১৯৪১-এর ১৯শে মে সকালবেলায় কলকাতা হরকরা পত্রিকায় এমন একটি খবর বেরুল যে মহাযুদ্ধের খবর ছপিয়েও সমস্ত শহরকে চঞ্চল করে তুলল। বিখ্যাত লেখক পরীক্ষিৎ মজুমদারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি নিরুদ্দেশ হয়েছেন, বেমালুম উধাও হয়ে গেছেন। খবরটি চমক লাগল সন্দেহ নেই, কারণ মজুমদারমশাই বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক। তাঁর বই ঘরে ঘরে, তাঁর গল্প মুখে মুখে। কোনো মাসিকে তাঁর উপন্যাস বেরোতে থাকলে তার কাটতি দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ছেলেরা, মেয়েরা, বুড়োরা, সকলেই তাঁর বই পড়তে ভালোবাসে। এই অতি প্রিয় লেখকের আকস্মিক অন্তর্ধানে শুধু কলকাতায় নয়, সমস্ত দেশে যে একটা বড়রকমের চাঞ্চল্য দেখা দেবে, তাতে অবাক হবার কিছু নেই।
কিন্তু ব্যাপারটা চাঞ্চলের বেশি, একেবারে হুলস্থূল! এতটা হয়তো হত না, যদি না ঠিক পরের দিনই, অর্থাৎ ২০শে মে পরীক্ষিৎ- জয়ন্তীর তারিখ ধার্য হত। ঐ তারিখে পরীক্ষিত্বাবুর পঞ্চাশ বছর পুরোবে। সেই উপলক্ষে তাঁর ভক্তরা মহাসমারোহে তাঁর সম্বর্ধনার ব্যবস্থা করেছেন। জয়ন্তীর আয়োজন চলেছে এপ্রিল মাস থেকে। চাঁদা উঠেছে অনেক, খরচও হয়েছে ঢের। সারা শহরে প্ল্যাকার্ড পড়েছে, ১০ই মে থেকে প্রতিদিন প্রত্যেক দৈনিকপত্রে নোটিশও বেরোচ্ছে। পরীক্ষিত্বাবুকে উপহার দেবার জন্যে পঞ্চাশটি রূপোর প্রদীপ বসানো একটি সোনার থালা প্রস্তুত। ২০শে মে বিকেলে টাউন হলের বিরাট সভায় মেয়র সেটি তাঁর হাতে দেবেন; বক্তৃতা করবেন প্রসিদ্ধ কবি, শিল্পী ও সম্পাদকগণ, তারপর, রাত্রে শুধু তাঁর বিশেষ বক্তদের নিয়ে একটি প্রীতিভোজ হবে ক্রোড়পতি বীমাব্যবসায়ী লালবিহারী মালাকারের কাশীপুর বাগানবাড়িতে। আয়োজন সম্পূর্ণ, উনিশ তারিখ কেটে গিয়ে বিশ তারিখ ভোর হলেই হয় এর মধ্যে কিন্তু স্বয়ং পরীক্ষিত্বাবুই অন্তর্হিত হলেন।
খবরটি প্রথম বেরোয় হরকরা-তেই। ফলে, এক ঘণ্টার মধ্যেই সমস্ত কাগজ ফুরিয়ে গেল, আবার দশ হাজার ছাপতে হল, আর বেলা দশটার মধ্যে অন্যান্য কাগজও এক পয়সার স্পেশাল বার করলে। ঘুম থেকে উঠে যারা খবরটি পায়নি, তারা আপিসে যেতে যেতে জেনে ফেলল।
হরকরা পত্রিকাটি অল্পদিনের। তার সম্বল খুব বেশি নয়; দোর্দণ্ডপ্রতাপ আর বঙ্গবীর -এর দুর্দান্ত প্রতিযোগিতায় সে যে টিকে আছে, এই জন্যেই অনেকে পরিচালকদের সাধুবাদ দিয়ে থাকেন। ও সব জবরদস্ত কাগজ এড়িয়ে এত বড় একটা খবর যে হরকরা-তেই প্রথমে বেরুল, তার একটু ইতিহাসও আছে।
হরকরা-র স্বত্বাধিকারী মহিম চাতুয্যে পরীক্ষিতবাবুর বাল্যবন্ধু। সকলে জানেন না, কিন্তু এই জয়ন্তীর আয়োজনের মোলে মহিমবাবুই আছেন। তিনি স্বভাব গোপন লোক, নাম ছাড়াতে ভালোবাসেন না, নেপথ্যে থেকে যোগাড় যন্ত্র করেন। নিজের পকেট থেকে বেশ মোটা টাকাই তিনি ফেলেছেন পরীক্ষিৎ জয়ন্তীর ফাণ্ডে, আর নৈশভোজনের ভারটা লালবিহারীবাবু যে নিতে রাজি হয়েছে, সে একান্তই মহিমবাবুর প্ররোচনায় – নয়তো এই বীমাব্যবসায়ী সহজে কি আর সাহিত্যের এলাকা মাড়ান! মহিম চতুয্যের সাহিত্যপ্রীতি অসাধারণ আর পরীক্ষিত্বাবুর সঙ্গে তাঁর গভীর বন্ধুতা। ১৮ তারিখ রাত্রে তিনি তাঁর একজন সব এডিটরকে পাঠান কথাসাহিত্য সম্রাটের বাড়িতে বাড়িতে, হরকরা-র জন্য বিশেষ একটি ‘বাণী’ চাই – এই অনুরোধ। সেই ‘বাণী’ হবে। ১৯শে তারিখের হরকরা-র প্রধান আকর্ষণ, এইরকম তাঁর মতলব ছিল। কিন্তু ‘বানী’র বদলে কী খবরই তাঁকে ছাপতে হল।
পরীক্ষিত্বাবুর বাড়ি যাওয়ার ভার পড়েছিল চঞ্চলের ওপর। চঞ্চল নাগ হরকরা-র আপিসে কনিষ্ঠ সাব-এডিটর। তাকে ছেলেমানুষই বলা চলে, কারণ তার সবে গোঁপ উঠেছে, বয়স আঠারোর বেশি না। চঞ্চল গরিবের ছেলে, ম্যাট্রিক পাশ করে কলেজে পড়বার সুবিধে হয়নি, তাই ঢুকে পড়েছিল ‘হরকরা’-র আপিসে। ডেসপাচার হয়ে ঢুকেছিল, অর্থাৎ তাকে ঠিকানা লিখতে আর টিকিট লাগাতে হত; মাইনে ছিল পনেরো টাকা। কিন্তু সুশ্রী, বুদ্ধিমান ও চটপটে এই ছেলেটি অল্পদিনের মধ্যেই মহিমবাবুর নজরে পড়ে যায়, সব-এডিটরের চেয়ারে বসতে তার বেশিদিন লাগেনি। এখন তার মাইনে, পঁয়ত্রিশ টাকা। এমন মোটা টাকা রোজগার করে চঞ্চল মহাখুশি। নামে সাব-এডিটর হলেও তাকে বেশির ভাগই রিপোর্টারের কাজ করতে হয়; অর্থাৎ তাকে লিখতে হয় অল্প, ঘুরতে হয় বেশি। কলকাতার কোথাও কিছু হলেই হরকরা-র নিজস্ব সংবাদদাতা হয়ে সেখানে সে উপস্থিত। কলকাতার বাইরে মাঝে মাঝে যেতে হয়; ঢাকা মেল-এর শেষ দুর্ঘটনার সময় মহিমবাবু তাকেই পাঠিয়েছিলেন। এ কাজে শারীরিক কষ্ট আছে, বিপদের আশঙ্কাও যে নেই তা নয়, কিন্তু মজাও আছে নানারকম। মোটের উপর, চঞ্চলের বেশ ভালোই লাগে। অন্তত আপিসে বসে কলম পেষার চাইতে এ ঢের ভালো।
চঞ্চলের চাকরি জীবন মাত্র দু বছরের হলেও নানারকম শক্ত কাজ সে ইতিমধ্যেই করেছে। কিন্তু ১৮ তারিখ রাত্তিরে পরীক্ষিতবাবুর বাড়ির উদ্দেশ্যে সে যখন বেরুল, তার মনে হল, এত বড় দায়িত্বপূর্ণ কাজ মহিবাবু আর কখনও তাকে দেননি। এমনকি তার বুকটাও যেন একটু ঢিপঢিপ করে লাগল। অথচ, কাজটা তেমন কিছুই না, মহিমবাবু আগেই টেলিফোন করে রেখেছেন, অসুবিধে হবারই কথা নয়। আসলে, এত বড় দিগ্বিজয়ী একজন কোনো লেখকের সামনে সে এ গিয়ে দাড়াবে, সে কথা ভাবতে চঞ্চল ঈষৎ ঘাবড়ে যাচ্ছিল। পরীক্ষিত্বাবুকে সে দূর থেকে কয়েকবার দেখেছে, তাঁর বক্তৃতাও শুনেছে, কিন্তু তাঁর বাড়ি গিয়ে মুখোমুখি তাঁর সঙ্গে কথা বলা – কথাটা ভাবতেই যেন দম আটকে আসে।
পরীক্ষিত্বাবুর বাড়ি রিজেণ্টস পার্কে। মহিমবাবু বলে দিয়েছিলেন রাত দশটায় যেতে – সে সময়ে অপরাজেয় কথাশিল্পী খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম করেন, লোকজনের ভিড় থাকে না। টালিগঞ্জ ট্রামডিপোয় নেমে মিনিট তিনেক হেঁটে চঞ্চল কাঁটায় কাঁটায় দশটার সময়ে ‘বাণীবনে’র গেট পার হয়ে ভিতরে ঢুকল। বাইরে থেকে সমস্ত বাড়ি অন্ধকার দেখে তার মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল – হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন, দেখা হবে না। যাই হোক, এসেছে যখন খবরটা নেয়াই যাক। বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল টিপে অপেক্ষা করতে লাগল।
একটু পরেই ভিতরে আলো জ্বলে উঠল, একজন চাকর এসে বলল, “কী চাই?”
চঞ্চল ঢোঁক গিলে বলল, “পরীক্ষিত্বাবু আছেন? আমি হরকরা-র আপিস থেকে আসছি।”
“আসুন।”
চাকরটি যাই হোক, বেশ ভদ্র। তাকে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে পাখা খুলে দিয়ে চলে গেল। চঞ্চল ধরেই নিল যে এরপরে স্বয়ং পরীক্ষিৎ মজুমদারই ঘরে ঢুকবেন। তার বুকের ভিতর এত শব্দ হতে লাগল যে, সে নিজের কানেই তা শুনতে পেল।
মিনিট দশেক পরে ঘরে ঢুকলেন পরীক্ষিৎবাবু নন, তাঁর ভাই বিজয়কৃষ্ণ। কথাসাহিত্য সম্রাট বিবাহ করেননি, তিনি ছাড়া এ বাড়িতে থাকেন তাঁর ভাই, আর ভাইয়ের পরিবার। ভাই বয়েসে অনেক ছোটো, কাজকর্ম কিছু করেন না, করবার দরকার নেই। এই ভাইকে পরীক্ষিতবাবু যে প্রাণতুল্য ভালোবাসতেন, তা সবাই জানে।
বিজয়কৃষ্ণ ঘরে ঢুকে বললেন, “দাদা তো বাড়ি নেই।”
চঞ্চল কুণ্ঠিতভাবে বলল, “আমি হরকরা আপিস থেকে আসছি। মহিমবাবু আমাকে বলেছিলেন…।”
“হ্যাঁ, তাঁর টেলিফোন পেয়েছিলুম। দাদা সে সময়েও ছিলেন না; আমি বলেছিলাম তিনি এলেই বলে রাখব।”
“কোথায় গেছেন তিনি?”
“রোজই সন্ধের আগে গঙ্গার ধারে হাওয়া খেতে যান, আজও তাই গেছেন। আটটার মধ্যে রোজই ফেরেন ⤒ এত দেরি তো কখনো হয় না।”
“তাহলে?”
“আপনি একটু বসুন, এক্ষুণি ফিরবেন নিশ্চয়ই!”
“সময়ে আপনাদের বিরক্ত করলুম,⤘” চঞ্চল বিনীত সুরে বললে।
“না না, বিরক্ত কিছু না।”
“আপনি হয়তো শুতে যচ্ছিলেন?”
বিজয়কৃষ্ণ হেসে বললেন, “শুয়ে পড়েও ছিলুম, কিন্তু ঘুমুতে পারছিলুম না! দাদা তো এমন অনিয়ম কখনো করেন না, একটু দুশ্চিন্তাই হচ্ছে। চাকরদের বলে রেখেছিলুম, কেউ এলেই আমাকে ডেকে দিতে। মহিমবাবুর টেলিফোনের কথা মনে ছিল। বসুন, বসুন।”
বেশ বোঝা গেল, উত্কণ্ঠার সময়ে একজন সঙ্গী পেয়ে বিজয়কৃষ্ণ বেশ খুশিই হয়েছেন, চঞ্চলকে ছাড়তে চাচ্ছেন না।
চঞ্চল জিজ্ঞেস করলেস, “কোথাও কোনো এনগেজমেন্ট ছিল নাকি?”
বিজয়কৃষ্ণ ছিট একটি হাই চেপে বললেন, “না তো, তেমন কিছুই ছিল না। দাদার সব এনগেজমেন্ট তো আমার মারফৎই হয়। এ ক-দিনই বিশেষ করে, তিনি একেবারেই চুপচাপ কাটাচ্ছেন, জয়ন্তীটা হয়ে গেলেই আবু পাহাড়ে গিয়ে বিশ্রাম করবেন শরীরটা বিশেষ ভালো যাচ্ছে না – ঐ তো, এলেন বুঝি!”
গেট পেরিযে গাড়ি ঢোকবার শব্দ হল। চঞ্চল সন্ত্রস্ত হয়ে হাত পা সোজা করে বসল, একটু পরেই তো মহালেখকের আবির্ভাব হবে।
বিজয়কৃষ্ণ উঠে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন, তারপর চঞ্চলের দিকে ফিরে বললেন, “সে কি! গাড়িটা দেখছি সোজা গ্যারেজের দিকে চলে গেল। ভিতরে ড্রাইভার ছাড়া আর কেউ ছিল বলেও মনে হয় না!”
বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনি ডাকলেন, “কাঞ্চা! কাঞ্চা!”
ফুটফুটে ফর্সা চেহারার বছর কুড়ির একটি নেপালি যুবক ঘরে ঢুকে সেলাম করে দাঁড়াল।
“বাবু কাঁহা?”
হিন্দি বাংলা মিশিয়ে কাঞ্চা যা বললে, তার মর্ম এই যে, রাত প্রায় আটটার সময়ে প্রিনসেপ ঘাটে বাবু তাকে ছেড়ে দিয়ে ঘরে ফিরে যেতে বললেন। সে আপত্তি করেছিল, বলেছিল, বাবু কেমন করে ফিরবেন তাহলে – কিন্তু বাবু তকে জোর করেই পাঠিয়ে দিলেন। পথে গাড়ির একটি টায়ার ফেটে যায়, সেইজন্যে ফিরতে তার এত দেরি হল। বাবু কি এখনও ফেরেননি?
বিজয়কৃষ্ণ উদ্বিগ্নস্বরে বললেন, “সে কি! এমন অদ্ভূত খেয়াল তো দাদার কখনও হয় না! রাত্রিতে কাঁটায় কাঁটায় ন’টার সময়ে খাওয়া তাঁর অভ্যেস, এর তো কখনও ব্যতিক্রম হতে দেখিনি। তোকে তিনি কি বললেন, ঠিক করে বল তো?”
বললেন, “তুই চলে যা, আমি একটু পরে যাচ্ছি।”
“একটু পরেই যদি যবেন, গাড়ি পাঠিয়ে দেবার কী মনে হতে পরে?”
“আমি তো সে কথাই বললুম। কিন্তু বাবু গল্পে মশগুল, আমার কথায় কানই দেন না!”
“গল্পে মশগুল? তাহলে সঙ্গে আর কেউ ছিল?”
“হ্যাঁ, আরও একটা বাবু ওখানে ছিলেন।”
“কে সে? চিনিস?”
“না, আমি চিনব কেমন করে?”
“বাড়িতে আসতে দেখেছিস কখনও?”
কাঞ্চা বললে যে, সেখনটায় আলো বেশি ছিল না, সে ছিল গাড়িতে বসে, আর বাবু ছিলেন একটু দূরে, ভালো করে দেখতে পায়নি।
“কেমন দেখতে সে লোকটি?”
“লম্বা।”
এই একটিমাত্র বিশেষণে কিছু বোঝা যায় না। বিজয়কৃষ্ণ একটা অধৈর্যসূচক শব্দ করে বললেন, “তার মুখ দেখিসনি?”
“মুখ? তা দেখেছি?”
“কেমন দেখতে?”
কিন্তু কাঞ্চা আর কিছুই বলতে পারলে না।
“পরনে ধুতি, না সাহেবের পোশাক?”
কিন্তু এ প্রশ্নের কাঞ্চা কোনো স্পষ্ট জবাব দিতে পারলে আ। বিজয়কৃষ্ণ বললেন, “তুই একটা উজবুক – দাঁড়া, যাসনে এখান থেকে।”