আকাশের ঘুমোট ভাব কাটল আরও দুদিন পরে, আজগরও সেদিন কোর্ট চত্বরে আসতে পারে।
কিন্তু আজগর তার ল্যাঙেড়া পাহাড়ের বুড়া-তুড়া ডাকা বানর দুটো নিয়ে কোর্ট চত্বরে আসলেই-বা কী, সেখানে মানুষজন থাকতে হবে তো। এই দিন তিনেকে, ঝড়-বাদল পরশু দিনের ব্যাপার, তারপর গতকাল গেছে, আর আজ, এই মোটমাট তিন দিনে এই এলাকার যেন অনেকখানিক বদলে গেছে। এখানকার চারপাশের আবহাওয়া এখন অনেকটাই গুমোট। কখন কী হয় তার ঠিক নেই। সর্বত্রই এক চাপা ভাব।
গতকাল আজগরকে দেখতে গিয়েছিল মোসলেম উদ্দিন। আজগর তখন উঠে বসতে পারে। চোখ দুটো কোঠরে ঢুকে গেছে। মুখোনা চিমসে। তাতে পান-তামাকের গুনে পোকায় খাওয়া দাঁতগুলো একেবারেই কেলিয়ে পড়ে। ভাঙাচোরা চেহারার আজগরকে মোসলেম উদ্দিন কেন, কোর্ট চত্বরে মানুষজন আগেও দেখেছে, কিন্তু দেখতে এতটা কাহিল আজগরকে যেন কেউ দেখেনি। এ কী চেহারা হয়েছে আজগরের। মাত্র দুটো দিনের ভিতরে মানুষটা এইরকম কাহিল হয়ে গেল। মোসলেম উদ্দিন চেয়ে চেয়ে আজগরকে দেখে। গলায় জোর আছে ঠিকই, ঠিকমতো দাঁড়াতে পারবে তো ছেলেটা। এরপর খেলা দেখাতে পারবে তো। বান্দর দুটোকে নাচানোর সময়ে গায়ে বল থাকতে হয়, সেই বল আবার ফিরে পাবে?
এই পর্যন্ত ভাবলেও, মোসলেম উদ্দিন এও জানা আছে, এই মুহূর্তে কোর্ট চত্বরের যে অবস্থা তাতে কয়দিনে যে এখানে আবার লোকজন ঠিকঠাক মতো হবে, তাই-বা কে জানে। ততদিনে আজগর নিশ্চয়ই আরও সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু এই কয়দিন তাহলে খাবে কী? অসুখ হয়ে কত জায়গায় ধার কর্য করেছে তার ইয়ত্তা নেই। যদি সুকুমার যদি খেলা দেখাতে পারত তাহলে হয়তো কিছু সাহায্য করতে পারত। যদিও গতকাল বিকালে মোসলেম রেল স্টেশনে সুকুমারকে দেখেছে। মোসলেমও গিয়েছিল কাপড় কাঁচার পাউডার নিয়ে। কিন্তু সেখানেও জনমানুষ কিছুটা হলে কমে গেছে। বাসের মালিকরা নাকি লোক লাগিয়েছে, যেন মানুষ বাসেই ওঠে। মাত্র এক ঘণ্টায় সবাইকে নিয়ে যাবে খুলনায়। অর্থাৎ, নদীর এপারের রূপসায়। তারপর তারা যাবে খুলনায়। সেখানে এই ট্রেনে, গরুরগাড়ি মার্কা ট্রেনে দুই ঘণ্টা আড়াই ঘণ্টায় খুলনায় যাওয়ার কোনও অর্থ আছে? মানুষও যুক্তি বোঝে। তারা বাস মালিকদের কথা শোনে। সদ্য বানানো তেলতেলে সিএণ্ডবি রাস্তা, এই রাস্তায় বাসে ওঠো আর একটানে চলে যাও খুলনা। চোখ খুলতে না খুলতেই রূপসা ঘাট। ফলে, বাস মালিকরা যদি ট্রেনঅলাদের সঙ্গে দেন দরবার করে, ভিতরে ভিতরে ঘুষ দিয়ে ট্রেনটা তুলে দিতে পারে, তাহলে ট্রেন স্টেশনে খেলা দেখানোর যে সুযোগ তাও আর কয়দিন বাদে থাকবে না।
কিন্তু এখন বিষয়টা তো একেবারে অন্য। মোসলেম যা ভাবছিল, যদি কোর্ট চত্বরের অবস্থা এই হয়, তাহলে তাদের পথে বসা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। আজগরেরই-বা কী হবে। মোসলেম যখন আজগরের ঝুপড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, তখন সেখানে জরিনা নেই। ঝিলিকও ছিল না। সুকুমারকে একবার দেখছিল, তার কাছে জানতে চেয়েছিল, চা খাবে কি না, তারপর কোন দিকে যে গেল! সুকুমার বড়ো অদ্ভুত ছেলে। মোসলেম আজগরের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে এসব ভাবল ঠিকই, কিন্তু তার চোখ মন সবই তখন পড়েছিল কোর্ট চত্বরে। আজগর বুঝল, মোসলেম উদ্দিন এখানে থেকেও এখানে নেই। এই বয়সেও লোকটা কাজের। এই বয়সেও লোকটা চলাচলতি সব ভালোই পারে, এখনও দেখো জামা কাপড় কী সুন্দর! এখানের উকিল মোক্তার পেশকার হাকিম ম্যাজিস্ট্রেটরাও এই মোসলেমের মতন ধবধবে জামা কাপড় পরে না। যদিও মোসলেম উদ্দিন তাদেরই মতন একজন ক্যানভাসার। আর সে সারডা জীবন বান্দর নাচাইয়ে এই জীবনে একদিনই এট্টু পরিষ্কার কাপড় পরে সে কোর্টের সামনে যেতে পারে নাই।
আজগর মোসলেমের দিকে চোখের পাতা নাচিয়ে বলল, দেহো কী? এইভাবে চাইয়ে চাইয়ে?
দেখপো আর কী? দেখি তোরে আজগর। তোর চেহারা হইচে কী, কোনও দিন আয়নায় দেহিচিস?
তুমি আছো তোমার ভাবে। বেচে কাপড় কাঁচার পাউডার, মানুষের জামা কাপড় পরিষ্কার করাও, আর আমার মতন বান্দর নাচানো আজগররেও তুমি সুন্দর দেকতি চাও!
সেয়া কইনিইরে ছেমড়া, সেয়া কইনিই, কইচি তুই তোর চেহারাডা বানাইচিস্ কী?
চেহারা তো আগেও এইয়ে ছেল, এহোনও তাই আছে। এয়ার আর ভালোমন্দ কী?
ওরে সেয়া কইনি। শরীলডার অবস্থা করিচিত্স কী? এহেবারে ভাইঙ্গে গেইচে তোর শরীর। তাকানো যায় না।
তাহানো না গেলি তাইয়ো না। তোমারে তাহাইয়ে দেকতি কইছি?
ফাও কতা কইস নে। ফাও কতা কওয়া স্বভাব তোর গেল না।
শোনো, আমরা চেহারা দেখপো কোয়ানদে, আয়না নেই। গোসল করার সময় যে দিন নদীর পানি ভালো পরিষ্কার থাহে, সেদিন নদীর পানিতে চেহারা দেইহে লই।
আবার ফাও কতা কইস?
আজগর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল! চোখ ঘুরিয়ে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে খুঁজল সুকুমারকে। দীর্ঘশ্বাসের শব্দ মোসলেম উদ্দিন শোনেনি। কিন্তু কাউকে খোঁজার জন্যে যে চোখ ঘোরাচ্ছে সেটা মোসলেম উদ্দিন বুঝতে পারল। আজগর দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছে, যেন নিজের অবস্থাকে মানিয়ে নিতে। অথবা, একখানা আয়নাও না-থাকা নিয়ে নিজের দারিদ্র্যকে বুঝে নিতে, অথবা, এমনিতেই আজগরের অজানিতে বেরিয়ে এসেছে ওই দীর্ঘশ্বাস। এখন সুকুমার এখানে থাকলে ভালো হত। যদি পারত মোসলেম ভাইকে একটু চা খাওয়াত, তার জন্যেও আনত একটু। ওই টিনের মগটাতে আনলেও হত। আজগরের জন্যে ওই টিনের মগে চা-ই সই। সুকুমার তার জন্যে যথেষ্ট করেছে। কদিন আগে তার সঙ্গে যে কথা কাটাকাটি হয়েছে তা মনে রাখেনি। এক জায়গা কাজ করলে অমন মন কষাকষি হয়, আবার তা মিটেও যায়। আজগর যখন এসব ভাবছিল, তখন মোসলেম উদ্দিন বলে, তোর নয় আয়না না আছে; সেই জন্যি জরিনারও আয়না নেই? ও মাইয়েডা নাইয়ে ধুইয়ে চোখে মুখে রংটং মাহে কী দিয়ে?
সের মনে হয় আছে একখান।
তালি সেইহানে নিজের চেহারা একবার দেকলি পারিস?
হইচে। বান্দর নাচানো আজগর তার আবার চেহারা।
এসময় নদীর কূল বেয়ে হাওয়া আসে। বৃষ্টি-বাদল কেটে যাওয়ার পরে এই বাতাস অনেক ঠান্ডা ও শীতল। প্রাণ জুড়ানো। যদিও দুপুরের আগ পর্যন্ত হাওয়া তেমন ছিল না। বিকেল থেকে এই কুলকুলানো হাওয়া বইতে শুরু করেছে। দুপুরে পেট ভরে খাওয়ার পরে এই হাওয়া গায়ে লাগলে সত্যি শরীর জুড়োয়। সুকুমারের সঙ্গে জরিনা আর ঝিলিক আলতাফের হোটেলে খেতে গেছিল, আর তার জন্যে এনেছিল থালাভরতি ভাত, ভেটকি মাছের ঝোল, একটা ছোটো ভেটকির মাথা, ডাল আর পুইশাকের তরকারি। বেশ কয়েকদিন বাদে আজগর আজ পেট ভরে খেয়েছে। মাছের ঝোল দিয়ে ভাত মেখে খেতে খেতে আজগরের মনে হয়েছিল, সে যেন মায়ের হাতের ভেটকি মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাইছে। চোখ ভেজার কথা না আজগরের। অত দয়ামায়া কোনও কালেই ছিল না তার। আজও নেই। তবু মনে পড়ায় পরানের একেবারে গভীর তলানিতে কোথায় যে হাহাকার করে উঠেছিল। কিন্তু এরপর আরও ওকথা মনে করে ভাতের থালায় হাত নামিয়ে রাখতে চায়নি সে। শুধু জরিনার কাছে জানতে চেয়েছিল, এ জরি, এই মাছের ঝোল রান্না করিচে কেডা?”
জরিনা বলেছে, শিউলির মা মনে কয়।
আজগর বলেছিল, আমি ভাবলাম, আলতাফের বউ রান্দিচে নিকি।
তোমার দেহি কোনও হিসেব হল না?
কেন হইচে কী?
খাইয়ে কাজ নেই আলতাফের বউ রানতি যাবে নে! তার এহোন কত পদের ফেনসিয়ান। ছওয়াল-মাইয়ে ইস্কুলে পড়ায়, আর এহোন সে ভাতের হোটেলের রান্ধা রাইন্ধে জীবন শেষ করবে!
ও কথার ওখানেই শেষ। তবে, মাছ-ঝোল-ভাত-তরকারি সবমিলে গড়ানো দুপুরে আজগর খেয়েছিল পেট পুরে। তারপর এখন নদী বেয়ে উঠে আসছে এই কুলকুলে হাওয়া। ঝুপড়ির একপাশে হেলান দিয়ে আজগর বসে আছে। তার গায়ে এই হাওয়ার কতটুকু লাগছে, তাতে অন্য সময় হলে তার চোখ ঘুমে জড়িয়ে যেত। এখন গেল না। এই কয়দিন যে রাম ঘুম ঘুমিয়েছে সে এখন রাত ছাড়া কোনওভাবেই তার চোখে ঘুম আসবে না।
এ সময়, সুকুমার একটা এলুমনিয়ামের মগে চা নিয়ে আসে। হাতে তিনটে ছোটো চা খাওয়ার গেলাস। মোসলেম উদ্দিন একটু অবাক। তাহলে সে আসার একটু পরে ভালো মন্দ কোনও কথা না-বলে সুকুমার যে চলে গেল, এই চা আবার জন্যে।
মোসলেম বলল, চা কোন জায়গা দিয়ে আনলা?
আলম ভাইর ওই জায়গা দে–
তুমি আলমের দোকানও দেহি চেনো।
জরিনাদি চেনোইয়ে দেছে।
মগের চা কাপে ঢালে। কাপ মানে ছোটো সাইজের গেলাস। এগুলোতেই এসব চায়ের দোকানে চা খাওয়া হয়। সুকুমার যখন ঢাকার ওদিকে গেছে, সেখানে দেখেছে, চায়ের দোকানে চা দেয় কাপে, কোনও জায়গায় দেয় গেলাসের গায়ে একটা আংটা লাগানো। আর এদিকে চায়ের দোকানে চা মানেই এইরকম ছোটো ছোটো গেলাসে চা।
চা খেতে খেতে মোসলেম উদ্দিন কথা শেষ করে উঠবে ভাবে। এসেছিল আজগরকে দেখতে। দেখা শেষ। এখন যাবে। আরও ভেবেছিল, জরিনাকে একটু গালমন্দ করবে। কোনওদিকে খেয়াল নেই। এই ঝুপড়ি ঘরটাও তো একটু গুছিয়ে রাখা যায়। তা করবে না। সারাটা দিন গায়ে বাতাস লাগিয়ে ড্যাং-ড্যাং করে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াবে। খাবে এই আজগরের, থাকবে এই আজগরের সাথে, তারপরও যদি কোনও কিছুর একটু খেয়াল রাখত ওই মেয়ে। মেয়েটার কোনও বোধ হইল না আজও। হবেও না কোনও কালে। সে তুলনায় ঝিলিককে অনেক লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে মনে হয় মোসলেমের। আসলে, এটা গাল দিতে গিয়েও ভিতরে ভিতরে নিজের সামলাল মোসলেম।
মোসলেম উঠবে, আজগর বুঝতে পারে। তা বুঝেছে সুকুমারও। সুকুমার মোসলেমকে নিয়ে সামনের মেইন রোড পর্যন্ত যাবে। যদি মোসলেম নদীর পাড় বেয়ে বাজারের দিকে যায়, তাহলে সেদিকেও যেতে পারে সুকুমার। ঝিলিক বলেছে, বাজারের দিকে গেরে সাগুদানা ও কলা আনতে, আর সুই-সুতো। সুকুমার জানতে চেয়েছিল, কলা কেন? ঝিলিকের সে কি হাসি। কলা কেন? আরে বাজারের করার আড়তের পাশে প্রচুর পচা কলা থাকে, দাম কম, এ কথা যে কতবার বলেছে সুকুমারকে। কতবার আর। সুকুমার কি বান্দরের ওস্তাদ নাকি। তবে ব্যাপার হল, এই বিষয়টা মনে থাকে না জরিনার। ওই অবলা বনের প্রাণী দুটো, কোর্টের সামনে যায় না, আজগরের ওই অবস্থা, তা বলে জরিনা তাদের খাওয়ার দিকে খেয়াল দেবে না।
কিন্তু মোসলেম উঠতে না উঠতেই বলল, কাইল যদি শরীর জুতের ঠেকিস, তাইলে যাইস একবার কোর্টের দিক।
আচ্ছা, যাবানে। কিন্তু যাইয়ে করব কী? উকিল সাবরা সব কোর্ট বাতিল করিচে।
হয়।
এরপর আজগর মোসলেমের কাছে কোর্টের বর্তমান পরিস্থিতি জানতে চায়। মোসলেম বলে। ট্রেন নিয়ে সমস্যা এখন কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। হক উকিল আর মোজাম্মেল উকিলরে তো ছাড়িনি, কাইলকে নাকি আবার সবুর উকিলের উপরও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। তবে তার চেয়েও গুরুতর বিষয় যেটা, বারের সামনে চা খেতে খেতে, ঘুরতে ঘুরতে মোসলেম শুনেছে তাই জানায়। সে বিষয়টা হল, উকিলদের ভিতরে আবার দুই ভাগ, যাগো যাগো ভাই ব্রাদারগো বাসের বিজনেস আছে তারা ট্রেন তুলে দেয়ার পক্ষে। আর যাগো নেই, তারা বিপক্ষে। তয়, হক সাব, মোজাম্মেল সাব আর সবুর সাব প্রত্যেকেই কিন্তু উকিল হিসেবে ভালো, তাগো ওইসমস্ত দেখার কোনও সুযোগ নেই। তাদের কথা হচ্ছে, এতকাল ধরে এই এলাকায় যে ট্রেন চলেছে, সেই ট্রেন কোনও ভাবে তুলে নেয়া যাবে না।
এরপর মোসলেম জানায় এই ঘটনায় ছাত্রদের কী প্রতিক্রিয়া। পিসি কলেজের ছাত্ররা ঠিক করেছিল, ট্রেনের টিটিদের সাথে একদিন টিকিটের পয়সা কালেকশন করবে, তা করেছে। করে দেখিয়েছে, সরকার যে বলে ট্রেনে লস হয়, লস্ কোথায় হয়। তাতে নাকি একদিনের তিন ট্রিপে এত টাকা উঠেছে যে, সারা সপ্তাহে এই লাইনের ট্রেনে এত পয়সা ওঠে না।
এসব জানিয়ে মোসলেম আজগরকে বলে, বোঝ অবস্থা। টিটি সরকারি, ট্রেন উঠাতে চায় সরকার, আবার সরকারেরই বড় গলা। চোরের মায়ের গলা তো বড়ো হবেই।
আজগর তো আজগর, সে এত সমস্ত বোঝে না। তার বোধেও কুলায় না এই হিসেব। জানে, কোর্টের কাছে একদিন তোক না আসলে তার পেটে ভাত নেই। যদি কখনও কোর্টের সামনে খেলা দেখানোর পর গায়ে সয় তো সে যায় রেল স্টেশন। তারপর কোনওদিন দুপুরে কোর্ট বন্ধ থাকলে সে পাড়ায় পাড়ায় বান্দর নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। তার আগে অবশ্য তার জানতে হয়, সেদিন ইস্কুল ছুটি কি না। তবে তা বুঝতে তার এমন কিছু বেগ পেতে হয়নি কোনও দিন। এই কোর্ট চত্বরের দক্ষিণ দিকে ও বাজারের আশেপাশের বাড়ি থেকে কত ছেলেমেয়ে স্কুলের জামা পরে ইস্কুলের দিকে। যায়। তাই দেখে সে বুঝে নিতে পারে, আজ স্কুল খোলা না বন্ধ।
মোসলেম উদ্দিন এরপর আরও যা জানায় তার কিছু কিছু এই শহরে নতুন হলেও সুকুমার ভালোই বুঝতে পারে। আজগরও বোঝে, কিন্তু সেভাবে মিলাতে পারে না। মোসলেম উদ্দিন জানায়, এই টেরেন তোলা নিয়ে অন্য রাজনীতিও আছে। সেই রাজনীতি আওয়ামী লীগ বিএনপির সাথে জাতীয় পার্টির। জাতীয় পার্টির সরকার যদি এখন ট্রেনটা এখান থেকে তুলে নিয়ে যেতে পারে, তাহলে তাদের জিত। ওদিকে আওয়ামী লীগ বিএনপি যদি ট্রেনটা না রাখতে পারে তাহলে তাদের হার। হক সাব বিএনপির নেতা, মোজাম্মেল উকিল আওয়ামী লীগের নেতা, আর সবুর সাব কমিউনিস্ট। জাতীয় পার্টি মনে করে এদের ঠাসা দিতে পারলে শহরের রাজনীতিতে তারা একটু বেশি সুবিধা করতে পাবে।
এই যে বিষয়গুলো আজগরের সামনে বলে গেল মোসলেম, সে এর ভিতরে নিজের হিসেবে যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। সে ভাবে, এ সব বোঝাবুঝি দিয়ে তার কাজটা কী?
সুকুমার এক ফাঁকে জানতে চেয়েছিল, আচ্ছা, এইরাম কোর্ট বন্ধ কয়দিন থাকপে?
মোসলেম বলল, আরে কোর্ট কি বন্ধ থাকপে? কোর্টের ভিতরের কাজ চলতি ঠিকই। তলে তলে একটা দফারফা কোনও না কোনওভাবে হবে। সরকারের সাথে সমঝোতা হবে। আর নয় সরকারই বসপেনে আপোষে।
কিন্তু টেরেন তো তুইলগা নিয়ে যাবে! জানতে চাইল আজগর।
না, অত সোজা মনে হয় হবে নানে। পারবে নানে। আবার কওয়াও যায় না। এরশাদ তো এক আজব জিনিস। তার কোনও কিছু ঠিক আছে? কোনও কিছুতে কিছু যায় আসে। আইজ এটা
তো কাইল ওটা।
আজগর বলল, ছলপলরা স্লোগান দিয়ে যায় না, এরশাদ লেখে কবিতা, পিছে আছে ববিতা।
সুকুমার এই স্লোগান শোনেনি। হাসল গলা উঁচু করে। তারপর জানতে চাইল, ববিতা আবার এরশাদের দলে যোগ দিচে নাকি?
না দিলি কয়?
গতকাল এই পর্যন্ত আলাপ হয়েছিল, এমন এক পরিস্থিতির জানা শোনা ছিল আজগরের কাছে। আজ বানর দুটো নিয়ে সে এসে কোর্ট চত্বরে। সুকুমার এসেছে তার আগে। বারিক বুড়োর বইয়ের দোকানের অশত্থ গাছটার নীচে সুকুমার মালপত্তর রেখেছে। ইব্রাহিম শেখ আসেনি। আসবে হয়তো। অথবা, ওই দড়াটানা ঘাটের দিক থেকে খবর পেয়েছে আজও কোর্ট চত্বরের অবস্থা ভালো না। কিন্তু দিলদার এসেছে। আজগর জানে দিলদার আসবে। এমন দিন দিলদারের মতন। পাবলিকের না-আসার কোনও কারণ নেই। তাদের তো অনুমান, তলে তলে গোয়েন্দাগিরি তার কাজ!
বানর দুটো ট্রেজারির পাশে কুল গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে, ফাঁকা চত্বরে দাঁড়িয়ে আজগর একবার চারদিকে নিরিখ করে। এই নাকি কোর্ট চত্বর! লোকজন আছে, আছে ঠিকই, তারা সব এখানকারই। উকিল পেশকার মোক্তার মহুরিরাও আছে। কিন্তু তারা আজগরের বান্দর খেলা দেখবে কেন? যাকে বলে পাবলিক, তা প্রায় নেই। ছাত্রদের একটা ছোটোখাটো জমায়েত উলটো পাশের ডিসির অফিসের সামনে হয়েছে, তারপর তারা চলে গেছে। মুখে মুখে শোনা গেছে, একটু বাদে কলেজের সকল ছাত্র আসবে স্কুল থেকেও বাকি ছাত্রদের নিয়ে, ছাত্রদের দাবি একটাই, এই ট্রেন কোনওভাবে তোলা যাবে না।
বারিকের দোকানের কাছে যখন তারা দাঁড়িয়ে, মোসলেম লাঠিতে ভর দিয়ে দিয়ে এসে আজগর আর সুকুমারের পাশে দাঁড়িয়ে বলে, ওদিক নদীর ওপারের মফিজ শেখ এই টেরেন উঠোইয়ে দেয়া নিয়ে গান বান্ধিছে–
এই সংবাদ অবশ্য আজগরের কাছে নতুন কিছু নয়। শহরে নতুন কিছু ঘটলেই মুনিগঞ্জের খেয়ার ওপারের কেশবপুর গ্রামের মফিজুদ্দিন শেখ তা নিয়ে গান বান্ধে। এমনকি দেশে নতুন ঘটনা ঘটলেও। আজগরের আর কতটুকু জানা শোনা এইসমস্ত। এ বিষয় ভালো জানে মোসলেম উদ্দিন আর বারিক বুড়ো।
মোসলেমের মুখে একথা শোনার পরে বারিক বুড়ো তার তন্দ্রা তার প্রতি মুহূর্তের তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখ দুটো আলত খুলে মোসলেমের দিকে তাকায়। মোসলেম হাতের লাঠিখানা একপাশে রেখে সুকুমারের বাক্স-পেঁটলার উপর বসে। বারিকের সঙ্গে তার চোখ চোখি হয়। তাদের প্রায় সমবয়েসি এই মফিজ শেখ, লতায় পাতায় জড়িয়ে মোসলেমের জ্ঞাতি ভাই। একেবারে বেবোধ এক মানুষ। হাট-বাজার-গঞ্জে ঘুরে বেড়ায়। এ নিয়ে তার একপ্রকার অহংকারও আছে। সে অহংকার মফিজ করতেও পারে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে দেশের হাটে মাঠে ঘাটে সবখানে গলায় গান অথবা ছড়া কবিতা নিয়ে না ঘুরেছে। তার বই শহরের প্রেসের মালিকেরা অল্প পয়সায় ছাপিয়ে দিয়েছে। সেই পাতলা চটি বই নিয়ে বেরিয়ে পড়ত মফিজ। লঞ্চে, ট্রেনে, বাস স্ট্যান্ডে, মাঝি ঘাটে বেচত। পড়ে শোনাত। মানুষকে বলত, সে পল্লিকবি।
মফিজের কবিতা লেখা, আর তা ছাপিয়ে বিক্রি করা নিয়ে মোসলেম আর বারিকের আলাপ শুরু হলে আরও জানা যায়, মফিজ শেখ সাহেবের ছয় দফা নিয়েও কবিতা লিখেছিল। তাই শুনেছিল তখন সবাই। এই কোর্ট চত্বরে কত মানুষ যে গোল হয়ে মফিজের কবিতা শুনত। শেখ সাহেব সে সময় ইলেকশনের জন্যে আসলে, সেই পাকিস্তান আমলে মফিজ ছয় দফার উপর কবিতা শুনিয়ে পাঁচশ টাকা পেয়েছিল। সেকথা দেশ স্বাধীনের পর নিজের পাউডারে টাকার ময়লা পরিষ্কার করতে করতে মোসলেমও কতজনকে বলেছে। বারিক এই গাছের নীচে কত কত দিন কত বার বেচেছে মফিজ শেখের বই।
সুকুমার চেনে না মফিজ শেখকে, আজগর চেনে। কিন্তু মোসলেম আর বারিকের ঝুলিতে থাকা এই ইতিহাস তাদের জানা থাকার কথা নয়। তবে, কিছুদিন আগে এরশাদকে নিয়ে কবিতা লিখলে মোসলেম যে মফিজকে গালমন্দ করেছিল, সেকথা আজগরের মনে আছে। আজগর এখন তা আর তুলল না। জ্ঞাতি ভাইকে নিয়ে এখন মোসলেম উদ্দিন বেশ আমোদে আছে। থাকুক, যখন ওপাশের বারের সামনে দেখে এসেছে, নিশ্চয়ই এখনই চলে আসবে।
তাই ঘটে। হাতে ছাপানো পাতলা এক দলা কাগজ। চাইলে লিফলেটের মতন হাতে হাতে বিতরণ করা যায়। কিন্তু তা করলে মফিজ শেখের পেটে ভাত উঠবে না। এগুলোর কিছু দিয়ে যাবে বারিকের এখানে, বারিক বেচবে। কিছু থাকবে মফিজ শেখের হাতে, ছাত্রদের দেবে। ছাত্রদের মাঝে বিক্রি করবে। তার কবিতার কদর যদি কিছু বোঝে এই ছাত্ররাই বুঝবে। বারিককে দিয়ে, তারপর গুনে নিতে বলে মফিজ শেখ প্রায় এক নিশ্বাসে বলে যায়, কাইলকে যাব কলেজে। কলেজের ছাত্ররা যা কেনবে, তাতে ছাপার খরচ উঠে যাবে।
তবে মফিজ শেখ সঙ্গে একথা জানাতে ভোলে না, এইসব ছাপার খরচ কোন উকিল, কোন ডাক্তার সাব, অর্থাৎ কোন কোন নেতা তাকে দেয়ার কথা বলেছে। যদিও বারিক বুড়ো আর মোসলেমের কাছে সেকথার তেমন গুরুত্ব নেই। কারণ, এমন কথা আগেও অনেক সময় অনেকে মফিজকে দিয়েছে, পরে তাদের কাউকে আর খুঁজে পায়নি। তখন ধরনা দেবে এই বারিকেরই কাজে। কয়ডা বিক্রি হইছে, দেবে নাকি সে বাবদ কিছু পয়সা।
মফিজ এক তোড়া কাগজ বারিকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, গুইনে দেহে, এই জায়গায় শ খানেক আছে। আরও লাগলি আইনে দেবানে।
বারিক বলল, এতেই হবে নে। আর লাগবে না। আজকাল মানুষ বই পড়ে না?”
মফিজ শেখ উলটো ঠেলা দেয়, রাইহে দে, এবারের কবিতা ভালো হইছে। জীবনে তো এরাম বই কম লিহিনি। তা প্রায় ষাইট সত্তরখান তো হবে।
মফিজের উঁচু গলার এসব কথা, ঘটনার উত্তেজনা–সব মিলে অশত্থ গাছতলায় খানিকটা জমায়েত। এর ভিতরে যদি এখন মফিজ শেখকে এভাবে থামিয়ে দেয় বারিক তা সে শুনবে কেন? সমবেত জনতার দিকে তাকিয়ে তারপর বারিককে বলে, পইড়ে দেখ হইচে কীরাম এবার।
এরপর বারিককে আর পড়ার সময় না দিয়ে নিজেই মাত্র একবার হাতের দিকে তাকিয়ে তারপর বলে যেতে থাকে :
শোনেন শোনেন শোনেন, শোনেন দিয়া মন,
ও বাগেরহাটবাসী, আর থাকপে না টেরেন।।
আশেপাশে মানুষের আগ্রহ খেয়াল করে। মফিজ শেখ আরও জানায় :
এইবার বুঝি ছুঁইটে গেল রেললাইন–
নিয়ে গেল আমাগোর মেলা দিনের পেরেম ॥
তারপর তার রচিত এই চারটি পদের সঙ্গে জুড়ে দেয় অনেক অনেক দিন ধরে এই অঞ্চলে ট্রেন নিয়ে প্রচলিত আরও দুটো লাইন :
রেলের গাড়ি কলে
চলে রূপসা হইতে বাগেরহাট।
গড়গড়াইয়া চলে গাড়ি লাট সাহেবের ছাতির বাট ॥
এ লাইন দুটোও হয়তো কোনও লোককবিরই রচনা। সেকথা জানে না মফিজ শেখ। জানে না। এখানকার কেউ। তারা একদা এই ট্রেন নিয়ে এমন লোকগান শুনে এসেছে। আজ সেই ট্রেন এখান থেকে উঠে যাচ্ছে, তা নিয়ে মফিজ শেখও এই লাইনগুলো সবাইকে শোনাচ্ছে। হয়তো একদিন এই ট্রেন উঠে যাবে, ছাত্রদের জনতার এলাকাবাসীর কোনও প্রতিরোধ কাজে আসবে না, অথবা এ নিয়ে প্রতিরোধে সামিল হওয়ার থাকবে না কেউ, তখন এমন পল্লিকবি মফিজ শেখের এই পঙক্তিগুলোও প্রয়োজনীয় মনে হবে। যেমন, এই ট্রেনের সারাটা কাল ধরে গড়গড়িয়েই চলেছে ব্রিটিশ লাট সাহেবের ছাতির বাটেরই মতন। এর বেশি কোনও গতি তার কোনওকালে আসেনি। আজও আসেনি, পাকিস্তান গেছে, বাংলাদেশেও গেছে দেড় যুগ। লাটের ছাতি নেই, তাই গড়গড়িয়ে চলে সে এক গরুর গাড়িরই মতন। তাকে অপ্রয়োজনীয় করে তুলতে কতজনের কত পদের আয়োজন, তা মফিজ শেখ তার গান দিয়ে এখন কী করে আটকাবে।
যদিও ছাত্ররা অত শত জানে না। তারা জানে, কলেজে আসতে তাদের প্রয়োজন এই ট্রেন। তাই তারা আন্দোলনে শামিল। নেতাদেরও কেউ কেউ, কারণ এই সরকারবিরোধী তারা, সরকারের সিদ্ধান্তও ঠিক নয়। কিন্তু তারা অনেকে এও জানে, তাদেরই আত্মীয়স্বজন অনেকেরই বাসের ব্যবসার উন্নতি হবে। বাস মালিক সমিতি তাদের দূরের কেউ নয়।
প্রচলিত লাইন দুটো শোনাতে না শোনাতেই, ছাত্রদের একটা বড়ো মিছিল ডিসির অফিসের দিকে আসে। মিছিলটি খুব জঙ্গি, এই অর্থে ছাত্ররা প্রায় দৌড়ে এসেছে যেন। ডিসি সাহেবকে এখনই তাদের সঙ্গে দেখা করতে হবে। স্লোগানে জানাচ্ছে তারা, যদি আটক নেতাদের কিছু হয়, প্রতিটি ঘরে আগুন জ্বলবে। তারা জেলের তালা ভেঙে হক, মোজাম্মেল আর সবুরকে বের করে আনবে। আর এরপর একজন বক্তা জানাচ্ছে, যদি এই রেল তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে শেষ ট্রেন যাওয়ার আগে তারা রেল পাটির ওপর শুয়ে আত্মাহুতি দেবে। তার ভিতর দিয়ে এরশাদ শাহির পতন হবে। সঙ্গে সঙ্গে রেলের স্লোগানের সঙ্গে ছাত্রদের একাংশ এও জানায়, এক দফা এক দাবি, এরশাদ তুই কবে যাবি!
অশত্থ গাছতলা থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে উলটো তাকালে ডিসির অফিস। মফিজ শেখ হাতের লিফলেট মতন কবিতাগুলো নিয়ে সেদিকে ছোটে। বাকিরাও ওদিকে তাকিয়ে। সেখানে প্রচুর পুলিশ। ছাত্ররা উত্তেজিত। যদিও সবারই জানা আছে, অন্তত বোঝেও, ছাত্ররা এখানে কিছু করবে না। যদি তেমন কিছু করে তো রেল স্টেশনে। এখানে নয়।
ছাত্ররা কিছুই করে না, তাও-বা কী করে হয়। ডিসি অফিসের সামনে থেকে উঁচু গলার শব্দ আসে। কথা কাটাকাটি ভেসে আসে। মোসলেম কিংবা বারিক ডিসিকে চেনে, আজগরও এক আধদিন তাকে দেখেছে। তারা জানে, এই লোক তার সুন্দর কথা দিয়ে ছাত্রদের বোঝাতে পারবে।
ছাত্রদের ওই জমায়েত থেকে দিলদার এখানে এসে জানায়, ছাত্রদের দাবি শুধু ট্রেন নিয়েই না, তারা জানতে চায় উকিলদের ছাড়বে কবে। এই দাবি তো তাদেরও। এই উকিলরা নেতা মানুষ। উকিলদেরও নেতা, তাদের ছাড়লে কোর্টও সচল হবে। কোর্টের সবচেয়ে বয়েসি উকিল নারায়ণ বাবু নাকি হুমকি দিয়েছেন, যদি তাদের না-ছাড়া হয়, তাহলে অনির্দিষ্টকালের জন্য কোর্টে কোনও কাজ হবে না।
মোসলেম উদ্দিন এই শোনে আর সরু চোখে দিলদারের দিকে তাকায়। দিলদার জানে, এটা মোসলেম উদ্দিনের স্বভাব। এই লোক কোনও দিন যেন দিলদারকে দেখতে পারে না। সব সময়ই দিলদারের কথায় তার সন্দেহ। কিন্তু এতই যদি সন্দেহ, তাহলে গিয়ে দেখে আসলে পারে ওই জায়গায় ছাত্রনেতারা ডিসিকে এইসব কথা বলছে কি না?
এ সময় জরিনা আসে। মুখোনা বিষণ্ণ। আসতে আসতে, এখানে দিলদার দাঁড়িয়ে আছে দেখেও তার মুখের বিষণ্ণ ভাব কোনওক্রমেই কাটে না। কাটার কোনও কারণ নেই। দিলদার আছে থাকুক। যদিও দিলদার জরিনার দিকে তাকিয়ে হেসেছে। জরিনা তার উত্তর দেয়নি। আর এমনভাবে তাকিয়ে মুচকি হাসা তো সব সময়ই তাদের ভিতরে বিনিময় হয়, এ নিয়ে আজগর-বা আর কারও বাড়তি খেয়াল দেয়ারও কোনও প্রয়োজন নেই।
জরিনা সুকুমারকে খোঁজে। আজগরের কাছে সুকুমার কোথায় জানতে চায়। চারপাশের পরিস্থিতি অনুযায়ী আজগর নীচু গলায় জানায়, এইমাত্র সুকুমার এখানেই ছিল, আছে আশেপাশে। মনে হয় পান-বিড়ি খেতে গেছে।
জরিনা চারদিকে তাকায়। পান-বিড়ি খেতে গেলে, ডিসি অফিস কিংবা চত্বরের ওপাশে কোর্টের দিক থেকে সুকুমারের আসার কথা নয়। আসবে পিছনের মেইন রোডের দিক থেকে অথবা একটু ডান দিকে কোর্ট বিল্ডিংয়ের ফাঁক গলে। জরিনা সেদিকে উল্কণ্ঠিত চোখে তাকায়। সে তাকানোয় আজগর উঠে জরিনার কাছে আসে, কী হইচে? তোরে এইরাম দেখাতিচে কী জন্যি!
জরিনা একটু যেন হতবিহ্বল। সে আজগরকেও বলতে চায় না কিছু, এমন তার চোখ। বলে, সুকুমার ভাই গেল কোতায়? তারে লাগবে
কেন, হইচে কী, আমারে ক–
ঝিলিক মনে হয় চইলে গেল। চইলে গেইচে হাহাকার করে ওঠে জরিনার গলা। ঝিলিক চলে গেছে কথাটা সে কষ্টে একাকার মুখে বলল সে। জানাল, ঝিলিককে আটকাতে পারেনি। কিন্তু এখন আজগরের কাছে কোথায়, কখনও, কেন এমন কোনও প্রশ্নও শুনতে চায় না।
আজগরের চোখমুখও ভ্যাবাচেকা দশা, কোথায় গেল? কোন দিক?”
সেয়া তুমি জাইনে করবা কী?
কেন?”
এই শরীরে তুমি এহেন কোথায় খুঁজদি যাবা? মাঝিঘাটা, বাসস্ট্যান্ড না রেল স্টেশনে? কোনদিক গেইচে, কোথায় যাবে আমারে কিছু কইয়ে যাইনি। আলতাফের হোটেলের সামনে দেহি নিজের একটা মোলা ব্যাগ হাতে নিয়ে দাঁড়াইয়ে রইচে। আমি সামনে আসতিই কল-
জরিনা থামে। মেইন রোডের দিকে তাকায়। তার মনে হয়, সদ্য অসুখ থেকে ওঠা আজগরকে এ সব বলা অর্থহীন। এই শরীরে যদি মানুষটা এখন ঝিলিককে খুঁজতে রওনা দেয়। জরিনা ঘাড় ঘুরিয়ে টাইপিস্টদের ছাউনির দিকে তাকায়। ওখানেই সুকুমার আছে, কিন্তু জরিনার চোখে পড়ল না। কারণ, এসময়ে ডিসি অফিসের সামনে থেকে ছাত্রদের সমবেত স্লোগান আসছে। নিশ্চয়ই তাদের কোনও দাবি মেনে নিয়েছে। অথবা, জানা গেছে কাউকে আজই ছেড়ে দেয়া হবে। জরিনা এসব বোঝে না। তার জানার কথা না। কোর্ট এখন স্থবির, এই অবস্থায় দিন চলতে পারে না, এমন হলে তাকে দিলদার কেন, অন্য মানুষ খুঁজতে হবে। অথবা সন্ধ্যার অন্ধকার পড়লে ঘুরঘুর করতে হবে ট্রাফিক ব্যারাকের সামনে। যদি তাকে কোনও পুলিশ ওই শুকলাল সংগীতের পিছনে নিয়ে যায়। আর নয়, সারাটা সন্ধ্যা কাটিয়ে দিতে হবে বেঙ্গির সঙ্গে, যদি বেঙ্গি তার জন্যে পার্কে অথবা অফিসার্স ক্লাবের পিছনে কোনও খদ্দের নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু এসব চায় না জরিনা। আজগর কাবু-কেতরা, আজগরের আয় রোজগার নেই, তবু সে আজগরের সঙ্গেই তো থাকে। আজগরই তার সব। সেই আজগরের চোখ এড়িয়ে এভাবে দুটো ভাতের জন্যে এইসব! নিরুপায় জরিনার ভিতরে হাহাকার করে ওঠে, সত্যি তার ভালো লাগে না।
আজগর উদ্বেগজড়ানো চোখে বলে, কী কইল?
কল, জরিনাদি তোমার ভাইরে কইয়ো আমি চইলে গেলাম।
কোতায় গেল?
সেয়া তো জানি না। আলতাফের হোটেলের কোনায় ওই পানের দোকানের সামনে দাঁড়ানো ছেলে একখানা রিকশা, আমি কিছু জিগানোর আগে রিকশায় যাইয়ে লাফ দিয়ে ওটল!
আজগর জরিনার মুখে তাকায়, গেল কোন দিক?
কী কইরে কব? কলাম না, সোজা মাঝিঘাট গেল না, না ডাইনে ঘুইরে রেল লাইনের দিক না সেইহেন দে বাস স্ট্যান্ডে আমি আর রিকশাখানা ঠাওড় করতি পারিনি।
আজগর পারে তো এখনই রওনা দেয়। জরিনা বলে, তুমি আবার যাইয়ে না। এই শরীর লইয়ে রোদ্দুরে ঘুরলি আর থাকপা নানে। এহেবারে কেতরাইয়ে যাবানে।
তবু যেন আজগর রওনা দেয়। ওই জায়গায় থেকে ট্রেজারির পাশে তার বানর দুটোর দিকে দেখে। সে দুটো ছায়াতেই আছে। দড়ি একটু লম্বা করে দেয়ার পাশের আতা গাছটার তলায় ঝিমুচ্ছে। এই কোর্ট-কাছারি, এই স্থবিরতা, তাদেরকে কলা দেওয়া ঝিলিক–কোথায় কি ওলোট পালট হল, অবলা প্রাণীর সে খোঁজ জানার কথা নয়। তার চেয়ে, বেশ কদিন পরে এই পরিচিত চত্বরে আসতে পেরে দিব্যি আছে। এখন আতা গাছটার নীচে ছায়াও বেশ। সেখানে তারা বুড়া বুড়িও নয়, জোয়ান নয়, শ্বশুরবাড়ি কি রান্নাঘরে কোথাও কারও যাওয়ার প্রয়োজন নেই। একদল মানুষের সামনে কোনও ছদ্ম ভালোবাসাও তাদের প্রদর্শন করতে হচ্ছে না। বরং, এখনকার এই তন্দ্রা অনেক নিরাপদ!
এখন ঝিলিককে খুঁজতে গেলে আজগর যে কেতরে-কাহিল হবে, তা সে নিজেও জানে। জরিনা বললেও সে যেতে পারত না। এই কোর্ট চত্বর পর্যন্ত আসতেই তার হাঁটুগুলো অসহযোগিতা করছে। দাঁড়াতে ভালো লাগে না। তবু এসেছে। যদি মানুষজন আসত, তাহলে খেলা দেখিয়ে দুটো পয়সা পেত। আলতাফের কাছে বাকি, হাফেজের রুটির দোকানে বাকি, হাফেজের বউ লালি পয়সা না পেলে দিন দুই বাদে কথা শুনাইতে ছাড়বে না।
এখন না-গেলও আজগর কিন্তু জরিনার কাছে এটা তো জানতে চাইতে পারে, গেল কেন ঝিলিক?
জরিনা বলল, ওরে সেয়া তো আমারে কইয়ে যায়নি।
কানদিচে নাকি?
চোখ এট্টু ভেজা।
মোড়েলগঞ্জ না কোন জায়গায় গেইল কয়দিন আগে, সেইহেনে গেল নাকি?
তোমার যা কতা, লি ওইভাবে কইয়ে যায় যে, তোমার ভাইরে কইয়ো, আমি চইলে গেলাম।
হয়।
তোমার বোধ হল না কোনও কালে। বাল তোমার সাতে থাকপে কোন বিটি। বাল বোঝে কিছু? আমি বুইলে থাইহে গেলাম।
থাকতি কয় কার বালে? থাহিস না। চইলে যা, যেহানে মনে চায় চোদাইয়ে আয়—
ফাও কতা কইয়ে না দিন। তোমার চেটের ফাও কতা শুনতি শুনতি জীবনডা গেল।
সত্যি, এই মুহূর্তে এসব ফাও কথা। একথা তর্ক বা ঝগড়া করেও বলা না। পরস্পরের সঙ্গে রঙ্গ-তামাশা। এর মানে আজগরের শরীর খানিকটা ভালো, গলায় অন্তত প্রকৃত আজগরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। দিন দুয়েকের ভিতরে লোকটা আরও চাঙা হবে নিশ্চিত।
আজগর জরিনার কাছে নিজেদের কথায় ফিরে আসে, দুইজনের এই কয়দিনে ঝগড়া করতি দেহিচিস?”
না। সেয়া করার মানুষ তারা না। সামনে তো করবে না। আলতাফের হোটেলে রাত্তিরে ঘুমোনোর সময় করিচে নিকি?
আলতাফের কিছু জিগোইচিস?
কী জিগোব?
এই যে?
এইয়ে মানুষের ঢোল দিয়ে জিগোন যায়? তুমি যে কী? তাছাড়া ওরা সম্পর্কে কী তা তুমি আর আমি ছাড়া অন্য মানুষ জানে নাকি?”
না, তা জানে না।
তালি?
আজগরের কাছে সত্যি এর কোনও জবাব নেই।
এই সময়ে টাইপিস্টদের ছাউনির বাইরে সুকুমারকে দেখতে পেল জরিনা। উঁচু গলায় ডাকল, ও সুকুমার ভাই?
সুকুমারের হাতে মফিজ শেখের ট্রেন নিয়ে লেখা পদ্যখানাসহ আরও-একটা কাগজ। এটা ট্রেন তুলে নেওয়া নিয়ে ছাত্ররা বিলি করেছে। তার একখানা সুকুমারের হাতে। একমনে পড়ছিল। জরিনার ডাক প্রথম বারে শুনল না। তারপর শুনে তাকাতেই দেখে, তার দিকে উৎকণ্ঠিত মুখে তাকিয়ে আছে আজগর আর জরিনা।
সুকুমার তাদের দিকে এগিয়ে আসতে, মাঝখানের রাস্তাটা প্রায় দৌড়ি পার হয়ে জরিনা বলে, ঝিলিক বুন্ডি কোথায় জানি চইলে গেইচে, ও সুকুমার ভাই!
সুকুমার কিছুটা বিস্মিত কিছুটা জেনে জানত এমনভাবে বলল, চইলে গেইচে? কহোন?
কেন তুমি জানতা?
না, জানতাম না।
তালি, কলা যে কহোন?”
কাইল কতিল, লালির ওইহানদে আসার সময়, একজনরে পাইচে, যে ওর স্বামী মানে আমার সেই দাদারে চেনে। জানে ওর ছওয়ালডা কোতায় আছে। ওর এহোন ছওয়ালডারে দেকতি মন চায়।
চায় তো ভালো কতা। সব মায়েরই চায়। তার এহেন কোতায় গেলি ছওয়ালরে পাবে, তারা তো থাহে ইন্ডিয়ায়। সে কি এই জায়গায়?
সেয়া তারে বুঝেইয়ে কয় কেডা? উপরদে দেখিচেন ঠান্ডা, আসলে ভিতরে ভিতরে মাইজে বউ ভীষণ ঘাউরো। কেউর কথা শোনে না। পরশু দিনদে মনে হইচে চইলে যাবে, আইজই হাঁটল।
তা তো বোঝালাম, তা যাবে কোয়ানে?
এহোন নাকি যাবে ফুলতলা। যার সাতে কথা হইচে সে ফুলতলায় থাহে, সেই জায়গার ঠিকানা দিয়ে গেইচে।
তারপর?
তারপর আর কী, সেই ফুলতলার বিটি সাতক্ষীরার ওই জায়গা দে ওপার নিয়ে যাবে। সেই জায়গা বশিরহাট না কী কয় কোন জায়গা নাকি ধারে—
সুকুমারের এ সব কিছুই বলতে ইচ্ছে করছিল না। গেছে গেছে। যেমন হঠাৎ এসেছিল সেভাবেই চলে গেছে। আবার কোনওদিন দেখা হবে তারই-বা নিশ্চয়তা কী? একবার একবার এই কথা ভেবে সুকুমার উদাস হতে পারে। এখন অবশ্য তার কিছু ঘটবে। এই চত্বরে আজও তার আসর বসানোর সুযোগ নেই। আলতাফের কাছে ঋণ। এর ভিতরে ছিল ওই কথা কওয়ার মতন। একটা মানুষ, সেও চলে গেল। কেন গেল, সেকথা তো সে চাইলে সব জরিনাকে বলতেও পারবে না।
তবু জরিনা যেন সেই কথাই জানতে চাইল, তোমাগো মদ্যি বাদাবাদি হইচে নিকি?
দেখো জরিনা প্রায় আসল প্রসঙ্গে চলে আসছে। সেদিকে যাবে না সুকুমার। এখন একবার ডিসি সাবের অফিসের সামনে যেতে পারলে হত। ছাত্রদের ভিড় পাতল হয়ে গেছে। নেতাদের নিয়ে মিটিং হচ্ছে। পরে কী সিদ্ধান্ত হয়, জানা যাবে।
সুকুমার বলল, না, কোনও বাদাবাদি হইনি—
তালি যাও এহোনই ফিরোইয়ে নিয়ে আসো। যাওয়ার সময় দেখলাম, চোখ দুটো ভরা পানি নিয়ে গেল।
কী যে কও, এহোন গেলি আর পাবানে?”
অন্তত জানো যহোন খুলনো যাবে, তালি টেরেনের ওই জায়গায় যাইয়ে দেহহা, পাইয়ে যাবানে মনে কয়–
কী যে কও না? কহোন গেইচে। এহোন আবার পাওয়া যাবে নিকি?
তবু যাও।
জরিনার পিড়াপিড়িতে সুকুমার রেল স্টেশনের দিকে রওনা দেয়। যাবে হেঁটেই। তাতে ততক্ষণে ট্রেন হয়তো চলে যাবে। তার ঝিলিককে ফিরিয়ে আনতে ইচ্ছে করছে না। তবু সুকুমার জানে না কেন যাচ্ছে।
যে কথা হয়েছিল তার সঙ্গে ঝিলিকের তা অতি তুচ্ছ। এমন বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি থেকে ঝিলিকের চলে যাওয়া পর্যন্ত গড়ানোর কথা না। কিন্তু ঝিলিকই সেখানে নিয়েছে। কথার মাত্রা এত দূরে ছাড়িয়ে গেছে যে সুকুমার বলতে বাধ্য হয়েছে, তোমার যা ইচ্ছে করো।
লালির-হাফেজের রুটির দোকানে ব্ল্যাকে শাড়ি-বেচা যে মহিলার সঙ্গে ঝিলিকের দেখা হয়েছিল, তার কোনও কিছুই পছন্দ হয়নি সুকুমারের। ঝিলিকের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছে। ঝিলিক রুটির দোকানের বাইরে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, তার দেবর। তারপর এই পথটুকু আসতে আসতে ঝিলিক জানায়, ভরত কোথায় আছে ওই মহিলা জানে।
তুই জানো, ওই বিটি ফুলতলার কোতায় থাকে?
হয়, খুলনায় ওর বোনের বাসায় আসত।
আচ্ছা, তালি তুমি যে যাবা, ভক্তদা তোমারে নেবে। সে তো অন্য মানুষ নিয়া থাহে।
যাইয়া তো দেহি–
সে সময় এ নিয়ে আর কথা বাড়ায়নি সুকুমার। কথা মুলতবি রেখেছিল, পরে বলবে। রাতে আলতাফের হোটেলে শুয়ে সুকুমারের গলার স্বর নামিয়ে, এমনকি আলত করে ঝিলিকের মুখমণ্ডল ছুঁয়ে বলে, মাইঝে বউ, তুমি যাইয়ে না। আমি একলা মানুষ, এ জায়গায় ও জায়গায় ঘুরি–তুমি সাতে থাকলি তবু একজন মানুষ থাকল, ফিরি আইসে চাইরডে কতা কওয়ারও একজন মানুষ হয়।
সবই বুঝি, কিন্তু আমারও তো ছওয়ালডারে দেকতি ইচ্ছে করে।
আমরা নয় ফাঁকে একবার যাবানে—
হয়, আর গেইচি—
থাইয়ে যাও।
সুকুমারের এই আকুতির উত্তরে ঝিলিক হঠাৎ না– বলে একেবারে যেন খেঁকিয়ে উঠল, যাই, চইলে যাব। তোমার ধারে থাকলি মানষি কবে আমি তোমার বান্দা মাগি!
কী ফাও কথা কও! মুখটুকু ঠিক আছে? অন্য পাশে মানুষজনও থাকতি পারে।
ফাও কত না, কও দেহি, আমি তোমার বান্দা মাগি ছাড়া আর কী।
বাদ দেও।
কাজ নেই, কাম নেই। উনি সারাদিন খেলা দেখাইয়ে ফিরে আসপে, আমি পা ফাঁক কইরে ওনার জন্যি শুইয়ে থাহি!
সুকুমার শোয়া থেকে উঠে বসে। মেজো বউর মাথা পাগল হয়ে গেল নাকি। নাকি ছেলের শোকে মাথা খারাপ। এসব কী বলে। ফাঁকা জায়গায় পরে রাস্তার দিকে এই দোতলায় যে বাড়তি জায়গা সেখানে এসে দাঁড়ায়। একবার ভাবে নীচে নেমে যাবে। কিন্তু এখন এই রাতে নীচে মেসিয়াররা শুয়ে আছে। সামনের দরজা বন্ধ। সুকুমার খুপড়ির সামনে এসে ঝিলিককে বলে, তোমার যে জায়গায় মন চায়, চলে যাও। আমি তোমারে আটকাব না।
আচ্ছা, ভালো হইছে।
আর এই জায়গাদে আমিও চইলে যাব, ফিরি আসলিও পাবা না।
কোথায় যাবা?”
তা জানি না।
এসব কথা একটু আগে জরিনাকে বলল না সুকুমার। তবে তার হেঁটে রেল স্টেশন আসতে আসতে ট্রেন ছেড়ে গেছে। তাহলে ছাত্ররা আর ট্রেন আটকাবে না, আজকের মতো চলেছে। ঝিলিক এতক্ষণে নিশ্চয়ই কলেজ স্টেশন পর্যন্ত চলে গেছে। আরও দূরেও যেতে পারে।
সুকুমার রেল স্টেশন থেকে নদীর কূলে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর সেখান থেকে দ্রুত হেঁটে ফিরে আসেবে আজগরের ঝুপড়ির সামনে। ততক্ষণে নিশ্চয় অন্ধকার হয়ে যাবে। এখন তার কিছু ভালো লাগছে না। এই পথটুকু হেঁটে আসতে আসতে সুকুমার সিদ্ধান্ত নিল, সেও চলে যাবে!