১০. তোমরা ছাগল ভালোবাস

ঝগড়ু বলল, তোমরা ছাগল ভালোবাস, দিদি

রুমু বলল, দাদুকে ছাগলে তাড়া করেছিল, জান ঝগড়ু?

বোগি বলল, হ্যাঁ, ভীষণ দুষ্টু হয় ওরা। ছাগলটা অনেকক্ষণ দাদুর পিছনে পিছনে ঘুরেছিল, যাতে দাদুর কোনোরকম সন্দেহ না হয়। তারপর একটি পেয়ারা গাছে শিঙে একটু শান দিয়ে নিয়ে, হঠাৎ তেড়ে এল। দাদু দারুণ ছুটতে পারে, জান ঝগড়ু? তবু অমরকাকাঁদের বারান্দায় উঠে তবে প্রাণ বাঁচল।

রুমু আরও বলল, আর দাদু বলেছে, ছাগলটা যখন দেখল শিকার হাতছাড়া হয়ে গেছে, তখন সে রেগে নাক দিয়ে হাওয়া ছাড়তে লাগল, আর মাটিতে খুর ঠুকতে লাগল। ভীষণ দুষ্টু হয়।

ঝগড়ু রাগ করে বলল, বেশ, তাহলে রইল জাদুকরা ছাগলের গল্প। কোথায় কার দাদুকে ছাগলে একটু তাড়া করেছিল, কামড়ায়নি পর্যন্ত, আর তাই সব ছাগল দুষ্টু হল, এ-রকম কথা তো কখনো শুনিনি। উঠি আমি, কাজ আছে অনেক।

না ঝগড়ু, না। দুমকার ছাগলের কথা বলিনি আমরা। বলতেই হবে তোমার গল্প।

ঝগড়ু, খুশি হয়ে বলল, আচ্ছা, তাহলে একটা পান মুখে দিয়ে আসি।

ঝগড়ু বলতে লাগল, আমার বুড়ো ঠাকুরদার কাচ তৈরির গল্প তো তোমাদের বলেইছি। তার ছেলে, আমার ঠাকুরদা ভারি নেশা করতেন।

ইস, কী খারাপ!

কেন, খারাপ কেন?

দিদিমা বলেছেন খারাপ লোকেরা নেশা করে।

তা বলতে পার তোমাদের ইচ্ছে হলে, তবে কী জান, খারাপ লোকেরা তো ভাতও খায়। আর আমার ঠাকুরদা অন্য কারণে নেশা করতেন।

কী কারণে বলল, ঝগডু।

কী মুশকিল, এত ভালো লোক ছিলেন সব বিষয়ে, আর নেশা করবার জন্য এক পয়সা খরচাও হত না, বন-ভরা মহুয়া ছিল, কত খাওয়া যায়। জান বোগিদাদা, উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম চারটে তো মোটে দিক। তা ছাড়া এক যদি কয়লার খনিতে মাটির নীচে সেঁধিয়ে যাও, তাহলে আবার শুনেছি বাইরের চোখ-কান আর মনের চোখ-কান সবেতে নাকি ধাঁধা লেগে যায়। নয়তো আকাশে উপরের দিকে ডানা-ভাঙা চিলের মতো চেয়ে থাকা যায়। মোট কথা ঠাকুরদার অতটুকু জায়গাতে কুলোত না, তাই নেশা করতে হত। নেশা করা খারাপ হতে পারে, কিন্তু ঠাকুরদা খারাপ ছিলেন না।

না, না, আমরা জানতাম না। বলো তারপর।

তার উপরঠাকুরমার ছিল যেমনি রাগী স্বভাব, তেমনি গায়ে জোর। ঠাকুরদাকে নানারকম ফন্দি করে বাড়ি থেকে দূরে গিয়ে থাকতে হত। অথচ বাড়ির মতো আরামটি কোথায় পাবেন?

তখন ঠাকুরদা বুদ্ধি করে ওখানকার সব চাইতে উঁচু পাহাড়ে ছাগল চরাতে যেতে আরম্ভ করলেন। ছাগলরা খুশিমতো চরে বেড়ায় আর ঠাকুরদা গাছতলায় পড়ে ঘুম লাগান। যেই সূর্য নেমে যায়, পাহাড়ের উপর থেকে রোদ সরে যায়, ঠাকুরদার শীত করে, আর অমনি ঘুম ভেঙে যায়, ছাগল গুনে নিয়ে ঠাকুরদা পাহাড় থেকে নেমে আসেন, ছাগল নিয়ে গিয়ে ঘরে তোলেন, ছোট্ট কাঁসার বালতিতে দুধ দোয়ান, তবে তার কাজ শেষ হয়।

একদিন কেমন যেন বেশি ঘুমিয়ে পড়েছেন, কখন রোদ নেমে গেছে টের পাননি। ঘুম ভাঙতে চেয়ে দেখেন গাছের ছায়াগুলো ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছে, হিম পড়ছে, ছাগলরা পায়ের কাছে জড়োসড়ো হয়ে রয়েছে।

ঠাকুরদা তাড়াতাড়ি ওদের নিয়ে নেমে এলেন। জায়গাটার নাম বড়ো খারাপ-ঠাকুরদা ছাড়া কেউ সেখানে যেতেই চায় না– ছাগল গুনে নেবার আর তর সইল না, সরাসরি বাড়িমুখো চললেন।

দোরগোড়ায় ছাগল গুনে ঠাকুমা দেখেন একটা ছাগল কম! ঠাকুরমার রাগ দেখে কে! সোনালিয়াকেই ছেড়ে এলে! এত নেশা কর! যাও তাকে খুঁজে নিয়ে এসো।

ঠাকুরদার নেশার ঘোর তখনও ছোটেনি, রাগ হল বটে, কিন্তু যা কান বোঁ বোঁ করছে, রাগটা আর দেখাতে পারলেন না। ফিরে গেলেন পাহাড়ে।

চাঁদের আলো ফুটফুট করছে, পাহাড়ে উঠে দেখেন সেই চাঁদের আলোয় হাজার হাজার ছাগল চরছে। মাঝখান দিয়ে ঝিরঝির করে এক ঝরনা বয়ে যাচ্ছে, তার এপারে-ওপারে ছাগল চরছে। কই দিনের বেলায় তো ঝরনা চোখে পড়েনি!

কয়েকজন দাড়িওয়ালা বুড়ো লোক ছাগল চরাচ্ছে, ঠাকুরদা তাদের কাছে গিয়ে সোনালিয়াকে চাইলেন। তারা উত্তর না দিয়ে ছাগলের পাল দেখিয়ে দিল।

ঠাকুরদা সোনালিয়াকে চিনতে পারেন না। যে ছাগলের দিকে তাকান তাকেই মনে হয় সোনালিয়া। রগড় দেখে দাড়িওয়ালা বুড়োরা হেসেই কুটোপাটি। সেই হাসি শোনবামাত্র ছাগলরা সব দলে দলে ঝরনা পার হয়ে চলে যেতে লাগল।

তখন ঠাকুরদা সামনে যাকে পেলেন, তাকেই মনে হল সোনালিয়া, তাকে কোলে তুলে নিয়ে, দৌড়োতে দৌড়োতে পাহাড় থেকে নেমে একেবারে বাড়িতে।

সোনালিয়াকে দুইতে গিয়ে ঠাকুরদা অবাক হয়ে গেলেন, বালতি ভরে দুধের গঙ্গা বয়ে যেতে লাগল, তবু থামে না। এমনসময় ঘরের দরজায় কে টোকা দিল।

গিয়ে দেখেন একজন দাড়িওয়ালা বুড়ো দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে, সঙ্গে তার সোনালিয়া। এতক্ষণে সত্যি সোনালিয়াকে চেনা গেল। ঠাকুরদা অন্য ছাগলটাকে এনে দিলেন। লোকটা যাবার আগে মুচকি হেসে ঠাকুরদার তামাকের দিকে দেখিয়ে দিল। দিলেন তাকে এক দলা তামাক, তার বদলে সে তাকে এই জিনিসটে দিয়ে গেল।

এই বলে ঝগড়ু তার কোঁচড় থেকে ছোট্ট একটা কালো গোল ফল বের করে দেখাল, তার বোঁটার কাছটা রুপো দিয়ে বাঁধানো।

কী হয় এতে, ঝগড়ু? কেন দিয়েছিল?

কী হয়? এ কাছে থাকলে লোকে স্বপ্ন দেখে বোগিদাদা, আর কোনো দুঃখু তার গায়ে লাগে না। নেশা করবারও দরকার লাগে না। চলো, চলো, মেঘ করে আসছে, দেখো এবার জোর জল পড়লে গুণমণির কী দশা হয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *