আগামী কল্য ঝুলনযাত্ৰা আরম্ভ। আজ শ্ৰাবণের শুক্লা দশমী তিথি, কাল একাদশী। একাদশীতে আরম্ভ হইয়া পূর্ণিমায় বিষ্ণুর দ্বাদশযাত্রার অন্যতম হিন্দোলযাত্রা শেষ হইবে। সাধাল গৃহস্থের বাড়িতে ঝুলনের বিশেষ উৎসব নাই। শুধু পূর্ণিমার দিন হল-কর্ষণ নিষিদ্ধ। আকাশে আবার মেঘ জমিয়াছে। গরমও খুব। বর্ষণ হইবে বলিয়াই মনে হইতেছে। এবার বর্ষণ শুক্লপক্ষে। বাংলার চাষীদের এদিকে দৃষ্টি খুব তীক্ষ্ণ। আষাঢ় মাস হইতেই তাহারা লক্ষ্য করে বর্ষণ এ বৎসর কোন। পক্ষে। প্রতি বৎসরই বর্ষণের একটা নির্দিষ্ট সময় পরিলক্ষিত হয়। যেবার কৃষ্ণপক্ষে বৰ্ষণ হয়, সেবার কৃষ্ণপক্ষের মাঝামাঝি আরম্ভ হইয়া পূর্ণাতিথিতে অর্থাৎ অমাবস্যায় প্রবল বর্ষণ হইয়া যায়। আর শুক্লপক্ষের প্রথম কয়েকদিন মৃদু বর্ষণের পর আকাশের মেঘ কাটে, দশ-পনের বা। আঠার দিন অ-বর্ষণের পর আবার ঘটা করিয়া বর্ষা নামে। অতিবৃষ্টিতে অবশ্য ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়, কারণ ও দুইটাও ঋতুচক্রের প্রাকৃতিক গতির অস্বাভাবিক অবস্থা, নিয়মের মধ্যে অনিয়ম-ব্যতিক্রম।
এবার বর্ষা নামিয়াছে শুক্লপক্ষে। দশমীতে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, দুই-চারি ফোঁটা বৃষ্টিও হইতেছে; পূর্ণিমায় প্রবল বর্ষণ হইবে হয়ত, বর্ষা এবার কিছু প্রবল হইলেও মোটের ওপর ভালই বলিতে হইবে। শ্রাবণ মাসে জলে প্রায় চিরকূট করিয়া দিল। কর্কট রাশির মাস শ্রাবণ; সূর্য এখন কর্কট রাশিতে। বচনে আছে—কৰ্কট চরকট, সিংহ (অর্থাৎ ভদ্ৰে) শুকা, কন্যা (অর্থাৎ আশ্বিনে) কানে-কান, বিনা বায়ে তুলা (অর্থাৎ কার্তিকে) বর্ষে, কোথায় রাখিবি ধান।
ধানের গতিক অর্থাৎ লক্ষণ এবর ভাল। জলের গুণও ভাল। এক এক বৎসর জল সচ্ছল হইলেও দেখা যায় ধানের চারা বেশ সতেজ জোরালো হইয়া ওঠে না, খুব উর্বর জমিতেও না। এবার কিন্তু ধানের চারায় বেশ জোর ধরিয়াছে কয়েকদিনের মধ্যেই। এমন বর্ষা চাষীদের সুখের বর্ষা। মাঠ-ভরা জল, ক্ষেত-ভরা লকলকে চারা, দলদলে মাটি আর চাই কি। প্রকৃতির। আয়োজন-প্রাচুর্যের মধ্যে আপনাদের পরিশ্রমশক্তিটুকু যোগ করিতে পারিলেই হইল।
এমন বর্ষায় চাষী মাঠে ঝপাইয়া পড়ে পাউশের মাছের মত। অন্ধকার থাকিতে মাঠে যাইবে; জলখাবার বেলা, অর্থাৎ দশটা বাজিলে, একবার হাল ছাড়িয়া জমির আলের উপর বসিয়া পিতৃপুরুষের পাঁচসেরি ধোঁয়া-বাটিতে মুড়ি গুড় খাইবে, তারপর এক ছিলিম কড়া তামাক খাইয়া আবার ধরিবে হালের মুঠা। একটা হইতে দুইটার মধ্যে হাল ছাড়িয়া আরও ঘণ্টাতিনেক, অর্থাৎ পাঁচটা পর্যন্ত কোদাল চালাইবে। পাঁচটার পর বাড়ি আসিয়া স্নানাহার করিয়া আবার মাঠে যাইবে বীজ চারা তুলিতে; জলে কাদায় হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া দুই হাতে চারা তুলিবে; প্রকাও চারার বোঝা মাথায় লইয়া বাড়ি ফিরিবে রাত্রি দশটায়। এমন বর্ষায় ভোর হইতে রাত্রি দশটা পর্যন্ত গ্রামের মাঠ হাসি-তামাশা-আনন্দে মুখর হইয়া ওঠে; ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বৎসর বয়সের প্রতিটি চাষী তাহার কণ্ঠস্বর যেমনই হউক না কেন—গলা ছাড়িয়া প্ৰাণ খুলিয়া গান গায়। সন্ধ্যার পর এই গান শোনা যায় বেশি এবং শোনা যায় হরেক রকমের গান।
দেবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। এবার এমন বর্ষাতেও মাঠে গান নাই। এমন বর্ষাতেও প্রতি চাষীরই এক বেলা করিয়া কাজ বন্ধ থাকিতেছে। চাষীর ঘরে ধান নাই। দেবুর বয়সের অভিজ্ঞতায় বর্ষায় চাষীর ঘরে ধান কোনো বৎসরই থাকে না; তবে সে শুনিয়াছে, আগে থাকিত। যতীনবাবুকে একদিন বৃদ্ধ দ্বারিকা চৌধুরী যাহা বলিয়াছিল সেই কথা তাহার মনে পড়িল।
—সেকালে গাই বিয়োলে দুধ বিলাতাম, পথের ধারে আম-কাঁঠালের বাগান করতাম, সরোবর-দিঘি কাটাতাম, দেবতার প্রতিষ্ঠা করতাম।
ছেলে-ঘুমপাড়ানি ছড়ায় আছে—চাঁদো চাঁদো, পাত ঘুমের ফাঁদো, গাই বিয়োলে দুধ দেবো, ভাত খেতে থালা দেবো। ভাত না থাকলে ভাত খাইবার থালা দিবে কোন্ হিসাবে? আর দিবে কোন্ ধন হইতে? ধানের বাড়া ধন নাই।
গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গাই, পুকুর ভরা মাছ; বাড়ির পাদাড়ে গাছা, বউ বেটির কোলে বাছা, গাইয়ের কোলে নই, লক্ষ্মী বলেন ওখানেই রই। আগেকার কালে এ সব ছিল ঘরে ঘরে। যদি না ছিল, তবে কথাটা আসিল কোথা হইতে? আজ এই পঞ্চগ্রামের মধ্যে এমন লক্ষণ শুধু শ্ৰীহরির ঘরে। কঙ্কণার বাবুদের লক্ষ্মী আছেন, কিন্তু এসব নাই। জংশনে লক্ষ্মী আছেন, কিন্তু সেখানকার লক্ষ্মীর লক্ষণ একেবারে স্বতন্ত্র। কঙ্কণার বাবুদের তবু জমি আছে, জমিদারি আছে। জংশনে আছে গদি, কল,ক্ষেত-খামারের সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ নাই। ধান সেখানে লক্ষ্মীই নয়, গাদা হইয়া পড়িয়া আছে, জুতা দিয়া উছলাইয়া ধান পরখ হয়, অমাবস্যা পূৰ্ণিমা তিথি বৃহস্পতিবার সকাল সন্ধ্যায় বিক্রয় হইতেছে। অথচ লক্ষ্মী সেখানে দাসীর মত খাঁটিতেছেন। চৈত্রলক্ষ্মীর ব্ৰতকথায় আছে লক্ষ্মী একবার এক ব্রাহ্মণের জমি হইতে দুইটি তিলফুল তুলিয়া কানে পরিয়াছিলেন, ইহার জন্য তাঁহাকে তিলসুনা খাঁটিতে হইয়াছিল ব্রাহ্মণের ঘরে। এই গদিওয়ালাদের কি ঋণ লক্ষ্মী করিয়াছেন কে জানে! …
একদল মাঠফেরত চাষী কলরব করিয়া পথ দিয়া যাইতেছিল। কলরব রোজই করে, আজ যেন কলরব কিছু বেশি। দেবু লণ্ঠনের আলোর শিখাটা কিছু বাড়াইয়া দিল। চাষীর দল দেবুর দাওয়ার সম্মুখে আসিয়া নিজেরাই দাঁড়াইল।
—পেনাম পণ্ডিত মশায়—পেনাম।
–বসে আছেন? সতীশ জিজ্ঞাসা করিল।
–হ্যাঁ।–দেবু বলিল–আজ গোল যেন বেশি মনে হল? ঝগড়াটগড়া হল নাকি কারুর সঙ্গে?
–আজ্ঞে না।
–ঝগড়া নয় আজ্ঞে।
–সতীশ আজ খুব বেঁচে গিয়েছে আজ্ঞে। উত্তেজিত স্বরে বলিল পাতু।
পাতু দুর্গার ভাই, সর্বস্বান্ত হইয়াছে, পেট ভরে না বলিয়া জাতি-ব্যবসা ছাড়িয়াছে। সে এখন মজুর খাটে। আজ ওই সতীশেরই ভাগের জমিতে মজুর খাঁটিতে গিয়াছিল।
—বেঁচে গিয়েছে? কি হয়েছিল?
আজ্ঞে সাপ। কালো কসকসে আলান। তা হাত দুয়েক হবে। সতীশ হাসিয়া বলিল-আজ্ঞে হ্যাঁ। কি করে, বুয়েছেন, মুখ ঢুকিয়েছিল বীজচারার খোলা অ্যাঁটির মধ্যে। আমি জানি না। অ্যাঁটিটা বাঁধবার লেগে ধরেছি চেপে, কষে চেপে ধরেছিলাম বুয়েছেন কিনা—লইলে ছাড়ত না। মুখে ধরেছি তো—হাত সটান করে মেলে পাক। দিলাম কাস্তেতে করে পেঁচিয়ে, কি করব?
ব্যাপারটা এমন কিছু অসাধারণ ভীষণ নয়, মাঠে কাল-কেউটে যথেষ্ট। প্রতি বৎসরই দুইচারিটা মারা পড়ে। মারা পড়ে অবশ্য এমনি ধারা একটা সাক্ষাৎ অনিবার্য সংঘর্ষ বধিলে, নতুবা তাহারা মাঠের আলের ভিতর থাকে। মাঠে চাষী চাষ করে, কেহই কাহাকেও অযাচিতভাবে আক্রমণ করে না। মারা পড়ে সাপই বেশি, কদাচিৎ মানুষ পরাজিত হয় দ্বন্দ্বের অসতর্ক মুহূর্তে।
পাতু বলিল—সতীশ দাদাকে এবার মা-মনসার থানে পাঁঠা দিতে হয়। কি বলেন?
সতীশ বলিল—সি হবে। চল চল তোরা এগিয়ে চল্ দেখি! আমি যাই। দলটি আগাইয়া চলিয়া গেল। সতীশ দাওয়াতে বসিল।
দেবু প্রশ্ন করিল—কিছু বলছ নাকি সতীশ?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনাকে না বললে আর কাকে বলি।
–বল।
–বলছিলাম আজ্ঞে, ধানের কথা।
দেবু বলিল—সেই তো ভাবছি সতীশ।
–আর তো আজ্ঞে, চলে না পণ্ডিতমশায়।
দেবু চুপ করিয়া রহিল।
সতীশ বলিল—এক আধ জনা লয়। পাঁচখানা গেরামের তামাম লোক। কুসুমপুরের শেখদের তো ইয়ার উপর পরব। আজ দেখলাম—একখানা হাল মাঠে আসে নাই।
দেবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল—উপায় তো একটা করতেই হবে সতীশ। দিনরাত্রি ভাবছি আমি। বেশি ভেবো না, যা হয় একটা উপায় হবেই।
সতীশ প্রণাম করিয়া বলিলব্যস, তবে আর ভাবনা কি? আপনি অভয় দিলেই হল।… সে চলিয়া গেল।
দেবু সন্ধ্যা হইতেই ভাবিতেছিল। সন্ধ্যা হইতেই কেন, কয়েকদিন হইতে এ ভাবনার তাহার বিরাম নাই। ওই জমাট-বস্তীর রাত্রির পরদিন হইতেই সে চিন্তান্বিত হইয়া পড়িয়াছে। ওই জমাট বস্তীর উদ্যোক্তা ভল্লারাই হউক বা হাড়িরাই হউক অথবা মুসলমান সম্প্রদায়ের অপরাধপ্রবণ ব্যক্তিরাই। হউক, এই উদ্যোগের মধ্যে তাহাদের অপরাধপ্রবণতা যেমন সত্য, উদরানের নিষ্ঠুর একান্ত অভাব তাহার চেয়ে বড় সত্য। অপরাধপ্রবণ ব্যক্তিগুলি সমাজের স্থায়ী বাসিন্দা, তাহারা বার মাসই আছে; দুর্যোগ, অন্ধকার—তাহাও আছে। কিন্তু এই অপরাধ তাহারা নিয়মিত করে না, বিশেষ করিয়া কার্তিক মাস হইতে ফায়ুন পর্যন্ত ডাকাতি হয় না। কার্তিক হইতে ফাল্গুন পর্যন্ত এ দেশে সকলেরই সচ্ছল অবস্থা। তখন ইহারা এই নৃশংস পাপ করা দূরে থাক্ব্ৰত করে, পুণ্য কামনা করিয়া স্বেচ্ছায় সানন্দে উপবাস করে, ভিক্ষুককে ভিক্ষা দেয়; ডাকাতের নাতি, ডাকাতের ছেলে—এই সব ডাকাতেরা তখন তো ডাকাতি করে না। অপরাধপ্রবণতা হইতেও অভাবের জ্বলাটাই বড়। মনে মনে সে লক্ষ্মীকে প্ৰণাম করিল। বলিলমা, তুমি রহস্যময়ী, তুমি থাকিলেও বিপদ, না থাকিলেও বিপদ। কঙ্কণায় তুমি বাধা আছ। সেখানে তোমারই জন্য বাবুদের ওই বাবু-মূর্তি! ওরা গরিবদের সর্বস্ব গ্রাস করে নানা ছলে–খাজনার সুদে, ঋণের সুদে, চক্রবৃদ্ধি হারের সুদে; এমনকি মানুষকে অন্যায় ভাবে শাসন করিবার জন্য মিথ্যা মামলা-মকদ্দমা করিতে তাহারা দ্বিধা করে না, এগুলোকে অধৰ্ম বলিয়া মনে করে না; তাহার মূলেও তুমি। আবার ভল্লারা ডাকাতি করে যাহারা কোনো পুরুষে কেহ ডাকাতি করে নাই, তেমন নূতন মানুষও ডাকাতের দলে যোগ দেয়, তাহার কারণ তোমার অভাব। মাগো, তোমার অভাবেই হতভাগ্যদের পাপবৃত্তি এমন করিয়া জাগিয়া উঠিয়াছে। জাগিয়া যখন উঠিয়াছে, তখন রক্ষা নাই। কোন দিন কোনো গ্রামে ডাকাতি হইল বলিয়া। এইজন্যই সে সেদিন তিনকড়ির বাড়ি গিয়াছিল। তিনকড়ির সঙ্গে দেখা হয় নাই, দেখা হইয়াছে তাহার মেয়েটির সঙ্গে। মেয়েটি যেমন শ্ৰীমতী, তেমনি বুদ্ধিমতী।
তিনকড়ির সঙ্গে দেখা না হইলেও দেখুড়িয়ার নিদারুণ অভাবের ব্যাপার সে স্বচক্ষে দেখিয়া আসিয়াছে। শুধু দেখুড়িয়ায় নয়—অভাব সমগ্ৰ অঞ্চলটায়। অথচ এমন সুবর্ষায় চাষীদের ধানের অভাব হওয়ার কথা নয়; মহাজন যাচিয়া ধান ঋণ দেয়। এবার ধর্মঘটের জন্য মহাজনরা ধান বাড়ি দেওয়া বন্ধ করিয়াছে। শ্ৰীহরির তো বন্ধ করিবারই কথা। ভাতে মারিয়া প্রজাদের কায়দা করিতে চায়। কঙ্কণার বাবুদের বন্ধ করিবার কারণও তাই। অন্য মহাজনে বন্ধ করিয়াছে জমিদারের ভয়ে এবং কায়দা করিয়া বেশি সুদ আদায়ের জন্য। তাহা ছাড়া দাদন পড়িয়া যাইবার ভয় আছে। সকল গ্রাম হইতেই চাষীরা আসিতেছে—কি করা যায় পণ্ডিত?
দেবু কি উত্তর দিবে?
তাহারা তবু বলে—একটা উপায় কর, নইলে চাষও হবে না, ছেলেমেয়েগুলানও না খেয়ে মরবে।
সতীশকে আজ সে অভয় দিয়া ফেলিল অকস্মাৎ। সতীশ খুশি হইয়া চলিয়া গেল। কিন্তু দেবু অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করিয়া চঞ্চল হইয়া উঠিল। দায়িত্ব যেন আরও গুরুভার হইয়া উঠিয়াছে বলিয়া মনে হইল তাহার।
হঠাৎ গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে অত্যন্ত সবল কোনো ব্যক্তি সশব্দ পদক্ষেপে অদূরের বাকটা ফিরিয়া দেবুর দাওয়ার সম্মুখে দাঁড়াইল। মাথায় পাগড়ি, হাতে লাঠি থাকিলেও তিনকড়িকে চিনিতে দেবুর বিলম্ব হইল না। সে ব্যস্ত হইয়া বলিল—তিনু-কাকা! আসুন, আসুন।
তিনু দাওয়ায় উঠিয়া সশব্দে তক্তপোশটার উপর বসিল, তারপর বলিল হ্যাঁ, এলাম। স্বন। বলছিল, তুমি সেদিন গিয়েছিলে। তা কদিন আর সময় করতে কিছুতেই পারলাম না।
দেবু বলিল-হা কথা ছিল একটু।
—বল। তোমার সঙ্গে আমারও কথা আছে।
দেবু একটু ইতস্তত করিয়া বলিল—সেদিন জমাট-বস্তীর কথা জানেন?
–হ্যাঁ জানি। বেটাদিগে আমি খুব শাসিয়ে দিয়েছি। তোমার কাছে বলতে বাধা নাই, এ ওই ভল্লা বেটাদের কাজ।
—শ্ৰীহরি থানাতে আপনার নামেও বোধহয় ডায়রি করেছে।
তিনকড়ি হা-হা করিয়া হাসিয়া সারা হইল; হাসি খানিকটা সংবরণ করিয়া বলিল-আমার উ কলঙ্কিনী নাম তো আছেই বাবাজী, উ আমি গেরাহ্যি করি না। ভগবান আছেন। পাপ যদি না করি আমি, কেউ আমার কিছু করতে পারবে না।
দেবু একটু হাসিল; তারপর বলিল—সে কথা ঠিক; কিন্তু তবু একটু সাবধান হওয়া ভাল।
–সাবধান আর কি বল? চাষবাস করি, খাঁটি-খুটি, খাই-দাই ঘুমোই! এর চেয়ে আর কি সাবধান হব?
এ কথার উত্তর দেবু দিতে পারি না, সত্যিই তো, সৎপথে থাকিয়া যথানিয়মে সংসারযাত্রা নিৰ্বাহ করিয়া যাওয়া সত্ত্বেও যদি তাহার উপর সন্দেহের বোঝা চাপাইয়া দেওয়া হয়, তবে সে কি করিবে? সৎপথে সংসার করার চেয়ে আর বেশি সাবধান কি করিয়া হওয়া যায়।
—উ বেটা ছিরে যা মনে লাগে করুক। না হয় জেলই হবে। বেটারা বি-এল করার তালে আছে, সে আমি জানি। উ জন্যে আমি ভাবি না। গৌর আমার বড় হয়েছে; দিব্যি সংসার চালাতে পারবে। জেলের ভাতই না হয় খেয়ে আসব কিছুদিন।—বলিয়া তিনকড়ি আবার হা-হা করিয়া পরুষ হাসি হাসিয়া উঠিল।
দেবু বুঝিল, তিনকড়ি কিছু উত্তেজিত হইয়া আছে। সঙ্গে সঙ্গে সে-ও একটু সিল।
হঠাৎ তিনকড়ির হাসি থামিয়া গেল। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সে বলিলভাগবানটগবান একদম মিছে কথা দেবু। নইলে তোমার সোনার সংসার এমনি করে ভেঙে যায় না। আমার স্বপ্নর মত সোনার পিতিমে সাত বছরে বিধবা হয়? আমি ওই পাথরটার লেগে কি কম করলাম? কি হল? আমারই টাকাগুলান গেল—জমি গেল। আমি বেটা গাধা বনে গেলাম। ভগবান-টগবান মিছে কথা, শুধু ফাঁকি, ফাঁকি!
দেবু শ্রদ্ধার সঙ্গে তিরস্কার করিয়া বলিল—ছিঃ তিনু-কাকা, আপনার মত লোকের ও কথা মুখ দিয়ে বের করা উচিত নয়।
—কেনে?
–ভগবানকে কি ওই সামান্য ব্যাপারে চেনা যায়? দুঃখ দিয়ে তিনি মানুষকে পরীক্ষা করেন।
—আহা-হা! তোমার ভগবান তো বেশ রসিক নোক হে! কেনে, সুখ দিয়ে পরীক্ষে করুন। না কেনে? দুখ দিয়ে পরীক্ষে করার শখ কেনে?
—তাও করেন বৈকি। ওই কঙ্কণার বাবুদিগে দেখুন। সুখ দিয়ে পরীক্ষা করছেন সেখানে।
–তাতে তাদের খারাপটা কি হয়েছে?
–কিন্তু আপনি কি কঙ্কণার বাবুদের মত হতে চান? ওই সব বাবুদের মতন শয়তান, চরিত্রহীন, পাষণ্ড? দেশের লোকে গাল দিচ্ছে। মরণ তাকিয়ে রয়েছে। যারা মলে দেশের লোকে বলবে পাপ বিদেয় হল, বাঁচলাম। তিনু-কাকা, মরলে যার জন্যে লোকে কাঁদে না-হাসে, তার চেয়ে হতভাগা কেউ আছে! কানা, খোঁড়া—দুনিয়াতে যার কেউ নাই, সে পথে পড়ে মরে, তাকে দেখেও লোকের চোখে জল আসে। আর যাদের হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ টাকা, জমিদারি, তেজারতি, লোক-লস্কর, হাতি-ঘোড়া, তারা মরে গেলে লোকে বলে-বাঁচলাম। এইবার ভেবে দেখুন মনে।
তিনকড়ি এবার চুপ করিয়া রহিল। দেবুর তীক্ষ্মস্বরের ওই কথাগুলো অন্তরে গিয়া তাহার অভিমান-বিমুখ ভগবৎপ্রীতিকে তিরস্কারে সান্ত্বনার আবেগে অধীর করিয়া তুলিল। কিন্তু আবেগোচ্ছ্বাসে সে অত্যন্ত সংযত মানুষ। স্বর্ণ যেদিন বিধবা হয় সেদিনও তাহার চোখে একফোঁটা জল কেহ দেখে নাই। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সে শুধু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। তারপর বলিল–তোমার ভাল হবে বাবাজী, তোমার ভাল হবে। ভগবান তোমাকে দয়া করবেন।
দেবু চুপ করিয়া রহিল।
তিনকড়ি বলিল—শোন, তোমার কাছে কি জন্য এসেছি, শোন।
—বলুন।
–ধানের কথা।
দেবু ম্লান হাসিয়া বলিল-ধানের উপায় তো এখনও কিছু দেখতে পাচ্ছি না তিনু-কাকা। দু-চারজন নয়, পাঁচখানা গাঁয়ের লোক।
কুসুমপুরের মুসলমানেরা ধানের যোগাড় করেছে। ধান নয়, টাকা। টাকা দান নিয়ে ধান কিনে নিয়ে এল। আজ মাঠে শেখেদের একখানা হালও আসে নাই।
দেবু বিস্মিত হইয়া গেল।
তিনকড়ি বলিল জংশনের কলওয়ালারা টাকা দিলে, ধান কিনলে গদিওয়ালাদের কাছে। কলওয়ালারা চাল দিতেও রাজি আছে। তবে তাতে ভানাড়ীর খরচ বাদ যাবে তা; তা ছাড়া তুষ, কুঁড়ো। আর তোমার ধর—কলের চাল কেমন জলজল, উ আমাদের মুখে রুবে না। তার চেয়ে টাকাই ভাল।
দেবু বলিল—কুসুমপুরের সব কলে দাদন নিলে?
–হ্যাঁ। দশ-পনের, বিশ-পঁচিশ যে যেমন লোক। আজ কদিন থেকেই ঠিক করেছে, কাউকে বলে নাই। তা আমি সেদিন ওদের মজলিসে ছিলাম। শুনে এসেছিলাম।
দেবু বলিলতাই তো! সে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।
–আমিও গিয়েছিলাম বাবাজী, কথাবার্তা বলে এলাম। তুমি বরং চল কাল-পরশু। আমি বলে এসেছি তোমার নাম। তা বললে—তার দরকার কি? তোমাদের কথা তোমরা নিজেরাই বল। দেবু পণ্ডিত টাকা নেবে না। সে একা লোক তার ঘরে ধানও আছে।
–আমার সঙ্গে কলওয়ালাদের দেখা হয়েছে তিনু-খুড়ো। আমার কাছে তো লোক। পাঠিয়েছিল।
—তোমার সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছে?
–হয়েছে। আমি রাজি হতে পারি নি।
–কেনে?
–হিসেব করে দেখেছেন, কি দেনা ঘাড়ে চাপছে? আমি হিসেব করে দেখেছি দেড়া সুদে ধান—বাড়ির চেয়ে ঢের বেশি। দাদনের টাকায় যে ধান কিনবেন, পৌষে ধান বিক্রি করবার সময় ঠিক তার ডবল ধান লাগবে।
–কিন্তু তা ছাড়া উপায় কি বল?
দেবু কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল—ভেবে কিছু ঠিক করতে পারি নি তিনু-কাকা।
–কিন্তু ই-দিকে যে পেটের ভাত ফুরিয়ে গেল! মুনিষ-মান্দের ধান-ধান করে মেরে ফেললে! ভল্লা বেটাদেরই বা রাখি কি করে?
–আজ আপনাকে কিছু বলতে পারলাম না তিনু-কাকা। কাল একবার আমি ন্যায়রত্ন মশায়ের কাছে যাব। তারপর যা হয় বলব।
তিনকড়ি একটা দীৰ্ঘনিশ্বাস ফেলিল। জংশন হইতে সে খুব খুশি হইয়াই আসিতেছিল। সে খুশির পরিমাণটা এত বেশি যে, এই রাত্রেই কথাটা সে দেবুকে জানাইবার প্রলোভন সংবরণ করিতে পারে নাই। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়াই সে বলিল—তবে আজ আমি উঠি।
দেবু নিজেও উঠিয়া দাঁড়াইল।
তিনকড়ি দাওয়া হইতে নামিয়া, আবার ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল—আর একটা কথা বাবাজী।
—বলুন।
–আমার মেয়ে স্বপ্নর কথা। তুমি দেখেছ তাকে সেদিন?
–হ্যাঁ। বড় ভাল লাগল আমার, ভারি ভাল মেয়ে।
–পড়া-টড়া একটুকুন ধরেছিলে নাকি? বলতে-টলতে পারলে?
দেবু অকপট প্রশংসা করিয়া বলিল—মেয়েটি আপনার খুব বুদ্ধিমতী; নিজেই যা পড়াশুনা করেছে দেখলাম, তাতেই ইউ-পি পরীক্ষা দিলে নিশ্চয়ই বৃত্তি পায়।
তিনু উদাসকণ্ঠে বলিল-আমার অদৃষ্ট বাবা, ওকে নিয়ে যে আমি কি করব, ভেবে পাই না। তা স্বপ্ন যদি বিত্তি পরীক্ষা দেয়-ক্ষতি কি?
–কিসের ক্ষতি? আমি বলছি তিনু-কাকা, তাতে মেয়ের আপনার ভবিষ্যৎ ভাল হবে। তিনু তাহার হাত দুইটা চাপিয়া ধরিল।—তা হলে বাবা, মাঝে মাঝে গিয়ে একটুকুন দেখিয়ে শুনিয়ে দিতে হবে তোমাকে।
—বেশ, মধ্যে মধ্যে যাব আমি।
তিনু খুশি হইয়া বলিল–ব্যস্—ব্যস্। স্বপ্ন তা হলে ফাস্টো হবে—এ আমি জোর গলায় বলতে পারি।
তিনু চলিয়া গেল। লণ্ঠনটা স্তিমিত করিয়া দিয়া দেবু আবার ভাবিতে বসিল। রাজ্যের লোকের ভাবনা। খাজনা বৃদ্ধির ব্যাপারটা লইয়া দেশের লোক ক্ষেপিয়া উঠিয়াছে। তিনকড়ি আজ যে পথের কথা বলিল, সে পথে লোকের নিশ্চিত সর্বনাশ! সে চোখের উপর তাদের ভবিষ্যৎ স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছে। এ সর্বনাশের নিমিত্তের ভাগী হইতে হইবে তাহাকে।
পাতু যথানিয়মে সস্ত্রীক শুইতে আসিয়াছে। সে জিজ্ঞাসা কলিল-দুগ্গা আসে নাই পণ্ডিত?
–কই, না।
–আচ্ছা বজ্জাত যাহোক। সেই সধে বেলায় বেরিয়েছে—
ঘোমটার ভিতর হইতে পাতুর বউ বলিল—রোজগেরে বুন রোজকার করতে গিয়েছে।
পাতু একটা হুঙ্কার দিয়া উঠিল। বলিল হারামজাদী, তুই এতক্ষণ কোথা ছিলি? ঘোষালের কাও বুঝি কেউ জানে নানা?
দেবু বিরক্ত হইয়া ধমক দিল-পাতু!
পণ্ডিত মশাই?—মৃদুস্বরে কে অদূরস্থ গাছতলাটা হইতে ডাকিল।
–কে?
–আমি তারাচরণ!-মৃদুস্বরেই তারাচরণ উত্তর দিল।
–তারাচরণ? কি রে?–দেবু উঠিয়া আসিল।
তারাচরণ নাপিতের কথাবার্তার ধরনই এইরূপ। কথাবার্তা তাহার মৃদুস্বরে। যেন কত গোপন কথা সে বলিতেছে। গোপন কথা শুনিয়া ও বলিয়াই অবশ্য অভ্যাসটা তাঁহার এইরূপ হইয়াছে। সে নাপিত, প্রত্যেক বাড়িতেই তাহার অবাধ গতি। এই যাতায়াতের ফলে প্রত্যেক বাড়িরই কিছু গোপন তথ্য তাহার কানে আসে। সেই তথ্য সে প্রয়োজনমত অন্যের কাছে বলিয়া, মানুষের ঈর্ষাশাণিত কৌতুহল-প্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করিয়া আপনার কার্যোদ্ধার করিয়া লয়। আবার তাহারও গোপন মনের কথা জানিয়া লইয়া অন্যত্র চালান দেয়। এ অঞ্চলটার সকল গোপন তথ্য সর্বাগ্রে জানিতে পারে সে-ই। থানার দারোগা হইতে ছিরু ঘোষ, আবার দেবু ঘোষ হইতে তিনকড়ি মণ্ডল—এমনকি মহাগ্রামের ন্যায়রত্ন মহাশয়েরও সুখ-দুঃখের বহু গোপন কথা তাহার জানা আছে। তাহাকে সকলেই সন্দেহের চক্ষে দেখে—তারাচরণ হাসে; সন্দেহের চোখে দেখিয়াও ধূর্ত তারাচরণের কাছে আত্মগোপন তাহারা করিতে পারে না। কিন্তু সারা অঞ্চলটার মধ্যে দুইটি ব্যক্তিকে তারাচরণ শ্রদ্ধা করে—একজন মহাগ্রামের ন্যায়রত্ন মহাশয়, অপরজন পণ্ডিত দেবু ঘোষ।
দেবু কাছে আসিতেই তারাচরণ মৃদুস্বরে বলিল রাঙাদিদির শেষ অবস্থা। একবার চলুন।
–রাঙাদিদির শেষ অবস্থা! কে বললে?
—গিয়েছিলাম আজ্ঞে, ঘোষ মশায়ের কাছারিতে। ফিরছি-পথে দুৰ্গর সাথে দেখা হল। বললেরাঙাদিদির নাকি ভারি অসুখ। আপনাকে একবার যেতে বললে।
রাঙাদিদি নিঃসন্তান, চাষী সাগোপদের কন্যা। এখন সে প্রায় সত্তর বৎসর বয়সের বৃদ্ধা। দেবুদের বয়সীরা তাহাকে রাঙাদিদি বলিয়া ডাকে, সেই বৃদ্ধা মরণাপন্ন। দেবু পাতুকে বলিল–পাতু, তুমি শুয়ে পড়। আমি আসছি।
রাঙাদিদির সঙ্গে তাহার একটি মধুর সম্বন্ধ ছিল। সে যখন চণ্ডীমণ্ডপে পাঠশালা করিত, তখন। বৃদ্ধা স্নানের সময় নিয়মিত একগাছি ঝাটা হাতে আসিয়া চণ্ডীমণ্ডপটি পরিষ্কার করিয়া দিত। এই ছিল তাহার পারলৌকিক পুণ্য সঞ্চয়ের কর্ম। বৃদ্ধার সঙ্গে তাহার সুখ-দুঃখের কত কথাই হইত। সেটেলমেন্টের হাঙ্গামার সময় সে যেদিন গ্রেপ্তার হয়, সেদিন বৃদ্ধার ভাবাবেগ তাহার মনে পড়িল। সে জেলে গেলে বিলুর খোঁজ-খবর সে নিয়মিতভাবে লইয়াছে। নিকটতম আত্মীয়-স্বজনের মত গভীর অকপট তাহার মমতা, বিলুর মৃত্যুর পর সমস্ত দিন তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বসিয়া থাকিত। তাহার ঘোলা চোখের সেই সজল বেদনাপূর্ণ দৃষ্টি সে জীবনে ভুলিতে পরিবে না।
পিছন হইতে তারাচরণ বলিল—একটুকুন ঘুরে যাওয়াই ভাল পণ্ডিতমশায়।
–কেন?
–ঘোষের কাছারির সামনে দিয়ে গেলে গোলমাল হয়ে যাবে।
—গোলমাল?—দেবু বিস্মিত হইয়া গেল। একটা মানুষ মরিতেছে, সেখানে গোলমালের ভয় কিসের? আত্মীয়স্বজনহীনা বৃদ্ধা মরিতে বসিয়াছে তাহার আজ কত দুঃখ, সে কাহাকেও রাখিয়া যাইতেছে না। মৃত্যুর পর এ সংসারে কেহ তাহার নাম করিবে না, তাহার জন্য একফোঁটা চোখের জল ফেলিবে না। আজ তো সারা গাঁয়ের লোকের ভিড় করিয়া তাহার মৃত্যুশয্যা পার্শ্বে আসা উচিত; বুড়ি দেখিয়া যাক গোটা গ্রামের লোকই তাহার আপনার ছিল। সে বলিল-এর মধ্যে লুকোচুরি কেন তারাচরণ? গোলমালের ভয় কিসের?
একটু হাসিয়া তারাচরণ বলিল—আছে পণ্ডিত মশাই। বুড়ির তো ওয়ারিশ নাই। মলেই শ্ৰীহরি ঘোষ এসে চেপে বসবে, বলবে বুড়ি ফৌত হয়েছে; ফৌত প্রজার বিষয়সম্পত্তি টাকাকড়ি সমস্ত কিছুরই মালিক হল জমিদার। আসুন, এই গলি দিয়ে আসুন।
কথাটায় দেবুর খেয়াল হইল। তারাচরণ ঠিক বলিয়াছে খাঁটি মাটির মানুষ সে, অদ্ভুত তাহার হিসাব, অদ্ভুত তাহার অভিজ্ঞতা। ওয়ারিশহীন ব্যক্তির সম্পত্তি জমিদার পায় বটে। আসলে প্রাপ্য রাজার বা রাজশক্তির; কিন্তু এদেশে জমিদারকে রাজশক্তি এমনভাবে তাহার অধিকার সমৰ্পণ করিয়াছে যে, হক-হুকুম, অধঃ-উৰ্ব্ব সবেরই মালিক জমিদার। জমি চাষ করে প্ৰজা, সেই প্ৰজার নিকট হইতে খাজনা সংগ্রহ করিয়া দেয় জমিদার। কাজ সে এইটুকু করে। কিন্তু জমির তলায় খনি উঠিলে জমিদার পায়, গাছ জমিদার পায়, নদীর মাছ জমিদার পায়। জমিদার খায়দায়, ঘুমায়, অনুগ্রহ করিয়া কিছু দান ধ্যান করে। কেহ নদীর বন্যা রোধের জন্য বাঁধ বাঁধিতে খরচ দেয়, সেচের জন্য দিঘি কাটাইয়া দেয়; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দাবি করে, খাজনাবৃদ্ধি তাহার প্রাপ্য হইয়াছে।
যাহার ওয়ারিশ নাই—তাহার সম্পত্তির আসল মালিক দেশের লোক। দেশের লোকের সকল সাধারণ কাজের ব্যবস্থা করে তাহাদেরই প্রতিনিধি হিসাবে রাজা বা রাজশক্তি; সেই কারণে সকল সাধারণ সম্পত্তির মালিক ছিল রাজা। সেইজন্য চণ্ডীমণ্ডপ সাধারণে তৈয়ারি করিয়াও বলিত রাজার চণ্ডীমণ্ডপ, সেইজন্য দেবতার সেবাইত ছিলেন রাজা, সেইজন্য ফৌত প্রজার সম্পত্তি যাইত রাজসরকারে। এসব কথা দেবু ন্যায়রত্ন এবং বিশ্বনাথের কাছে শুনিয়াছে। তাহাদের কপাল! আজ রাজা জমিদারকে তাহার সমস্ত অধিকার দিয়া বসিয়া আছেন। জমিদার দিয়াছে পত্তনিদারকে। দেবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। কিন্তু আজ সে এমন গোপনে যাইবে কোন অধিকারে? সে থমকিয়া দাঁড়াইল।
তারাচরণ বলিলপণ্ডিত আসুন।
গলিটার ও-মাথা হইতে কে বলিল—পরামানিক, পণ্ডিত আসছে? দুর কণ্ঠস্বর।
তারাচরণ বলিল–দাঁড়ালেন কেন গো?
—আরও দু-চারজনকে ডাক তারাচরণ।
–ডাকবে পরে। আগে তুমি এস জামাই—দুর্গা আগাইয়া আসিল।
দেবু বলিল—কিন্তু তুই জুটলি কি করে?
মৃদুস্বরে দুর্গা বলিল-কামার-বউয়ের বাড়ি এসেছিলাম। কদিন থেকেই একটুকুন করে জ্বর হচ্ছিল রাঙাদিদির; কামার-বউ যেত-আসত, মাথার গোড়ায় একঘটি জল ঢেকে রেখে আসত। রাঙাদিদিও কামার-বউয়ের অসময়ে অনেক করেছে। আমি দুধ দুয়ে দিতাম দিদির গরুর, বউ। জ্বাল দিয়ে দিয়ে আসত। বাকিটা আমি বেচে দিতাম। আজ দুপুরে গেলাম তো দেখলাম বুড়ির শ নাই জ্বরে। কামার-বউ কপালে হাত দিয়ে দেখলে খুব জ্বর। বিকেলে যদি দুজনায় দেখতে গেলাম তো দেখি পাতি লেগে বুড়ি পড়ে আছে। চোখ-মুখে জল দিতে দিতে দাতি ছাড়ল, কিন্তু বিগার বকতে লাগল। এখন গলগলিয়ে ঘামছে, হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে।
দেবু বলিল—ডাক্তারকে ডাকতে হয়। তারাচরণ, তুমি যাও জগন ভাইকে ডেকে আন আমার নাম করে।
—না।—বাধা দিয়া দুর্গা বলিল-আমরা বলেছিলাম, তা রাঙাদিদি বারণ করলে।
–বারণ করলে? এখন জ্ঞান হয়েছে নাকি?
–হ্যাঁ, খানিক আগে থেকে জ্ঞান হয়েছে। বললে ডাক্তার কোবরেজে কাজ নাই দুগ্গা, তুই আর ছেনালি করি না। ডাকবি তো দেবাকে ডাক। তা কামার-বউকে একা ফেলে যেতেও পারি না, লোকও পাই না তোমাকে ডাকতে। শেষে পরামানিককে ডেকে বললাম।
দেবু একটু চিন্তা করিয়া বলিল না তারাচরণ, তুমি ডাক্তারকে ডাক একবার।
বুড়ির শেষ অবস্থাই বটে। হাত-পায়ের গোড়ার দিকটা বরফের মত ঠাণ্ডা। ঘোলা চোখ দুইটি আরও ঘোলাটে হইয়া আসিয়াছে। মাথার শিয়রে তাহার মুখের দিকে পদ্ম বসিয়া ছিল, দেবুকে দেখিয়া সে অবগুণ্ঠন টানিয়া দিল। তাহার জীবনেও এই বৃদ্ধা অনেকখানি স্থান জুড়িয়া ছিল। প্রায়ই খোঁজ-খবর করিত, গালিগালাজও দিত, আবার নুন, তেল, ডাল-পদ্মর যখন যেটার হঠাৎ অভাব পড়িত, আসিয়া ধার চাহিলেই দিত; শোধ দিলে লইত, কিন্তু বিলম্ব হইলে কখনও কিছু বলিত না। নিজের বাড়িতে শশা, কলা, লাউ যখন যেটা হইত-বুড়ি তাহাকে দিত। বুড়ি যখন যাহা খাইতে ইচ্ছা করিত-তাহার উপকরণগুলি আনিয়া পদ্মের দাওয়ায় রাখিয়া দিয়া বলিত—আমাকে তৈরী করে দিস। উপকরণগুলি তাহার একার উপযুক্ত নয়; দুই-তিনজনের উপযুক্ত উপকরণ দিত। বৃদ্ধা আজীবন দুধ বেচিয়া, ঘুঁটে বেচিয়া, ছাগল-গরু পালন করিয়া, বেচিয়া বেশ কিছু সঞ্চয় করিয়াছে। অবস্থা তাহার মোটেই খারাপ নয়। লোকে বলে বুড়ির টাকা অনেক। হায়দার শেখ পাইকার হিসাব দেয়—আমি রাঙাদির ঠেনে পাঁচ-পাঁচটা বলদ-বাছুর কিনেছি। পাঁচটাতে তিনশো টাকা দিছি। ছাগল-বকনা তো হামেশাই কিনেছি। উয়ার টাকার হিসাব নাই। দেবু আসিয়া পাশে বসিয়া ডাকিল রাঙাদিদি।
দুর্গা বলিল—জোরে ডাক, আর শুনতে পাচ্ছে না।
দেবু জোরেই ডাকিল রাঙাদিদি! রাঙাদিদি!
বুড়ি স্তিমিত দৃষ্টিতে তাহার মুখের দিকে চাহিয়াছিল, দেখিয়া দেবু বলিল-আমি দেব। বুড়ির দৃষ্টিতে তবু কোনো পরিবর্তন ঘটিল না। দেবু এবার কানের কাছে কণ্ঠস্বর উচ্চ করিয়া বলিল আমি দেবা, রাঙাদিদি! দেবা!
এবার বুড়ি ক্ষীণ মৃদুস্বরে থামিয়া থামিয়া বলিল—দেবা! দেবু-ভাই!
–হ্যাঁ।
বুড়ি মৃদু হাসিয়া বলিল-আমি চললাম দাদা।
পরক্ষণেই তাহ র পাণ্ডুর ঠোঁট দুইখানি কাঁপিতে লাগিল, ঘোলাটে চোখ দুইটি জলে ভরিয়া উঠিল; সে বলিল—আর তোদিকে দেখতে পাব না।… একটু পরে বিচিত্ৰ হাসি হাসিয়া বলিল–বিলুকে—তোর বিলুকে কি বলব বল্; সেখানেই তো যাচ্ছি!