কতক্ষণ এ ভাবে কাটল কে জানে, হঠাৎ চঞ্চল লক্ষ করল, বারান্দায় অন্ধকারে একটা মূর্তি ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে। চঞ্চল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল; লম্বা একটা ছায়া যেন স্তব্ধ হয়ে তাকেই লক্ষ করছে। মুহূর্তের জন্যে চঞ্চলের গা ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, কিন্তু এখন ভয় পেলে চলবে না, এখনই মাথা ঠাণ্ডা রাখবার সময়। চঞ্চল আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। ছায়ামূর্তি তবু সরল না, নড়ল না। চঞ্চল একটু একটু করে এগোতে লাগল, তারপর যেই দরজার কাছে এসেছে, মূর্তিটা এক লাফে নামল বারান্দা থেকে মাটিতে। সঙ্গে সঙ্গে চঞ্চলও দৌড় দিল, পকেট থেকে টর্চ বের করে জ্বালাতেই যা দেখল, মনে মনে তা দেখতেই হয়তো আশা করেছিল, তবু সত্যি সত্যি তাই দেখল তার সমস্ত শরীরে যেন চকিতে বিদ্যুৎ খেলে গেল।
সেই অন্ধকারে টর্চের আলো বিঁধল কাকে? ফুটে উঠল উপেন ধরের দীর্ঘ মূর্তি, তার মুখে হিংস্র কুটিল হাসি।
অবাক হবার সময় চঞ্চল বেশি পেল না, এক লাফে সেও নামল মাটিতে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই তার মাথার উপর প্রচণ্ড একটা ঘুষি নামল, টর্চ খসে পড়ে গেল মাটিতে, ভোঁ করে উঠল মাথা। সেটা হয়তো সামলে উঠতে পরত, কিন্তু তার পরেই পরপর কয়েকটা বজ্রমুষ্টির আঘাত তাকে যেন একেবারে গুঁড়ো করে দিল। শেষটায় বুকের উপর এমন এক কিল খেল যে, দম বন্ধ হয়ে উবু হয়ে বসে পড়ল মাটিতে। অন্ধকরের ভিতর দিয়ে উপেন ধর দিল দৌড়।
পালাচ্ছে, লোকটা পালাচ্ছ। হাঁটুর উপর বুক চেপে চঞ্চল মিনিট খানেক বসে রইল, কিন্তু তক্ষুনি আবার টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। উহ, লোকটা জোয়ান বটে। জু-জুৎসুর প্যাঁচ চঞ্চলের জানা ছিল, গায়ে জোরও তার মন্দ নেই, কিন্তু কিছু করতে পারলে না, শুধু পড়ে পড়ে মার খেল। কিন্তু পালাতে সে দেবে না ওকে, কিছুতেই না। কষ্টে নিঃশ্বাস পড়ছিল, তবু দৌড় দিলে উপেন ধর যেদিকে গেছে সেটা আন্দাজ করে। ঐ রাস্তায় একটা মোটর দাঁড়িয়ে না? উপেন ধর লাফিয়ে উঠল গাড়িতে, এঞ্জিন গাঁ গাঁ করে উঠল। চঞ্চল ছুটল প্রাণপণে, গাড়ি যেই চলতে শুরু করেছে , উঠল ফুটবোর্ডে, তারপর মাথা গলিয়ে ভিতরে ঢুকে বসে পড়ল পিছনের সিটে। হাওয়ার বেগে গাড়ি ছুটল।
গাড়ি চালাচ্ছে উপেন ধরই। কোথায় যাচ্ছে চঞ্চল জানে না। হয়তো এই ছোটো বিপদ থেকে আরও বড় বিপদের দিকে সে যাচ্ছে। এখন সে বুঝতে পারল উপেন ধরই শেয়ালদা থেকে তার পিছু নিয়েছিল, তার আগেই এ বাড়িতে এসে ছিল লুকিয়ে। কিন্তু এই গাড়িটা এল কোত্থেকে? আর পরীক্ষিৎবাবুই বা কোথায়? যদি তিনি এখানে নাই থাকবেন, তাহলে উপেন ধরের এখান থেকে পালিয়ে যাবার কথা নয়। যাই হোক, চঞ্চল মনে মনে ভাবলে, সে যে গাড়িটায় চড়ে বসতে পেরেছে, এটাই মস্ত লাভের কথা, কারণ এ রহস্যের সমাধান যে উপেন ধরের সূত্রেই হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
কোথায় যাচ্ছে উপেন ধর? কে জানে! গাড়ি এমনভাবে ছুটেছে যেন একেবারে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে গিয়ে থামবে।
খানিক পরে গাড়ির বেগ একটু কমিযে উপেন ধর পিছনে তাকিয়ে বললে, “ভালো চাও তো নেমে যাও গাড়ি থেকে।”
চঞ্চল জবাব দিল, “পার তো জোর করে নামিয়ে দাও।”
“সেতা ইচ্ছে করলেই পারি তা জান?
চঞ্চল বললে, “দ্যাখো না চেষ্টা করে।”
আশ্চর্যের বিষয়, উপেন ধর অনেকবার শাসালে বটে কিন্তু তাকে জোর করে নামিয়ে দেবার চেষ্টা একবারও করল না। ইচ্ছে করলেই সে যে তা পরে তার কিলঘুষির সঙ্গে পরিচিত হবার পর চঞ্চলের তাতে আর সন্দেহ নেই। উপেন ধর একটু পরপরই পিছনের দিকে তাকাচ্ছিল, আর বিড়বিড় করে নিজের মনে কী বলছিল – চঞ্চল ভাবছিল যে সে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখছে আর তার উদ্দেশেই গালাগালি দিচ্ছে – কিন্তু খনিক পরে কেমন সন্দেহ হওয়ায় সেও পিছনের দিকে তাকাল, দেখল, আর একটি গাড়ি তাদের পিছন পিছন আসছে।
ডাযমণ্ড হার্বারের রাস্তায় বেশি রাত্রেও গাড়ি চলাচল কিছু আশ্চর্য নয়, কিন্তু খনিকক্ষণ লক্ষ করবার পর চঞ্চলের সন্দেমাত্র রিল না যে অন্য গাড়িটা ঠিক তাদেরই পিছু নিয়েছে। নিঃশব্দে মাঝখানকার দূরত্ব সমানে রেখে গাড়িটা আসছে] উপেন ধর স্পিড বাড়ালে সেটারও বাড়ে, কমালে সেটারও কমে। বারবার পিছনে তাকিয়ে উপেন ধর ঐ গাড়িটাকেই তাহলে দেখছে, তাকে নয়?
ঐ গাড়িতে কে? ষে যাই হোক, উপেন ধর যে তকে পছন্দ করে না, এটা বেশ বোঝা যচ্ছে। ঝড়ের বেগে গাড়ি ছুটিয়ে সে চলেছে কোথায়? একটা অ্যাকসিডেন্ট না করে! দেখতে দেখতে কলকাতা এসে পড়ল, সার্কুলার রোড ধরে গাড়ি সোজা চলেছে উত্তরে। অন্য গাড়িখানা ঠিক পিছন পিছন আসছে। চঞ্চল এতক্ষণে বুঝতে পারল যে উপেন ধর যে তকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেবার চেষ্টা করছে না তার কারণ ঐ পিছনের গাড়িই। তাকে জোর করে নামাতে হলে গাড়ি থামাতে হবে, আর গাড়ি থামালেই পিছনের ওরা এসে পড়বে ঘাড়ে। মজা মন্দ নয়। হয়তো কোনো নতুন দারুণ বিপদের দিকে চলেছে, কিন্তু ভয়ের ভাবের চেয়েও চঞ্চলের যেন ভালোই লাগছিল বেশি।
শেয়ালদা পার হয়ে সার্কুলার রোড যেই বেশ চওড়া হয়ে এল, উপেন ধর এমন স্পিড দিলে যে, চঞ্চলের মাথা ভোঁ করে উঠল। বাপরে, দু দিকে কিছু দেখা যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে শরীরটা শূন্যে হাওয়া হয়ে মিলিয়ে যাবে। চঞ্চল গদিতে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজল কিন্তু একটু পরেই উপেন ধর বিকট সুরে চিৎকার করে উঠতেই তাকিয়ে দেখল, একটা ল্যাম্পপোষ্ট তীরের বেগে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আর উপায় নেই। এক্ষুণি চুরমার। চঞ্চলের শুধু এ কথা ভাবার সময় হল যে মরবার পক্ষে তার বয়েসটা বড়ই কম, সেই মুহূর্তেই উপেন ধর প্রাণপণে ব্রেক কষলে, সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা ল্যাম্পপোস্টে গিয়ে ধাক্কা খেল, মস্ত একটা ঝাঁকুনি, তারপর চুপ।
একটু পরেই পিছনের গাড়িখানা তাদের পাশে এসে দাঁড়াল, ভিতর থেকে কে একজন বলল, “কিছু ভাববেন না উপেনবাবু, আমাদের গাড়িতে আসুন, অনেক জায়গা রয়েছে।”
চঞ্চল গলার আওয়াজ চিনতে পারল, এ তো রণজিৎ সামন্ত।
রণজিৎবাবু গাড়ি থেকে নেমে বললেন, “চলে আসুন, আর দেরি করে লাভ কী! গাড়িটা থাক, আমার একজন লোক এখানে রেখে যাচ্ছি। এস, চঞ্চল, তুমিও এস।”
চঞ্চল গাড়ি থেকে আগে নেমে পড়ল। “আপনি ডায়মণ্ড হার্বারে ছিলেন?”
“সে সব পরে হবে। উপেনবাবু, আর দেরি করে লাভ নেই। আজ রাত্তিরে একটু ঘুমোতে দেবেন, না দেবেন না?”
উপেন ধর নামল গাড়ি থেকে, তার মুখ একদম ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। আর উপায় নেই, ধরা দিতেই হল পুলিশের হাতে।
রণজিৎবাবুর সঙ্গে তিনজন ধুতি পরা কনেস্টবল ছিল, তাদের একজন রইল উপেন ধরের গাড়ির পাহারায়। ইন্সপেক্টর নিজেও ধুতি পরা, চেহারা দেখে মনে হতে পরে বিযের নেমন্তন্ন খেতে চলেছেন।
গড়িটা বেশ বড়, সবারই জায়গা হয়ে গেল।
চঞ্চল রণজিৎবাবুকে জিগ্যেস করল, “কোথায় চলেছেন।”
“চল, দেখবে।”
পরীক্ষিৎবাবুর খোঁজ পেয়েছেন?”
“তুমি কি দেখলে ওখানে?”
“কিছুই না। ঐ উপেন ধর -”
“হ্যাঁ, তিনি তো সঙ্গেই চলেছেন। উপেনবাবু, আপনার তো দেখছি অনেক গুণ। গাড়িও চালান চমৎকার। দয়া করে বলে দিন, পরীক্ষিৎবাবু কোথায় আছেন – আপনার কিছু ভয় নেই।”
কিন্তু উপেন ধর একটিও কথা বললে না, সমস্ত রাস্তা চুপ করে রইল।
রাস্তা আর খুব বেশিও ছিল না। লালবিহারী মালাকারের কাশীপুরের প্রকাণ্ড বাগানবাড়িতে গাড়ি যখন ঢুকল, তখন রাত ঠিক দেড়টা। চঞ্চল বাড়িটা চিনতে পারলে, আগে সে একবার এসেছিল মহিবাবুর কাজেই। গাড়ি থামতেই একতলার একটা দরজা খুলে গেল, ভিতরে দেখা গেল আলো।
রণজিৎ বাবু সকলের আগে গাড়ি থেকে নেমে বললেন, “আসুন উপেনবাবু। নিজেই আসবেন, না হাত ধরতে হবে?”
উপেনবাবু নিঃশব্দে নামলেন, তার পিছনে চঞ্চল ও কনেস্টবল দুজনও নামল।
রণজিৎবাবু বললেন, “আপনি আগে যান, উপেনবাবু।”
লম্বা সিঁড়ি দিযে উঠে সামনেই একটা মস্ত হল। সেই হলঘরে উপেন ধরের পিছন পিছন সবাই ঢুকল। সেই ঘরে আছেন মহিমবাবু – আর পরীক্ষিৎ মজুমদার।