১০. পদার্থবিদ্যাকে ঐক্যবদ্ধ করা

১০. পদার্থবিদ্যাকে ঐক্যবদ্ধ করা (The Unification of Physics)

প্রথম অধ্যায়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল মহাবিশ্বের সবকিছু নিয়ে সম্পূর্ণ একটি ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব একবার গঠন করা খুবই কঠিন হত। তার বদলে আমরা একাধিক আংশিক তত্ত্ব আবিষ্কার করে অগ্রসর হয়েছি। এই তত্ত্বগুলো ঘটনাসমষ্টির একটি সীমিত অঞ্চল ব্যাখ্যা করে। এই কাজে তারা অন্যান্য অভিক্রিয়া (effects) অগ্রাহ্য করে কিম্বা কিছু কিছু সংখ্যার সাহায্যে সেগুলোর আসন্নতায় (approximating them) পৌঁছাতে চেষ্টা করে। (উদাহরণ : রসায়ন শাস্ত্র পরমাণুগুলোর কেন্দ্রকের গঠন না জেনে তাদের পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া গণনা অনুমোদন করে)। শেষ পর্যন্ত কিন্তু একটি সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ তত্ত্ব আবিষ্কার আশা করা যায়। সমস্ত আংশিক তত্ত্বই আসন্নতারূপে সে তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত হবে। সেই আংশিক তত্ত্বগুলোর প্রয়োজন হবে না, ঘটনাবলির সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষার জন্য তত্ত্বে কয়েকটি যাদৃচ্ছিক সংখ্যার মূল্য বেছে নেয়া। এই রকম একটি তত্ত্ব অনুসন্ধানের নাম “পদার্থবিদ্যা ঐক্যবদ্ধ করা”। আইনস্টাইন জীবনের শেষ ক’বছরের অধিকাংশ সময়ই ব্যয় করেছেন এরকম একটি তত্ত্বের সন্ধানে। কিন্তু সফল হননি। কারণ তখনো এরকম তত্ত্ব আবিষ্কারের সময় হয়নি। মহাকর্ষ এবং বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল সম্পর্কে আংশিক তত্ত্ব ছিল কিন্তু কেন্দ্রীয় বল (nuclear forces) সম্পর্কে তখন সামান্যই জানা ছিল। তাছাড়া কণাবাদী বলবিদ্যা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা সত্ত্বেও আইনস্টাইন এই বলবিদ্যার (quantum mechanics) বাস্তবতা স্বীকার করতেন না। তবুও মনে হয় যে মহাবিশ্বে আমরা বসবাস করি তার একটি মূলগত অবয়ব অনিশ্চয়তার নীতি। সুতরাং আবশ্যিক ভাবেই এই নীতিকে একটি সফল ঐক্যবদ্ধ তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

এরকম একটি তত্ত্ব আবিষ্কারের সম্ভাবনা এখন অনেক বেশি, তার কারণ এখন আমরা মহাবিশ্ব সম্বন্ধে অনেক বেশি জানি। এখন আমি এ বিষয়ের বিবরণ দেব কিন্তু অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস সম্পর্কে আমাদের সাবধান হতে হবে। আগেও এরকম মিথ্যা প্রভাত (false dawn) আমাদের হয়েছে। উদাহরণ : এই শতাব্দীর প্রথমে মনে হয়েছিল অবিচ্ছিন্ন পদার্থের স্থিতিস্থাপকতা এবং তাপ পরিবহনের মত ধর্মের বাগ্মিধিতে সমস্তই ব্যাখ্যা করা যাবে। পারমাণবিক গঠন এবং অনিশ্চয়তার নীতি আবিষ্কারের ফলে সে আশা সজোরে ভেঙ্গে পড়ে। তারপর আবার ১৯২৮ সালে পদার্থবিদ নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ম্যাক্স বর্ন (Max Born) গয়েটিংগেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (Gottingen University) একদল সাক্ষাৎকারীকে বলেছিলেন, “আমরা যাকে পদার্থবিদ্যা বলি ছ’মাসেই তার সমাপ্তি ঘটবে।” তার বিশ্বাসের ভিত্তি ছিল অনতিকাল পূর্বে ডিরাকের (Dirac) আবিষ্কৃত ইলেকট্রনের আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী সমীকরণ। তখন মনে হয়েছিল এরকম আর একটি সমীকরণ প্রোটনের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করবে। তখন পর্যন্ত প্রোটনই (proton) ছিল অন্য একটিমাত্র জানিত কণিকা। সুতরাং এই সমীকরণ জানা হয়ে গেলেই তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা শেষ হবে। কিন্তু তারপর নিউট্রন এবং কেন্দ্রীয় বল আবিষ্কার সে আশার মাথায় আঘাত করে। একথা আমি বলছি, তবুও আমি বিশ্বাস করি– সতর্ক আশাবাদের যুক্তি রয়েছে, আমরা হয়ত প্রকৃতির চূড়ান্ত বিধি অনুসন্ধানের শেষ প্রান্তের কাছাকাছি এসে গেছি।

আগের অধ্যায়গুলোতে আমি ব্যাপক অপেক্ষবাদ, মহাকর্ষের আংশিক তত্ত্ব এবং দুর্বল, সবল ও বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল নিয়ন্ত্রণকারী আংশিক তত্ত্বের বিবরণ দিয়েছি। তথাকথিত মহান ঐক্যবদ্ধ তত্ত্বে (grand unified theory কিম্বা GUT) শেষের তিনটির সমন্বয় করা যেতে পারে, তবে এগুলো খুব সন্তোষজনক নয়। তার কারণ মহাকর্ষ তার অন্তর্ভুক্ত নয় এবং বিভিন্ন কণিকার আপেক্ষিক ভরের মত এমন কতকগুলো সংখ্যা সেগুলোর ভিতর রয়েছে, যেগুলো তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী থেকে বলা যায় না, পর্যবেক্ষণফলের সঙ্গে খাপ খাওয়ার মত করে বেছে নিতে হয়। মহাকর্ষকে অন্যান্য বলের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ করা বিষয়ে প্রধান অসুবিধা হল ব্যাপক অপেক্ষবাদ একটি “চিরায়ত” (classical) তত্ত্ব অর্থাৎ কণাবাদী বলবিদ্যার অনিশ্চতার নীতি এর অন্তর্ভুক্ত নয়। অন্যদিকে অন্যান্য আংশিক তত্ত্বগুলো অপরিহার্যভাবে কণাবাদী বলবিদ্যার উপর নির্ভরশীল। সুতরাং প্রথম ধাপ হল ব্যাপক অপেক্ষবাদের সঙ্গে অনিশ্চিয়তাবাদের সমন্বয় করা। আমরা দেখেছি এর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ফলশ্রুতি হতে পারে যেমন– কৃষ্ণগহ্বরগুলো কালো নয়, মহাবিশ্ব স্বয়ংসম্পূর্ণ তবে কোন অনন্যতাহীন এবং সীমানাহীন। অসুবিধাটি সপ্তম অধ্যায়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে অনিশ্চয়তার নীতির অর্থ হল, এমন কি “শূন্য” (empty) স্থানও জোড়া জোড়া কল্পিত কণিকা এবং কল্পিত বিপরীত কণিকায় পূর্ণ। এই জোড়গুলোতে শক্তি থাকবে অসীম, সুতরাং আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ E = mc^2 অনুসারে তাদের ভর (mass) হবে অসীম। তাদের মহাকর্ষীয় আকর্ষণ মহাবিশ্বকে বক্র করে অসীম ক্ষুদ্র আকারে নিয়ে আসবে।

অন্যান্য আংশিক তত্ত্বেও দৃষ্টত অবিশ্বাস্য অনেকটা একইরকম বহু অসীম infinite) দেখা যায় কিন্তু পনুঃস্বাভাবিকীকরণ পদ্ধতির (renormalization) সাহায্যে এই সমস্ত ক্ষেত্রে অসীমগুলোকে বাতিল করা সম্ভব। এ পদ্ধতিতে অন্যান্য অসীম উপস্থিত করে অসীমগুলোকে বাতিল করতে হয়। যদিও এই পদ্ধতি গাণিতিকভাবে সন্দেহজনক তবুও কার্যক্ষেত্রে এ পদ্ধতি ফলপ্রদ। এই সমস্ত তত্ত্বে ভবিষদ্বাণী করার জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। এই ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর পর্যবেক্ষণের সঙ্গে মিলের নির্ভুলতা অসাধারণ। একটি সম্পূর্ণ তত্ত্ব আবিষ্কারের চেষ্টার দিক থেকে কিন্তু পনুঃস্বাভাবিকীকরণ পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি আছে। তার কারণ এর অর্থ তত্ত্ব থেকে ভর এবং বলগুলোর শক্তি সম্পর্কে পূর্বাভাস দেয়া যায় না। পর্যবেক্ষণ ফলের সঙ্গে খাপ খাওয়ার মত করে বেছে নিতে হয়।

অনিশ্চিয়তার বিধিকে ব্যাপক অপেক্ষবাদের অন্তর্ভুক্ত করতে হলে মাত্র দুটি সংখ্যার সঙ্গে সমন্বয় (adjust) করতে হবে : মহাকর্ষের শক্তি এবং মহাবিশ্বতত্ত্বের ধ্রুবকের মূল্যাঙ্ক (value of cosmological constant)। কিন্তু এই দুটি সংখ্যার সমন্বয়ই সমস্ত অসীম দূর করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। সুতরাং এমন একটি তত্ত্ব পাওয়া গেল যে তত্ত্বেও স্থান-কালের বক্রতার মত কয়েকটি পরিমাণ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী হল– সেগুলো অসীম কিন্তু এই পরিমাণগুলো পর্যবেক্ষণ করা এবং মাপা সম্ভব। তার ফলে দেখা যায় সেগুলো অসীম, তাতে কোন ভুল নেই। ব্যাপক অপেক্ষবাদ এবং অনিশ্চয়তার নীতির এই সমন্বয়ে এই সমস্যার অস্তিত্ব রয়েছে এরকম সন্দেহ কিছুদিন ধরেই ছিল কিন্তু বিস্তৃত গণনা দ্বারা এ সন্দেহের সত্যতা চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয় ১৯৭২ সালে। চার বছর পর “অতিমহাকর্ষ” (supergavity) নামে একটি সম্ভাব্য সমাধান উপস্থিত করা হয়। গ্র্যাভিটন নামে চক্ৰণ-২ কণিকা মহাকর্ষীয় বল বহন করে। সম্ভাব্য সমাধানের কল্পনা ছিল গাভিটনের সঙ্গে চক্ৰণ ১,১,এবং ০ বিশিষ্ট কয়েকটি নতুন কণিকা সংযুক্ত করা। এক অর্থে এই সমস্ত কণিকাকে একই “অতিকণিকার” (superparticle) বিভিন্ন অবয়ব বলে বিচার করা যায়। এইভাবে ঐক্যবদ্ধ করা যায় চক্ৰণ ১, এবং ৩, পদার্থ কণিকা এবং চক্ৰণ ০, ১ এবং ২ বলবাহী (force carrying) কণিকা। চক্ৰণ ১, এবং ৩বিশিষ্ট কল্পিত (virtual) কণিকা/বিপরীত কণিকার জোড়ের তাহলে অপরা (neg ative) শক্তি থাকবে, সুতরাং চক্ৰণ ২, ১ এবং ০ বিশিষ্ট কল্পিত জোড়ের পরা শক্তিকে বাতিল করতে চাইবে। এর ফলে সম্ভাব্য অনেক অসীম বাতিল হয়ে যাবে কিন্তু সন্দেহ ছিল কিছু অসীম বোধ হয় তখনও থেকে যাবে। কিন্তু বাতিল না করা কোন অসীম থেকে গেল কিনা সেই গণনা ছিল এত জটিল এবং দীর্ঘ যে কেউই সে দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত ছিল না। গণনায় দেখা গিয়েছিল একটি কম্পিউটার ব্যবহার করলেও সময় লাগবে প্রায় চার বছর এবং অন্তত একটি ভুলের সম্ভাবনা থাকবে খুবই বেশি এমন কি তার চাইতে বেশি ভুণ্ডলের সম্ভাবনাও থাকতে পারে। সুতরাং উত্তরটি ঠিক করেছে জানতে হলে অন্য একজনকে গণনা করে একই উত্তর পেতে হবে। সে সম্ভাবনাও খুব বেশি ছিল না।

এই সমস্ত সমস্যা এবং অতিমহাকর্ষ তত্ত্বগুলোর কণিকার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা কণিকাগুলোর মিল নেই মনে হওয়া সত্ত্বেও অধিকাংশ বৈজ্ঞানিকই বিশ্বাস করতেন অতিমহাকর্ষই সম্ভবত পদার্থবিদ্যাকে ঐক্যবদ্ধ করার সমস্যার সঠিক সমাধান। মহাকর্ষকে অন্যান্য বলের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ করার এটিই মনে হয়েছিল সবচাইতে ভাল উপায়। কিন্তু ১৯৮৪ সালে যে তত্ত্বগুলোকে তত্ত্বত্ত্ব (string theories) বলা হয় সেই তত্ত্বগুলোর সপক্ষে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। কণিকাগুলোর অবস্থান স্থানে একক একটি বিন্দুতে কিন্তু এই তত্ত্বগুলোতে মূলগত বস্তু (basic objects) কণিকা নয়। এই তত্ত্বের মুলগত বস্তুর দৈর্ঘ্য আছে কিন্তু অন্য কোন মাত্রা (dimension) নেই। এগুলো অসীম কৃশ (thin) তন্তুর মত। এই তন্তুগুলোর তথাকথিত মুক্ত open) তন্তুর মত প্রান্ত (ends) থাকতে পারে কিম্বা নিজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বদ্ধ ফাস (loop) হতে পারে (বদ্ধতন্তু) (চিত্র :১০.০ এবং ১০.২)। একটি কণিকা কালের প্রতিটি ক্ষণে স্থানের একটি বিন্দু অধিকার করে থাকে। সুতরাং স্থান-কালে এর ইতিহাস একটি দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠ (two dimensional surface)। এর নাম বিশ্বপাত (world sheet) (এইরকম একটি বিশ্বপাতের যে কোন একটি বিন্দুর বিবরণ দেয়া যায় দুটি সংখ্যা দিয়ে। একটি নির্দেশ করে কাল, অন্যটি নির্দেশ করে তন্তুর উপর বিন্দুটির অবস্থান)। একটি মুক্ত তন্তুর বিশ্বপাত একটি ফালি (strip)। এর কিনারাগুলো তন্তুর প্রান্তগুলোর স্থান-কালের ভিতর দিয়ে পথের প্রতিরূপ (represent) (চিত্র : ১০.২)। একটি বদ্ধতন্তুর বিশ্বপাত (world sheet) একটি সিলিন্ডার কিম্বা একটি নল (cylinder or tube) (চিত্র : ১০.২)। নলের ফালি (slice) একটি বৃত্ত। সে বৃত্ত একটি বিশেষ কালে তন্তুর অবস্থানের প্রতিরূপ (represents)।

দুই খণ্ড তার (string) যুক্ত হয়ে একক একটি তন্তু গঠন করতে পারে। যুক্ত তন্তুগুলোর ক্ষেত্রে তাদের প্রান্তগুলো শুধুমাত্র যুক্ত হয় (চিত্র : ১০.৩)। আবার বদ্ধতন্তুগুলোর ক্ষেত্রে ব্যাপারটি অনেকটা পায়জামার দুটি পায়ের জোড়া লাগার মত (চিত্র: ১০.৪)। একই ভাবে একখণ্ড তন্তু বিভক্ত হয়ে দুটি তন্তু হতে পারে। আগে যেগুলোকে কণিকা ভাবা হত আজকাল সেগুলোর চিত্রন তন্তু দিয়ে প্রবাহিত তরঙ্গের মত, এর তুলনা করা যায় ঘুড়ির সুতো দিয়ে প্রবাহিত তরঙ্গের সঙ্গে। একটি কণিকা থেকে অন্য একটি কণিকা নির্গত হওয়া কিম্বা একটি কণিকার দ্বারা অন্য একটি কণিকা বিশোষিত হওয়া তন্তুর বিভক্ত হওয়া কিম্বা যুক্ত হওয়ার অনুরূপ। উদাহরণ : সূর্যের পৃথিবীর প্রতি মহাকর্ষীয় বলের ব্যাখ্যার চিত্র ছিল সূর্যের একটি কণিকা থেকে একটি গ্যাভিটন (graviton) নির্গত হওয়া এবং পৃথিবীর একটি কণিকা কর্তৃক সেটি বিশোষিত হওয়া (চিত্র : ১০.৫)। ততত্ত্বে এই পদ্ধতি H আকারের নলের (tube or pipe) অনুরূপ (চিত্র :১০.৬) তিতত্ত্ব অনেকটা জল কিম্বা গ্যাসের জন্য নল বসানোর কাজের মত (plumbing)]। দুটি H এর দুটি উল্লম্ব বাহু সূর্য এবং পৃথিবীর কণিকাগুলোর অনুরূপ এবং আনুভূমিক (horizontal), আড়াআড়িভাবে অবস্থিত দণ্ড সূর্য এবং পৃথিবীর ভিতরে গমনাগমনশীল গ্রাভিটনের অনুরূপ।

তন্তুতত্ত্বের ইতিহাস অদ্ভুত। এ তত্ত্ব ১৯৬০ এর দশকের শেষ দিকে আবিষ্কৃত হয়েছিল সবল (strong) বল ব্যাখ্যার জন্য একটি তত্ত্ব আবিষ্কারের চেষ্টার ফলে। চিন্তনটি ছিল : প্রোটন কিম্বা নিউট্রনের মত কণিকাগুলোকে তন্তুর উপর তরঙ্গরূপে কল্পনা করা যায়। কণিকাগুলোর অন্তর্বর্তী সবল বলগুলো (strong forces) হবে অন্যান্য তন্তুখত্রে ভিতর দিয়ে গতিশীল একাধিক তদ্ভুখণ্ডের অনুরূপ– মাকড়সার জালের মত। এই তত্ত্ব অনুসারে কণিকাগুলো অন্তর্বর্তী সবল বলের পর্যবেক্ষণ করা মাপনের সমকক্ষ হতে হলে অন্তগুলোকে রবার ব্যান্ডের মত হতে হবে এবং তার আকর্ষণ pull) হতে হবে দশ টন।

১৯৭৪ সালে প্যারিসের জোল শার্ক Joel Scherk) এবং ক্যালিফোর্নিয়ার ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির জন শোয়ার্জ (John Schwarz) একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। সেই পত্রে তারা দেখিয়েছিলেন তদ্ভুতত্ত্ব মহাকর্ষীয় বলের বিবরণ দিতে পারে শুধুমাত্র যদি তন্তুর বিততি (টান tension) অনেক বেশি হয় প্রায় এক হাজার মিলিয়ান, মিলিয়ান, মিলিয়ান, মিলিয়ান, মিলিয়ান, মিলিয়ান (একের পিঠে ঊনচল্লিশটা শূন্য) টন হয় তাহলে। স্বাভাবিক দৈর্ঘ্যের মানে তন্ততত্ত্ব এবং ব্যাপক অপেক্ষবাদের ভবিষ্যদ্বাণী একেবারেই অভিন্ন হবে কিন্তু পার্থক্য হবে অত্যন্ত স্বল্প দূরত্বে অর্থাৎ এক সেন্টিমিটারের এক হাজার মিলিয়ান, মিলিয়ান, মিলিয়ান, মিলিয়ান, মিলিয়ান ভাগের এক ভাগের কম হলে (এক সেন্টিমিটারকে একের পিঠে তেত্রিশটি শূন্য দিলে যে সংখ্যা হয় সেটি দিয়ে ভাগ করলে)। কিন্তু তাঁদের গবেষণা বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করেনি, তার কারণ প্রায় সেই সময়ই অধিকাংশ লোক সবল বলে সপক্ষে মূল তত্ত্বতত্ত্ব পরিত্যাগ করেন। তাঁরা সমর্থন করেন কার্ক (guark) এবং গ্লুয়ন (Gluon) ভিত্তিক তত্ত্ব। মনে হয়েছিল পর্যবেক্ষণের ফলের সঙ্গে এই তত্ত্বেরই সামঞ্জস্য বেশি। শার্কের মৃত্যুর ব্যাপারটি বড়ই দুঃখের (তার ডায়াবেটিস অর্থাৎ মধুমেহ ছিল। তিনি অজ্ঞান হয়ে যান অর্থাৎ তার হয় ডায়াবেটিক কোমা। তা ইনসুলিন ইঞ্জেকশন দেয়ার মত কেউ কাছাকাছি ছিল না)। সুতরাং শোয়ার্জ একলা পড়ে গেলেন। বোধ হয় তিনিই ছিলেন তদ্ভুতত্ত্বের একমাত্র সমর্থক কিন্তু তখন তন্তুর প্রস্তাবিত বিততির মান অনেক বেশি।

১৯৮৪ সালে তন্তুর উপর আকর্ষণ হঠাৎ পুনরুজ্জীবিত হয়। আপাতদৃষ্টিতে তার কারণ ছিল দুটি। একটি ছিল : অতিমহাকর্ষ সীমিত কিম্বা আমরা যে কণিকাগুলো পর্যবেক্ষণ করি সেগুলো অতিমহাকর্ষ ব্যাখ্যা করতে পারে; এই দুটি বিষয় প্রদর্শনের ব্যাপারে আসলে কোন অগ্রগতি হয়নি। অন্য কারণ ছিল : লন্ডনের কুইন মেরী কলেজের জন শোয়ার্জ John Schwarz) এবং মাইক গ্রীন (Mike Green) একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এই গবেষণাপত্রে দেখানো হয়েছিল তন্ততত্ত্ব হয়ত আমরা যে কণিকাগুলো পর্যবেক্ষণ করি সেগুলোর ভিতরে যেগুলোর গঠনগতভাবে বামমুখীতা আছে (built-in left-handedness) সেরকম কণিকার অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করতে পারবে। কারণ যাই হোক না কেন, অনতিবিলম্বে অনেকেই তন্তু নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন এবং এ তত্ত্বের একটি নতুন রূপ বিকাশ লাভ করে তার নাম তথাকথিত হেটারোটিক তন্তু (heterotic string)। মনে হয়েছিল এ তত্ত্ব আমাদের পর্যবেক্ষণ করা বিভিন্ন ধরনের কণিকা হয়ত ব্যাখ্যা করতে পারবে।

তন্তুতত্ত্বগুলোও অসীমের পূর্বগামী কিন্তু মনে হয় হেটারোটিক তন্তুর মত বাগ্বিধিতে এ তত্ত্বে সমস্ত অসীমই বাতিল হয়ে যাবে (যদিও এ ব্যাপারটা এখনও নিশ্চিতভাবে জানা যায় না)। কিন্তু তন্তুগুলোর একটি বৃহত্তর সমস্যা রয়েছে : তন্তু তত্ত্বগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে শুধুমাত্র যদি সাধারণ চার মাত্রা না থেকে স্থান-কালের দশ কিম্বা ছাব্বিশ মাত্রা থাকে। অবশ্য বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে স্থান-কালের অতিরিক্ত মাত্রা হামেশাই দেখা যায়। আসলে এই অতিরিক্ত মাত্রা এই কাহিনীগুলোর প্রয়োজনীয় উপাদানের ভিতর প্রায় এসে যায়। অপেক্ষবাদের অন্তনিহিত অর্থ : আলোকের চাইতে দ্রুতগতিতে গমনাগমন সম্ভব নয়। সুতরাং অতিরিক্ত মাত্রা না থাকলে তারকা এবং নীহারিকাগুলোতে যাতায়াত করতে বড় বেশি সময় লাগবে। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীগুলোর চিন্তাধারা হল : হয়ত উচ্চতর মাত্রা dimension) দিয়ে একটি সহজ পথ (chort cut) পাওয়া যেতে পারে। ব্যাপারটা কল্পনা করা যেতে পারে নিম্নলিখিত রূপে : মনে করুন যে স্থানে আমরা বসবাস করি তার মাত্র দুটি মাত্রা আছে এবং সেটি নোঙর ফেলার আংটা কিম্বা টোরাসের (torus) পৃষ্ঠের মত বঙ্কিম (চিত্র :১০.৭)। আপনি যদি আংটার ভিতর দিকের কিনারার একপাশে থাকেন এবং অন্যদিকের কোন এক বিন্দুতে যেতে চান তাহলে আপনার আংটার ভিতরের কিনারা দিয়ে ঘুরে যেতে হবে কিন্তু আপনার যদি তৃতীয় মাত্রায় (third dimension) ভ্রমণ সম্ভব হয় তাহলে আপনি সোজাসুজি অন্যদিকে যেতে পারেন।

এই সমস্ত অতিরিক্ত মাত্রার অস্তিত্ব যদি বাস্তব হয় তাহলে কেন সেগুলো আমাদের নজরে আসে না? কেন আমরা শুধুমাত্র স্থানের তিনটি এবং কালের একটি মাত্রা দেখতে পাই? ইঙ্গিতটি হল : অন্য মাত্রাগুলো বক্র হয়ে অত্যন্ত ক্ষুদ্র আয়তনের স্থানে রয়েছে। সেই স্থানের আয়তন প্রায় এক ইঞ্চির এক মিলিয়ান, মিলিয়ান, মিলিয়ান, মিলিয়ান, মিলিয়ান ভাগের এক ভাগ। এগুলো এত ক্ষুদ্র যে আমাদের নজরেই আসে না। আমরা দেখতে পাই শুধুমাত্র একটি কালিক এবং তিনটি স্থানিক মাত্রা সেক্ষেত্রে স্থান-কাল যথেষ্ট মসৃণ (fairly flat)। এটা প্রায় একটি কমলালেবুর বাইরের দিকটির মত– কাছে থেকে দেখলে সবটাই বঙ্কিম এবং কুঞ্চিত কিন্তু দূর থেকে দেখলে উঁচু নিচু দেখতে পাওয়া যায় না; মনে হয় মসৃণ। স্থান-কালের ব্যাপারটাও সেরকম– অত্যন্ত ক্ষুদ্র মাত্রায় দেখলে দশ মাত্রিক এবং অত্যন্ত বঙ্কিম কিন্তু বৃহত্তর মাত্রায় বক্রতা কিম্বা অতিরিক্ত মাত্রা দেখতে পাওয়া যায় না। এই চিত্রন সঠিক হলে সেটা বহু মহাকাশচারীদের কাছে একটি দুঃসংবাদ : অতিরিক্ত মাত্রাগুলো এত বেশি ক্ষুদ্র যে মহাকাশযান তার ভিতর দিয়ে যেতে পারবে না। কিন্তু এই ব্যাপারটা আর একটি বৃহৎ সমস্যা উত্থাপন করছে। সব কটি মাত্রা না হয়ে শুধু কয়েকটি মাত্র মাত্রা কেন বক্র হয়ে ক্ষুদ্র গোলকের আকার ধারণ করবে? বোধ হয মহাবিশ্বের অতি আদিমকালে সমস্ত মাত্রাই অত্যন্ত বক্র ছিল। কিন্তু কেন একটি কালিক মাত্রা এবং তিনটি স্থানিক মাত্রা সমতল হয়ে গেল অথচ অন্য মাত্রাগুলো কঠিন ভাবে বক্র হয়ে রইল?

একটি সম্ভাব্য উত্তর নরত্বীয় নীতি। দুটি স্থানিক মাত্রা আমাদের মত জটিল জীব বিকাশের পক্ষে যথেষ্ট মনে হয় না। উদাহরণ : যদি দ্বিমাত্রিক জীবরা এক মাত্রিক পৃথিবীতে বাস করে তাহলে অন্য কাউকে অতিক্রম করতে হলে তাদের অন্য জন্তুটির গায়ের উপর উঠে পার হতে হবে। দ্বিমাত্রিক জীব যদি এমন কিছু খায় যা সে সম্পূর্ণ হজম করতে পারবে না তাহলে খাদ্যের অবিশিষ্টাংশ (মূল –অনুবাদক) তাকে যে মুখে সে খেয়েছে সেই মুখ দিয়েই বের করে দিতে হবে। যদি দেহের ভিতরে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত পথ থাকে তাহলে জন্তুটি দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাবে। আমাদের দ্বিমাত্রিক জীব ভেঙে পড়বে। (চিত্র : ১০.৮) একইভাবে বলা যায় একটি দ্বিমাত্রিক জীবের রক্ত চলাচল কিভাবে হবে বোঝা কঠিন।

তিনটির বেশি স্থানিক মাত্রা হলেও সমস্যা দেখা দেবে। দুটি বস্তুপিণ্ডের দূরত্বের বৃদ্ধির সঙ্গে অন্তর্বর্তী মহাকর্ষ বলের হ্রাসপ্রাপ্তি ত্রিমাত্রিক স্থানে মহাকর্ষীয় বলের ঐ অবস্থায় হ্রাসপ্রাপ্তির তুলনায় অনেক বেশি হবে (দূরত্ব দ্বিগুণ হলে ত্রিমাত্রিক স্থানে মহাকর্ষীয় বল হ্রাস পেয়ে এক চতুর্থে পরিণত হয়, কিন্তু চারমাত্রিকে পরিণত হয় ১ এ, পাঁচমাত্রিকে পরিণত হয় ১. এ এবং মাত্রাবৃদ্ধির সঙ্গে মহাকর্ষীয় বলের হ্রাসপ্রাপ্তি এভাবেই চলতে থাকে)। এই তথ্যের অর্থ হল : পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহের সূর্যের প্রদক্ষিণ করার কক্ষের স্থিরত্ব হ্রাস পাবে অর্থাৎ বৃত্তাকার কক্ষের সামান্যতম অস্থিরতা হলে (অন্যান্য গ্রহের মহাকর্ষীয় আকর্ষণের ফলে যা হতে পারে) পৃথিবী সর্পিল গতিতে হয় সূর্য থেকে দূরে সরে যাবে নয়ত সূর্যের ভিতরে গিয়ে পড়বে। হয় আমরা ঠাণ্ডায় জমে যাব নয়ত পুড়ে যাব। আসলে তিনটির অধিক মাত্রা হলে দূরত্ব সাপেক্ষ মহাকর্ষের ঐ একই আচরণের অর্থ হবে চাপের সঙ্গে মহাকর্ষের ভারসাম্যের ফলে সূর্য যে স্থির অবস্থায় থাকে সেই স্থির অবস্থায় আর থাকতে পারবে না। হয় টুকরো টুকরো হয়ে যাবে নয়ত চুপসে কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হবে। যাই হোক না কেন পার্থিব জীবনের আলোক এবং তাপের উৎস হিসেবে সূর্য আর কোন কাজে লাগবে না। ক্ষুদ্রতর মানে বিচার করলে যে বৈদ্যুতিক বল ইলেকট্রনগুলোকে পরমাণুর কেন্দ্রকে আবর্তন করে ঘূর্ণায়মান রাখে সেই বলের আচরণও মহাকর্ষীয় বলের মত হবে। ফলে হয় ইলেকট্রনগুলো পরমাণু থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে পরমাণু থেকে নির্গত হবে কিম্বা সর্পিল গতিতে কেন্দ্রকে পতিত হবে। যাই হোক না কেন, যে পরমাণুকে আমরা চিনি সে পরমাণু আর আমরা পাব না।

সুতরাং স্পষ্টতই মনে হয় স্থান-কালের যে সমস্ত অঞ্চলে একটি কালিক এবং তিনটি স্থানিক মাত্রা কুঞ্চিত হয়ে ক্ষুদ্র হয়ে যায়নি একমাত্র সেই সমস্ত অঞ্চলেই প্রাণ অর্থাৎ আমরা প্রাণ বলতে যা বুঝি সেই রকম প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব। এর অর্থ হবে দুর্বল নরত্বীয় নীতির আশ্রয় নেয়া যেতে পারে তবে সেক্ষেত্রে এ তত্ত্বতত্ত্ব যে অন্ততপক্ষে মহাবিশ্বে ঐরকম অঞ্চলের অস্তিত্ব অনুমোদন করে সেটি দেখাতে হবে মনে হয় তত্ত্বতত্ত্ব এরকম অনুমোদন করে। মহাবিশ্বের অন্যান্য এরকম অঞ্চল কিম্বা এমন একাধিক মহাবিশ্ব (তার অর্থ যাই হোক না কেন) থাকার যথেষ্টই সম্ভাবনা রয়েছে, যেখানে সমস্ত মাত্রাই কুঞ্চনের ফলে ক্ষুদ্র কিম্বা যেখানে চারটি মাত্রাই প্রায় সমতল (flat), কিন্তু সেই সমস্ত অঞ্চলে সংখ্যক কার্যকর মাত্রাগুলো পর্যবেক্ষণ করার মত বুদ্ধিমান জীব থাকবে না।

স্থান-কালের প্রতীয়মান মাত্রার সংখ্যার প্রশ্ন ছাড়াও ততত্ত্বের আরো অনেকগুলো সমস্যা রয়েছে। তদ্ভূতত্ত্ব পদার্থবিদ্যার চূড়ান্ত ঐক্যবদ্ধ তত্ত্বরূপে ঘোষিত হওয়ার আগে এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে। আমরা এখনও জানি না সমস্ত অসীম পরস্পরকে বাতিল করে কিনা আমাদের পর্যবেক্ষণ করা বিশেষ ধরনের কণিকার সঙ্গে তন্তুর উপরের তরঙ্গগুলোকে কিভাবে সম্পর্কিত করতে হবে তাও আমরা জানি না। তবুও এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আগামী কয়েক বছরের ভিতরে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় এবং এ শতাব্দীর শেষাশেষি আমরা জানতে পারব তদ্ভুতত্ব সত্যিই বহু আকাঙ্ক্ষিত পদার্থবিদ্যার ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব কি না।

কিন্তু এরকম ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব থাকা কি সত্যিই সম্ভব? না কি আমরা শুধুই মরীচিৎকার পিছনে ছুটছি? তিনটি সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় : (১) একটি সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব সত্যিই রয়েছে এবং আমরা যথেষ্ট বুদ্ধিমান হলে কোন না কোনদিন সে তত্ত্ব আবিষ্কার করতে পারব। (২) মহাবিশ্ব সম্পর্কে চূড়ান্ত কোন তত্ত্ব নেই। শুধু রয়েছে বহু তত্ত্বের অসীম পরম্পরা, সে তত্ত্বগুলো ক্রমশই অধিকতর নির্ভুলভাবে মহাবিশ্বের বিবরণ দান করে।

১৪৬

(৩) মহাবিশ্বের কোন তত্ত্ব নেই। একটি বিশেষ সীমার বাইরে ঘটনাবলি সম্পর্কে কোন ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না। ঘটনাগুলো ঘটে যাদৃচ্ছিক ভাবে, এলোমলো ভাবে।

অনেকে হয়ত তৃতীয় সম্ভাবনার সপক্ষে বলবেন। তাদের যুক্তি, এরকম সম্পূর্ণ এক কেতা বিধি থাকলে সেগুলো ঈশ্বরের নিজের মনের পরিবর্তন করে বিশ্বে হস্তক্ষেপ করার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করত। এ ব্যাপারটি অনেকটা সেই প্রাচীন স্ববিরোধিতার মত : ঈশ্বর কি এমন একটি পাথর তৈরি করতে পারেন যেটা এত ভারি যে তিনি নিজেই সেটা তুলতে পারেন না? ঈশ্বর তার মনের পরিবর্তন করতে চাইতে পারেন এই চিন্তাধারা একটি হেত্বাভাসের (fallacy) উদাহরণ। এদিকে প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন সেন্ট অগাস্টিন (Saint Augustine)। এই হেত্বাভাসটি হল ঈশ্বর কালে অবস্থান করেন এই কল্পন। আসলে ঈশ্বর যে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন কাল তার একটি ধর্ম মাত্র। অনুমান করা যেতে পারে তিনি যখন মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন তখন নিজের মনের বাসনা তার জানা ছিল।

কণাবাদী বলবিদ্যার (quantum mechanics) আবির্ভাবের পর আমরা মেনে নিয়েছি সম্পূর্ণ নির্ভুলভাবে ঘটনাবলি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না এবং কিছু মাত্রায় অনিশ্চয়তা সব সময়ই থাকে। পছন্দ হলে এলোমেলো অনিশ্চয়তার দায়িত্ব ঈশ্বরের হস্তক্ষেপের উপর আরোপ করা যেতে পারে। কিন্তু এই হস্তক্ষেপ হবে অদ্ভুত, কারণ এই হস্তক্ষেপ কোন উদ্দেশ্যের অভিমুখে এরকম প্রমাণ নেই। যদি থাকত তাহলে সংজ্ঞা অনুসারেই একে এলোমেলো বলা যেত না। আধুনিক যুগে আমরা উপরে উল্লিখিত তৃতীয় সম্ভাবনাটি কার্যকর ভাবে দূর করেছি। এ সম্ভাবনা দূর করেছি বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য নতুনভাবে নির্দেশ করে : বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য এমন এক কেতা বিধি গঠন করা যে বিধি আমাদের অনিশ্চয়তার নীতি দ্বারা নির্ধারিত সীমা অবধি ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা দান করবে।

দ্বিতীয় সম্ভাবনা হল সংখ্যায় অসীম তত্ত্ব পরম্পরা রয়েছে এবং সে তত্ত্বগুলো ক্রমশই অধিকতর সংস্কৃত (refined) হয়ে চলেছে। এর সপক্ষে আমাদের এ পর্যন্ত সঞ্চিত সমস্ত অভিজ্ঞতার ঐক্য রয়েছে। অনেক সময় আমরা নিজেদের মাপনের সূক্ষ্মতা (sensitiv ity) বাড়িয়েছি কিম্বা নতুন শ্রেণীর পর্যবেক্ষণ করেছি, ফলে আকিস্তৃত হয়েছে নতুন এমন পরিঘটনা যেগুলো বর্তমান তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণীতে নেই। এই পরিঘটনাগুলো ব্যাখ্যা করার জন্য আমাদের আবিষ্কার করতে হয়েছে অধিকতর অগ্রগামী তত্ত্ব। আধুনিক প্রজন্মের বৃহৎ ঐক্যবদ্ধ তত্ত্বের দাবি : প্রায় ১০০ Gev এর বৈদ্যুতিক দুর্বল (electroweak) ঐক্যকারী শক্তি (unification energy) এবং এক হাজার মিলিয়ন মিলিয়ান Gev এর বৃহৎ ঐক্যকারী শক্তির (Grand unified energy) মধ্যবর্তী অঞ্চলে নতুন কিছু ঘটবে না। এ দাবি যদি ভুল হয় তাহলে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না। যে কার্ক (Quark) এবং ইলেকট্রনকে আমরা এখন মৌলকণা বলে মনে করি, সত্যিই হয়ত আমরা তার চাইতে মূলগত গঠনের কয়েকটি নতুন স্তর আবিষ্কার করতে পারি।

কিন্তু মনে হয় বাক্সের ভিতরে বাক্সের” এই পরম্পরাকে সীমিত করতে পারে মহাকর্ষ । যদি কোন কণিকার শক্তি, যাকে প্লাঙ্ক শক্তি বলে, তার চাইতে অর্থাৎ দশ মিলিয়ান, মিলিয়ান, মিলিয়ান Gev (একের পিঠে উনিশটি শূন্য) এর চাইতে বেশি হয় তাহলে তার ভর এত ঘনীভূত (concentrated) হবে যে সে নিজেকে অবশিষ্ট মহাবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি ক্ষুদ্র কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হবে। সুতরাং (refined) তত্ত্বের এই পরম্পরা সীমিত হওয়া উচিত এবং তাহলে উচিত মহাবিশ্ব সম্পর্কে একটি চূড়ান্ত তত্ত্বের অস্তিত্ব থাকাও। বর্তমানে আমরা গবেষণাগারে খুব বেশি হলে ১০০ Gey এর কাছাকাছি শক্তি উৎপাদন করতে পারি। এই পরিমাণ শক্তির সঙ্গে প্লাঙ্ক শক্তির পার্থক্য অবশ্য বিরাট। নিকট ভবিষ্যতে আমরা কণিকা ত্বরণ যন্ত্রের সাহায্যেও এই পার্থক্য দূর করতে পারব না। কিন্তু মহাবিশ্বের অতি আদিম অবস্থা এমন একটি ক্ষেত্র (arena) যেখানে এরকম শক্তির অস্তিত্ব ছিল। আমার মনে হয় আমাদের ভিতরকার কয়েকজনের জীবন কালের ভিতরেই আদিম মহাবিশ্ব বিষয়ক গবেষণা এবং গাণিতিক সামঞ্জস্যের প্রয়োজনীয় উপাদানের সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ তত্ত্বের পথিকৃৎ হওয়ার খুবই সম্ভাবনা রয়েছে। অবশ্য অনুমান করছি তার আগে আমরা নিজেদের সামগ্রিক ধ্বংস ডেকে আনব না।

যদি সত্যিই আমরা মহাবিশ্ব বিষয়ক চূড়ান্ত তত্ত্ব আবিষ্কার করি তাহলে তার অর্থ কি হবে? প্রথম অধ্যায়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল– এ বিষয়ে আমরা কখনোই নিশ্চিত হতে পারব না যে আমরা সত্যিই সঠিক তত্ত্ব আবিষ্কার করেছি, তার কারণ তত্ত্ব প্রমাণ করা যায় না। কিন্তু তত্ত্বটি যদি গাণিতিক ভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এবং সবসময়ই যদি সে তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে পর্যবেক্ষণের ঐক্য দেখা যায় তাহলে আমরা সঠিক তত্ত্ব আবিষ্কার করেছি এরকম বিশ্বাস করা যুক্তিসঙ্গত হবে। এই আবিষ্কার মহাবিশ্বকে বুঝবার প্রচেষ্টায় মানব জাতির বৌদ্ধিক সংগ্রামের দীর্ঘ এবং গৌরবময় অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটাবে। তাছাড়া এই আবিষ্কার সাধারণ মানুষের মহাবিশ্বের শাসনবিধি সম্পর্কিত বোধেও বিপ্লব নিয়ে আসবে। নিউটনের সময় একজন শিক্ষিত লোকের পক্ষে মানবজাতির সমগ্র জ্ঞান ভাণ্ডার সম্পর্কে একটি ধারণা থাকা সম্ভব ছিল, অন্ততপক্ষে সম্ভব ছিল সে ধারণার সাধারণ রূপরেখা (outline) সম্পর্কে ধারণা করা। কিন্তু তার পর থেকে বিজ্ঞানের বিকাশের গতির ফলে এরকম সম্ভাবনা আর নেই। নতুন নতুন পর্যবেক্ষণ ফলের কারণ দর্শানোর জন্য তত্ত্বগুলো সব সময়েই পরিবর্তিত হচ্ছে। সে তত্ত্বগুলো সাধারণ মানুষের বুঝবার মত করে সঠিকভাবে হজম হয় না, সরলীকৃতও হয় না। বুঝতে হলে আপনাকে বিশেষজ্ঞ হতে হবে। কিন্তু তা হলেও বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলোর অতি সামান্য অংশ সম্পর্কেই সম্যক জ্ঞানের আশা আপনি করতে পারেন। তাছাড়া বিকাশের গতি এত দ্রুত যে স্কুলে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যা শেখানো হয় সেগুলো সবসময়ই একটু সেকেলে। জ্ঞানের দ্রুত অগ্রসরমান সীমান্তের সঙ্গে সামান্য কয়েকজনই তাল রাখতে পারেন কিন্তু তাঁদেরও সমস্ত সময় ব্যয় করতে হয় এই কাজে এবং তাদের বিশেষজ্ঞ হতে হয় একটি ক্ষুদ্র বিষয়ে। যে অগ্রগতি হচ্ছে অথবা অগ্রগতির ফলে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে জনগণের অবশিষ্ট অংশের সে সম্পর্কে ধারণা থাকে অতি সামান্য। এডিংটনকে যদি বিশ্বাস করা যায় তাহলে বলতে হয় সত্তর বছর আগে ব্যাপক অপেক্ষবাদ বুঝতেন মাত্র দু’জন। এখনকার দিনে বহু অযুত (দশ হাজার) বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক এই তথ্য বোঝেন এবং বহু নিযুত (মিলিয়ান দশ লক্ষ) মানুষের এই চিন্তন সম্পর্কে অন্ততপক্ষে একটি ধারণা আছে। যদি সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব আবিষ্কার হয় তাহলে কালে কালে সে তত্ত্ব হজমও হবে আর সরলীকৃতও হবে এবং স্কুলেও পড়ানো হবে। অন্ততপক্ষে তার রূপরেখা তো পড়ানো হবেই। যে বিধি মহাবিশ্ব শাসন করে এবং আমাদের অস্তিত্বের জন্য দায়ী, আমরা সবাই সে বিধিগুলোর কিছু কিছু বুঝতে পারব।

যদি আমরা সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব আবিষ্কারও করি তাহলে তার অর্থ এই হবে না যে সাধারণভাবে আমরা ঘটনাগুলো সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারব। তার দুটি কারণ। প্রথম কারণ কণাবাদী বলবিদ্যা আমাদের ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতার উপর একটি সীমা আরোপ করে। এই সীমা অতিক্রম করার কোন উপায় আমাদের নেই। কার্যক্ষেত্রে কিন্তু এই প্রথম গণ্ডি (সীমা) দ্বিতীয় গণ্ডির চাইতে কম অনতিক্রম্য। দ্বিতীয় গণ্ডির উৎস একটি সত্য (fact)। সেই সত্য অনুসারে খুব সহজ সরল পরিস্থিতি ছাড়া কোন পরিস্থিতিতেই আমরা নির্ভুলভাবে সমীকরণগুলোর সমাধান (solve the equation) করতে পারিনি (এমন কি আমরা নিউটনের মহাকর্ষীয় তত্ত্ব অনুসারে তিনটি বস্তৃপিণ্ডের গতি সম্পৰ্কীয় সমকিরণ নির্ভুলভাবে সমাধান করতে পারি না, বস্তুপিণ্ডের সংখ্যা এবং তত্ত্বের জটিলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সমাধানের অসুবিধাও বৃদ্ধি পায়)। অত্যন্ত চরম পরিস্থিতি ছাড়া অন্যান্য সমস্ত পরিস্থিতিতেই পদার্থের আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী বিধিগুলো আমাদের এখন জানা। বিশেষ করে আমরা জানি সম্পূর্ণ রসায়ন শাস্ত্র এবং জীববিজ্ঞানের মৌলিক বিধিগুলোর ভিত্তি। তবুও আমরা এই বিষয়গুলোকে সমাধান করা সমস্যার স্তরে নিশ্চয়ই নামিয়ে আনতে পারিনি। এখন পর্যন্ত গাণিতিক সমীকরণের সাহায্যে মানসিক আচরণ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার ব্যাপারে আমাদের সামান্যই সাফল্য হয়েছে। সুতরাং যদি আমরা সম্পূর্ণ এক কেতা বিধি আবিষ্কারও করি তাহলেও তার পরবর্তী কালের জন্য থেকে যাবে আমাদের বুদ্ধিকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করার মত কর্মের দায়িত্ব। সে কর্ম হল জটিল এবং বাস্তব পরিস্থিতিগুলোর সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কার্যকর ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা লাভের জন্য উন্নততর আসন্নতা (approximation) লাভের পদ্ধতি আবিষ্কার (better approximation methods) একটি সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব শুধুমাত্র প্রথম ধাপ : আমাদের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হল : আমাদের নিজস্ব অস্তিত্ব এবং আমাদের সর্বপাশ্বের ঘটনাবলি সম্পূর্ণ বোঝ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *