১০. বিস্ফোরণ
বৃহস্পতিবার দিনটিতে মনে হয় গোড়া থেকেই কিছু গোলমাল ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি লাবলুর জ্বর। মাঝে মাঝেই কেন জানি লাবলুটার জ্বর উঠে। তখন কেমন যেন চুপচাপ হয়ে শুয়ে থাকে। দেখেই কেন জানি মন খারাপ হয়ে যায়।
স্কুলে গিয়েও গোলমাল। ক্লাস কেপ্টেন খামাখা আমার নাম লিখে স্যারের কাছে। নালিশ করল, আমি নাকি ক্লাশে গোলমাল করেছি। স্যার তখন আমাকে একেবারে যা তা বলে বকাবকি করলেন। জীবনের উপর বিতৃষ্ণা এসে গেল সেই বকাবকি শুনে।
টিফিন ছুটির সময় কাশেম আমার একটা বই কেড়ে নিল। লাইব্রেরি থেকে এনেছি, এখনো পড়া হয়নি। সেটা ফেরৎ নিতে গিয়ে মহা গোলমাল, ছোটখাট ধাক্কাধাক্কি ছাড়া অবশ্যি আর কিছু হল না, সলীল পাশে না থাকলে মনে হয় মার খেয়ে ভূত হয়ে যেতাম।
বিকাল বেলা হঠাৎ দেখি, কলম থেকে কালি চুঁইয়ে শার্টের পকেটটা মাখামাখি হয়ে গেছে, বাসায় পৌঁছানোর পর মা যা একটা কাণ্ড করবেন সেটা আর বলার নয়।
স্কুল ছুটির পর বাসায় আসতে আসতে রাস্তার মোড়ে আমি একটা আছাড় খেলাম। শুকনো ঠনঠনে রাস্তা, আছাড় খাওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। কিন্তু আমি তার মাঝে আছাড় খেয়ে ফেললাম। একটা দিন কেমন যাবে সেটা মনে হয় গ্রহ নক্ষত্র দিয়ে বিচার করা যায়। আজকে নিশ্চয়ই সবগুলি গ্রহ নক্ষত্র আমার জন্যে সবচেয়ে খারাপ খারাপ জায়গায় গিয়ে হাজির হয়েছে। আছাড় খেয়ে হাঁটুর ছাল উঠে গেছে কিন্তু সেটা। নিয়ে আমি ব্যস্ত হতে পারলাম না। সামনে নিচু ক্লাসের কয়জন ছেলে ছিল, তারা এমন জোরে হাসতে শুরু করল যেন ভারি মাজার একটা ব্যাপার হয়েছে। মানুষ আছাড় খেলে যে দেখে হাসতে হয় না এই জিনিসটা মনে হয় কেউ তাদের শেখায়নি।
দিনটা যে খুব খারাপ যাচ্ছে সেটা নিয়ে একেবারে নিঃশন্দেহ হয়ে গেলাম যখন বাসায় এসে দেখি, বাবা এসেছেন। অনেক দূর থেকে তাঁর ঘড়ঘড় শব্দ করে জিব পরিষ্কার করার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আজকে বাবার আসার কথা নয় কিন্তু আমার সর্বনাশ পুরো করার জন্যে মনে হয় একদিন আগে এসে হাজির হয়েছেন।
বাসায় ঢোকার আগে খানিকক্ষণ বারান্দায় বসে রইলাম। মনটা এত খারাপ হয়েছে। যে বলার নয়। মনে হতে লাগল, সলীলের সাথে পালিয়ে গিয়ে বেদে হয়ে যাওয়াটা এমন কিছু খারাপ ব্যাপার নয়। পড়াশোনা করে কি হবে?
আমাকে দেখেই বাবার মুখ শক্ত হয়ে গেল কিন্তু আমাকে কিছু বললেন না। প্রত্যেকবারই বাবা পুরো ব্যাপারটা আগেরবার থেকে একটু ভিন্ন ভাবে করেন। কোন কথা না বলাটা মনে হয় একটা নতুন কায়দা।
আমি বাবাকে পাশ কাটিয়ে টেবিলের উপর বইগুলি রেখে রান্নাঘরে গিয়ে হাজির হলাম। মা চুলা থেকে ডেকচিটা নামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ কপালে তুলে বললেন, নতুন শার্টটা এইভাবে নষ্ট করেছিস?
কলম থেকে কালি বের হয়েছে–
মা গর্জন করে বললেন, সাবধানে রাখতে পারিস না? কোন জংগলের ভূত হয়েছিস তুই?
সস্তা কলম, আমি কি করব?
সস্তা কলম? মা মুখ খিঁচিয়ে বললেন, লাট সাহেবের জন্যে সোনার কলম কিনে আনতে হবে!
আমি রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এলাম, এমনিতে বাবার পিটুনী খেয়ে আসছি, এখন। তার সাথে মায়ের মুখ খিচুনী যোগ হল। জীবনের উপর বিতৃষ্ণা এসে গেল হঠাৎ। রান্নাঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, তখন হঠাৎ দেখি বাবা শোবার ঘর থেকে লাবলুর কান ধরে টেনে আনছেন। লাবলুর মুখ ভয়ে একেবারে ছাইয়ের মত সাদা হয়ে গেছে। একটু আগে দেখেছি জ্বরে কাহিল হয়ে লাবলু বিছানায় শুয়ে আছে। তাকে যে বাবা কান ধরে টেনে আনবেন আমি কখনো কল্পনাও করিনি।
আমার মাথার মাঝে হঠাৎ কেমন জানি একটু গোলমাল হয়ে গেল। কেমন করে হল বা কেন হল সেটা আমি জানি না কিন্তু কিছু একটা ঘটে গেল তাতে কোন সন্দেহ। নেই। আমি তখন হঠাৎ একটা অসম্ভব সাহসের কাজ করে ফেললাম। রান্নাঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হুকুম দেওয়ার মত করে বললাম, বাবা, লাবলুকে ছেড়ে দেন।
বাবার মাথার উপর বাজ পড়লেও মনে হয় বাবা এত অবাক হতেন না। তাঁর মুখ মাছের মত হা হয়ে গেল, চোখ দুটি গোল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। শুধু যে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন তাই নয়, সত্যি সত্যি লাবলুকে ছেড়ে দিলেন। তাকে দেখে মনে হতে লাগল তাঁর ভিতরে কিছু একটা গোলমাল হয়ে গেছে। কি হচ্ছে কিছুই আর বুঝতে পারছেন না। কয়েক সেকেন্ড সেভাবে গেল, তারপর হঠাৎ করে বাবা নড়ে উঠলেন, তার চোখ মুখ হাত পা শরীর কেমন যেন কিলবিল করে উঠল। মুখ বন্ধ করে বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, কি বললি?
আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম যা হবার হয়ে গেছে, এখন আর পেছানোর উপায় নেই। গলার স্বরটাকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললাম, বলেছি লাবলুকে ছেড়ে দেন। ওর জ্বর উঠেছে, শুধু শুধু মারবেন না।
মা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এলেন। আমি চোখের কোণা দিয়ে দেখলাম, দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, মনে হয় নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। কি একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন, তারপর হঠাৎ শাড়ির আচল দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললেন।
লাবলু ছাড়া পেয়েও তখনো সরে যায়নি। অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখ ভয়ে আরো সাদা হয়ে গেছে। একটু আগে ভয়টা ছিল নিজের জন্যে, এখন ভয়টা আমার জন্যে।
বাবা প্রচণ্ড রাগে কি করবেন বুঝতে না পেরে হঠাৎ একটা ট্রাকের মত আমার দিকে ছুটে এলেন, কাছে এসে একেবারে বাঘের মত আমার উপর লাফিয়ে পড়লেন।
আমি ব্যাপারটার জন্যে প্রস্তুত ছিলাম, ঠিক সময়মত একটা লাফ দিয়ে সরে গেলাম, বাবা আমাকে ধরতে পারলেন না। বাবা স্বপ্নও এরকম একটা জিনিস চিন্তা করেননি। তার একেবারে পুরোপুরি মাথা খারাপ হয়ে গেল। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকালেন।
রেগে গেলে মানুষের চেহারা খুব খারাপ হয়ে যায়। বাবার চেহারা এমনিতেই আগে কোনদিন আমার ভাল মনে হয়নি, এখন এই ভয়ংকর রাগে চেহারা এত খারাপ দেখাতে লাগল যে, দেখে আমার শরীর কেমন জানি শিউরে উঠে। চোখ দুটি লাল হয়ে আছে, নাকের গর্তগুলি বড় বড়, মুখ হা করে বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছেন, মুখের ভিতরে ময়লা হলুদ দাঁত, থুতনিতে এক গোছা দাড়ি নড়ছে। কি কুৎসিত একটা দৃশ্য! বাবা গোঙানোর মত শব্দ করতে করতে চিৎকার করে বললেন, শুওরের বাচ্চা, আজকে আমি তোকে খুন করে ফেলব, একেবারে জবাই করে ফেলব।
বাবা সেই জায়গা থেকে আরেকটা লাফ দিলেন। আমি তখন মরীয়া হয়ে গেছি, আমি জানি আমাকে ধরতে পারলে বাবা আমার গলা টেনে ছিঁড়ে ফেলবেন। আমি আরো জোরে একটা লাফ দিয়ে সরে গেলাম, বাবা আমাকে ধরতে পারলেন না বরং তাল হারিয়ে কেমন যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। বয়স্ক মানুষ, লাফ-ঝাঁপ দিয়ে অভ্যাস নেই। মনে হল পড়ে গিয়ে খুব ভাল মত একটা চোট খেলেন, উঠে দাঁড়াতে তার একটু অসুবিধা হল, শেষ পর্যন্ত যখন উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি বুঝতে পারলাম, আমার বেঁচে থাকার আর কোন সম্ভাবনাই নেই। বাবা এখন সত্যি সত্যি আমাকে মেরে ফেলবেন। মরে যাওয়ার সময় নাকি পুরো জীবনের স্মৃতি চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যায়। একটু পরেই আমি দেখব সেটা সত্যি কি না!
বাবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে এদিকে সেদিকে তাকালেন। হাতের কাছে কিছু না পেয়ে হঠাৎ রান্নাঘরে ঢুকে মাছ কাটার বটিটা নিয়ে বের হয়ে এলেন। তার চোখ ধ্বক ধ্বক করছে। হাতে একটা বটি। কি ভয়ংকর একটা দৃশ্য! আমার রক্ত একেবারে হিম হয়ে গেল।
রান্নাঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে বাবা বটিটা উপরে তুলে ফ্যাসফ্যাসে এক রকমের গলায় বললেন, হারামজাদা, তুই যদি এক পা নড়িস তোকে খুন করে ফেলব। একেবারে খুন করে ফেলব জানোয়ারের বাচ্চা–
বটিটা আমার দিকে ছুঁড়ে মারবেন কিনা জানি না কিন্তু সেটা নিয়ে চিন্তা ভাবনা
করার সময় নেই। বাবা ডান হাতে ধরে বটিটা মাথার উপরে তুলে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছেন। এক লাফ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করা যায় কিন্তু সত্যি যদি কোপ মেরে বসেন?
বাবা নাক দিয়ে ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস নিয়ে আবার দুই পা এগিয়ে এলেন। আমি তার হাতের দিকে তাকিয়ে আছি। সত্যি কি আমাকে কোপ মেরে বসবেন? খবরের কাগজে তো দেখি মাঝে মাঝে বাবা ছেলেকে কিংবা ছেলে বাবাকে মেরে ফেলেছে। ব্যাপারগুলি এভাবেই হয় তাহলে!
বাবা তখন আরো দুই পা এগিয়ে এলেন। আমি তখন মরীয়া হয়ে আরো একটা সাহসের কাজ করে ফেললাম। চিৎকার করে বললাম, সবাইকে বলে দিব আমি। সবাইকে–
কি বলবি? বাবা হুংকার দিয়ে বললেন, কি বলবি শুওরের বাচ্চা?
আপনি ওষুধ চুরি করেন। ভেজাল ওষুধ বিক্রি করেন। আমার কাছে প্রমাণ আছে।
বাবা এক সেকেন্ডের জন্যে কেমন জানি হকচকিয়ে গেলেন। তার চোখ হঠাৎ ঘোলাটে হয়ে গেল, শরীর কাঁপতে লাগল, মুখ হা হয়ে গেল এবং সেই অবস্থায় মুখে আঁ আঁ শব্দ করে বটিটা নিয়ে ছুটে এসে আমাকে কোপ মেরে বসলেন। আমি শেষ মুহূর্তে লাফ মেরে সরে গেলাম বলে আমার গায়ে লাগল না, বটিটা পিছনের কাঠের দরজায় গেঁথে গেল ইঞ্চিখানেক।
বাবা সেটা টেনে বের করার চেষ্টা করতে লাগলেন আর হঠাৎ করে আমার ভিতর থেকে সব ভয় চলে গেল। হঠাৎ করে আমার মনে হল, আমি বুঝি অনেক বড় হয়ে গেছি। আমি কেমন জানি হতবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই মানুষটা আমার নিজের বাবা। আমাকে কুপিয়ে মেরে ফেলতে চাইছে? আমার নিজের বাবা!
গভীর কেমন একটা দুঃখে হঠাৎ আমার বুকটা কেমন জানি হু হু করে উঠে।
মা তখন হঠাৎ চিলের মত চিৎকার করে ছুটে এসে বাবাকে টেনে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন, কি সব বলতে লাগলেন আমি তার কিছু বুঝতে পারলাম না। লাবলুটাও ছুটে এসে চিৎকার করে আমার হাত ধরে কাঁদতে শুরু করল। বাবা তখনো মায়ের হাত থেকে ছুটে আসতে চেষ্টা করছিলেন কিন্তু মা শক্ত করে ধরে রাখলেন। বাবা সেই অবস্থায় কাঁপতে কাঁপতে আমার দিকে হাত দেখিয়ে বললেন, বের হয়ে যা। শুওরের বাচ্চা, বের হয়ে যা তুই বাসা থেকে–
আমি সোজাসুজি বাবার চোখের দিকে তাকালাম, আর কি আশ্চর্য! বাবা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলেন না, চোখ সরিয়ে নিলেন। সেইভাবে চিৎকার করে বললেন, বের হয়ে যা–এই মুহূর্তে বের হয়ে যা —
আমি আর কোন কথা বললাম না। ঠিক সেইভাবে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। মা চিৎকার করে কি যেন বলছেন, লাবলুটা কাঁদছে কিন্তু কিছুই আমার কানে আসছিল না। কিছুই না।