ভিনসেন্ট প্রস্তাব করে, প্রকৃতপক্ষে ইয়াসমিন আজ নবজন্ম গ্রহণ করিল। সে আমাদের মধ্যে। আসিল। আইস আমরা আনন্দ করি।
মেঝের ওপর বসে দেয়ালে ঠেস দিয়ে পিটার তখন থেকে কোকোর গালে চুমো খাচ্ছিল। ভিনসেন্টের প্রস্তাব শুনে সে তার আনন্দময় কাজে ক্ষণকালের বিরতি দিয়ে বলে, তাহার পূর্বে জন্মগ্রহণের অনুষ্ঠান সম্পাদিত হওয়া আবশ্যক।
কোকো পিটারের গালে চুমো দিয়ে সমর্থন জানায় এবং তার দুই উরুর ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে বলে, শীত করিতেছে। উষ্ণতা ধার লইতেছি।
পিটার কোমল হাতে কোকোকে ছাড়িয়ে এবার উঠে দাঁড়ায়। ঊর্ধ্ববাহু হয়ে ঘুরে ঘুরে সে বলে, বন্ধুগণ, ইয়াসমিন এখন জন্মগ্রহণ করিবে।
সকলে এমনকি ইয়াসমিন নিজেও হাততালি দিয়ে ওঠে।
উত্তম, উত্তম প্রস্তাব।
অলবানি স্ট্রীটের এই বিশাল তেতলা বাড়িটি বহুদিন খালি পড়েছিল। লন্ডনে এমন বহু বাড়ি আছে, কোনো কারণে খালি। প্রধান একটা কারণ, মালিক বেশি ভাড়ার আশায় ফেলে। রাখে। আরেকটা বড় কারণ, পুরনো বাড়ি ভেঙ্গে নতুন বহুতল দালান ওঠানোর অনুমতি পাওয়া নিয়ে আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে টানাহেঁচড়া চলে, সেই অবসরে বাড়িটি থাকে খালি পড়ে।
কিছুদিন থেকে একটা হাওয়া বইছে। কিছু তরুণ-তরুণী, কিছু দম্পতি একসঙ্গে মিলে এই সব বাড়ি দখল করে বিনাভাড়ায় বাস করছে। তরুণ-তরুণীদের আধকাংশই এক ধরনের আদিম ও মৌলিক জীবনযাত্রায় বিশ্বাসী। এরা যতদিন পারে সরকারের কাছ থেকে বেকার ভাতা নেয়। যখন বেশি চাপ আসে একটা কোনো কাজ জুটিয়ে নেয়, রেস্তোরার কাজ, রাজমিস্ত্রির জোগানদারের কাজ, দেয়ালে রঙ বা কাগজ লাগাবার কাজ, বড়লোক বাড়ির বাগান পরিষ্কার রাখবার কাজ। বিধিবদ্ধ সামাজিক জীবন-যাত্রার প্রতি এদের চূড়ান্ত বিতৃষ্ণা। যে-কোনো আচার বা আনুষ্ঠানিকতা এদের চোখের বিষ। একে অপরের জিনিস ভাগ করে ব্যবহার করে, প্রায়ই জোড়া পাতিয়ে নেয়; স্বামী-স্ত্রীর মতো বাস করে, কখনো খায় কখনো খায় না। নিয়মিত গ্রহণের ভেতরে গাঁজা বা চরস জাতীয় কিছু।
ইয়াসমিনের বন্ধু এবং বান্ধবীদের ভেতরে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ যে কয়েকজন, তারা সকলেই। একে একে লেখাপড়া ছেড়ে, বাবা বা মায়ের বাড়ি ছেড়ে অলবানি স্ট্রীটের এই বাড়ির তেতলায় এসে জায়গা নিয়েছে আজ বেশ কয়েক মাস। নিচের দুটি তলাতেও এ ধরনের। কিছু দল আছে। আসলে, আগে থেকে যারা পরিচিত, তারা এখানে এসেও সূত্রটা রক্ষা করে বলে ছোট ছোট দলে তারা ভাগ করা মনে হয়। সবাই আবার এক সঙ্গে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন বসে বাড়ির ভালোমন্দ, পানি বিজলী নিয়ে আলোচনা করে। পুলিশি উৎখাত উৎপাতের মোকাবেলা করা যায় কী করে, আলাপ করে।
মায়ের কাছে বন্ধুর জন্মদিনের কথা মিথ্যে বলে ইয়াসমিন সোজা চলে আসে অলবানি স্ট্রীটের তেতলায়। তাকে দেখে হৈচৈ করে ওঠে পিটার, ভিনসেন্ট, জো, গ্যাবি, কোকো, প্যাম, এমনকি স্বভাবতই যে চুপচাপ থাকে, রাতে গোরস্তানে গিয়ে গিটার বাজায়, সেই মার্ক পর্যন্ত খুশি হয়। এরা সকলেই এক ইস্কুলে পড়াশোনা করত। এদের দলে এতদিন নাম লেখায় নি কেবল ইয়াসমিন।
সন্ধে বেলায় এসে প্রথমে সে বলে নি, বাড়িতে আর ফিরবে না বলেই সে এসেছে। সমস্ত সন্ধে-রাত, দুপুর-রাত পর্যন্ত ধোঁয়ায় ধোঁয়াকার হয়ে যাবার পর, গ্যাবি আর ভিনসেন্ট, কোকো আর পিটার, প্যাম আর জো, একে অপরের কাঁধে মাথা রেখে জুটি বেঁধে যাবার পর ইয়াসমিন ভীষণ একা বোধ করতে থাকে। তার একবার মনে হয়, বাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু এদের মুক্ত এই জীবন তাকে আয়নার মতো আকর্ষণ করে রাখে। দূরে, একা, আপনমনে গিটার বাজাচ্ছিল মার্ক। সে ধীরে এগিয়ে আসে ইয়াসমিনের কাছে এবং একটি মাত্র বাক্য উচ্চারণ করে বন্ধুদের সান্নিধ্যে নিঃসঙ্গ বোধ করিও না। তারপর আর কিছু না বলে গিটার নিয়ে কিছুক্ষণ টুংটাং করে খসখসে গলায় গান ধরে মার্ক। কথাগুলো ইয়াসমিনকে স্থির সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
অদ্যই আগামীকাল, আগামীকালই অদ্য। জনুই মৃত্যু এবং মৃত্যুই জীবন। সম্পদই দারিদ্র্য দারিদ্রাই সম্পদ। বন্ধু উপলব্ধি করিলেই তুমি আমার বন্ধু। তোমারও স্থান আছে হেঁড়াকোটের তলায়।
মানুষের চোখে চোখ— ইন্দ্রজাল। জলের গভীরে মাছ ইজাল। শব্দের অতলে নীরবতা— ইন্দ্রজাল। বন্ধু, কোলাহল থামলেই তুমি আমার বন্ধু। তোমারও স্থান আছে হৃদয়ের আগুনের পাশে।
সারারাত ঘুমের ভেতরেও গানটি শুনতে পায় ইয়াসমিন। সকালে জেগে উঠে নিজেকে যখন সে আবিষ্কার করে তারা সকলে মেঝের ওপর গোল হয়ে ঘুমিয়ে আছে তখন সে আপন মনেই বলে ওঠে, ইহা সুন্দর, ইহা কী সুন্দর!
তারপর ঘুম থেকে উঠে সবাই গোল হয়ে যোগাসন করতে বসে। ইয়াসমিনের অভ্যেস নেই, তবু সেও তাদের অনুকরণ করে। ভিনসেন্টের নেতৃত্বে আধঘণ্টা ধ্যান শেষ হবার পর ইয়াসমিন সোজা উঠে গিয়ে তাকে বলে, এই আমার বাসগৃহ। আমাকে তোমরা গ্রহণ করিবে?
ভিনসেন্ট ঘোষণা করে, হাততালি থেমে যাবার পর, অতঃপর ইয়াসমিন জন্মগ্রহণ করিবে। আমরা সেই স্বর্গীয় দৃশ্য প্রত্যক্ষ করিব।
এই দলটির প্রধান হিসেবে ভিনসেন্টকে সকলেই মান্য করে। বয়সেও সে সকলের চেয়ে বড়। তার বাবার অবস্থাও অত্যন্ত ভালো। বাবা বিলেতের সবচেয়ে নামকরা স্থপতি। ভিনসেন্টের মতে, তিনি মানুষের জন্যে কারাগার নির্মাণ করেন। উন্মুক্ত আকাশ নির্মাণ করিবার ক্ষমতা তাহার নাই।
ভিনসেন্ট এখন অনুষ্ঠানটির নেতৃত্ব দেয়। দলনেতা হিসাবে সে তার জুটি গ্যাবিকেই জননী হিসাবে মনোনয়ন করে।
ভিনসেন্ট ঘোষণা করে, তোমরা দেয়াল ঘেঁষিয়া চক্রাকারে উপবেশন কর। পদ্মাসনে তন্তয় হও। অতঃপর, গ্যাবি, এই রমণী, বিশ্বজননী হইল। ইয়াসমিন, নিকটে আইস। তুমি কি এই রমণীকে চিনিতে পার?
ইয়াসমিন ঠিক বুঝতে পারে না, কী তার উত্তর হওয়া দরকার। সে নিজেকে তুচ্ছ ও অসহায় বোধ করতে থাকে।
ভালো করিয়া অবলোকন কর। অনুমান হয়?
গ্যাবি গোল চক্রের মাঝখানে ধ্যাননেত্রে বসে আছে। তার কাঁধের দু পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়েছে সোনালি দীর্ঘচুল। মুখখানি একই সঙ্গে কোমল ও কঠিন বলে মনে হচ্ছে। ইয়াসমিন হঠাৎ যেন এতদিনের চেনা গ্যাবিকে চিনে উঠতে পারে না। মুহূর্ত কালের জন্যে তার ভয় হয়। সে পাশে তাকাতেই মার্ক হামাগুড়ি দিয়ে কাছে এসে তার কানে কানে বলে, বল, হাঁ, চিনিতে পারিতেছি। ইনিই আমার গর্ভধারিণী।
হাঁ, চিনিতে পারিতেছি, ইনিই আমার গর্ভধারিণী।
সন্দেহ নাই?
ইয়াসমিন অনুষ্ঠানের মাদকতায় প্রতিধ্বনি করে ওঠে, সন্দেহ নাই।
ভিনসেন্ট চোখ বুজে গম গম গলায় উচ্চারণ করে, তবে গর্ভে প্রবিষ্ট হও।
ইয়াসমিন আবার অপ্রতিভ বোধ করে। কী কর্তব্য অনুমান করতে পারে না। এদের উপযুক্ত সে এখনো নয়, তাকে ক্লিষ্ট করে ফেলে।
ভিনসেন্ট নিমিলীত চোখেই বলে, ক্ষণকাল অপেক্ষা করবার পর, বালিকাগণ, তোমাদের কি কর্তব্যবোধ নাই? তোমাদের ভগ্নীকে সাহায্য করিবার কোনো প্রেরণাই কি বোধ করিতেছ না?
চঞ্চল হয়ে ওঠে প্যাম, কোকো। তারা জো আর পিটারের পাশ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসে ইয়াসমিনের কাছে। ইঙ্গিতে তাকে উঠে দাঁড়াতে বলে। বসে থাকা প্রত্যেকের দিকে চোখ না ফিরিয়েও ইয়াসমিনের মনে হয়, সে ভীষণ লম্বা হয়ে গেছে। তার সংকোচ বোধ হয়। কিছুক্ষণ পর অতি ধীর গতিতে উঠে দাঁড়ায় কোকো আর প্যাম। নিঃশব্দে তারা ইয়াসমিনের দেহ থেকে একে একে সোয়েটার, জামা, লম্বা স্কার্ট স্নেহের সঙ্গে খুলে ফেলতে থাকে। ইস্কুলে সাঁতার কেটেছে, যদিও বাবা জানলে তাকে সাঁতার কাটতে দিতেন না ঐ সংক্ষিপ্ত পোশাকে, এ ছাড়া প্রকাশ্যে অনাবৃত হবার অভিজ্ঞতা তার নেই। মুহূর্তের জন্য একবার মনে হলো, তার ভীষণ লজ্জা করবে। কিন্তু একে একে যখন সমস্ত কিছু পায়ের। কাছে লুটিয়ে পড়ল, তখন বিন্দুমাত্র মনে হলো না, সে উলঙ্গ। নগ্নতার উপলব্ধি যদি কিছুটা হয়ে থাকে তো শীতবোধেই তা সীমিত। তার নিজের মনে হয়, লজ্জায় নয় শীতের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্যে দুহাত বুকের ওপর গুটিয়ে আনে এবং দু হাঁটুর ভেতরে মুখ গুঁজে দেয়।
সে কাঁধ গুটিয়ে বসে পড়তে গিয়েও, পাছে কিছু ত্রুটি হয়, বসে না।
ভিনসেন্ট নির্দেশ উচ্চারণ করে, প্রবিষ্ট হও।
তার সেই কণ্ঠস্বরের অভিঘাতেই যেন ইয়াসমিন উপুড় হয়ে বসে পড়ে। তার মাথার ভেতরে ঝিম ঝিম করতে থাকে। ভোরে উঠেই এক প্রস্থ ধোঁয়া গেলার পর যা মনে হয় নি, এখন নিজেকে অস্বভাবিক রকমে নির্ভার ও অবাস্তব বলে বোধহয় তার।
ইয়াসমিন কাত হয়ে শুয়ে পড়ে। শিশুর মতো তার পা ভাঁজ হয়ে আসে বুকের কাছে, তার ফাঁকে দুহাত গুঁজে দেয় সে। ঠোঁট নীল হয়ে যায় শীতে ও উত্তেজনায়। ঠোঁট থর থর করে কাঁপতে থাকে।
ইয়াসমিন প্রবিষ্ট হও।
ইয়াসমিন তার দুপাশে কিছু একটার উপস্থিতি অনুভব করে। চোখ খুলে দ্যাখে গ্যাবি যে এতক্ষণ পদ্মাসনে বসেছিল, এখন সে দুপা ছড়িয়ে ইয়াসমিনের দুদিকে মেলে দিয়েছে। তখন তার পাশ থেকে সরে গেছে প্যাম আর কোকো। তারা ফিরে গেছে জো আর পিটারের কাছে। যার যার জুটির হাত শক্ত মুঠোয় ধরে তারা বিস্ফারিত চোখে স্থির তাকিয়ে আছে ইয়াসমিনের দিকে।
ধীরে ধীরে গ্যাবি এগোয়। বসে বসেই সে এগিয়ে এসে দুপায়ের ভেতরে ইয়াসমিনের মাথাটা সম্পূর্ণ নিয়ে নেয়। তারপর নিজের লম্বা স্কার্ট দিয়ে ঢেকে দেয় তার মাথা, কাঁধ, পিঠ। ক্রমশ ইয়াসমিনের পুরো দেহে ঢাকা পড়ে যায় গ্যাবির ঢিলে স্কার্টের তলায়।
মার্ক তার গিটারে ঝনঝনাৎ করে অপ্রত্যাশিত এবং ক্ষণস্থায়ী আওয়াজ তোলে।
ইয়াসমিন, তুমি এখন কোথায়?
এইখানে।
বিশ্বজননীর গর্ভে?
সকলে একসঙ্গে মন্ত্রের মতো প্রতিধ্বনি করে, বল, হাঁ, বিশ্বজননীর গর্ভে।
হাঁ, বিশ্বজননীর গর্ভে।
তুমি কি গর্ভের উষ্ণতা বোধ করিতেছ?
এবার সমবেত সকলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ইয়াসমিন বলে–হাঁ, গর্ভের উষ্ণতা বোধ করিতেছি।
তোমার কি ভ্রূণাবস্থা?
হাঁ, আমার ভ্রূণাবস্থা।
তোমার কি হস্তপদ আছে?
না, আমার হস্তপদ নাই।
তোমার কি চক্ষু আছে?
না, আমার চক্ষুও নাই।
ভিনসেন্ট এবার আদেশ করে, তুমি প্রার্থনা কর–আমাকে ভ্রুণ হইতে পূর্ণদেহ কর যাহাতে দেহের সমস্ত সম্ভাবনা আবিষ্কার করিতে পারি, আমাকে হস্তপদ প্রদান কর যাহাতে নির্মাণ ও অতিক্রম করিতে পারি, আমাকে চক্ষু দাও যাহাতে বন্ধুকে অবলোকন করিতে পারি। তুমি ভূমিষ্ঠ হও।
সঙ্গে সঙ্গে ইয়াসমিন টের পায় গ্যাবির পা দুখানা তার গলা জড়িয়ে ধরেছে। প্রথমে সে গুরুত্ব দেয় নি, ক্ষণকাল পরে কণ্ঠনালীর ওপর পায়ের সবল চাপ অনুভব করে সে। গ্যাবির স্কার্টের ভেতর তার সমস্তটা শরীর, ফলে নিঃশ্বাস নেয়া আরো কঠিন হয়ে পড়ে। সে ছটফট করতে থাকে। আর্তনাদ করে ওঠে। গ্যাবি আরো জোরে পীড়ন করতে থাকে তাকে। সে তখন নিজেকে মুক্ত করে নেবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করে, গ্যাবির স্কার্টের তলা থেকে বেরিয়ে আসবার জন্যে শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে।
মুহূর্তেই সে বেরিয়ে আসে গ্যাবির স্কার্টের ভেতর থেকে। বেরিয়ে মেঝের উপর নগ্নদেহে পড়ে থেকে সে হাঁপায়। সকলে একসঙ্গে আহ ধ্বনি করে ওঠে। প্যাম একটা কম্বল দিয়ে ঢেকে দেয় ইয়াসমিনকে।
ভিনসেন্ট ঘোষণা করে— বালিকার জন্ম হইয়াছে। সে এখন শায়িত আছে। ক্ষণকাল পরে সে যৌবনপ্রাপ্ত হইবে এবং আমাদের আনন্দে অংশগ্রহণ করিবে।
ইয়াসমিন উপলব্ধি করে, মায়ের পেট থেকে বেরুবার অভিনয় সে এইবার করে উঠল।
গ্যাবি পা দিয়ে চেপে ধরায় অভিনয় যে জীবন্ত হয়, এতে সে আমোদ বোধ করে এখন। বন্ধুদের সঙ্গে নিবিড় আত্মীয়তা বোধ করে।
ভিনসেন্ট বলে, আজ আমরা দিবস ও রজনী আনন্দ করিব। ইয়াসমিন, উঠ, বস্ত্র পরিধান কর। তুমি এখন যথার্থই আমাদের হইলে।
ইয়াসমিন উঠে বসে প্যামের দিকে হাত বাড়ায়— আমার শার্ট কোথায় রাখিয়াছ?
উহা এখন পরিতে পারিবে না। ভিন্ন পোশাক পরিতে হইবে।
আমি যে দ্বিতীয় বস্ত্র সঙ্গে আনি নাই। মাহজাবীনকে বলিয়া আসিয়াছি, সে যদি পারে আমার কিছু কাপড় ও জিনিস দিয়া যাইবে।
তবে এখনকার মতো আমার জীনস পরিয়া লও।
ইয়াসমিন কম্বল গায়ে উঠে দাঁড়ায়। পাশের ঘরে গিয়ে প্যামের হাত থেকে জীনস নেয়।
প্যাম বলে, তোমার জন্মগ্রহণ সুন্দর হইয়াছে।
অদ্ভুত মনে হইলেও অনুষ্ঠানটির সৌন্দর্য আছে।
ইহা ভিনসেন্টের উদ্ভাবনা। সে বলে, আচার অনুষ্ঠান ভিন্ন দলীয় সংহতি নাই, আত্মার বন্ধনও স্থাপিত হয় না।
আমার তো এখন মজাই লাগিতেছে। বাড়ি হইতে পালাইয়া বাচিয়াছি। নইলে আজই হয়তো আমার বিবাহ দিয়া দিত।
জীনস পরে ইয়াসমিন বলে, নগ্নবক্ষ হইয়া থাকিব নাকি? জামা দিবে না?
নগ্নই তো সুন্দর। তোমার বক্ষের গড়ন অপূর্ব। বলতে বলতে প্যাম একটা লেবু-হলুদ শার্ট ধার দেয়।
ভারি সুন্দর শার্ট। কোথা হইতে কিনিয়াছ?
পোর্টোবেলো মার্কেট হইতে চুরি করিয়াছি।
মাহজাবীন আমার পোশাকগুলি আনিতে পারিবে কিনা, কে জানে।
ইয়াসমিন যখন পাশের ঘরে ফিরে যায়, তাকে দেখেই পিটার শিস দিয়ে ওঠে। তার বান্ধবী কোকো সঙ্গে সঙ্গে আদরের কোমল চড় লাগিয়ে দেয় পিটারকে। শাসন করে–ভিন্ন ক্ষেতে ফসল বপন করিবে না।
পিটার চটপট উত্তর দেয়, শিস ক্ষেত দেখিয়া দিই নাই, ক্ষেতের গায়ে টাঙ্গানো নোটিশ দেখিয়া দিয়াছি।
পিটার আঙ্গুল দিয়ে ইয়াসমিনের পেছনটা দেখিয়ে দেয়। সেখানে, জীনসের ওপর সাটা স্টিকার। তাতে লেখা I’M A LUNATIK.
ভিনসেন্ট ইয়াসমিনকে কাছে ডাকে। তোমার সঙ্গে অর্থ কী পরিমাণ আছে?
গুনিয়া দেখি নাই। সামান্য আছে।
বৃদ্ধের কিঞ্চিত খসাইয়া আসা উচিত ছিল। উহারা পুঁজিবাদী। যে ভবিষ্যত আনবিক বোমার আতঙ্কে দ্বিখণ্ডিত, উহারা সেই ভবিষ্যতের জন্যে অর্থ সঞ্চয় করিয়া রাখে। অথচ কুসুমের সন্তানেরা ধ্যানের খোরাক পায় না। উচ্চমূল্যে ক্রয় করিতে হয়। ধরা পড়িলে কারাদণ্ড, তাও দীর্ঘমেয়াদী।
পাউণ্ড দশেকের মতো ছিল, ইয়াসমিন ভিনসেন্টের হাতে তুলে দেয়।
মাহজাবীন আসিলে বলিব, আমাকে কিছু অর্থ সংগ্রহ করিয়া দিবে।
ভিনসেন্ট উপদেশ করে, সরকারি আপিসে গিয়া বেকারভাতার জন্য নাম লিখাইয়া আসিবে। তুচ্ছ এই বাস্তব লইয়া কথা বলিতে আমার ভালো লাগে না। পিটার সিগারেট বানাইতেছে। তুমি আমার নিকটে থাক। আনন্দে তোমাকে দীক্ষা লইতে হইবে না?
গাঁজার অভ্যাস আমার আছে। পিটার জানে। গ্যাবি জানে। আজ প্রভাতেও গোটা তিনেক টান দিয়াছি।
ইয়াসমিনের বাহাদুরি নস্যাৎ করে দেয় ভিনসেন্ট। বলে, টানিলেই টানা হয় না। টানিবার মতো টানিতে হয়। নিজেকে প্রস্তুত করিতে হয়। তোমাকে দেখাইয়া দিলে বুঝিবে, পূর্বের অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞতাই নহে।
ইয়াসমিন হঠাৎ লক্ষ করে মার্ক গিটারে টুংটাং করতে করতে তার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে।
কী মার্ক?
মার্ক আপন মনে টুং টাং করে চলে। উত্তর দেয় না। দৃষ্টিও ফিরিয়ে নেয় না। তখন ইয়াসমিন তার গায়ে ঠেলা দিয়ে বলে, ড্যাবড্যাব করিয়া কী দেখিতেছ? তোমাকে তো ভালো মানুষ বলিয়াই জানিতাম।
মার্ক টুংটাং করতে করতেই প্রশ্ন করে, ইয়াসমিন, তুমি কি কাহারো সহিত নিদ্রা গিয়াছ?
না।
আমারও তাই বোধ হইতেছিল।
যখন আমার দেহ নগ্ন ছিল, তুমি বুঝি এই দেখিতেছিলে?
হাঁ, সত্য বলিলাম।
দেখিলে, তো বুঝিলে কী করিয়া আমি কুমারী? এত অভিজ্ঞতা কাহার কৃপায় লাভ করিয়াছ, মার্ক। বল, আমাকে সত্য করিয়া বল। আমার কাছে লুকাইবে না। আমি সব শুনিতে চাই। তুমি আমার সহিত নিদ্রা যাইবে?
ইয়াসমিন একটু চিন্তা করে বলে, প্রস্তাব করিতেছ, না ঠাট্টা করিতেছ? যদি ঠাট্টা হয়, তোমার মুখে জলত্যাগ করিব।
আর যদি প্রস্তাব হয়?
ভাবিয়া দেখিব, তোমার মতো অভিজ্ঞলোকের কাছে কুমারীত্ব বিসর্জন দিব, না কোনো অনিপুনকে বাছিয়া লইব। মার্ক ঠাট্টা রাখ। তুমি কি সত্যই এইসব ভাবিতেছিলে?
তুমি হয়তো জান না ইয়াসমিন, নারীর প্রতি আমার কোনো আকর্ষণ নাই। যদি চাহিতাম, গ্যাবির সহিত, কোকোর সহিত, প্যামের সহিত, এমনকি তোমার সহিত নিদ্রা দিতে পারিতাম। নিচের তলায় জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিও, তিন বালিকা আমার সহিত সম্পর্ক করিতে খেপিয়া রহিয়াছে।
তবু, মুখ খারাপ করিলে কেন?
আমি যখন গান রচনা করি, ইয়াসমিন, তখন আমার চেতনার অভ্যন্তরে দুই শক্তি ক্রিয়া করে। এক, কাব্যশক্তি, দুই, দেহশক্তি। উভয়ই মূলত প্রজনন। রচনাকালে আমি নারী সঙ্গ কল্পনা না করিয়া পারি না। কখনো কখনো আমার স্বলনও হয়।
এখন?
এখনও পরাজিত নহি? তোমার জন্য এই মাত্র একটি গান রচনা করিতেছিলাম। যদি শুনিতে চাও, গাহিতে পারি।
আমি শুনিব। আমাকে লইয়া পূর্বে কেহ গান রচনা করে নাই।
ভিনসেন্ট এতক্ষণ ব্যস্ত ছিল পিটারের সঙ্গে বসে সিগারেট বানানোয়। ইয়াসমিনকে মার্কের সঙ্গে, যে মার্ক স্বভাবতই কম কথা বলে, কথা বলতে দেখে সে দূর থেকেই হলা দেয়।
ইয়াসমিন সাবধানে থাকিও, কোনো কোনো জন্তুর বাকশক্তি নাই, কামড় দিতে দড়।
মার্ক সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে গান ধরে, মৃদু গলায়, ফিরিয়া যাইবার জন্য আমার বাসায়। আসিও না। ভুলিবার জন্য কেহ ভালোবাসিও না। ইহার চেয়ে শূন্যতা অনেক ভালো। ইহার চেয়ে শূন্য চোখে দূরের কোনো জামার দিকে দৃষ্টি করা অনেক ভালো। ও ইয়াসমিন, আসিও না, ভালো বাসিও না।
ভিনসেন্ট উঠে আসে ইয়াসমিনের কাছে। বলে, সিগারেট প্রস্তুত, দীক্ষা লইবে না?