শাপলা ট্রাভেল এজেন্সির সাইনবোর্ড দেখেই ডাঃ বারী বলে ওঠে, আরে, এখানে নাকি? মেয়ে কার? আলি সাহেবের?
ডাঃ ইউনুস ভাইয়ান ফর্সা মানুষ। লজ্জায় রাঙ্গা হলে সহজে বুঝা যায়। সেটা গোপন করবার ব্যর্থ চেষ্টা করে সে বলে, হাঁ। বড় মেয়ে।
আশ্চর্য, ফি বছর টিকিট নিচ্ছি আলি সাহেবের কাছ থেকে, একবারও তো শুনি নি, মেয়ে আছে।
যুক্তিটা দুর্বল। টিকিট নিলেই টিকিটদাতার পারিবারিক সব খবর ক্রেতার জানা হয়ে যাবে, বা হওয়া উচিত, এটা কোনো কথা নয়। বারী নিজেও সেটা অন্য সময় হলে বুঝত। কিন্তু, প্রতি বছর সে দেশে গেছে পাত্রী খুঁজতে, সে পরিপ্রেক্ষিতে এখানকার এই আবিষ্কার সত্যি তাকে ক্লিষ্ট করে। রুহুল কুদুস একবারে পাশ করেছে, সে পারে নি, দুপুরে সেটা মনে করেও এখনো বুকের ভেতর খচখচ করছে।
গাড়ি থামিয়ে বারী গম্ভীর মুখে বেরিয়ে আসে। ভাইয়ান থেকে দূরত্ব বজায় রাখে। ভাইয়ানের একবার মনে হয়, তাকে না বলে এতদূর টেনে আনাটা বোধহয় ঠিক হয় নি। লোকটা সত্যি সত্যি রাগ করেছে। পুষিয়ে দেবার জন্য সে খুব চটপটে হয়ে বলে, বেশিক্ষণ বসব না। এক নজর দেখা, এই তো! আপনার ওপর খুব ডিপেন্ড করছি। আপনিই দেখবেন, আপনি বললে করব, নইলে নয়।
তেলটাতে বিশেষ কাজ হয় বলে মনে হয় না। বারী প্রায় স্বগতোক্তির মতো উচ্চারণ করে, আমি নিজের ওপর স্বয়ং নির্ভর করতে পারি না।
পাশাপাশি দুটো দরোজা। বাড়ির ভেতরের ওপর তলায় যাবার দরোজাটা নিরেট কাঠের। তার পাশেই আপিসে ঢোকার দরোজা স্বচ্ছ কাচের। ভাইয়ান বারীকেই সমুখে ঠেলে দেয়। আপিস থেকেই মিষ্টার আলি দেখতে পেয়েছিলেন ওদের। স্বাভাবিক পরিস্থিতি হলে সাগ্রহে উঠে এসে আপ্যায়ন করে ভেতরে আনতেন, এখন ওদের দেখা মাত্র তার মনে হলো, যদি পালিয়ে যেতে পারতাম। ইয়াসমিনের অনুপস্থিতির কী ব্যাখ্যা দেবেন বহু ভেবেও তা ঠিক করে উঠতে পারেন নি। শেষে ভবিষ্যতের হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন নিজেকে। এটুকু স্থির করেছেন, ইয়াসমিন বাড়িতে নেই বলবেন, বাকিটা অবস্থা দেখে বানিয়ে নেবেন।
এই মুহূর্তে তার মনে হলো কাগজপত্র নিয়ে ব্যস্ত থাকাই ভালো। তিনি কাচের দরোজার ওপারে ওদের দেখেই বিরাট এক ফাইল খুলে বসেন।
দরোজা ঠেলে প্রথমে ঢোকে বারী, পেছনে ভাইয়ান।
বারীকে দেখে অবাক হন আলি। ভাইয়ানের দিকে চোখ যেতে চায় তার, তিনি শাসন করে রাখেন। হাত বাড়িয়ে দেন বারীর দিকে।
আরে, আপনি, আসসালামুআলাইকুম, আসুন, আসুন। ভালো আছেন? ম্যানচেস্টারেই আছেন? এমনভাবে কথা বলেন তিনি যেন দ্বিতীয় আর কেউ নেই সেখানে।
বারী পরিচয় করিয়ে দেয়।
ইনি আমার বন্ধু ডাঃ ইউনুস ভুইঞা, বেলশিলে থাকেন।
মিস্টার আলি একটা মিথ্যা কথা বলেন, ও তাই তো! আপনার আসবার কথা, অপেক্ষাও করছি, অথচ বুঝতে পারি নি। বারী সাহেবকে দেখে মনে করেছি, টিকিটের ব্যাপার কি দেশেটেশে যাচ্ছেন, জিনিস কেনা কাটা আছে। বসুন, বসুন।
দুজনে বসে। আপিসের এক পাশে জোড়া একটা সোফা, সেখানেই বসে তারা। মিস্টার আলি ফাইল বন্ধ করে ক্যাবিনেটে তুলে রাখতে রাখতে বলেন, ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ, ডাক্তার সাহেব।
দুজনেই ডাক্তার, তবু বুঝতে কষ্ট হয় না, উদ্দিষ্ট হচ্ছে ডাঃ বারী।
ভাইয়ান তখন থেকে মুখে একটা স্থির বিস্তৃত হাসি ঝুলিয়ে বসে আছে। বসে আছে কিন্তু স্বস্তি নেই, একবার পা লম্ব করছে, ভালো লাগছে না; পা ভাজ করছে, আরাম বোধ হচ্ছে না; আবার ডান দিকে একটু কাত হচ্ছে, হাতলে লাগছে; তখন আবার সোজা হচ্ছে; আবার গোড়া থেকে শুরু করছে।
বারী বলে, কেন খারাপ কেন?
আলি এসে চেয়ার টানেন, টেবিলে এক হাত রাখেন, ঠেস দিয়ে বসেন।
খারাপ হবে না? দেশে লোক যাচ্ছে কোথায়? সবাই তো আসছে। বাংলাদেশ থেকে এখানে আসছে। ফেরত যাবার সংখ্যা দিনকে দিন কমে যাচ্ছে, ডাক্তার সাহেব। আমরা তো এই ব্যবসাই করি, স্ট্যাটিকটিক্স আমাদের কাছে আছে।
বারী যতখানি চিন্তিত নয়, তার চেয়ে বেশি চিন্তিত মুখ করে বসে থাকে। একটু পর বলে, উনি বেলকিশ থেকে আসছিলেন, পথে আমাকে তুলে নিলেন। আমি কিছু জানতাম না।
ও।
তাও উনি ওখানে আমাকে কিছু বলেন নি। পথে শুনলাম। তা আপনার ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে, আবার ঠিক হয়ে যাবে। ব্যবসায় ওঠানামা তো আছেই। কী বলেন ডাক্তার সাহেব? ভাইয়ান হকচকিয়ে তাড়াতাড়ি জবাব দেয়, হাঁ, তাতো বটেই।
দু মিনিটও হয় নি, এর ভেতরই অধির বোধ করছে সে। কখন মেয়ে দেখা যাবে? ভেতরে নিয়ে যাবে? না এখানেই দেখাবে? মেয়ের সঙ্গে আলাদা একটু কথা বলা যাবে তো? মেয়ে স্বয়ং না হোক, মেয়ের ছোট বোন দুটিকেও একবার দেখা যাচ্ছে না কেন? পাত্র বাড়িতে এসেছে, তাদের কি কোনো কৌতূহল নেই!
আলি দু হাতের করতল চিৎ করে বলেন, এবার নামারই পালা, বুঝলেন? বাংলাদেশের যা পরিস্থিতি আপনি তো প্রত্যেক বছরই যাচ্ছেন, আপনিই ভালো বলতে পারবেন মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এতদিন শিক্ষিতলোক, দেশের উপকারে আসবে, এই জানতাম, এখন। দেখছি, শিক্ষিত হলেই বাইরে ছোটে না। আর শিক্ষিতদেরই বা দোষ দেই কেন? মিডিল ইস্টে আপনার কী বলে, সাধারণ লোক, মজুর, ড্রাইভার, বাবুর্চি ছুটছে না?
বারী এখানে বাধা দেয়।
একটা তফাত আছে আলি সাহেব। ওরা যারা যাচ্ছে, দেশে গিয়ে তো কয়েকবারই দেখলাম, দু হাতে টাকা উপার্জন করে, জিনিসপত্র কিনে দেশে ফিরছে, দেশে জমি কিনেছে, বাড়ি কিনেছে। আর শিক্ষিত লোক, তারা রোজগার করে বিদেশেই খরচ করছে, বিদেশেই বাড়ি গাড়ি করছে। আমরাই বা কী করছি? এই যে ভাইয়ান সাহেব, তা আপনার দশ বছর হয়ে গেল না? আমার তো তারো বেশি, আমরা এখানে পড়ে আছি, দেশে যাব, দেশে গেলে আমারই সমসাময়িক ডাক্তারেরা সব পোস্ট দখল করে বসে আছে, কেউ মন্ত্রী হয়েছে, কেউ গুলশানে বাড়ি টাড়ি করে ফেলেছে, আমরা গেলে কনুই মেরে বার করে দেবে, দেশে যাচ্ছি না তা আপনার কথাই ঠিক, দেশে কেউ আর ফিরে যাচ্ছে না।
বারীর ধারণা, এবং তার আশেপাশের বন্ধু বাঙালি ডাক্তারদের ধারণা, সে খুব বলিয়ে কইয়ে লোক, রাজনীতিও খুব ভালো বোঝে। তাই ভাইয়ানের মতো অনেক ডাক্তারই তাকে কাজ কর্মে সঙ্গে রাখে। তার কথার তোড়ে গরম বোধ করে। আসলে, বারী যে এক কথা থেকে আরেক কথায় লাফ দিয়ে যায়, দুটো কথার ভেতরে যুক্তির ফাঁক গমগমে আওয়াজ দিয়ে ভরিয়ে দেয়, এটা হঠাৎ কারো চোখে পড়ে না। তার কথায় শেষে সকলেই, বুঝুক আর না বুঝুক, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাতে হয়।
অভ্যেস বশে ভাইয়ানও চিন্তিত মুখ সৃষ্টি করে।
আলি সেটা লক্ষ করেন। তার চৈতন্য হয়, মেয়ে দেখতে এসেছে, দেরি হয়ে যাচ্ছে, আর মোটেই শোভন দেখাচ্ছে না।
আরো কিছু সময় নেবার জন্যে, পরিস্থিতি সামাল দেবার উপায় ভেবে নেবার জন্যে আলি এই আলোচনার জের টেনে বলেন, গুলশানের কথা বলছিলেন, ডাক্তার সাহেব। সেদিন এক ভদ্রলোকের সঙ্গে বিমান আপিসে দেখা। মাস তিনেকের জন্য এসেছেন। ইউনিভার্সিটিতে পড়ান। তিনি এক কথা বললেন।
বারী ভ্রূ তুলে অপেক্ষা করে। দেয়ালে প্যান আমিরিকান-এর এক পোস্টারে সহাস্য এক তরুণীর জীবন্ত ছবি দেখে অজান্তে তার হাত উঠে যায় টাকে। বার দুয়েক বুলিয়ে নেয়। আলি বলেন, সেই ভদ্রলোক বলছিলেন, গুলশানে আর একটি বাড়িও থাকবে না।
কেন?
পাবলিক একটা একটা করে ইট খুলে নেবে। বেশিদিন আর বাকি নেই।
রেভেলেউশন তো একটা হওয়া দরকার, আলি সাহেব। তবে, হবে বলে আমার মনে হয় না। বাঙালিকে কিছুটা চিনি তো? হোটেলের সামনে ফেলে দেওয়া খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করবে, হোটেলে ঢুকে কেড়ে খাবে না। এই হচ্ছে আপনার বাঙালি। নাহ্, আপনার ভদ্রলোকের কথা মানতে পারলাম না। হলে তো ভালোই।
ভাইয়ান এবার স্থির হয়ে গেছে। প্রথম ঢুকেই যে উত্তেজনা বোধ করছিল, কিছুতেই শান্ত হয়ে বসতে পারছিল না, এখন সে যেন অন্ধ নিয়তির হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছে।
আলি উঠে দাঁড়ান।
ওপরে একটা খবর দিয়ে আসি।
ডাঃ ইউনুস ভাইয়ানের বুকের ভেতরটা ধ্বক করে ওঠে। ট্রাউজারের ভেতরে শিরশির করতে থাকে। একাধিক শ্বেতাংগিনীর সাহচর্য পাবার পরও, তার নিজেরই বিশ্বাস হয়ে যায়, সে এখনো কুমার।