লঞ্চঘাট থেকে নদীর কূল ধরে নাগের বাজারের দিকে এগোলে, মাঝামাঝি জায়গায় হাফেজ আর লালির রুটির দোকান। লালি হাফিজের বউ। সেখানে রুটি কিনতে এসেছে জরিনা। আজগর সঙ্গে আসেনি। আজগর যে আসবে না, জরিনা জানত। দুপুরের পর থেকে জরিনার সঙ্গে ওই সমস্ত করে, তারপর লোকটা লম্বা ঘুম দিল। জরিনা বেশিক্ষণ ঘুমায় পর থেকে অথবা জরিনার ঘুম আসেনি। সে উঠে সুকুমার আর ঝিলিককে খুঁজেছে। তখন জরিনার আসলে কোনও কাজ ছিল না। সে জানে, অমন সব করার পরে আজগর প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমাবে। তাছাড়া সুকুমারের সঙ্গে ওই ঝগড়ার আজগরের মনটা খারাপ। একেবার ঘুমে তলিয়ে গেলে, উঠে যদি মনটা ভালো হয়, একটু ফুরফুরা আজগরকে দেখতে তখন তারও ভালো লাগবে। শুধু শুধু মেজাজ করে তার সঙ্গে কথা বলবে না। সন্ধ্যার দিকে এক কাপ চা খেয়ে তারপর কিছুক্ষণ নদীর কূলে হাওয়া বাতাস খাবে।
কিন্তু তার আগে দীর্ঘ সময় জরিনার। এমন গরমের দিনে বিকালে একটু বাতাস চাললেও পারে। একবার নদীর এপার ওপারের নারকেল গাছের পাতাগুলোয় বাতাসের নাচন দেখেছিল। তখন জরিনার মনে হয়েছিল, এই যে বাতাস চালাল, এবার দুনিয়াদারি ঠান্ডা হবে। কিন্তু কোথায় কী? একটু বাদেই আর নেই। একটা নারকেল গাছের পাতাও কাঁপল না। অল্প অল্প হলেও একটাও মেঘনিশ গাছের থেকে ঝরে পড়ল না পাতা। নদীর পানিতে কোনও তরঙ্গ বয়ে গেল না। বরং, দুপুরের শেষ দিকে তাপ যেন আরও বাড়ল। বিকাল পর্যন্ত সেই তাপ। তার ভিতরে আজগর ওই ঝুপড়ি ভেঁস ভেঁস করে ঘুমায়। এদিকে জরিনা কাপড়-চোপড় একটু গুছিয়ে পরে, চুলটা একটু গুছিয়ে এক প্যাঁচে খোঁপা করে লঞ্চঘাটের পন্টুনের ওপর আসে। মনে আশা, এই নদীর কূল ধরে ডাক বাংলো ঘাট দিয়ে ঢুকে পুরো কোর্ট চত্বর আর ক্লাব আর আশেপাশে সুকুমার আর ঝিলিককে খুঁজে আসবে।
জরিনা জানে, বিকালে কোর্ট চত্বর ফাঁকা। অফিস আদালতে তখন মানুষের আর কাজ কী? তবে ডিসি অফিসে আলো জ্বলে, সেখানে বড়ো বড়ো সাহেবরা কত পদের মিটিং করে। সেই সোজা কোর্ট মসজিদ রোডের দোকানে তখন মানুষ, আরও এগোলে কাজী নজরুল ইসলাম রোড কি কাপুড়ে পট্টিতেও মানুষজন তখন গিজগিজ। ওই কাজী নজরুল ইসলাম রোডে পড়ে বাঁয়ের হাতায় আবার মেইন রোড। ওটাই রাহাতের মোড়, লঞ্চঘাটের একেবারে লাগোয়া। জরিনা এই পথটুকু ঘুরে আসবে ঠিক করে। রাহাতের মোড় থেকে হোটেলের পাশের গলি ধরে আবার যাবে নদীর কূলে। যাওয়ার আগে ওই ভাতের হোটেল। এমনকি একবার লঞ্চঘাটে আলতাফের ভাতের হোটেলেও যেতে পারে। কিন্তু আলতাফের চোখ বড়ো খারাপ, শালার কথাও খারাপ। মাছের মাথা খাইয়ে যাতি কয়! তাকে বলেছে, একদিন আসতে, হোটেলের দোতলায় নিয়ে পাশে বসিয়ে কাতলার মাথা খাওয়াবে। শালা, কাতলার মাথা খাওয়াবে না সস্তা মেইড মাছের তা জানে কেডা?
থাক, আজগরকে ঘুমন্ত রেখে আগে লঞ্চঘাটের পন্টুনে এসে জরিনা দেখে, সব লঞ্চ ছেড়ে গেছে, শুধু ঢাকার লঞ্চখানা বাঁধা। আর যেসব লঞ্চ ফিরে আসবে, সেগুলোও আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা। কদম আলি পন্টুনের এক কোনায় বসে বড়ালিতে গুলসা টেংরা ধরছে। এই ভাটির গোনে টেংরা বাঁধবেই। আগে জরিনার এসব ভালোই হিসেব থাকত। আজকাল কখন কোন গোন যায়, কী হয় না হয়, ওপার চরগার মাঠে জোগার গোনে মাছ ওঠে কি ওঠে না–সেসব কোনও কিছুই তার মাথায় থাকে না। অথবা, এসব জরিনা মাথায় রাখার প্রয়োজনবোধও করে না। দরকার কী? তবু, ওই কদম আলির কাছে থেকে বড়শি নিয়ে একদিন দুইদিন কি সেও বড়শি বায়নি। এখনও চাইলে বাইতে পারে। বড়শি চাইলেই কদম আলি বলবে, যা ওইদিক, ওপাশে দেখে উপরের দিক আর একটা বড়শি আছে। আইসে বা। তয় মাছ নিয়ে বাজারে যাতি পারবি না, আমারে দিয়ে যাবি। তোগে চাউল চুলো নেই, মাছ দিয়ে করবিডা কী?
হুঁ, সারাবেলা বড়শি বাইয়ে, মাছ দিয়ে যাও ওনারে! জরিনা ভাবে। কিন্তু কদম আলির কথাও তো সত্যি, জরিনার চাল-চুলো নেই। চাল-চুলো নেই আজগরেরও। কদম আলির সংসার আছে। সে কি আর তাদের মতন। ঘাটের কেয়ারটেকার। সরকারি চাকরি। পুরোন বাজারে বাসা তার। লঞ্চ না থাকলে, যাত্রী না আসলে এই সময়ে তার কাজ কী? তখন পন্টুনে বসে বড়শি বায়। এমনকি নদীর একেবারে কুলে শ্যাওড়া গাছ, গোলপাতা গাছের তলায়ও টেংরা ধরে। কখনও এক সঙ্গে দুটো বড়শিতে মাছ ধরে কদম। তখনও জরিনা পাশে গিয়ে দাঁড়ালে বলে, কী মাছ ধরবি? তারপর জানায় কোথায় আরও বড়শি আছে।
এখন কদম আলির কাছে ভিড়ল না জরিনা। কদমের উলটো দিকের পন্টুনের একবার চোখ দিল, তারপর বের হয়ে এল লঞ্চঘাট থেকে। জরিনার একবারও মনে হল না, ঘাটে বাঁধা ঢাকার লঞ্চেও তো থাকতে পারে সুকুমার আর ঝিলিক। মনে না হওয়ার কারণও আছে। এই সময়ে কোনওভাবেই তাদের ঢাকার লঞ্চে উঠে বসে থাকার কোনও সম্ভাবনা নেই।
লঞ্চঘাট থেকে বেরিয়ে, নদীর পাড় ধরে জরিনা ডাকবাংলো ঘাটের দিকে গেল। সেই পথে, যে পথ তার কল্পনায় ছিল যে, ডাকবাংলো ঘাট হয়ে সে যাবে কোর্টের দিকে। এইসমস্ত জায়গা, সবখানেই খুঁজবে তাদের। জরিনার বারবার মনে হয়েছে, আজ দুপুরে আজগর সুকুমারের সাথে কাজটা তেমন ভালো করেনি। এজন্যে জরিনা একটু হলেও মোসলেমকেও দোষ দেয়। বয়স্ক মানুষ মোসলেম, তার উচিত ছিল ঘটনাটার ওই জায়গায় একটা ভালো ফয়সালা করে দেয়া। তা করল না। আবার, সুকুমারও ওই সময় ওইভাবে রাগ দেখিয়ে চলে না-গেলেও পারত।
যাই হোক, যা ঘটার ঘটে গেছে। জরিনা এর একটা ফয়সালা চায়। সুকুমার মানুষটা খারাপ না। খেলা দেখিয়ে পেট চালায়। সেই মানুষটার সঙ্গে খালি খালি আজগর এমন করবে কেন? তাছাড়া এই জায়গায় এসেছে বেশিদিন হয়নি, আবার কবে চলে যায়, কয়দিনের জন্যে এই জায়গায় এক-একজন আসে, কিন্তু আজগর বান্দরঅলা তো বহুদিন ধরে এই জায়গায়, সে এইরম না করলেও পারত!
এসব ভাবে। যদিও জরিনার মনের তলানিতে ঘটনাটি একটু অন্য। সে কারণ, ওই ঝিলিক। জরিনা জানে না, ঝিলিকের সঙ্গে সুকুমারের সম্পর্ক কী? কিন্তু ঝিলিককে চেনে সে। ভালো মতোই চেনে। যদিও এখনও সুকুমারের সঙ্গে ঝিলিক থেকে থাকে, তাহলে অনেকদিন বাদে তাদের আবার এক জায়গায় দেখা হবে। দুপুরে বলতে গেলে এক পলক দেখেছিল, কোর্টের কোনার ওই হোটেলে, সেখানে ঢুকতে ঢুকতেই বেরিয়ে এসেছিল জরিনা। ঝিলিকের সঙ্গে ভালোমতো কথাও হয়নি। তাছাড়া জরিনা ওই হোটেলে প্রায় ঢোকেও না, যদি উকিল পেশকার মহুরিরা তাকে বের করে দেয়। একদিন এক উড়ে মালি আর তার বউ ঢুকেছিল, তাই নিয়ে দোকান মালিকের কী গালমন্দ, জরিনা তখন কাছেই দাঁড়িয়ে। তখন ঝিলিককে দেখে সে ঢুকেও ছিল, মোসলেম একটু এগিয়ে, কিন্তু ওই এক পলকের দেখার সেই মুহূর্তে টাইপিস্টদের বড়ো একচালা ঘরখানার সামইে তো চলছিল আজগর আর সুকুমারের কাজিয়া। তখন কি সে জানত, একটু বাদে ঝিলিক এসে সুকুমারের পাশে দাঁড়াবে আর তার প্রায় পরক্ষণেই তারা দুজন ওই জায়গা ছেড়ে হাঁটা দেবে।
তবে, এখন এমন না যে ঝিলিককে জরিনার দরকার। কিন্তু কতদিন বাদে দেখা। ভালোমন্দ কয়ডা কথা কইত। সেই যে মূলঘর স্টেশনে একবার দেখা, তারপর আর কতদিন দেখা নেই। কোথায় ছিল এতকাল জরিনা ঝিলিকের সঙ্গে দেখা হওয়ার সেই অতীতকে ভেবে নিতে পারে। ভেবে নিতে পারে, সেই দুর্যোগের দিন ঝিলিক আর তার স্বামী তাকে কীভাবে যাত্রাপুর পৌঁছে দিয়েছিল। আজকের একটা ছোটো বাঁধাবাধিতে সেই কথাগুলো আবার মনে করা হল না। কিন্তু মনে করবে কী করে, জরিনা কি জানত ঝিলিক চেনে সুকুমাররে, আর ওই জায়গায় ঝিলিক আসা মাত্রই সুকুমার ওইভাবে রওনা দেবে রাগ হয়ে। আর তারা সবাই, এমনকি মোসলেমও, অসহায়ভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে তাই দেখবে। দেখেছে ভালো কথা, একবারও সুকুমারকে ডাক দেবে না? আহা, এতদিন বাদে দেখা ঝিলিকের সঙ্গে, ভালোমন্দ কয়ডা কথাও বলা হল না!
ডাক বাংলোর পরে লাইব্রেরি বিল্ডিং রেখে বাঁয়ের সুরু রাস্তা ধরে জরিনা উকিল বারের মাঠের দিকে আসে। রেজিস্ট্রি অফিসের ছোট্ট লাল দালান আর ডানে ট্রাফিক ব্যারাক ফেলে, ক্লাব আর জেলখানার দিকে এগোয়। ট্রেজারির ঘণ্টায় পর পর ছয়টা বাড়ি পড়ল, তাতে জরিনার এইসমস্ত ভাবনায় খানিকক্ষণের জন্যে ছেদ পড়ে। আলো ধরে এসেছে। আরও একটা দিন শেষ! একটু বাদেই সন্ধ্যা হবে। যদিও এই কোর্ট চত্বরে আর পার্ক এলাকায় সন্ধ্যাটা সারা শহরের চেয়ে অনেক ভালো বোঝা যায়। কোর্ট চত্বরের চারদিকে বড়ো বড়ো গাছ। আছে কৃষ্ণচূড়া, শিরীষ, মেঘনিশ আর মেহগনি। বট বা অশখও কয়েকটা। অনেক উঁচু। নারকেল গাছ কোথাও কোথাও প্রায় লাইন ধরে। একমাত্র মেহগনি বাদে সব গাছেই পাখি। নীচের পথ, পিচ ও কংক্রিটের রাস্তা–সবই পাখির গুয়ে প্রায় তলানো। পথচারী হাঁটে সেই গুয়ের দাগ দেখে। সন্ধ্যার আগে আগে প্রতিদিন নদীর ওপার থেকে পাখিরা ফেরে। কিচির মিচির কলকাকলিতে পুরো এলাকা মুখর।
জরিনা হাঁটতে হাঁটতে বুঝতে পারল, সেটা এখনও শুরু হয়নি। তার মানে আরও কিছুক্ষণ সময় আছে সুকুমারকে খোঁজার। কিন্তু আজগর যদি এতক্ষণে উঠে থাকে। যদি উঠে থাকে উঠবে। কাজ কী? দরকারে একলা একলা চা খাবে। যদি মনে হয়, জরিনার জন্যে তার বার চাওয়ার দরকার আছে, তাহলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে। জরিনা এখনই তো ফিরবে। যাবে কোথায়? আছে কোনও জায়গায় দুই চোখ যেদিকে যায় চলে যাওয়ার?
এদিকে জরিনাই-বা আর যাবে কত দূর। সামনে স্বাধীনতা উদ্যান, আগেকার পার্ক, এখানে ছেলেরা ফুটবল খেলছে। রেড ক্রিসেন্টের বারান্দার একপাশে সে এই পার্কের স্থায়ী বাসিন্দা বেঙ্গাকে বসে থাকতে দেখে। তার কাছে জানতে চায়, বেজি কোথায়? জানতে চেয়ে বোঝে এখনই জরিনার একটা দবড়ানি খাওয়া লাগবে। বেঙ্গার যেমন একটা নাম আছে, হাত পা বাঁকা বলে, আশেপাশের ছেলে ছোঁকড়ারা ডাকে বেঙ্গা, সেই থেকে বেঙ্গার সঙ্গী বেঙ্গি। কিন্তু বেঙ্গির নাম যে সুফিয়া এটা মনে থাকে না জরিনারও। সবাই ডাকে ওই নামে, এখন তাই ডাকল সেও।
বেঙ্গা সঙ্গে সঙ্গে খেলার মাঠে তাকাল। ওই ছেলেরা কেউ শুনল কি না! তারপর জরিনার দিকে চেয়ে হাসল। তার মানে ওই ছেলেরা শুনলে তাকে হয়তো বলত, ওই তো তোমার নাম বেঙ্গা, সবাই ডাকে, শুধু আমরা ডাকলেই দোষ?
এই ছোট্টো পার্কটার রাত্রিকালীন একচ্ছত্র সম্রাট আর সম্রাজ্ঞী এই বেঙ্গা-বেঙ্গি। পুকুরের পাশের বেঞ্চির নীচে আছে চুলো, তার সঙ্গে থাল গেলাস। বৃষ্টি বাদলার দিনে রান্না চাপায় রেড ক্রিসেন্টের ওই দিকের কোনার বারান্দায়। অন্য সময় খোলা আকাশে। খাওয়ার জন্যে পাশের ট্রাফিক ব্যারাকের চাপ কলের পানি। নাওয়ার জন্যে পার্কের পুকুর। পায়খানা রাত্রের বেলা এক কোনা কানাচিতে করে নিলেই হল, এত দালান। আবার পুকুরে তেলাপিয়া আছে, বেঙ্গি তাই ধরে। নদীতে বড়শি বাইলেও মাছ পাওয়া যায়।
যেমন, এখন বেঙ্গি উলটো দিকের জেলখানার পুকুরে তেলাপিয়া ধরছে। উলটো দিকের জেলখানার গার্ডরা কেউ গালমন্দ করলেই খ্যামা দেবে। আবার এই দুজনকে কেউ কিছু বলে না। যা বলার বলে, ওই রহমত পাগলা, যদি কখনও রেড ক্রিসেন্টের বারান্দায় ঘুমাতে আসে। বেঙ্গা বেঙ্গি অবশ্য বৃষ্টি না হলে খোলা আকাশের নীচে ঘুমায়, পুকুরের পাড়ের বেঞ্চিতে। যাতে লাভ এই, কেউ যদি কেউরে সঙ্গে নিয়ে আসে, বেঙ্গা বেঙ্গিরেও দুই-একটা টাকা সাধে। তারা টাকা আর চেয়ে পেলে একটা বিড়ি কি সিগারেট নিয়ে রেড ক্রিসেন্টের বারান্দায় আসে। তখন তারা পাহারাদার।
জরিনার এসব জানা আছে। আজগর বলেছে। আজগরের চোখ ফাঁকি দিয়ে এক আধবার জরিনা এসেছেও কারও সঙ্গে। আজগর খাওয়ায়, রাখে, কিন্তু আজগরেরও টানাটানি, বান্দর নাচিয়ে আর কয় পয়সা। তাছাড়া একটু পান খেতে কি চুলে তেল দিতে যে পয়সা লাগে সেই পয়সার জন্যে সবসময় আজগরের কাছে হাত পাতা যায়?
আবার বেঙ্গা-বেঙ্গির এও জানা এসব কথা কারুকে বলা যায় না। বলা যাবে না। বললেই লোকসান। মাঝেমধ্যে ভদ্দরলোকের বাড়ির ছেলেপুলেরা আসে, তাদের দেখভাল করা কর্তব্য। দিনের বেলা তারাই যদি এসে তাদের তুলে দেয়, তাহলে তারা থাকবে কোথায়?
বেঙ্গা জানাল, বেঙ্গি ওই পুকুরে মাছ ধরে।
বেঙ্গির সারা শরীর স্পষ্ট। সেখানে দিন শেষের অন্ধকার একটুও নেই। কারণ, বেঙ্গি ক্লাব বিল্ডিংয়ের দিকে পিঠ দিয়ে আর সেখানে পাশের টেনিস লনের ফ্লাড লাইটের আলো। শহরে যত অন্ধকার থাক, ওই জায়গাটুকু খুব আলোকিত। সেখানে বিকেল থেকে সন্ধ্যা রাত পর্যন্ত লন টেনিস খেলা হয়। সে আলোয় বেঙ্গির পিঠে আলো। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বেঙ্গিকে পুকুরের পাড়ে দেখে জরিনা তাকে বলে, যাই। দুইজন মানষিরে খুঁজদি আইলাম, পালাম না। আর একদিন দিনেমানে আসপানে।
বেঙ্গা হাসে, না, রাত্তিরেও আইসানে, আমরা তো আছি।
কেউ শুনলে এই কথার ভিতরে কোনও ইঙ্গিত আছে কি না কোনওভাবে বুঝতেও পারবে না। জরিনাও তাই হাসল।
ফিরত পথে, ফাঁকা কোর্ট চত্বর। কিন্তু পাখির ডাকে এখন কান ভারি। একটি দিন শেষ হয়ে আসছে। একদিন এমন সন্ধ্যায় মূলঘর স্টেশনে তার সঙ্গে ঝিলিকের দেখা হয়েছিল।
সেই দেখা হওয়াটাকে আকস্মিক বলা যাবে না। যেন ওই ঘটনাটাই এমন যে, ঝিলিক আর তার স্বামীর সঙ্গে জরিনার দেখা হয়েই যেত। আরও তো কত মানুষ। জরিনা খুলনা থেকে আসছিল। যাত্রাপুর। এক ঝুমুর দলে তখন জরিনা থাকে। যাত্রাপুরে তখন লাটফলার রথের মেলা চলে। জরিনা ঝুমুর গান জানে না। কোনও গানই জানে না। তার গলায় কোনও দিনও গান নেই। একেবারে কর্কশ। এমনকি এই গলায় কোনওদিন তাকে কেউ ভালোমতো একটু মধুর করে কথা কইতেও যেন শোনেনি। যদিও অতটা কর্কশ তার গলা তাও জরিনার মনে হয় না। সেই ঝুমুর দলে গানের মেয়েদের সাহায্য করে। সাজায় কখনও। এই কাজটা ভালো পারে জরিনা। আর, সে-দলের মালিক বললে কোনও মানুষের সঙ্গে এখানে সেখানে ঘণ্টা চুক্তিতে যায়। এমনকি এই দলেও কোনও কোনও মানুষ আসত, কয়েকদিন থাকত। মালিকের নির্দেশমতো জরিনা তাদের সঙ্গেও শুয়েছে। এটা ওসব দলে স্বাভাবিক ঘটনা। তাছাড়া জরিনা তখন যাবেই-বা কোথায়।
কিন্তু সে রূপসা গিয়েছিল দিন তিনেক আগে। আগে থাকতেই জানত লাউফলায় এত তারিখ থেকে ঝুমুর দল যাবে। মালিক তাকে আগেই বলেছিল। সেবার অবশ্য এই লাউফলা রথের মেলাতেই জরিনা প্রথম আজগরকে দেখেছিল। তখন আলাপ পরিচয় সেভাবে হয়নি। কিন্তু প্রথম দিনের দেখা আর আলাপ পরিচয় প্রায় না-হওয়া সেই আজগরের সঙ্গে জরিনা এইভাবে জড়িয়ে যাবে, তাকি সে কোনও দিনও কোনওভাবে জানত। তবে, সেও ঝিলিকের সঙ্গে মূলঘর স্টেশনে দেখা হওয়ার পরের বছরের ঘটনা।
রূপসা থেকে ট্রেনে যাত্রাপুরের উদ্দেশে রওনা দিয়ে, মূলঘর ক্রসিঙে আসতে জরিনা শোনে ট্রেন আর যাবে না। খানজাহানপুরে লাইনে সমস্যা হয়েছে বৃষ্টিতে। অথচ মাঝখানে স্টেশন ওই একটাই, খানজাহানপুর। খানজাহানপুরের পরেই যাত্রাপুর। তাও ট্রেন খানজাহানপুর পর্যন্ত গেলেও হত, পরের পথটুকু সন্ধ্যাসন্ধি সে যাত্রাপুরে পৌঁছতে পারত। কিন্তু এখান থেকে যাওয়া সম্ভব না। বৃষ্টি বাদলার দিন। রূপসা থেকে ট্রেনে ওঠার সময়ই প্রবল বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রওনা দিয়েছিল। মানুষ বলে, রথের মেলার সময় বৃষ্টি হবেই। তা বৃষ্টি হবে ভালো কথা, আষাঢ় মাসে তো বৃষ্টি হবেই, কিন্তু সেই বৃষ্টি এমন হওয়া লাগে যে ট্রেন চলতে পারবে না লাইন দিয়ে।
আসলে, বৃষ্টি একটা কারণ হয়তো, তবে খানজাহানপুরে ট্রেন লাইনেও সমস্যা হয়েছে। মূলঘর স্টেশনে লোকে লোকারণ্য। ছয় বগিতে উপচানো মানুষ নিয়ে চলছিল ট্রেন, অনেকের গন্তব্য যাত্রাপুর। অবশ্য এই সন্ধ্যার মুখে কয়জনই-বা যাবে যাত্রাপুর। তখন জরিনার খেয়াল হয়, কাল শুক্রবার, ছুটির দিন, খুলনায় অফিস করা মানুষজন সব বাগেরহাটে যাচ্ছিল এই বিকালের ট্রেনে।
মূলঘর স্টেশনে নেমে জরিনা পরিচিত কাউকে খোঁজে। এত মানুষ কিন্তু জরিনার পরিচিত আশেপাশে তখন একজন মানুষও নেই। ট্রেনটা উলটো দিকে কিছুদূর গিয়ে দাঁড়ায়। স্টেশন বৃষ্টি কমলে ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে যায়। জরিনা একবার নেমে রাস্তায় গিয়েছিল। ভ্যান পাওয়া যায় একটু পর পর। কিন্তু সবাই বাগেরহাটে যাবে। তাছাড়া জরিনা যে ভ্যানে যাবে, তখন সেই পয়সাও তার কাছে নেই, সুযোগ পেয়ে ভ্যানঅলা ভাড়া বাড়িয়েছে। এক ভ্যানে চারজন করে যাচ্ছে, সেখানে জরিনা একা-একটা মেয়ে মানুষ, রাস্তায় গিয়েও তার যাওয়ার সুযোগ হল না। একদিকে আবার আকাশ কালো করে বৃষ্টি আসে। তখনও যে দিন অবশিষ্ট আছে, তাই এতক্ষণ তো প্রায় বোঝাই যাচ্ছিল না, এখন আবার আকাশ ভেঙে বৃষ্টি আসায় চারদিক আরও অন্ধকার হয়ে যায়।
ইতিমধ্যে স্টেশনে লোক কমেছে। প্ল্যাটফর্মে লোকজন যা ছিল তারা সব ছাউনির নীচে, টিকেট ঘরের সামনে। তার এক কোনায় জরিনা এসে দাঁড়ায়। তার পাশে তখন বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়ানো ঝিলিক। কথায় বোঝা যায় পাশের লোকটা তার স্বামী। কোলের বাচ্চাটা ঘুমিয়ে। কোলে নেয়ার তুলনায় বেশ বড়োসড়ো। জরিনা তাদের দেখে। ঝিলিকের কপালের সিঁদুর বৃষ্টিতে ধুয়ে কিছুটা লেপ্টে গেছে। ঝিলিকের স্বামী জরিনা তাদের কাছে দাঁড়ানো দেখেই কপাল কোঁচকায়। জরিনা সেটা লক্ষ করে। হয়তো দিন হলে, চারদিক একটা অন্ধকার না হয়ে আসলে ঝিলিকের স্বামীর ওই অস্বস্তি জরিনা আরও ভালো বুঝতে পারত।
জরিনাও লোকটার দিকে চোখ বড়ো করে চাইল। ঘরের বউঝির কাছে জরিনার মতো মেয়ে মানুষ ভিড়লেই, এসব লোকের চোখ ছোটো হয়ে আসে, কিন্তু সুযোগ পাইলেই যে গায়ে হাত দেয়, চোখ টেপে কখনও গাও টেপে, তাও তার জানা আছে। এই লোকটিও তাই। জরিনা এসব পাত্তা দেয় না। এমন মানুষ তার অনেক দেখা আছে। কিন্তু বৃষ্টির ছাঁটের কারণেই তো সে তাদের একটু কাছে ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। না হয় এই জায়গায় দাঁড়ানোর তার কোনও দরকার ছিল?
কিন্তু এসব উলটে ঝিলিক তার সঙ্গে কথা কয় নরম গলায়। তার আগে সে তার স্বামীকে বলে ছেলেটাকে একটু কোলে নেওয়ার জন্যে। হাত দুটো ব্যথায় প্রায় বিষ হয়ে গেছে। আর পারছে না। তারপর গলা নামিয়ে জরিনার কাছে জানতে চায়, সে কোথায় যাচ্ছিল।
জরিনা তা বলল। ঝিলিক জানাল, তারাও যাবে যাত্রাপুর, তবে লাউফলা রথের মেলায় নয়, বিষ্ণুপর। সেখানে ঝিলিকের নন্দেজামাই বাড়ি, সে-বাড়িতে কাল ননদের ছেলের মুখেভাতের অনুষ্ঠান। এখন এই বর্ষায়, ট্রেনের এমন অবস্থা হল! তারা যদি না যেতে পারে, তাহলে কি সারারাত এই জায়গায় থাকতে হবে।
এরপর তাদের এই যাওয়া নিয়ে আরও কথা হয়। এমনকি কে কোথায় থাকে, তার স্বামী কী করে এইসব নিয়েও, স্বাভাবিক যে সমস্ত কথা তাদের ভিতর হতে পারে। জরিনা তখনও ঝিলিকের নাম জানে না, ঝিলিকও জানে না জরিনার নাম। কিন্তু পরস্পরের কথা চলতে থাকে। ঝিলিকের স্বামী পাশে ছেলে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শোনে। জরিনার কেন যেন একবার একবার মনে হয়, মেয়েটার স্বামীটা একটু গোয়ার আর বলদা কিসিমের। আবার তাও খানিক বাদে তাদের কোনও কথার ভিতরে কথা বললে আর মনে হয় না। আবার, কিছুক্ষণ পরে জরিনার এও মনে হয়, তার সঙ্গে যে কথা বলছে ঝিলিক, তাও পছন্দ করছে না ঝিলিকের স্বামী! ঝিলিক এরপর জানতে চাইল, লাউফলায় সে কোথায় যাবে? জরিনা জানিয়েছে, সে লাউফলা রথের মেলাতেই যাবে। এক ঝুমুর দল এই মেলার কয়দিন থাকবে সে। কথাটা যেন শুনে ফেলে ঝিলিকের স্বামী। যদিও তেমন নীচু গলায় জরিনা বলেনি। জরিনার দিকে তাকাল ঝিলিকের স্বামী। তবে, ঝুমুর দলে থাকা আর অন্যান্য বিষয়ে কিছুই যেন বোঝেনি ঝিলিক। সে জানে, ঝুমুর একপ্রকার গানের দল।
এ সময় বৃষ্টি একটু ধরে আসে। প্রায় নেই, যদিও থাকে তা গাছের পাতার পানি। প্ল্যাটফর্মের থেকে বাইরের রাস্তার দু-পাশই গাছ ছাওয়া। এখান থেকে বৃষ্টি কী পরিমাণে পড়ছে তা বোঝা যায় না, বৃষ্টি থেমে গেলেও, গাছের পাতার পানি পড়ায় মনে হয় এখনও বৃষ্টি আছে। তবু, প্ল্যাটফর্মের চালের টিন থেকে পানি প্রায় পড়ছে না দেখে ঝিলিকের মনে হল, এখন তার স্বামী রাস্তায় গিয়ে ভ্যান ডাকতে পারে। ঝিলিক তার স্বামীকে একটু নীচু গলায় তাই বলল, এহোন যাবা নাকি, বৃষ্টি মনে কয় ছ্যাঁক দেবে। দেহো, এট্টা ভ্যানট্যান পাও নাকি।
দেহি। ঝিলিকের স্বামী বলে, আর-এট্টু ছ্যাঁক দিক।
দেহি না। সন্ধ্যা হইয়ে আইচি–এট্টু পর চাইরদিক অন্ধকার হইয়ে যাবে। পথ তো এহেবারে কম না। আমরা দুইজন মাইয়ে মানুষ, জরিনার দিকে ইঙ্গিত করল, এই দিদিও যাবে আমাগো সাতে। যাও। মানুষ কম না, চালিই ভ্যান পাবা নানে।
প্ল্যাটফর্মের টিমটিমে আলো জ্বলছে। এরপর রাতে আর মাত্র দুটে ট্রেন আসত দুই দিক থেকে। তা আর আসবে না। ভিড় দ্রুত পাতলা হচ্ছে। যারা এরপরের স্টেশনে যেত তারা হাঁটা শুরু করেছে। আবার উলটো দিকের যেসব যাত্রী খানজাহানপুর থেকে এই ফকিরহাট মূলঘরে আসত, সেসব ভ্যানের কোনও কোনওটা এতক্ষণে প্ল্যাটফর্মের বাইরে এসে দাঁড়াচ্ছে। নিশ্চয়ই দুই দিকের সব স্টেশনেই এ খবর পৌঁছে গেছে, রেল লাইনে সমস্যা। ঝিলিকের স্বামী সে-সবের কিছু বুঝতে পারছে কি না কে জানে?
তবে লোকটা এবার একটু গা-ঝাড়া দিল। ছেলেটাকে ঝিলিকের কোলে দিয়ে নেমে গেল প্ল্যাটফর্ম থেকে। নেমে যেতে যেতে একবার তাকাল ফিরে ঝিলিকের দিকে। ঝিলিক তাতে হাসল, কেন জানি মনডা খারাপ!
জরিনা জানতে চাইল, কেন, হইচে কী?
যে নন্দেজামাইর বাড়ি যাচ্ছি, তারে মেটে চোখে দেকতি পারে না। কবে জানি আমার ছোটো ননদের হাত ধইরে টান দিল, তখন আমার বিয়ে হইনি, সেইর পরদে ওই লোকের বাড়িঘরে আর যায় না। এবার আমার ননদ আইসে কইয়ে গেইচে। কন সেই মোল্লাহাট পর্যন্ত গেইচে নিমতন্ন। করতি, ছেলের মুখেভাত, না গেলি দেখি হয়? উনি এই দেশে বড়ো মামা!
মুখেভাত বিষয়টা জরিনা বোঝে, কিন্তু তার সঙ্গে বড়ো মামার যাওয়া না-যাওয়ার বিষয়টা তার জানা নেই। কিন্তু তার কথায় বুঝল, এই অনুষ্ঠানে তার স্বামীকে ঝিলিকই নিয়ে যাচ্ছে।
ঝিলিক এবার বিড়বিড় করল, এহোন ভ্যান কি পাবেনে? জানে কেডা!
পাবে। এহোনও তো রাত্তির হইনেই। তাছাড়া ভ্যানঅলারও জাইনে গেইচে—
হয়, পালি হয়।
আপনাগো পাইয়ে আমার খুব উপকার হল। কী উপকার তা কইয়ে বুঝোতি পারব না।
কী হল, আবার? আপনি একলা মানুষ, একভাবে না একভাবে কইলে যাতি পারতেন। ভিজদি ভিজদি গেলি তো এতক্ষণ ভ্যানে উইঠে প্রায় পৌঁছোইয়ে যাতেন।
তা যাতাম। কিন্তু কী কব–আমার ধারে আছে মোটে দুই টাকা–এইয়ে দিয়ে ভ্যানে নেত নাকি আমারে! যদিও জরিনা জানে, কথাটা সে ঠিক বলেনি। তার কাছে আরও চার টাকা, মোট ছয় টাকা আছে। সব এক টাকার নোট। ট্রেনে সে টিকেট কাটেনি। কখনওই কাটে না।
মোটে দুই টাকা নিয়ে বাড়িদে বাইরোইচেন? ঝিলিক একটু সন্দেহের চোখে জরিনার দিকে তাকায়। এমনিক তার জিজ্ঞাসার ভিতরে আছে অবিশ্বাস।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে জরিনা কথাটা অন্য দিকে নিয়ে গেল, আমার আবার বাড়িঘর আছে নিকি?
এবার ওই আধো অন্ধকারে ঝিলিকের তার দিকে তাকানোটা বদলে গেল। সেখানে জরিনা কোথার মানুষ কেমন মানুষ তা যেমন, একইসঙ্গে যেন কিছু করুণাও। হয়তো একই সময়ে জানতেও চাইত কোথায় তার বাড়িঘর অথবা বাপের বাড়ি, আর বিয়ে-থা এইসমস্ত কিছু হয়েছে কি না। তখনই ঝিলিকের স্বামী তাদের ডাকে। দুই থাক সিঁড়ি ঝিলিক ছেলেটাকে কোলে নিয়ে নামে, তারপর তার স্বামী এসে ছেলেটাকে কোলে নেয়। নীচের দিকে বাকি আরও দুটো সিঁড়ি নামতে নামতে ঝিলিক জরিনাকে বলে, চলেন–
ঝিলিক খেয়াল করেছে, সে নামার সময় জরিনা দাঁড়িয়েছিল। তার স্বামী হয়তো শুধুই ঝিলিককে ডেকেছে। জরিনা তখনও নিজের সংকট কাটাতে পারেনি। জানে না, তারা তাকে সঙ্গে নেবে কি না?
তারপর ঝিরিঝির বৃষ্টি মাথায় নিয়ে জরিনা ঝিলিক ও তার স্বামীর সঙ্গে ভ্যানে ওঠে।
তাহলে, জরিনা কখন জেনেছিল তার নাম ঝিলিক। ক্লাবের কাছে থেকে প্রায় একইরকম আধো অন্ধকারে, লঞ্চঘাটের নদীর পাড় পর্যন্ত হেঁটে আসতে আসতে জরিনা মনে করতে পারে না, সে কখন জেনেছিল তার নাম ঝিলিক। আজ মোসলেমের সঙ্গে কোর্ট চত্বরে ঢুকতেই দেখেছিল, মোসলেমকে বলেও ছিল, তারপর ওই যে সুকুমারের সঙ্গে এসে যখন ওদিকে চলে গেল, তখন তো তার দেখার কোনও ভুল ছিল না। তাহলে, নামটা জানল কখন?
সেটা এখন মনে না করলেও চলবে। এই জীবনে কত পদের মানুষের সঙ্গে দেখা, কত মানুষের সঙ্গে কত পদের রঙ্গ তামাশা, এক ঘণ্টা আধ ঘণ্টায়ও দেখা, সেখানে ভ্যানে প্রায় ঘণ্টাখানেকের রাস্তায় সে একজনের সঙ্গে আলাপে তার নামটা কখন জেনেছিল, তাই মনে রাখতে হবে? নামটা যে মনে আছে এই বেশি। না, নামটা মনে থাকবে। ওই বাদলার দিনে তার কত উপকার করেছিল। যাত্রাপুর পর্যন্ত আসতে আসতে প্রায় রাত। তারপর স্টেশনের কাছে নেমে প্রায় পৌনে এক মাইল পথ হেঁটে লাউফলা।
লঞ্চঘাটের গলিতে ঢুকতে ঢুকতে জরিনার মনে পড়ে, না সে কখনও নাম বলেনি। বার দুই তার নাম ধরে ডেকেছিল তার স্বামী, তাই নামটা এখনও তার মনে আছে। এমনকি সেই ঘুম ঘুম বাচ্চা ছেলেটাকে দুইবার মাথায় হাত বুলিয়ে ডেকেছিল, ভরত; তাও আরও কিছুক্ষণ ভেবে জরিনা মনে করতে পারে। গোলমতো মুখ ছেলেটার, মুখোনায় কত মায়া! কোলে নিয়ে চুমু খেতে মন চায়। ভ্যানে ওই বাচ্চা ছেলের পা তার গায়ে লাগলে, সে পায়ে হাত বুলিয়েছিল।
আজ এখানে, হঠাৎ সেই ঝিলিক! একলা, সুকুমারের সঙ্গে কী! কোনও কেসের জন্যে মোল্লারহাট থেকে এসেছে? সুকুমারের বাড়ি মোল্লারহাট? জরিনা জানে না কিছুই। চলে গেছে নাকি দুপুরের পরের ট্রেনে?
নদীর পাড়ে আজগরের ঝুপড়ির কাছে এসে জরিনা দেখে, আজগর দরজার সামনে একখানা ভাঙা টুলে বসে অনবরত কাশছে! লোকটার গলায় সমস্যা হল না তো। এই কাশির দমকটা কয়দিন বাদে বাদেই পেয়ে বসে। আজও বসেছে। পকেটে পয়সা আছে, নাকি? থাকলে এই কাশির দমক কমাতে যাবে কামারপট্টির পিছনে। সেখান থেকে শালসার বোতল ভরে এনে নদীর কূলে অথবা পন্টুনে বসে গলায় ঢালবে। তাতে নাকি কাশির দমক কমে।
জরিনা ওই অবস্থায় আজগরকে বসা দেখে ভাবে, যা থাকে কপালে আজ তাকে কোনওভাবে কর্মকারপট্টির দিকে যেতে দেবে না। নেশার পয়সা নাকি ভূতে জোগায়। যেভাবেই জোগাক, যাই ঘটুক আজ আজগরকে সে আটকাবেই। নাকি জরিনাকে দেখে ইচ্ছে করে এই কাশির দমকটা তুলেছে, যাতে শালসার বোতল ভরে মাল আনতে ওদিকে যেতে পারে।
জরিনা একটু খেঁকিয়ে জানতে চায়, কী হইচে তোমার, কাশো কী জন্যি?
আজগর কোনও উত্তর দিল না। মাথাটা নীচের দিকে ঝুঁকিয়ে যেভাবে বসেছিল, সেভাবেই বসে থাকল। জরিনা যে কিছু জিজ্ঞাসা করেছে, তাও যেন এখন তার কাছে যেন পাত্তা দেওয়ার মতো নয়। তাকে কাশতে দেখলে জরিনা গলা অমন কর্কশ করে, আজগরের জানা আছে।
আজগর উত্তর না-দিলেও উঠে গেল। জরিনা নদীর কূলের কাঁচা রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে। আজগর যেন জরিনাকে দেখেইনি। সোজা হেঁটে একটা দোকান থেকে এক ঠোঙা মুড়ি আর চারটে কলা কিনে নিয়ে এল। ঝুপড়ির সামনে আসার আগে দুটো কলা দিয়ে এল বাঁদর দুটোকে। পাশে ঢালল কিছু মুড়ি। তারপর ঝুপড়ির সামনে আসতে আসতে জরিনাকে বলল, খাবা? খাইলে নেও। বসে পড়ে একটা কলা ছালতে লাগল, বাকিটা পাশে রাখল। ঠোঙা থেকে মুড়ি তুলে মুখে দিয়ে, কলায় কামড় দিয়ে আবার জরিনাকে বলল, কী কই, কতা গায় লাগে না?
জরিনা একটু অবাক হল। একটু আগে তাহলে লোকটাকে গালমন্দ করছিল কেন? তার জানা আছে, মাতালের স্বভাব তো কোনওকালে যায় না। সব সময়ই বলে এসেছে, কাশির দমক থামানোয় ওই জিনিস হল একেবারে ওষুধ! আইজ ওই ওষুধ খাবে না। নাকি এখন এই কলা-মুড়ি খেয়ে একটু বাদে হেলে দুলে যাবে কর্মকার পট্টির দিকে?
নিজের কলাটা ছুলতে ছুলতে জরিনা আজগরকে বলে, জানো, ওই যে সুকুমারের সাথে যে বিটিরে দেকলাম, তারে আমি চিনি!
সে তো তোর চোখ দেইকা তখন বুজজি!
কিন্তু সে সুকুমারের চেনে কী কইরে?
তোগো মতন মাইয়েগো মানুষ চিনতি সময় লাগে নাকি?
সব সময় এক কতা। আমাগো মতন মাইয়ে মানুষ। কী আমাগো এট্টা দুধ বেশি গজাইচে নিকি?
সেয়া গজাইলেও মন্দ হইত না। বাইর কইরগা মাইনষেরা দেহাইয়া বেড়াইতে পারতি!
খালি ফাও কতা যত। তোমার তা খাতিও আমার ঘেন্না করে!
তাইলে খাইস না।
এবার জরিনা একটু এগিয়ে এল। গলাও একটু নামিয়েছে, কেন, খালি ফাও কতা কও কেন?
অন্ধকারে আজগর জরিনার দিকে চায়। এই খোটা দেয়া কথা বলার পরও তো ঢঙ করা কমে। কত রঙ্গ জানে যে জরিনা।
জরিনা বলে, কীভাবে চিনি সেয়া শোনবা না?
শোনবানে। তুই কি তারে খুঁজদি গেচেলি? পাইচো?
না, পাই নেই।
তালি চুপচাপ বইসে থাক। সুকুমারের পাইলে সব জানতি পারবি–
তা পারব। তয়, একবার ফকিরহাট স্টেশনদে একসাথে ভ্যানে আইলাম। সাতে ঝিলিকের স্বামী আর ছল। ঝিলিক হিন্দু, মাথায় এই জায়গায় সিন্দুর দেয়া, হাতে শাখা। কী বৃষ্টি সেদিন! কোন জায়গায় জানি টেরেন পইড়ে গেইল লাইনেদ-
বোঝলাম তো। সুকুমারের পাইলে সব জানতে পারবি!
জরিনা যতই উৎসাহের সঙ্গে বলুক, কোনওভাবেই বুঝতে পারছে না, কেন আজগর তার কথার গুরুত্ব দিচ্ছে না। এতদিন পরে দেখা। কী সমাচার। গেরস্ত ঘরের বউ, কেন এই জায়গায়?
তা অবশ্য এর কিছুক্ষণ বাদেই জানতে পারে জরিনা। ততক্ষণে আজগরের কাশির দমক কমেছে। আজগর ঝুপড়ির দরজায় বসে ঝিমায় যেন। জরিনার দিকে খেয়াল নেই, এমনকি রাতে কী খাবে, কোথায় খাবে তা নিয়েও ভাবনা নেই। আজগর এ রকম ঝিম মেরে থাকার বিষয়টা জরিনা কিছুটা হলেও বোঝে। আসলে, তলে তলে ধান্দা, ভাবছে যাবে নাকি একবার কর্মকারপট্টির দিকে। যদিও আজ আজগর সেই দিকে যেতে পা বাড়ালে জরিনা ঠিক করে রেখেছে, সে বাধা দেবে। কিন্তু আজগর কিছুই বলছে না। ঢাকার লঞ্চটায় আলো জ্বলে গেছে। আর হয়তো কিছুক্ষণ বাদে ছাড়বে। লঞ্চঘাট কিছুটা আলোকিত। জরিনা আর আজগর বসে আছে অন্ধকারে। জরিনা ভাবে, লোকটার কাছে জানতে চাবে নাকি তার ধান্দা কী? এমন মেরে বসে আছে কেন? যদিও সে জানে, আজগর কখনও কখনও এ রকম ঝিম মেরে বসে থাকে। এখনও তাই বসে আছে। নাকি সে এখান থেকে সরলেই যাবে ওই শালসার বোতলের খোঁজে।
জরিনা এবার জানতে চায়, কী? রাত্তিরে খাওয়া-টাওয়া লাগবে না? নাকি সারা রাত্তির এই জায়গায় বইসে মশা মারবা?
আজগর পয়লা চুপ করে থাকে। আবার কাশে। সে বোঝাতে পারছে না, কোনওভাবেই শরীরটা ভালো লাগছে না তার। অন্ধকারে একবার জরিনার দিকে মুখ তুলে চেয়ে হাসল। তারপর জরিনার কথা ঘুরিয়ে দিতেই যেন বলল, আইজ আমারে এহেবারে কাবু বানাইয়ে দেলা।
হইচে–বুড়ো হাড়ে কত সাধ তোমার! কিন্তু এহোন ওই কতা কলি পেট ভরবে না। খাইয়ে ঘুম দেও আবার!
যাও তয়। ওই লালির দোকানদে রুটি নিয়ে আসো। সাতে লাচড়া আইগো।
আনবানে। তুমিও চলো।
আমি যাইতে পারলে তোরে যাইতে কই?
আমি রুটি আনতি গেলিই তুমি শালসা টানতি যাবা!
না, যাব নানে।
আজগর জরিনাকে রুটি আনতে টাকা দেয়। জরিনার তাও কেন যেন মনে হয়, সে নদীর কূল ধরে নাগের বাজারের দিকে এগোলেই আজগর এ জায়গা থেকে উঠে যাবে। অন্যদিন আজগর গেছে যাক, আজগর ওইসমস্ত খেয়ে কাঁদে, তাও সে জানে। কিন্তু আজ যেন না যায়। ও জিনিস জীবনে বেশ কবার জরিনাও খেয়েছে। খেতে মন্দ লাগে না। আজগরের সঙ্গেও খেয়েছে। মনটা খুলে যায়। একলা একলা তখন জীবনের কত কথা কইতে সাধ জাগে। কিন্তু এই গরমে? এই গরমে খাইলে আর উপায় থাকবে না। কাপড়-চোপড় খুলে বসে থাকতে হবে। পুরুষ মানুষ তবু খালি গায়ে নদীর কূলে হাওয়া খেতে পারে। তার মতন মেয়েছেলে?
আজগর রুটি আনতে উঠবে না বুঝে জরিনা বলে, তালি নদীতে এটা ডুব দিয়ে আসো। সেই সহালে নাইচো, তারপর আর নাওনি–সারাদিন যে গরম গেল!
আজগর নীচু গলায় বলল, তুমি নাবা না?
রুটি কিনে আইনে। তুমি তালি ওঠো। যাও, নাইয়ে আসো–দেইহেহানে তারপর শরীলডা ভালো লাগবে। আর কাশপা নানে-
কথাটা মন্দ বলেনি জরিনা। তা যাবে। হাঁটু মোড়া থেকে কাতরানো শব্দ করে আজগর উঠে দাঁড়ায়। অন্ধকারে কোথায় গামছা, কোথায় কী? লম্ফে নেই কেরোসিন। আনার দরকারও নেই। জরিনা দাঁড়িয়ে থাকে। আজগর জানে, সে নাইতে ডাকবাংলো ঘাটের দিকে না যাওয়া পর্যন্ত জরিনা দাঁড়িয়ে থাকবে। ঝুপড়িতে হাতাতে হাতাতে আজগর গামছা পায়। জামাটা খুলে দরজায় ঝুলিয়ে রাখে। তারপর খালি গায়ে ডাকবাংলো ঘাটের দিকে রওনা দেয়। যাবার সময় গলায় বেশ দরদ দিয়ে বলে, যাও তয়। এই দেহো আমি নাইতে যাইতেচি।
জরিনা বলে, যাও। বলে জরিনার বেশ ভালো লাগল। যতই কোক, গালমন্দ করুক, লোকটা কথাও শোনে। তা শোনে। মনে কত দুঃখ নিয়ে আজ এই বান্দর নাচাইয়ে খায়। সেই দুঃখের কথা কেউরে কয় না। কখনও কখনও জরিনাকেও না। শুধু পেটে শালসার বোতলের পানি পড়লেই মুখ খুলে যায়।
হাফেজের রুটির দোকান একটু এগোলেই। সেখানে পৌঁছে জরিনা দেখে নদীর কূলে দাঁড়িয়ে আছে সুকুর আর ঝিলিক!
আজগর ফিরে এসে দেখে জরিনার সঙ্গে বসে আছে তারা।