলেছে, আর চোখ বুজে দু’দিকে ঘাড় দোলাচ্ছে অনিমেষ। দুলিয়েই চলেছে।

একটুক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা অবলোকন করল পারমিতা। তারপর হেসে ফেলেছে। ছেলেমেয়েদের বলল,— অ্যাই, কী হচ্ছে? স্যারকে জ্বালাচ্ছ কেন?

পারমিতার গলা পেয়ে অনিমেষ চোখ খুলেছে। আহ্লাদিত স্বরে বলল,— এই তো, তোমাদের ম্যাডাম এসে গেছে…। দ্যাখো তো পারমিতা, এদের কী গতি করা যায়?

হয়েছেটা কী, আগে শুনি।

কর্ণগহ্বরে কড়ে আঙুল চালাতে চালাতে অনিমেষ বলল,— উনত্রিশ তারিখ থেকে ওদের প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা…

জানি তো। বারাসতে সিট পড়েছে।

তার আগে ওরা দু’-তিন দিন প্র্যাক্টিস করতে চায়।

বেশ তো, আপনি ডেট ফিক্স করে দিন।

খেপেছ? আমি আর এসবে নেই। কানের ফুটো থেকে আঙুল বার করে নিরীক্ষণ করছে অনিমেষ। ঠোঁট টিপে বলল,— আমার তো চাকরির মেয়াদ খতম। বাকি ক’টা দিন আমি আর কোনও ঠিক করাকরিতে নেই।

তা বললে হয় স্যার? আপনি আমাদের হেড!

সাকুল্যে তো আমরা দু’জন। তুমি আর আমি। তার আবার হেড-টেল! অনিমেষ খোঁচা খোঁচা দাড়ি চুলকোল,— যাও, তোমাকে আজ থেকে হেড করে দিলাম। এখন থেকে তুমিই সব দেখবে। তুমিই হুকুম করবে, আমি সেইমতো চলব।

অবসর গ্রহণের প্রাক্কালে অদ্ভুত এক বৈরাগ্য জেগেছে অনিমেষের। কলেজের কোনও কাজেই আর থাকতে চায় না। অথচ রসায়ন বিভাগের তিনখানা পরীক্ষাগারই তার নিজের হাতে গড়া। অনার্সও চালু হয়েছিল তারই উদ্যোগে। প্রিন্সিপালের পিছনে লেগে থেকে থেকে আরও দুখানা পোস্টের অনুমোদন আনিয়েছিল এই অনিমেষই। লেকচারার অবশ্য এসেছে শুধু একজন। পারমিতা। বাকি কাজ অতিথি অধ্যাপক দিয়ে চলে। ছ’-সাত বছর ধরে কেন শিক্ষা দপ্তর তৃতীয় পদটিতে কাউকে পাঠাল না, তা নিয়ে খুব গজগজ করত অনিমেষ। এখন যেন সেটা নিয়েও কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। বরং রাজ্যপাট পারমিতাকে সঁপে অবসরে যাবে, এই ঘোষণাতেই তার বেশি আনন্দ।

পারমিতা হেসে বলল,— ঠিক আছে স্যার, আপনি রিল্যাক্স করুন। আমি এদের দেখছি।

আগামী সপ্তাহের মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, তিনটে দিন বরাদ্দ করে ছেলেমেয়েগুলোকে ভাগাল পারমিতা। গুছিয়ে বসেছে চেয়ারে। বছরের এই সময়টায় ক্লাস টাস বিশেষ নেই। ফাইনাল ইয়ার চলে গেছে। যারা থার্ড ইয়ারে উঠবে, তাদের ক্লাস শুরু হতে আরও দিন দশেক। আর এই ছেলেমেয়েগুলোর তো পরীক্ষাই শেষ হল না। নতুন মুখ তো সবে ঢুকছে। সেশান শুরুর এই সময়েই নোট ফোট বানিয়ে ফেলতে হয়।

বাইরে স্লোগান বাজছে। মুহুর্মুহু ধ্বনিতে কলেজ চত্বর মুখর সহসা। কী যে বলছে বোঝা দায়, শুধু ‘মানছি না, মানব না’টাই শোনা যায় স্পষ্ট।

ক্ষণপূর্বের অস্বচ্ছন্দ ভাবটা ফিরে আসছিল পারমিতার। নার্ভাস গলায় অনিমেষকে বলল,— ওই আবার স্টার্ট হল স্যার। আজ আমাদের ডিপার্টমেন্টই ওদের টার্গেট।

অনিমেষের হেলদোল নেই। হাই তুলে বলল,— ওই অ্যাডমিশানের কেসটা তো? প্রিন্সিপালকে বুঝে নিতে দাও।

কিন্তু প্রিন্সিপাল স্যার তো আমাদেরই ডাকবেন। খেয়াল আছে তো স্যার, আপনিও কিন্তু কাউন্সেলিং-এর দিন ছিলেন?

তো? গর্দান যাবে?

তা নয়। অহেতুক একটা অপ্রীতিকর সিচুয়েশান…

ছাড়ো তো। ঘেঁচু হবে। খানিকক্ষণ গলা ফাটাবে, প্রিন্সিপালকে পাবে না, তারপর যে যার ধান্দায় কেটে পড়বে।

ও। প্রিন্সিপাল স্যার আজ আসেননি?

কলেজে ক’টা ঝঞ্ঝাটের দিন উনি থাকেন? ব্যাটা মহা শাহেনশাহ। আগাম টের পায় আর টুক করে ডুব মারে। অসুবিধে তো নেই, কলকাতায় কোনও কাজ দেখিয়ে দিলেই হল। ব্যাটার দু’তরফা লাভ। এদিকে কলেজ বাঙ্ক, ওদিকে ট্রাভেলিং অ্যালাউন্সও তুলল।

এমন একটা রটনা কলেজে আছে বটে। অধ্যক্ষ স্বপন বিশ্বাস অত্যন্ত ধড়িবাজ। দুই ছাত্রসংগঠনেই নাকি স্বপনের গুপ্তচর মজুত, তাদের মাধ্যমেই গোপন খবরটবর মেলে, আগাম সতর্কবার্তাও। এই ধরনের প্যাঁচোয়া লোকের অধীনে চাকরি করা যে কী বিপজ্জনক! কাকে কখন কীভাবে ফাঁসায় তার ঠিক আছে? পারমিতাকে নরম-সরম ভেবেই কি অ্যাডমিশান কমিটিতে ঢোকাল? কে জানে!

স্লোগান চড়া হচ্ছে ক্রমশ। একটা খুদে মিছিল পাক খাচ্ছে কলেজময়। কেমিস্ট্রি বিভাগের সামনে এসে দু’-চার মিনিট জোর তড়পাল, তারপর ধীরে ধীরে ঝিমিয়েও গেল হল্লাগুল্লা।

ক্যান্টিনের ঝন্টু চা দিয়ে গেছে। ভাঁড়ে সুড়ুৎ টান দিয়ে অনিমেষ বলল,— ব্যস, খেল খতম, পয়সা হজম! এবার তুমি নিশ্চিন্ত মনে নিজের কাজ করো। …একটা কথা মাথায় রেখো, তুমি যদি জেনেবুঝে অন্যায় না করো, দুনিয়ার কাউকে ভয় পাবে না। বিবেকটা শুধু সাফ থাকলেই হল।

পিতৃতুল্য মানুষটার এ হেন কথাবার্তা সাহস জোগায় পারমিতাকে। মেরুদণ্ডের জোর আছে অনিমেষের, একেবারে কর্তাভজা টাইপ নয়, পারমিতা তাকে বেশ শ্রদ্ধাই করে। কলেজে যখন প্রথম পূর্ণ সময়ের শিক্ষক হিসেবে পারমিতা ঢুকল, ক্লাস নিতে গিয়ে কী যে নার্ভাস থাকত! অনিমেষই ধমকে-ধামকে জড়তা কাটিয়ে দিয়েছিল পারমিতার। বিয়ের পর পরই তাতার এল পেটে, চাকরিতে পারমিতা তখনও প্রায় নতুন, মেটারনিটি লিভে যেতে বড় সংকোচ হচ্ছিল…। টুপটাপ টিপ্পনীও তো তখন গিলতে হয়েছে পারমিতাকে। মেয়েদের নিয়ে এই এক ফ্যাকড়া, কাজ ফেলে বাচ্চা বিয়োতে ছুটল…! পুরুষ অধ্যাপকদের মধ্যে এই অনিমেষই তখন প্রায় বাবার মতো আগলেছিল পারমিতাকে। গেস্ট লেকচারার দিয়ে চালিয়ে নিয়েছিল দিব্যি। জয়েন করার পরেও পুরো একটা সেশান পারমিতার ক্লাসের বোঝা কমিয়ে দিয়েছিল অনেকটা। মানুষটা মাথার ওপর থাকবে না, ভাবলেই কেমন অসহায় অসহায় লাগে।

চা শেষ। পারমিতা আলমারি থেকে ফাইল বার করে আনল। অনিমেষকে জিজ্ঞেস করল,— থার্ড ইয়ারের ইউনিট টেস্টের মার্কসগুলো তা হলে রেডি করে ফেলি স্যার? ইউনিভার্সিটিতে পাঠাতে হবে তো।

আবার আমায় জড়াচ্ছ? অনিমেষ আড়মোড়া ভাঙছে,— বললাম না, আজ থেকে ডিপার্টমেন্ট তোমার?

ওরকম করছেন কেন? আমি তো অকূল পাথারে পড়ে যাচ্ছি।

তাই তো বলছি, সাঁতার টানা স্টার্ট করো। ধরেই নাও, টিচার ফিচার আর পাবে না। আমার জায়গাতেও আসবে না কেউ। এভাবেই ঠেলে, গড়িয়ে, টেম্পোরারিদের তেল দিয়ে চালাও ধুঁকতে ধুঁকতে। অনিমেষ ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাল,— বাই দা বাই, তোমার সেই প্ল্যানটার কী হল?

কোনটা স্যার?

রিসার্চ!

আর কি হয়ে উঠবে? এখন থেকে একাই তো এই ডিপার্টমেন্ট…

তো? নিজের কেরিয়ার কেন বিসর্জন দেবে? ইউ-জি-সির এখন হাজার গন্ডা স্কিম, কত ইনস্টিটিউটও তো ফেলোশিপ দিচ্ছে…দেখেবুঝে দরখাস্ত ঠুকতে থাকো। যদি জুতসই কিছু পাও, তবে তো নো সমস্যা। তোমার স্টাডি লিভের সময় ইউ-জি-সির পয়সাতেই লোক আসবে, নইলে বড়জোর তুমি উইদাউট পে হবে। কিন্তু পিএইচ-ডি ইজ মাস্ট। তোমার বয়স কম, সময়টাকে বয়ে যেতে দিয়ো না।

শুনতে তো ভালই লাগে পারমিতার। প্রচুর উন্নতি যে হবে, তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। এই তো, ফিজিক্সের কণাদ গত ডিসেম্বরে কাল্টিভেশান অব সায়েন্স থেকে পিএইচ-ডি করে ফিরল ডিপার্টমেন্টে, এখন ওর কত সুবিধা। রিডার হওয়ার দরজা খোলা, সময়ও লাগবে কম, ইউনিভার্সিটিতে আবেদন করতেও আর কোনও বাধা নেই। চাকরিতে পারমিতার চেয়ে মাত্র এক বছরের সিনিয়ার, অথচ কতটা এগিয়ে গেল! কিন্তু পারমিতা চাইলেও আদৌ সম্ভব হবে কি? কত যে বাধাবিঘ্ন! পড়াশোনার জন্য তো তিন বছরের বেশি ছুটি মেলে না। ওই সময়সীমার মধ্যে কণাদের মতো বউ-মেয়ে-সংসার শিকেয় তুলে গবেষণা শেষ করতে পারবে কি পারমিতা? এখন তো পিএইচ-ডি করা আরও কঠিন। রিসার্চের আগে ছ’মাস কোর্সওয়ার্ক করতে হচ্ছে। ওই বাড়তি পড়াশোনাও তো সময় খাবে খানিকটা। নাহ্, হবে না, পারবে না পারমিতা। মাঝখান থেকে আবার নতুন একটা চাপ…

পারমিতা প্রসঙ্গটা ঘোরাতে চাইল। আলগা হেসে বলল,— আপনার সময় কী করে কাটবে এখন? আপনি তো টিভিও দেখেন না, গল্পের বইয়ের নেশাও নেই…

ব্রেনটাকে নিজের মতো করে সচল রাখব। চাকরি-জীবনের গোড়ায় অল্পস্বল্প টিউশানি করতাম, তারপর তো ছেড়েই দিলাম…ভাবছি ছাত্র পড়ানোটাই ফের শুরু করি না কেন! কম বয়সে আর একটা বাসনা ছিল বুঝলে। নানান ল্যাঙ্গুয়েজ শেখার। ফ্রেঞ্চ, রাশিয়ান, জার্মান…। তাতেও হয়তো লেগে যেতে পারি। পপুলার সায়েন্স নিয়ে লেখালিখিরও ইচ্ছে আছে।

হুবহু বাবার মতো সংলাপ! পারমিতা ঈষৎ নাড়া খেয়ে গেল। বোঝাই যায়, আগামী দিন সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই অনিমেষের। বাবার দশা হবে না তো শেষে? দুম করে ফাঁকা জীবনে পৌঁছে খেই না হারিয়ে ফেলে!

ধুস, কেন এসব ভাবছে পারমিতা? সবাই বাবার মতো হবে কেন? অনিমেষের ছেলে, ছেলের বউ দু’জনেই ডাক্তার, অনিমেষের সঙ্গে তারা থাকে, মিসেস কস্মিনকালে চাকরি বাকরি করেনি, বাড়িতে নাতি-নাতনি…এমন ভরভরন্ত সংসারে একাকিত্বের সুযোগই কই।

পারমিতা আর কথা চালাল না, ফাইল খুলেছে। ছাত্রছাত্রীদের মার্কস্লিপগুলো বার করল, অনিমেষও চেয়ার ছাড়ল। দরজায় যেতে যেতে বলল,— তুমি কাজ সারো, আমি লাইব্রেরিতে যাই। কী কী বই ফেরত দিতে হবে তার একটা লিস্ট বানিয়ে আনি।

কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে পারমিতার হঠাৎ খেয়াল হল, নিত্যকর্মটাই বাকি। কলেজ থেকে বারোটা-একটা নাগাদ একবার ফোন করে শাশুড়িকে। ক্লাস নেওয়ার ফাঁকে বা অন্য কোনও কাজকর্মের মাঝে যখনই সময় পায়, দু’-চারটে কথা বলে নেয়। তাতার কখন প্লে-হোম থেকে ফিরল, বেশি দুষ্টুমি করছে কিনা…। চার মাসের তাতারকে মানসীর জিম্মায় রেখে ফের কলেজে জয়েন করার সময়ে শুরু হয়েছিল ওই ফোনালাপের পালা। এখন অবশ্য নিছকই অভ্যাস। তাতার এখন দিব্যি সাব্যস্ত, মা নিয়ে তেমন ঘ্যানঘ্যানানি নেই, বরং মা যে দুপুরে থাকবে না এটা সে জন্ম থেকেই মেনে নিয়েছে, এবং দাদু-ঠাম্মার সঙ্গেই তার পটে বেশি, তবু ফোন একটা পারমিতা করবেই। পাছে মানসী ভেবে বসে, তাকে দায়টা গছিয়ে পারমিতা গায়ে হাওয়া লাগাচ্ছে! যদিও মানসী এ হেন অভিযোগ কদাচ করেনি, হয়তো মানসীর চিন্তাতেও এমন ধারার ক্ষোভ নেই, উলটে তাতার বিনা মানসী-শুভেন্দুর দিনটাই তো পানসে। তাও পারমিতার কোথায় যেন একটা খচখচ করে। চাকুরে মায়েদের বুঝি এও এক জ্বালা। পারমিতার মা-ও তো ফোন করত। পারমিতার ঠাম্মিকে। সেই স্মৃতিই কি সংস্কার হয়ে গেঁথে গেছে মগজে?

কলম বন্ধ করে নিয়ম রক্ষেটা সারল পারমিতা। বাঁধা গতের দু’-চারটে সংলাপের আদানপ্রদান, তাতেই যেন শান্তি। এবার আর মনোযোগী হতে বাধা নেই, বিভাগীয় জাবদা খাতায় টুকছে ছেলেমেয়েদের নম্বর, পূরণ করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কস-স্লিপ, এর পর খামে ভরে প্রিন্সিপালকে জমা দিলে ল্যাটা চোকে।

হিসেব প্রায় শেষ, মোবাইলে সুরেলা ঝংকার। সাধারণ রিংটোন, অতএব রাজা নয়। তা হলে কি কলেজের কেউ? নাকি মা? কোনও বিশেষ দরকার?

ভাবতে ভাবতেই মোবাইল ব্যাগ থেকে হাতে। পারমিতা সামান্য অবাক। সোনালি।

বোতাম টিপে পারমিতা বলল,— তুই হঠাৎ? অসময়ে? অফিসে কাজটাজ নেই?

আপাতত ফাঁকা। এবার লাঞ্চে যাব।… ভাবলাম, ক’দিন তোর খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে না…। সোনালি খিলখিল হাসল,— কাটছে কেমন? বর বিহনে?

দেড় বছরের ছোট সোনালির সঙ্গে পারমিতার সখীত্বের সম্পর্ক। হেসে বলল,— নাথিং স্পেশাল।

তবু…। এবার রাজাদার যাওয়াটা তো একটু স্পেশাল!

কী জানি, কিছু তো মালুম হচ্ছে না। তবে খাটে জায়গা বেড়েছে, হাত-পা ছড়িয়ে আয়েশ করে ঘুমোচ্ছি।

ইস, কথাটা নিশ্চয়ই বলিসনি রাজাদাকে?

কী হবে বললে?

বা রে, কষ্ট পাবে না? বউ তার বিরহে কাতর নয়, শুনতে কোন বরের ভাল লাগে?

বিরহ টিরহের টাইম নেই রে রাজার। সে এখন অন্য ঘোরে। নিজের গন্ধে নিজেই মাতাল।

ওভাবে বলছিস কেন? অমন একটা প্রোমোশান পেলে কে না পুলকিত হয় রে?… ফোন টোন করছে তো?

মাঝরাতে। পারমিতার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, যখন আমার চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে…। কোনওক্রমে গিলে নিয়ে স্বর তরল করল,-বাবুর যে দিনান্তে একবার বউকে মনে পড়ছে, এই না ঢের!

ওটাই ভাল, বুঝলি। সারাক্ষণ ঘাড়ে নিশ্বাস ফেললেও তো দম আটকে যাবে। ভাব তুই, বস হয়তো একটা লে-আউট বোঝাচ্ছে, পুঁ করে শমীকের বাঁশি! কম্পিউটারে ডাটা এন্ট্রি করতে করতে জেরবার, মাথা পুরো থানইট, তখনই কিনা শমীকের জানার ইচ্ছে হল দুপুরে কী খেয়েছি, কখন লাঞ্চ সেরে ফিরলাম…!

আহা রে, বেচারার যে এখনও মধুচন্দ্রিমা ফুরোয়নি রে! পারমিতা ঠাট্টা জুড়ল। হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল,— তা আমাদের টুসকিরানির কী খবর? নতুন কোনও কীর্তি ঘটাল?

হাঁটাটা একটু স্টেডি হয়েছে। ধুপধাপ পড়ছে না। এর মধ্যে তো আবার ক’দিন বেশ ভুগল। গরমে ঘামাচি টামাচি বেরিয়ে…সেখান থেকে ফোড়া…। কিছু খেতে চাইছিল না। যা দেওয়া হয়, থুথু করে। দেখাশোনা করার মেয়েটাও হয়েছে সেরকম। গুড ফর নাথিং। বাচ্চা ম্যানেজই করতে জানে না।

ওই রোগামতন বউটা? তাকে রেখেছিস কেন?

আর একটা ভদ্র গোছের পাই, এটাকে দেব দূর করে।

তোর শাশুড়িকে এসে থাকতে বল না।

তিনি শ্রীরামপুরের বাড়ি ছেড়ে নড়বেন? হুঁহ্। সোনালি একটু থেমে বলল,— সবাই তো তোর শাশুড়ির মতো বুঝদার নয়। ছেলে কেন শ্রীরামপুর থেকে অফিস করল না, কেন এখানে ফ্ল্যাট নিল…সেই রাগে তিনি এখনও মটমট। আরে বাবা, তার ছেলের বউকে যে ন’টার মধ্যে অফিসে ঢুকতে হয়, সেখান থেকে যাতায়াতে তার তো প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছিল!

পারমিতা মনে মনে হাসল। সোনালি চিরকালই আজুলি টাইপ। একদম ধকল নিতে পারে না। জীবনে তেমন কোনও ধাক্কা তো সইতে হয়নি, তাই অল্পেই মেজাজ হারায়।

উপদেশের সুরে পারমিতা বলল,— শোন, একটু নরম নরম ডায়ালগ দিয়ে শাশুড়িকে ভজা। বাড়িতে বয়স্ক কেউ থাকলে কত সুবিধে। দেখবি, টেনশানের লেভেল অনেকটাই নেমে গেছে।

লাভ হবে না রে। তা ছাড়া, টু স্পিক দা ট্রুথ, ওই মহিলার না আসাই ভাল। এমন খিটকেল, একত্রে থাকলেই হল্লা মাচাবে। শান্তিতে জিন্‌স পরার জো নেই। কোথায় যাচ্ছি, কেন গেলাম…হাজার গন্ডা কৈফিয়ত দাও। তার চেয়ে বরং আমার সমস্যা আমারই থাক। তিনি মনের সুখে বাড়ির ছাদে বেলফুল জুঁইফুল ফোটান যত খুশি। ফোনে একটা দীর্ঘশ্বাস ভাসাল সোনালি,— বাদ দে।…মেসো কেমন আছে রে?

আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন? যাদবপুরে ফোন করলেই পারিস।

বাড়ি ফিরে আর কিছু মাথায় থাকে না রে। টুসকিটা এমনভাবে আঁকড়ে ধরে…! দেখি, একদিন চলেই যাব মাসির ওখানে। টুসকিকে নিয়ে গোটা দিন কাটিয়ে আসব।

যাস। মা-বাবা দু’জনেই খুব আনন্দ পাবে। আমি ছাড়া কেউ তো বড় একটা যায় না।

তুই কিন্তু মেসোর জন্য জান লড়িয়ে দিয়েছিস। সত্যি বলতে কী, ছেলেরাও এতটা করে না।

গ্যাস দিস না তো। আমি জাস্ট আমার ডিউটি করছি।

প্রায় নির্লিপ্ত স্বরে পারমিতা বলল বটে, তবে ফোন ছাড়ার পর সোনালির স্তুতিটুকু যেন তিরতির কাঁপন জাগাচ্ছিল বুকে। শুধুই তা হলে উদ্বেগ নয়, প্রশংসা শোনার আকাঙ্ক্ষাও কি তাকে ছোটায় যাদবপুর? নির্মোহ, নিষ্কাম কর্তব্যের পাশাপাশি গৌরবান্বিত হওয়ার বাসনাও কি তাকে উজ্জীবিত করে? কে জানে!

বাপের বাড়ি হয়ে গড়িয়া ফিরতে আজ একটু রাত হল পারমিতার। শুভেন্দু ড্রয়িং হলে টিভিতে সংবাদ শুনছিল। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল পারমিতাকে, কোনও প্রশ্ন করল না। আগে আগে প্রতিদিন প্রণবের খবর নিত শুভেন্দু-মানসী, দেখতেও যেত প্রায় সপ্তাহে, ইদানীং বুঝি ব্যাপারটা গা-সওয়া হয়ে গেছে।

পারমিতা খানিক জবাবদিহির সুরে বলল,— আজ বড্ড দেরি হয়ে গেল।

কিছু প্রবলেম হয়েছিল নাকি?

না। মা একটা মলম আনতে বলেছিল, যাদবপুরে পাওয়া যাচ্ছে না, তাই শেয়ালদায় নেমে খুঁজতে হল দোকানে দোকানে। তারপর ও বাড়ি গিয়ে দেখি বহুকাল পর ছোটপিসি এসেছে। তার সঙ্গে বকর বকর…

পারমিতার গলা পেয়ে মানসী বেরিয়েছে ঘর থেকে। স্বাভাবিক স্বরে বলল,— একটু জানিয়ে দিতে পারতে। তাতারটা তোমার জন্য এতক্ষণ জেগে ছিল, এই ঘুমোল।

পারমিতার বলতে ইচ্ছে করল, আপনারাও তো ফোন করতে পারেন! গলা দিয়ে বেরোল,— তাতার কি খাওয়ার সময়ে খুব জ্বালিয়েছে?

তেমন কিছু নয়। তবে বেশি বাবা-বাছা করতে হল…। ওকে আজ আর উঠিয়ো না, ও আমাদের ঘরেই ঘুমোক।

রাত্তিরে কিন্তু চরকি খাবে। বাবার অসুবিধে হতে পারে।

না না, আমার এপাশে তো থাকবে। মানসীর যেন হঠাৎই কী মনে পড়েছে, এমনভাবে বলল,— হ্যাঁগো মিতা, বিকেল থেকে কি তোমার মোবাইল অফ?

কই, না তো!

রাজা সন্ধেবেলা এখানে ফোন করেছিল। বলল, তোমায় নাকি পাচ্ছে না…

তাই?

তাড়াতাড়ি সেলফোনখানা বার করল পারমিতা। সত্যি তো, তিনটে মিসড কল! ছটা বারো থেকে ছটা ছেচল্লিশের মধ্যে। ওষুধটা কিনে পারমিতা আর স্টেশনে ফেরেনি, বাস ধরেছিল, তখনই বোধহয়…। ভিড় আর হট্টগোলে কখন যে ফিরে গেছে রাজার ডাক!

কিন্তু অসময়ে রাজার ফোন কেন? পারমিতা শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করল,— কিছু বলেছে কি? কোনও কি জরুরি কথা ছিল?

আমাকে তো ভাঙল না কিছু। মানসী গিয়ে শুভেন্দুর পাশে বসেছে। স্মিত মুখে বলল,— রাজার ফোনটা পেয়ে আজ বেশ লাগল। মনে হচ্ছিল কত কাল পর ছেলের গলা শুনলাম!

সূক্ষ্ম একটা শ্লেষ রয়েছে কি মানসীর কণ্ঠে? রাজা প্রতি রাতে বউকেই ফোন করে, মাকে নয়, এটাই কি ঘুরিয়ে বলল শাশুড়ি? নাকি এ শুধুই আনন্দের সরল বহির্প্রকাশ?

পারমিতা আর ঘাঁটাল না মানসীকে। চটপট পোশাক আশাক বদলে খেতে এসেছে। রানা ফেরেনি, যে ডিউটিই থাকুক, রাত এগারোটার আগে ফেরেও না, তার খানা ঢাকা থাকে টেবিলে। শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে নৈশাহার সারল পারমিতা, তারপর ঘরে এসে অপেক্ষা করছে রাজার ফোনের। এক সময়ে অসহিষ্ণু হয়ে নিজেই টিপল সেলফোনের বোতাম। এনগেজড, এনগেজড…। মিনিট দশেক পর আবার চেষ্টা করল। আবার ব্যস্ত। পনেরো মিনিট পর একই প্রয়াস। জবাবও এক। দা নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়ালড ইজ বিজি…। হায় রে, রাজার কনফারেন্স কল আর ফুরোয় না। একটা এস এম এস পাঠাবে কি? যদি পরে রাজা দেখে…!

থাক। হতাশ হয়ে পারমিতা শুয়ে পড়ল। কখন যে ভারী হয়ে এল দু’চোখের পাতা…!

গভীর রাতে হঠাৎই ভেঙেছে ঘুম। পরিচিত অভ্যাসে হাত ঘুরছে শয্যায়। অভ্যস্ত কাউকে খুঁজছে যেন।

ধড়মড়িয়ে উঠে বসল পারমিতা। ফাঁকা বিছানাটা বড্ড বেশি শূন্য শূন্য লাগে। বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা টানল। চাইছে রাজাকে।

আহ্বান পৌঁছোল না। রাজার ব্ল্যাকবেরি এখন নিদ্রায়।

.

০৪.

কম্পিউটারের পরদায় চমৎকার এক ফ্ল্যাটের ছবি। আটতলার প্রশস্ত লিভিং হলে আধুনিক সোফাসেট, নকশাদার কার্পেটে আয়তাকার সেন্টারটেবিল, দেখনদার স্ট্যান্ডল্যাম্প, বাহারি ল্যাম্পশেড, দেওয়ালে পেন্টিং, দামি দামি পরদা, বৃত্তাকার কাচের ডাইনিংটেবিল, সবই অতি সুচারুভাবে সাজানো। ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ডিশওয়াশার শোভিত মডিউলার কিচেনটিও চোখ টানে। দু’খানা শয়নকক্ষ, দুটোই বেশ বড়সড়। মানানসই কাঠের আসবাব, দেওয়ালে এল-সি-ডি টিভি, জানলার ওপারে ঘন নীল আকাশ…। গিজার বাথটব সহ লাগোয়া বাথরুম দুটোও চমকদার।

মাউস স্ক্রোল করে পুরো ফ্ল্যাটখানা পরিক্রমা করল পারমিতা। এবার দু’ নম্বর। এটি পাঁচতলায়। একই ধরনের সাজসজ্জা, তবে রান্নাঘর বাথরুম যেন একটু ছোট ছোট। অবশ্য ব্যালকনিটায় বাহার আছে।

আবার মাউস ক্লিক। তিন নম্বর। তেরোতলায়। বসা আর খাওয়ার জায়গা এখানে ছাড়া ছাড়া। দুটো ব্যালকনি, দুটোই মোটামুটি গোছের। তবে বাড়তি একটি ছোট ঘর দৃশ্যমান। সেখানে বইয়ের র‍্যাক, কম্পিউটার টেবিল, সুন্দর একটা আরামকেদারা…

প্রতিটি ফ্ল্যাটই কোনও না কোনও সম্পন্ন আবাসনে। নীচে সুইমিং পুল, বাচ্চাদের খেলার জায়গা, ক্লাব হাউস, ভূগর্ভস্থ গ্যারাজ ট্যারাজ নিয়ে রীতিমতো স্বয়ংসম্পূর্ণ বন্দোবস্ত। প্রথমটা জয়নগরে, পরের দুটো কোরামঙ্গলায়। এ ধরনের আবাসনে থাকার কত দিনের যে শখ পারমিতার!

তাতার মা’র গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। হাঁ করে দেখছিল ছবিগুলো। চোখ পিটপিট করে বলল,— এগুলো কাদের বাড়ি গো?

যে থাকে, তার। পারমিতা ছেলের চুল ঘেঁটে দিল,— চাইলে আমাদেরও হতে পারে।

আমরা ওই বাড়িগুলোয় থাকব?

সব ক’টায় নয়, যে-কোনও একটাতে। কোনটা তোর পছন্দ?

তাতার ফাঁপরে পড়ে গেল। ভুরু কুঁচকে ভাবছে।

পারমিতা হেসে ফেলল। কাল রাতে ছবিগুলো মেল করেছে রাজা। তখন আর কম্পিউটারে বসা হয়নি। আজ শনিবার, পারমিতার অফ-ডে, মন দিয়ে এখন নিরীক্ষণ করছে ফ্ল্যাটগুলো। এর মধ্যে কোনও একটি আপাতত ভাড়া নেবে রাজা। অন্দরের সাজসজ্জা সমেত। কোম্পানিই দিচ্ছে। পছন্দ করার গুরুদায়িত্বটা পারমিতার। কিন্তু কোনটাকে যে সে হ্যাঁ বলে?

পারমিতা ছেলেকেই খোঁচাল,— কী রে, বল?

আমি কী জানি! তাতার ঠোঁট উলটোল,— আমরা কি গিয়ে থাকব?

তোর বাবা তো থাকবে।

বাঙ্গালোরে?

হুঁ। আমরাও যাব মাঝে মাঝে। তুই, আমি…

আর দাদু-ঠাম্মা?

তারাও যেতে পারে। যখন ইচ্ছে।

মানসীর প্রসঙ্গ উঠতে না উঠতে মানসীর আবির্ভাব। দরজায় দাঁড়িয়ে বলল,— মা-ছেলেতে কী হচ্ছে?

তাতার চোখ বড় বড় করে বলল,— বাবার বাড়ি দেখছি। এসো না, এসো। তুমিও দ্যাখো।

রাজা গেস্টহাউস ছেড়ে ফ্ল্যাটে যাবে শিগগিরই, এ তথ্য মানসীর অজানা নয়। কিন্তু সত্যি সত্যি সে যে এতটা এগিয়েছে, দেখে মানসী মহা পুলকিত। পারমিতার সঙ্গী হয়ে সেও বসে গেল ছেলের ডেরা নির্বাচনে। চলছে চুলচেরা বিচার। বেশি উঁচুতে থাকার কী সুবিধে অসুবিধে…ব্যালকনি বড় নেওয়া ভাল, না রান্নাঘর…কোন ফ্ল্যাটের বেডরুমে ভাল আলো-বাতাস খেলতে পারে…লিভিংরুম বড় হওয়া কতটা প্রয়োজনীয়… কিছুই ছাড় পাচ্ছে না গবেষণা থেকে। শেষমেশ আটতলার ঘরটাই মানসীর মনে ধরেছে। রাজা নিশ্চয়ই তো আর চিরকাল ভাড়াবাড়িতে থাকবে না, আজ না হোক কাল বাড়ি কিনবেই, সুতরাং এখন কাজ চলা গোছের একটা বাসস্থানই তো যথেষ্ট…

পারমিতার তত চোখে লাগেনি ফ্ল্যাটটা। তেরোতলাতেই তার আকর্ষণ বেশি। তবু নিজের মতামত সেভাবে জাহির করল না। কেজো গলায় বলল,— তা হলে আট নম্বরটাই রাজাকে ফাইনাল করতে বলি?

হ্যাঁ, হ্যাঁ। সঙ্গে জানিয়ে দাও, ঢোকার আগে একবার যেন রং করিয়ে নেয়।

কেন? দেওয়াল টেওয়াল তো বেশ ঝকঝক করছে।

ছবিতে ওরকম লাগে। তা ছাড়া আগে কারা বাস করেছে তার ঠিক নেই…। নিজের মতো করে দু’পোঁচ বুলিয়ে নেওয়া উচিত।

এবারও তর্কে গেলে না পারমিতা। বলল,— বেশ। পাঠিয়ে দিচ্ছি আপনার অ্যাডভাইস।

মানসীর প্রফুল্ল ভাব বেড়েছে আরও। আদুরে গলায় নাতিকে বলল,— অ্যাই ছেলে, চল, চান করবি তো?

উঁউঁউঁ, আমি আজ মা’র কাছে করব।

আজ খুব মা মা, অ্যাঁ? অন্য দিন কে করায়?

নিতান্তই সরল বাক্য। মানসী এভাবেই তো বলে। তাও কেন যেন কানে টুং করে বাজল কথাটা। ওই বাজনাটুকু শুনতে চায় না বলেই না নিজের ছুটির দিনে শাশুড়িকে যথাসাধ্য ঝাড়া হাত-পা রাখার চেষ্টা করে পারমিতা। রাঁধুনি মেয়েটা না এলে রান্নাঘরে পর্যন্ত ঢুকতে দেয় না। এবং কী আশ্চর্য, পারমিতার অফ ডে-টাই অণিমার কামাই করার দিন। সম্ভবত সেও বুঝে গেছে, এই দিনটায় পারমিতার ওপর চাপ তৈরি করা খুব সহজ। শাশুড়িকে সরিয়ে পারমিতা এদিন হেঁশেল ঠেলবেই। না ঠেলে পারবেই না।

আজ অবশ্য অণিমা দেবী দয়া দেখিয়েছেন, দেরিতে হলেও এসেছেন কাজে। শাশুড়িও খুশ, পারমিতাও খুশ। অন্তত নিশ্চিন্ত মনে কম্পিউটারে বসতে পারছে তো পারমিতা।

বৈদ্যুতিন চিঠি টাইপ করতে করতে পারমিতা মুচকি হাসল,— তাতারকে আজ আমার হাতেই ছেড়ে দিন মা। প্রাণের সুখে দুরমুশ করি।

সেই ভাল। মানসী নাতিকে তর্জনী দেখাল,— আমার কাছে তো শ্যাম্পু মাখতে চাও না… দ্যাখো আজ মা কীভাবে ডলে!

শুনেই তাতারের বিদঘুটে ভেংচি। পরক্ষণে ঘর ছেড়ে ধাঁ। মানসীও ধর তো, ধর তো, বলে ছুটেছে পিছনে। গ্রীবা হেলিয়ে নাতি-ঠাকুমার চকিতে নিষ্ক্রমণ দেখে নিয়ে রাজাকে চিঠিটা পাঠাল পারমিতা। তারপর হঠাৎই যেন আনমনা। একবার যাবে নাকি ইউ-জি-সির সাইটে? কণাদ পরশু বলছিল, নতুন কী একটা ফেলোশিপ দিচ্ছে…। তা ছাড়া আগামী বার যদি নেটে বসে, পরীক্ষার তারিখটাও তো জানা দরকার।

ধুস, কী হবে জেনে? রিসার্চ তার কপালে নেই, স্বপ্নটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলাই ভাল। ক্ষণে ক্ষণে স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণাটা তো পোয়াতে হয় না। চাকরি একটা জুটেছে, তাতে লেগে থাকাই তো যথেষ্ট। এখন বরং বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে খানিক আড্ডা মারলে মাথাটা ঝরঝরে হয়।

ভাবামাত্র কাজ। ফেসবুকে ঢুকছে পারমিতা। প্রযুক্তির কী মহিমা, হারিয়ে যাওয়া বন্ধুরাও কেমন জড়ো হতে পারে এক জায়গায়। হোক না এক কাল্পনিক পরিসর, যোগাযোগ একটা হচ্ছে তো। স্কুলের বন্ধু, কলেজ-ইউনিভার্সিটির সহপাঠী…কত হারিয়ে যাওয়া চেনাজানাকে পারমিতা খুঁজে পেল এখানে। একটাই যা দুঃখ, ক’দিনই বা প্রাণ ভরে গল্প-আড্ডার ফুরসত মেলে!

আজ ফেসবুকে গিয়ে পারমিতার চক্ষু স্থির। অনেক দিন বসা হয়নি, তাতে কী ব্যাপক সাড়া পড়ে গেছে! তার অলীক দেওয়ালে গাদা গাদা টিপ্পনী। নিজের বন্ধুদের, রাজার বন্ধুদের…। কী রে, বর কেটেছে বলে তুইও ভ্যানিশ!…দেবদাস যে বিবাগী হল পারো, বাঙ্গালোর গিয়ে তাকে বাঁচাও।…তুই কি একাই কলেজ করিস নাকি রে শালা, থুড়ি শালি! …কী গো দিদিমণি, সাড়া দাও, সাড়া দাও!…অ্যাই, তুই বেঁচে আছিস তো? না থাকলে কাগজে মৃত্যু সংবাদটা ছাপিয়ে দে।… রাজাকে মিস করতে করতে কিসমিস হয়ে গেলি নাকি রে!

দেওয়াল-লিখন পড়তে পড়তে পারমিতা মিটিমিটি হাসছিল। রাজার বেঙ্গালুরু প্রস্থান তা হলে রীতিমতো একটা ইভেন্ট? সবাইকে আলাদা আলাদা উত্তর দিতে হবে নাকি? একটাই জুতসই কিছু লিখলে হয়, যাতে এক ঢিলে সব ক’টা পাখি…!

ভুরু বেঁকিয়ে মনপসন্দ্ একটা জবাব খুঁজছিল পারমিতা, দরজায় মৃদু টকটক,— ব্যস্ত আছ?…আসব?

পারমিতা অবাক। রানা তো বড় একটা আসে না এ ঘরে?

ঘুরে বসে পারমিতা বলল,— কী ব্যাপার গো? কিছু বলবে?

কাজ করছিলে? ডিস্টার্ব করলাম?

রানার হাতে চায়ের কাপ। কাল অনেক রাতে ফিরেছে, এইমাত্র উঠল বোধহয়। পরনে আজও সেই শর্টস আর স্লিভলেস টিশার্ট। চুল এলোমেলো। দৃষ্টি কম্পিউটারের মনিটরে।

পারমিতা ওয়েব-সাইট থেকে বেরিয়ে এল। যন্ত্রটাকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে বলল,— তেমন কিছু না।…দাঁড়িয়ে কেন, বোসো।

খাটে বসেছে রানা। কাপে চুমুক দিয়ে বলল,— তোমাদের এই অফ ডে-র সিস্টেমটা কিন্তু বেড়ে। একটা দিন বাড়তি ছুটি।

পারমিতা হাসল,— সাংবাদিকরা কি কিছুই খবর রাখে না? এটা ছুটি নয় স্যার, প্রিপেরাটারি ডে। সারা সপ্তাহ পড়ানোর প্রস্তুতি নিতে হয় এই দিনে।

সরি। সরি। নলেজটা বাড়ল।…তোমাদের কলেজ এখন ফুল সুয়িং-এ চলছে, না?

বলতে পারো। এটাই তো কলেজের পিক সিজন।

অর্থাৎ এই সময়ে ক্লাসটা বেশি থাকে?

হ্যাঁ। সব ক’টা ইয়ার একসঙ্গে চলে তো।

দিনে তোমায় কতগুলো ক্লাস নিতে হয়?

ঠিক থাকে নাকি! কোনওদিন হয়তো তিনটে, আবার কোনওদিন প্র্যাক্টিকাল নিয়ে ছ’টা-সাতটা।

তোমাদের কেমিস্ট্রিতে তোমরা মোট ক’জন টিচার?

স্টোরি করবে নাকি? পারমিতা ঠোঁট টিপে হাসল, ভাল ম্যাটার পাবে কিন্তু।

কীরকম?

ধরো… ল্যাবরেটারি বেস্‌ড ডিপার্টমেন্ট সাতজনের কমে চলে না। পাঁচজনের নীচে তো চালানো প্রায় অসম্ভব। কিন্তু আমাদের পোস্ট আছে তিনটে। লোক মাত্র দুই। অগস্টে একজন বাই বাই করছেন, তখন হারাধনের একটা মাত্র মেয়ে পড়ে থাকবে।

সর্বনাশ! পারবে কী করে?

ওটাই তো ম্যাজিক। এখন চারজন গেস্ট-লেকচারার দিয়ে কোনওমতে কাঠামোটা খাড়া করা আছে। সামনের মাসে আমাদের হেড চলে গেলে অন্তত আরও তিনজন দরকার। ক্লাস পিছু তাদের বরাদ্দ একশো পঁচিশ টাকা। সপ্তাহে তাদের আটটার বেশি ক্লাস দেওয়ার নিয়ম নেই। মাসে তিন-সাড়ে তিন হাজারের বেশি জোটে না বলে তাদেরও বয়ে গেছে ভাল করে পড়াতে। কোনওক্রমে সিলেবাস উলটোয়, আর ছাঁকনি ফেলে টিউশান ধরে। ছেলেমেয়েরাও জন্ম থেকে প্রাইভেট পড়তে অভ্যস্ত, গোছা গোছা নোটই তাদের বৈতরণী পার করে দেয়। আমি ক্লাসে কত খাটলাম, তা নিয়ে ওদের কণামাত্র মাথাব্যথা নেই। সুতরাং ডিপার্টমেন্টও ঠিক গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যায়।

তবু…তোমার ওপর প্রেশার তো একটা থাকছেই।

সে আর বলতে, প্র্যাক্টিক্যালগুলো শেষ করানোর দায়িত্ব, বছরে অন্তত তিনবার ইউনিট টেস্ট নেওয়া, গোছা গোছা খাতা দেখা, রুটিন তৈরি, কোয়েশ্চেন সেট করা…। এ ছাড়া ইউনিভার্সিটির এগজ্যামের হ্যাপা তো আছেই। সঙ্গে কলেজের হাজারো হ্যাঙ্গামা, এই কমিটি, সেই কমিটি…। বলতে বলতে পারমিতার উৎসাহী স্বর থেমেছে সহসা। চোখ সরু করে বলল,— অ্যাই, তুমি কি সত্যিই আমাদের প্রবলেম নিয়ে ইন্টারেস্টেড?

উঁহু। আমার ইন্টারেস্ট শুধু তুমি। ইউ।

পারমিতা এবার সত্যিই থতমত। কাল রানা কিছু খেয়েছিল টেয়েছিল নাকি? এখনও কি খোঁয়াড়ি কাটেনি? না হলে এই ধরনের বাক্য তো রানার মুখ দিয়ে বেরোনোর কথা নয়!

পারমিতার গলা দিয়ে ঠিকরে এল,— মানে?

চা শেষ করে কাপটা দু’ হাতে ঘোরাচ্ছে রানা। মিচকি হেসে বলল,— বড্ড স্ট্রেন হয় তোমার। বিকেলে একটা সিনেমায় যাবে?

তোমার সঙ্গে?

ইয়েস। একদিন গেলে কী হয়? ভাল একটা মুভি চলছে। পিপলি লাইভ। মিডিয়াকে খুব আওয়াজ মেরেছে। তোমার মজা লাগবে।

পারমিতা আরও গোমড়া হয়ে গেল, তুমি কি আমার সঙ্গে ইয়ারকি মারছ?

মোটেই না। বেরোতে তোমার কষ্টও হবে না। দাদার গাড়িটা তো পড়েই আছে, সেন্টার থেকে একটা ড্রাইভার ডেকে নিচ্ছি, সোজা কোনও মাল্টিপ্লেক্সে চলে যাব। রানা গাল ছড়িয়ে হাসল,— আরে বাবা, চলোই না। একজন তোমার সঙ্গে খুব আলাপ করতে চাইছে।

পারমিতার রক্তচাপ যেন বেড়ে গিয়েছিল হঠাৎ। ঝুপ করে নেমে গেছে। হাঁ করে একটা শ্বাস ফেলল। ভুরু নাচিয়ে বলল,— কে? কে? স্পেশাল কেউ?

গেস করো। গেস করো। রানা হাসি হাসি মুখে উঠে পড়ল। খানিকটা যেন বায়নার সুরে বলল,— আমি কিন্তু তা হলে ড্রাইভার ডাকছি। সাড়ে তিনটেয় তৈরি থেকো।

রানা বেরিয়ে যাওয়ার পর পারমিতা হতবুদ্ধির মতো বসে রইল একটুক্ষণ। বোঝাই যাচ্ছে, কোনও গার্লফ্রেন্ড টালফ্রেন্ড। রানাকে তো আপাত চোখে নীরসই মনে হয়, সেও কিনা প্রেমে পড়ল? নীরস? নাকি নিস্পৃহ? রাজা জীবনে বড় চটপট ঝকমকিয়ে উঠেছে, তুলনায় রানা যেন অনেকটাই নিষ্প্রভ। মাস কমিউনিকেশানে ডিপ্লোমা করে বেশ কিছুকাল বেকার ছিল রানা, মাঝে মাঝে টুকটাক ফিচার লিখত এদিক সেদিক। তখন একটা হীনন্মন্যতায় ভুগত রানা, পারমিতা জানে। নতুন বাংলা দৈনিকটায় সাংবাদিক বনে যেতেই এক ধরনের আত্মম্ভরিতা জেগেছে রানার, পারমিতা এও বোঝে। হয়তো এটা ওই হীনম্মন্যতারই উলটো পিঠ। মাইনেকড়ি খুব একটা বেশি পায় না তো! তা বলে চিরকালই একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলা রানা তার প্রেমিকার সঙ্গে পারমিতার আলাপ করাতে উদগ্রীব, এটা কেমন আজব ঠেকে না?

খবরটা তো রাজাকে জানাতেই হয়। মোবাইল মুঠোয় তুলেও পারমিতা রেখে দিল। রাজার এখন ব্যস্ত সময়, কোথায় কী মিটিং-এ বসেছে কে জানে, রসালো গল্পটার হয়তো স্বাদই পাবে না।

কম্পিউটারও আর চালু করল না পারমিতা। ছন্দ কেটে গেছে, ফেসবুক তোলাই থাকুক। বরং সপ্তাহান্তের কাজে লেগে পড়াই সংগত। কোণে নেটের বালতিতে ক’দিনের ছাড়া জামাকাপড় জড়ো করা আছে, বিছানায় চাদর বালিশের ঢাকাও খুলে ফেলল, সবগুলো সাপটে নিয়ে চলেছে ওয়াশিং মেশিনে ঢোকাতে। এ বাড়িতে আগে একটি সেমি অটোমেটিক যন্ত্ররজক ছিল, সেটিকে পালটে গত বছর একখানা পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় কাচাকুচির মেশিন কেনা হয়েছে। পারমিতাই কিনেছে। শ্বশুর-শাশুড়ি কিছুতেই পারমিতার কাছ থেকে মাসিক টাকা নিতে রাজি নয়। ছেলের বউয়ের রোজগারে হাত ছোঁয়াতে বাধে বোধহয়। হয়তো সংস্কার। অথবা মানে লাগে। তবে এই ধরনের জিনিস টিনিস কিনে আনলে খুব একটা আপত্তি জোড়ে না। দিতে পেরে পারমিতারও মনের ভার খানিকটা লাঘব হয়। এভাবেই চিমনি ঢুকেছে রান্নাঘরে, এসেছে মাইক্রোওয়েভ ওভেন, একগাদা ননস্টিক বাসন, বিদেশি ডিনারসেট…

কাপড় হাতে বড় বাথরুমে গিয়ে পারমিতা হতবাক। অন্দরে শ্বশুরমশাই। স্ক্রু-ড্রাইভার ঘুরিয়ে কমোডের ঢাকনাখানা খুলছে!

বিস্মিত স্বরে পারমিতা বলল,— ওটা কী করছেন, বাবা?

কভারটা চেঞ্জ করব। একদম রং জ্বলে গেছে। ঘাম থসথসে মুখে শুভেন্দু ঘুরেছে,— কাল একখানা নতুন কিনে এনেছি।

সে ঠিক আছে, কিন্তু আপনি লাগাচ্ছেন কেন?

পারি বলে। যে কাজ সাধ্যের মধ্যে আছে, তার জন্য খামোখা মিস্ত্রি ডাকব?

তা বলে কমোডের ঢাকনা…!

সো হোয়াট? জানোই তো, তুচ্ছ কারণে অন্যের ওপর ডিপেন্ডেন্ট হওয়া আমার পোষায় না।

হ্যাঁ, তা পারমিতা এত দিনে টের পেয়েছে বই কী। বাড়ির কোনও জিনিস খারাপ হলে সেটা নিজেই আগে মেরামতির চেষ্টা চালায় শুভেন্দু। সে মিক্সিই হোক, কিংবা গ্যাস-ওভেন। বাতিল ট্রানজিস্টারই হোক, কি হোঁচট খেতে খেতে চলা দেওয়ালঘড়ি। প্রথমেই পটাপট খুলে ফেলে বস্তুটি। তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খোঁজে ব্যাধিটা। বেশির ভাগ সময়ে সারিয়েও ফেলে। রিটায়ারমেন্টের পর বাতিকটা যেন আরও বেড়েছে। এই তো, মাস তিনেক আগে পারমিতার মোবাইলটা গড়বড় করছিল, অপর প্রান্তের কথা ঠিকঠাক শোনা যাচ্ছিল না, ওমনি শুভেন্দু সিমকার্ড খুলে শুকনো কাপড়ে ঘষে দিব্যি সযুত করে দিল। হিসাবরক্ষকের চাকরিতে থেকেও যন্ত্রপাতিতে এমন পারদর্শিতা একান্তই দুর্লভ। হায় রে, বাবার যে কেন এমন কোনও নেশা ছিল না?

পারমিতা হেসে বলল,— আপনার কি সময় লাগবে?

তা একটু…। নতুনটাকে লাগাব…। শুভেন্দু চোখ চালিয়ে কাপড়ের গোছাটা দেখল,— তুমি ঢুকিয়ে দাও। আমি সাবান দিয়ে চালিয়ে দিচ্ছি। …একটা কাজ করো তো। বাথরুমের দরজাটা টেনে দিয়ে যাও।

কেনওও?

তোমার পুত্তুরটি যে বারবার হানা দিচ্ছে! এই তো, একখানা স্ক্রু নিয়ে চম্পট দিল।

সত্যি, দাদু-ঠাকুমাকে বড্ড জ্বালায় তাতার। যত দিন যাচ্ছে, দুরন্তপনা বাড়ছে। ঠাম্মার শান্তিতে টিভি দেখার জো নেই, ঘাড়ে উঠে লাফাচ্ছে, চ্যানেল ঘুরিয়ে দিচ্ছে পটাপট…। দাদু বেচারা তো নাতি থাকলে পেশেন্স খেলায় বসতেই পারে না, এমন এলোমেলো করে দেয় তাস…। প্লে-হোম ছেড়ে স্কুলে ভরতি হবে সামনের বছর, তখন যদি খানিক শান্ত হয়।

মানসীর ঘর থেকে তাতারকে ধরল পারমিতা। তারপর টানা যুদ্ধ ঘণ্টাখানেক। ছেলেকে স্নান করানো, গা মোছানো, জামাকাপড় পরানো, চুল আঁচড়ানো, গায়ে পাউডার দেওয়া…প্রতি পদে সে এক লড়াই। আর খাওয়ানো তো রীতিমতো সংগ্রাম। প্রথম একটা-দুটো দলা ঠিকঠাক খায়, তারপর গালে ঠুসে বসে আছে তো বসেই আছে…পারমিতার ধৈর্য হারানোর জোগাড়।

আজ তো পারমিতা ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দিল। চোখ পাকিয়ে বলল,— কী হচ্ছে কী তাতার? চিবোও, চিবোও বলছি।

মানসী খাবার টেবিলে। এতক্ষণ যেন মা-ছেলের দ্বৈরথ উপভোগ করছিল। এবার হাঁ হাঁ করে উঠেছে,— আহা, মারছ কেন? ওভাবে হবে না। গালে আলতো ঠোনা দাও, মুখ চলতে শুরু করবে।

পারমিতা ঈষৎ অপ্রসন্ন সুরে বলল,— এক-আধদিন ওকে পেটানো দরকার মা। রোজ খেতে বসে বদমাইশি, রোজ খেতে বসে বদমাইশি…। রাত্তিরেও তো দেখি রুটি মুখে বসেই থাকে।

বাচ্চারা তো এরকম করেই, মিতা। মাথা ঠান্ডা রেখে ভুলিয়ে ভালিয়ে খাওয়াতে হয়।

না মা, ওকে আর একদম আশকারা দেবেন না। আদরে বাঁদর তৈরি হচ্ছে। পারমিতা ছেলেকে ঝাঁকাল,— কী হল, গেলো। কী হল, কথা কানে যাচ্ছে না?

নিজের গলতা থেকে কখন যেন বেরিয়ে এসেছিল রানা। কোমরে হাত রেখে দেখছিল নাটক। দৃশ্যটাকে ক্লাইম্যাক্সে তুলতেই বুঝি বলে উঠল,— খবরদার মা’র কথা শুনবি না তাতার। মুখেরটা বার করে দে। ফু ফু করে।

একটু একটু ঠোঁট ফুলছিল তাতারের। কাকাইয়ের পরামর্শে অভিমান উধাও, হি হি হেসে উঠেছে। ওমনি কী কাণ্ড, ভাতের দলা মুখগহ্বর ছেড়ে থস টেবিলে।

তাড়াতাড়ি ভাতটুকু কাচিয়ে থালার কোনায় রাখল পারমিতা। বেজার মুখে বলল,— কেন ওকে উসকোচ্ছ? এরকম চললে আমার কিন্তু আর বেরোনো হবে না।

সঙ্গে সঙ্গে মানসী টানটান,— তুমি আজ যাদবপুর যাচ্ছ নাকি মিতা?

পারমিতার হয়ে রানাই উত্তর দিল,— বউদি একটা মুভি দেখতে যাবে। আমার সঙ্গে। ড্রাইভার ফিট করেছি, দাদার গাড়িটা নিয়ে বেরোব।

মানসী ভয়ানক আশ্চর্য হয়েছে। এমন ঘটনা কদাচ ঘটে না তো। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলল,— তোরা…সিনেমায়…একসঙ্গে…?

কেন, আপত্তি আছে?

তা নয়, যাস না তো কখনও। মানসী টুকুন দম নিল। বুঝি ধাতস্থ করছে নিজেকে। খানিকটা আত্মগত ভাবে বলল,— ভাবছিলাম বিকেলে একবার মাকে দেখে আসব…শনি-রোববার ছাড়া তো হয়েও ওঠে না…তোর ছোটমামা বলছিল বুকে নাকি সর্দি বসেছে…

আজকের বদলে কাল যেয়ো।

যদি না কাল আবার কোনও বাধা পড়ে…

তা হলে পরশু যাবে। তুমি তো চেনে বাঁধা নেই।

আমার তাতার রয়েছে না? ওকে ফেলে যখন তখন নড়তে পারি?

আশ্চর্য, বাবা একদিন তাতারকে সামলাতে পারে না?

তিনি কি বিকেল-সন্ধের তাসের আড্ডাটি মিস করবেন? একদিনও?

তুমি তা হলে তাতারকে নিয়েই যেয়ো।

ওই দুরন্ত ছেলে নিয়ে বাসে…?

আহ্, বাড়িতে একটা গাড়ি তো পড়ে। ইউজ তো করতেই পারো।

ওরে বাবা, একদিন চড়ব…ওমনি তোর বাবার হিসেব কষা শুরু হয়ে যাবে। গড়িয়া থেকে ভবানীপুর কত কিলোমিটার, যাতায়াতে ক’ লিটার পেট্রল পুড়ল, তার মূল্য কত, ড্রাইভারের পিছনে কত খসল…

মা-ছেলের কথোপকথন শুনতে শুনতে কান-মাথা জ্বালা জ্বালা করছিল পারমিতার। পলকের জন্য মনে হল, আজ প্রোগ্রামটা বাতিল করে দেয়। কিন্তু মেয়েটিকে দেখার কৌতূহলও যে বিজবিজ করছে!

গলা নামিয়ে পারমিতা বলল,— একটা কথা বলব মা? গাড়ির ট্যাঙ্কি আজ ভরতি করে আনছি। যেদিন চাইবেন, রানার চেনা ড্রাইভার আপনাকে দিদার বাড়ির থেকে ঘুরিয়ে আনবে। আর কাল যদি চান, আমিও সঙ্গে যেতে পারি।

শেষের বাক্যটি যেন কানেই গেল না মানসীর। আগেরটুকুই আঁতে লেগেছে বোধহয়। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,— না না বাবা, অত করার দরকার নেই। একবার বললে ওদের ছোটমামাই তো আমায় গাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারে। আমি গেলে বাসেই যাব। এখনও আমার হাত-পা চলে। …তোমরা যাও, সিনেমা দেখে এসো।

শাশুড়ির স্বরে কি ব্যঙ্গ? নাকি কোনও ক্ষোভ? উষ্মা? পারমিতা ঠিক ঠিক বুঝতে পারছিল না। স্নানে ঢুকেও ভাবছিল কথাগুলো। শ্বশুরবাড়ির প্রতি কর্তব্য পালনে তার কি কোনও ফাঁক থেকে যাচ্ছে? মাঝে মাঝে কি তার শাশুড়িকে নিয়ে বেরোনো উচিত? আজ হয়তো পরিস্থিতির চাপে কথাটা উচ্চারণ করল, কিন্তু রাজা যাওয়ার পর একবারও কি বলেছে মুখ ফুটে? কী করবে পারমিতা, সপ্তাহের ছোটাছুটি করে এত ক্লান্ত থাকে, এত ক্লান্ত লাগে…! তবু… রাজা যখন ছিল, তখন কি রবিবারে বেরোত না? বন্ধুবান্ধবদের বাড়ি আড্ডা, রাতে বাইরে খাওয়া, সিনেমা-থিয়েটার, সবই তো চলত! আবার পরদিন হাঁপাতে হাঁপাতে কলেজ করেছে। করেনি? রাজার মামার বাড়িও ছুঁয়ে এসেছে অবরেসবরে। কিংবা অন্য কোনও আত্মীয়ের বাড়ি। রাজার সঙ্গে। রাজার গাড়িতে। কিন্তু তাতে কি শাশুড়িকে নিয়ে এখন না বেরোনোর দোষ স্খালন হয়? ক্লান্তির দোহাই পাড়াটা কি হাস্যকর শোনায় না?

বিশ্রী এক দোলাচল। পারমিতার মেজাজ ক্রমশ পানসে। খাওয়া দাওয়া সেরে যখন সাজতে বসেছে, তখনও মন বলছে, না বেরোলেই হয়, না বেরোলেই হত…। সারা সপ্তাহ পরতে হয় বলে ছুটিছাটায় শাড়ি দেখলেই অসহ্য লাগে, সালোয়ার সুটে কত আরাম, তবু শাড়িই পরল আজ। রানার বান্ধবীর সামনে বেশ চকমা দিয়ে হাজির হওয়ার বাসনা জেগেছিল, যৎসামান্য প্রসাধনেই থেমে গেল হাত।

বাইরে আকাশেরও আজ মুখ ভার। ঘন মেঘে ছাওয়া। শ্রাবণের মাঝামাঝি ফের ফিরেছে বর্ষা, রোজই এখন ঢালছে দু’-চার পশলা তবে তেমন জোরদার বারিধারার দর্শন মিলল না এখনও। শুধু মেঘই সার, ভ্যাপসা গুমোটে বৃষ্টি যেন উবে যায়।

যথাসময়ে বাইপাসের শপিংমলটায় পৌঁছেছে রানা-পারমিতা। পথে রানা চুপচাপই ছিল, গাড়ি থেকে নেমে হঠাৎই সে ব্যস্তসমস্ত। পারমিতাকে দাঁড়াতে বলে সাঁ ঢুকে গেল মলে। ফিরল এক শ্যামলা মেয়েকে নিয়ে। চেহারাটি বড়সড়, পরনে লো-কাট জিন্স, খাটো টপ। জিন্স আর টপের মধ্যে পক প্রণালী নয়, ভূমধ্যসাগরের ব্যবধান। এবং রঞ্জিত নাভিটি প্রবলভাবে প্রকট। হাইলাইট করা বাদামি চুল ঝাঁপ কাটছে মুখে, চোখের পাতা কালচে লাল, ঠোঁটে চড়া লিপস্টিক। চরণে স্টিলেটো। কানে পাকানো পাকানো ঝোলা দুল।

রানা পরিচয় করানোর আগেই মেয়েটি জড়িয়ে ধরেছে পারমিতাকে। গালে আলতো চুমু দিয়ে বলল,— আমি রঞ্জা। রঞ্জাবতী খাসনবিশ। তোমার কথা দেবর্ষির মুখে এত শুনেছি, এত শুনেছি…

পারমিতা বেশ হকচকিয়ে গেছে। বোকা বোকা হেসে বলল,— কী বলে? খুব নিন্দে করে বুঝি?

ওমা, না না, তা কেন…দেব তো তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তোমার মতো ব্রিলিয়ান্ট মেয়ে নাকি দুটো নেই, তুমি হেভি সুইট, দারুণ ডিউটিফুল…!

যাহ্, বাড়িয়ে বলে।

না গো, তোমায় দেখেই বোঝা যায় তুমি কত ভাল। কাঁধে হাত রাখল রঞ্জা। আহ্লাদি আহ্লাদি গলায় বলল,— তুমি তো আমাদের লাইনেই কলেজে পড়াতে যাও, তাই না?

কোথায় থাকো তুমি?

ঘোলা। সোদপুর। চেনো তো?

উম্। আমাদের অনেক স্টুডেন্ট ওদিক থেকে আসে।

উত্তরের অবশ্য প্রয়োজন ছিল না, রঞ্জা একাই বকে যেতে পারে একটানা। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে নিজের ঠিকুজিকুষ্টি উগরে দিল। কোন কলেজে পড়েছে, কী কী কোর্স করেছে, কবে প্রথম চাকরিতে ঢুকল, ক’টা চাকরি বদলে এখন সে কোন মোবাইল কোম্পানিতে কী পদে আসীন, দেবের সঙ্গে তার কোথায় আলাপ, দেব তখন কেমন লাজুক ছিল, দিদির গল্প, বাবা-মা’র সমাচার, কী না শোনাল! সব কথা মস্তিষ্কে ঠিকঠাক সেঁধোচ্ছিল না পারমিতার, এত তড়বড় করে রঞ্জা! তার মাঝেই ব্যাগ থেকে সিগারেট বের করে ধরিয়ে ফেলল, ওস্তাদ নেশাড়ুর মতো ধোঁয়া ছাড়ছে। অর্ধেকটা টেনে ফেলে দিল। তারপর পারমিতাকে বগলদাবা করে সোজা চারতলায়। রানা ভ্যাবলার মতো অনুসরণ করছে রঞ্জাকে। ঝটপট তিনখানা টিকিট কেটে ফেলল, অতঃপর চিপস-কোল্ডড্রিঙ্কস হাতে হলে প্রবেশ, এবং চলচ্চিত্র দর্শন। ভারী মজাদার ছবি। শ্লেষ-বিদ্রূপে বোঝাই। কিন্তু পারমিতা দেখবে কী, এমন সশব্দে হাসে রঞ্জা! সে হাসি থামতেই চায় না। প্রায় জনশূন্য শীতল প্রেক্ষাগৃহ যেন কেঁপে কেঁপে ওঠে!

শেষ হতেই ফুডকোর্ট। আস্ত একখানা পিৎজা খেল মেয়েটা, সঙ্গে দু’খানা ব্রাউনি। রানা আর পারমিতা বারগার নিয়েছে। খুঁটছে পারমিতা, আর চোরা চোখে ঘড়ি দেখছে। কখন যে ছাড়া পাবে!

এক সময়ে রঞ্জাবতী টয়লেটে যেতেই রানা ব্যগ্র স্বরে প্রশ্ন করল,— কেমন দেখলে?

পারমিতা ঠোঁট টিপে হাসল,— মন্দ কী!

খুব লাইভলি না?

একটু বেশিই প্রাণবন্ত! কইমাছের মতো খলবলে! ধরলে না কাঁটা ফোটে!

পারমিতা হেসেই বলল,— হ্যাঁ, সে তো বটেই।

তা হলে বাবা-মাকে কনভিন্স করার ভারটা তোমার?

আজই বলতে হবে?

তা কেন, টেক ইয়োর টাইম। তবে আমরা কিন্তু জলদি রেজিস্ট্রিটা সেরে ফেলছি। তোমাকে বিয়েতে উইটনেস থাকতে হবে।…পাক্কা?

কোনওমতে পারমিতা হাসিটা ধরে রাখল। আর বাতচিত হল না তেমন। রঞ্জাবতীকে ছেড়ে এক্ষুনি এক্ষুনি নড়ার লক্ষণ নেই রানার, একাই উঠে পড়ল পারমিতা।

গাড়িতে চেপেই রাজাকে ফোন লাগিয়েছে। ওপারে রাজার গলায় লঘু সুর,— সাঁঝবেলায় আহ্বান কেন সখী?

এখনও কি অফিসে…?

এবার বেরোব।…তোমার তো আজ মস্তির দিন। এনজয় করছ নিশ্চয়ই?

এনজয় বলে এনজয়! আজ রানার সঙ্গে বেরিয়েছিলাম।

রানা? অফ অল দা পারসন্‌স?

হুম্। ওর ফিঁয়াসের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল।

হোয়াট? রানা প্রেমে পড়েছে?

হাবুডুবু। কী মুগ্ধ নয়নে তাকিয়েছিল তুমি ভাবতেও পারবে না।

দেখতে কেমন মেয়েটা?

তোমার বউয়ের মতো নয়। রীতিমতো জাঁদরেল। রানাকে বনবন ঘোরাবে। ড্রাইভারকে আড়ে দেখে নিয়ে পারমিতা গলা নামাল,— খুব হেপ্ মেয়ে। কী স্মার্টলি স্মোক করছিল!

আজকাল তো মেয়েরাই সিগারেট খায়। ফ্যামিলিটা কেমন?

মিডল ক্লাস। বাবার ওষুধের দোকান। সোদপুর বাজারে। দিদি শাদিশুদা।

ভালই তো।

কিন্তু মেয়েটা বড্ড চুলবুলে। কী লাউডলি হাসে, বাপ্‌স!

বুঝেছি। এক্সট্রোভার্ট টাইপ। এরা কিন্তু বেসিকালি সরল হয়।

পারমিতারও রঞ্জাকে তেমন জটিল মনে হয়নি। তবু বলল,— তোমাদের বাড়িতে কি ওই মেয়ে চলবে? যা ড্রেস-ট্রেস…দেখে বাবা-মা না ভিরমি খায়।

তাতে তোমার কী এল গেল? বাবা-মা বুঝে নেবে।

কিন্তু…রানা যে এদিকে আমাকেই উকিল পাকড়েছে!

খবরদার না। রাজা হঠাৎই গম্ভীর,— তুমি এসবে একদম থাকবে না।

কেন?

যদি পরে ভালমন্দ কিছু হয়, তখন তো তোমার দিকেই আঙুল উঠবে।

আমার ধারণা…ওই মেয়ে রানার চলবে না।

সেটাও রানাকেই বুঝতে দাও।

বা রে, তোমার ভাই যদি পরে মুশকিলে পড়ে…

তাকে নিজেকেই আসান করতে হবে। তুমি তখন বড়জোর একটা ভাল ল’ইয়ার ধরে দিতে পারো।

রাজার বলার ভঙ্গিটা পছন্দ হল না পারমিতার। বড় বেশি কর্তা কর্তা ভাব। এখন যদি পারমিতা বলে রানা তাকে বিয়ের সাক্ষী করতে চাইছে, চটে লাল হয়ে যাবে নির্ঘাত। আরও কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু রানাও যে বড় মুখ করে অনুরোধ করল, তাকে না বলাটা কি শোভন দেখায়? তা ছাড়া পারমিতা কোন ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাও কি রাজা বেঙ্গালুরু থেকে রিমোট কনট্রোলে স্থির করে দেবে?

কী হল? ফের রাজার গলা,— চুপ মেরে গেলে যে?

ভাবছি। তোমার ভাই আজ সত্যিই জব্বর সারপ্রাইজ দিয়েছে।

আমিও একটা দিতে পারি। রাজার গলা অনেকটাই তরল আবার,— অ্যান্ড আই বেট, সেই সারপ্রাইজটাও তোমার কল্পনাতে নেই।

কী গো? কী? কী?

ধীরে সখী, ধীরে…। দেখতেই পাবে।…অ্যাই শোনো, একটা কল আসছে, এখন ছাড়ছি। রাত্তিরে ফোন করব।

আলাপ ছিন্ন হল। গাড়ির চালে বৃষ্টির শব্দ। অবশেষে আকাশ ভাঙল বোধহয়। বন্ধ কাচের ওপারে ঝাপসা হয়ে এল পৃথিবীটা।

পারমিতার গা ছমছম করছিল হঠাৎ। আবার কী সারপ্রাইজ দেবে? আবার একটা প্রোমোশান? নাকি নতুন চাকরি? আরও কি দূরে চলে যাবে রাজা?

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *