০৭. তারানাথ খুব মিশুক লোক ছিল না

তারানাথ ভাল গল্প বলতে পারলেও খুব মিশুক লোক ছিল না। এক ধরনের ফুর্তিবাজ জমাট মানুষ থাকে যারা চায়ের আড্ডায়, ময়দানের বেঞ্চিতে কিম্বা বিয়ের বাসরে একেবারে দারুণ জমিয়ে তোলে। তারানাথ ঠিক তার উল্টো—লোক দেখলে সে গুটিয়ে যায়। বিশেষ করে নিজের কথা সে কিছুতেই বলতে চায় না। কিন্তু আমাদের সহানুভূতির ছোয়ায় তারানাথের বন্ধ মনের দরজা অনেকখানি খুলে গিয়েছিল। অবশ্য সেটা কেবল আমাদের কাছেই। ইদানীং হাত দেখানো বা কোষ্ঠীবিচারের খদ্দের প্রায় নেই বললেই চলে, বন্ধুও কেউ নেই। সারাদিন একাকীত্ব ভোগ করার পর মাঝে মাঝে বিকেলের দিকে আমরা হাজির হলে তারানাথের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত। মানুষটা গল্পের খনি, আমরা নানাভাবে খুঁচিয়ে তার কাছে গল্প আদায় করতাম। তার মতের বিরোধিতা করলে তারানাথ রেগে যেত। আমি আর কিশোরী গল্পের লোভে হঠাৎ তার কথার মাঝখানে হো হো করে হেসে উঠে বলতাম—বাঃ, তা কখনো হয়?

তারানাথ চটে গিয়ে বলত—হয় না? এই শোনো তবে—

একটা নতুন গল্প শুরু হয়ে যেত।

সেদিন সকাল থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। জামাকাপড়, রুমাল—এমন কি মনের ভেতরটা অবধি ভিজে স্যাতসেঁতে হয়ে রয়েছে। অন্যদিন অফিস ছুটির পর বলাইবাবু কিম্বা হরি মিত্তিরের সঙ্গে মোড়ের দোকানে চা খেতে খেতে রাজনীতি, জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য অথবা বাঙালী কি ছিল আর কি হয়েছে—এসব বিষয়ে গভীর আলোচনা করে আনন্দ পেয়ে থাকি। কিন্তু আজ আর সে-সব ইচ্ছে করল না। অফিস থেকে বেরিয়ে তারানাথের বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলাম।

পৌঁছে দেখি কিশোরী সেন আমার আগেই এসে বসে আছে। আমাকে দেখে বলল—এই যে! এসো হে—তোমারই জন্য বসে আছি—হেসে বললাম—কি করে জানলে আমি আসব?

–ওর জন্য কি আর মন্ত্র-তন্ত্র জানতে হয়? আজ এমন বাদলা করেছে—যাকে বলে আড্ডার মেজাজ, না এসে যাবে কোথায়?

তারানাথের জন্য এক প্যাকেট পাসিং শো কিনে এনেছিলাম, তাকে দিয়ে বললাম—আজ একটা ভাল গল্প হবে নাকি?

তারানাথ হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিল বটে, কিন্তু তার মুখে বিশেষ প্রফুল্লতা দেখলাম না। বিরসমুখে সে বলল—নাঃ তোমাদের কাছে গল্প বলতে ইচ্ছে করে না, তোমরা আমার গল্প অবিশ্বাস করো—

কিশোরী বলল—কই, সব গল্প তো অবিশ্বাস করি না! নেহাত যেগুলো একেবারেই বিশ্বাস করবার মত নয়, সেগুলো বাদে।

তারানাথ চটে উঠতে যাচ্ছিল, আমি কথার মোড় ঘোরাবার জন্য বললামকিশোরীর কথা ছেড়ে দিন। আসল কথা হচ্ছে, আপনার গল্প যদি সত্যি হয় তাহলে আমরা বিশ্বাস করলেই বা কি আর না করলেই বা কি? সত্য কারো মতামতনির্ভর নয়।

তারানাথ কথঞ্চিৎ শান্ত হয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল—এই যে বিশ্বাসের কথা বললে না? বিশ্বাসে সত্যিই অনেক কিছু ঘটায়, সাধারণ বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা করা যায় না—

কিশোরীর ঘাড়ে আজ দুগ্রহ ভর করেছিল, সে বলল—তার মানে আপনি বলতে চাইছেন কেউ যদি বিশ্বাস করে সে কোনোদিন মরবে না, তাহলে বিশ্বাসের জোরে সে সত্যি সত্যিই অমর হয়ে যাবে?

—যাবেই তো। তবে তোমার মত ফিচেল লোক পারবে না। হিমালয়ে যে-সব। প্রাচীন যোগীরা শত শত বছর বেঁচে আছেন, তারা কি করে এত দীর্ঘকাল জীবিত আছেন বলে মনে কর? কেবলমাত্র ইচ্ছাশক্তির জোরে। মানুষের বিশ্বাস ইচ্ছাশক্তিরই একটা প্রকাশ

এমন সময় বাইরে আবার ঝমঝম্ করে বৃষ্টি নামল। আলো কমে গিয়ে অন্ধকারমত হয়ে এল ঘরের ভেতরে। বৃষ্টির বহর দেখে মনে হল সহসা থামবার নয়। অবশ্য তাড়াতাড়ি মেসে ফিরেই বা কি লাভ? কিন্তু এখানে বসে থাকতে হলে গল্প চাই। বললাম-বিশ্বাসের শক্তি সম্বন্ধে একটা ভাল গল্প হোক তবে

তারানাথ বলল—আমার কাছে কোনো গল্প নেই, সব সত্যি ঘটনা।

কিশোরী আবার কি বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম—এখন অন্তত ঘণ্টাদুই আমরা আপনার অতিথি, বেরোবার উপায় নেই। আমাদের প্রার্থনা—একটি গল্প—মানে সত্যি ঘটনা। সৎ গৃহস্বামী মাত্রেই অতিথির প্রার্থনা পূরণ করে থাকে। আপনারও করা উচিত।

তারানাথ একটু হাসল। চোখ বুজে কিছুক্ষণ ভেবে বোধ হয় মনে মনে গল্পটা গুছিয়ে নিল, তারপর বলতে শুরু করল—বছর কুড়ি আগেকার কথা। এক শিষ্যবাড়ি থেকে স্বস্ত্যয়ন করে ফিরছি, ট্রেন বদলাবার জন্য বসে আছি রানাঘাট স্টেশনে। টেনের তখনো প্রায় ঘণ্টাখানেক দেরি। কি করা যায়, একটা বেঞ্চিতে বসে আপন মনে সিগারেট খেয়ে সময় কাটাতে লাগলাম। দক্ষিণ এবং পুজো বাবদ পাওয়া জিনিসপত্র পোটলা করে পায়ের কাছে রাখা। এমন সময় একজন মধ্যবয়সী লোক এসে আমার কাছে দাঁড়িয়ে বলল—একটু আগুনটা দেবেন তো ভাই

বিশেষ খেয়াল না করেই পকেট থেকে দেশলাই বের করে তার হাতে দিলাম। প্রথম কাঠিটা নষ্ট করে দ্বিতীয় কাঠি দিয়ে লোকটা বিড়ি ধরিয়ে আমাকে দেশলাই ফেরত দিল। তখনও আমি তার দিকে তাকাইনি। দেশলাই পকেটে পুরে কি জানি কেন হঠাৎ লোকটার দিকে একবার চাইলাম। সে তখন পেছন ফিরে প্ল্যাটফর্মের অন্যদিকে চলে যাচ্ছে।

তাকিয়েই চমকে উঠলাম।

তোমরা তো জানো আমার কতগুলো বিশেষ ক্ষমতা আছে—যা দিয়ে আমি মানুষের আশু বিপদ বা ভাগ্য পরিবর্তনের কথা টের পাই। পেছন থেকে তাকিয়ে আমি লোকটার শরীর ঘিরে একটা কালো ছায়া দেখতে পেলাম। যেন একটা কালো মসলিনের ঘেরাটোপের মধ্যে থেকে লোকটা চলাফেরা করছে। বুঝলাম মানুষটা ভয়ানক বিপদগ্রস্ত। পায়ের কাছ থেকে পোটলাটা হাতে নিয়ে আমি দ্রুতপায়ে তার পেছনে এগিয়ে গেলাম।

প্লাটফর্মের একটা অপেক্ষাকৃত নির্জন জায়গায় দাঁড়িয়ে লোকটি অন্যমনস্কভাবে লাইনের ওপারে তাকিয়ে ছিল। আস্তে করে ডাকলাম—শুনছেন ভাই?

ভদ্রলোক ভয়ানক চমকে উঠে আমার দিকে তাকালেন। দেখলাম বছর চল্লিশ বয়সের একজন মানুষ, উদ্বেগে ও চিন্তায় মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। গালে পাঁচ-ছ’দিনের

কামানো খোঁচা খোচা দাড়ি। শার্টের একটা বোতাম ভুল ঘরে লাগানো। ভদ্রলোক বিস্মিত গলায় বললেন— আমাকে কিছু বলছেন কি?

একটু বিপদে পড়লাম। কেন ডেকেছি তা ভদ্রলোককে কি ভাবে বলা যায়? একজনকে তো আর হঠাৎ বলা যায় না—ও মশাই, আপনার খুব বিপদ, কারণ আপনার চারদিকে একটা কালো ছায়া দেখা যাচ্ছে!

সময় নেবার জন্য বললাম—আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা ছিল, একটু এদিকে আসবেন?

–কিন্তু আপনাকে তো ঠিক, মানে–

—না, আপনি আমাকে চেনেন না। আসুন, ওই চায়ের দোকানটায় এক ভাড় চা খেতে খেতে গুছিয়ে বলছি। আমি যা বলতে চাই এক কথায় বলা সম্ভব না।

যে কোন কারণেই হোক, এই সময়ে চায়ের স্টলে বিশেষ ভিড় ছিল না। ভদ্রলোককে একটা বেঞ্চিতে বসিয়ে দু-কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম।

ভদ্রলোক উসখুস্থ করছিলেন, বললেন—কই, কি বলবেন বলছিলেন-কি ব্যাপার বলুন তো?

কোন ভূমিকা না করেই বললাম—আমি একটু-আধটু জ্যোতিষ ইত্যাদি চর্চা করি। আপনি যখন আমার কাছে দেশলাই চাইলেন, আমার হঠাৎ কেন যেন মনে হল। আপনার খুব বিপদ। সত্যি কি তাই? আমাকে খুলে বললে আমি হয়ত আপনার কাজে লাগতে পারি—

আমার বিশেষ ক্ষমতার কথাটা আর বললাম না। প্রথমেই সে কথা বললে আমাকে হয় পাগল নয়তো ঠগ মনে করবে।

ভদ্রলোক একটু সন্দিগ্ধ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। এবার ভাল করে দেখে বুঝলাম মানুষটা বেশ বুদ্ধিমান, কিন্তু সাম্প্রতিক দুঃসময় এবং উদ্বেগ তার মুখের স্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্যের ওপর ছায়া ফেলেছে। আজকাল সময় খারাপ, নানারকম ধান্দাবাজ লোক চারদিকে ঘুরছে—এমন অবস্থায় আমাকে হঠাৎ বিশ্বাস করতে না পারাই সম্ভব। কিন্তু মনের যে জোর থাকলে লোকে কোন কিছুকে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করতে পারে, বর্তমানে সে মনের জোর তার নেই। অসহায় ভাবে ভদ্রলোক আমার দিকে চেয়ে বসে রইলেন।

হেসে বললাম–ভয় নেই, আমি ঠগ-জোচ্চার নই। আমার একটা, মানে একটা। বিশেষ ধরনের ক্ষমতা আছে, তা দিয়ে আমি অনেক কিছু আগে থেকে বুঝতে পারি। আমার গুরুর আদেশ ছিল কারো বিপদ বুঝতে পারলে এগিয়ে গিয়ে সাহায্য করা, তাই আপনাকে দেখে

ভদ্রলোক সামান্য কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন—কি ধরনের বিশেষ ক্ষমতা?

বললাম—এই যেমন ধরুন—আপনাকে দেখে বুঝতে পারছি আপনার জন্ম চৈত্র মাসে, সাত থেকে দশ তারিখের মধ্যে। আপনার নামের আদ্যক্ষর ক। গত তিনচারদিনের মধ্যে আপনি বেশ বড় রকমের একটা অগ্নিভয় থেকে রক্ষা পেয়েছেন। আর—

ভদ্রলোকের চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠেছিল, বললেন—আর কি?

—বলব?

দুর্বল স্বরে ভদ্রলোক বললেন—বলুন।

গত বছর আপনার কর্মস্থলে আপনাকে নিয়ে যে গোলমাল হয়েছিল তাতে বিচারে আপনি রেহাই পেয়ে গেলেও দোষটা কিন্তু আপনারই ছিল, তাই না?

ভদ্রলোক মাথা নিচু করে শুনছিলেন। মুখ তুললে দেখলাম তার চোখে জল। আস্তে আস্তে বললেন—আজ্ঞে হ্যাঁ, দোষ আমারই ছিল! কেউ জানে না সেকথা, আমার স্ত্রীও না। কিন্তু বিশ্বাস করুন, নিতান্ত বাধ্য হয়েই

বললাম—তিন হাজার টাকা। ঠিক তো?

ভদ্রলোক একবার কেঁপে উঠলেন আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি সবই জানতে পেরেছেন দেখছি। আপনার ক্ষমতায় আর আমি অবিশ্বাস করছি না। স্ত্রীর অসুখে বাধ্য হয়ে তাকে বাঁচাবার জন্য টাকাটা নিতে হয়েছিল। ভেবেছিলাম কেউ টের পাবার আগেই দেশের জমিজমা বিক্রি করে আবার পুরিয়ে দেব। কিন্তু তার আগেই অডিট্র বসল, ঘাটতি ধরা পড়ে গেল। আমি বহু পুরনো বিশ্বস্ত কর্মচারী, আমাকে কেউ সন্দেহ করল না। অন্য কারো ঘাড়ে দোষ পড়লে হয়ত আমি এগিয়ে গিয়ে অপরাধ স্বীকার করতাম। কিন্তু তাও হল না—যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে টাকাটা বাজে খরচের খাতে লিখে রাখা হল।

তারপর ভদ্রলোক আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন-ওঃ, আপনার। কাছে সব স্বীকার করে যেন বাঁচলাম! এতদিন মনে পাপবোধ পুষে রাখা—উঃ, সে যে কি কষ্ট–

ধুতির খুঁটে মুখ মুছে আবার বললেন—হ্যাঁ, গত পরশুদিন আগুনের হাত থেকে বেঁচেছি বটে। আমার স্ত্রী পুত্র বর্তমানে দেশের বাড়িতে রয়েছে—যেখানে আমি এখন যাচ্ছি। নিজে রান্না করে খাওয়ার অভোস নেই কোনকালে। হোটেলে খেলে আমার শরীর খারাপ হয়, তাই যা হোক ভাতে-ভাত দুটো-কটা ফুটিয়ে নেব বলে স্টোভ জেলে চাল বের করতে পেছন ফিরেছি, আর মশাই ধুতিতে লেগে গিয়েছে আগুন! কি ভাগ্য, সেই সময় আমার এক বন্ধু এসে হাজির আড্ডা দিতে। সে বিছানার মোটা চাদর চেপে ধরে আগুন নেভায়। তাও দেখুন না, কতখানি পুড়ে গিয়েছে—

ডান পায়ের থেকে কাপড় সরিয়ে নিতেই দেখলাম পায়ের গুলি থেকে উরুর পেছন অবধি ভেজা নেকড়ার ফেটি বাধা। বললেন—নারকেল তেলের পট্টি বেঁধে রেখেছি।

চায়ের দোকানের ছেলেটা এসে শূন্য কাপ দুটো নিয়ে গেল। তাকে বললাম আর দু-কাপ চা দিতে। সিগারেটের প্যাকেট বের করে নিজে ধরালাম, ভদ্রলোককেও দিলাম। সিগারেটে গোটা কয়েক লম্বা টান দিয়ে তিনি বললেন—আমার নাম কালীপ্রসাদ মিত্র। খুলনার বিখ্যাত মিত্রদের কথা হয়ত শুনে থাকবেন, আমরা তাদেরই বংশধর। অবশ্য পঞ্চাশ-ষাট বছর হল খুলনার সঙ্গে আমাদের আর কোনো যোগাযোগ নেই। ঠাকুরদা কর্ম উপলক্ষ্যে এদিকে চলে আসেন—সেই থেকেই আর কখনো দেশে ফিরে যাওয়া হয়নি।

আবার চা এল। গরম চায়ে চুমুক দিয়ে কালীপ্রসাদ বললেন—নদীয়া জেলার উত্তর প্রান্তে কিছু ভূসম্পত্তি কিনে ঠাকুরদা বসবাস শুরু করেন। ব্যবসা করতেন কোলকাতায়, মাঝে মাঝে গ্রামে এসে থাকতেন। তিনি ছাড়া বাড়ির লোকজন গ্রামেই থাকত। বন্দরে যে-সব জাহাজ এসে ভেড়ে, তাতে কাঁচা আনাজ যোগান দেবার ব্যবসা করতেন ঠাকুরদা। বিলক্ষণ দু’পয়সা করেছিলেন। কিন্তু বহু প্রতিদ্বন্দ্বী জোটায় তার জীবদ্দশাতেই সে ব্যবসা নষ্ট হয়ে যায়। চেনাগুনো কাকে যেন ধরে বাবাকে এক সাহেবী ফার্মে চাকরিতে ঢুকিয়ে দেন। বাবা অবসর গ্রহণ করার পর সেই চাকরি আমি পেয়েছি।

-কতদিন বাবা রিটায়ার করেছেন?

—তা বছর কুড়ি তো বটেই। বাবার বয়েস এখন প্রায় আশি, কিন্তু বেশ ভাল স্বাস্থ্য—অসুখবিসুখ কিছুই নেই। কেবল চোখে একটু কম দেখেন।

বললাম—যা হোক, যা বলছিলেন বলে যান—

চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে পেয়ালাটা নামিয়ে রেখে কালীপ্রসাদ বলতে শুরু করলেনজ্ঞাতিদের কিছুই আনতে পারেননি। নগদ টাকা সামান্য যা ছিল তাই দিয়েই কোলকাতায় ব্যবসা শুরু করেন। কেবল প্রাণের চেয়েও প্রিয় একটি জিনিস বয়ে নিয়ে আসেন–

বললাম—কি জিনিস?

—একটি অষ্টধাতুর তৈরী কালীমূর্তি। আমাদের গৃহদেবী। চার-পাঁচ পুরুষ ধরে এই মূর্তি আমাদের পরিবারে পুজো পেয়ে আসছে। ঠাকুরদার বাবা—আমার প্রপিতামহতিনি ছিলেন তন্ত্রসাধক। আজীবন সাধনা করে তন্ত্রের বিভিন্ন শাখায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন বলে শোনা যায়। তার জীবনের শেষদিকে একবার গ্রহনক্ষত্রের কি এক বিচিত্র সংস্থান এবং অমাবস্যা একসঙ্গে পড়ে। তেমন যোগ নাকি একশো বছরেও একটা আসে না। সেই বিশেষ অমাবস্যার রাত্তিরে আমার প্রপিতামহ সারারাত জেগে তন্ত্রের এক গৃঢ় প্রক্রিয়া সাধন করেন। শেষরাত্রে হোমকুণ্ডে পূর্ণাহুতি দিয়ে একটা গোল লোহার কোটায়ে পুজোর উপচার থেকে কি একটা জিনিস পুরে কৌটোটা প্রপিতামহীর হাতে দিয়ে বলেন—এই নাও, রাখো। এ যা করে দিয়ে গেলাম। আমাদের বংশে আর হঠাৎ কারো কোন বিপদ হবে না। সত্যিই তার পর থেকে আজ পর্যন্ত এই কৌটোটা আমাদের সব আপদে-বিপদে রক্ষা করে এসেছে। কারো অসুখবিসুখ হলে এই মা-কালীর কৌটো তার মাথায় বুকে ঠেকিয়ে দিলে সে ভাল হয়ে ওঠে। ডাক্তার জবাব দিয়ে গিয়েছে এমন মরণাপন্ন রোগীকেও মা-কালীর কৌটোর প্রভাবে সেরে যেতে দেখেছি। সেও না হয় কাকতালীয়, কিন্তু কে একবার কৌটোর মহিমা নিয়ে উপহাস করায় বাবা সাপুড়েদের সদ্য ধরা বিষাক্ত গোখরো সাপের সামনে কোটোটা ধরেন। ছোটবেলার ঘটনা হলেও আমার পরিষ্কার মনে আছে— সাপটা সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে গুটিয়ে এতটুকু হয়ে পড়ে রইল। জোকের মুখে নুন পড়লে যেমন হয়।

বললাম—এটা কিন্তু দ্রব্যগুণ হতে পারে।

কালীপ্রসাদ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-ঠিক। দ্রব্যগুণে সাপ বশীভূত হয়, কিন্তু লোহার কৌটো ফুটো করে দ্রব্যগুণ বের হবে কি করে বলতে পারেন?

যথার্থ কথা। বললাম—বলে যান।

যাই হোক, বিগত তিনপুরুষ ধরে আমাদের পরিবারের ভালমন্দর ব্যাপারে আমরা মাকালীর কৌটোর ওপর নির্ভর করে থাকি। তবু তো আমি আধুনিক লোক, বাস করি আধুনিক কোলকাতায়, আমার বিশ্বাস হয়ত অতটা দৃঢ় নয়। কিন্তু বাবা প্রাচীন মানুষ—ডাক্তার-উকিলের চেয়ে এই কৌটোর ওপর তার নির্ভরতা বেশি।

মাস চারেক আগে কোলকাতার বাসায় আমার বড় ছেলের খুব অসুখ হয়। ছেলে মরণাপন্ন হচ্ছে—ভেতরে বাইরে আমি তখন খুব বিপন্ন। টাকার ব্যাপার বাবা জানতেন না, কিন্তু নাতির অসুখের খবর পেয়ে আমার এক খুড়তুতো ভাইয়ের হাত দিয়ে মাকালীর কৌটো কোলকাতায় আমার কাছে পাঠিয়ে দেন। কৌটোর মহিমাতেই কিনা জানি না, আমার ছেলেটি সেরে ওঠে— অফিসের গোলমালও মিটে যায়।

একটু থেমে কালীপ্রসাদ বললেন-কিছু মনে করবেন না, আমাকে আর একটা সিগারেট দেবেন?

সিগারেট ধরিয়ে ঘন ঘন টান দিয়ে প্রায় অর্ধেক করে আনবার পর কালীপ্রসাদ আবার বলতে শুরু করলেন—এতদিন মা-কালীর কৌটো কোলকাতায় আমার কাছেই ছিল। হঠাৎ দিন দুয়েক আগে বাবার এক জরুরি চিঠি পেলাম। সে এক অদ্ভুত চিঠি। ছেলে-বৌকে কদিন আগেই বাবার দেখাশুনা করবার জন্য দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম—

এখন চিঠি পেয়ে আমিও চলেছি। কোটোটাও নিয়ে যাচ্ছি সঙ্গে। বললাম—চিঠিটা অদ্ভুত বলছেন কেন? কি আছে চিঠিতে?

উত্তরে কালীপ্রসাদ কাধের ঝোলা থেকে একটা খাম বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন-নিজেই পড়ে দেখুন।

বয়স্ক মানুষের ঈষৎ কম্পিত হস্তাক্ষরে লেখা চিঠি—

স্নেহের কালীপ্রসাদ,

আশা করি মঙ্গলময়ের কৃপায় কুশলেই আছ। এক বিচিত্র ঘটনার সম্মুখীন হইয়া তোমাকে এই পত্র দিতেছি। আজ কয়েকদিন হইল আমাদের বাটিতে নানা অলৌকিক এবং ভৌতিক উপদ্রব আরম্ভ হইয়াছে। ইহার কারণ বা কি ভাবে নিরসন হইবে কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। যাহা হউক, পত্র পাওয়া মাত্র তুমি ছুটি লইয়া দেশে আসিবে। গত চার-পাঁচ মাস যাবৎ মা-কালীর কৌটা তোমার কলিকাতায় বাসায় রহিয়াছে, আসিবার সময় উহা সঙ্গে আনিতে ভুলিবে না। সম্ভবত উহা না থাকাতেই এই উপদ্রব। এই পত্রকে তার মনে করিয়া অবিলম্বে রওনা হইবে। আশীর্বাদ লইয়ো। ইতি–

আঃ
চণ্ডিকাপ্রসাদ মিত্র

পড়া শেষ করে চিঠিটা কালীপ্রসাদকে ফেরত দিলাম। ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন-কি বুঝলেন?

–হ্যাঁ, রহস্যময় চিঠি বটে।

—কি অলৌকিক ব্যাপার কিছু আন্দাজ করতে পারেন?

বললাম—তা কি বলা যায়? সে তো কত কিছুই হতে পারে। আগে কখনো আপনাদের বাড়িতে এরকম কিছু হয়েছে?

কালীপ্রসাদ বললেন—কক্ষনো না।

বেলা পড়ে আসছে। আমার ট্রেন আসবার সময় হল। কালীপ্রসাদ দাঁত দিয়ে নিচের ঠোট কামড়ে ধরে কি যেন ভাবছেন। যাক, আমার আর কি করবার আছে? পোটলাটা হাতে নিয়ে বেঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম—আসি তাহলে। সাবধানে থাকবেন—

কালীপ্রসাদ কেমন যেন হতাশ আর ভীত গলায় বললেন-কিন্তু আমার কি হবে? জানেন, আমার বড় ভয় করছে।

—বিপদে ঈশ্বরকে স্মরণ করবেন। একমাত্র তিনিই সমস্ত ভয় থেকে মানুষকে মুক্ত করতে পারেন।

কালীপ্রসাদের মুখ দেখে মনে হল না যে আমার উপদেশে তিনি কিছুমাত্র ভরসা পেয়েছেন। অবশ্য সেজন্য তাকে দোষ দেওয়া যায় না। ঈশ্বর অদৃশ্য, আড়ম্বর করে তার পুজো দেওয়া যায়। কিন্তু জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে তার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা একটা উচ্চস্তরের সাধনা। সে সাধনায় কালীপ্রসাদ এখনো সিদ্ধিলাভ করেননি। কিন্তু আমি আর কি করবো? বিদায়সূচক সামান্য হেসে পেছন ফিরে হাটতে শুরু করলাম।

কয়েক পা হেঁটে আসতে-না-আসতেই কালীপ্রসাদ দৌড়ে এলেন।

–শুনছেন? একটু দাঁড়ান–

দাঁড়ালাম। কালীপ্রসাদ আমার কাছে পৌঁছে বললেন—আর একটা কাজ করা যেতে পারে।

-–কি?

–আপনি কি তাতে রাজি হবেন?

বললাম—বলেই ফেলুন না। আমারও তো ট্রেন আসবার সময় হল—

গুরুত্বপূর্ণ কথা শুরু করার ভঙ্গিতে কেশে গলা পরিষ্কার করে কালীপ্রসাদ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—আপনি আমার সঙ্গে আমাদের দেশের বাড়ি চলুন।

প্রস্তাবটা নিতান্ত আকস্মিক। অবাক হয়ে বললাম—আমি? আপনার বাড়িতে?

—হ্যাঁ। আপনি অলৌকিক শক্তির অধিকারী। আপনি গেলে আমাদের অমঙ্গল কেটে যাবে। আপত্তি করবেন না—দয়া করে আমার সঙ্গে চলুন। বলুন, যাবেন?

লোকটা সত্যিই ভয় পেয়েছে। পাওয়াই স্বাভাবিক। একটু চিন্তা করলাম-বাড়িতে এমন কিছু বলে আসিনি যে তাড়াতাড়ি ফিরবো। আরো পাঁচ-সাত দিন দেরি হলে ক্ষতি নেই। দেখাই যাক না এর সঙ্গে গিয়ে।

বললাম—আচ্ছা চলুন—যাব।

কালীপ্রসাদের চোখের দৃষ্টি কৃতজ্ঞতায় ভারী হয়ে এল। আমার হাত দুটো ধরে তিনি বললেন—বাঁচলাম। সত্যি বিশ্বাস করিনি আপনি যেতে রাজি হবেন—

 

একটা ছোট্ট গ্রাম্য স্টেশনে নেমে পাক্কা তিন মাইল হেঁটে কালীপ্রসাদের বাড়ি। গ্রামে যখন ঢুকলাম, তখন রাত্রি প্রায় আটটা। পল্লীগ্রামের তুলনায় শেষ রাত। কৃষ্ণপক্ষের সুমুখ অন্ধকার রাত্তির, পঞ্চমীর রাঙা চাদ পুবদিগন্তের নিচে থেকে চালতে গাছের পেছন দিয়ে এক অলৌকিক গোলকের মত উঠে আসছে। গ্রামের প্রায় শেষের দিকে আম-জাম গাছে ঘেরা নির্জন বাড়ি, পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সদর দরজায় শেকল নাড়তে একটু বাদে দরজার ফাঁক দিয়ে লণ্ঠনের আলো দেখা গেল। কিন্তু কারো সাড়াশব্দ নেই, যেন ভেতরে যে দাঁড়িয়ে, সে সাহস করে দরজা খুলতে পারছে না।

কালীপ্রসাদ হেঁকে বললেন—অভিরাম নাকি? দরজা খোল—

—কে, বাবু?

ব্যস্ত হয়ে যে লোকটি দরজা খুলে দিল তার বয়েস ষাট ছাড়িয়েছে। মাথায় কাচাপাকা চুল, পরনে খাটা েধুতি, খালি গা। তার সরল মুখে বিশ্বস্ততার ছাপ! কালীপ্রসাদ বললেন–ঠাকুরমশাই, এ হচ্ছে অভিরাম। পুরনো লোক, আমাকে কোলে করেছে ছোটবেলায়। দরজা খুলছিলি না কেন রে?

অভিরামের সরল মুখে ভয়ের স্পষ্ট চিহ্ন ফুটে উঠল। সে বলল—বাবু বাড়িতে যা কাণ্ড। দরজা হঠাৎ খুলতে সাহস হয় না—

–কেন, কি হচ্ছে বাড়িতে?

এর উত্তর অভিরামের দিতে হল না। আমাদের পেছনে আমবাগানে অন্ধকারের মধ্যে গাছের পাতার সরসর শব্দ উঠল, যেন গাছের একটা ডাল ধরে কেউ খুব জোরে বাকাচ্ছে। আমরা দুজন অবাক হয়ে সেদিকে ফিরে তাকাতেই অভিরাম বলল—ওই আবার শুরু হল, দেখছেন তো? নানান উপদ্রব–

সত্যিই, কিসে নাড়াচ্ছে অত মোটা ডালটাকে? মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে?

সাঁই করে কি একটা জিনিস গাছের ওপর থেকে আমাদের দিকে ছুটে এল। সহজাত সংস্কারের বশে কালীপ্রসাদ কোমর থেকে শরীর সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে ফেলেছিলেন, জিনিসটা ঠক্ করে পাঁচিলে লেগে মাটিতে পড়ে গেল। নইলে এই আঘাতেই কালীপ্রসাদের পঞ্চভূপ্রাপ্তি ঘটত।

লষ্ঠনের স্নান ঘোলাটে আলোয় দেখলাম মাটিতে পড়ে আছে একটা সেরদশেক ওজনের পাথরের টুকরো।

বললাম—আপনারা দুজনে ভেতরে চলে যান। বাড়িতে টর্চ আছে?

–আজ্ঞে না। কেন?

আমি একবার ওই গাছটার কাছে যাব। দাও হে অভিরাম, তোমার লণ্ঠনটাই দাও— কালীপ্রসাদ বিচলিত হয়ে বললেন—না না, একা যাবেন না। দেখলেন তো–

-–আমার কিছু হবে না। আপনি ভিতরে যান।

আমি জানতাম মধুসুন্দরী দেবীর কৃপায় কোনো নিম্নশ্রেণীর প্রেত আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। পাথরটা কালীপ্রসাদকে লক্ষ্য করেই নিক্ষিপ্ত হয়েছিল, আমাকে নয়।

 

লণ্ঠন হাতে বাগানের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালাম।

চারদিক নিঃঝুম, কোথাও গাছের একটি পাতা অবধি নড়ছে না। মনে হল সামনের মোটা গুড়িওয়ালা আমগাছটার ওপর থেকেই পাথরটা ছুটে গিয়েছিল। লণ্ঠনটা তুলে ধরে ওপরদিকে দেখবার চেষ্টা করলাম—কিছু দেখা গেল না।

কিন্তু আমার মনের মধ্যে একটা আশ্চর্য অনুভূতি হল।

মনের একেবারে গভীরে হঠাৎ যেন কে একটা কল বিগড়ে দিল। আমার হাত-পা অবশ হয়ে আসছে, সজ্ঞান চৈতন্য নিভে আসতে চাইছে তেলহীন প্রদীপের মত। আর আমি যেন এক পা-ও হাটতে পারব না। সমস্ত দেহে-মনে কি অস্বস্তি। সে ভাষায় বোঝানো যাবে না।

নিজের ক্ষমতার ওপর অগাধ বিশ্বাস নিয়ে একা এখানে এসেছিলাম। এবার আমার অকস্মাৎ ভয় করতে লাগল। মৃত্যুভয় নয়, যে কোন কারণেই হোক সে ভয় আমার কোনোদিনই নেই। কোন অজানা শক্তির মুখোমুখি হতে গেলে যে ভয় হয়— সেই রকম।

বিশ্রী একটা গন্ধে ভরে গিয়েছে চারদিক। প্রতি নিঃশ্বাসে গন্ধটা একেবারে ফুসফুসের ভেতর অবধি চলে গিয়ে যেন শরীরকে অপবিত্র করে দিচ্ছে। মনকে স্থির করে আমি মধুসুন্দরী দেবীর ধ্যানমন্ত্র আবৃত্তি করতে লাগলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পরিবেশ থেকে দুর্গন্ধ দূর হয়ে গেল, মনের বল ফিরে পেলাম।

দরজা খোলাই ছিল, ভেতরে ঢুকে দেখি উঠোনের ওপারে বারান্দায় বাড়ির সবাই জড়ো হয়ে শঙ্কিত চোখে তাকিয়ে আছে। আমি ঢুকতেই কালীপ্রসাদ বললেন—এই যে ঠাকুরমশাই। ওঃ, আমরা যা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম–

কালীপ্রসাদের কাধে হাতের ভর রেখে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, আন্দাজে বুঝলাম। তিনিই চণ্ডিকাপ্রসাদ। ফর্সা মানুষ, দীর্ঘদেহী—দেখে বোঝা যায় এককালে খুবই সুপুরুষ ছিলেন। অগোছালো ধরনের ধুতি পরা!

বারান্দায় উঠে লণ্ঠনটা নামিয়ে রাখলাম। চণ্ডিকাপ্রসাদ এগিয়ে এসে বললেনকালী আমাকে এতক্ষণ আপনার কথা বলছিল। আপনি যে কষ্ট করে এসেছেন—

বললাম—ও কথা বলবেন না, আপনি আমার বাবার বয়েসী—

চণ্ডিকাপ্রসাদ আমার হাত দুটো ধরে বললেন—তাতে কি? আপনি বর্ণশ্রেষ্ঠ, সাধক মানুষ। আপনি এসেছেন, এবার আমার বাড়ির অমঙ্গল কেটে যাবে।

কঠিন রোগীর বাড়ি বিলেতফেরত ডাক্তার গেলে বাড়ির লোকে যেমন বলে।

–আমার যা সাধ্য আমি করব মিত্রমশায়। নইলে আমি আসতাম না।

—আমাদের বাড়িতে কেন এমন হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছেন ঠাকুরমশাই?

–কিছু কিছু বুঝতে পেরেছি বইকি।

পিতা পুত্র দুজনেই বলে উঠলেন-কি? কি বুঝেছেন?

–এখন না। আগে আপনাদের কথা শুনে নিই। তারপর বলব।

চণ্ডিকাপ্রসাদ ব্যস্ত হয়ে বললেন—হ্যাঁ, হ্যাঁ—চলুন, হাত-মুখ ধুয়ে বসে সব শুনবেন। ওরে—ও অভিরাম, ঠাকুরমশাইকে জল দে–

দক্ষিণ দিকে বড় বড় জানালাওয়ালা একটা ঘরে আমার থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল। একটু সুস্থ হয়ে সেখানে বসে চণ্ডিকাপ্রসাদের বিবরণ শুনলাম।

চণ্ডিকাপ্রসাদ বললেন—আমার জীবনে কখনো এমন অভিজ্ঞতা হয়নি ঠাকুর মশাই। দিন পনেরো-কুড়ি আগে এক রাত্তিরে শুরু। খেতে বসেছি সবে, রাত দশটা কি সাড়ে দশটা হবে–হঠাৎ বাইরে শো শো আওয়াজ করে একটা ঘূর্ণি হওয়া মত উঠল। আমরা অবাক। ঝড়বৃষ্টির সময় নয়, আকাশে মেঘ নেই—এমন বাতাস উঠল কোত্থেকে? সেই বাতাসের দাপটেই রাজ্যের ধুলোবালি এসে আমার ভাতে পড়ল। মনটা যেন কেমন হয়ে গেল। আমরা সেকেলে মানুষ, লক্ষণ-অলক্ষণ মানি—আর না খেয়ে উঠে পড়লাম। সারারাত ভাল ঘুম হল না। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে রাত শেষ হয়ে গেল। সকালে উঠে গড় হাতে বাগানে যাচ্ছি, দেখি সদর দরজার কাছে দুটো মরা পাখি পড়ে আছে। প্রথমে ভাবলাম গতরাত্রিতে যে বাতাস উঠেছিল, তারই ঝাপটায় বোধ হয় মারা পড়েছে। ভাল করে লক্ষ্য করে দেখি তা নয়—কে যেন পাখি দুটোর ঘাড় মুচড়ে ঘুরিয়ে দিয়েছে। ঝড়ে তেমন হতে পারে না। বাড়ির সবাই দেখলে ভয় পাবে বলে হাতে করে মরা পাখি দুটোকে ঝুলিয়ে নিয়ে গিয়ে দূরে ফেলে দিলাম।

একটু দম নিয়ে চণ্ডিকাপ্রসাদ বললেন—এই শুরু হল। মাঝেমাঝেই উলটো-পালটা বাতাস দেয়, বাড়ির জিনিসপত্র হুড়মুড় করে পড়ে যায়, অদ্ভুত গোঙানির শব্দ শোনা যায় বাড়ির চারপাশে। এসব কিন্তু আমার বাড়ি এবং চারদিকের কিছুটা জায়গায় ঘটে। পরে গ্রামের মধ্যে জিজ্ঞেস করে দেখেছি, তারা ঝড়-বাতাস কিছুই টের পায়নি। কেন এমন হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি কি বলেন ঠাকুরমশাই?

চণ্ডিকাপ্রসাদের দিকে তাকিয়ে বললাম—আপনার বাড়িতে কোনো প্রেতের উপদ্রব হচ্ছে না। অন্তত যে অর্থে আমরা ‘প্রেত’ কথাটা ব্যবহার করি—সে অর্থে নয়।

ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন—তাহলে?

—ব্যাপারটা আপনাকে বোঝানো একটু কঠিন হবে। আমাদের এই মানুষের জগতের মতই আরো বহু জীবলোক আমাদের চারদিকে সর্বদাই বর্তমান। তারা ঠিক ভূত বা প্রেত নয়—তারাও এক ধরনের জীব। হয়ত মানুষের চেয়ে অন্য রকম। তাদের মন, চিন্তা, আচার-ব্যবহার সবই মানুষের থেকে আলাদা। আমাদের বিচারে হয়ত অমানুষিক। সে জগতের সমস্ত পদার্থই আমাদের কাছে অদৃশ্য ও অস্পর্শযোগ্য। বস্তুত একই স্থান অধিকার করেও এই দুই জগৎ একে অপরের কাছে অস্তিত্বহীন। কিন্তু মাঝে মাঝে প্রকৃতির কোনো আশ্চর্য খেয়ালে এই ছায়াজগৎ আমাদের জগৎকে স্পর্শ করে। এখানে ঠিক তাই হয়েছে। আমরা কোনোভাবে তাদের দুনিয়াতে ঢুকে পড়েছি। সেটা তাদের পছন্দ না হলে তাদের দোষ দেওয়া যায় না। যা ঘটতে দেখছেন, তা হচ্ছে আমাদের জাগতিক বস্তুর ওপর তাদের মানসিক শক্তির ক্রিয়া। হয়ত তারা ভাবছে এই ভাবে ভয় দেখিয়ে তাদের জগৎ থেকে তারা আমাদের দূর করতে পারবে। বাড়িতে বেড়ালকুকুর ঢুকলে আমরা যেমন ঠেঙিয়ে তাড়াই আর কি! পার্থক্য এই যে, এক্ষেত্রে এসবে কোনো কাজ হবে না। পরিবেশে আর একটা বড় রকমের ঝাঁকুনি লাগলে দুটো জগৎ আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তার আগে নয়।

আমি থামতে চণ্ডিকাপ্রসাদ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। তারপর বললেনএসব আপনি জানলেন কি করে?

খুলে বললে বিস্তর কথা বলতে হয়। ইচ্ছে করছিল না। সংক্ষেপে বললাম—আমি জানতে পারি।

–ওই ঝাঁকুনি না কি বললেন, সেটা কি করে দেওয়া যায়?

—সেটা আপনাআপনিই হয়ে যেতে পারে, যেমন করে শুরু হয়েছিল। স্বস্ত্যয়ন বা স্থানশুদ্ধি গোছের একটা হোমও করতে পারি। কিন্তু আপনাকে সত্য কথাই বলে রাখা ভাল, এই ধরনের উপদ্রবের কথা আমি গুরুদেবের কাছে শুনেছি মাত্র—নিজে দেখছি এই প্রথম। এ বিষয়ে আমার বিশেষ কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আমার হোমে কতদূর কাজ হবে জানি না।

চণ্ডিকাপ্রসাদ কি ভাবলেন, তারপর বললেন—তা হোক, আপনি হোমের আয়োজন করুন। আর একটা কথা, যদি কিছু মনে না করেন—

—না, বলুন আপনি—

একটু ইতস্তত করে চণ্ডিকাপ্রসাদ বললেন—আপনার ওপরেই যদিও সব কিছু ছেড়ে দিচ্ছি, তবু আমার নিজস্ব বিশ্বাসের জন্য যদি কিছু ক্রিয়াকলাপ করি তাহলে আপত্তি হবে না তো?

হেসে বললাম—না, আমার কি আপত্তি? করুন আপনার যা ইচ্ছে—

চণ্ডিকাপ্রসাদ ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন—কালী, কৌটোটা এনেছিস তো?

—হ্যাঁ, বাবা। এনে দেব?

—নিয়ে আয়।

কালীপ্রসাদ উঠে পাশের ঘর থেকে মা কালীর কৌটো এনে বাবার হাতে দিলেন। সেটা নিয়ে চণ্ডিকাপ্রসাদ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—এটার কথা শুনেছেন বোধ হয়?

বললাম—হ্যাঁ, কালীবাবু আসতে আসতে আমাকে বলেছেন।

—তাহলে তো আপনি সবই জানেন। এই কৌটোর ওপর আমাদের সবার মনে একটা গভীর বিশ্বাস আছে আর কি। তবে বিশ্বাসটা অযৌক্তিক নয়, পরীক্ষিত সত্য। গ্রামে বসন্তের মড়ক লেগে হাহাকার পড়ে গিয়েছিল। এই কৌটাতে হাতে মা কালীর নাম করতে করতে বাড়ির চারদিক ঘুরে গণ্ডি কেটে দিয়েছিলাম। আন্দেক গ্রাম সাফ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আমাদের বাড়িতে অসুখ ঢোকেনি। আজও তাই করবো ভাবছি, কৌটো নিয়ে বাড়ির চারধারে গণ্ডি কেটে দেব। আসবেন আমার সঙ্গে? কালী, তুইও আয়—

বৃদ্ধকে একা ছাড়তে ইচ্ছে করল না। বললাম-চলুন, যাবো।

বাইরে যাবার জন্য সবে উঠে দাঁড়িয়েছি, হঠাৎ বাড়ির ভেতরে হুড়মুড় করে বিকট শব্দ হল—ধাতব কিছু পড়ে যাওয়ার আওয়াজ।

চণ্ডিকাপ্রসাদ বললেন—ওই শুরু হল আবার! চলুন দেখি।

ভেতরের বারান্দা থেকে আওয়াজ এসেছিল, সেখানে গিয়ে দেখলাম বাড়ির মেয়ে আর বাচ্চারা বারান্দার অপর প্রান্তে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দশ-বারোখানা ইট দিয়ে বেদীমত করে তার ওপরে একটা লোহার ড্রাম দাঁড় করানো ছিল—চাল রাখবার জন্য। সেটা উলটে পড়ে চাল ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে। আমরা যখন পৌঁছলাম, তখনও ড্রামটা গড়াচ্ছে। আমাদের পায়ের কাছে এসে থেমে গেল।

আমার নাকে ভেসে এল সেই বিশ্রী গন্ধটা, বাইরের বাগানে যেটা পেয়েছিলাম।

চণ্ডিকাপ্রসাদ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তাকে বললাম—যা করবার করে ফেলুন, আর রাত করবেন না।

সদর দরজা দিয়ে আমরা বাইরে এলাম। সঙ্গে কালীপ্রসাদ আর লণ্ঠন নিয়ে অভিরাম। চাদ ঢাকা পড়েছে গাছের পাতার আড়ালে। মাটিতে স্নান জ্যোৎস্না আর ছায়ার খেলা। ঝোপেঝাড়ে জোনাকি জুলছে। বাতাস নেই কোনো দিকে, কেমন একটা থমথমে আবহাওয়া। কালীপ্রসাদের হাতে একটা মোটা লাঠি, যদিও বুঝতে পারলাম না অতিপ্রাকৃত কোন বিপদ হলে লাঠি দিয়ে কি করে ঠেকানো সম্ভব।

চণ্ডিকাপ্রসাদের হাতে মা-কালীর কৌটো, মুখে বিড়বিড় করে কি মন্ত্র পড়তে পড়তে চলেছেন। ক্রমে আমরা বাড়ির পেছনদিকে এসে হাজির হলাম। এদিকটায় জঙ্গল খুব বেশি, আসশেওড়া আর কুঁচকাটার ঝোপে ভর্তি। সাবধানে কাপড় বঁচিয়ে চলেছি, আর কয়েক পা হাঁটলেই আমরা একটা বাক ফিরে বাড়ির পুব দিকের সীমানায় পৌঁছব, সেখানে ঝোপঝাড় অপেক্ষাকৃত কম। এমন সময় আমার মনের ভেতর সেই পরিচিত বিপদের ঘণ্টাটা বেজে উঠল—বুঝতে পারলাম এক্ষুনি একটা কিছু ঘটবে।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ডানদিকের একটা ঘন ঝোপের মধ্যে খড়খড় করে কি নড়ল, আমরা সবাই থমকে দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকালাম। কালীপ্রসাদ দুই হাতে লাঠি বাগিয়ে ধরেছেন। অভিরাম লণ্ঠন মাটিতে নামিয়ে রেখে নিঃশব্দে তার হাত থেকে লাঠিটা নিল।

পরমুহূর্তেই ঝোপের মধ্যে থেকে কালো মত বেশ বড়সড় কুকুরের আকারের কি একটা জীব বেরিয়ে এসে ক্রুদ্ধ গর্জন করে চণ্ডিকাপ্রসাদের দিকে ছুটে গেল। কালীপ্রসাদ ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন। আমি বলে উঠলাম—সামলে!

জন্তুটা চণ্ডিকাপ্রসাদের পায়ে দাঁত বসিয়ে দিতে গেল, অস্ফুট আর্তনাদ করে সরে গেলেন তিনি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অভিরাম সবলে লাঠি দিয়ে আঘাত করল প্রাণীটার মাথায়। শূন্য মাটির হাড়ি ফেটে যাবার মত ফটাস করে শব্দ হল। নিঃশব্দে জন্তুটা কত হয়ে পড়ে গেল একপাশে।

বলতে এত সময় লাগলেও ঘটতে লেগেছিল কয়েক মুহূর্ত মাত্র।

কালীপ্রসাদ লণ্ঠন নিয়ে ঝুঁকে পড়ে বললেন—এঃ! এ তো শেয়াল। মরে গেছে।

মরা জ্যোৎস্না আর লণ্ঠনের আলো মিলিয়ে কেমন একটা আলো-আঁধারি মত হয়েছে। তবু ভাল করে তাকিয়ে মনে হল শেয়ালই বটে।

অভিরাম বলল—অদ্ভুত ব্যাপার বাবু! শেয়ালে কখনো তাড়া করে কামড়াতে আসে শুনিনি!

কালীপ্রসাদ বললেন—ঠিক কথা। শেয়াল ভীতু জন্তু, মানুষ দেখলে পালিয়ে যায়। এটা তাড়া করে এল কেন?

চণ্ডিকাপ্রসাদ বোধ হয় নিজেকে সান্ত্বনা দেবার জন্য বললেন—পাগলা শেয়াল হবে। নইলে কি আর—যা হোক চল—অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত নয়।

এদিনের গৃহ প্রদক্ষিণের একটা ফল কিন্তু হাতে হাতে দেখতে পেলাম। সে রাত্তির থেকে বাড়ির ভেতরের উপদ্রব বন্ধ হয়ে গেল। সারারাত সজাগ হয়ে শুয়ে রইলাম, কাশির শব্দ শুনে টের পাচ্ছিলাম চণ্ডিকাপ্রসাদও জেগে। কিন্তু সে রাতে আর কোনো উপদ্রব হল না।

পরের দিন সমস্ত ব্যাপারটা অদ্ভুতভাবে মিটে গেল। যে কথা বলবার জন্য এ গল্পের অবতারণা। আমাকে আর যজ্ঞ করতে হয়নি। এ ঘটনায় আমার ভূমিকা ছিল শুধুই দ্রষ্টার।

মরা শেয়ালটার পা ধরে টেনে অভিরাম দূরে আমবাগানের ওপাশে একটা পতিত জমিতে ফেলে দিয়ে এসেছিল। রাত্তিরেও কোন উপদ্রব হয়নি। সকালে উঠে দেখলাম বেশ প্রসন্ন সূর্যের আলোয় চারদিক ভরে আছে। চণ্ডিকাপ্রসাদের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ করে দিনটা কেটে গেল। ভদ্রলোক সেকেলে মানুষ হলেও হিন্দু শাস্ত্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে বেশ পড়াশুনো করেছেন।

দুপুরে সুন্দর দিবানিদ্রা দিয়ে যখন উঠলাম, তখন বিকেলের রোদ মিলিয়ে গিয়ে ছায়া গাঢ় হয়ে এসেছে। বাইরের তক্তাপোশে বসে চণ্ডিকাপ্রসাদ হুঁকোয় টান দিচ্ছিলেন, সেখানে গিয়ে বসলাম। গড় হাতে কালীপ্রসাদ উঠোন পেরিয়ে বাড়ির বাইরে বাগানের দিকে চলে গেলেন। চণ্ডিকাপ্রসাদ ডেকে বললেন—কালী, চট করে সেরে আয়। একসঙ্গে বসে ঠাকুরমশায়ের যজ্ঞের ফর্দটা করে ফেলা দরকার।

এই আসছি—বলে কালীপ্রসাদ বেরিয়ে গেলেন।

সকালের আলোচনার খেই ধরে চণ্ডিকাপ্রসাদ বললেন হ্যাঁ, সকালে যে কথা হচ্ছিল—নিষ্ঠা এবং সদগুরুর প্রয়োজন আছে ঠিকই, কিন্তু মস্ত্রোচ্চারণের যথার্থতার ওপরেই অনুষ্ঠানের সাফল্য নির্ভর করে। মন্ত্রের প্রত্যেক অক্ষরের একজন অধিষ্ঠাত্রী দেবী আছেন, সঠিক উচ্চারণ না হলে তারা কুপিত হন—

বাড়ির ভেতর থেকে গরম ভাজা পরোটা আর আলুভাজা এল। খেতে খেতে গল্প। চলল। যখন সন্ধ্যে উতরে অন্ধকার বেশ ঘন হয়ে উঠেছে, সে সময় অভিরাম এসে জিজ্ঞাসা করল—কত্তামশাই, ছোটবাবু কোথায়? মাঠাকরুণ ডাকছেন—

চণ্ডিকাপ্রসাদ বললেন—কে, কালী তো-তাই তো, কালী ফেরেনি? সে কি!

হঠাৎ আমারও খেয়াল হল, কালীপ্রসাদ বহুক্ষণ হল বাগানে গিয়েছেন বটে। ছোট-বড় কোনো প্রাকৃতিক আহানে সাড়া দিতেই এতক্ষণ লাগতে পারে না।

দু’এক মুহূর্তের ভেতর ব্যাপারটা সম্যক উপলব্ধি করে আমরা লাফিয়ে উঠলাম। চণ্ডিকাপ্রসাদ কেমন অবরুদ্ধ গলায় বললেন—অভিরাম, আলো আর লাঠি নিয়ে আয়, তাড়াতাড়ি।

বাড়ি থেকে বেরুচ্ছি, চণ্ডিকাপ্রসাদ বললেন—ঐ যাঃ, দাঁড়ান—এক্ষুনি আসছি।

তিনি আবার বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেলেন। মিনিটখানেক বাদে বেরিয়ে এলে বুঝলাম আমার আন্দাজ ঠিকই ছিল—তার হাতে মা-কালীর কৌটো। এইটে আনতেই তিনি ফিরে গিয়েছিলেন।

আমবাগানে পা দিয়েই বুঝতে পারলাম এ বাড়ির ওপর থেকে দুর্ভাগ্যের কালো ছায়া একেবারে মিলিয়ে যায়নি। সমস্ত পরিবেশে ছেয়ে আছে একটা বিকট গন্ধ, গতকাল এসে যেটা পেয়েছিলাম। বিকেলবেলা মনের মধ্যে যে প্রসন্নতা জেগে উঠেছিল, তা কোথায় বিলীন হয়ে গেল।

লণ্ঠন হাতে অভিরাম আগে আগে চলেছে, সে ডাকছে—ছোটবাবু গো-ও-ও—

চণ্ডিকাপ্রসাদ ডাকছেন—কালী-ই-ই—

আমার বুক গুরগুর করছে। আজ সন্ধ্যেটা ভাল নয়—ভাল নয়।

একটা ঝোপের পেছনে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা কালীপ্রসাদকে অভিরামই আগে দেখতে পেল! ‘ছোটবাবু’ বলে চিৎকার করে উঠে সে ছুটে গিয়ে কালীপ্রসাদের দেহের পাশে হাটু গেড়ে বসে কেঁদে উঠল।

পরমুহূর্তেই আমরাও পৌঁছে গেলাম। আমি শক্ত করে চণ্ডিকাপ্রসাদের হাত ধরে রেখেছি, বুঝতে পারছি তার সমস্ত শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে। এ অবস্থায় সেটাই স্বাভাবিক। তার হাত ছেড়ে দিয়ে বললাম—দাঁড়ান একটু, এত বিচলিত হবেন না—

নিচু হয়ে কালীপ্রসাদের নাড়ি দেখলাম, বুকে হাত দিয়ে স্পন্দন বোঝার চেষ্টা করলাম। নাড়ি ঠিক আছে, তবে মৃদু। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললাম—ভয় নেই, ইনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন। অভিরাম, চল-ধরাধরি করে একে বাড়ি নিয়ে যাই।

আমরা অজ্ঞান কালীপ্রসাদের দেহ তোলবার জন্য নিচু হয়েছি, হঠাৎ ঠিক গতকালের মত ঝোপের মধ্যে খস খস শব্দ হল। কি যেন আমাদের দিকে আসছে। কিন্তু তার গতি কালকের চেয়ে ধীর।

আমাদের ভয়চকিত দৃষ্টির সামনে ঝোপ ঠেলে বেরিয়ে এল একটা শেয়াল! গতকাল যে শেয়ালটাকে অভিরাম মেরেছিল! প্রাণীটার মাথা দুফাক হয়ে আছে, ঘিলু বেরিয়ে গড়াচ্ছে ডান চোখের ওপর দিয়ে। অন্য চোখে মৃত, নিষ্প্রাণ দৃষ্টি। প্রকট দংষ্ট্রার ফাঁক দিয়ে জিভের আধখানা বেরিয়ে রয়েছে। সে এক অনৈসর্গিক, বীভৎস দৃশ্য!

ধীর, কিন্তু অমোঘ গতিতে শেয়ালটা আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। কোনোদিকে কোনো শব্দ নেই, গাছের পাতায় বাতাসের সামান্যতম মর্মর নেই—সমস্ত জগৎটাই অন্ধকারের চাদরে ঢাকা পড়ে আড়াল হয়ে গিয়েছে চেতনার থেকে। থাকবার মধ্যে কেবল সামনে ওই সচল মৃতদেহটা।

হঠাৎ অনুভব করলাম আমার পাশে চণ্ডিকাপ্রসাদের নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠেছে। তাকিয়ে দেখলাম তার বার্ধক্যে স্তিমিত চোখে কি এক আগুনে জ্বলছে। মুখের ভঙ্গিতে ভয় নেই, আছে প্রবল ক্রোধ। ত্বরিতে মা কালীর কৌটো হাতে নিয়ে সামনে ঝুঁকে পড়ে কৌটোটা বাড়িয়ে ধরে বললেন—থাম!

সচল মৃতদেহ স্থাণু হয়ে গেল।

আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কৌটোসুদ্ধ হাত মাথার ওপর তুলে চিৎকার করে চণ্ডিকাপ্রসাদ বললেন—মা কালীর নামে বলছি, আমার বাড়ির সব বিপদ দূর হয়ে যাক যদি সদ্ধর্ম নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে থাকি, যদি সৎ কায়স্থের সন্তান হই, যদি জীবনে কোনো পুণ্যসঞ্চয় করে থাকি—তার সবটুকুর জোরে আদেশ করছি, যে অপদেবতারা আমার বাড়িতে ভর করেছে তারা এই মুহূর্তে দূর হয়ে যাক। আমার হাতে পবিত্র নির্মাল্যের এই কৌটো রয়েছে। দেখি তাদের কত শক্তি, সাধ্য থাকে আমার ক্ষতি করো—

মাথার ওপরে কৌটো তুলে ধরে তিনি বিভিন্ন দিকে ঘোরাতে লাগলেন।

শেয়ালের মৃতদেহটা আস্তে আস্তে আবার কাত হয়ে পড়ে গেল। এবারে সেটা সত্যিই মরেছে।

তার সঙ্গে সঙ্গে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল।

এতক্ষণ বন ছিল, নিম্পন্দ, নীরব। হঠাৎ কোথা থেকে ছুটে এল ঝড়ের মত বাতাস। সারা বাগান, ঝোপঝাড় মথিত করে কিছুক্ষণ সে বাতাস বইল। অভিরাম বলে উঠল—দেখুন ঠাকুরমশায় দেখুন।

তার নির্দেশিত দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেখানে গাছপালা একটু কম, পাতার ফাঁক দিয়ে রাত্রির আকাশ দেখা যায়। চাঁদ উঠতে আজ দেরি আছে, কিন্তু অস্পষ্ট তারার আলোয় অন্ধকার অনেকটা তরল। বাতাসের ঘূর্ণির সঙ্গে পাক খেয়ে একটা জমাট অন্ধকারের স্তম্ভ আকাশে অনেকখানি ঠেলে উঠেছে। অন্ধকারের উপাদানে তৈরি অমানুষী এক আকৃতি-পরিচিত কিছুর সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। সমস্ত পরিবেশ থেকে, চণ্ডিকাপ্রসাদের বাড়ির ওপর থেকে, আমবাগান থেকে বাতাসের সঙ্গে উঠে যাচ্ছে গুড়ো গুড়ো অন্ধকার। কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকারের কালো পিণ্ডটা অনেক ওপরে উঠে গিয়ে আবছা হয়ে মিলিয়ে গেল।

তারপরেই বনের বাইরে থেকে ভেসে এল একঝলক বাতাস। বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবার মত সহজ, স্বাভাবিক, মুক্ত বাতাস কিটকিট করে নিশাচর কীটপতঙ্গেরা ডাকতে শুরু করল। আমরা কেউ কথা না বললেও বুঝতে পারলাম অমঙ্গলের ছায়াটা একেবারে সরে গিয়েছে। কালীপ্রসাদকেও বয়ে নিয়ে যাবার প্রয়োজন হল না, এর কিছুক্ষণের মধ্যেই তার জ্ঞান ফিরে এল। বাগান থেকে ফেরবার মুখে শেয়ালটা এসে ওঁর সামনে দাঁড়িয়েছিল। ভদ্রলোক স্নায়ুর ওপর এত চাপ সহ্য করতে পারেননি।

ফেরবার সময় চণ্ডিকাপ্রসাদ বললেন—দেখলেন আমার মা কালীর কৌটোর গুণ? সব ব্যাটাকে তাড়িয়ে দিলাম—

বললাম—তা বটে।

তারানাথ থামল। কিশোরী বলল—কিন্তু এ তো মন্ত্রশক্তি বা দ্রব্যগুণের গল্প। এতে বিশ্বাসের শ্রেষ্ঠত্ব কি প্রমাণিত হয়?

তারানাথ বলল—হয়। পরের দিন নির্জনে বসে কালীপ্রসাদের সঙ্গে গল্প করছিলাম। কালীপ্রসাদ বললেন—বাবা বিশ্বাসের জোরে আমাদের আপদ দূর করে দিলেন।

বললাম—কেন, মা কালীর কৌটোর গুণও আছে বলতে হবে—

ম্লান হেসে কালীপ্রসাদ বললেন—দাঁড়ান, একটা জিনিস দেখাই আপনাকে।

একটু পরে হাতে করে মা কালীর কৌটোটা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন ভদ্রলোক এবং আমার বিস্মিত দৃষ্টির সামনে ঢাকনাটা খুলে ফেললেন।

বাধা দিয়ে বলে উঠলাম—ও কি করছেন? মন্ত্রপূত নির্মাল্য খুলতে নেই, ওতে গুণ নষ্ট হয়ে যায়।

কিছু না বলে কালীপ্রসাদ বিছানার ওপরে কৌটোটা উপুড় করে ধরলেন। ভিতরে যা ছিল চাদরের ওপর ছড়িয়ে পড়ল।

ভেতর থেকে বেরুল কতকগুলো গোল গোল করে পাকানো খবরের কাগজের গুলি। আর কিছু নেই।

অবাক হয়ে বললাম—এ কি! নির্মাল্য কই?

কালীপ্রসাদ বললেন—নেই।

–তার মানে?

কালীপ্রসাদ মাথা নিচু করে বললেন—মানে আসল কৌটো অনেক দিন আগে। হারিয়ে গিয়েছে। এটা নকল। ছেলের অসুখের সময় কোলকাতায় নিয়ে যাবার পথেই কোথাও পড়ে যায়। বাবা শুনলে অনর্থ করবেন এই ভয়ে শিশিবোতলওয়ালার কাছ থেকে দু’পয়সা দিয়ে এই কোটোটা কিনি। বাবা আজকাল চোখে কম দেখেন, তাকে ঠকানো সহজ। কাজেই বুঝতে পারছেন, যা হয়েছে তা বাবার বিশ্বাসের জোরেই হয়েছে—

—আর কেউ জানে এ কথা?

—শুধু আপনার বৌমা, আমার স্ত্রী। অন্য কেউ না। বাবার বয়েস হয়েছে, আর কদিন বা বাঁচবেন? খামোক কেন তাকে দুঃখ দিই?

তারানাথ থামল। ঘরের মধ্যে স্তব্ধতা। বাইরেও বৃষ্টি ধরে এসেছে। একটা নিঃশ্বাস ফেলে কিশোরী বলল—গল্পটা বেশ। গল্প বানানোয় আপনার একটা স্বাভাবিক দক্ষতা আছে—

সিগারেট ধরাতে গিয়ে তারানাথ জুলন্ত চোখে কিশোরীর দিকে তাকাল।

আমি ব্যাকুল হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কিশোরীর হাত ধরে টানলাম—ওঠো হে, আবার বৃষ্টি এলে বাড়ি ফেরা মুশকিল হয়ে পড়বে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *