০৭. বিবাহের আচার-অনুষ্ঠান
হিন্দুর দৃষ্টিতে বিবাহ অবশ্য করণীয়ধর্মীয় অনুষ্ঠান। বিশুদ্ধিকরণেব জন্য হিন্দুদের যে দশবিধ সংস্কার আছে, বিবাহ তার মধ্যে শেষ সংস্কার। অবশু করণীয় ধর্মীয় আচরণ বলে বিবাহ ব্যাপারে হিন্দুদের নানা আচার-অনুষ্ঠানের অনুবতী হতে হয়। এ সকল আচারঅনুষ্ঠানগুলিকে দুভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে—স্ত্রী-আচার ও পুরোহিত কর্তৃক সম্পাদিত ধর্মীয় আচার। স্ত্রী-আচার বাড়ীর মেয়েদের মধ্যে যারা সধবা তাদের দ্বারাই সম্পাদিত হয়। মেয়েলীসমাজে পুরোহিত কর্তৃক ধর্মীয়-আচারের চেয়ে স্ত্রী-আচারের উপর বেশী জোর
দেওয়া হয়। তাদের বিশ্বাস এগুলির কোন ত্রুটি-বিচু্যতি ঘটলে বরকনে উভয়েরই অমঙ্গল ঘটবে। এগুলির উপর যে ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়ার প্রভাব আছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। স্ত্রী-আচারগুলিব উদ্দেশ্য হচ্ছে বিবাহের পূর্বে যতরকম বাধাবিপত্তি ঘটতে পাবে সেগুলিকে প্রতিহত করা। আর পুরোহিত কর্তৃক সম্পাদিত অনুষ্ঠানগুলির উদ্দেশ্য হচ্ছে বিবাহের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ককে পবিত্রীকৃত করা । এসময় মৃত পুরুষদের আত্মার শাস্তিকামনা করা হয় ও দেবতাদের প্রসন্নতা প্রার্থনা করা হয়।
হিন্দুর জীবনে বিবাহ অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আগেই বলা হয়েছে যে, মানুষকে পাপমুক্ত করে বিশুদ্ধিকরণ করবার জন্য হিন্দুর যে দশবিধ সংস্কার আছে তার মধ্যে বিবাহ হচ্ছে শেষ বা চরম সংস্কার । বিবাহ দ্বারা স্ত্রীলোকের কুলসম্পর্কের চু্যতি ঘটে। গোত্রদ্বারাই হিন্দুদের মধ্যে কুলসম্পর্ক সুচিত হয়। বিবাহের পর স্ত্রীলোককে পিতৃকুলের গোত্র পরিহার করে স্বামীর কুলের গোত্র গ্রহণ করতে হয়। সেজন্য হিন্দুনারীর পক্ষে বিবাহ-জীবন চরম সন্ধিক্ষণ। এরূপ সন্ধিক্ষণে যাতে কোন বাধা-বিপত্তি না ঘটে তার উদ্দেশ্যেই আচার অনুষ্ঠান সমূহ পালিত হয়।
আচার-অনুষ্ঠানগুলির একটা সামাজিক উদ্দেশ্যও আছে। বরকনের মধ্যে যে বিবাহ ঘটছে এবং সে বিবাহ যে অবৈধ নয় সাধারণের মধ্যে তার প্রচার ও প্রকাশ করাও এই সকল আচার-অনুষ্ঠানের উদেশ্ব। সেজন্য জগতের সকল জাতির মধ্যেই বিবাহ উপলক্ষে আচার-অনুষ্ঠান পালনের নিয়ম আছে, যদিও এসকল আচার-অনুষ্ঠান বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিভিন্ন রকমের। আবার একই দেশের মধ্যে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানগত রীতি বা প্রথা দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের দেশের কথাই ধরুন । বিবাহের আচারঅনুষ্ঠানগুলির মধ্যে অপরিহার্য ও বাধ্যতামূলক অংশ হিসাবে, পাঞ্জাবে “ফেরে” বা যজ্ঞকুণ্ডি প্রদক্ষিণ করা প্রথা প্রচলিত আছে। উত্তর প্রদেশের বহু স্থানে কিন্তু যজ্ঞকুণ্ডি প্রদক্ষিণ করা হয় না। যেসব স্থানে বিবাহের জন্য মণ্ডপ নির্মিত হয় বা দণ্ড স্থাপিত হয় তাই প্রদক্ষিণ করা হয়। বাংলা, বিহার ও ওড়িষ্যায় কন্যার সিথিতে “সিন্দুর দান”-ই অপরিহার্য ও বাধ্যতামূলক প্রথা। আবার অনেক জায়গায় নিম্নশ্রেণীর মধ্যে র্কাটাদ্বারা আঙ্গুল থেকে রক্ত বের করে সেই রক্ত উভয়ে উভয়কে মাখিয়ে দেয়। মহারাষ্ট্র দেশে উচ্চশ্রেণীর হিন্দুরা “প্রদক্ষিণ” প্রথা অনুসরণ করে। কিন্তু নিম্নশ্রেণীর লোকেরা বর-কনের উপর মাত্র চাউল, জল বা দুধ ছিটিয়ে দেয়। দক্ষিণ ভারতের প্রায় সর্বত্র “তালিবন্ধন” প্রথাই বিবাহের অপরিহার্য অঙ্গ ।
উপরে যে সমস্ত প্রথার কথা বলা হলো সেগুলো হচ্ছে মাত্র অপরিহার্য অংশ। এছাড়াও অনেক আড়ম্বরপূর্ণ ও বিশদ ধরনের আচার-অনুষ্ঠান আছে। এ সকল আচার-অনুষ্ঠান পালনের জন্য একাধিক দিন লাগে এবং এগুলি পুরোহিত ও বাড়ীর মেয়েদের দ্বারাই সম্পাদিত হয়। সাধারণত পুরোহিত যে অনুষ্ঠানগুলি সম্পাদন করেন সেগুলি ধৰ্মীয় আচরণ আর মেয়েরা যেগুলি করে সেগুলি লোকাচার সম্পর্কিত। এই উভয়বর্গীয় আচার-অনুষ্ঠানসমূহের উদ্দেশ্য হচ্ছে নবদম্পতির সুখ, শাস্তি, আয়ু ও মঙ্গল কামনা করা।
পশ্চিম বাংলার বিবাহের আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে সকলেই পরিচিত। সুতরাং এখানে তার বিশদ বিবরণ দেওয়া নিম্প্রয়োজন । মাত্র এটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, এ সকল আচার-অনুষ্ঠান তিনদিন ব্যাপী স্থায়ী হয় এবং এতে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে বর, কনে, নাপিত, পুরোহিত, বরের ও কনের বাবা ও মা, পাচ বা সাতজন সধবা স্ত্রীলোক ও কনের জ্যেষ্ঠ ভগ্নীপতি। স্ত্রী-আচারের মধ্যে প্রধান হচ্ছে গায়ে হলুদ ও কলাতলা ও ছাদনাতলার আচারসমূহ, বৌভাত, ফুলশয্যা এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলির অন্তভুক্ত হচ্ছে পিতৃপুরুষদের প্রীতির জন্য আভু্যদয়িক ও কন্যাসম্প্রদান। ছাদনাতলার অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব করে নাপিত আর সম্প্রদানের অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব করে পুরোহিত । যেখানে কুশণ্ডিকা নেই সেখানে সম্প্রদানের পরই কন্যার সিথিতে সিন্দুরদান করা হয়। আর যেখানে কুশণ্ডিক আছে সেখানে পরের দিন কুশণ্ডিকার পর সিন্দুরদান করা হয়। বর পরের দিন কনেকে নিয়ে নিজের বাড়ী চলে যায়। ওই দিনের রাত্রিকে কালরাত্রি বলা হয় এবং ওইদিন বর-কনে পরস্পরের সান্নিধ্যে আসে না । তৃতীয় দিনে কস্তাকে পাককরা অন্নস্পর্শ করতে দেওয়া হয় এবং ওই অন্ন সে আত্মীয়স্বজনের পাতে দেয়। একে বৌভাত বলা হয়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে পাকাপাকিভাবে কনেকে পরিবারভুক্ত করা, যাতে তার স্পৃষ্ট অন্ন সকলে বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করে। সকলের শেষ অনুষ্ঠান, ফুলশয্যা । সেটা ওইদিনই রাত্রে হয়।
এখানে একটা কথা বলা দরকার। ছাদনাতলায় স্ত্রী-আচারের সময় কনের জ্যেষ্ঠ ভগ্নীপতিকে কিছু কাপড়-চোপড় উপহার দেওয়া হয় । একে জামাইবৱণ বলা হয়। ১৯২৯ সালে বর্তমান লেখক “ম্যান ইন ইণ্ডিয়া” পত্রিকায় এক প্রবন্ধে দেখিয়েছিলেন যে বাংলাদেশে এক সময় শালীবরণ প্রথা ছিল এবং জামাইবরণ প্রথা তারই স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে। শালীবরণ বলতে বুঝায় একই সঙ্গে একাধিক ভগ্নীকে বিবাহ করা। এক সঙ্গে একাধিক ভগ্নীকে বিবাহ করার রীতি প্রাচীনকালে প্রচলিত ছিল। বিচিত্রবীর্য বিবাহ করেছিলেন অম্বিকা ও অম্বালিকাকে। নাভিও দুই যমজ ভগ্নীকে বিবাহ করেছিলেন। আমাদের বাংলাদেশের ময়নামতীর গানে আমরা দেখি যে হরিশ্চন্দ্র গোপীচন্দ্রের সঙ্গে “অদ্ভুনার বিয়া দিয়া পছনা করিল দান” । এক সঙ্গে একাধিক ভগ্নীকে বিবাহ করার প্রথা না থাকলে এরূপভাবে অপর মেয়েকে দান করার কথা উঠতেই পারে না।
আর একটি কথা এখানে বলা দরকার। পূর্ববঙ্গে কতকগুলি আচারঅনুষ্ঠান আছে, যা পশ্চিমবঙ্গে নেই। এগুলি মঙ্গলাচরণ, অধিবাস ( পশ্চিমবঙ্গের গাত্রহরিদ্রার পরিবর্ত ), নিদ্রাকলস, ও দধিমঙ্গল । এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, বিবাহের আচার-অনুষ্ঠান একই প্রদেশের ভিন্ন ভিন্ন অংশে ভিন্ন ভিন্ন রকমের হতে পারে। ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের তো কথাই নেই। তা তামিলনাড়র আচার-অনুষ্ঠান থেকেই পরিষ্কার বোঝা যাবে।
তামিলনাড়র ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিবাহ অনুষ্ঠান পাচদিন ব্যাপী স্থায়ী হয়। তবে এর মধ্যে দুদিন হচ্ছে প্রধান । এ দুদিন হচ্ছে বিবাহের দিন ও তার পূর্বদিন। বিয়ের আগের দিন বরের দল (এর মধ্যে থাকে বরের পিতামাতা ও ভাই-বোনের ) আসে কনের গ্রামে। সেখানে স্বতন্ত্র বাড়ীতে তাদের থাকার, আদর আপ্যায়ন ও আহারাদির ব্যবস্থা করা হয়। প্রথমে তারা নিকটস্থ কোন মন্দিরে গিয়ে দেবতার অর্চনা করে। তারপর বরকে একটি সজ্জিত যানে করে বিবাহমণ্ডপে নিয়ে আসা হয়। একে বলা হয় “যানবাসন” বা “মপিপলই আঝাইপপু” বা বরানুগমন। বিবাহ মণ্ডপে সমবেত লোকের সামনে ঘোষণা করা হয় যে পরদিন ওই বরের সঙ্গে অমুকের মেয়ের বিয়ে হবে। একে বলা হয় “নিচয় থারথম” এবং এই অনুষ্ঠানের সময় বর-কনেকে এক সঙ্গে বসান হয়। এরপর ভোজ উৎসব হয়।
বাংলাদেশে বিবাহ হয় রাত্রে আর তামিলনাড়তে বিবাহ হয় দিনের বেলায় মধ্যান্ত্রের পূর্বে। বিবাহের দিন প্রাতের প্রথম অনুষ্ঠান হচ্ছে “ব্রতম”। এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য হচ্ছে নবদম্পতির সুখশান্তি ও দীর্ঘায়ু কামনা করা এবং সমস্ত বাধাবিপত্তি ও অমঙ্গল প্রতিহত করা । এই সময় কতগুলি কপটভাবের ভান করা হয়। বর কয়েকজন ব্রাহ্মণকে পাঠিয়ে দেয়, তার জন্য একটি যোগ্য পাত্রীর অন্বেষণে আর নিজে একটি পুটুলীর মধ্যে খাদ্যদ্রব্য, কাপড়-চোপড়, একটি ছাতা ও লাঠি নিয়ে “কাশীযাত্ৰা” করে। এই কপটভাবের দ্বারা সে দেখাতে চায় যে উপযুক্ত কনে না পাওয়ার দরুন সে দেশত্যাগী হয়ে কাশী যাচ্ছে। এই সময় পথে মেয়ের বাপ তার গতিরোধ করে তাকে বলে যে তার একটি উপযুক্ত মেয়ে আছে, মেয়েটিকে তার সঙ্গে বিয়ে দেবে।
তারপর বর-কনেকে একটি ঝোলায় বসান হয় এবং মেয়ের স্ত্রী-আচার ঘটিত অনুষ্ঠানসমূহ সম্পাদন করে।
এর পর মূল অনুষ্ঠানসমূহ আরম্ভ হয়। দক্ষিণ ভারতের সর্বত্রই বিবাহ অনুষ্ঠানের মূল অংশ হচ্ছে “তালিবন্ধন” । তালির অপর নাম হচ্ছে “থিরুমঙ্গলম”। বিবাহের শুভ মুহুর্তে বর কর্তৃক কনের গলায় থিরুমঙ্গলম বেঁধে দেওয়া হয়। এটা আমাদের বাংলাদেশের “সিন্দুর দানের” পরিবর্ত মাত্র। থিরুমঙ্গলম জিনিসটা কি তা এখানে একটু বিশদভাবে বলা দরকার। থিরুমঙ্গলম হচ্ছে সোনার তৈরী লকেটের মত একটা জিনিস যার উপর শিবলিঙ্গ বা কোন ফুল খোদিত থাকে। বিশেষ আনুষ্ঠানিক আড়ম্বরের সঙ্গে এই জিনিসটা স্বর্ণকারকে তৈরী করতে দেওয়া হয়। একখানা আলপনা দেওয়া পিড়ির উপর স্বর্ণকারকে পূর্বদিকে মুখ করিয়ে বসান হয় এবং তাকে থিরুমঙ্গলম তৈরী করবার জন্য সোনা ও একটি থালায় করে পান, স্বপারী, আতপ চাউল ও কিছু দক্ষিণ সমেত একটি “সিধে” দেওয়া হয়।
দক্ষিণ ভারতে সধবা স্ত্রীলোককে “সুমঙ্গলী” বলা হয়। আমাদের বাংলাদেশে সিথির সিন্দুর ও হাতের “নোয়া” যেমন সধবা স্ত্রীলোকের চিত্ন, দক্ষিণ ভারতে তেমনি থিরুমঙ্গলম “সুমঙ্গলী” স্ত্রীলোকের চিহ্ল।
দক্ষিণ ভারতে বিবাহের শুভলগ্নের সময় বর ও কনেকে পিড়ির উপর বসান হয়। তারপর পুরোহিত মন্ত্রপাঠ করে অগ্নিতে হোম দেয়। এই সময় বর একখানা মূল্যবান শাড়ী সমেত থিরুমঙ্গলমটি কনের হাতে দেয়। বরকেও ওই সময় একখানা মূল্যবান বস্ত্র দেওয়া হয়। ওই বস্ত্রকে “অঙ্গবস্ত্র” বলা হয়। বর-কনে এই সময় ওই বস্ত্র ও শাড়ী পরে। থিকমঙ্গলমটিকে হলুদসিক্ত স্থতোয় বেধে দেবতাদের কাছে উৎসর্গের জন্য দেওয়া হয়। উৎসর্গীকৃত হবার পর থিরুমঙ্গলমটিকে একটি থালার উপর রেখে সমবেত লোকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের আশীৰ্বাদ গ্রহণের জন্য। তারপর একটা “জোয়াল” পূজা করা হয় ও সেটা বর-কনের কাধের উপর স্থাপন কবা হয়। এর রূপকার্থ হচ্ছে, বর-কনে উভয়ে যেন জোয়াল-গ্রথিত বলদের হ্যায় যুক্তভাবে জীবনের সুখ-দুঃখের সমান অংশীদার হয়।
তারপর কনেকে তার বাপের কোলে বসানো হয় এবং মন্ত্র উচ্চারণ ও ঢাকঢোলের বাজনার মধ্য দিয়ে বর-কনের গলায় থিরুমঙ্গলমটা বেঁধে দেওয়া হয়। বর মাত্র একটা গেরো দেয়, বাকী গেরো দেয় বরের বোনের। এর পরই “পাণিগ্রহণ” ও সপ্তপদীগমন অনুষ্ঠিত হয়। তারপর বর-কনেকে হোমাগ্নি প্রদক্ষিণ করান হয় এবং কনের একটি পা পাথরের উপর রাখতে বলা হয়, যাতে স্বামীর প্রতি তার ভক্তি ও অনুরাগ পাথরের মত দৃঢ় হয়।
রাত্রে “শেষহোমম” সম্পাদন করে বর-কনেকে আকাশে ধ্রুব ও অরুন্ধতী নক্ষত্র দুটির প্রতি তাকাতে বলা হয়। তারপর “আশীৰ্বাদ” সম্পাদন করে বিবাহ অনুষ্ঠান শেষ করা হয়। বর পরের দিন কনেকে নিয়ে তার নিজের বাড়ী চলে যায়। একে বলা হয় “গৃহপ্রবেশম”। বরের বাড়ী আর কোন অনুষ্ঠান হয় না।
মহারাষ্ট্র এবং গুজরাটে বিবাহ একদিনেই শেষ হয়ে যায়। হরিয়ানায় কিন্তু দুদিন লাগে। মহারাষ্ট্রে মেয়ে পছন্দ হবার পর সকলকে সাক্ষী রেখে যৌতুকের জন্য ইয়াদী’ নামে এক চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। নগদ টাকা, অলঙ্কার প্রভৃতি থেকে আরম্ভ করে যা কিছু যৌতুকস্বরূপ দেওয়া হবে তা সব এই চুক্তিপত্রে লেখা থাকে। ইয়াদী-পত্র স্বাক্ষরিত হবার পর মেয়ের বাবা পাত্র সমেত পাত্র পক্ষের সকলকে তার গৃহে নিমন্ত্রণ করেন। পুরোহিত মন্ত্রপাঠ করেন ও তার সমক্ষে মেয়ের বাবা ছেলেকে ও ছেলের বাবা মেয়েকে “কুকুমতিলক” পরিয়ে দেন। এরপর ছেলের বাবা একটা জরি দিয়ে তৈরী ঠোঙায় করে মেয়ের হাতে কিছু মিষ্টি দেয়। এই অনুষ্ঠানকে “সাখবপুড়া” বলা হয়। ইহাই বিবাহের পাকা দেখা। বিয়ের আগের দিন সকালে মেয়ের বাড়ীতে হয় “বাঙ নিশ্চয়” অনুষ্ঠান আর সন্ধ্যাবেলা ছেলের বাড়ীতে হয় “সমস্ত পূজন” অনুষ্ঠান। বিয়ের দিন সকালে বর-কনে উভয়ের বাড়ীতেই অনুষ্ঠিত হয় “হলদী” বা গায়ে হলুদ। তারপর মেয়েরা দেওয়ালে চন্দ্র-সূর্য ও নানারকম মাঙ্গলিক চিহ্নের নকশা আঁকেন ও তার সামনে একটা উচু পিড়িতে একটি লক্ষ্মীমূর্তি স্থাপন করেন। একে বলা হয় “দেবক”। মেয়েকে এই লক্ষ্মীমূর্তির সামনে বসিয়ে রাখা হয়।
বর এলে মেয়ের বাবা ও মা জল ও দুধ দিয়ে বরের পা ধুইয়ে দেয়। তারপর যেখানে বিয়ে হবে সেখানে বরকে নিয়ে যাওয়া হয় । সেখানে সামনা-সামনি দুখানা পিড়ি থাকে। বরকে একটা পিড়ির ওপর দাড় করিয়ে দেওয়া হয়। দুজন মহিলা একখানা কাপড়ের ফুকোণ ধরে বরের সামনেট আড়াল করে দেয়। একে “অন্তরপট” বলা হয়। তারপর কনের মামা কনেকে নিয়ে এসে তাকে অপর পিড়িতে দাড় করান। এরপর আটবার “মঙ্গলাষ্টক” মন্ত্র পাঠ করা হয়। “মঙ্গলাষ্টক” শেষ হলে বর-কনের মধ্যবর্তী কাপড়ট সরিয়ে দেওয়া হয়। তখন কনে বরের গলায় মালা পরিয়ে দেয় আর বর সোনার পুতি দিয়ে তৈরী “মঙ্গলসূত্রম” কণ্ঠী কনের গলায় পরিয়ে দেয়। তারপর বর-কনে পাশাপাশি বসে ও মেয়ের বাবা কন্যাদান করে। মহারাষ্ট্রের কন্যাদান অনুষ্ঠানটা একটু বিচিত্র। বরের হাতের উপর কনের হাত রেখে কনের বাবা মেয়ের হাতে একটু জল ঢেলে দেন। মেয়ের আঙুলের ফাক দিয়ে জল বরের হাতে পড়লেই ‘কন্যাদান অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয়। এরপর লাজহোম, অগ্নি প্রদক্ষিণ, ঘৃতাহুতি ও সপ্তপদীগমন অনুষ্ঠিত হয়। তারপর আসে নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের খাওয়ান-দাওয়ানর ব্যাপার। এরপরই বর-কনে বিদায় নেয়।
বরের বাড়ীর সদর দরজায় এক কুনকে চাল রাখা হয়। কনে এসে প্রবেশ করবার সময় পা দিয়ে সেই চালের কুনকে ঘরের ভিতর ছুড়ে ফেলে দেয়। বর এই সময় কনের নূতন নামকরণ করে। মহারাষ্ট্র দেশে মেয়েদের বিয়ের পর বাপের বাড়ীর দেওয়া নাম পরিহার করতে হয়। বিয়ের পর স্বামী যে নূতন নাম দেন সেই নামেই সে পরিচিত হয়। সেই রাত্রেই বর-কন্যার ফুলশয্যা হয়।
গুজরাটে বরপক্ষ যখন প্রথম মেয়ে দেখতে আসে তখন সেই সঙ্গে ছেলে নিজেও আসে। বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষের মধ্যে কথাবার্তা শেষ হলে এবং মেয়ে পছন্দ হলে তখন সকলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। মাত্র ছেলে ও মেয়ে সেই ঘরে থাকে ও তারা নিজেদের মধ্যে ইচ্ছামত আলাপ করে। তারপর বরপক্ষকে নানারকম মিষ্টান্ন খাওয়ান হয়। একে “মিঠাজিভ” বলা হয়।
তারপর একদিন যে অনুষ্ঠান হয় তার নাম “সওয়া রূপিয়া লিয়া।” এই অনুষ্ঠানে বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষের সকলেই শ্ৰীনাথজী ঠাকুরের নামে সওয়া রূপিয়া নিবেদন করে। পরে ওই টাকা শ্ৰীনাথজীর মন্দিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এরপর হয় “চুনরি প্রসঙ্গ”। এই উপলক্ষে ছেলের মা একখানা সবুজ রঙের জরির নকশাদার শাড়ী, অলঙ্কার, মিষ্টান্ন,নারিকেল প্রভৃতি নিয়ে মেয়ের বাড়ী আসে ও তাকে কুস্কুমের তিলক পরিয়ে সেগুলি তার হাতে দেয়। এছাড়া মেয়ের নাকে একটা নাকছবি ও পায়ে রূপার আংটি পরিয়ে দেয়। এরপর “নারিকেল বদলী” অনুষ্ঠানের জন্য মেয়েপক্ষের মহিলারা ছেলের বাড়ী যায় ও বরকে কুস্কুমের তিলক পরিয়ে তাকে আশীৰ্বাদ করে। তারপর মেয়ের ভাবী ননদ বা জ এসে মেয়েকে ছেলের বাড়ী নিয়ে যায়। সেখানে মেয়ের পায়ে কুঙ্কুম লাগিয়ে একখানা শাদা কাপড়ের উপর দু’পায়ের ছাপ নেওয়া হয়। ছেলের মা তাকে একখানা নূতন শাড়ী দেন ও আদর করে তাকে সরবৎ খাওয়ান ।
গুজরাটে বিয়ে সাধারণত দুপুরবেলা হয়। সবুজ বা লাল রঙের শাড়ী পড়ে বিয়ে হয়।
বর বিয়ে করতে এলে মহিলারা বরের প্রশংসায় গান করে। বর এলে কনে বরের গলায় মালা পরিয়ে দেয়। বরও কনের গলায় মালা পরায়। তারপর কনের মা বরকে আরতি করেন ও জলপূর্ণ কলসী নিয়ে বরণ করেন। তারপর পুরোহিত যজ্ঞাগ্নি জেলে মন্ত্রপাঠ করেন। মন্ত্রপাঠ শেষ হলে মেয়ের বোন বা ‘ভাবী মেয়েকে নিয়ে বিবাহমণ্ডপে আসে। একটুকরা হলুদ-কাপড় মেয়ের শাড়ীর আঁচলের সঙ্গে বেঁধে বরের কাধের উপর স্থাপন করা হয়। তারপর বর-কনে চারবার হোমাগ্নি প্রদক্ষিণ করে। একে “ফেরা” বলা হয়। তারপর বরকনেকে দেবতার মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর খাওয়ান দাওয়ান হয়। খাওয়ান-দাওয়ান শেষ হলে সেই রাত্রেই বর-কনে বিদায় নেয়। বর-কনে বাড়ী পৌছলে বরের মা তাদের আরতি করে ঘরে তোলেন। তারপর বর-কনেকে দিয়ে গণেশ পূজা করান হয়। সেই রাত্রেই ফুলশয্যা হয় ।
হরিয়ানাতেও বিবাহে হিন্দুর চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী মাল্যদান, হবন বা হোম, কাঠবন্ধন, কন্যাদান, অগ্নিপ্রদক্ষিণ, লাজবর্ষণ ইত্যাদি অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। তবে অগ্নিপ্রদক্ষিণ শেষ হলে বরের বোনের কনেকে মালা পরান ও মিষ্টিমুখ করান। এই অনুষ্ঠানকে “চৌকা” বলা হয়। এর জন্য মেয়ের মা বরের বোনেদের শাড়ী দেন। পশ্চিমবঙ্গের অনেকগুলি প্রথা হরিয়ানায় দৃষ্ট হয়। যেমন, বিবাহমণ্ডপে কলাগাছ বসান, রাত্রিকালে বিবাহ, বিয়ের পরের দিন বর-কনের বিদায় ইত্যাদি। কনে শ্বশুরবাড়ী পৌছলে শাশুড়ী সদর দরজায় এসে বর-কনেকে দুধভরা ঘটি দিয়ে আশীৰ্বাদ করেন। পশ্চিম বঙ্গের মত কনের কোলে একটি ছোট ছেলেকেও বসিয়ে দেওয়া হয়। সেই রাত্রেই “সোহাগ-রাত” বা ফুলশয্যা হয়।
আদিবাসীসমাজেও বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে বিবাহবিষয়ক আচার-অনুষ্ঠানের বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। তবে হিন্দুদের তুলনায় আদিবাসীসমাজের আচার-অনুষ্ঠান অনেক পরিমাণে সরল, সংক্ষিপ্ত ও আড়ম্বরহীন । বিবাহ সাধারণত একদিনেই সমাপ্ত হয়। তবে কোন উপজাতিসমাজে এর জন্য একাধিক দিনও লাগে। যেমন, মধ্যপ্রদেশের বারগুণ্ডাদের মধ্যে বিবাহ তিনদিনে সমাপ্ত হয় । আদিবাসীসমাজে বিবাহ সাধারণত কোন জ্যেষ্ঠ আত্মীয় বা আত্মীয়া বা পঞ্চায়েত বা বাইগা ( ওঝা ) দ্বারা সম্পাদিত হয়। তবে যে সকল উপজাতি হিন্দুভাবাপন্ন হয়েছে ( যেমন মধ্যপ্রদেশের পাতলিয়া ভালজাতি বা যশপুরের গোগুজাতি) তারা ব্রাহ্মণ পুরোহিত দ্বারাই বিবাহ সম্পাদন করায়। আবার উপজাতিদের মধ্যে কোন কোন জায়গায় বিবাহ অনুষ্ঠানকে ধর্মীয় স্বরূপ দেবার জন্য দেবদেবীরও পূজা করা হয়। আবার কোন কোন জায়গায় অনুষ্ঠানের কোন বালাই নেই ; মাত্র মালাবদল, কী তালিবন্ধন, কী কন্যার সিঁখিতে সিন্দুর ঘর্ষণ, কী কন্যাকে লুণ্ঠন করবার নাটকীয় অনুকরণ করেই বিবাহ করা হয়। এ সম্পর্কে বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে আচারঅনুষ্ঠানের যে বৈচিত্র্য আছে তা নীচের দৃষ্টান্তগুলি থেকে পরিষ্কার বুঝতে পারা যাবে।
ভীলদের মধ্যে বর তার পিতা ও অন্যান্য আত্মীয়-আত্মীয়াদেব নিয়ে কনের বাড়ী যায়। সেখানে বরের বাবা কনের পিতামাতাকে কিছু অর্থদান করে। তারপর বর-কনেকে এক সঙ্গে বসান হয় এবং দলের সমস্ত মেয়ে-পুরুষ তাদের ঘিরে নাচগান করতে থাকে। এরপর ভোজ ও মদ্যপান চলে এবং তার সঙ্গেই বিবাহ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে। গোগুদের মধ্যে বরযাত্রী ও কন্যাযাত্রী উভয়দলই নিজ নিজ বাড়ী থেকে রওনা হয় এবং মধ্যপথে পরস্পরের সহিত মিলিত হয়। এখানে উভয় দলের মধ্যে দানসামগ্রীর আদান-প্রদান ঘটে। তারপর বর-কনে জল ভর্তি একটি মঙ্গলঘট সাতবার প্রদক্ষিণ করে। এই অনুষ্ঠানের দ্বারাই বিবাহ নিম্পন্ন হয়। এক্ষেত্রেও দলবেঁধে নাচগান ও মদ্যপান করে উৎসব শেষ করা হয়। মারিয়াদের মধ্যে বিবাহ অনুষ্ঠিত হয় বরের বাড়ীতে। মেয়ের বাপ-মা কনেকে সেখানে নিয়ে আসে। কোন দেবদেবীর পূজা হয় না কিন্তু একটি ছাগ বলি দেওয়া হয়। তারপর দলের সকলে মদ্যপান করে। উদয়পুরের পাণ্ডাদের মধ্যে বিবাহ উপলক্ষে একটি দণ্ড স্থাপন করা হয় এবং সাতবার সেই দণ্ড প্রদক্ষিণ করে বিবাহকর্ম শেষ করা হয়। উদয়পুরের সাওতালদের মধ্যে বিবাহের অনুষ্ঠান খুবই সরল এবং দুইজন কুমারী মেয়ে এই অনুষ্ঠানের নেতৃত্ব করে। ওরাওদের মধ্যে যারা ক্রীশ্চান তার প্রথমে গির্জায় গিয়ে বিয়ে করে কিন্তু তারপর আবার উপজাতিসমাজের আচার-অনুষ্ঠানগুলি পালন করে। নীলগিরি পাহাড়ের পালিয়ানদের মধ্যে বরের বোন কনের গলায় তালি বেঁধে দেয় এবং সেই সময় নিকটস্থ কোন বাড়ী থেকে কোন লোক চেচিয়ে ঘোষণা করে যে অমুকের বাড়ীতে বিয়ে হচ্ছে। তখন সংলগ্ন কোন বাড়ী থেকে কোন প্রবীণ ব্যক্তি তার উত্তর দিয়ে বলে “হ্যাঁ, এ বিয়েতে আমাদের সকলের সম্মতি আছে। মাত্রার পালিয়ানদের মধ্যে অনুষ্ঠান আরও সরল। এদের মধ্যে রীতি হচ্ছে, বর-কনে পরস্পরের গলায় কালরং-এর পুতির একটা মালা বেঁধে দেয় এবং কনেকে বর একখানা কাপড় দেয়। ওড়িষ্যার পরোজাদের মধ্যে লুণ্ঠনের নাটকীয় অনুকরণ করা হয়। তাদের মধ্যে বিবাহের নির্দিষ্টদিনে বর বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে কনের বাড়ীর কাছে গিয়ে লুকিয়ে থাকে এবং কনে যখন সেই পথে এক অসে তখন সে তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে ও তাকে লুণ্ঠন করে নিজের বাড়ী নিয়ে যায়। তারপর কনের বাবা বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে মেয়েকে উদ্ধার করতে আসে। এরপর এক কপট যুদ্ধ হয় এবং যুদ্ধ করে যখন সকলে ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন তারা বরের বাড়ী গিয়ে মদ্যপান ও ভোজে যোগ দেয়। ত্রিবাঙ্কুরের মুড় বানদের মধ্যেও এরূপ লুণ্ঠন করে বিয়ে করার রীতি আছে। মুড় বানদের মধ্যে বিয়ের একট। অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ হচ্ছে বর, কনেকে একটা চিরুনী দেয় এবং কনে সেই চিরুনীট চিরদিন মাথার পিছন দিকে খোপায় রাখে। মান্নানদের মধ্যে রীতি হচ্ছে বরের বোন কর্তৃক কনের গলায় তালি বেঁধে দেওয়া। দক্ষিণ ভারতের অধিকাংশ উপজাতিদের মধ্যে বিবাহ তালিবন্ধন দ্বারাই অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠান সাধারণত কনের বাড়ীতেই হয়। কিন্তু কোথাও কোথাও বরের বাড়ীতে হবার প্রথাও আছে । মাণ ডালা ও বালাঘাটের বাইগাদের মধ্যে বিবাহ স্থির হয়ে গেলেই বরের বাবা তু বোতল মদ এনে কনের বাবাকে উপহার দেয়। এই মদের কিছু পরিমাণ বুড়া দেওতার কাছে উৎসর্গ করা হয় আর বাকিটা সমবেত সকলের মধ্যে পরিবেশন করা হয়। এই অনুষ্ঠানকে “সাগাই” বলা হয়। একপক্ষকাল পরে বরের দল চার বোতল মদ নিয়ে আবার কনের বাড়ী আসে। কনের বাপ-মা তাদের ভোজ দিয়ে আপ্যায়ন করে এবং বিয়ের দিন স্থির করে। এই অনুষ্ঠানকে “বরোধি” বলা হয়। এরপর কনের বাবাকে দশদিনের সময় দেওয়া হয় বিয়ের আয়োজন করবার জন্য। দশদিন পরে বরের দল কনের বাড়ী আসে। কনের বাবা তাদের ভোজ দিয়ে আপ্যায়ন করে এবং সমস্তরাত্রি নাচগান চলতে থাকে। মদ্যপানও রীতিমত হয়। পরের দিন অপরাহ্লে “ভানওয়ার” অনুষ্ঠিত হয়। এরজন্য একটা মণ্ডপ তৈরী করা হয় এবং মাটিতে একটা দণ্ড পোত হয়। কনেকে নিয়ে বর তিনবার এই দণ্ড প্রদক্ষিণ করে। তারপর বর-কনে ও কনের বাপ-মা বরের বাড়ীর দিকে রওনা হয়। বরের বাড়ীতেও অনুরূপ একটি মণ্ডপ তৈরী করা থাকে এবং সেখানেও একটা দণ্ড পোতা থাকে। কনেকে নিয়ে বর সাতবার ওই দণ্ড প্রদক্ষিণ করে। তারপর ভোজ ও মদ্যপান করে উৎসবের পরিসমাপ্তি ঘটানো হয়। মধ্যপ্রদেশের অপরাপর উপজাতিদের মধ্যেও অনুরূপ অনুষ্ঠানসমূহ প্রচলিত আছে। তবে ওঁরাও, কোরবা প্রভৃতি জাতিসমূহ মণ্ডপের পাশে একটি জাত স্থাপন করে এবং তার উপর পাচটি চালের স্তৃপ রাখে। প্রতি ভূপের উপর যথাক্রমে একটি তামার পয়সা, হলুদ, সুপারি প্রভৃতি রাখা হয়। কনে একখানা কুলো হাতে নিয়ে বরের সামনে এসে দাড়ায়। কনের ছোট ভাই কিছু খই ওই কুলোয় দেয় আর বর পিছন দিক থেকে কনের হাত ধরে। তারপর তারা ওই কুলোর সমস্ত খই ছড়াতে ছড়াতে পাঁচবার মণ্ডপটি প্রদক্ষিণ করে। প্রতিবার প্রদক্ষিণ করবার সময় কনের পা দিয়ে বর জাতার উপর স্থাপিত চালের স্তৃপগুলি মাটিতে ফেলিয়ে দেয়। তারপর সিন্দুরদান অনুষ্ঠিত হয়। অনেক গ্রামে এ সম্পর্কে একটা অত্যাবগুকীয় অনুষ্ঠান পালন করা হয়। সেটা হচ্ছে, কনের বসা অবস্থায় তার ডানপায়ের উপর বর বা পায়ে দাড়ায় এবং একটা পাতা থেকে তেল নিয়ে কনের মাথায় মাখিয়ে দেয় ।
মহবুবনগরের চেংচুদের মধ্যে বরের দল কিছু মহুয়া ফুল, মদ ও একজন ঢুলিকে নিয়ে কুনের বাড়ীর দিকে যাত্রা করে। কনের বাড়ীর কাছাকাছি এলে ঢাকী ঢাক বাজাতে আরম্ভ করে। তারপর কন্যাপক্ষের লোকের বরের দলকে অভ্যর্থনা করতে থাকে। অভ্যর্থনা করে তাদের নিয়ে যাবার পর নাচ, গান, ভোজ ও মদ্যপান চলে। পরের দিন সকালে সকলে একত্রিত হয়ে আবার ভোজ ও মদ্যপান করে। বর তারপর কনেকে একখানা শাড়ী, একখানা চেলি ও একটা পুতির মালা দেয়। কনে পুতির মালাটি নিজের গলায় পরে। এর পর সমাগত অতিথিরা ও কনের বাবা বরকে বলে, সে যেন স্ত্রীকে মুখে রাখে ও তার প্রতি যত্নবান হয়। এখানেই বিবাহ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।
বিবাহ উপলক্ষে উদয়পুরের নাগাসিয়াদের মধ্যে এক বিচিত্র অনুষ্ঠান আছে। বর আনুষ্ঠানিকভাবে নদীতে স্নান করবার পর তীরধমুক নিয়ে এক কল্পিত মৃগের দিকে সাতবার ধাবমান হয়। সাতবারের পর তার ভগ্নীপতি এসে তীরটা কেড়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। বর তাকে ধরবার জন্য পিছনে পিছনে ছুটে । যদি তাকে ধরতে না পারে তা হলে এক আনা অর্থদণ্ড দিতে হয়। এখানেই বিবাহ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে। তবে আনুষ্ঠানিক স্নানের পূর্বে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয় সেগুলো উপজাতি ও হিন্দুসমাজের আচার-অনুষ্ঠানের মিশ্রণে রচিত।
যশপুরের রাউতিয়াদের মধ্যে বিবাহ উপলক্ষে “দুলহা দেও”-এর পূজা করা হয়। কনেকে একটা ডুলি করে নিয়ে আসা হয়। কালে রং-এর ছোপবিশিষ্ট লাল রং-এর একটা ছাগল আনা হয় এবং এক জায়গায় রাশিক্ত চাউল রেখে তাকে খেতে দেওয়া হয়। তারপর সেই ছাগলটিকে বাড়ীর বাইরে এক কোণে কাটা হয়। ছাগলের রক্ত বাড়ীর ভিতরে এনে চাউলের উপর ছিটিয়ে দেওয়া হয় ও তিনবার “ফুলহা দেও”-এর কাছে প্রার্থনা দ্বারা নবদম্পতির সুখ, শাস্তি ও মঙ্গল কামনা করা হয়। তারপর রক্ত ছিটানো চাউলগুলি নদীতে ফেলে দেওয়া হয় এবং ছাগ-মাংস রান্না করে পরিবারের সকলে ও অতিথিরা খায়। এদের মধ্যে অন্তান্ত আচার-অনুষ্ঠানগুলি প্রতিবেশী অন্য উপজাতিদের মতই, কেবল দ্বিতীয় দিনে বরকে একটি আমগাছের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে ধূপ-ধুনা জালিয়ে বরকে ওই আগুনের উপর আটা, ঘি, গুড় ইত্যাদি ছিটিয়ে দিতে বলা হয়। পরে গাছটির চারদিকে স্থত জড়িয়ে দেওয়া হয় এবং ওর একটা ডাল এনে কনের বাড়ীর বিবাহমণ্ডপে পুতে দেওয়া হয়। এদের মধ্যে বিবাহের সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান নাপিত কর্তৃক অনুষ্ঠিত হয়। বর-কনের মুখে ও গলায় সিন্দুর মাখিয়ে দেওয়া হয় এবং উপস্থিত সকলের মধ্যে অন্ন বিতরণ করা হয়। তারপর একটা আমডালের সাহায্যে বর-কনের উপর শাস্তিজল ছিটিয়ে দেওয়া হয় ও তাদের উভয়ের কাপড় নিয়ে গাটছড়া বেঁধে দেওয়া হয়। রাউতিয়ারা বলে যে তাদের মধ্যে এ সকল আচার-অনুষ্ঠান আদিমকাল থেকে অনুস্থিত হয়ে এসেছে ।
মধ্যভারতের কোলজাতির মধ্যে বিবাহের আচার-অনুষ্ঠানসমূহ উপজাতি ও হিন্দু—এই উভয় সমাজ থেকে গৃহীত হয়েছে। এদের মধ্যে বাগ দান ও বিবাহের লগ্ন স্থির হয়ে যাবার পর, বর-কনে উভয়ের বাড়ীতে “মঙ্গর মাটি” অনুষ্ঠান সম্পাদন করা হয়। বিবাহ উপলক্ষে যে সমস্ত চুলা (উনুন ) তৈরী করা হয় তার জন্য মাটি সংগ্রহ করাই “মঙ্গর মাটি” অনুষ্ঠানের মুখ্য উদ্দেশ্য। “মঙ্গর মাটি” অনুষ্ঠান বর ও কনের বাটিতে একই রাত্রে সম্পাদিত হয়। মাত্র মেয়েরাই এই পবিত্র মাটি সংগ্রহ করে। পাঁচ-সাতটি চুলা তৈরী করা যেতে পারে এরূপ পরিমাণ মাটি সংগ্রহ করা হয় এবং সেই রাত্রেই চুলাগুলো তৈরী করা হয়। পরের দিন চুলা সমূহে “লাওয়া” তৈরী করা হয়। লাওয়া হচ্ছে খই ও জোয়ার-এর মিশ্রণে প্রস্তুত একটা পদার্থ যা কোলজাতির মধ্যে বিবাহের এক অত্যাবশ্বকীয় উপকরণ। লাওয়া তৈরী করবার পর তা একটা নতুন হাড়িতে রাখা হয়। এই হাড়ির গায়ে মেয়েছেলের চিত্র অঙ্কিত থাকে। অনেকসময় ওই হাড়ির মধ্যে আতপ চাউল, হলুদ এবং দুটি পয়সা রাখা হয়। বরের বাড়ী যে লাওয়া তৈরী করা হয়, তা বরযাত্রীর সঙ্গে করে কনের বাড়ী নিয়ে আসে এবং সেখানে কনের বাড়ীতে তৈরী লাওয়ার সঙ্গে মিশ্রিত করা হয় ।
বিবাহ উপলক্ষে কনের বাড়ীর উঠানে একটা মণ্ডপ তৈরী করা হয়। নির্দিষ্ট নিয়মকানুন অনুযায়ী এবং বিশেষ গাছের কাঠ দিয়ে এই মণ্ডপ নির্মাণ করা হয়। মণ্ডপটিকে “মাড়ওয়া” বলা হয়। এই মাড়ওয়ার মধ্যেই বিবাহ সম্পাদিত হয়। এদের মধ্যে বিবাহ তিন ংশে তিন দিনে নিম্পন্ন হয়। প্রথম দিনের সন্ধ্যায় বরাত বা বরযাত্রীর দল কনের গ্রামে এসে উপস্থিত হয়। কনের বাড়ীর সমস্ত মেয়েরা মশাল হাতে করে গ্রামের সীমান্তে গিয়ে বরযাত্রীদের স্বাগত জানায় । যারা স্বাগত জানাতে যায় তাদের নেত্রী হয়ে যায় কনের সহোদরা বা অন্ত কোন বোন। বিবাহ হয় তার পরের দিন রাত্রে। বিবাহ সম্পাদিত হয় ব্রাহ্মণ পুরোহিত দ্বারা। কিন্তু আগে থেকে যদি সিদ্ধান্ত করা হয় যে পুরোহিতের সাহায্য নেওয়া হবে না, তা হলে বিবাহ সম্পাদন করে কনের পিসে। পূর্বেই বলা হয়েছে যে বিবাহ মণ্ডপের মধ্যে নিম্পন্ন হয়। বর কনের সিথিতে সিন্দূর পরিয়ে দেয় । তারপর কনের বোন বর-কনের কাপড়ের কোণ নিয়ে গাটছড়া বেঁধে দেয়। এরপর বর-কনে পবিত্র দণ্ডের চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করে। কনের বয়স যদি খুব কম হয় তা হলে মাত্ৰ পাচবার প্রদক্ষিণ করা হয় আর কনে যদি “সেয়ানা” হয় তা হলে সাতবার প্রদক্ষিণ করতে হয়। প্রদক্ষিণের পর বর কনেকে অনুসরণ করে ও ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে। সেখানে একটি প্রদীপ জ্বলে এবং কনের মা বরকে ফু দিয়ে সেই প্রদীপটি নিবিয়ে দিতে বলে। কিন্তু কনের মায়ের কাছ থেকে কিছু দক্ষিণ না পাওয়া পর্যন্ত বর এক কথায় এ কাজ করে না। তারপর তাদের গাটছড়া খুলে দেওয়া হয় এবং কনের শাড়ীর এক অংশ তার মুখের সামনে ধরে বরকে শুভদৃষ্টি করতে বলা হয়। পরের দিন “বিদা” বা বরের বাড়ী ফিরে যাওয়ার পালা পড়ে। কন্যাপক্ষ বরপক্ষের সঙ্গে গ্রামের সীমান্ত পর্যন্ত গিয়ে তাদের বিদায় দেয়। কোলেদের মধ্যে কনে কিন্তু বরের সঙ্গে যায় না । সে বাপের বাড়ীতেই থেকে যায়। কনের যখন যৌবন প্রাপ্তি ঘটে বর তখন “গৌণা” অনুষ্ঠান সম্পাদন করে কনেকে নিজের বাড়ী নিয়ে যায়। যেক্ষেত্রে বিবাহের সময় মাত্ৰ পাচবার দণ্ড প্রদক্ষিণ করা হয়েছিল সেক্ষেত্রে বাকী দুবার এই সময় প্রদক্ষিণ করতে হয়। কোলেদের মধ্যে বিবাহ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে “রওনা” অনুষ্ঠান সম্পাদন করে। রওনা আর কিছুই নয়, বর কর্তৃক কনেকে নিজের বাড়ী নিয়ে যাওয়া মাত্র ।
কোলেদের মধ্যে আর এক রকম বিবাহেরও প্রচলন আছে । একে বলা হয় “ভাগল” বা কনেকে গোপনে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করা । এ ক্ষেত্রে তারা প্রথমে কোন আত্মীয় বা বন্ধুর বাড়ী গিয়ে উপস্থিত হয় । বর সেখানে কনের হাতে দশগাছ কালো রং-এর চুড়ি পরিয়ে দেয় ও তার সিথিতে সিন্দুর ঘষে দেয়। তারপর থেকে তাদের মধ্যে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক অর্সায়। অনেক সময় এর সামাজিক স্বীকৃতির জন্য পঞ্চায়েতকে ভোজ দেওয়া হয়।