০৪. অনিশ্চয়তাবাদ (The Uncertainty Principle)
বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলোর সাফল্য, বিশেষ করে, নিউটনীয় মহাকর্ষীয় তত্ত্বের সাফল্যের ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ফরাসী বৈজ্ঞানিক মার্কুইস দ্য লাপ্লাস (Marquis De Laplace) যুক্তি দেখিয়েছিলেন–মহাবিশ্ব সম্পূর্ণভাবে নির্ধারণীয় (বৈজ্ঞানিক নিয়তিভিত্তিক (deterministic)। লাপ্লাসের প্রস্তাবনা ছিল, এমন একগুচ্ছ বৈজ্ঞানিক বিধি থাকা উচিত যার সাহায্যে মহাবিশ্বের যে কোন এক সময়কার অবস্থা যদি সম্পূর্ণভাবে জানা থাকে, তা হলে ভবিষ্যতে মহাবিশ্বে কি ঘটবে সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব হবে। উদাহরণ : সূর্য এবং গ্রহগুলোর যে কোন এক সময়কার দ্রুতি এবং অবস্থান যদি জানা থাকে, তা হলে নিউটনের বিধিগুলোর সাহায্যে সৌরতন্ত্রের অন্য যে কোন সময়কার অবস্থা গণনা করে বলা সম্ভব। এক্ষেত্রে নির্ধারণীয়তাবাদ determinism) বেশ স্পষ্ট। কিন্তু লাপ্লাস আরো খানিকটা অগ্রসর হয়েছিলেন। তাঁর অনুমান ছিল, অন্য সমস্ত বিষয় সম্পর্কে, এমন কি, মানসিক আচরণ সম্পর্কেও এই ধরনের বিধি রয়েছে।
অনেকেই বৈজ্ঞানিক নির্ধারণীয়তাবাদের (determinism) ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁরা মনে করতেন, এই মতবাদ পৃথিবীতে ঈশ্বরের হস্তক্ষেপের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে। কিন্তু, তবুও এই শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত নির্ধারণীয়তাবাদই ছিল প্রমাণ (standard) বৈজ্ঞানিক অনুমান। এই বিশ্বাস পরিত্যাগ করতে হবে এই সম্পর্কে প্রথম ইঙ্গিতগুলোর একটি ছিল ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিক লর্ড র্যালে (Lord Raylcigh) এবং স্যার জেমস জিনসের (Sir James Jeans) গণনা। সে গণনায় দেখা যায়, যে কোন উত্তপ্ত বস্তুপিণ্ড কিম্বা তারকার মত একটি পস্তুপিণ্ড আবশ্যিকভাবে অসীম হারে শক্তি বিকিরণ করবে। তখন আমরা যা বিশ্বাস করতাম, সেই বিধি অনুসারে একটি উত্তপ্ত বস্তুপিণ্ডের সমভাবে সমস্ত স্পন্দাঙ্কে (frequency) বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ (electro magnetic wave) [যেমন–বেতার তরঙ্গ, দৃশ্যমান আলোক, কিম্বা এক্স-রে] বিকিরণ করা উচিত। উদাহরণ : একটি উত্তপ্ত বস্তুপিণ্ড সেকেন্ডে এক থেকে দুই মিলিয়ান মিলিয়ান তরঙ্গে স্পন্দাঙ্কে যে পরিমাণ শক্তি বিকিরণ করে, সেই একই পরিমাণ শক্তির সেকেন্ডে দুই থেকে তিন মিলিয়ান মিলিয়ান তরঙ্গের স্পন্দাঙ্কেও বিকিরণ করা উচিত। যেহেতু প্রতি সেকেন্ডে তরঙ্গের সংখ্যা অসীম সেজন্য এর অর্থ হবে বিকিরিত (radi ated) শক্তির পরিমাণও অসীম।
সুস্পষ্ট হাস্যকর এই ফলশ্রুতি এড়ানোর জন্য জার্মান বৈজ্ঞানিক ম্যাক্স প্রাঙ্ক (Max Planck) ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে প্রস্তাব করেন– আলোক, এক্স-রে এবং অন্যান্য তরঙ্গ যাদৃচ্ছিক (arbitrary) হারে বিকিরিত হতে পারে না। বিকিরিত হতে পারে শুধুমাত্র বিশেষ প্যাকেটে (packet), তার নাম তিনি দিয়েছিলেন কোয়ান্টা। তাছাড়া প্রতিটি কোয়ান্টামেই একটা বিশেষ পরিমাণ শক্তি থাকে এবং তরঙ্গের স্পন্দাঙ্ক যত বেশি হয় শক্তিও হয় তত বেশি। সুতরাং যথেষ্ট উচ্চ স্পন্দাঙ্ক হলে এক একটি কোয়ান্টামের বিকিরণে যে শক্তির প্রয়োজন হবে সেটা প্রাপ্তিযোগ্য শক্তির চাইতে বেশি। সুতরাং উচ্চ স্পন্দাঙ্কের বিকিরণ কমে যাবে। অতএব, বস্তুপিণ্ড যে শক্তি ক্ষয় করবে, সেটাও হবে সীমিত।
কোয়ান্টাম প্রকল্প (hypothesis) তপ্ত বস্তুপিণ্ডগুলো থেকে বিকিরণ নির্গত হওয়ার পর্যবেক্ষণ করার হার ভালই ব্যাখ্যা করেছিল। কিন্তু ১৯২৬ সালের আগে পর্যন্ত নির্ধারণীয়তাবাদ (determinism) সাপেক্ষ এই প্রকল্পের ফলশ্রুতি বোঝা যায়নি। সেই সময় ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ (Werner Heisenberg) নামে আর একজন জার্মান বৈজ্ঞানিক বিখ্যাত অনিশ্চয়তাবাদ (uncertainty principle) গঠন করেন। একটি কণিকার (Particle) ভবিষ্যৎ অবস্থান ও গতিবেগ (velocity) সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে হলে তার বর্তমান অবস্থান ও গতিবেগ নির্ভুলভাবে মাপা প্রয়োজন। স্পষ্টতই এ কাজ করার সহজ পন্থা কণাটির উপর আলোকপাত করা। তাহলে কিছু আলোক তরঙ্গকে এ কণিকা বিক্ষিপ্ত (scattered) করে দেবে এবং তার ফলে আর অস্থানের নির্দেশ পাওয়া যাবে। কিন্তু আলোকের দুটি তরঙ্গশীর্ষের দূরত্বের চাইতে বেশি নির্ভুলভাবে ঐ কণিকার অবস্থান নির্ধারণ করা যাবে না। সেজন্য প্রয়োজন হবে হ্রস্ব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকপাত করা, যাতে কণিকাটির অবস্থান সঠিকভাবে মাপা যায়। কিন্তু প্লঙ্কের কোয়ান্টাম প্রকল্প অনুসারে যাদৃচ্ছিক (arbitrary) ক্ষুদ্র পরিমাণ আলোক ব্যবহার করা সম্ভব নয়। অন্ততপক্ষে, এক কোয়ান্টাম আলোক ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু এই কোয়ান্টাম কণিকাটিকে অস্থির করে তুলবে (disturb) এবং তার গতিবেগে এমন পরিবর্তন আনবে যে সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যাবে না। তাছাড়া, অবস্থানের মাপন যত নির্ভুল হবে, আলোকের তরঙ্গদৈর্ঘ্যও তত ক্ষুদ্র হবে। সুতরাং এক কোয়ান্টামে শক্তির পরিমাণও হবে উচ্চতর। তাহলে, কণিকাটির গতিবেগের স্থিরতৃকে বৃহত্তর শক্তি বিঘ্নিত করে তুলবে। অন্যভাবে বলা যায়, একটি কণিকার অবস্থান যত নির্ভুলভাবে মাপার চেষ্টা করা যাবে, তার দ্রুতির মাপন হবে তত কম নির্ভুল এবং এর বিপরীতও সত্য হবে (vice versa)। হাইজেনবার্গ দেখিয়েছিলেন কণিকাটির ভরকে তার গতিবেগের অনিশ্চয়তা দিয়ে গুণ করে তাকে কণিকার অবস্থানের অনিশ্চয়তা দিয়ে গুণ করলে গুণফল কখনোই একটি বিশেষ পরিমাণের মত হতে পারে না। এই পরিমাণই প্লাঙ্কের ধ্রুবক (Plank’s constant) বলে পরিচিত। তাছাড়া, এই সীমা কণিকাটির অবস্থান মাপনের চেষ্টার পদ্ধতি কিম্বা গতিবেগ মাপনের চেষ্টার পদ্ধতি কিম্বা কণিকার জাতিরূপের (type) উপর নির্ভরশীল নয়: হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতি বিশ্বের একটি মূলগত অনতিক্ৰমণীয় ধর্ম।
পৃথিবী সাপেক্ষ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে এই অনিশ্চয়তার নীতির নিহিতার্থ গভীর। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় কেটে গেছে। এখনও বহু দার্শনিক ব্যাপারটার মর্ম সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারেন নি এবং এখনও এই অনিশ্চয়তার নীতি বহু দ্বন্দ্বের মূলে রয়েছে। লাপ্লাসের (Laplace) স্বপ্ন ছিল বিজ্ঞানের এমন একটি তত্ত্ব মহাবিশ্বের এমন একটি প্রতিরূপ যা হবে সম্পূর্ণ নির্ধারণযোগ্য (deterministic) : মহাবিশ্বের বর্তমান অবস্থানই যদি নির্ভুলভাবে মাপা সম্ভব না হয়, তা হলে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নির্ভুলভাবে বলা অসম্ভব। এই পরিস্থিতি লাপ্লাসের স্বপ্নের অন্তিম অবস্থারই ইঙ্গিত। অবশ্য আমরা এখনো কল্পনা করতে পারি কোন এক অতিপ্রাকৃত জীব সাপেক্ষ এমন একগুচ্ছ বিধি রয়েছে যে বিধি ঘটনাবলি সম্পূর্ণভাবে নির্ধারণ করে। তিনি হয়ত কোনরকম অস্থিরতার সৃষ্টি না করেই মহাবিশ্বের বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে পারেন! কিন্তু আমাদের মত সাধারণ মরণশীল জীবের পক্ষে মহাবিশ্বের সেই প্রতিরূপের কোন আকর্ষণ নেই। তার চাইতে বরং ওকাম্স্ রেজর (Occam’s Razor)(১) নামক মিতব্যয়িতার নীতি প্রয়োগ করে তত্ত্বটির যা কিছু পর্যবেক্ষণ করা যায় না সবটাই হেঁটে বাদ দিতে পারি। উনিশশ’ কুড়ির দশকে এই দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে হাইজেনবার্গ, এরভিন শ্রয়েডিংগার এবং পল্ ডিরাক বলবিদ্যার পুনর্গটন করে কণাবাদী বলবিদ্যা (quantum mechanics) নামক নতুন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এই নতুন তত্ত্বের ভিত্তি হল অনিশ্চয়তাবাদ। এই তত্ত্ব অনুসারে কণিকাগুলোর আর পৃথক সুসংজ্ঞিত (well-defined) অপর্যবেক্ষণযোগ্য অবস্থান এবং গতিবেগ রইল না। তার বদলে তাদের থাকল কোয়ান্টাম অবস্থা। সে অবস্থা গতিবেগ এবং অবস্থানের সমন্বয়।
সাধারণত, কণাবাদী বলবিদ্যার (quantum mechanics) ভবিষ্যদ্বাণীতে একটি পর্যবেক্ষণের একক সুনিশ্চিত ফল থাকে না। তার বদলে সে ভবিষ্যদ্বাণীতে থাকে অনেকগুলো পৃথক পৃথক (defferent) ফলশ্রুতি। তাছাড়া থাকে ফলগুলোর প্রতিটির কতটা সম্ভাব্যতা। অর্থাৎ কেউ যদি বহুসংখ্যক সমরূপতন্ত্রের (similar system) একই মাপ নেন এবং তাদের প্রতিটি যদি একইভাবে শুরু হয়ে থাকে, তাহলে দেখতে পাবেন বিশেষ সংখ্যক ক্ষেত্রে মাপন ফল হবে ক। ভিন্ন আর কিছু ক্ষেত্রে মাপন ফল হবে খ এবং এই রকম (and so on)। কতবার ফল ক কিম্বা খ হবে সে সম্পর্কে একটা আসন্ন (approximate) সংখ্যা ভবিষ্যদ্বাণীতে থাকতে পারে। কিন্তু একক একটি মাপনের বিশেষ ফল (specific result) সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যাবে না। সুতরাং কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উপস্থিত করেছে ভবিষ্যদ্বাণী করার অসম্ভাব্যতা কিম্বা একটা এলোমেলো অনিশ্চিত অবস্থা (randomness)। এই পরিস্থিতি এড়ানো অসম্ভব। এই সমস্ত চিন্তাধারার বিকাশে আইনস্টাইন খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে তাঁর খুবই আপত্তি ছিল। কোয়ান্টাম তত্ত্বে অবদানের জন্য আইনস্টাইনকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও মহাবিশ্ব শাসিত হয় আপতন (chance) দ্বারা এ তত্ত্ব আইনস্টাইন কখনোই মেনে নিতে পারেন নি। এ সম্পর্কে তার মনোভাব সংক্ষেপে তাঁর বিখ্যাত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে– “ঈশ্বর পাশা খেলেন না।” কিন্তু অন্যান্য বৈজ্ঞানিকদের অধিকাংশই কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে মেনে নিতে ইচ্ছুক ছিলেন। তার কারণ, এ বলবিদ্যার সঙ্গে পরীক্ষামূলক তথ্যের নিখুঁত ঐক্য ছিল। সত্যিই এ তথ্য বিশেষভাবে সাফল্য লাভ করেছে। আধুনিক বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিবিদ্যার প্রায় অধিকাংশের ভিত্তি এই তত্ত্ব। ট্রানজিস্টার এবং সমকলিত পরিপথ (intergrated circuit) নিয়ন্ত্রণ করে এই তত্ত্ব। টেলিভিশন এবং ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিরও অবিচ্ছেদ্য উপাদান ট্রানজিস্টার এবং সমকলিত পরিপথ integrated circuit)। আধুনিক রসায়ন এবং জীববিদ্যারও ভিত্তি এই তত্ত্ব। ভৌতবিজ্ঞানের যে দুটি ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে এখনও সঠিকভাবে যুক্ত করা যায়নি, সে দুটি হল মহাকর্ষ এবং মহাবিশ্বের বৃহত্মাত্রিক গঠন (large scale structure)।
আলোক তরঙ্গ দিয়ে গঠিত হলেও প্লাঙ্কের কোয়ান্টাম প্রকল্প বলে, কোন কোন অবস্থায় আলোকের আচরণ এমন যে মনে হয় আলোক কণিকার দ্বারা গঠিত। আলোক শুধুমাত্র প্যাকেট (packet) কিম্বা কোয়ান্টাম রূপেই নির্গত হতে পারে কিম্বা বিশোষিত হতে পারে। একইভাবে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তাবাদের অর্থ কণিকাও কোন কোন ব্যাপারে তরঙ্গের মত আচরণ করে। তাদের কোন নিশ্চিত অবস্থান নেই। সেগুলো বিশেষ সম্ভাবনায় বিতরিত হয়ে “প্রলিপ্ত হয়” (smeared out with a certain probability distribution)। কোয়ান্টাম গণিতের তত্ত্বের ভিত্তি সম্পূর্ণ অন্য এক ধরনের গণিত। এ গণিত কণিকা এবং তরঙ্গের বাগ্বিধিতে (terms) এর বাস্তব জগতের বিবরণ দান করে না। এই সমস্ত বাগ্বিধিতে শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণ করা বিশ্বেরই বিবরণ দেয়া যেতে পারে। সেজন্য কোয়ান্টাম বলবিদ্যাতে তরঙ্গ এবং কণিকার ভিতরে দ্বিত্ব duality) রয়েছে। কোন কোন উদ্দেশ্যে কণিকাগুলোকে তরঙ্গরূপে চিন্তা করলে সুবিধা হয়, আবার কোন কোন উদ্দেশ্যে তরঙ্গকে কণিকা রূপে চিন্তা করলেই ভাল। এর একটা গুরুত্বপূর্ণ ফলশ্রুতি হল, দুই কেতা (set) তরঙ্গ কিম্বা কণিকার ভিতরে ব্যতিচার (interference) পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। অর্থাৎ এক কেতা (set) তরঙ্গের শীর্ষ অন্য কেতা (set) তরঙ্গপাদের (wave trough) সঙ্গে সমস্থানিক (coincide) হতে পারে। তাহলে দুই কেতা তরঙ্গ পরস্পরকে বাতিল করে দেবে। আশা করা যেতে পারত দুটি যোগের ফলে আরো শক্তিশালী একটা তরঙ্গ হবে কিন্তু সেটা হয় না (চিত্র : ৪.১) সাবানের ফেনার বুদবুদের ভিতরে যে রঙ দেখা যায়, সেটা আলোকের ক্ষেত্রে ব্যতিচারের (interference) একটি সুপরিচিত উদাহরণ। যে সূক্ষ্ম জরের পর্দা এ বুদবুদটি গঠন করে, তার দুপাশ থেকে আলোর প্রতিফলনই এর কারণ। সাদা আলো বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোক নিয়ে গঠিত। বিশেষ কয়েকটি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ক্ষেত্রে একদিক থেকে প্রতিফলিত তরঙ্গগুলোর শীর্ষ অন্য দিক থেকে প্রতিফলিত তরঙ্গপাদ সমস্থানিক (coincide) হয়। এই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অনুরূপ রঙগুলো প্রতিফলিত আলোকে অনুপস্থিত থাকে। সুতরাং সে আলোকগুলোকে রঙিন মনে হয়।
কোয়ান্টাম বলবিদ্যা যে দ্বিত্ব (duality) উপস্থাপন করেছে, তার দরুন কণিকার ক্ষেত্রেও ব্যতিচার হতে পারে। তথাকথিত দুটি চেরা ছিদ্রের পরীক্ষা (two-slit experiment, চিত্র : ৪.২) এর একটা বিখ্যাত উদাহরণ দুটি সমান্তরাল ও সরু চেরাই যুক্ত একটা বিভাজক প্রাচীরের কথা বিবেচনা করুন। প্রাচীরের একপাশে একটি বিশেষ রঙের আলোকের উৎস স্থাপন করা হোক (অর্থাৎ, একটি বিশেষ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো)। অধিকাংশ আলোই বিভাজক প্রাচীরে পড়বে কিন্তু খুব সামান্য পরিমাণ আলো ঐ চেরাই করা ফাঁকের ভিতর দিয়ে যাবে। এবার ভেবে নেয়া যাক বিভাজক প্রাচীরের অন্যদিকে একটা পর্দা টাঙানো হয়েছে। পর্দার যে কোন বিন্দুতেই দুটি চেরাই করা ফাঁক থেকে তরঙ্গ এসে পড়বে। কিন্তু সাধারণত দুটি চেরাই করা ফাঁক দিয়ে উৎস থেকে পর্দায় পৌঁছাতে আলোর ভিন্ন ভিন্ন দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে। এর অর্থ হবে চেরাইয়ের ফাঁক দিয়ে নির্গত তরঙ্গগুলো যখন পর্দায় পৌঁছাবে তখন তারা পরস্পর সাপেক্ষ একই দশায় (phase) থাকবে না। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা পরস্পরকে বাতিল করবে আবার কোন কোন ক্ষেত্রে তারা পরস্পরকে শক্তিশালী করবে। ফল হবে আলোর এবং অন্ধকারের একটা বিশিষ্ট নক্সার ঝালর।
উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, যদি আলোক উৎসের বদলে নির্দিষ্ট নিশ্চিত গতি সম্পন্ন কোন কণিকা প্রতিস্থাপন করা যায়, তা হলে একই রকম নক্সা পাওয়া যাবে। সে কণিকা উলেকট্রনও হতে পারে (এর অর্থ হল অনুরূপ তরঙ্গগুলোও একটি নির্দিষ্ট নিশ্চিত দৈর্ঘ্য রয়েছে)। ব্যাপারটা আরো অদ্ভুত এইজন্য যে শুধুমাত্র একটি চেরাই করা ফাঁক থাকলে নক্সা পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় পর্দার উপরে সমরূপে বণ্টিত (uniformly distributed) ইলেকট্রন। অনেকে ভাবতে পারেন, আর একটি চেরাই করা ফাঁক থাকলে পর্দার প্রতিবিন্দুতে যে ইলেকট্রনগুলো আঘাত করছে সেগুলোর সংখ্যা বাড়বে। কিন্তু ব্যতিচারের (interference) জন্য বাস্তবে কোন কোন স্থানে ইলেকট্রনের সংখ্যা বরং কমে যায়। এই চেরাই করা ফাঁক দুটো দিয়ে যদি একটা করে ইলেকট্রন পাঠানো যায়, তা হলে আশা করা উচিত ছিল ইলেকট্রনগুলো কোনবার একটি ফাঁক দিয়ে ঢুকবে, কোনবার অন্য ফাঁক দিয়ে ঢুকবে। অর্থাৎ শুধুমাত্র একটি ফাঁক হলে তাদের আচরণ যে রকম হত, সে রকম আচরণ হবে। ফলে পর্দার উপরে সমরূপ বণ্টন হবে। বাস্তব ক্ষেত্রে কিন্তু একটি করে ইলেকট্রন পাঠালেও নক্সা দেখা দেয়। তা হলে প্রতিটি ইলেকট্রন নিশ্চয়ই একই সময়ে দুটি ফাঁক দিয়ে ঢুকছে!
কণিকাগুলোর ভিতরে ব্যতিচার (interference) আমাদের পরামাণুর গঠন বোঝার পক্ষে একটি বিনিশ্চায়ক (crucial) পরিঘটনা। রসায়ন ও জীবনিদ্যায় এই পরমাণুই মূল একক (basic unit)। আর এই পরমাণুই আমরা ও আমাদের চারপাশে যা আছে সেগুলো গঠন করার ইট। এ শতাব্দীর প্রথমে ভাবা হত অনুগুলো অনেকটা সূর্যের কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান গ্রহের মত। ইলেকট্রনগুলো (অপরা (negative) বৈদ্যুতিক কণিকা] কেন্দ্রীয় নিউক্লিয়াসের চারপাশে কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান। কেন্দ্রীয় নিউক্লিয়াস পরা (positive) বিদ্যুৎ বহন করে। অনুমান করা হত সূর্য এবং গ্রহগুলোর অন্তর্বর্তী মহাকর্ষীয় আকর্ষণ (gravitational attraction) যে রকম গ্রহগুলোকে তাদের কক্ষপথে রাখে ঠিক সেই রকম অপরা এবং পরা বিদ্যুতের আকর্ষণও ইলেকট্রনগুলোকে তাদের কক্ষপথে রাখে। এ তত্ত্বের অসুবিধা হল, কোয়ান্টাম বলবিদ্যার আগেকার বলবিদ্যা এবং বিদ্যুৎবিজ্ঞানের (electricity) বিধি অনুসারে পূর্বাভাস ছিল : ইলেকট্রনগুলো ক্রমশ শক্তি হারাবে এবং ক্রমশ ঘুরতে ঘুরতে ভিতরে প্রবেশ করবে এবং নিউক্লিয়াসের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হবে। এর অর্থ হত পরমাণু এবং সমস্ত পদার্থই দ্রুত চুপসে অত্যন্ত ঘন একটি অবস্থায় পৌঁছাবে। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের বৈজ্ঞানিক নীলস বোর (Niels Bohr) এই সমস্যার একটি আংশিক সমাধান পেয়েছিলেন। তার প্রস্তাবনা (suggestion) ছিল ইলেকট্রনগুলো হয়ত কেন্দ্রীয় নিউক্লিয়াস থেকে যে কোন দূরত্বে অবস্থিত কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করতে পারে না। প্রদক্ষিণ করতে পারে কয়েকটা বিশেষ নির্দিষ্ট দূরত্বে। এছাড়া যদি অনুমান করা যায় এই সমস্ত দূরত্বের যে কোন একটিতে মাত্র একটি কিম্বা দুটি ইলেকট্রন কক্ষপথে ঘুরতে পারে তাহলে পরমাণু টুপসে যাওয়ার সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে। কারণ, সে ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন শক্তি এবং দূরত্বে অবস্থিত কক্ষপথ ছাড়া ইলেকট্রনগুলো অন্য কোন কক্ষপথে ঘুরতে পারে না।
এই প্রতিরূপ সরলতম পরমাণু হাইড্রোজেনের গঠন খুব ভালই ব্যাখ্যা করতে পারে। কারণ তার নিউক্লিয়াসের চারপাশে কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান একটিমাত্র ইলেকট্রন থাকে। কিন্তু এই তত্ত্ব কি করে আরো জটিল পরমাণুর ক্ষেত্রে প্রসারিত করা যায় সেটা খুব স্পষ্ট ছিল না। তাছাড়া অনুমোদিত সীমিত কয়েক কেতা মাত্র কক্ষ সম্পর্কে ধারণা খুব যাদৃচ্ছিক বলে মনে হত। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার নতুন তত্ত্ব এই অসুবিধা দূর করেছে। এই তত্ত্বে প্রকাশ পেয়েছে নিউক্লিয়াসের সর্বদিকে কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান ইলেকট্রনকে একটি তরঙ্গও ভাবা চলে। সেই তরঙ্গের দৈর্ঘ্য নির্ভর করবে তার গতিবেগের উপর। কোন কোন কক্ষপথের ক্ষেত্রে কক্ষের দৈর্ঘ্য হবে ইলেকট্রনের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের একটি পূর্ণ সংখ্যার অনুরূপ (তবে ভগ্নাংশের নয়)। এই সমস্ত কক্ষপথের ক্ষেত্রে প্রতি আবর্তনে তরঙ্গশীর্ষ থাকবে একই জায়গায়। সুতরাং তরঙ্গগুলো যোগ হতে থাকবে। এই কক্ষপথগুলো হবে বোরের অনুমোদিত কক্ষগুলোর অনুরূপ। কিন্তু যে সমস্ত কক্ষপথের দৈর্ঘ্য তরঙ্গদৈর্ঘ্যগুলোর একটি পূর্ণ সংখ্যা নয়, সে সমস্ত ক্ষেত্রে ইলেকট্রনগুলো যখন ঘূর্ণায়মান তখন প্রতিটি তরঙ্গশীর্ষকে একটি তরঙ্গপাদ বাতিল করে দেবে। যে তরঙ্গগুলোর দৈর্ঘ্য পূর্ণ সংখ্যা নয়, সেগুলো অনুমোদিত হবে না।
আমেরিকান বৈজ্ঞানিক রিচার্ড ফেনম্যানের (Richard Feynman) উপস্থিত করা তথাকথিত ইতিহাসের যোগফল (sum over histories), তরঙ্গ এবং কণার দ্বিত্ব (duality) অনুধাবন করার একটা খুব সুন্দর পদ্ধতি। এই উপস্থাপনে চিরায়ত অ কোয়ান্টাম তত্ত্বের মত স্থান-কালে কণিকার একটি মাত্র ইতিহাস কিম্বা পথ অনুমান করা হয় না। তার বদলে অনুমান করা হয় কণিকাটি সম্ভাব্য যে কোন পথেই ক থেকে খ-এ যেতে পারে। প্রতিটি পথের সঙ্গে দুটি সংখ্যা যুক্ত। একটি সংখ্যা তরঙ্গের আকার নির্দেশক, আর অন্যটি নির্দেশ করে এই চক্রে তার স্থান (অর্থাৎ এটা শীর্ষে না পাদে অবস্থিত)। ক থেকে খ-এ যাবার সম্ভাবনা পাওয়া যায় পথ সাপেক্ষ সমস্ত তরঙ্গের যোগফল দিয়ে। সাধারণভাবে কাছাকাছি পথের কেতাগুলো তুলনা করলে (a set of neighbouring path) এই চক্রে দশা (phase) অথবা অবস্থানের প্রচুর পার্থক্য দেখা যাবে। এর অর্থ হল– এই সমস্ত পথের সংশ্লিষ্ট তরঙ্গগুলো প্রায় নির্ভুলভাবে একে অপরকে বাতিল করে দেবে। তবে কাছাকাছি পথগুলোর কোন কোন কেতার (sets) পথগুলোর ভিতর দশার (phase) খুব পার্থক্য হবে না। এই পথগুলো সাপেক্ষ তরঙ্গগুলো পরস্পরকে বাতিল করবে না। এই পথগুলো বোরের অনুমোদিত কক্ষপথগুলোর অনুরূপ।
এই ধারণাগুলোর ভিত্তিতে মূর্ত গাণিতিক গঠনের সাহায্যে আরো জটিল পরমাণুর ক্ষেত্রে, এমন কি, অণুর ক্ষেত্রেও অনুমোদিত কক্ষপথগুলো গণনা করা তুলনায় বেশ সহজ ছিল। অণুগুলো কক্ষস্থিত ইলেকট্রন দ্বারা আবদ্ধ একাধিক পরমাণু দ্বারা গঠিত। এই ইলেকট্রনগুলো একাধিক কেন্দ্ৰক (নিউক্লিয়াস) প্রদক্ষিণ করে। অণুর গঠন এবং তাদের পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া সমগ্র রসায়ন শাস্ত্র এবং জীববিদ্যার ভিত্তি। সেজন্য নীতিগতভাবে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আমাদের চারপাশে আমরা যা কিছু দেখি সে সম্পর্কে পূর্বাভাস দেবার সামর্থ্য দান করে। অবশ্য সে সামর্থ্য অনিশ্চয়তাবাদ দিয়ে সীমিত (কার্যক্ষেত্রে কিন্তু যে সমস্ত তন্ত্রে কয়েকটির বেশি ইলেকট্রন আছে সেগুলো সম্পর্কে গণনা এত জটিল যে আমরা সে গণনা করতে পারি না)।
মনে হয় আইনস্টাইনের ব্যাপক অপেক্ষবাদ মহাবিশ্বের বৃহত্মাত্রিক গঠনের নিয়ামক। এটা হল তথাকথিত চিরায়ত তত্ত্ব (classical theory), অর্থাৎ এ তত্ত্ব কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অনিশ্চয়তাবাদ বিবেচনা করে না। অথচ অন্যান্য তত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষার জন্য এটা বিবেচনা করা উচিত। এর জন্য পর্যবেক্ষণফলের সঙ্গে কোনরকম গোলমাল না হওয়ার কারণ, সাধারণত আমাদের অভিজ্ঞতায় যে সমস্ত মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র আমরা পাই সেগুলো খুবই দুর্বল। ইতঃপূর্বে আলোচিত অনন্যতার উপপাদ্য (singularity theorem) অনুসারে কিন্তু মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের অন্তত দুটি পরিস্থিতিতে খুবই শক্তিশালী হওয়া উচিত : কৃষ্ণগহ্বর (black hole) এবং বৃহৎ বিস্ফোরণ (big bang)। এক অর্থে চিরায়ত ব্যাপক অপেক্ষবাদ অসীম ঘনত্বের (infi nite density) বিন্দু সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে নিজেরই পতন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, ঠিক তেমনি চিরায়ত বলবিদ্যা (অর্থাৎ যে বলবিদ্যা কোয়ান্টাম নয়) পরমাণু চুপসে অসীম ঘনত্ব প্রাপ্ত হবে এই ভবিষ্যদ্বাণী করে নিজের পতন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। ব্যাপক অপেক্ষবাদ এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে ঐক্যবদ্ধ করে এরকম সঙ্গতিপূর্ণ সম্পূর্ণ একটি তত্ত্ব এখনো আমাদের নেই, কিন্তু সে তত্ত্বের অবয়ব কি রকম হবে সে সম্পর্কে আমাদের কিছু কিছু জানা আছে। কৃষ্ণগহ্বর এবং বৃহৎ বিস্ফোরণ সাপেক্ষ এইগুলো ফলশ্রুতি নিয়ে আমরা পরের অধ্যায়গুলোতে আলোচনা করব। আপাতত আমরা ইদানীং প্রকৃতির অন্যান্য বলগুলোকে একক ঐক্যবদ্ধ কোয়ান্টাম তত্ত্বে। বুঝার যে আধুনিক প্রচেষ্টাগুলো হয়েছে, দৃষ্টিপাত করব সেই দিকে।
———
১. ওকামস রেজর : উইলিয়াম অব ওকাম (১২৮৫-১৩৪৯)। ওকামের নামে পরিচিত মিতব্যয়িতার নীতি। এ নীতি গ্যালিলিওর মত অনেকেই অনুসরণ করেছেন। নীতিটির মূল বক্তব্য হল : সরলতম প্রকল্পই গ্রহণযোগ্য- অনুবাদক।