সেদিন বিকেলে তারানাথের বাড়ি গিয়ে দেখি সে বাইরের ঘরে তক্তপোশের ওপর বসে তামাক খাচ্ছে। চোখমুখ উদাস। মাঝে মাঝে তারানাথের এ ধরনের ভাবপরিবর্তন দেখেছি, দুচারদিন থাকে, তারপর আবার ঠিক হয়ে যায়। বললাম—কি, মন খারাপ নাকি?
আমি যে ঘরে ঢুকেছি তা বোধ হয় তারানাথ লক্ষ্যই করেনি, একটু চমকে উঠে বলল—ও, তুমিএস!, বোস ওইখানটায়। না মনখারাপ নয়, অনেকদিন আগেকার কথা ভাবছিলাম ছোটবেলার কথা। পুরনো দিনের কথা মনে এলে একটু মন খারাপ তো হয়ই, না? কিশোরী এল না যে?
-আসবে। তাকে সকালে বলে রেখেছি, অফিসের পরে সোজা এখানে চলে আসবে।
নাম করতে করতেই কিশোরী এসে পড়ল।—কি, গল্প শুরু হয়ে গিয়েছে নাকি?
তারানাথ বলল—না, বোসো। তোমার কথাই হচ্ছিল। আজ গল্প বলার মেজাজ নেই, আর একদিন হবে’খন। চা খাবে?
বাড়ির ভেতরে গিয়ে চায়ের কথা বলে এসে তারানাথ আবার তক্তাপপাশে বসে হুঁকো টানতে লাগল। আমি আর কিশোরী জানি গল্প হবে না কথাটার বিশেষ কোন গুরুত্ব নেই। অপেক্ষা করলে একটা ভাল গল্প বেরিয়ে আসতেও পারে।
কয়েকটা ব্যর্থ টান দিয়ে বিরক্তমুখে হুঁকো নামিয়ে রাখতে রাখতে তারানাথ বলল— দুত্তোরিবোস তো!এটা আবার গেল নিবে!মরা, চারিকে বলে আসি একছিলিম সেজে দিতে—
কিশোরী পকেট থেকে নতুন পাসিং শো-এর প্যাকেট বের করে (মাসের প্রথম, এ সময়টা আমরা একটু নবাবী করেই থাকি) তক্তাপোশে রেখে বলল–বসুন ঠাকুরমশাই, বারবার উঠতে হবে না, সিগারেট খান—
তারানাথ উজ্জ্বলমুখে একটা সিগারেট বের করে ধরাতে ধরাতে বলল—সে বরং ভাল। হুকোকলকে আমাদের দেশে আর চলবে না, বুঝলে? কত ফৈজৎ, তামাকটিকের যোগাড় রাখ, ঠিক্রে লাগাও-ছিলিম সাজ, একঘণ্টা ধরে ফুঁ দাও—নাঃ, সিগারেটই ভাল–
চোখ বুজে সিগারেটে টান দিতে দিতে একটু পরে তারানাথ বলল—তবে কি জানো? তামাকের মৌজ সিগারেট নেই। এই যে সোদা সোদা গন্ধ, কড়া ধাক, গুড়ুক গুড়ুক শব্দ-সব মিলিয়ে একটা দারুণ আমেজ। তারপরে ধরো, ঠিক্রে গুজছি, তামাক আর টিকে সাজাচ্ছি, মনোযোগ দিয়ে ফুঁ দিচ্ছি, আর মনের ভেতর এই হয়ে গেল— এক্ষুনি আমি তামাক খাব–এই ভাব। সেটাও একরকমের মেজাজ, ওই অপেক্ষাটা। আর সিগারেট কি, না—এই ধরালাম, দুদশটা টান দিয়ে ফেলে দিলাম-—চুকে গেল। তা মানুষের হাতে সময় কমে আসছে, করবে কি? এই সিগারেটই বাজার দখল করবে দেখ—
কিশোরী বলল—পুরনো দিনের কথা ভাবছিলেন বললেন না? আপনার ছোটবেলার ঘটনাই বলুন না, শোনা যাক।
ছাইদানী হিসেবে ব্যবহৃত নারকোলের মালায় সিগারেটের দগ্ধাবশেষ গুঁজে দিয়ে তারানাথ বলল—সে তো আর একটা টানা গল্প নয়, কত বছর ধরে টুকিটাকি কত কিছু ঘটেছে আমার কাছে সেসবের গভীর মূল্য আছে-কিন্তু তোমাদের ভাল লাগবে কেন?
আমি জিজ্ঞাসা করলাম—আচ্ছা, তন্ত্রসাধনার দিকে প্রথম আপনার বোক আসে কি করে?
—সে তো তোমাদের বলেছি, গ্রামের বাঁধানো গাছতলায় সেই সাধু, তারপর বীরভূমের শ্মশানের সেই মাতঙ্গিনী—সে আবার ডামরতন্ত্রে সিদ্ধ ছিল, কিংবা বরাকর নদীর ধারের সাধুজী, যার পঞ্চমুতী আসনে বসে মধুসুন্দরী দেবীকে দেখতে পাই। এদেরই প্রভাবে এ পথে আসি—এ গল্প তো তোমরা শুনেছ।
বললাম—কিন্তু তারও আগে?
একেবারে ছোটবেলায় কবে বুঝলেন যে আপনার জীবনটা ঠিক অন্য সবার মত হবে না? তারানাথ দুই আঙুলে ভ্রর মাঝখানটা টিপে ধরে রইল কিছুক্ষণ-, তারপর মুখ তুলে আস্তে আস্তে বলল—জন্মের সময় থেকেই বোধ হয় ঈশ্বর আমার জীবনের গতিপথ নির্ণয় করে দিয়েছিলেন। আমি যখন ভূমিষ্ঠ হই সেই মুহূর্তে আকাশ দিয়ে একটা বিরাট উল্কা ছুটে গিয়েছিল। মা আঁতুড়ঘরে, গ্রামের বৌ ঝিরা তাকে ঘিরে–বসে রয়েছে, বাবা পায়চারী করছেন দক্ষিণের বারান্দায়। গরম জল নেবার জন্য সিন্ধুবালা দাই আঁতুড়ঘর থেকে উঠোন পেরিয়ে রান্নাবাড়ির দিকে আসছিল। সেই–হঠাৎ আকাশে আশ্চর্য আলো দেখতে পেয়ে চিৎকার করে ওঠে। তার ডাকে বাড়ির সবাই উঠোনে এসে জড়ো হল। অদ্ভুত নীল আলোয় চারিদিক উদ্ভাসিত করে একটা নীল আগুনের গোলক পুবদিক থেকে পশ্চিম দিগন্তের দিকে চলে যাচ্ছে। সাধারণত উল্কা জ্বলে উঠেই চকিতে মিলিয়ে যায়, লোকজন ডেকে এনে দেখবার অবকাশ পাওয়া যায় না। এই নীল আলো কিন্তু অনেক অনেক ওপর দিয়ে বেশ সময় নিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে, ধূমকেতুর মত একটা অস্পষ্ট স্বতঃপ্রভ ধোয়ার পথরেখা ফেলে যাচ্ছে পেছনে।
পশ্চিমদিগন্তে নীল উল্কা মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি ভূমিষ্ঠ হই।
এ গল্প পরে বড় হয়ে সবার মুখে শুনেছি। সে বয়েসটা একটা অদ্ভুত বয়েস, বুঝলে? রেড়ির তেলের প্রদীপ, ছোট ছোট ফোড় দেওয়া পদ্মকাথা, আরামদায়ক রোদঝিমঝিম করা নির্জন দুপুর, উঠোনের চাটাইতে শুকোতে দেওয়া টোপাকুলের ভরপুর গন্ধ, রাত্তিরে জ্যোৎস্নায় চকচক করা নারকোল গাছের পাতা—সে সময়ে সবই সম্ভব ছিল। সমবয়েসীদের সঙ্গে বনতো না, তাদের খেলাধুলো কথাবার্তা কেমন অর্থহীন আর হাস্যকর বলে মনে হত। একা একা বেড়াতাম মাঠেবনে, গ্রামের বাইরে যাবার পথে চৌধুরীদের বাঁশবাগানে। একটা জিনিস খুব অনুভব করতাম, এখনো ভাবলে মন উদাস হয়ে যায়। ধরো, খাওয়াদাওয়া সেরে বাড়ির সকলে দুপুরের ঘুম–দিচ্ছে, আমি বেরিয়ে চলে গিয়েছি সাঁতরাদ্দীঘির পারে। চুপ করে বসে আছি। বিরঝিরে বাতাসে দীঘির জলে ডুরে ডুরে ঢেউ উঠেছে। লিচু আর জামরুল গাছের পাতার ফাক দিয়ে সূর্যের আলো এসে মাটিতে রোদ আর ছায়ার আলপনা তৈরি করছে—আমগাছের গুঁড়ি বেয়ে উঠছে একসারি কাঠপিপড়ে। এইসব নির্জন মুহূর্তে, আমি তোমাদের সত্যি বলছি, স্পষ্ট শুনতে পেতাম গাছপালা, মাটি, দীঘির জল আমার সঙ্গে কথা বলছে। ঠিক কোন ভাষা দিয়ে নয়, সে ভাষা ওদের নেই। এ অনেকটা গানের সুরের মত—কিম্বা তাও ঠিক নয়, এমন একটা কিছু—যা মন দিয়ে বোঝা যায় কিন্তু মুখ দিয়ে বলা যায় না। পরে সাধনা করতে গিয়ে দেখেছি উচ্চকোটির তন্ত্রসাধকেরও স্বীকার করেছেন যে, আমরা যাদের নিজীব পদার্থ ভাবি তাদেরও প্রাণ আছে চেতনা আছে। এখন ভাবলে বিস্মিত হই, তখন কিন্তু ব্যাপারটাকে খুবই স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিলাম। ভাবতাম, সবাই বুঝি আমার মতই ওদের কথা শুনতে পায়।
একদিন দুপুরে খেলা করতে করতে চলে গিয়েছি গ্রামের বাইরের মাঠে। কেউ কোথাও নেই, শূন্য মাঠের ওপর রোদুর বা বা করছে। গ্রামের ঠিক প্রান্তে একটা বিরাট চটকাগাছ। সেই চটকাগাছের নিচে একজন লোক বসে আছে। কুচকুচে কালো রঙ, খালি গা। হাতে একটা পাচনবাড়ি। সম্ভবত সে শুয়োর চরায়, কারণ এদিক ওদিকে কয়েকটা শুয়োর চরে বেড়াচ্ছে দেখলাম।
দৃশ্যটা অতি সাধারণ। গ্রামের অনেক গরিব মানুষেরা শুয়োর চরিয়ে দিনাতিপাত করে, তাদের এইরকমই দেখতে এবং তারা ক্লান্ত হয়ে পড়লে গাছতলায় বসে বিশ্রামও করে। কাজেই অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। কিন্তু কেন যেন লোকটাকে ভাল করে দেখবার জন্য আমি পায়ে পায়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম।
আমি কাছে যেতেই লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। কি তার চোখের প্রখরতা। ভাল করে তাকান যায় না। যেন ঝকঝক করে জুলছে। আটোসাটো দৃঢ় শরীরের মধ্যে সে যেন নিজেকে আটকে রাখতে পারছে না, প্রাণশক্তি উপচে পড়ছে। শরীর ছাড়িয়ে। আমার দিকে তাকিয়ে সে বলল—এস, তোমার জন্যই বসে আছি।
অবাক হয়ে বললাম—আমার জন্য?
–হ্যাঁ। তোমার সঙ্গে কথা বলবার জন্যই আজ আমাকে পাঠান হয়ে হয়েছে। বোস।
—কে পাঠিয়েছে?
—সে বললে এখন তুমি বুঝবে না, বড় হলে নিজেই জানতে পারবে। এদিকে এসোতো, কাছে এসো–
আমার ঠিক ভয় করছিল না, বরং কেমন যেন রহস্যময় আনন্দের অনুভূতি হচ্ছিল। লোকটার কাছে এগিয়ে যেতে সে আমার কপালে হাত দিয়ে কি যেন দেখতে লাগল, তারপর খুশি হয়ে বলল—ঠিক আছে, বোস ওই শেকড়টার ওপরে।
বসলাম। দু-একটা দুষ্ট শুয়োর দল ছেড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, নিজেদের মধ্যে মারামারির উদ্যোগ করছিল। লোকটা পাচনবাড়ি তুলে বিচিত্র এক হুঙ্কার দিল—এ্যাও! সাবধান, আমি জেগে আছি! ঠিক হয়ে চল—
শুয়োরগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মত ঠেলাঠেলি বন্ধ করে একজায়গায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম তার হাতের পাচনবাড়িটা কোন গাছের ডাল বা কঞ্চি। দিয়ে তৈরি নয়— কিসের যেন সরু হাড় সেটা!
বললাম—কোথায় থাক তুমি? এ গাঁয়ে তো দেখিনি তোমাকে।
সে বলল—এ গাঁয়ে থাকি না, তাই দেখনি।
—তাহলে?
লোকটা তার প্রখর দৃষ্টিতে একবার চারদিকে তাকাল। সূর্যের আলো সরাসরি তার মুখে এসে পড়েছে, আকাশে উড়তে উড়তে একটা চিল ডাকছে কর্কশ, তীক্ষ্ণ স্বরে। সেই রৌদ্রালোকিত আকাশ, দিগন্ত আর পৃথিবীর দিকে লোকটা দুহাত ছড়িয়ে দিয়ে বলল—এই সবকিছুর মধ্যে আমার থাকার জায়গা। অল্প জায়গায় আমাকে ধরে না যে!
আমি তার কথা ঠিকঠাক বুঝতে পারলাম না। একজন লোক একটা বাড়িতে থাকবে এটাই নিয়ম। সব জায়গায় সে থাকে কি করে? বললাম—তুমি শুয়োর চরাও?
লোকটা চমকে বলল—কই, না তো!
—এগুলো তোমার শুয়োর নয়?
সে একবার স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শুয়োরগুলোর দিকে দেখল, তারপর বলল—কিন্তু এরা তো কেউ শুয়োর নয়—
আমার তখন দৃঢ় ধারণা হয়েছে লোকটা বদ্ধ পাগল। হ্যাঁ ঠিক তাই। সেজন্যেই এর কথাবার্তা কেমন কেমন, চাউনি অমন অদ্ভুত। আর তাছাড়া পরিষ্কার দেখছি অতগুলো শুয়োর দাঁড়িয়ে রয়েছে, তবু মানতে হবে ওরা শুয়োর নয়? ওগুলো কি তবে শেয়াল?
লোকটা বলল—তুমি ছোটো তো, তোমাকে এখন বোঝান অসুবিধে হবে। এগুলো সত্যিই শুয়োর নয়। এগুলো হচ্ছে—কি বলি—আমাদের ভেতরে যে দোষগুলো থাকে, যাদের জন্য আমরা খারাপ কাজ করি, খারাপ কথা ভাবি—এরা হচ্ছে সেইসব দোষের বাইরের চেহারা। সাধারণ মানুষকে এরা চরিয়ে বেড়ায়, কিন্তু আমি এদের চরাবার বিদ্যা শিখেছি—
দুটো শুয়োর আবার মারামারির উদ্যোগ করছিল, লোকটা সরু হাড়ের লাঠি তুলে গর্জন করে উঠতেই তারা চুপ করে গেল।
লোকটা এবার যেন একটু ব্যস্ত হয়ে বলল—নাঃ, কথায় কথায় অনেক দেরি হয়ে গেল। আমার ফিরে যাবার সময় হয়েছে। যে জন্য আসা সেটা তাড়াতাড়ি সেরে নিই। এদিকে এগিয়ে এসো তো খোকা, কোন ভয় নেই, এসো—
কাপা কাপা গলায় বললাম—কেন?
সে বলল—আমি তোমাকে একটু মনখারাপ দিয়ে যাব।
আমার দুই কাধ ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে লোকটা অস্বাভাবিক জোরে, প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল—আমার চোখের দিকে তাকাও!
আমি তার চোখের দিকে তাকলাম।
হঠাৎই মানুষটার চোখ যেন দুটো জানালা হয়ে গিয়েছে। ভেতরে কতদূর অবধি দেখতে পাচ্ছি। ওখানে যেন আর একটা জগৎ, এ রকমই রোদুর বা বা করছে দিগন্ত অবধি বিছিয়ে থাকা মাঠে। সবুজ বন, নীল পাহাড় থেকে ঝুরঝুর করে ঝরনা নেমে আসছে—মেঘে আর কুয়াশায় ঢাকা ওই পাহাড়ে কবে যেন আমি থাকতাম। সুতোর কাটিম উলটোদিকে ঘুরে যাওয়ার মত বিস্মৃতির আড়াল থেকে কত পুরনো, মহাকালের স্তরে স্তরে সঞ্চিত ভুলে যাওয়া কথা মনে পড়ে যেতে লাগল। ক্রমে আমার সমস্ত চেতনা ওই দুই চোখের জানালার ভেতর দিয়ে আশ্চর্য জগৎটার মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল। আমাদের গ্রামের সীমানায় চটকাগাছটা, চিলের তীক্ষ ডাক, সামনে পড়ে থাকা কইখালির বিশাল মাঠ—সব কোথায় মিলিয়ে গেল। এখন আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সে জগতে ছায়াবাড়ির মত অজস্র ছবি মেলে যাচ্ছে চোখের সামনে দিয়ে। কোথায় যেন এক উন্নতশীর্ষ মন্দির, শেষবেলার আলোয় তার চূড়ার সোনার পদ্ম ঝলসে উঠছে। কাদের হাসিমুখ-এরা আমাকে খুব ভালবাসত, কিন্তু এখন মিলিয়ে গিয়েছে দূর অতীতে। কানে ভেসে আসছে সমস্বরে উচ্চারিত মন্ত্রধ্বনির মত একটানা উদার-গম্ভীর সংগীতময় শব্দপ্রবাহ। সব ছবি মিলিয়ে গিয়ে চোখের ওপর ভেসে উঠছে সৃষ্টিপূর্ব আদিম অন্ধকারের মত কালো মহাশূন্য থেকে থেকে সেই পরম কিছু না-র মধ্যে চমকে উঠছে তীব্র জ্যোতির উদ্ভাস, সৃষ্টি হচ্ছে নক্ষত্রের, নীহারিকার, অনন্ত শূন্যের থেকে বস্তুপুঞ্জের। আমার চেতনা চলে যেতে লাগল, আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলেই আমি সম্পূর্ণ জ্ঞান হরাব। ঠিক তখনই অনুভব করলাম চিরচেনা পৃথিবীর বিপুল আকর্ষণে আমি ফিরে আসছি আমাদের গ্রামের প্রান্তের রোদে পোড়া মাঠে। নিকষ কালো অনস্তস্পশী মহাশূন্যের বুক চিরে চলে যাচ্ছে একটা নীল উল্কা।
চটকগাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে আমি মুহ্যমানের মত বসে রইলাম, মাঠের ওপর দিয়ে তার শুয়োর তাড়িয়ে নিয়ে লোকটা কোথায় যেন চলে গেল। সে কোথায় যাচ্ছে, কি করে আবার দেখা হবে কিছুই জিজ্ঞাসা করা হল না।
কিন্তু কি মনখারাপই সে আমাকে দিয়ে গেল!
এরপর আমার আর কিছু ভাল লাগত না। একা তো ছিলামই, আরও একা হয়ে গেলাম। সবসময় মনে হত কি একটা কাজ যেন ফেলে রেখেছি, কোথায় যেন আমাকে চলে যেতে হবে।
প্রথম যৌবনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি, সে কথা তোমাদের বলেছি। বীরভূমের শ্মশানে মাতু পাগলী আমাকে সম্মােহিত করে নানা দৃশ্য দেখিয়েছিল। আমি যেন নদীর জলে নেমে গাছের শেকড়ে আটকে থাকা মৃতদেহ তুলে এনে পূজার উপকরণ সংগ্রহ করে শবসাধনায় বসলাম। সারারাত কত আতঙ্কজনক দৃশ্য দেখলাম, কত উপদ্রব ঘটল। পরে সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখি ধূসর সন্ধ্যায় নির্জন শ্মশানে দাঁড়িয়ে আমি মাতু পাগলীর সামনে—মাত্র দশমিনিট সময় কেটেছে। এ তো গেল ভেলকি, কিন্তু সদগুরুর সাহায্যে আমি প্রকৃতই একবার শবসাধনা করেছিলাম। মুর্শিদাবাদ জেলার এক অজ পাড়াগায়ের শ্মশানে তখন আস্তানা গেড়েছি—সঙ্গে গুরু রয়েছেন। জ্যৈষ্ঠের শেষে আশেপাশের গ্রামগুলোতে কলেরার মহামার শুরু হল। সারাদিন ধরে দূর দূরান্ত থেকে মৃতদেহ দাহ করতে আনছে লোকে। পরে এমন অবস্থা দাঁড়াল, দাহ করার কাঠ জোটে না। মুখে আগুন ছুইয়ে দেহ ফেলে শ্মশানবন্ধুরা পালায়। তারই ভেতর থেকে লক্ষ্মণযুক্ত একটি মৃতদেহ একদিন তুলে নিয়ে এলাম। শ্মশানের পূর্বপ্রান্তে একটু জঙ্গলমত জায়গা, সেখানে বিরাট একটা বাকড়া ছাতিমগাছ রয়েছে। তারই তলায় গুরু পূজার আয়োজন করলেন। রাত্তিরে দাহ করার জন্য দলবল এলেও এদিকে তারা যেসবে না।
আমি ভেবেছিলাম গুরুই বোধহয় শবাসনে বসবেন। কিন্তু প্রাথমিক প্রকরণের শেষে গুরু যখন আমাকে পদ্মবীজের মালা ধারণ করতে বললেন, তখন অবাক হয়ে বললাম—আমি কেন?
-–তুমিই তো আসনে বসবে?
—আমি। আমি কি পারব?
—নিশ্চয় পারবে, আমি তোমাকে আমার শক্তির অংশ দান করব। তাছাড়া এ আমার কাছে আল আর হুগলি হে আল ক্ষা তোমারই অধিকার।
ঘোর অমাবস্যার মধ্যরাত্রি। গুরু আমাকে আসনে বসিয়ে দিয়ে সকালে আসব। বলে চলে গেলেন। শব সাধনার সময় সামনে অন্য সাধকের উপস্থিত থাকতে নেই।
সাষ্টাঙ্গ প্রণামের ভঙ্গিতে উপুড় করে শোয়ানো মৃতদেহের পিঠের ওপর বজ্রাসনে বসে বীজমন্ত্র জপ আরম্ভ করলাম। মনে কোন ভয় নেই। বহুদিন হল তান্ত্রিক সাধুসঙ্গ করছি, অনেক অস্বাভাবিক আর অলৌকিক ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে দেখেছি। আমি জানি নিখুঁতভাবে দেহশুদ্ধি করে আসনে বসলে কোন বিপদ সাধককে স্পর্শ করে না। ঘণ্টাখানেক একমনে জপ চালাবার পরে অনুভব করলাম নিচে মৃতদেহটা যেন নড়ে উঠছে, তাতে প্রাণের স্পন্দন জেগেছে। পোড়া মাছ গুজে দিলাম শবের মুখে, নরকপাল থেকে একটু একটু করে কারণ ঢেলে দিতে লাগলাম। শব আবার শাস্ত হয়ে এল। আরও তিনবার এমন হল সে রাত্তিরে। সাধনায় বিঘ্ন সৃষ্টি করবার জন্য হাকিনীরা কত বীভৎস রূপ ধারণ করে এল— দিয়ে নৃত্য করছে। যে কোন সাধারণ মানুষের হৃৎপিণ্ড থামিয়ে দেবার পক্ষে এ দৃশ্য যথেষ্ট। সে মুহূর্তে বুক যে একটু কেঁপে ওঠেনি তা বলব না। প্রাণপণে মনকে একাগ্র করে বীজমন্ত্র জপ করতে লাগলাম, ধীরে ধীরে মিলিয়ে এল প্রেতের দল।
অনেকের মধ্যেই ভুল ধারণা আছে যে, একরাত শবসাধনা করলেই বুঝি সিদ্ধিলাভ হয়। বিশেষ বিশেষ তিথিতে কয়েকবার আসনে বসলে তবেই সিদ্ধি আসে। এতে অনেকবছরও লেগে যেতে পারে। ধরো, তিথি সুপ্রশস্ত, পূজার সব আয়োজনই করা হয়েছে, কিন্তু শেষপর্যন্ত শব পাওয়া গেল না। সব পণ্ড। আমারও তাই হয়েছিল। নানা কারণে ওই একবার ছাড়া আর শবসাধনা করতে পারিনি। গুরুর কাছ থেকে যখন বিদায় নিয়ে আসি তখন তিনি সাবধান করে বলেছিলেন—শোনো, সময়মত সাধনা সম্পূর্ণ কোরো। তোমাকে তো সবই শিখিয়ে দিয়েছি, আমি না থাকলেও অসুবিধে হবে না। নইলে কিন্তু বিপদ–
—আজ্ঞে, কি রকম বিপদ?
–ভয়ঙ্কর বিপদ। মৃত্যুর পরে আত্মা সঙ্গে সঙ্গে উর্ধ্বগতি পায় না। বেশ কিছুক্ষণ নিজের প্রাণহীন দেহটার কাছে ঘোরাফেরা করে। যার দেহ নিয়ে শবসাধনা করা হয়, তার আত্মা দেখতে পায় দেহের সৎকার হয়নি বরং সেটা সাধক নিজের কাজে লাগিয়েছে। তাতে মৃতের আত্মা নিশ্চয় খুশি হয় না। সে প্রতিশোধ গ্রহণের সুযোগ খোজে। সাধনা সম্পূর্ণ করলে সাধক অমিত শক্তিলাভ করে, ফলে তার আর ভয় থাকে না। নইলে বুঝতেই পারছ কি বিপদ হতে পারে! সাবধানে থেকে, জানো তো, প্রবাদ আছে—সাপুড়ের মরণ সাপের হাতে। তোমার ভাগ্য আমি গণনা করে দেখেছি, তুমি একটানা সাধনা করতে পারবে না, আবার তোমাকে ফিরে যেতে হবে গৃহাশ্রমে। আবার বেরুবে—এবং ফিরে যাবে। এইভাবেই চলবে। শবসাধনা গৃহে বসে করবার জিনিস নয়। কাজেই একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়ার আগে কর্ম সম্পূর্ণ করে রেখো।
তারপর আমার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে গুরু বললেন-কিন্তু তোমার কপালে একটা আশ্চর্য যোগাযোগের চিহ্ন রয়েছে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। খুব বড় একজন। মহাপুরুষ, কিংবা মহাসাধক তোমাকে কৃপা করবেন। দেখি হাতটা–
ডান হাত বাড়িয়ে দিলাম। উনি হাতটা ধরলেন, কিন্তু দেখলেন না, তাকিয়ে। রইলেন আমার দিকে। বললাম—কি ধরনের মহাপুরুষ?
—এমন কোন উচ্চমাগের মুক্ত আত্মা যার নাম মুখে উচ্চারণ করার যোগ্যতা আমার নেই। সবরকম সাধনা ও সিদ্ধির উর্ধ্বে চলে গিয়েছেন এমন কেউ। ইতি তোমাকে অনেক বিপদ থেকে রক্ষা করবেন।
আমি ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—কবে এর দেখা পাব?
শান্তকষ্ঠে গুরু বললেন—এর দেখা তুমি পেয়েছ।
—সে কি কবে?
—তা জানি না। তবে মহাগুরুর সান্নিধ্য পেলে দেহে ও মনে যে যে লক্ষণ ফুটে ওঠে, তা তোমার রয়েছে।
—আমি দেখা পেলাম আর আমিই জানতে পারলাম না?
গুরু বললেন—তেমন তো হতেই পারে। এসব সাধকদের কোন ভেকও নেই, ভড়ংও নেই। নিতান্ত সাধারণ মানুষের মত বেড়ান, দেখলেও হয়ত চিনতে পারবে না।
হঠাৎ আমার ছোটবেলায় দেখা সেই অদ্ভুত মানুষটিকে মনে পড়ে গেল। রোদ ঝিমঝিম করা কইখালির মাঠ, সেই শুয়োরের দল, আমার হারানো শৈশব। তিনিই কি আমার জীবনের অজানা মহাপুরুষ?
তরাই অঞ্চলে কোথায় তন্ত্রসাধকদের এক গোপন মিলনসভা হবে খবর পেয়ে গুরু সেখানে রওনা হয়ে গেলেন, আমি আর সঙ্গে গেলাম না। এবার কিছুদিন একা থাকব ঠিক করলাম। পথে পথে ঘুরি, বেশির ভাগই শ্মশানে-মশানে রাত কটাই, কচিৎ কখনও কোন গৃহস্থবাড়িতে আশ্রয় নিই। একদিন এক রেল স্টেশনের প্লাটফর্মে বসে আছি, আমার ট্রেন আসতে ঘণ্টাখানেক দেরি। সেটা জংশন স্টেশন, লুপ লাইনে যেতে হলে ওখান থেকে গাড়ি বদল করতে হয়।
প্রচণ্ড বৃষ্টি নেমেছে সকাল থেকে, আকাশ কালো হয়ে রয়েছে মেঘে। ঝুপকূপ করে বৃষ্টির আর যেন বিরাম নেই।
দু-পয়সার বিড়ি কিনব বলে স্টেশনের দোকানটার দিকে এগুচ্ছি, হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন ডাকল—আরে, তারানাথ না?
থমকে দাঁড়ালাম। এমন জায়গায় আমার নাম ধরে কে ডাকে? এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখি ওজন করার লোহার কলের পাশে কয়েকটা চটের বস্তার আড়ালে বেঞ্চির ওপর বসে আছে আমাদের গ্রামের ভূপতি শিকদারের ছেলে রমাপতি। ছোটবেলায় এই রমাপতিই বোধ হয় গ্রামে আমার একমাত্র বন্ধু ছিল। কতদিন ওদের বাগান থেকে দুপুরে কাচা পেপে ছিড়ে এনে নুন দিয়ে খেয়েছি। গ্রামের পুরনো বন্ধুকে। দেখে হাসিমুখে এগিয়ে গেলাম, রমাপতিও উঠে এসে আমার হাত ধরে বলল—উঃ, কতদিন পরে দেখা! এখানে কি করছিস রে? তোর গেরুয়া কই?
হেসে বললাম—আমি কি সন্ন্যাসী হয়েছি নাকি, যে গেরুয়া পরে ঘুরব?
-সন্ন্যাসী হোস নি? তবে যে সবাই বলে তুই সাধু হয়ে চলে গিয়েছিস?
-সংস্কৃতে সাধু মানে ভাল লোক, সেটা হবার চেষ্টা করছি বটে—তবে ভেকধারী সন্ন্যাসী হইনি। তুই এখানে কেন?
—আমার শ্বশুড়বাড়ি এখান থেকে ট্রেনে বদল করে যেতে হয়। বৌ সেখানে আছে, আনতে যাচ্ছি। আয় ওই দোকানটায় চা খাবি?
পুরনো বন্ধুর অকৃত্রিম আগ্রহে রমাপতি আমার হাত ধরে টেনে চায়ের দোকানে গিয়ে চা আর কেকের অর্ডার দিল। পকেট থেকে নতুন মেপোল সিগারেটের প্যাকেট বের করে আমাকে একটা দিয়ে বলল—ধরা। তারপর তুই কোথায় যাচ্ছিস বললি না তো?
—বিশেষ কোথাও না। বাড়ি ছাড়ার পরে এইরকমই ঘুরে ঘুরে বেড়াই, একজায়গায় থাকি না বেশিদিন–
-–কেন বল দিকি? এতে লাভ কি?
—তা তো তোকে বোঝাতে পারব না ভাই! যারা বাড়িতে থাকে, তাদের দেখে আমার মনে হয়, এতে তাদের লাভ কি? কাজেই এর ঠিক কোন উত্তর হয় না।
রমাপতি চুপ করে রইল। তার মুখ দেখে বুঝলাম আমার উত্তরটা তার বিশেষ পছন্দ হয়নি, সে বুঝতেও পারেনি। গৃহত্যাগ করে বিদেশে গিয়ে অর্থ উপার্জন করলে বোঝা যায়, বাড়ি থেকে পালিয়ে সাধু-সন্ন্যাসী হলে তারও যাহোক একটা মানে হয়— কারণ তেমনটা বহু ঘটতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু সে-সব কিছু নয় খামোক একজন মানুষ বাড়ির আরাম ছেড়ে পথে পথে বেড়িয়ে বেড়ায়—এর কারণ সে ধরতে পারছে না।
চা খেতে খেতে রমাপতি বলল—তুই তো বেশ অনেকদিন বাড়ি ছেড়েছিস, তাই?
-হ্যাঁ।
—যেতে বাধা আছে কোন?
—না, বাধা আর কি? আমি তো আর গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হইনি—তোকে বললাম না? যখন ইচ্ছে করবে চলে যাব।
চায়ের কাপ দোকানীকে ফেরত দিয়ে রমাপতি একটু ইতস্তত করে বললতারানাথ, তোর বোধহয় এখন একবার বাড়ি যাওয়া উচিত
তার গলায় কেমন একটা সুর ছিল, ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—কেন বল তো? হঠাৎ বাড়ি যাব কেন?
–কাকীমার খুব অসুখ। অবস্থা তেমন একটা—মানে, কখন কি হয় বলা যায় না। তুই একবার যা–
বিশ্বে মাতৃশক্তি একটা খুব বড় শক্তি। আমার পথে পথে বেড়ানো যাযাবর জীবন, সাধুসঙ্গে আগ্রহ, সিদ্ধিলাভের আকাক্ষা—সব কোথায় উড়ে গেল। মনে হল, যার নাড়ি ছিড়ে ভূমিষ্ঠ হয়েছি, যার কোলে খেলা করে বড় হয়েছি—আমার সেই চিরপরিচিত সদাহাস্যমুখী মা অসুস্থ। তিনি হয়ত আমাকে দেখতে চান—আমি এখুনি বাড়ি যাব।
কি ভয়ানক বৃষ্টি। থামবার নাম নেই। তারই মধ্যে ভিজতে ভিজতে পরের দিন দুপুর নাগাদ বাড়ি পৌঁছলাম। মানুষের মনের সঙ্গে শরীরের একটা ঘনিষ্ঠ যোগ আছে। মায়ের রোগশয্যার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে আমাকে দেখে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বিছানায় বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করলাম—এখন কেমন আছ মা?
উত্তরে মা শীর্ণ হাত দিয়ে আমার চিবুক ছুঁয়ে বললেন—ভয় নেই খোকা, তুই এসে পড়েছিস-এ যাত্রা আমি আর মরব না।
সত্যই পরের দিন থেকে মায়ের অবস্থা ভালোর দিকে যেতে লাগল। আমি ফেরায় বাড়ির লোকও খুশি। খাইদাই আর চণ্ডীমণ্ডপে বসে বৃষ্টি দেখি। চার-পাচদিন ধরে নাগাড়ে বর্ষা চলেছে। গ্রামের সব পথে একটু কাদা, খালবিল আর মাঠ একাকার হয়ে গিয়েছে জলে। আমাদের পুরনো কৃষাণ বনমালী ভিজতে ভিজতে বলল— দাদাবাবু, এমন কাণ্ড জন্মে দেখিনি। সারা গা থৈ থৈ করছে, পাচু হালদারের বাঁশবাগানে একহাটু জল! তার চে আশ্চর্য কইখালির মাঠে মাছ খেলছে দেখে এলাম শিং-মাগুর, পোনার চারা, কই-শয়ে শয়ে মাছ!
কৈশোরে মাছ ধরবার খুব নেশা ছিল। শুধু বড়শি দিয়ে নয়, পোলো, হাত-জাল আর কোচ দিয়েও বহু মাছ ধরেছি। মাছ খাব বলে মাছ ধরা নয়, আসলে এর তোড়জোড় আর মজাটাই বড় কথা। বনমালীর বর্ণনা শুনে হঠাৎ পুরনো নেশাটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। এমন ঘনঘোর বর্ষা দিনরাত্রির ব্যাঙ ডাকছে খালেবিলে—এই তো মাছ ধরার উপযুক্ত সময়। বনমালীকে ডেকে বললাম—বনমালীদা, তোমার কাছে একটা পোলো হবে?
—পোলো? মাছ ধরবে নাকি?
—হ্যাঁ। অনেকদিন অভ্যেস নেই অবিশ্যি, দেখি তবু–
-–আছে বোধহয় একটা। ওবেলা এনে দেব এখন।
বিকেলে বনমালী পোলো এনে দিল। পোলো জানো তোমরা? বেত বা কঞ্চির চটা দিয়ে তৈরি একটা গোল খাঁচামত জিনিস, ফুটতিনেক উঁচু। ওপরদিকে সরু মুখ, সেখান দিয়ে হাত গলিয়ে মাছ বের করতে হয়। তলার দিকের ঘের বড়। মাছ দেখতে পেলেই ঝপ করে পোলো দিয়ে চেপে ধরলে আর পালাতে পারে না। ছিপ না নিয়ে পোলো নেবার কারণ হল—আমি রাত্তিরে মাছ ধরব স্থির করে ফেলেছি। আলো নিয়ে মাছ ধরা ভারি মজার। বিশেষ করে সে সময়ে বিরক্ত করার কেউ থাকে না, পাশে দাঁড়িয়ে পরামর্শ দেয় না, কটা মাছ পেয়েছি জিজ্ঞাসা করে না। রাত্তিরেই ভাল।
পোলো দিয়ে মাছ ধরতে হলে পুকুর বা বিলে সম্ভব নয়, অগভীর জলাশয় প্রয়োজন। সন্ধ্যের একটু আগে গিয়ে কইখালির মাঠের অবস্থা দেখে এলাম। সমস্ত মাঠটায় পায়ের গোছ ডুবে যায় এমন জল। মাঝে মাঝে সামান্য উঁচু জমি এখানেওখানে দ্বীপের মত জেগে আছে। একেবারে আদর্শ জায়গা।
খাওয়া-দাওয়া সেরে রাত এগারোটা নাগাদ লণ্ঠন আর পোলো নিয়ে বেরুলাম। বনমালী সঙ্গে আসতে চেয়েছিল, আমি রাজি হইনি। ওই যে বললাম, মাছ ধরার পরিবেশটাই আসল। সঙ্গে লোক থাকলে বকবক করবে, নানান কথা বলবে—নাঃ, সে সুবিধে হবে না।
কিন্তু বনমালীকে সঙ্গে নিলেই ভাল করতাম। তখনও জানিনা কি ঘটতে চলেছে সেদিন রাত্তিরে।
সন্ধ্যে থেকে বৃষ্টিটা একটু ধরেছে, আজ পাচদিন পর এই প্রথম একটু ক্ষান্তি। কিন্তু সমস্ত আকাশ কালো মেঘে ঢেকে রয়েছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে একটু বাদে বাদেই। যে কোন সময়ে আবার কেঁপে জল আসতে পারে। খুড়তুতো ভাইয়ের কাছ থেকে তার বাঁশের হাতলওয়ালা ছাতাখানা চেয়ে এনেছি, সেটা বগলে রয়েছে। ভাজ করা। ছাতার ভেতরে আছে মুগার সুতো দিয়ে বোনা জালের থলে। মাছ পেলে তাতে রাখা হবে। আয়োজন সব ঠিক, এবার দেখা যাক কি রকম কি হয়। ভোর রাত অবধি চেষ্টা তো চালিয়ে যাব।
মাঠে পা দিয়েই বুঝলাম বনমালী মিথ্যে খবর দেয়নি। খালবিল ভেসে গিয়ে প্রচুর মাছ চলে এসেছে কইখালির মাঠে। কিন্তু মাছ থাকা আর মাছ ধরা এক ব্যাপার নয়। তুমি পোলো হাতে এগিয়ে গিয়ে ঝুপ করে চেপে ধরবে বলে মাছ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে তা তো হয় না। জলের জীব—বহু কৌশল করে তবে এদের ধরতে হয়। কৌশল আমার অজানা নেই, ছোটবেলা থেকে মাছ ধরে আসছি। যেমন ধর, শোল বা ল্যাটা মাছ লণ্ঠন উঁচু করে ধরে নাড়ালে আলোয় আকৃষ্ট হয়ে কাছে আসে। কইমাছ আবার আলোটালো কিছুই খেয়াল করে না, ঝাকবেঁধে একদিকে চলেছে তো চলেছেই। এদের ধরা সোজা। শিং আর মাগুর খুব চালাক মাছ, মানুষ বা অন্য কিছুর সাড়া পেলেই আর সে তল্লাটে থাকে না, শো শো করে পালায়—এরা ছোটেও খুব জোরে, জলের মধ্যে দৌড়ে নাগাল পাওয়া যায় না। কিন্তু মজা হচ্ছে, শিং-মাগুর ছোটে একদম সোজা, কোনদিকে গেল খেয়াল করলে একটু পরে পেছন পেছন সেখানে গিয়ে হাজির হওয়া যায়। সচরাচর এরা তাড়া খেয়ে আলের ধারে বা গাছের শেকড়ের কাছে গিয়ে আশ্রয় নেয়, খোলা জায়গায় থাকে না। অমন জায়গায় পোলো বসানো মুশকিল। তখন পা দিয়ে জলে শব্দ করতে হয়, ভয় পেয়ে মাছ আবার দৌড় দেবার উদ্যোগ করলেই তাড়াতাড়ি পোলো বসিয়ে দিতে হয়। যাক গে, কথায় কথায় অন্য প্রসঙ্গে চলে এসেছি, আসল কথাটা বলি।
রাত দেড়টার মধ্যে অনেক মাছ ধরে ফেললাম। মুগার সুতো দিয়ে তৈরি ব্যাগ এত ভারী হয়ে উঠেছে যে, শক্ত সরু সুতো হাতে কেটে বসে যাচ্ছে। এদিকে আবার মেঘ ডাকতে শুরু করেছে, গা শিরশির করা বাদলার হাওয়া দিচ্ছে—বৃষ্টি ফের এল বলে। এবার বাড়ি চলে যাওয়াই ভাল।
অনেকক্ষণ থেকেই মনের ভেতরে কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল, কি অস্বস্তি সেটা আমি ঠিক বলে বোঝাতে পারব না। কোন অমঙ্গল আসবার আগে থেকে আমি টের পাই, এ কথা আগেই বলেছি। এতক্ষণ মনের একেবারে তলায় কোণের দিকে কোথাও একটা বিপদের পূর্বাভাস খচ খচ্ করছিল, মাছ ধরার আনন্দ আর উত্তেজনায় খেয়াল করিনি। এবারে পরিপূর্ণ সম্বিত ফিরে পেয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম ঘনবর্ষার মধ্যরাত্রে গ্রামের বাইরে নির্জন জলভরা মাঠে একা দাঁড়িয়ে আছি। একটা শেয়াল পর্যন্ত এই দুর্যোগে আশ্রয় ছেড়ে বাইরে বের হয়নি। তেমন কিছু ঘটলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেও সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে আসবে না। নাঃ, বনমালীকে সঙ্গে আনাই উচিত ছিল। এই জলকাদা ভেঙে বাড়ি পৌঁছতেও অন্তত আধঘণ্টা সময় লাগবে। তার মধ্যে আবার বৃষ্টি এসে গেলেই তো হয়েছে।
ভাবতে ভাবতেই ঝিরঝির করে বৃষ্টি নামল। তাড়াতাড়ি ছাতা খুলতে যাচ্ছি, কেমন করে যেন হাত ফসকে লণ্ঠনটা জলে পড়ে নিভে গেল।
চারদিকে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার।
কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আলো থাকলে বুকে বেশ সাহস থাকে। তাছাড়া আমাদের তন্ত্রশাস্ত্রে বলে আগুন হচ্ছে পবিত্রকারী শুভশক্তি, কোন অশিব উপস্থিতি আগুনের সান্নিধ্যে আসতে পারে না। এইজন্য সাধকদের আসনে সবসময় ধুনি জ্বালিয়ে রাখা নিয়ম। কিন্তু দাঁড়িয়ে থেকে তো লাভ নেই, বরং আন্দাজে আন্দাজে চলতে শুরু করাই ভাল। মাছ ধরতে ধরতে মাঠের একেবারে অপর প্রান্তে চলে গিয়েছিলাম। এবার মাঠ পার হয়ে সেই চট্রকাগাছটার পাশ দিয়ে গ্রামের পথে ঢুকতে হবে। মাথায় ছাতি ধরে মাছভর্তি থলে আর নেভা লণ্ঠন হাতে চট্ৰকাগাছটা আন্দাজ করে হাটতে শুরু করলাম।
হঠাৎ দিকদিগন্ত উদ্ভাসিত করে একবার বিদ্যুৎ চমকাল।
সামনের দিকে তাকিয়েছিলাম, অন্ধকারে হাটবার সময় মানুষ যেমন মুখটা একটু তুলে রাখে, বিদ্যুতের উজ্জ্বল আলোয় স্পষ্ট দেখলাম উলটোদিক থেকে একজন মানুষ আমার দিকে এগিয়ে আসছে। বিদ্যুতের আলো একমুহূর্তের বেশি ছিল না, কিন্তু আলো নিভে যাবার পরেও মনে মনে চিন্তা করে কোথায় কি দেখেছি, কতটা দেখেছি বোঝা যায়। যে লোকটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে তার হাঁটার ভঙ্গিতে কোন জড়তা নেই, অন্ধকারেও যেন সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। তার গা খালি, কালো রঙ-পরনে একটা নেংটিমত কাপড়ের ফালি। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা ও লোকটাকে আমি চিনি! খুব পরিচিত সে, এই—কিছুদিনের ভেতরেই কোথায় যেন দেখেছি। কোথায়? কোথায়?
অকস্মাৎ আমি বুঝতে পারলাম, এবং সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করলাম আমি ভয়ানক বিপদগ্রস্ত। জীবিত অবস্থায় এ মাঠ থেকে বেরুতে পারব কিনা তার নিশ্চয়তা নেই। কারণ—
যে মানুষটির মৃতদেহের ওপর বসে ছ-মাস আগে আমি সাধনা করে এসেছি তার শব এগিয়ে আসছে আমার দিকে, বৃষ্টিধারার মধ্যে দিয়ে।
গুরুর কথাই ফলে গেল। সময়মত সাধনা শেষ করতে পারিনি, এবার সেই শৈথিল্যের মূল্য বুঝে নিতে আসছে ওই মূর্তি।
যতদূর সম্ভব শব্দ করা থেকে বাঁচিয়ে সাবধানে জলে পা ফেলে ডানদিকে সরে যেতে লাগলাম—একটু ঘুরপথে হলেও যদি ওই জীবন্ত বিভীষিকার হাত এড়িয়ে গ্রামের পথে পা দিতে পারি। একবার বাড়ি পৌঁছতে পারলে আর ভয় নেই। সেখানে প্রতিষ্ঠিত গৃহদেবতা আছেন, সেখানে এই শরীরী আতঙ্ক প্রবেশ করতে পারবে না।
অনেকখানি সরে এসেছি এমন সময় আবার চমকে উঠল বিদ্যুৎ। চকিত মুহূর্তের মধ্যেই দেখতে পেলাম চলন্ত অপচ্ছায়াও তার গতিপথ বদলে সোজা আমার দিকে আসছে।
আমারই ভুল। অন্ধকারে ওই ভয়ঙ্করের দৃষ্টি বাধা পায় না। এভাবে ওকে ফাকি দেবার চেষ্টা বৃথা। আদিম জড়বিশ্বের বুদ্ধিহীন, চেতনাহীন অন্ধশক্তির দ্বারা চালিত হয়ে একটা বিকৃত মানবদেহ অমোঘগতিতে আমার নিকটবর্তী হচ্ছে। কোনোক্রমে বাড়ি ফিরতে পারলে কয়েকটা গৃঢ় প্রক্রিয়ার দ্বারা একে আমি ঠেকাতে পারি, কিন্তু এই মাঠে দাঁড়িয়ে তা সম্ভব নয়।
শেষ চেষ্টা করার জন্য আমি হাতের জিনিসপত্র ফেলে দিয়ে মাঠের দূর প্রান্তের দিকে প্রাণপণে দৌড়তে লাগলাম। পারব কি গ্রামের পথে পৌঁছতে? সে পথে একটু এগিয়ে হাক দিলে গ্রামের শেষে কোনো বাড়ি থেকে হয়ত শুনতে পাওয়া যাবে।
হঠাৎ অন্ধকারে উঁচুমত একটা কিসের সঙ্গে হোচট খেয়ে ঠিকরে পড়লাম জলে। প্রথমেই বলেছি মাঠের মধ্যে কয়েক জায়গায় উঁচু ডাঙা দ্বীপের মত জেগে ছিল, তারই একটাতে ঠোক্কর লেগে পড়েছি বুঝতে পারলাম। একটা মাটির ঢেলা বা ইটের টুকরোতে ডান হাটু পড়েছিল, দারুণ যন্ত্রণায় মাথার ভেতর অবধি ঝনঝন করে। উঠল। হাটু আর সোজা করতে পারছি না।
বেশ কিছুক্ষণ আর উঠতে পারব না বুঝতে পারলাম। এতক্ষণ নিজের পায়ের শব্দে টের পাইনি, এবার শুনতে পেলাম ছপ ছপ করে জলের ওপর দিয়ে ভারী পায়ের আওয়াজ ক্রমেই এগিয়ে আসছে কাছে। এল, এল, ওই এল!
অতিরিক্ত ভয়ে, আতঙ্কে আর আসন্ন ভয়াবহ মৃত্যুর উপলব্ধিতে অকস্মাৎ আমার মন থেকে সবরকম অনুভূতি লুপ্ত হয়ে গেল। হাঁটু চেপে ধরে চিৎ হয়ে শুয়ে আছি, মুখের ওপর বিরবির করে বৃষ্টি পড়ছে, কানে ভেসে আসছে দূরাগত মেঘগর্জন-কিন্তু হাঁটুতে প্রবল যন্ত্রণা ছাড়া পৃথিবীর আর সব বাস্তবতা আমার কাছে অর্থহীন হয়ে গিয়েছে।
এমন সময় আমার চারদিকে জলের ওপর অনেকগুলো পায়ের শব্দ জেগে উঠল। অগুনতি পা দ্রুত জলে পড়ছে, কারা যেন ছুটে যাচ্ছে এদিকে সেদিকে। আশ্চর্য। কাদের পায়ের শব্দ এ? এখানে আসতে হলে তো জল পেরিয়ে জানান দিয়ে আসতে হবে, কিন্তু এই পদশব্দ যেন অকস্মাৎ জলের বুকেই জন্ম নিল–শুন্য থেকে জেগে উঠল হঠাৎ।
তড়বড় করে একদল ঘোড়া যেন ছুটে যাচ্ছে সামনে-পেছনে। কি ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছি না। বিদ্যুতও চমকাচ্ছে না বেশ কিছুক্ষণ।
এবং তারপরেই আমার চারদিকে একপাল শুয়োরের ঘোৎ ঘোৎ শব্দ শুনতে পেলাম!
এই দুর্যোগে কইখালির মাঠে শুয়োর কোথা থেকে এল? তাও একটা দুটো নয়, পায়ের আওয়াজে বুঝতে পারছি পনেরো কুড়িটা প্রাণী অন্তত ছুটোছুটি করছে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমার মনে পড়ে গেল শৈশবে দেখা সেই অদ্ভুত মানুষটিকে, সরু হাড়ের দণ্ড দিয়ে যিনি শূকররূপী হিংস্র প্রবৃত্তিগুলিকে শাসন করেন। তবে কি তিনিই—
আমার খুব কাছে এসে কে দাঁড়িয়েছে। তাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু সে আমাকে দেখতে পাচ্ছে। আমার মনে আর ভয় নেই, পরিবেশ থেকে মুছে গিয়েছে অমঙ্গলের অনুভূতি। বরং কার অদৃশ্য উপস্থিতিজনিত পবিত্রতা অনুভব করছি সমস্ত অস্তিত্বে।
কে যেন ভালবেসে হাত রাখল—না, আমার হাতে নয়, শরীরের কোথাও নয়—সে হাত রেখেছে আমার বুকের ঠিক মধ্যেটায়।
তারপরই বুঝলাম মাঠে আমি একা, সে উপস্থিতি আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে আমাকে রক্ষা করে ফিরে গিয়েছে স্বস্থানে। এতক্ষণ বাদে এবার বিদ্যুৎ চমকাল, আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে চিরে যাওয়া আলোয় ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম কোথাও আর কেউ নেই। সে অপচ্ছায়াও নয়—আমার ত্রাণকর্তাও নয়।
রাত বোধহয় আড়াইটে। বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছেই।
কোনোরকমে বাড়ি ফিরে এসে শুয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে মেঘ কেটে সূর্য উঠল পাঁচদিন বাদে। ঝকঝকে রোদুরে ভেসে যাওয়া পৃথিবীর রূপ দেখে আমার নিজেরই সন্দেহ হতে লাগল—সত্যিই কি কাল রাত্তিরে কিছু ঘটেছিল? বাড়ির কাউকে কিছু জানালাম না। অনর্থক তাদের চিন্তা বাড়িয়ে লাভ কি?
মা সুস্থ হয়ে ওঠার মাসখানেক পরে আবার বাড়ি ছাড়লাম। একটানা গৃহবাস ঈশ্বর আমার কপালে লেখেন নি। ঘুরতে ঘুরতে এক সন্ধ্যায় খামারবেড়িয়া নামে এক গ্রামে গিয়ে পড়লাম। দেখি গ্রামের একধারে ঝুরিনামা বটগাছের নিচে একজন জটাধারী সাধু ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছেন। ভাবলাম ভালই হল, আজ রাত্তিরটা অন্তত এর সঙ্গে কাটানো যাবে। গুটি গুটি ধুনির এপারে গিয়ে বসলাম। প্রত্যেক গ্রামেই কিছু লোক থাকে যারা সাধু-সন্ন্যাসী দেখলে ওষুধ-বিষুধ আর মাদুলির জন্য ভিড় করে। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। জনাকয়েক লোক করুণমুখে তাদের দুঃখদুর্দশার কথা সাধুকে জানাচ্ছে। ক্রমে তারা বিদায় নিয়ে চলে গেলে সাধুবাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—তারপর? তোমার কি চাই?
সবিনয়ে জানালাম, আমার কিছু চাই না।
—তবে আর কি, যাও, বাড়ি যাও—
দু-এক কথায় বুঝিয়ে দিলাম আমার বাড়ি এখানে নয়, আমি পথে পথে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছি, আপাতত রাতটা এখানে কাটাতে চাই।
সাধু আর কোনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করলেন না, বললেন—থাকে।
একটু পরে নিজের ঝুলি থেকে একটা পাকা কলা আর একটা পেয়ারা বের করে আমাকে দিয়ে বললেন—খাও, আর কিছু আমার কাছে নেই।
—আপনি খাবেন না?
–আমি রাত্তিরে কিছু খাই না।
দু-একটা কথা বলতে বলতে আলাপ জমে উঠল। দেখলাম সাধুজী স্বল্পভাষী হলেও বদমেজাজী নন। একসময় আমাকে বললেন—এখানে ধুনি জেলে আজ ভুল কাজ করেছি, বুঝলে? দু-একদিন থাকব ভেবেছিলাম, কিন্তু কাল চলে যেতে হবে।
—আজ্ঞে, কেন?
ওপরদিকে আঙুল তুলে সাধুজী বললেন—এই গাছে অনেক পাখির বাসা রয়েছে, ধুনির গরম হলকা আর ধোঁয়ায় তারা আজ কেউ বাসায় ফিরতে পারেনি। ওই দেখ, ওদিকে একটা গাছের ডালে বসে কিচমিচ্ করছে। কাউকে গৃহহীন করা মহাপাপ। ইতর প্রাণীদেরও আত্মা আছে, তাদের মনে দুঃখ দিলে সাধনার ফল ক্ষয় হয়ে যায়—
বললাম যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
–কি?
—আপনি কোন মার্গের সাধক?
—কেন বল তো?
—আপনার কথা শুনে আমার খুব ভাল লাগছে। আমি অনেক সাধুসঙ্গ করেছি, বেশির ভাগ সাধকেরা অস্তরে মহৎ হলেও বড় কটুভাষী, অপরের দুঃখ সম্বন্ধে উদাসীন। আপনার মত কথা বলতে শুনিনি কাউকে।
সাধু মৃদু হেসে বললেন—কোনো মার্গেরই নয়। আমার দীক্ষাই হয়নি।
অবাক হয়ে বললাম—সে কি! তাহলে?
–তাহলে আর কি? ভগবানের স্বরূপ জানতে ইচ্ছে করে, তাই ঘুরে বেড়াই, তার সৃষ্টির বিচিত্র রূপের মধ্যে তাঁকে খুঁজতে চেষ্টা করি। ভগবানকে ডাকব, তার আবার মার্গ কি? দীক্ষা কি?
সাধুজীর ওপর শ্রদ্ধা হল। আবছা অনুভব করতে পারলাম—অনেক বড় সাধক ইনি। সারারাত ধরে কত গল্প করলেন, ধর্মের বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে গভীর জ্ঞানের পরিচয় দিলেন। সঙ্কীর্ণতা নেই এতটুকু। সব মতের প্রতিই সমান শ্রদ্ধা।
তাকে প্রশ্ন করলাম—আপনি যে ভগবানকে ডাকেন, তার কোন রূপ কল্পনা করেন। ধ্যানের সময়?
—কোনো রূপই নয়। মনকে কেন্দ্রীভূত করতে পারলে ঈশ্বরের রূপকল্পনার প্রয়োজন হয় না। দুরকম শক্তি মহাবিশ্বে ক্রিয়াশীল। শুভশক্তি, আর ঈশ্বরবিরোধী অশুভশক্তি। বিশ্বের সৃষ্টির সময়েই এই দুই শক্তির জন্ম। ঈশ্বরবিরোধী শক্তির ক্ষমতা কিন্তু কম নয়, বৌদ্ধধর্মে একেই মার’ হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। কালভৈরবের মাধ্যমে জগদীশ্বর এর দমন করেন। সর্বদা এই দুই শক্তির লড়াই চলেছে। তোমার চারদিকে তার প্রকাশ তো দেখতেই পাচ্ছ—
বললাম—-কালভৈরব কে? তিনি শুভশক্তির প্রয়োগকর্তা। দক্ষিণকালিকাতন্ত্রে তার রূপ কল্পনা করা হয়েছে এইভাবে—মহাবলশালী পুরুষ, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, নগ্নগাত্র, রিপুতাড়ন তার প্রধান কর্ম। শূকরের ছদ্মবেশে কাম-ক্রোধ-হিংসা ইত্যাদি রিপুগণ তার বশবর্তী হয়ে সর্বদা তার সঙ্গে ঘোরে। নিজের বুকের পাঁজরের একখানা হাড় দিয়ে তিনি তাদের শাসন করেন।
আমি তখন উত্তেজনায় সটান খাড়া হয়ে বসেছি। এ বর্ণনা তো কইখালির মাঠে শৈশবে দেখা সেই মানুষটির সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। বললাম—তারপর?
—আর কি? কালভৈরবই অনিবার্য ধ্বংসের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করছেন। ঈশ্বরের সাক্ষাৎ শিষ্য তিনি। আমি সেই ভগবানেরই আরাধনা করি।
আমার গলা তখন আবেগে বুজে এসেছে। স্বয়ং কালভৈরব সেদিন রাত্তিরে আমাকে স্বয়ং এসে রক্ষা করেছেন। শৈশবে তার অপার করুণার স্পর্শ দিয়েছেন।
একটু চুপ করে থেকে তারানাথ বলল—কিন্তু সে তুলনায় জীবনে কিছুই করতে পারলাম না। কতগুলো তুচ্ছ সিদ্ধাই পেয়েছিলাম, কিছু টাকাকড়ি-বড় কিছুই হল না। এ জন্ম এমনই গেল। দেখি, যদি পরজন্ম বলে কিছু থাকে—অন্তত এবারের ভুলগুলো আর করব না—
তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল—আজকের গল্প এইখানেই শেষ। কিন্তু ভয় পেয়ো না, বলবার মত গল্প আমার ঝুলিতে আরো অনেক রয়েছে সময়মত বলা যাবে। আজ থামি তাহলে, কেমন?
(সমাপ্ত)