শ্ৰীহরি ঘোষ বাড়ি ফিরিয়া বাকি রাত্রিটা জাগিয়া কাটাইয়া দিল। কিছুতেই ঘুম আসিল না, জমাট-বস্তী দেখিয়া সে চিন্তিত হইয়া পড়িয়াছে। তাহার মনে হইতেছে—এই পঞ্চগ্রামের সমস্ত লোক তাহার বিরুদ্ধে কঠিন আক্ৰোশে ষড়যন্ত্ৰ করিয়া তাহাকে ঘিরিয়া ফেলিতে চাহিতেছে। তাহারা তাহাকে পিষিয়া মারিয়া ফেলিতে চায়। পরশ্ৰীকাতর হিংসুক লোভীর দল সব! পূর্বজন্মের পুণ্যফলে, এ জন্মের কর্মফলে মা-লক্ষ্মী তাহার উপর কৃপা করিয়াছেন—তাহার ঘরে আসিয়া পায়ের ধূলা দিয়াছেন, সে অপরাধ কি তাহার? সে কি লক্ষ্মীকে অপরের ঘরে যাইতে বারণ করিয়াছে? সে এই অঞ্চলের জন্য তো কম কিছু করে নাই? প্রাইমারি স্কুলের ঘর করিয়া দিয়াছে, রাস্তা করিয়াছে, কুয়া করিয়াছে, পুকুর কাটাইয়াছে, মাটির চণ্ডীমণ্ডপও সে-ই পাকা করিয়া দিয়াছে, লোকের পিতৃ-মাতৃদায়ে, কন্যাদায়ে, অভাব অনটনে সে-ই টাকা ঋণ দেয়, ধান। বাড়ি দেয়। অকৃতজ্ঞের দল সে কথা মনে করে না। তাহার বিরুদ্ধে কে কি বলে—সে সব খবর রাখে।
অকৃতজ্ঞেরা বলে ইউনিয়ন বোর্ডের স্কুল-ঘর, বোর্ডই তৈরি করে দিত। আমরাও তো ট্যাক্স দি। …
ওরে মূর্খের দল-ট্যাক্স থেকে কটা টাকা ওঠে?
বলে–নইলে ছেলেরা আমাদের গাছতলায় পড়ত।…
তাই উচিত ছিল।
রাস্তা সম্বন্ধেও তাহাদের ওই কথা।
চণ্ডীমণ্ডপ সম্বন্ধে বলে ওটা তো শ্রীহরি ঘোষের কাছারি।
কাছারি নয়—শ্ৰীহরি ঘোষের ঠাকুরবাড়ি। চণ্ডীমণ্ডপ যখন জমিদারের, আর সে যখন গ্রামের জমিদারি স্বত্ব কিনিয়াছে—তখন একশোবার তাহার। আইন যখন তাহাকে স্বত্ব দিয়াছে, সরকার যখন আইনের রক্ষক, তখন সে স্বত্ব উচ্ছেদ করিবার তোরা কে? দেবু ঘোষের বাড়ির মজলিশে মহাগ্রামের ন্যায়রত্ন মহাশয়ের নাতি নাকি বলিয়াছে—চণ্ডীমণ্ডপের সৃষ্টিকালে জমিদারই ছিল না, তখন চণ্ডীমণ্ডপ তৈয়ারি করিয়াছিল গ্রামের লোকে, গ্রামের লোকেরই সম্পত্তি ছিল চণ্ডীমণ্ডপ। ন্যায়রত্ন মহাশয় দেবতুল্য ব্যক্তি, কিন্তু তাঁহার এই নীতিটির পাখনা গজাইয়াছে। পুলিশ তাহার প্রতি পদক্ষেপের খবর রাখে। চণ্ডীমণ্ডপ যদি গ্রামের লোকেরই ছিল, তবে জমিদারকে তাহারা দখল করিতে দিল কেন?
পুকুর কাটাইয়াছে শ্ৰীহরি; লোকে পুকুরের জল খায়, অথচ বলে জল তো ঘোষের নয়, জল মেঘের। শ্ৰীহরি মাছ খাবার জন্যে পুকুর কাটিয়াছে, আম-কাঁঠাল খাবার জন্যে চারিদিকে বাগান লাগিয়াছে—আমাদের জন্যে নয়। বারণ করে, খাব না পুকুরের জল। …
বারণই তাহার করা উচিত। না; তাহা সে কখনও করিবে না। আবার পরজন্ম তো আছে। জন্মান্তরেও সে এই পুণ্য লইয়া জন্মগ্রহণ করিবে। আগামী জন্মে সে রাজা হইবে।
ঋণের জন্য তাহারা বলে–ঋণ দেয়, সুদ নেয়।
আশ্চর্য কথা, অকৃতজ্ঞের উপযুক্ত কথা! ওরে, সেই বিপদের সময় দেয় কে? ঋণ লইলেই সুদ দিতে হয় এই আইনের কথা, শাস্ত্রের কথা। উঃ, পাষণ্ড অকৃতজ্ঞের দল সব! …
চিন্তা করিতে করিতে শ্ৰীহরি তিন করুে তামাক খাইয়া ফেলিল। আজকাল তামাক তাহাকে নিজে সাজিতে হয় না, তাহার স্ত্রীও সাজে না; বাড়িতে এখন শ্রীহরি চাকর রাখিয়াছে, সেই সাজিয়া দেয়।
সকালে উঠিয়াই সে জংশন-শহরে রওনা হইল। গতরাত্রে জমাট-বস্তির কথা থানায় ডায়রি করিবে; লোক পাঠাইয়া কাজটা করিতে তাহার মন উঠিল না। কর্মচারী ঘোষ অবশ্য পাকা লোক, তবুও নিজে যাওয়াই সে ঠিক মনে করিল। সংসারে অনেক জিনিসই ধারে কাটে বটে, কিন্তু ভার না থাকিলে অনেক সময়ই শুধু ধারে কাজ হয় না। ক্ষুদ্র পেঁাচ দিয়ে নালী কোটা যায়, কিন্তু বলিদান দিতে হলে গুরু-ওজনের দা চাই। সে নিজে গেলে দারোগা জমাদার বিষয়টার উপর যে মনোযোগ দিবে, ঘোষ গেলে তাহার শতাংশের একাংশও দিবে না।
টাপর বাঁধিয়া গরুর গাড়ি সাজানো হইল। জংশন শহরে আজকাল পায়ে হাঁটিয়া যাওয়া আসা সে বড় একটা করে না। গাড়ির সঙ্গে চলিল কালু শেখ। কালু শেখ মাথায় পাগড়ি বাঁধিয়াছে। গাড়ির মধ্যে শ্ৰীহরি লইয়াছে কিছু ডাব, এক কাঁদি মর্তমান কলা, দুইটি ভাল কাঁঠাল। বড় আকারের হৃষ্টপুষ্ট বলদ দুইটা দেখিতে ঠিক একরকম, দুইটার রঙই সাদা, গলায় কড়ির মালার সঙ্গে পিতলের ছোট ছোট ঘণ্টা বাধা। টুং-টাং ঘণ্টা বাজাইয়া গাড়ি বাঁধে বলদ দুইটা জোর কদমে চলিল।
শ্ৰীহরি ভাবিতেছিল ডায়রির ভিতর কোন কোন লোকের নাম দিবে সে? তিনকড়ির নাম তো দিতেই হইবে। থানার দারোগা নিজেই ও-নামটার কথা বলিবে। পুলিশ কর্তৃপক্ষ নাকি পুনরায় তিনকড়ির বিরুদ্ধে বি-এল কেসের জন্য প্রস্তুত হইতেছেন। দারোগা নিজে বলিয়াছে, লোকটা যদি নিজে ডাকাত না হয়, ডাকাতির মালও যদি না সামলায়, তবুও ও যখন ভল্লাদের কেসের তদ্বির করে, তখন যোগাযোগ নিশ্চয় আছে।
ভল্লাদের মধ্যে রামভল্লা নেতা। অন্য ভল্লাদের নাম তদন্ত করিয়া পুলিশই বাহির করিবে। আর কাহার নাম? রহম শেখ? ও লোকটাও পুলিশের সন্দেহভাজন ব্যক্তি। ভল্লা না হইলেও–ভল্লাপ্রধান ডাকাতের দলে না থাকিতে পারে এমন নয়। প্রজা-ধর্মঘটের ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে ওই লোকটার প্রচণ্ড উৎসাহ এবং লোকটা পাষণ্ডও বটে। সুতরাং ধর্মঘটীদের মধ্যে দুর্ধর্ষ। পাষণ্ড যাহারা, তাহারা যদি এই সুযোগে তাহার বাড়িতে ডাকাতির মতলব করিয়া থাকে, তবে। তাহাদের সঙ্গে রহমের সংস্রব থাকা কিছুমাত্র বিচিত্র নয়। ভল্লাপ্রধান ডাকাতদলের মধ্যে মুসলমানও থাকে। মুসলমানপ্রধান দলে দু-একজন ভল্লার সন্ধানও বহুবার মিলিয়াছে। তিনকড়ি, রহম—আর কে?
অকস্মাৎ গাড়িখানার একটা ঝকিতে তাহার চিন্তাসূত্র ছিন্ন হইয়া গেল; আঃ বলিয়া বিরক্তি প্রকাশ করিয়াই সে দেখিলগাড়িখানা রাস্তার মোড়ে বাঁক ফিরিতেছে, ডাইনের সতেজ সবল গরুটা লেজে মোচড় খাইয়া লাফ দিয়া বাঁক ফিরিয়াছে। সঙ্গে সঙ্গে তাহার মুখে হাসি ফুটিয়া উঠিল, ভাল তেজী গরুর লক্ষণই এই! টাকা তো কম লাগে নাই, সাড়ে তিনশো টাকা জোড়াটার দাম দিতে …। মনের কথাও তাহার শেষ হইল না। সম্মুখেই অনিরুদ্ধের দাওয়া, দাওয়াটার উপর কামার-বউ একটা নয়-দশ বছরের ছেলেকে বুকে জড়াইয়া ধরিয়াছে, ছেলেটা প্রাণপণ শক্তিতে নিজেকে মুক্ত করিবার চেষ্টায় এক হাতে কামার-বউয়ের চুল ধরিয়া টানিতেছে, অন্য হাতে তাহাকে ঠেলিতেছে। কামার-বউয়ের মাথার অবগুণ্ঠন নাই, দেহের আবরণও বিস্ত, চোখে উন্মত্ত দৃষ্টি, শীর্ণ পাণ্ডুর মুখখানা রক্তোচ্ছাসে যেন থমথম করিতেছে।
শ্ৰীহরির বুকের ভিতরটা কয়েক মুহূর্তের জন্য ধকধক করিয়া প্রচণ্ডবেগে লাফাইয়া উঠিল। তাহার অন্তরের মধ্যে পূর্বতন ছিরু উঁকি মারিল, তাহার বহু দিনের নিরুদ্ধ বাসনা উল্লাসে উচ্ছৃঙ্খল হইয়া উঠিল। সঙ্গে সঙ্গে শ্ৰীহরি আপনাকে সংযত করিল। সে জমিদার, সে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, তা ছাড়া পাপ সে আর করিবে না। পাপের সংসারে লক্ষ্মী থাকেন না। কিন্তু তবু সে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল বিসস্তবাস অনবগুণ্ঠিতা পদ্মের দিকে।
সহসা পদ্মের দৃষ্টিও পড়িল তাহার দিকে। বলদের গলার ঘণ্টার শব্দে গাড়ির দিকে চাহিয়া সে দেখিল শ্ৰীহরি ঘোষ, সেই ছিরু পাল, তাহার দিকে চাহিয়া আছে নিম্পলক দৃষ্টিতে। সঙ্গে সঙ্গে সে ছেলেটাকে ছাড়িয়া দিল। ছেলেটা সেই উচ্চিংড়ে। সকাল বেলাতেই সে জংশন হইতে গ্রামে আসিয়াছে। আজ ছিল লুণ্ঠন-ষষ্ঠী। ষষ্ঠীর দিন মা-মণিকে তাহার মনে পড়িয়ছিল। পড়িবার কারণও ছিল—পূর্বে ষষ্ঠীর দিন মা-মণি খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করিত প্রচুর। কিন্তু এবার কোনো আয়োজনই নাই দেখিয়া সে পলাইয়া যাইতেছে। মুখে কিছু বলে নাই। বোধ হয় লজ্জা হইয়াছে। নজরবন্দি যতীনবাবু যখন এখানে পদ্মের বাড়িতে থাকিততখন যতীনবাবু পদ্মকে বলিত মা-মণি; উচ্চিংড়েও তখন যতীনবাবুর কাছে পেট পুরিয়া ভাল খাইতে পাইত বলিয়া এখানেই পড়িয়া থাকিত, পদ্মকে সেও মা-মণি বলিত। আজ মা-মণি, তাহাকে বারবার অনুরোধ করিল—এইখানে থাকিতে, অবশেষে পাগলের মত তাহাকে এমনিভাবে বুকে জড়াইয়া ধরিয়াছিল।
ছাড়া পাইয়া উচ্চিংড়ে দাওয়া হইতে লাফাইয়া পড়িয়া বো-বো করিয়া ছুটিয়া পলাইল। পদ্ম আপনাকে সংবৃত করিয়া ঘরে গিয়া ঢুকিল। গাড়িখানাও কামার-বাড়ি পার হইয়া গেল।
শ্ৰীহরির অনেক কথা মনে হইল। অনিরুদ্ধ কামার শয়তান, তাহার ঠিক হইয়াছ। জেল খাঁটিতে হইয়াছে, দেশত্যাগী হইতে হইয়াছে। সে সময় ওই কামারনীটির উপর তাহার লুব্ধ দৃষ্টি ছিল, আজও বোধ হয় … কিন্তু মেয়েটার চলে কেমন করিয়া দেবু ধান দেয় বলিয়া শুনিয়াছে সে। কেন? দেবু ধান দেয় কেন? মেয়েটাই বা নেয় কেন? সে-ও তো দিতে পারে ধান; অনেক লোককেই সে ধান দান করে। কিন্তু কামার-বউ তাহার ধান কখনই লইবে না। শুধু তাহার কেন—দেবু ছাড়া বোধহয় অন্য কাহারও কাছে ধান লইবে না।
গ্রাম পার হইয়া, কঙ্কণা ও তাদের গ্রামের মধ্যপথে একটা বড় নালা; দুইখানা গ্রামের বর্ষার জল ওই নালা বাহিয়া ময়ূরাক্ষীতে গিয়া পড়ে। বেশি বর্ষা হইলে নালাটাই হইয়া ওঠে একটা ছোটখাটো নদী। তখন ওই নালাটার জন্য তাহাদের গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে যাওয়া একটা দুর্ঘট ব্যাপার হইয়া ওঠে। সম্প্রতি জংশন-শহরের কলওয়ালারা এবং গদিওয়ালারা ইহার উপর একটা সাঁকো বধিবার জন্য ইউনিয়ন বোর্ডকে বলিয়াছে। তাহারা যথেষ্ট সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও দিয়াছে। সাঁকোটা বাধা হইলে—বর্ষার সময়েও এদিককার ধান-চালরেলওয়ে ব্রিজের উপর দিয়া জংশনে যাইতে পারিবে।
শ্ৰীহরি আপন মনেই বলিল-আমি বাধা দেব। দেখি কি করে সাঁকো হয়। এ গাঁয়ের লোককে আমি না খাইয়ে মারব।
আজও নালাটায় এক কোমর গভীর জল খরস্রোতে বহিতেছে। গতকাল বোধহয় সাঁতার জল হইয়াছিল। নালাটার দুই ধারে পলির মত মাটির স্তর পড়িয়াছে। গাড়ি নালায় নামিল। পলিপড়া জায়গাগুলিতে একটু কাদা। কিন্তু শ্ৰীহরির বলদ দুইটা শক্তিশালী জানোয়ার, তাহারা অবলীলাক্রমে গাড়িটা টানিয়া ওপারে লইয়া উঠিল; এই কাদায় বেটা চাষাদের হাড়পাঁজরা বাহির করা বলদ-বাহিত বোঝাই গাড়ি যখন পড়িবে—তখন একটা বেলা অন্তত এইখানেই কাটিবে। নিজেরাও তাহারা চাকায় কাঁধ লাগাইয়া গাড়ি ঠেলিবে, পিঠ বাঁকিয়া যাইবে ধনুকের মত; কাদায়, ঘামে ও জলে ভূতের মত মূর্তি হইবে। শ্ৰীহরির মুখখানা গাম্ভীর্যপূর্ণ ক্রোধে থমথম করিতে লাগিল।
নালাটার পরে খানিকটা পথ অতিক্রম করিয়াই রেলওয়ে ব্রিজ। শ্ৰীহরির গাড়ি ব্রিজে আসিয়া উঠিল। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা পুরনো কালের খিলান-করা ব্রিজ। একদিকে রাশি রাশি বেলেপাথরকুচির বন্ধনীর মধ্য দিয়া চলিয়া গিয়াছে রেলের লাইন-লাইনের পাশ দিয়া অন্যদিকে মানুষ যাইবার পথ। শ্ৰীহরির জোয়ান গরু দুইটি লাইন দেখিয়া চকিত হইয়া উঠিল—ফেঁসফেঁস শব্দে বারবার ঘাড় নাড়িতে আরম্ভ করিল। কচি বয়স হইতে তাহারা অজপাড়াগাঁয়ে কোনো গরিব চাষীর ঘরে, মেটে ঘর, মেঠো নরম মাটির পথ, শান্ত-স্তব্ধ পল্লীর জনবিরলতার মধ্যে লালিত-পালিত হইয়াছে; মাত্র কয়েক মাস হইল আসিয়াছে শ্ৰীহরির ঘরে। এই ইটপাথরের পথ, লোহার চকচকে রেললাইন—এসব তাহাদের কাছে বিচিত্র বিস্ময়; অজানার মধ্যে বিস্ময়ে ভয়ে গরু দুইটা চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। ব্রিজ পার হইয়া খেয়াঘাট পার হইতে হইবে।
শ্ৰীহরি গাড়োয়ানকে বলিল—শ করে চালা। বলিয়া সে হাসিল। জংশন-শহর তাহাদের কাছেও বিস্ময়। তাহার বয়স পঁয়তাল্লিশ পার হইল। মূল রেললাইনটা অবশ্য অনেক দিনের, স্টেশনটা তখন একটা ছোট স্টেশন ছিল। গ্রামটাও ছিল নগণ্য পল্লীগ্রাম। তাহার বয়স যখন বারতের বৎসর, তখন স্টেশনটা পরিণত হইল বড় জংশনে। দুই-দুইটা ব্রাঞ্চ লাইন বাহির হইয়া গেল। সে সব তাহার বেশ মনে আছে। পূর্বকালে শ্রীহরি মূল লাইনের গাড়িতে চড়িয়া কয়েকবার গঙ্গাস্নানে গিয়াছে—আজিমগঞ্জ, খাগড়া প্রভৃতি স্থানে। তখন ওই স্টেশনটায় কিছুই মিলিত না। স্টেশনের পাশে মিলিত শুধু মুড়ি-মুড়কি-বাতাসা। তখন এ অঞ্চলের বাবুদের গ্রাম ওই কঙ্কণা ছিল—তখনকার বাজারে-গ্রাম। ভাল মিষ্টি, মনিহারির জিনিস, কাপড় কিনিতে লোকে কঙ্কণায় যাইত। তারপর ব্রাঞ্চ লাইন পড়ায় সঙ্গে সঙ্গে স্টেশনটা হইল জংশন। বড় বড় ইমারত তৈয়ারি হইল, বিস্তীর্ণ মাঠ ভাঙিয়া রেল-ইয়ার্ড হইল, সারি সারি সিগনালের স্তম্ভ বসিল, প্রকাও বড় মুসাফিরখানা তৈয়ার হইল। কোথা হইতে আসিয়া জুটিল দেশ-দেশান্তরের ব্যবসায়ী-বড় বড়। গুদাম বানাইয়া এই অঞ্চলটার ধান, চাল, কলাই, সরিষা, আলু কিনিয়া বোঝাই করিয়া ফেলিল। আমদানিও করিল কত জিনিস—হরেক রকমের কাপড়, যন্ত্রপাতি, মশলা, দুর্লভ মনিহারি বস্তু। হারিকেন লণ্ঠন ওই জংশনের দোকানেই তাহারা প্রথম কিনিয়াছে; হারিকেন, দেশলাই, কাচের দোয়াত, নিবের হোল্ডার কলম, কালির বড়ি, হাড়ের বাঁটের ছুরি, বিলাতি কঁচি, কারখানায়তৈয়ারি ঢালাই-লোহার কড়াই, বালতি, কালো কাপড়ের ছাতা, বার্নিশ করা জুতা, এমনকি কারখানার তৈয়ারি চাষের সমস্ত সরঞ্জাম; টামনা—বিলাতি গাঁইতি, খন্তা, কুড়ুল, কোদাল, ফাল পর্যন্ত। বড় বড় কল তৈয়ারি হইল—ধান-কল, তেলকল, ময়দা-কল। ভানাড়ী কলু মরিলঘরের জাঁতা উঠিল। ছোটলোকের আদর বাড়িল দলে দলে আশপাশের গ্রাম খালি করিয়া সব। কলে আসিয় জুটিয়াছে।
শ্ৰীহরির গাড়ি স্টেশন-কম্পাউন্ডের পাশ দিয়া চলিয়াছিল। অদ্ভুত গন্ধ উঠিতেছে; তেলগুড়-ঘি, হরেক রকম মশলাধনে, তেজপাতা, লঙ্কা, গোলমরিচ, লবঙ্গের গন্ধ একসঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে; তাহার মধ্য হইতে চেনা যাইতেছে—তামাকের উগ্র গন্ধ। অদূরের ধানকল হইতে ইহার সঙ্গেই আবার ভাসিয়া আসিয়া মিশিতেছে—সিদ্ধ ধানের গন্ধ। স্টেশন-ইয়ার্ড হইতে মধ্যে মধ্যে এক এক দমকা কয়লার ধোঁয়াও আসিয়া মিশিতেছে তাহার শাসরোধী গন্ধ লইয়া। রেলগুদামের চারিটা পাশেওই সমস্ত জিনিস পড়িয়া চারিদিকের মাটি ঢাকিয়া গিয়াছে।
গাড়োয়ানটা সহসা বলিয়া উঠিল—ওরে বাস্রে! গাট কত রে?
শ্ৰীহরি মুখ বাড়াইয়া দেখিল—সত্যই দশবারটা কাপড়ের বড় গাঁট পড়িয়া আছে। পাশে পড়িয়া আছে প্রায় পঞ্চাশটা চটের গাঁট। গাড়োয়ানটা সবগুলোকেই কাপড় মনে করিয়াছে। এক পাশে পড়িয়া আছে কতকগুলো কাঠের বাক্স। নূতন কাপড় এবং চটের গন্ধের সঙ্গেওষুধের বঁঝালো গন্ধ উঠিতেছে; তাহার সহিত মিশিয়াছে—চায়ের পাতার গন্ধ।
গুদামটায় দুমাদুম শব্দ উঠিতেছে, মালগাড়ি হইতে মাল খালাস হইতেছে। রেল-ইয়ার্ডে ইঞ্জিনের স্কিমের শব্দ, বাঁশির শব্দ, দ্রুত চলন্ত বিশ-পঞ্চাশ-শত-দেড়শত জোড়া লোহার চাকার শব্দ, কলগুলার শব্দ, মোটর-বাসের গর্জন;–মানুষের কলরবে চারিদিক মুখরিত।
দিন দিন শহরটা বাড়িতেছে। রাস্তার দুপাশে পাকাবাড়ির সারি বাড়িয়াই চলিয়াছে। ফটকে নাম লেখা হরেক ছাদের একতলা দোতলা বাড়ি; দোকানের মাথায় বিজ্ঞাপন, দেওয়ালে। বিজ্ঞাপন।
গাড়োয়ানটা বলিয়া উঠিল—ওঃ, পায়রার কাঁক দেখো দেখি। প্রায় দুইশতখানেক পায়রা রাস্তার উপর নামিয়া শস্যকণা খুঁটিয়া খাইতেছে। লোক কিংবা গাড়ি দেখিয়াও তাহারা ওড়ে না, অল্পস্বল্প সরিয়া যায় মাত্র। জংশনশহর তাহাদের কাছেও এখন বিস্ময়ের বস্তু। সহসা শ্ৰীহরির। একটা কথা মনে হইল,এখানকার কলওয়ালা কয়েকজন এবং গদিওয়ালা মহাজনগুলি তাহাদের অর্থাৎ জমিদারের বিরুদ্ধে প্রজাদের পক্ষ লইয়া কতখানি উস্কানি দিতেছে সন্ধান লইতে হইবে। সে তাহাদের জানে। উহাদের জন্য চাষী প্রজারা এতখানি বাড়িয়াছে। ছোটলোকগুলা তো কলের, কাজ পাইয়াই চাষের মজুরি ছাড়িয়াছে। তাহাদের শাসন করিতে গেলে—বেটারা পলাইয়া আসিয়া কলে ঢুকিয়া বসে। কলের মালিক তাহাদের রক্ষা করে। কত জনের কাছে তাহার ধানের দাদন এইভাবে পড়িয়া গেল তাহার হিসাব নাই। চাষবাস করা ক্ৰমে ক্ৰমে কঠিন ব্যাপার। হইয়া দাঁড়াইতেছে। চাষীদের দাদন দেয় ইহারাই, জমিদারের সঙ্গে বিরোধে তাহাদের পক্ষ লইয়া আপনার লোক সাজে। মূর্খেরা গলিয়া গিয়া দাদন নেয়; ফসলের সময় পাঁচ টাকা দরের মাল তিন টাকায় দেয়—তবু মূৰ্খদের চৈতন্য নাই! এখনও একমাত্র ভরসার কথা মিলওয়ালারা, গদিওয়ালারা ধান ঋণ দেয় না, দেয় টাকা। ধানের জন্য চাষী-বেটাদের এখনও জমিদারমহাজনের দ্বারস্থ হইতে হয়।
গাড়িটা রাস্তা হইতে মোড় ঘুরিয়া থানা-কম্পাউন্ডের ফটকে ঢাকিল।
দারোগা হাসিয়া সম্ভাষণ করিলেন আরে, ঘোষ মশাই যে! কি খবর? এদিকে কোথায়?
শ্ৰীহরি বিনয় করিয়া বলিল হুজুরদের দরবারেই এসেছি। আপনারা রক্ষে করেন তবেই, নইলে তো ধনে-প্ৰাণে যেতে হবে দেখছি।
—সে কি!
—খবর পেয়েছেন নাকি কাল রাত্রে জমাট-বস্তী হয়েছিল—মৌলকিনীর বটতলায়? ভূপালরতন আসে নাই?
–কই না—বলিয়া পর মুহূর্তেই হাসিয়া দারোগা বলিলেন আর মশাই, থানা–পুলিশের ক্ষমতাই নাই তা আমরা করব কি? এখন তো মালিক আপনারাই ইউনিয়ন বোর্ড। ভূপালরতনের আজ ইউনিয়ন বোর্ডের কাজের পালি। কাজ সেরে আসবে।
–আমি কিন্তু বারবার করে সকালেই আসতে বলেছিলাম।
–বসুন, বসুন। সব শুনছি।
শ্ৰীহরি কালু শেখকে বলিল—কালু, ওগুলো নামা।
কালু নামাইল—কলা, কাঁঠাল ইত্যাদি।
দারোগা বক্রভাবে সেগুলির উপর চকিতে দৃষ্টি বুলাইয়া লইয়া বলিলেন, চা খাবেন তো? তিনি বারান্দায় দাঁড়াইয়া রাস্তার ওপারের চায়ের দোকানিকে হাকিয়া বলিলেন—এই, দু কাপ চা, জলদি।
শ্ৰীহরিকে লইয়া তিনি অফিসে গিয়া বসিলেন। চা খাইয়া বলিলেন—সিগারেট বের করুন। সিগারেট ধরিয়ে শোনা যাক কালকের কথা।
শ্ৰীহরি বাড়িতেও সিগারেট খায় না, কিন্তু রাখে; দারোগা হাকিম প্রভৃতি ভদ্র লোকজন আসিলে বাহির করে। বাহিরে গেলে সঙ্গে লয়, আজও সঙ্গে আনিয়াছিল। সে সিগারেটের প্যাকেট বাহির করিল। দারোগা দ্বাররক্ষী কনস্টেবলকে বলিলেন দরজাটা বন্ধ করে দাও।
প্ৰায় ঘণ্টাখানেক পরে শ্ৰীহরি থানার অফিস-ঘর হইতে বাহির হইল। দারোগাও বাহির হইয়া আসিয়া বলিলেন—ও আপনি ঠিক করেছেন, কোনো ভুল হয় নি—অন্যায়ও হয় নি–ঠিক করেছেন।
শ্ৰীহরি একটু হাসিল—শুষ্ক হাসি।
সে গতরাত্রের জমাট-বস্তীর কথা ডায়রি করিয়া, ওই সঙ্গে তাহার যাহাদের উপর সন্দেহ হয়, তাহাদের নামও দিয়াছে। রাম ভল্লা, তিনকড়ি মণ্ডল, রহম শেখ-এর নামগুলি তো বলিয়াছেই, উপরন্তু সে দেবু ঘোষের নামও উল্লেখ করিয়াছে। তাহাকে তাহার সন্দেহ হয়। গোটা ব্যাপারটাই যদি প্রজা-ধর্মঘটের ফেঁকড়া হল, তবে দেবুকে বাদ দেওয়া যায় না; দেবুই সমস্তের মূল—সেই সমস্ত মাথায় করিয়া ধরিয়া রাখিয়াছে, পিছন হইতে প্রেরণা যোগাইতেছে।
দারোগা প্রথমটা বিস্ময় প্রকাশ করিয়াছিলেন—তা কি সম্ভব ঘোষ মহাশয়? দেবু ঘোষ ডাকাতির ভেতর?
শ্ৰীহরি তখন বাধ্য হইয়া গতকাল গভীর রাত্রে সেই দুর্যোগের মধ্যেও গ্রামপ্রান্তে দেবুর প্রতি দরদী দুর্গা মুচিনীর উপস্থিতির কথা উল্লেখ করিয়া বলিয়াছিল দেবু ছোঁড়ার পতন হয়েছে দারোগাবাবু।
–বলেন কি!
—শুধু দুর্গাই নয়; দেবু ঘোষ এখন অনিরুদ্ধ কামারের স্ত্রীর ভরণপোষণের সমস্ত ভার নিয়েছে তা খবর রাখেন?
দারোগা কিছুক্ষণ শ্ৰীহরির মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া খসখস করিয়া সমস্ত লিখিয়া লইয়া বলিয়াছিলেন—তবে আপনি ঠিকই সন্দেহ করেছেন।
শ্ৰীহরি চমকিয়া উঠিয়াছিল—আপনি লিখলেন নাকি দেবুর নাম?
–হ্যাঁ। চরিত্রদোষ যখন ঘটেছে, তখন অনুমান ঠিক।
–না, না। তবু ভাল করে জেনে লিখলেই ভাল হত—
দারোগা হাসিয়া বারবার তাহাকে বলিলেনকোনো অন্যায় হয় নি আপনার। ঠিক ধরেছেন আর ঠিক করেছেন আপনি।
ফিরিবার পথে দুই-চারিজন গদিওয়ালা মহাজন ও মিল-মালিকদের ওখানেও সে গেল। কিন্তু কোনো সঠিক সংবাদ মিলিল না। কেবল একজন মিলওয়ালা বলিলটাকা আমরা দোব ঘোষ মশায়। জমি হিসেব করে টাকা দোব। আপনাদের সঙ্গে প্রজাদের বিরোধ বেধেছে, আমাদের লাভের এই তো মরসুম।—সে দৰ্পের হাসি হাসিল।
শ্ৰীহরি মনে মনে ক্রুদ্ধ হইলকিন্তু মুখে কিছু বলিল না। সে-ও একটু হাসিল।
মিলওয়ালা ভদ্রলোকটি বেঁটেখাটো মানুষ, বড়লোকের ছেলে; জংশন-শহরে তাহার দুইটা কল—একটা ধানের, একটা ময়দার। অনেকটা সাহেবি চালের ধারা-ধরন; কথাবার্তা পরিষ্কার। স্পষ্ট, তাহার মধ্যে একটু দাম্ভিকতার আভাস পাওয়া যায়। সে-ই আবার বলিল-কলের মজুর নিয়ে আপনারা তো আমাদের সঙ্গে হাঙ্গামা কম করেন না। কথায় কথায় আপন এলাকার মজুরদের আটক করেন। প্রজাদের বলেন-কলে খাটতে যাবি নে, গদিওয়ালার দাদন নিতে পারবি নে, তাদিকে ধান বেচতে পারবি নে। এখন আপনাদের সঙ্গে তাদের বিরোধ বেধেছে, এই তো আমাদের পক্ষে সুবিধের সময় তাদের আরও আপনার করে নেবার।
শ্ৰীহরির অন্তরটা গর্তের ভিতরকার খোঁচা-খাওয়া ক্রুদ্ধ আহত সাপের মত পাক খাইতেছিল, তবুও সে কোনোমতে আত্মসংবরণ করিয়া লইল ও নমস্কার করিয়া উঠিয়া পড়িল।
মিলওয়ালা বলিল কিছু মনে করবেন না, স্পষ্ট কথা বলেছি আমি।
শ্ৰীহরি ঘাড় নাড়িয়া গাড়িতে উঠিয়া বসিল।
মিলওয়ালা বাহিরে আসিয়া আবার বলিল-আপনি কোনটা চাচ্ছেন? আমরা টাকা না দিলে প্রজারা টাকার অভাবে মামলা করতে পারবে না, তা হলেই বাধ্য হয়ে মিটমাট করবে! না তার চেয়ে আমরা টাকা দিই প্রজাদের? মামলা করে যাক তারা আপনাদের সঙ্গে, শেষ পর্যন্ত তারা তো হারবেই; একেবারে সর্বস্বান্ত হয়ে হারবে। তখন আপনাদের আরও সুবিধে। লোকটি বিজ্ঞতার হাসি হাসিতে লাগিল।
শ্ৰীহরি কোনো উত্তর না দিয়া গাড়োয়ানকে বলিল—কঙ্কণায় চল্।
মিলওয়ালা সহাস্যে জিজ্ঞাসা করিল—জমিদার-কনফারেন্স নাকি?
শ্ৰীহরি চকিত দৃষ্টি ফিরাইয়া একবার মিলওয়ালার দিকে চাহিল, তারপর সে ধীরে ধীরে গাড়িতে উঠিল। তেজী বলদ দুইটা লেজে মোচড় খাইয়া লাফাইয়া গাড়িখানাকে লইয়া ঘুরিয়া চলিতে আরম্ভ করিল।
মিলের বাঁধানো উঠানে মেয়ে-মজুরদের কয়েকজন তাহাকেই দেখিতেছিল।
শ্ৰীহরি দেখিল—তাহারই গ্রামের একদল মুচি ও বাউড়ির মেয়ে। মিলের বাঁধানো প্রাঙ্গণে মেয়ে-মজুরেরা পায়ে পায়ে সিদ্ধ ধান ছড়াইয়া চলিয়াছে—আর মৃদুস্বরে একসঙ্গে গলা মিলাইয়া গান গাহিতেছে।
শ্ৰীহরি আসিয়া উঠিল মুখুয্যেদের কাছারিতে।
মুখুয্যেবাবুরা লক্ষপতি ধনী। বৎসরে লক্ষ টাকার উপর তাঁহাদের আয়। শুধু এ অঞ্চলের নয়, গোটা জেলাটার অন্যতম প্রধান ধনী। কঙ্কণা অবশ্য বহুকালের প্রাচীন ভদ্রলোকের গ্রাম; কিন্তু বর্তমান কঙ্কণার যে রূপ এবং জেলার মধ্যে যে খ্যাতি, সে এই মুখুয্যেবাবুদের কীর্তির জন্যই। বড় বড় ইমারত, নিজেদের জন্য বাগানবাড়ি, সাহেব-সুবার জন্য অতিথিভবন, সারি সারি দেবমন্দির, স্কুল, হাসপাতাল, বালিকা বিদ্যালয়, ঘাট বাঁধানো বড় বড় পুকুর ইত্যাদি মুখুয্যেবাবুদের অনেক কীর্তি। জমিদারি সম্পত্তি সবই প্রায় দেবোত্তর। দেবোত্তর হইতেই প্রতিষ্ঠানগুলির ব্যয়ভার নির্বাহ হয়। সাহেবদের জন্য মুরগি কেনা হয়, মদ কেনা হয়, বাবুর্চির বেতন দেওয়া হয়, খেমটা-নাচওয়ালী-বাইজী আসে, রামায়ণ, ভাগবত প্রভৃতির দল আসে। বাবুদের ছেলেরাও রঙচঙ মাখিয়া থিয়েটার করে। দেবোত্তরের আয়ও প্রচুর। ন্যায্য আয়ের উপরেও আবার উপরি আয় আছে। দেবোত্তরের সকল আদান-প্রদানেই টাকায় এক পয়সা হিসাবে বাড়তি দিতে হয় দেনাদারকে, টাকা নিতে গেলে ঢাকায় এক পয়সা কম নিতে হয়। পাওনাদারকে। মুখুয্যে-কর্তা হিসেবি বুদ্ধিমান লোক। শ্ৰীহরি মুখুয্যে-কর্তার পায়ের ধূলা লইয়া প্ৰণাম করিল।
মুখুয্যে-কর্তা বলিলেন—তাই তো হে, তুমি হঠাৎ এলে? আমি ভাবছিলাম একটা দিন ঠিক করে আরও সব যারা জমিদার আছে তাদের খবর দোব। সকলে মিলে কথাবার্তা বলে একটা পথ ঠিক করা যাবে।
শ্ৰীহরি বলিল—আমি এসেছি আপনার কাছে উপদেশ নিতে। অন্য জমিদার যারা আছেন, তাঁদের দিয়ে কিছু হবে না বাবু। অবস্থা তো সব জানেন।
মুখুয্যে-কর্তা হাসিয়া বলিলেন—সেই জন্যেই তো। শ্ৰীহরি তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
কর্তা বলিলেন—এঁরা সব বনেদি জমিদার। জেদ চাপলে বৃদ্ধির মামলা করবেন বৈকি। জেদ চাপিয়ে দিতে হবে।
শ্ৰীহরি হাসিয়া সবিনয়ে বলিল প্রজারা ধর্মঘট করে খাজনা বন্ধ করলে—কদিন মামলা করবেন সব?
–টাকা ঠিক করে রাখ তুমি। ছোটখাটো যারা তাদের তুমি দিয়ে। বড় যারা তাদের ভার আমার উপর রইল। টাকা-আদায় সম্পত্তি থেকেই হবে।
শ্ৰীহরি অবাক হইয়া গেল।
কর্তা বলিলেন—এতে করবার বিশেষ কিছু নাই; এক কাজ কর। তুমি তো ধানের কারবার কর? এবার ধান দাদন বন্ধ করে দাও। কোনো চাষীকে ধান দিয়ো না।–বলিয়া তিনি হাকিয়া গদি-ঘরের কর্মচারীদের উদ্দেশ করিয়া বলিলেনকে আছ, পজিটা দিয়ে যাও তো হে।
পাঁজি দেখিয়া তিনি বলিলেন। মুসলমানদের রমজানের মাস আসছে। রোজার মাস। রোজা ঠাণ্ডার দিন, ইদলফেতর পরব। ধান দিয়ে না, মুসলমানদের কায়দা করতে বেশি দিন লাগবে না আবার তিনি হাসিয়া বলিলেন-পেটে খেতে না পেলে বাঘও বশ মানে।
শ্ৰীহরি প্রণাম করিয়া বলিল—যে আজ্ঞে, তা হলে আজ আমি আসি।
কর্তা হাসিয়া আশীৰ্বাদ করিয়া বলিলেন—মঙ্গল হোক তোমার! কিছু ভয় কোরো না। একটু বুঝে-সমঝে চলবে। ঘরে টাকা আছে, ভয় কি তোমার? আর একটা কথা। শিবকালীপুরের পত্তনির খাজনা কিস্তি কিস্তি দিচ্ছ নাকি তুমি?
–আজ্ঞে হ্যাঁ, পাই-পয়সা দিয়ে দিয়েছি।
–গভর্নমেন্ট রেভিন্যু তুমি দাওনা, জমিদার দেয়?
শ্ৰীহরি এবার বুঝিয়া লইল। হাসিয়া বলিল-আশ্বিন কিস্তিতে আর দেব না।
পথে আসিতে শ্ৰীহরি দেখিল পথের পাশেই বেশ একটা ভিড় জমিয়া গিয়াছে। তিনকড়ি মণ্ডল একটা পাঁচন লাঠি হাতে লইয়া ক্রুদ্ধ বিক্ৰমে দাঁড়াইয়া আছে, তাহার সম্মুখে নতমুখে বসিয়া আছে একজন অল্পবয়সী ভল্লা। ভল্লাটির পিঠে পাঁচন লাঠির একটা দাগ লম্বা মোটা দড়ির মত ফুলিয়া উঠিয়াছে।
শ্ৰীহরি ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল—কি হয়েছে? ওকে মেরেছ কেন অমন করে?
তিনকড়ি বলিল কিছু হয় নাই। তুমি যাচ্ছ যাও।
শ্ৰীহরি ভল্লাটিকে বলিল—এই ছোকরা, কি নাম তোর?
সে এবার উঠিয়া প্ৰণাম করিয়া বুলিল-আজ্ঞে, আমরা ভল্লারা।
–হ্যাঁ, হ্যাঁ! কি নাম তোর?
–আজ্ঞে না, ছিদাম ভল্লা!
–কে মেরেছে তোকে?
ছিদাম মাথা চুলকাইয়া বলিল-আজ্ঞে না। মারে নাই তো কেউ।
—মারে নাই? পিঠে দাগ কিসের?
–আজ্ঞা। উ কিছু লয়।
–কিছু নয়?
–আজ্ঞে না।
তিনকাড়ি নিতান্ত অবজ্ঞাভরেই আবার বলিল—যাও–যাও, যাচ্ছ কোথা যাও। হাকিমি করতে হবে না তোমাকে। মেরে থাকি বেশ করেছি। সে বুঝবে ও–আর বুঝব আমি।
শ্ৰীহরি বাড়ি ফিরিয়াই বৃত্তান্তটি লিখিয়া কালু শেখকে থানায় পাঠাইয়া দিল।