বিবাহ-বহির্ভূত যৌন সংসর্গ
জগতের অধিকাংশ সমাজেই স্বামী বিবাহ দ্বারা স্ত্রীর সঙ্গে যৌন মিলনের একাধিপত্য পায়। কিন্তু এমন অনেক সমাজ আছে যেখানে সামাজিকভাবে এই অধিকার অপরকে সমর্পণ করা হয়। যৌন মিলনের জন্য নিজের স্ত্রীকে অপরের হাতে সমর্পণ করবার পিছনে যে যুক্তি আছে সেটা হচ্ছে এই যে, যেহেতু স্বামীই হচ্ছে স্ত্রীর একমাত্র অধিকারী সেইহেতু তার ক্ষমতা আছে সেই অধিকার সাময়িকভাবে অপরকে সমর্পণ করবার। অনেক সমাজে এই অধিকার বিশেষভাবে সমৰ্পিত হয় অতিথির কাছে। যৌন মিলনের অধিকার সমর্পণ করে আতিথেয়তা পালন করা প্রাচীনকালে বহু সমাজে প্রচলিত ছিল । বর্তমানকালেও অনেক সমাজে এ রীতি আছে। বিখ্যাত সমাজতত্ত্ববিদ ওয়েষ্টারমারক বলেন যে যৌন আতিথেয়তা সাধারণ আতিথেয়তারই এক সম্প্রসারিত ক্রিয়ামাত্র। আদিমসমাজে অবচেতন মনে অতিথি সম্পর্কে ভয়, সন্ত্রাস, শ্রদ্ধা ইত্যাদি নানারূপ অনুভূতির উপর এর ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত। মানুষ অপরিচিত আগন্তুককে স্থষ্টির প্রারম্ভ থেকেই ভয় করে এসেছে। সেজন্য এরূপ আগন্তুককে অতিথিরূপে যখন গ্রহণ করা হয় তখন তার , সন্তোষবিধানের জন্য অতিথিসেবক সবসময় প্রস্তুত থাকে সাময়িকভাবে তার কাছে নিজের স্ত্রী বা মেয়েকে পর্যন্ত সমর্পণ করতে।
যৌন আতিথেয়তা প্রাচীন ভারতেও প্রচলিত ছিল। মহাভারতেও এর উল্লেখ আছে। বিশেষ করে অনুশাসন পর্বে সুদর্শন ও ও ঘাবতীর কাহিনী এ সম্বন্ধে বিশেষ আলোকপাত করে। সুদর্শন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ছিলেন। তিনি গৃহস্থাশ্রম পালন করেই মৃত্যুকে জয় করবেন সঙ্কল্প করেছিলেন। স্ত্রী ওঘাবতীকে অতিথি সৎকারের কাজে নিয়োজিত করে তিনি তাকে আদেশ দেন যে, প্রয়োজন হলে ওঘাবতী যেন নির্বিচারে নিজেকেও অতিথির কাছে সমর্পণ করে। কেননা, অতিথি অপেক্ষ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি আর কেউ নেই। একদিন তার আদেশের সততা পরীক্ষা করবার জন্য তাঁর অনুপস্থিতকালে যমরাজ স্বয়ং ব্রাহ্মণের বেশে সেখানে উপস্থিত হয়ে ওঘাবতীর সঙ্গে সঙ্গম প্রার্থনা করলেন। ওঘাবতী প্রথমে কৌশল করে এটা এড়াবার চেষ্টা করেন কিন্তু ব্ৰাহ্মণবেশী ধর্মকে নাছোড়বান্দা দেখে অগত্যা তার সঙ্গে যৌনমিলনে প্রবৃত্ত হন। এই সময় সুদর্শন ঘরে ফিরে এসে স্ত্রীকে সামনে দেখতে না পেয়ে তাকে বারবার ডাকতে থাকেন। কিন্তু কোন উত্তর পেলেন না। কেননা ওঘাবতী তখন ব্রাহ্মণের সঙ্গে যৌনমিলনে নিযুক্ত থাকায় নিজেকে অশুচি জ্ঞান করে স্বামীর আহবানে সাড়া দেন না । এমন সময় অতিথি ব্রাহ্মণ ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে সুদর্শনকে বলেন যে ওঘাবতী তার কামনা পূর্ণ করেছে। ওঘাবতীর অতিথিপরায়ণতা দেখে সুদর্শন অত্যন্ত প্রীত হন। ধর্ম তখন আত্মপ্রকাশ করে বলেন, “সুদর্শন, তুমি তোমার সততার জন্য এখন থেকে মৃত্যুকে জয় করলে।”
মহাভারতের আদিপর্বে উদালক পুত্র শ্বেতকেতুর কাহিনী থেকেও আমরা এর আভাস পাই। একদিন শ্বেতকেতু যখন পিতামাতার কাছে বসেছিলেন সেইসময় এক ব্রাহ্মণ এসে তার মায়ের সঙ্গে যৌনমিলন কামনা করে তাকে কক্ষান্তরে নিয়ে যায়। শ্বেতকেতু এতে ক্রুদ্ধ হয় কিন্তু পিতা উদ্দালক বলেন, “স্ত্রীলোক-গাভীদের মত স্বাধীন। সহস্র পুরুষে আসক্ত হলেও তাদের অধৰ্ম হয় না—ইহাই সনাতন ধর্ম।“ মহাভারতে আরও উল্লিখিত আছে যে সন্তসুজাত অর্জুনকে বলেছিলেন যে বন্ধুত্বের ষড়গুণের মধ্যে অন্ততম হচ্ছে বন্ধুর নিকট নিজ পুত্র ও স্ত্রীকে সমর্পণ করা। কৃষ্ণও বন্ধুর কাছে পুত্র এবং স্ত্রীকে সমর্পণ করতে ইচ্ছা -শ্রকাশ করেছিলেন। কর্ণও বলেছিলে যে যদি কউ তাকে দেখিয়ে দেয় যে অর্জুন কোথায় আছে তাহলে তিনি তাকে তাঁর স্ত্রী ও পুত্রকে সমপণ করবেন। মহাভারতের পরবর্তীকালে অবশ্য এ প্রথা ভারতে বিলুপ্ত হয়েছিল।
স্ত্রী বা কন্যাকে অপরের হাতে সমপণ করা সম্পর্কে মধ্যপ্রদেশের সাথিয়া উপজাতির মধ্যে এক বিচিত্র প্রথা প্রচলিত আছে। এদের মধ্যে কোন চুক্তির শর্ত হিসাবে বা ঋণের জামিনস্বরূপ উত্তমর্ণের কাছে নিজের স্ত্রী, কন্যা বা অপর কোন আত্মীয়াকে বন্ধক রাখা হয়। ঋণ পরিশোধ বা চুক্তির শর্ত প্রতিপালন না হওয়া পর্যন্ত ওই স্ত্রী বা কন্যা পাওনাদারের গৃহেই থাকে।
বন্ধকী অস্থাবর সম্পত্তি ভোগদখল করবার যেমন উত্তমর্ণের অধিকার থাকে এক্ষেত্রে ওই স্ত্রী বা কন্যাকে ভোগ করবার সম্পূর্ণ অধিকারও পাওনাদারের থাকে। এই অবস্থায় পাওনাদারের গৃহে যদি ওই স্ত্রী বা কন্যা সন্তানবতী হয় তাহলে সে নিজ গৃহে পুনরায় ফিরে আসবার সময় ওই সন্তানকে পাওনাদারের গৃহে রেখে আসে। সাথিয়ারা এরূপভাবে স্ত্রী বা কন্যাকে বন্ধক রাখা মোটেই লজ্জাজনক বা নীতিবিগর্হিত ব্যাপার বলে মনে করে না।
ধর্মানুষ্ঠানের অঙ্গস্বরূপ পরস্ত্রীর সহিত যৌনমিলন তন্ত্রশাস্ত্রে অনুমোদিত আছে। তান্ত্ৰিকসাধনার মূল কথা হচ্ছে প্রকৃতি ও পুরুষের মিলন। এই প্রকৃতি ও পুরুষের মিলনকে তন্ত্রশাস্ত্রে গৃহ রূপ দেওয়া হয়েছে। তন্ত্রশাস্ত্রে পঞ্চ “ম”-কার সহকারে চক্র-পূজার ব্যবস্থা আছে। পঞ্চ “ম”-কার হচ্ছে মন্ত, মাংস, মৎস্য, মুদ্র ও মৈথুন। তন্ত্রপূজার এগুলি অত্যাবশ্বকীয় অঙ্গ। তন্ত্রে শক্তিসাধনা বা কুলপূজার উপর বিশেষ করে জোর দেওয়া হয়েছে। কোন স্ত্রীলোককে শক্তির প্রতীক ধরে নিয়ে তার সঙ্গে যৌনমিলনে রত থাকাই শক্তিসাধনার মূলতত্ত্ব। গুপ্তসংহিতায় বলা হয়েছে, সে ব্যক্তি পামর, যে ব্যক্তি শক্তিসাধনার সময় কোন স্ত্রীলোকের সঙ্গে মৈথুন-ক্রিয়ায় নিজেকে না নিযুক্ত রাখে ; নিরুক্ততন্ত্র এবং অন্যান্য অনেক তন্ত্রে বলা হয়েছে যে শক্তিসাধক কুলপূজা হতে কোনরূপ পুণ্যফল পায় না, যদি না সে কোন বিবাহিত নারীর সহিত যৌনমিলনে প্রবৃত্ত হয়। এ কথাও বলা হয়েছে যে কুলপূজার জন্য কোন নারী যদি সাময়িক ভাবে স্বামীকে পরিহার করে তবে তার কোন পাপ হয় না। আরও বলা হয়েছে যে কূলপূজার জন্য প্রশস্তা নারী হচ্ছে ষোড়শী, সুদর্শনা এবং বিপরীত-রমণে সিদ্ধা। তবে অনূঢ়া কিংবা গণিকাকেও কুলপূজার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে।
অনেক সময় ধর্মের রূপ দিয়ে কামাচারী ব্রাহ্মণ প্ররোহিতরা বিবাহিতা নারীকে প্রলুব্ধ করতো তার সতীত্ব বিসর্জন দিতে। এরূপ ভাবে প্রলুব্ধ হয়ে সতীত্ব বিসর্জন দেবার এক কাহিনী অষ্টাদশ শতাব্দীর পর্যটক আবে দুবোয়া তার গ্রন্থে বিরত করে গেছেন। তিনি বলেছেন যে দক্ষিণ ভারতে এমন কতকগুলি মন্দির আছে যেখানকার পুরোহিতরা প্রচার করে যে আরাধ্য দেবতার অত্যাশ্চর্য শক্তি আছে স্ত্রীলোকের বন্ধ্যতা দূর করবার। এরূপ মন্দিরের মধ্যে কর্ণাটদেশের তিরুপতির মন্দির বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। এখানকার দেবতা ভেনকাটেশ্বরের কাছে অসংখ্য স্ত্রীলোক আসে সন্তান কামনায় । পুরোহিতগণ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে তারা মন্দিরে রাত্রিযাপন করে। পুরোহিতরা তাদের বলে যে তাদের ভক্তি দ্বারা প্রীত হয়ে ভেনকাটেশ্বর রাত্রিকালে তাদের কাছে আসবে এবং তাদের গর্ভবতী করে দিয়ে যাবে। তারপর যা ঘটতো তা না বলাই ভাল। পাঠক তা সহজেই অনুমান করে নিতে পারেন। পরদিন প্রভাতে এই সকল জঘন্য চরিত্রের ভণ্ড তপস্বীরা কিছুই জানে না এরূপ ভান করে ওই সকল স্ত্রীলোকদের কাছে এসে করুণা লাভ সম্বন্ধে বিশদভাবে অনুসন্ধান করত এবং তারা দেবতার অনুগ্রহ লাভ করেছে বলে তাদের পুণ্যবতী আখ্যা দিয়ে তাদের কাছ থেকে দান গ্রহণ করত। দেবতার সঙ্গে তাদের যৌনমিলন ঘটেছে এই আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে এই সকল হতভাগিনী নারীরা নিজ নিজ গৃহে ফিরে যেত।
দক্ষিণ ভারতের অপর একস্থানেও আবে দুবোয়া যে প্রথা দেখেছিলেন তার বিবরণও তিনি দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, কোন কোন জনবিরল অঞ্চলে এমন অনেক মন্দির আছে যেখানে দেবতাদের প্রীতির জন্য অতি জঘন্য ধরণের লাম্পট্যের লীলা চলে। এসকল স্থানে বন্ধ্যা নারীর সবরকম লজ্জাসরম বিসর্জন দিয়ে নির্বিচারে ও নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর লোকেদের সঙ্গে যৌনমিলনে প্রবৃত্ত হয়। প্রতি বৎসর জানুয়ারি মাসে এই সকল স্থানে উচ্ছৃঙ্খলতার এক উৎসব হয় এবং ওই উৎসবের সময় সকল শ্রেণীর নরনারী (বিশেষ করে গ্রামের জঘন্য চরিত্র লোকেরা) ওই সব স্থানে সম্মিলিত হয়। বন্ধ্যা নারীরা এখানে দেবতার কাছে এসে মানত করে যে তারা যদি সন্তানবতী হতে পারে তাহলে দেবতার প্রীতির জন্য কোন বিশেষ সংখ্যক পুরুষের সঙ্গে সহবাস করে তবে বাড়ী ফিরে যাবে। এমন কি যেসব নারী বন্ধ্যা নয় তারাও দেবতার প্রতি তাদের ভক্তি প্রদর্শনের জন্য অতি নির্লজ্জভাবে অপরের সহিত যৌন-মিলনে প্রবৃত্ত হতো।
ধর্মের নামে আর এক রকমের গণিকাবৃত্তিও মন্দির সমূহে প্রচলিত ছিল। এ হচ্ছে দেবদাসী প্রথা । সেকালে দেবতার প্রীতির জন্য অনেকে নিজের মেয়েদের উৎসর্গ করতে দেবতার কাছে । এরা মন্দিরে থাকতো এবং এদের দেবদাসী বলা হতো। এদের উত্তমরূপে নাচ-গান শেখান হতো এবং তারা দেবতার সামনে নৃত্যগীত করতো । দেবদাসী যে হিন্দু-মন্দিরেই থাকতো তা নয়, বৌদ্ধমন্দিরেও থাকতো । কালক্রমে দেবদাসী প্রথা কদৰ্য গণিকাবৃত্তিতে পরিণত হয়েছিল। এখনও অনেক মন্দিরে দেবদাসী প্রথা জীবিত আছে।
দেবদাসী প্রথা কত প্রাচীন তা জানা নেই। তবে মধ্যযুগের বাংলাদেশের বড় বড় মন্দিরে যে অনেক দেবদাসী থাকতো তার প্রমাণ আমরা ভবদেব ভট্টের “ভুবনেশ্বরী প্রশস্তি” এবং বিজয় সেনের “দেওপাড়া প্রশস্তি”তে পাই। সন্ধ্যাকর নন্দীর “রামচরিত” ও ধোয়ীর “পবনদূত” কাব্যদ্বয়েও দেবদাসীর কথা উল্লিখিত হয়েছে। অনেক সময় দেবদাসীর রাজানুগ্রহ লাভ করে রাজার গৃহিণীও হতেন। “রাজতরঙ্গিনী” থেকে জানা যায় যে, অষ্টম শতাব্দীতে উত্তর বাংলার পুণ্ড্রবর্ধন নগরে অবস্থিত কার্তিকেয়ের মন্দিরে কমলা নামী এক অলৌকিক রূপগুণসম্পন্ন দেবদাসী ছিল। কাশ্মীররাজ জয়াপীড় বিনয়াদিত্য তার প্রতি আসক্ত হয়ে তাকে বিবাহ করেছিলেন। ওড়িষ্যার সোমবংশীয় নরপতি কর্ণরাজের রত্নগিরি তাম্রশাসন থেকেও আমরা জানতে পারি যে তার মহিষী কর্পূরশ্ৰী বিবাহের পূর্বে সলোনপুরের বিহারস্থিত বৌদ্ধমন্দিরে দেবদাসী ছিলেন। আরও জানা যায় যে কর্পূরশ্রীর মা-ও দেবদাসী ছিলেন।
বিবাহ-বহির্ভূত যৌন-মিলনের যে সকল দৃষ্টান্ত উপরে উল্লিখিত হলো সেগুলোর পিছনে সামাজিক বা ধর্মীয় অনুমোদন ছিল। এরূপ অনুমোদনের যেখানে অভাব ঘটতে সেখানে অবৈধ যৌনসংসর্গকে ব্যভিচার বলা হতো। হিন্দু ও আদিবাসী এই উভয় সমাজেই ব্যভিচার বরদাস্ত করে না। হিন্দুর স্মৃতিশাস্ত্রে ব্যভিচারের তারতম্য করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, সকল রকম ব্যভিচারের মধ্যে গুরুতল্লই ( গুরু-স্ত্রীর সহিত যৌনসংসর্গ ) হচ্ছে সর্বাপেক্ষা জঘন্য। এরজন্য কঠোর দণ্ডের ব্যবস্থা ছিল । মনু বলেছেন, গুরুতর অপরাধের শাস্তিস্বরূপ অপরাধীর চক্ষু উৎপাটন ও যৌনাঙ্গকর্তন করা হবে ও তাকে জলন্ত লৌহপট্টের উপব উপবেশন করানো হবে।
অন্যান্য রকম ব্যভিচার সম্পর্কে মনু ও যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন যে, প্রায়শ্চিত্ত করে ও অর্থদণ্ড দিয়ে তার স্খলন করা যায়। তবে কেহ যদি অবাঞ্ছিত নারীর সঙ্গে ব্যভিচার অপরাধে লিপ্ত হয় তা হলে তাকে কঠোর শাস্তিভোগ করতে হবে। এই সকল বিশেষ শ্রেণীর নারীর অন্যতম ছিল প্রতিপালিতা, বন্ধুপত্নী, সগোত্রা, পরিব্রাজিক ও কুমারী। নারদের মতে তপস্যারতা স্ত্রীলোকের সঙ্গে ব্যভিচার অজাচারের সামিল। সকলক্ষেত্রে গুরুতল্পের মত কঠোর দণ্ড দেওয়া হতো। কিন্তু উত্তরকালে দণ্ডের অনেক লঘুকরণ করা হয়েছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে যে এই সকল অপরাধের শাস্তিস্বরূপ কৌটিল্য মাত্র ২৪ পণ অর্থদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছেন।
আর একরকম ব্যভিচারের জন্যও স্মৃতিশাস্ত্রে কঠোর শাস্তির নির্দেশ আছে। সেটা হচ্ছে উচ্চবর্ণের স্ত্রীলোকের সঙ্গে হীনবর্ণের পুরুষের ব্যভিচার। এক্ষেত্রে স্ত্রী-পুরুষ উভয়কেই প্রকাশ্বস্থানে কুকুরদ্বারা খণ্ড-বিখণ্ডিত করাবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নিম্নবর্ণের স্ত্রীলোকের সঙ্গে উচ্চবর্ণের পুরুষেরও শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। তার জন্য অনেক ক্ষেত্রে কঠোর দণ্ডেরই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে সাধারণত তাকে রাষ্ট্র থেকে বহিস্কৃত করে দেওয়া হতো। অস্ত্যজ স্ত্রীলোকের সঙ্গে ব্যভিচারের জন্য শূলে চাপিয়ে বধ করাই সাধারণ দণ্ড ছিল। ক্ষত্রিয়, বৈশু ও শূদ্র নারী যদি ব্রাহ্মণের সঙ্গে ব্যভিচার করতে তা হলে তাকে দগ্ধ করে মারা হতো। ওই একই শাস্তি দেওয়া হতে। পুরুষকে, যদি সে ক্ষত্রিয়া বা বৈশু নারীর সঙ্গে ব্যভিচার করতে বা বৈশ্য পুরুষ যদি ক্ষত্রিয়া নারীর সঙ্গে অনুরূপ আচরণ করতো।
তবে স্মৃতিশাস্ত্রের ব্যবস্থা অনুযায়ী বিনাদণ্ডে কোন কোন বিশেষ শ্রেণীর নারীর সঙ্গে যৌনসঙ্গম করা যেতো। এদের মধ্যে ছিল গণিকা ও ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্ত বর্ণের স্বৈরিণী। এ সব ক্ষেত্রে একে ব্যভিচার বলা হতে না। তবে পরগ্রহ বা অপরের রক্ষিতা নারীর সঙ্গে যৌনসঙ্গম ব্যভিচার বলেই গণ্য হতো। আবার অপর পক্ষে নারদ বলেছেন যে স্বামী পরিত্যক্ত নিষ্কলঙ্ক স্ত্রীলোকের সঙ্গে যৌনমিলন ব্যভিচার বলে গণ্য হবে না। স্বামী যদি নপুংসক হন, কী ক্ষয়রোগাক্রান্ত হন, সেক্ষেত্রেও অপর পুরুষের সহিত যৌনসঙ্গম ব্যভিচার বলে গণ্য হবে না।
উত্তরকালে হিন্দুসমাজে নারীর সতীত্বের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। তার ফলে ভারতে দাম্পত্য সম্পর্ক যে কত পূত হয়েছিল, তা পাশ্চাত্য দেশের মেয়েদের কল্পনার বাইরে।
ভারতের আদিবাসীসমাজেও ব্যভিচার খুব গুরুত্বপূর্ণ অপরাধ। একই টটেম বা গোষ্ঠীভুক্ত স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে ব্যভিচার অজাচার বলে গণ্য হয় এবং তার জন্য খুব কঠোর দণ্ড দেওয়া হয়। যেমন ভানটু উপজাতির মধ্যে এরূপ অপরাধের জন্য মাথার চল ও গোফ কামিয়ে সেই চুল গ্রামের প্রকাশ্য স্থানে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এর উদ্দেশ্য অপরকে সতর্ক করে দেওয়া। তবে এ কথা বলা প্রয়োজন যে আদিবাসীসমাজে ব্যভিচার খুবই বিরল। কিন্তু ব্যভিচার যখন ঘটে তখন তার জন্য কঠোর দণ্ড দেওয়া হয়।
বর্তমানে ভারতীয় দণ্ডবিধি আইন অনুযায়ী ব্যভিচার সকল শ্রেণীর নর-নারীর পক্ষেই দণ্ডনীয় অপরাধ ।