০৮. মুক্তিযোদ্ধার সামনে আমরা

প্রকৃতপক্ষে এতগুলো মুক্তিযোদ্ধার সামনে আমরা আর ঠিকমত লোকমা তুলতে পারছিলাম না। নন্দিনী তো ভাতের বাসনের ওপর কেবল আঙুল বুলিয়ে খেলছিল। যদিও নাসরিন তার ভাতে ডাল ঢেলে দিতে দিতে বলল, খান। আপনি বুঝি আমাদের চাল ডাল বের করে চট করে রেঁধে নিয়েছেন?

কী করব বল, খিদের জ্বালায় মরে যাচ্ছিলাম।

খুব ভাল করেছেন। তবে এখন আমরা আসাতে আর খেতে পারছেন না। খান, কোনো বদ মতলব না থাকলে আমরা আপনাদের ক্ষতি করব না।

অভয় দিয়ে নাসরিন হাসল। মনে হয় সে আমাদের সাথে কিছুক্ষণ আগে যে আচরণ করেছে সেটার জন্যে সামান্য অনুতপ্ত।

আমাদের কোনোই বদ মতলব নেই নাসরিন। আমরা টাকাটা ফেরত না দিলেও পারতাম। তোমরা কোনোদিন জানতেও পারতে না টাকাটা কার হাতে পড়েছে। তোমাদের যে লোক ব্যাগটা আমার হাতে দিয়েছিলেন তিনি আমাদের নামধাম বা পরিচয় জানতেন না। এ টাকায় আমরা কলকাতায় এই যুদ্ধের মধ্যে আরামে দিন কাটাতে পারতাম। আমাদের বিবেক ও দেশের প্রতি কর্তব্যবোধই এখানে টেনে এনেছে। তোমরা এখন আমাদের নিয়ে কী করবে তা তোমাদের ব্যাপার। আমরা তোমাদের সাথে দেশের জন্য লড়ব বলে এখানে এসেছি।

নন্দিনীর কথায় অস্ত্রধারীরা পরপর মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। দাড়িঅলা লোকটি যেন একটা ইঙ্গিত করা মাত্রই দলের অন্যেরা তাক করা অস্ত্রের নল আমাদের দিক থেকে নামিয়ে ফেলল।

দাড়িঅলা লোকটি বলল, আপনারা কী আমাদের সাথে থাকতে চান?

আপনারা যদি বিশ্বাস করে আমাদের আশ্রয় দেন তবে আমরা থাকতেই এসেছি।

জবাব দিলাম আমি।

আপনাদের কোনো সামরিক ট্রেনিং আছে?

দাড়িঅলা লোকটি আবার প্রশ্ন করল।

না। বলল নন্দিনী।

আমাদের সাথে থাকতে হলে আপনাদের ট্রেনিংটা নিতে হবে।

আমি বললাম, আমরা এ ব্যাপারে প্রস্তুত হয়েই এসেছি। এখন আপনারা যদি আমাদের বিশ্বাস করেন তবে আমাদের গ্রহণ করতে পারেন। কলকাতায় ফিরে যেতে চাই না। আপনার নামই কী আলী?

আমার প্রশ্নে দাড়িঅলা লোকটি একটু চমকে গিয়ে তার সঙ্গিদের দিকে তাকাল। নাসরিণ প্রশ্ন করল, আপনারা এ নাম কোথায় জানলেন?

নন্দিনী বলল, ব্যাগটায় টাকার সাথে যেসব কাগজপত্র ছিল সেখানেই আমরা তোমাদের নাম ও আলী বলে একজনের নাম পেয়েছি।

এবার দাড়িঅলা লোকটি বলল, আমার নামই আলী। আলী রেজা। আমি আপনাদের এত ঝুঁকি নিয়ে এখানে এসে টাকাটা পৌঁছে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমাদের পার্টির আদর্শের সাথে আপনাদের পরিচয় না থাকলেও আমরা আপনাদের আশ্রয় দেব। তবে এখানে আমাদের ট্রেনিং ক্যাম্প একেবারে ভারত সীমান্তের কাছে। সেখানে কমপক্ষে একমাস আপনাদের থাকতে হবে অত্যন্ত কষ্টের মধ্যে। জনমানবহীন একটা পরিত্যক্ত গ্রামে আপনাদের থাকতে হবে। ঠিকমত খাবার জুটবে না। হানাদাররা সার্চ করতে গেলে পশ্চিমবঙ্গের একটা গ্রামে গিয়ে থাকতে হবে। সেখানেও একটা ট্রেনিং ক্যাম্প আমরা চালু করেছি। ট্রেনিং শেষ হলে সরাসরি আপনাদের খুলনা, যশোর, কিংবা ঢাকায় গিয়ে গ্রুপ লীডারের নির্দেশে কাজ করতে হবে। ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আজ রাতটা একটু ভেবে দেখুন। যদি রাজি থাকেন তবে কাল আমাদের জানাবেন। আর যদি আবার কলকাতায় ফিরে যেতে চান তবে আমাদের লোকজন আপনাদর পৌঁছে দেবে।

কথাগুলো বলে আলী রেজা তার সঙ্গীদের দিকে তাকাল। বলল, তোমরা গিয়ে বৈঠকখানায় অপেক্ষা কর।

নাসরিনসহ অন্য তিনজন কোনো কথা না বলে সামনের কামরায় চলে গেল। আমাদেরও খাওয়া শেষ। হাত ধুয়ে মুছে আমি আলী রেজার সামনে এসে বসলাম। নন্দিনী থালা বাসন নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল।

আমি ধীরে সুস্থে পকেট থেকে সিগ্রেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগ্রেট আলী রেজাকে দিলাম। তিনি সিগ্রেটটা নিতে নিতে হেসে বললেন, এখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন খুবই কষ্টকর। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। পলিটিক্যাল মোটিভেশন না থাকলে দেশের ভেতরে থেকে যুদ্ধ করা আরও মুস্কিল। আপনাদের খুব ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এবার আপনার ও আপনার সঙ্গিনীর পূর্ণ পরিচয় আমাকে বলুন।

আমার নাম সৈয়দ হাদী মীর। আমার স্থায়ী ঠিকানা অর্থাৎ জন্মস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়া। পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিলের গ্রন্থাগার পরিচালনা করতাম। কবিতা লেখারও চেষ্টা করি।

আয়েসের সাথে সিগ্রেটের টান দিয়ে জবাব দিলাম।

আপনার সঙ্গিনী কী আপনার স্ত্রী?

একথা কেন বলছেন?

আমরা বুঝতে পারি। না হলেও আমাদের কোনো ক্ষতি নেই। তবে আপনাদের আসল পরিচয় এবং সম্পর্কটা আমার এবং আমার পার্টির জানা থাকা দরকার, কারণ আপনারা আমার শরণার্থী হলেও আমাদের পার্টির অশেষ উপকার করেছেন। আপনাদের নির্লোভ মানসিকতা আমার কাছে একধরণের বৈপ্লবিক বিস্ময়। এই মহিলার সত্যিকার পরিচয় আমরা নথিভুক্ত করব। আমি আশা করি আপনারা আত্মপরিচয় গোপন করে সেই সৌভাগ্য থেকে অযথা নিজেদের বঞ্চিত করবেন না। আপনার নাম শুনে মনে হচ্ছে আপনার কবিতা আমিও পড়েছি। আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতি করলেও আকাট মুখ নই।

হাসলেন আলী রেজা।

আমার নাম নন্দিনী চক্রবর্তী। ভৈরব বাজারে বাড়ি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার ছাত্রী।

নন্দিনী কখন যে ধোয়ামোছার কাজ সেরে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারি নি। আমি ও আলী রেজা মুখ তুলে তার দিকে তাকালাম। সে তখন হাসিমুখে আঁচল দিয়ে হাত মুছছে।

আলী বললেন, আপনি বসুন।

নন্দিনী খাবার টেবিলের খালি চেয়ারটায় বসল।

এখন মুস্কিল হল আপনাদের ট্রেনিং পিরিয়ডে আপনারা একসাথে থাকার জিদ ধরবেন না। তেমন গ্যারান্টি দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভবও হবে না। কারণ আপনাদের যে ক্যাম্পে পাঠাব বলে ভাবছি তা দেশের ভেতরের একটা ক্যাম্প। সেখানে কোনো মহিলা কমরেড আমাদেরই নাই। কবি সাহেবকে কাল সকালেই সেখানে চলে যেতে হবে। আর মিস চক্রবর্তী, আমি জানি না আপনারা বিবাহিত কিনা, সেজন্য মিস বললাম। আপনাকে আমাদের ভারত সীমান্তের ভেতরের একটি গ্রামে যেতে হবে। সেখানে আমাদের ক্যাম্পে কয়েকজন মেয়ে আছেন। আপনাদের প্রাথমিক ট্রেনিং শেষ হলে আবার এখানে ফিরে আসতে হবে। পরের ব্যবস্থা আমরা স্থির করব। আমরা অবশ্য আপনাদের এখানে ফিরে এলে আমাদের পার্টির বিয়য় এবং লিটারেচার সম্বন্ধে জ্ঞাত করব। গ্রহণ করা না করা আপনাদের ইচ্ছা। এতে মুক্তিযুদ্ধে পার্টিসিপেশন আটকাবে না। আপনারা কী কমরেড তোহার নাম শুনেছেন?

আমি বললাম, তার সাথে একদা আমার পরিচয় ও আন্তরিকতা ছিল! কয়েকবার আমি তাকে আমার ঢাকার বাসায় শেলটারও দিয়েছি।

ভেরি গুড।

হাসলেন আলী রেজা।

নন্দিনী বলল, আমিও কমরেড তোহার নাম শুনেছি। চট্টগ্রাম থাকতে শুনতাম তিনি নোয়াখালীর চরাঞ্চলে কৃষকদের সংগঠিত করছেন।

আপনারা সচেতন মানুষ। আপনাদের সাহায্য আমাদের একান্ত দরকার। রাজনৈতিক মতপার্থক্য এখন মুক্তিযুদ্ধে বাধা হবে না। আজ রাতটা একটু ভালো করে ভেবে দেখুন। যদি আমার প্রস্তাবে রাজি থাকেন তবে আগামীকালের মধ্যে আপনাদের দুজনকে দুজায়গায় ট্রেনিংয়ের জন্য চলে যেতে হবে। বাকি রাতটা শান্তিতে ঘুমোন। নাসরিন আপনাদের সাথে থাকবে। সকালে ব্রেকফাস্ট সারা হলে নাসরিন আপনাদের আমার কাছে নিয়ে যাবে।

কথা শেষ করেই আলী রেজা পাশের ঘরে তার অন্যান্য সঙ্গীদের কাছে চলে গেলেন। একটু পরেই পাশের ঘর থেকে আলী রেজাদের বেরিয়ে যাওয়ার শব্দ পেলাম। একই সঙ্গে নাসরিন এসে আমাদের ঘরে ঢুকল। মুখখানা হাসি হাসি। এতক্ষণ নাসরিন মেয়েটির ছবি সুরৎ ভালো করে লক্ষ করার ফুরসৎ পাই নি।

এখন দেখলাম মেয়েটি বেশ দীর্ঘাঙ্গী। তবে চেহারায় কিশোরীসুলভ চপলতা। চোখ দুটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। কালো এবং গভীর। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম। মাথার দুদিকে দুটি লম্বা বেণী। ডানদিকের সুরেখার ঠিক ওপরে একটা হালকা ক্ষতচিহ্ন থাকায় মনে হয় দুটি রেখা বুঝি মেয়েটির চোখের উপর কেউ ভুল করে বসিয়ে দিয়েছে। কিশোরী হলেও নাসরিনের বুকের গঠন পরিপূর্ণ, নিখুঁত। নাসরিন গাঢ় সবুজবর্ণের সালোয়ার কামিজ পরে আছে।

আমি হেসে বললাম, এসো কমরেড নাসরিন। এবার তোমার সাথে একটু কথা বলি। কিছুক্ষণ আগে তুমি যেমন সামরিক কসরৎ দেখালে তাতে একটু ঘাবড়ে গেলেও এখন ভয়টা একটু কমেছে।

আমাকে আপনাদের ঘুমের ব্যবস্থা ছাড়া আর কোনো বাড়তি দায়িত্ব দেওয়া হয় নি। সামনের ঘরে গিয়ে দুজন চুপচাপ শুয়ে পড়ুন। কাল কথা হবে।

হেসে নাসরিন এসে নন্দিনীর হাত ধরল।

নন্দিনী বলল, তোমার মা বুঝি এখানে থাকেন না?

আম্মা ছুটিছাটায় এখানে এসে থাকলেও, বেনাপোলেই বেশি থাকেন।

তোমার আব্বা?

নন্দিনীর প্রশ্নের জবাবে নাসরিন বলল, আব্বা চাটগাঁর কাস্টম ট্রেনিং সেন্টারের কোর্স কো-অর্ডিনেটর। মাঝে মধ্যে এলেও মার সাথে বেনাপোলেই থাকেন। মাঝে মধ্যে আমাকে দেখতে এখানে আসেন। আমি একাই এখানে থাকি। এবার চুয়াডাঙ্গা কলেজ থেকে আই. এ. পরীক্ষা দেব।

আমি বললাম, নাসরিন তুমি খুব অল্প বয়েসেই রাজনীতির সাথে জড়িয়ে গেছ। একথা তোমার আব্বা আম্মা জানেন না নিশ্চয়ই?

কেন জানবেন না। রাজনীতিটা আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। আমি যে পলিটিক্স করি আমার বাপ মাও এই আদর্শেরই সমর্থক। তবে সরকারি কর্মচারী বলে তারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেন না।

তোমরা কী ভাব বাংলাদেশে সাম্যবাদী দলের আদর্শই সঠিক?

আমাদের তো তাই বিশ্বাস। যাক এখন আর রাজনীতির আলোচনা নয়। আপনারা সামনের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন। দুজন এক ঘরেই থাকবেন তো?

আজ রাতটা অন্তত থাকি।

হাসল নন্দিনী।

মশারি টাঙানো আছে। খাটে উঠে শুধু চারধারটা একটু গুঁজে দিন। আমি গিয়ে বাতি নিবিয়ে দিয়ে আসব।

নাসরিনের কথায় আমরা সামনের ঘরে এসে বিছানায় উঠলাম। নন্দিনী মশারি গুঁজতে লাগল। নাসরিন একটু পরেই এসে বাতি নিবিয়ে দিয়ে গেল। বাতি নেভাবার আগে আমাদের খাটের দিকে তাকিয়ে তার লাজুক মিষ্টি হাসি আমি মশারির ভেতর থেকেও এক ঝলক চকিতে দেখতে পেয়ে সংকোচিত বোধ করলাম। আলী রেজার কথায় একটু আগেই বুঝেছি আমরা যে স্বামী-স্ত্রী নই আলী রেজারা কীভাবে যেন আগেই আন্দাজ করে নিয়েছিল। পরে অবশ্য আমাদের পরিচয় পেয়েই আলী রেজা বুঝে গেছে আমাদের মধ্যে প্রণয় থাকলেও আমরা স্বামী-স্ত্রী নই। আমাদের আলোচনা নিশ্চয়ই পাশের কামরা থেকে নাসরিনরাও শুনেছে। এখন এ ব্যাপারে সংকোচ করেও কোনো ফল হবে না। ভেবে আমি নন্দিনীকে বললাম, আমরা যদি এদের ট্রেনিং ব্যবস্থায় রাজি হই তবে আগামীকালই তোমাকে এখান থেকে অন্যত্র চলে যেতে হবে।

আমি আলী রেজা সাহেবের প্রস্তাবগুলো শুনেছি।

আজ রাতেই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।

অর্থাৎ তুমি সীমান্তের ওপারে পশ্চিমবঙ্গের একটি গ্রামে গিয়ে ট্রেনিং নেবে। আর আমি থাকব এদিকে।

আলী রেজা তো এ প্রস্তাবই তোমাকে দিয়েছিলেন। এখন তুমি ঠিক কর তুমি কী করবে?

আমাকে ছেড়ে যেতে তোমার কষ্ট হবে না?

হবে।

তবুও যাবে?

কী করব বল? আমি হামিদার কাছে পরাজিত ও ছোট হয়ে বেঁচে থাকতে পারব না।

এটা তবে স্বীকার কর, দেশের স্বাধীনতা নয় প্রতিদ্বন্দিনীর প্রতি ঈর্ষাই তোমার অবচেতন বুক জুড়ে আছে। হামিদার স্বার্থ ত্যাগ ও দেশের জন্য জীবন বাজি রাখার প্রতিজ্ঞাকে তুমি সহ্য করতে পারছ না। ভাবছ এতে তোমার হার হয়েছে।

হতেও পারে। তোমাকে আমি ভালবাসি যখন তখন তোমার বৌকে জিততে দেব কেন? অবচেতন ঈর্ষা থাকতেও পারে। আমি এখন চেতন-অবচেতন বিচার করার মতো অবস্থায় নেই।

তোমার বুকের ওপর একটু হাত রাখব?

রাখো। ব্লাউজ খুলে দেব?

না থাক। এমনি তোমার বুকে মুখে একটু হাত বুলিয়ে দিতে মন চাইছে। আমরা এখন এমন এক পরিস্থিতিতে চলে এসেছি আবার যে দেখা সাক্ষাৎ হবে এমন গ্যারান্টি কোথায়?

তাহলে আর অত ভয় কি? আজ রাতটা তোমাকে দিচ্ছি। তোমার যেভাবে খুশি নাও।

আমি আল্লাকে ভয় পাই নন্দিনী। মনে হয় এই পাওয়াটা বৈধ বা ন্যায়সঙ্গত হচ্ছে না। কোথায় একটা সীমাকে লঙ্ঘন করে যাচ্ছি। এদিকে কামনায়, লোভে আমার বুকের পশম পর্যন্ত কাঁপছে। আমিও তো পুরুষ। আমি আর পারছি না।

আল্লার ভয় নয়। হামিদার ভয়ে তুমি কাঁপছ।

আল্লাহ যদি হামিদার রূপ ধরে আমার বিবেকের ওপর দৌরাত্ম্য করে তবে আমি কী করব নন্দিনী?

আমি বালিশে মুখ রেখে ফোঁপাতে লাগলাম। নন্দিনী হঠাৎ বিছানায় উঠে বসে আমার বুকে মুখে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আমি একটু শান্ত হলে আমার দিকে পেছন রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। আমি কী করব বুঝতে না পেরে বিছানায় উঠে চুপচাপ খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে বসে থাকলাম। সারা কলোনীটা জুড়ে ঝিঁঝির একটানা শব্দ উঠছে। আমি মশারির ভেতর থেকেই এর স্বচ্ছ হালকা আবরণ ভেদ করে আকাশের তারা দেখতে পাচ্ছিলাম। শেষ প্রহরের পাখিরা এবং কলোনীর গৃহস্থদের মোরগ বাক দিয়ে উঠল। আমি নন্দিনীর খোঁপাভাঙা বিপুল কেশরাশিকে বালিশের ওপর দিকে সাজিয়ে দিয়ে আবার নিজের বালিশে শুয়ে পড়লাম যদিও জানি আজ আর ঘুম আসবে না। ওদিকে নাসরিনের ঘুমের আবছা আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। একবার ভাবলাম এ অবস্থা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হল নিঃশব্দে দুয়ার মেলে এ ঘর থেকে যেদিকে দুচোখ যায় পালিয়ে যাওয়া। কিন্তু কোথায় যাব? তাছাড়া আমি তো নন্দিনীকে কথা দিয়েছি, এই যুদ্ধের সময়টা আমি তাকে একা ফেলে কোথাও যাব না। এখন কী নন্দিনী একা? আগামীকালই সে আবার নতুন পরিবেশে নতুন একদল উদ্যমী মানুষের মধ্যে ট্রেনিং নিতে চলে যাচ্ছে। আমিও এখানে অন্য একটি ক্যাম্পে অন্যদের মধ্যে আধুনিক গেরিলা যুদ্ধের কলাকৌশল শেখার জন্য চলে যাব। নন্দিনীর সাথে কী আর সত্যি আমার দেখা। হবে? আজ একটু আগেই তো সে তার সর্বস্ব আমাকে উজাড় করে দিয়ে তৃপ্ত করতে চেয়েছিল। আমি নিতে পারছি না কেন? যুদ্ধের ময়দানে এই নারী কী সত্যি আমার জন্যে অবৈধ? আমি যদি আজ এখান থেকে পালিয়ে হামিদার কাছে চলে যাই সেকি আমাকে কাপুরুষ, দেশদ্রোহী ভাববে না? আর আমি ঢাকায় গিয়ে কোথায় হামিদা নাম্নী এক মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে পাব? এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই সকালের আলো এসে আমার মুখের ওপর পড়ল। পাশের ঘর থেকে নাসরিনের জেগে ওঠার শব্দও পেলাম। আমি আর শুয়ে থাকতে না পেরে তার নাম ধরে ডাকলাম, নাসরিন?

আপনারা জেগেছেন?

আপনারা নয়, আমি জেগেছি নাসরিন।

উঠে হাতমুখ ধোন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি চা নাস্তা দিচ্ছি।

আড়মোড়া ভেঙে জবাব দিল নাসরিন।

আমি বললাম, সকাল বেলা আমার চায়ের খুব বদ অভ্যেস। নাস্তার আগেই এককাপ বেডটির মতো হবে না নাসরিন?

কেন হবে না। একটু সবুর করুন এক্ষুণি দিচ্ছি।

বলল নাসরিন।

আমি বিছানায় বসে সকালের আলোয় ঘুমন্ত নন্দিনীর ছড়িয়ে যাওয়া কেশরাশি, মুখের ঈষৎ বিবর্ণ ক্লান্তি এবং শারীরিক ক্লান্তির নারীসুলভ সৌন্দর্য চোরের মতো দেখে নিতে লাগলাম। তার নাকের বা পাশে মাছির মতো একটা বড় তিল যেন তার সরলতার সাক্ষ্য দেবার জন্য জ্বলজ্বল করছে।

নিজের বৌকে অমন অবাক হয়ে দেখতে হয় নাকি?

হাসির খিল খিল শব্দ তুলে চায়ের কাপ হাতে নাসরিন।

আমি তাড়াতাড়ি মশারি সরিয়ে বাইরে আসতে আসতে বললাম, দুঃখ কষ্টে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে বেরিয়েই তো দিন কেটে যাচ্ছে। নিজের আপনজনকে চোখ ভরে তেমন করে আর দেখতে পেলাম কই?

বেশ তো দেখুন না। নিন চায়ের কাপটা ধরুন। চা খেতে খেতে নয়ন ভরে দেখুন। আমি মশারিটা তুলে দিচ্ছি। নাসরিন আমার হাতে চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিয়ে মশারি তুলতে গেলে নন্দিনীর ঘুম ভেঙে গেল। সে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল, কি ব্যাপার আমাকে জাগাও নি কেন?

জাগাব কি, আপনার সাহেব তো ঘুমের মধ্যে আপনার রূপ দেখেই কূল পাচ্ছে না।

মুখের ওপর হাত রেখে হাসি লুকোতে চেষ্টা করল নাসরিন।

নন্দিনী তার আগোছালো চুল টেনে এনে খোঁপা বাঁধল। বিছানা থেকে নেমে শাড়ি ঠিক করতে করতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এর মধ্যে চাও পেয়ে গেলে? নাসরিন তো খুব ভাল মেয়ে দেখতে পাচ্ছি। আমি ট্রেনিংয়ে চলে গেলে তোমার খুব অসুবিধে হবে না।

নাসরিন ঠোঁটে আঙুল রেখে আমাদের সতর্ক করে বলল, একটু আস্তে কথা বলুন। কলোনীর মানুষজন জাগছে। নাস্তার পরই আপনাদের পাশের একটা বাড়িতে যেতে হবে। সেখান থেকে দুজনকে দুদিক চালান করে দেয়া হবে। আমি রুটি বেলে আনছি। শুধু রুটি আর চা। আর কিছু নেই ঘরে। এ খেয়েই সকালটা কাটাতে হবে।

আমি হাত নেড়ে আমাদের সন্তুষ্টি ব্যক্ত করলাম। নাসরিন নাস্তার যোগাড়ে অন্য ঘরে চলে গেলে আমি মৃদুস্বরে বললাম, মনে হয় চমৎকার ঘুম হয়েছে নন্দিনী।

কী করে বুঝলে?

আমি জেগে থেকে তোমার সুখনিদ্রা উপভোগ করার দৃশ্যটা প্রাণভরে দেখে নিয়েছি।

তুমি ঘুমাও নি?

ঘুম পাচ্ছিল না।

ঘুমের ওষুধ তো আমি বাৎলেছিলাম। তুমিই নিলে না। এখন আমার ঘুমন্ত দেহের বা রূপের প্রশংসা করে ভুলিও না তো।

আজ ছাড়াছাড়ির দিনটায় ঝগড়া করে তিক্ত করে যেও না নন্দিনী। আমি তোমাকে ভালবাসি বলেই সম্মান করি। লঙ্ঘন করতে সাহস হচ্ছে না বলে আমাকে কাপুরুষ ভেবো না। এটুকু অতৃপ্তি না নিয়ে গেলে আমরা পরিস্থিতির চাপে একদিন হয়তো পরস্পরকে ভুলে যেতাম। এখন আর ভোলার সম্ভাবনা নেই। অন্তত আমার পক্ষ থেকে।

নন্দিনী স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। তারপর কী ভেবে যেন বলল, হামিদাকে আমি জিততে দেব না কবি। আমার কপালে যাই থাক এই মুক্তির লড়াইয়ে একটা যোগ্য ভূমিকা আমাকে নিতেই হবে। ট্রেনিং পিরিয়ডটা যত কষ্টকরই হোক আমি তাতে সফল হয়ে তোমার কাছে ফিরে আসব। তোমার কাছে অনুরোধ, এই যুদ্ধটাকে তুমি অবহেলা কর না। বল করবে না?

আমি হেসে বললাম, যদি সুখ আর নিরাপত্তার কথাই ভাবতাম তবে কী আমরা কলকাতার জীবন ছেড়ে এখানে আসতাম? আমার ব্যাপারে তুমি কিছু ভেবো না নন্দিনী। আমার প্রতিজ্ঞাও তোমার মতোই। আগে দেশের স্বাধীনতা, ঢাকায় ফিরে যাওয়া, তারপর ভাগ্যে যা আছে তা দেখা যাবে।

.

দর্শনা হল্ট স্টেশনের পাশেই রেল শ্রমিকের একটা কোয়ার্টারের দশ পনেরো জন মুক্তিযোদ্ধার একটা বৈঠকে আমাকে ও নন্দিনীকে নিয়ে নাসরিন হাজির হল। আমরা ঘরে ঢোকা মাত্রই আলী রেজা বলল, কবি সাহেব, এখানে বেশি কথা বার্তা বলা যাবে। না। পাঞ্জাবিরা কাস্টম কলোনী ও রেলকর্মচারীদের কোয়ার্টারগুলোকে গত রাত থেকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। মোজাফফর গ্রুপের যে দুজন আপনাদের কলোনীতে পৌঁছে দিয়ে গেছে তারা যাওয়ার সময় দর্শনা হল্টে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মালগাড়ির ভেতর ক্যামোফ্লাজ করে থাকা দশজনের একটা পাঞ্জাবি গ্রুপের ওপর হ্যান্ড গ্রেনেড ও হালকা চাইনিজ রিকয়েললেস রাইফেল দিয়ে এ্যাটাক করে শেষ করে দিয়েছে। খুব সাকসেসফুল অপারেশন। ব্রেভো। তবে দুজনের একজনের উরুতে রাইফেলের বুলেট একটা বিঁধে গেছে। লোকটার নাম লতীফ। সাহায্যের জন্য আমাদের একটা ক্যাম্পে এসে উঠেছে। বুলেটটা আজই রিমুভ করতে হবে। আমরা নিজেরাই কাজটা করতে পারতাম কিন্তু স্পটেই লতীফের খুব রক্তপাত হওয়াতে সে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে। একজন ডাক্তার চুয়াডাঙা থেকে আজই নিয়ে আসতে হবে। এ অবস্থায় আমরা আর দেরি করতে পারছি না। কমরেড চক্রবর্তীকে কমরেড আলতাফ ও কমরেড হাসান এই মুহূর্তেই আমাদের সীমান্তের ওপারের ক্যাম্পে নিয়ে যাবে। আর কবি সাহেব আপাতত আমার সাথে থাকুন।

আলী রেজার কথায় দুজন লোক উঠে দাঁড়িয়ে নন্দিনীর দিকে হাত বাড়িয়ে করমর্দন করল। এবং তাকে তাদের পেছনে যেতে বলে ঘরের বাইরে পা বাড়াল। নন্দিনী মুহূর্তের জন্য একটু অসহায়ের মতো আমার দিকে তাকালেও, পরমুহূর্তেই তার মুখে প্রতিজ্ঞার দৃঢ়তা ফুটে উঠল।

কবি, আমি যাচ্ছি।

আমার মুখ দিয়ে অকস্মাৎ যেন ছিটকে বেরিয়ে গেল, খোদা হাফেজ নন্দিনী।

নন্দিনী দুজন কমরেডের সাথে কোয়ার্টারের বাইরে চলে গেলে আলী রেজা আমাকে বললেন, ট্রেনিং পাওয়ার আগেই আপনাকে অপারেশন শুরু করতে হচ্ছে কবি সাহেব। এখনই একজন ডাক্তারের জন্য আপনাকে চুয়াডাঙ্গা যেতে হচ্ছে। আমি আপনাকে যে ঠিকানা দেব সেখানে গেলে তারা আপনাকে একজন সার্জারীর ছাত্র ডাক্তারকে আপনার সাথে দেবে। তাকে নিয়ে আপনি এখানে এই কোয়ার্টারের তিন নং প্লটে ফিরে আসবেন। চলুন আপনাকে সব বুঝিয়ে স্কুটারে তুলে দিচ্ছি।

আমি একটু হতবাক হয়ে গেলেও আলী রেজার কথায় সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম। তিনি আমাকে নিয়ে কোয়ার্টারের বাইরে এসে আগে থেকেই অপেক্ষমান স্থানীয় ভ্যান গাড়িতে চড়লেন। গাড়ি চলতে লাগল। যেতে যেতে তিনি বললেন, এই ভ্যানের চালক আমাদের লোক। এ আপনাকে আমাদের একটা প্রাইভেট স্কুটারে তুলে দেবে। মনে রাখবেন স্কুটার ড্রাইভারও আমাদের লোক। মুক্তিযোদ্ধা। সে আপনাকে চুয়াডাঙ্গা যে বাড়িতে নিয়ে যাবে সেখানে গিয়ে প্রফেসর আবদুল মতিনকে আপনি আমার এই চিঠিটা দেবেন। তিনি সব ব্যবস্থা করে সন্ধ্যায় সার্জারীর ছাত্রটি সহ স্কুটারে তুলে দিলে আপনি রেল কোয়ার্টারে এসে রিপোর্ট করবেন। নিন এই চিঠি আর খামটার মধ্যে এক হাজার টাকা আছে।

আলী রেজা আমাকে পকেট থেকে চিঠি ও টাকার খামটা দিলেন। আমি হাত পেতে নিয়ে চিঠি ও টাকার খাম সাবধানে পকেটে রাখলাম।

.

ভ্যান গাড়িটা একটু এগিয়ে গিয়ে স্টেশনের বাঁ দিকের পথ ধরল। এতক্ষণে আমি একটু ধাতস্থ হয়েছি। আলী রেজার হঠাৎ সিদ্ধান্তে নন্দিনী ও আমার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়াটা আমাকে একটু হতবাকই করে ফেলেছিল। এখন আমি একটু উপলব্ধি করছিলাম নিজের ইচ্ছাতেই আমি ও নন্দিনী জীবনের মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত রাজনীতি সম্বন্ধে আমার ও নন্দিনীর ধারণাই ছিল অস্পষ্ট। কিন্তু যুদ্ধটা ছিল প্রত্যক্ষ। আমরা আগরতলার যাত্রাপথে বামুটিয়া বাজারের কাছে কেবল মারণাস্ত্রের শব্দই শুনি নি। যুদ্ধের প্রকৃত হিংস্রতা এবং প্রিয়জনের মৃত্যুর দৃশ্যের সাথে নিজের পক্ষের লোকদের অমানুষিক আচরণও প্রত্যক্ষ করেছি। যুদ্ধ যে মানবিক ব্যাপার নয় বরং মানুষের সভ্য স্বভাবের অধঃপতন এটা আমার চেয়ে বেশি বুঝেছিল নন্দিনী। তবুও যুদ্ধ সুবিচার ও স্বাধীনতার জন্য আমাদের উভয়ের কাছেই ছিল একান্ত জরুরি। আর হামিদা তো লড়াইয়ের মধ্যেই তার বেঁচে থাকার সার্থকতা খুঁজতে স্বামীকেও, যে কিনা একজন কবি, ছেড়ে যেতে দ্বিধা করে নি। যুদ্ধ যত নির্মমই হোক এখন আমি সম্ভবত এর সামনাসামনি এসে পড়েছি। এ অবস্থায় আমার পক্ষে মৃত্যুবরণ যতটা কাম্য, ধরা পড়াটা কিছুতেই নয়।

গাড়ীটা এতক্ষণে একটা গাঁয়ে এসে পড়েছে। আলী রেজা এবার আমার সাথে কথা বলার জন্য মুখ ফেরালেন। তার মুখে একটা উদার হাসি খেলে যাচ্ছে।

এবার একটি সিগ্রেট চলতে পারে।

আমি পকেট থেকে সিগ্রেট ও দেশলাই বের করে তাকে দিলাম।

এবারও আমি কোনো জবাব দিলাম না। তার হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে নিজে একটা ধরালাম।

এ সময় জরুরি কাজে চলাফেলার কেউ কাউকে সতর্ক করা মানে অযথা ভয় পাইয়ে দেয়া। তবুও নতুন মানুষ ও অচেনা জায়গা বলে আপনাকে কতগুলো নির্দেশনা দিতে চাই। ভ্যানগাড়ি আর একটু এগিয়ে আপনাকে স্কুটারে তুলে দেবে। সে গাড়ির চালক সশস্ত্র। যদি পথে কেউ গাড়ি থামাতে চায় গাড়ি থামবে না। আপনি কোনো অবস্থাতেই ড্রাইভারকে থামতে বলবেন না। আপনি গাড়িতে স্থির হয়ে বসে থাকবেন। তবে ড্রাইভার যদি কোথাও গাড়ি ছেড়ে পালাতে থাকে আপনি বিনা বাক্য ব্যয়ে তাকে ফলো করবেন। সে যদি বাধ্য হয়ে কাউকে চার্জ করে তবে ভাববেন সে সঠিক কাজই করেছে। তার ইঙ্গিতের দিকে লক্ষ্য রাখবেন। সে কোথাও কোনো দোকানে চা খেতে নামলে আপনিও নামবেন। কোনো প্রশ্ন করবেন না। আপনি নিজে থেকে কারও কোনো জিজ্ঞাসার জবাব দেবেন না। ড্রাইভার আমীনই কথা বলবে। আর মনে রাখবেন ধরা পড়ার চেয়ে মুত্যুই শ্রেয়।

আলী রেজার কথা শেষ হওয়ার আগেই ভ্যান গাড়িটা মোড় ঘুরল। সামনেই পিচঢালা বড় রাস্তা। আলী রেজা ভ্যান থেকে নেমে পড়ল।

আসুন, জয় বাংলা।

জয় বাংলা।

আমিও আলী রেজার প্রতিধ্বনি করলাম।

সে হেসে বাঁক ঘুরে গাছপালা ঘেরা একটা বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। ভ্যানগাড়ি ততক্ষণে বড় রাস্তায় এসে উঠেছে। আর আমরা রাস্তায় ওঠা মাত্রই কোত্থেকে যেন একটা স্কুটার মৃদু শব্দ তুলে ভ্যানগাড়ির একরকম পথ আটকে দাঁড়াল।

ভ্যানগাড়ির চালক যার মুখটা এতক্ষণ আমি ঠিকমত নজর করতে পারি নি, কারণ আমি ও আলী রেজার কথাবার্তার মধ্যে সে একবারও আমাদের দিকে ফিরে তাকায় নি। এবার তার মুখখানা দেখলাম। একজন পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের যুবক। পরনে ময়লা সবুজ লুঙ্গি ও ঘেঁড়া গেঞ্জি। পায়ে রবারের স্যান্ডেল। মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গায়ের রং ফর্সা। গলায় রুপোর তাবিজ। আমার দিকে ফিরে বলল, স্কুটারে উঠে পড়ুন। জলদি।

আমি নিঃশব্দে স্কুটারে উঠে বসলাম। স্টার্ট চালু ছিল। গাড়ি চলাতে লাগল বাতাসের বেগে।

আমার নাম আমীন।

আমি হাদী মীর।

আপনার পরিচয় আমার জানা।

ড্রাইভার মুহূর্তের জন্য এক পলক আমার দিকে ঘাড় ফেরাল। হাসি মুখ। চমৎকার স্মার্ট চেহারা। স্বাস্থ্যবান বলিষ্ঠ বাহু। সজোরে হ্যান্ডেল ধরে আছে। কালো রংয়ের হাফহাতা বুশ শার্ট ও জিনসের প্যান্ট পরনে। কানের ওপর ডান দিকে একটা সরু ক্ষতচিহ্নের দাগ। দাগটা কোঁকড়ানো ঘন চুলের ওপরও জ্বলজ্বল করছে। মোটা বলিষ্ঠ ঘাড় দেখলে বডি বিল্ডারের মতো মনে হয়।

আমি বললাম, গাড়িতে বসে সিগ্রেট-টিগ্রেট খেতে কোনো মানা নাইতো কমরেড?

আরে না, আরামসে খান।

বলেই ড্রাইভার গাড়ি স্লো করতে গিয়ে ব্রেক কষার শব্দ তুলল। আমি পকেট থেকে তাড়াতাড়ি প্যাকেট বের করে সিগ্রেট ধরালাম। ড্রাইভারকে একটা দেব কিনা ইতস্তত করার মধ্যে আমীন বলল, আমাকে এখন দেবেন না। এখান থেকে পথে আর কোনো কথা নয়।

আমি হাত গুটিয়ে আনলাম।

.

আমরা বেলা তিনটায় চুয়াডাঙ্গা স্টেশনকে বাঁয়ে রেখে একটা মাঠের মতো জায়গায় এসে পড়লাম। মাঠটার মাঝামাঝি একটা ডোবার পাড়ে কয়েকটি খড়ের চালাঘর। সম্ভবত খুবই হতদরিদ্র দুএকটি পরিবার এখানে বাস করে। ঘরবাড়ি শ্রীহীন। পাটকাঠির বেড়ার জন্য ভেতরের উঠোন বা অন্দর দেখা যাচ্ছে না। আমীন বাড়িটার কাছে এসেই স্কুটারের গতি কমিয়ে আনল এবং একবার মাঠের চারদিকটা মুহূর্তের মধ্যে দেখে নিয়ে বাড়িতে ঢোকার পথের ওপর গাড়ি তুলে এনে সোজা উঠোনে ঢুকে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দিল।

আমরা এখন এখানেই অপেক্ষা করব। আমার পেছনে আসুন।

আমি নেমে আমীনের পেছন পেছন একটা ঘরে এসে ঢুকলাম। ঘরের ভেতর একজন মধ্যবয়স্ক স্ত্রীলোক কুলোয় চাল বাছছিল। আমীনকে দেখেই বলল, খাওয়ার ব্যবস্থা করব?

হ্যাঁ আমরা খাব।

দুজনের মতো ভাত-তরকারি হবে মনে হয়।

স্ত্রীলোকটি কুলোর চাল কায়দা করে একপাশে সরিয়ে এনে উঠে দাঁড়াল। আমীন আমার দিকে ফিরে বলল, আসুন হাতমুখটা ধুয়ে বসে যাই। আপনারও খিদে পেয়েছে নিশ্চয়?

আমি বললাম, কোথায় যেতে হবে?

আমার পেছনে আসুন।

আমীন আমাকে নিয়ে ঘরটার পেছনে এসে দাঁড়াল। এখানে একটা নেবু ঝোপের পাশে মাটিতে মটকা বসানো। মটকার মুখে টিনের ঢাকনার ওপর পানি তোলার মগ রাখা আছে। আমিন ঢাকনা খুলে পানি তুলে হাত মুখে ঝাপটা দিল। আমার দিকে ফিরে বলল, আসুন।

আমি মগটা হাতে নিয়ে বললাম, চিঠিটা যার হাতে দেব সেই অধ্যাপক সাহেব কী এখানে আসবেন? না আমাদেরই অন্য কোথাও গিয়ে দিতে হবে?

আপনাকে এখন আর কিছুই করতে হবে না। খেয়ে চৌকির ওপর গড়াগড়ি যাবেন। আমি গিয়ে মতিন সাহেবকে খবর দেব। তিনি এলে আপনাকে যা করতে বলা হয়েছে তাই করবেন। আমি খেয়ে স্কুটার নিয়ে বেরিয়ে যাব। এখানে আর ফিরব না। যেখান থেকে ফের আপনি স্কুটারে উঠবেন সে জায়গাটা প্রফেসর সাহেব আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। কিংবা আপনাকে চিনিয়ে দিলে আপনি ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে হেঁটেই চলে আসবেন। মনে রাখবেন এখন যে বেটি আমাদের খাওয়াবে সে এখানকার রাজাকার লীডারের স্ত্রী। আমাদের ফ্রেন্ড।

একটু হাসল আমীন।

আমি কথার কোনো জবাব না দিয়ে হাতমুখ ধুতে লাগলাম। স্ত্রীলোকটি ঘরের ভেতর থেকে একটা লাল গামছা নিয়ে বেরুল। আমীন গামছাটা নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, আসুন। আমরা খেতে বসলে করিমন প্রফেসরকে খবর দিতে যাবে। আমরা যে পাড়াটা পেছনে রেখে এসেছি মতিন সাহবেরে বাড়ি সেখানে। আমার বা আপনার সরাসরি সেখানে যাওয়া বিপদজ্জনক। আপনি এখানে থাকবেন। আমি অন্য জায়গায়। সব ব্যবস্থা ঠিকমতোই হয়ে যাবে। চিন্তা করবেন না।

আমীনের কথায় আমি নিশ্চিন্ত হলাম। বুঝলাম সব ব্যবস্থা শৃঙ্খলা মতোই এগোচ্ছে। আমার দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগের মধ্যে থাকার কিছু নেই। হাতমুখ মুছে আমি চৌকিতে এসে বসলাম। সামনে ভাতের থালা। বাটিতে নলা মাছের শুকনো ভাজি, লালশাক আর ডাল। আমীন আমার পাতে মাছ ভাজা আর লাল শাক তুলে দিলে বলল, খান। করিমন ভালই রাঁধে। তাছাড়া খুব বুদ্ধিমতী মহিলা। এখনই আপনি যাকে চান তাকে খবর দিতে যাবে।

আমীনের কথায় করিমন একটু হেসে পেছনের দরজার দিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেল। সত্যি খাওয়াটা অমৃতের মতোই লাগল। আমার প্রচন্ড খিদে থাকায় প্রচুর ভাত খেলাম। মনে হল আমার খাওয়া দেখে আমীনও পরিতৃপ্ত, করিমনের রান্নাটা দারুণ, না?

আমি বললাম, নিঃসন্দেহে দারুণ।

আমাদের সাথে কাজ করলে আরও বহুবার আপনাকে এখানে আসতে হবে।

তবে যে বললেন রাজাকারের বৌ?

রাজাকারের বৌ হলে আমাদের মিত্র হতে পারে না? আমীনের কথায় ঠাট্টার ইঙ্গিত স্পষ্ট। আমি কৌতূহলী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালে তিনি হেসে ফেললেন।

আমাদের একজন নেতৃস্থানীয় কমরেড রাজাকারের স্ত্রী সেজে এক রিকশাওয়ালার সাথে ঘর করতে হচ্ছে। কিছু বুঝলেন?

না। রহস্য রেখে খুলে বলুন।

ইনি দিনাজপুরের কমরেড আদিনাথ মজুমদারের স্ত্রী সবিতা মজুমদার। হেঁয়ালি করছি না কবি সাহেব।

তার কথা শেষ হবার আগেই উঠোনে রিকশার বেল শুনে সেদিকে মুখ তুললাম। একজন শীর্ণকায় লোক ঘরে এসে আমাদের দিকে হাত তুলে সালাম দিল। পরণে চেক লুঙ্গি। শ্যামবর্ণ চেহারা। বয়েস পাশের মতো। গায়ে হাফহাতা ময়লা গেঞ্জি। বলল, পথে করিমনের সাথে এই মাত্র কথা হল। সে মতিনকে খবর দিতে গেছে। খাওয়া হয়ে গেলে তুমি আর দেরি করো না। চলে যাও।

আগন্তুক কাঁধের গামছাটা হাতে নিয়ে আমার দিকে তাকাল।

আমীন তাড়াতাড়ি বলল, একে রেজাভাই পাঠিয়েছেন। ইনি সঙ্গে ডাক্তারকে নিয়ে যাবেন। মতিন ভাইয়ের জন্য এর কাছে একটা চিঠি আছে।

ডাক্তার কেন?

একজনের গুলী লেগেছে।

আমাদের লোক?

না অন্য গ্রুপের।

বুকে?

ঊরুতে। খুব রক্ত গেছে। দুর্বল। আমাদের শেলটারে আছে।

থালা থেকে হাত তুলল আমীন, আমি হাত ধুয়ে আসছি।

আগন্তুক আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আস্তে খান। আপনার তাড়াতাড়ি করতে হবে না।

আমি বললাম, আমারও হয়ে গেছে। আমিও হাতটা ধুয়েই আসি।

বেশ যান।

আমি পেছনের দরজা দিয়ে আমীনের পেছনে এসে দাঁড়ালাম।

আপনি যার নাম বলেছিলেন ইনিই সেই কমরেড?

হ্যাঁ।

আমীন হাসল।

আমি বললাম, আপনারা সব রহস্যময় মানুষ। মনে হচ্ছে আমি একটা বেশ বীরত্বপূর্ণ ঘটনার মধ্যে এসে পড়েছি।

আসলে তাই তবে ভয় পাবেন না, আমরাই জিতব।

বলে আমীন সোজা ঘরের ভেতর চলে যেতে উদ্যত হলে আমি বললাম, একটু দাঁড়ান। কমরেড আদিনাথকে তবে কোনো নামে ডাকব?

রিকশাওয়ালার নাম আবদুল্লা মিয়া। আপনি আবদুল্লা নামে ডাকবেন। তার স্ত্রী করিমন। মনে থাকবে?

প্রশ্ন করল আমীন। আমি বললাম, থাকবে বৈকি।

আমি আমীনের পেছনে ঘরের মধ্যে এলাম। আবদুল্লাহ চৌকির ওপর থেকে থালাবাটি মাটিতে নামিয়ে চাটাইয়ের ওপর চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। ঘরে ঢুকেই আমীন বলল, আমি তাহলে চলি।

এসো উঠোনে দাঁড়িয়ে একটু কথা বলি।

একথা বলে আবদুল্লাহ আমীনকে নিয়ে ঘরের বাইরে স্কুটারের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। দশ মিনিট অনুচ্চস্বরে কথা বলার পর আমীন স্কুটারে স্টার্ট তুলে উঠোন থেকে নেমে গেলে আবদুল্লা ঘরে এসে আমাকে বললেন, আপনি এখন একটু বিশ্রাম করুন। এইমাত্র আপনার পরিচয় জানলাম। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের লেখকরাও অংশগ্রহণ করছে এটা আমাদের জন্য খুবই আনন্দের ব্যাপার। দেশের মানুষের সংগ্রামে যোগদান না করলে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা কোত্থেকে হবে। তবে কমরেড রেজার আপনাকে এখানে এই বিপজ্জনক মুহূর্তে পাঠানো সুবিবেচনার কাজ হয় নি। যে কোনো মুহূর্তে আমরা বিপদে পড়ে যেতে পারি। হানাদারদের ইনফর্মারদের ওপর খুবই চাপ আসছে আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টিটার সদস্যদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য। খুব চাপ। অন্যদিকে ইন্দিরা গান্ধি চাইছেন না মুক্তিযুদ্ধটা আওয়ামী লীগের হাত ফসকে দেশের ভেতরকার মার্কসবাদী বিপ্লবী গ্রুপগুলোর হাতে চলে যাক। এ অবস্থায় আপনারা যারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে এসে দাঁড়িয়েছেন তাদের কোনো রাজনৈতিক সচেতনতা কিংবা বিপ্লবী প্রস্তুতি নেই।

আমি বললাম, যুদ্ধটা কী দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে আপনারা মনে করেন?

আমরা চাই এই লড়াই দীর্ঘস্থায়ী হোক। যুদ্ধ যতই বিলম্বিত হবে ততই আওয়ামী লীগের বুর্জোয়া অংশের সাথে তাদের তরুণ বিপ্লবী অংশের ভেতরকার দ্বন্দ্ব প্রকট হবে। ততদিনে দেশের সাধারণ মানুষের এই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ ব্যাপকতর হবে এবং মুক্তিযুদ্ধে দিকনির্দেশনা দেওয়ার ক্ষমতা আওয়ামী লীগের সুবিধাবাদী গ্রুপ হারিয়ে ফেলবে।

আপনি কী মনে করেন ভারতীয় বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে?

আপনাদের নেতারা যারা এখন ভারত সরকারের অতিথি হয়ে কলকাতায় আরাম আর উদ্বেগের মধ্যে কাল কাটাচ্ছেন তারা চাইলেই প্রবেশ করবে। এমনকি না চাইলেও প্রবেশ করতে বাধা দিচ্ছে কে? কোটি কোটি শরণার্থীর অজুহাত তাছাড়া আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মস্কোর সমর্থন তো আছেই।

বললেন আবদুল্লাহ ওরফে কমরেড আদিনাথ।

আমি বললাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তা কিছুতেই মানতে পারবেন না। সারাদেশ তার কথাতেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তিনি পাকিস্তানী শোষণের বদলে ভারতীয় শোষণ ডেকে আনতে পারেন না। আপনাদের তত্ত্বে নিশ্চয়ই কোথাও ভুল রয়ে গেছে। দেশবাসী শেখ সাহেবের নেতৃত্বে এখনও ঐক্যবদ্ধ। ভারত এই যুদ্ধে আমাদের সাহায্য, সহানুভূতি ও আশ্রয় দিচ্ছে। সহানুভূতিকে আধিপত্য বলে ধরে নিলে আপনাদের ভুল হবে কমরেড।

এ নিয়ে আমাদের আর তর্ক করে কী হবে। ভুল কার ভাঙবে তা বোঝা যাবে কয়েকমাস পরেই। এখন যুদ্ধটাই প্রধান। মতান্তর ভুলে এখন সেটাই চালিয়ে যেতে হবে। আপনি এবার একটু বিশ্রাম নিন।

বললেন আবদুল্লাহ।

আমি বললাম, এখন কী আর বিশ্রাম নেব। বরং আসুন একটা সিগ্রেট ধরাই। নিন।

ধন্যবাদ, আমি ধুমপান করি না।

এসময় করিমন এসে ঘরে ঢুকল। ঢোকা মাত্রই আবদুল্লাহ বললেন, কি ব্যাপার, প্রফেসর আসেন নি?

তিনি এখনই আসছেন।

করিমন আবদুল্লাহকে ইঙ্গিতে তার পিছনে যেতে বলে ঘরের পেছনে চলে গেলে আবদুল্লাহও তার পেছনে গেলেন। আমি একা সিগ্রেট টানতে টানতে একটু কাত হয়ে চৌকিতে শোয়া মাত্রই দুচোখে ঘুম নেমে এল। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়ার আগেই তৃতীয় এক ব্যক্তি ঘরে এসে প্রবেশ করায় আমি চোখ মেলে তাকালাম। একজন বৃদ্ধ লোক। মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। গায়ে শাদা পাঞ্জাবি। পরনে পায়জামা। চোখ দুটি খুব তীক্ষ্ণ সতর্ক এবং অনুসন্ধানী বলে মনে হল। আমাকে শুয়ে থাকতে দেখেই জিজ্ঞেস করলেন, আপনি দর্শনা থেকে এসেছেন?

আমি মুহূর্তের মধ্যে উঠে বসে জবাব দিলাম, হ্যাঁ।

আমার নাম মতিন।

আপনার একটা চিঠি আছে।

আমি চিঠিটা বের করে অধ্যাপক মতিনকে দিলাম।

তিনি চৌকিতে বসে চিঠিটা খুললেন। এর মধ্যে আবদুল্লাহ ও করিমন ঘরে ফিরে এল। মতিন চিঠি পড়ে কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে বললেন, সার্জারীর যে ছেলের কথা চিঠিতে লেখা আছে সে জরুরি কাজে এখন ঢাকায়। আমরা একজন নার্সকে আপনার সঙ্গে দিচ্ছি। সার্জন না হলেও বহুদিন ঢাকায় সার্জিক্যাল অপারেশন কাটাছেঁড়ার কাজে সহকারী ছিল। বুলেটটা বের করে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে আসবে। বলবেন আহতকে রক্তদান ইত্যাদির প্রয়োজনে শেষপর্যন্ত কলকাতায় যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। বুলেটটা বের করার মতো অবস্থায় না থাকলে আমাদের নার্স সেটা করতে যাবে না। সেক্ষেত্রে সে ব্যথা ও অন্যান্য উপসর্গ ঠেকাবার জন্য ওষুধপত্র নিয়ে যাবে এবং রোগীর সাথে কলকাতার পর্যন্ত সঙ্গ দেবে। এর বেশি এখান থেকে আমরা কিছু করতে পারছি না।

আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকলাম।

এবার আমি উঠি। সন্ধ্যায় নার্স মেয়েটি এসে আপনাকে যথাস্থানে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠবে। আসি তাহলে।

মতিন সাহেব আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমি তার সাথে হাত মেলালে তিনি সকলকে সালাম দিয়ে বিদায় নিলেন। ঘরের বাইরে গিয়ে আবদুল্লাহর রিকশায় উঠলেন। আবদুল্লাহ রিকশার দিকে যেতে যেতে করিমনকে বলল, অতিথিকে চা টা দিও।

রিকশা বেল বাজিয়ে রাস্তায় গিয়ে উঠল। এবার করিমন আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন, এখনই কী চা দেব?

না একটু পরে দিলেও চলবে।

তাহলে আপনি বিশ্রাম নিন। আমি একটু বাসি বাসনপত্রগুলো ধুয়ে ফেলি।

আমি শুলেই ঘুমিয়ে পড়ব।

পড়ুন না। পাঞ্জাবিরা না এলে আমি আপনাকে জাগাব না। মনে রাখবেন এটা রাজাকার সর্দারের বাড়ি!

হাসল করিমন ওরফে সবিতা মজুমদার। বয়েস চল্লিশের কম হবে না। তবে দেহের অটুট গড়নে তাকে যুবতীই মনে হয়। তার হাসিটা বেশ অকপট এবং উদার বলেই মনে হল। এবার আমিও হাসলাম, তাহলে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ি, কী বলেন? আমি অবশ্যি আপনাদের অন্য পরিচয়ও জানি মিসেস মজুমদার।

এটা আমীনের ঠিক হয় নি।

আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন।

বিশ্বাস অবিশ্বাসের ব্যাপার নয় সতর্কতার ব্যাপার। যে কোনো মুহূর্তে আমি ও আমার সঙ্গী ধরা পড়ে যেতে পারি। ধরা পড়া মৃত্যু নয়, অসহ্য দৈহিক নির্যাতন। আপনি জানেন না ধরা পড়া মুক্তিযোদ্ধাদের কী পরিমাণ নির্যাতন করা হচ্ছে। শুনলে গা কাঁটা দিয়ে উঠবে। আচ্ছা এখন শুয়ে পড়ুন, আমি একটু ঘরকন্নার কাজ করি। আর ঘুমোতে না চাইলে অপেক্ষা করুন দশ মিনিট পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিউজ বলবে। রেডিও ঐ বালিশটার নিচে তোষকের তলায় লুকানো আছে। আমি সেন্টার ঠিক করে রেখেছি। শুধু অন করে দিলেই চলবে।

করিমন বেরিয়ে গেলে আমি তোষকের তলা থেকে হালকা ট্রানজিষ্টারটা বের করে সামনে রাখলাম। দশ মিনিটকে মনে হল যেন দশ ঘন্টা পার হচ্ছে। কলকাতায় থাকতেও স্বাধীন বাংলা বেতার শোনার সুযোগ আমার বা নন্দিনীর তেমন হয় নি। যদিও ঐ বেতারের পরিচালক মন্ডলীর মধ্যে একজন ছিলেন আমারই ভগ্নিপতি। হঠাৎ পারুল আর মিতুর মুখ চকিতে মনের ভেতর ভেসে উঠল। মামা আপনাকে একটা সারপ্রাইজ দেব! এক্ষুণি ওপরে চলুন। হামিদার সাথে হোটেলের দেখা হওয়ার মুহূর্তটির কথা কেন জানি খুব মনে পড়ল। আমি রেডিওটা অন করে দিলাম।

অনেকক্ষণ পর্যন্ত একটানা একটা ঘরঘর শব্দের জন্য ঘোষকের গলা শুনতে পেলাম না। যখন শব্দটা স্পষ্ট হল শুনতে পেলাম, গতরাতে সিদ্ধিরগঞ্জ স্টেশনের কাছে এক আক্রমণে আমাদের বীর মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা ঢাকার সাথে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন করে দিলে ঢাকা শহর অন্ধকারে ডুবে যায়। হানাদার বাহিনী এখন সর্বত্রই দিশেহারা। এখন পর্যন্ত ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হয় নি বলে জানা গেছে। এই আক্রমণে আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতরভাবে আহত হলেও অপারেশনের সময় সম্মুখ যুদ্ধে ৭ জন পাঞ্জাবি নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর ভয়ে নারায়ণগঞ্জের কলাবরেটররা শহরে আরও দৃঢ় পাহারা বসাবার জন্য জেনারেল নিয়াজীর কাছে দাবি জানিয়ে দেনদরবার করছে। ঢাকা থেকে খবর পাওয়া গেছে যে টাঙ্গাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও ভৈরবে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতার মুখে দিশেহারা ঘাতকবাহিনী গায়ের সাধারণ চাষী পরিবারগুলোর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাচ্ছে। যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং বাপ মায়ের চোখের সামনেই তাদের যুবক পুত্রদের গুলী করে মারা হচ্ছে।…

সংবাদ শেষ হলে রেডিওতে গান শুরু হল, একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি, আমরা।…

এসময় এককাপ চা নিয়ে করিমন ঘরে ঢুকল, নিন চা। ঢাকার খবর কি?

ভালো।

হেসে করিমন আমার পাশে এসে বসল। গানটা আরও একটু কমিয়ে দিলাম। এ সময় বাইরে রিকশার বেল বেজে ওঠায় করিমন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, সম্ভবত সিস্টার মরিয়ম এসেছে।

বোরখা পড়া একজন মেয়েকে নিয়ে আবদুল্লাহ ঘরে এসে ঢুকল।

আপনাকে এক্ষুণি একে নিয়ে রওয়ানা হতে হবে। সন্ধ্যার পর আপনাদের যাওয়ার রাস্তা নিরাপদ থাকবে না। উঠে পড়ুন।

আমি চায়ের কাপটা করিমনের হাতে দিয়ে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালাম। সিস্টার বোরখার নেকাব সরিয়ে মুখ বের করলে দেখলাম, শ্যামলা চেহারার এক যুবতী। হাতে ধাত্রী মেয়েদের মতো একটা ভারী ব্যাগ। বলল, আমি যাচ্ছি আপনার সাথে। আমার নাম মরিয়ম।

আমি হাত বাড়িয়ে মরিয়মের ব্যাগটা নিয়ে বললাম, চলুন।

আমি আর মরিয়ম পাশাপাশি রিকশায় বসলাম। আবদুল্লাহ রিকশা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল।

.

আমরা সূর্যাস্তের আগেই চুয়াডাঙ্গা স্টেশন ক্রশ করে একটা মোটর পার্টসের দোকানের সামনে এসে নামলাম। মরিয়মই রিকশা থেকে নেমে আমাকে এখানে নামতে ইঙ্গিত করায় আমি নেমে গেলাম। আমাদের নামিয়ে দিয়েই আবদুল্লাহ রিকশা নিয়ে চলে গেল। আমরা দোকানটার বারান্দায় দাঁড়াবা মাত্রই হাওয়া থেকে যেন হু হু শব্দে স্কুটার নিয়ে আমীন হাজির হল।

তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন। মনে হয় এখানকার অবস্থা ভাল নয়। মুজিব বাহিনীর একটা গ্রুপ এখানকার একটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের বাড়ি আক্রমণ করে চেয়ারম্যানসহ কয়েকজনকে খতম করেছে। তার বাড়িতে শান্তিবাহিনীর বৈঠক হচ্ছিল।

আমি ও মরিয়ম ফুটারে উঠে বসা মাত্র গাড়ি দ্রুতবেগে ছুটতে শুরু করল। স্কুটার আবাসিক এলাকা ছাড়িয়ে মাঠের পথ ধরে এগোতে লাগল। দুপাশে ধানের খেতের মাঝ দিয়ে খোয়া বিছানো এ্যাবড়ো থ্যাবড়ো রাস্তা। আমরা আসার সময় যে এপথে আসি নি তা বুঝতে পেরে আমি আমীনকে বললাম, আজ রাতটা অপেক্ষা করে রওনা হলে ভালো হত না?

না, তাহলে আমরা বিপদে পড়ে যেতাম। পাঞ্জাবিরা এখানে ব্যাপকভাবে তল্লাসি শুরু করেছে। এরা কী যেন একটা টের পেয়েছে। শুনলাম সিদ্ধিরগঞ্জের পাওয়ার স্টেশনের কাছে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের ফলে গত কালও ঢাকা শহর অন্ধকার ছিল। হানাদাররা ভয় পেয়ে এখানে যাকে সন্দেহ হচ্ছে তাকেই গুলী করছে। তাছাড়া আমার ওপর নির্দেশ আজই আপনাকে আর সিস্টারকে নিয়ে দর্শনায় ফিরে যাওয়ার।

স্কুটারের সামনে থেকে মুখ ঘুরিয়ে আমীন আমার দিকে তাকালে আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, যে পথে যাচ্ছি এতে বিপদ নেই তো?

এখন সব পথেই বিপদ আছে কমরেড। প্রাণ হাতে করেই এ পথে যাচ্ছি। তবে ভয় পাবেন না, আমি ও সিস্টার কেউই নিরস্ত্র নই। প্রাণ বাঁচাবার মতো হাতিয়ার আমাদের দুজনের কাছেই আছে। বিপদে পড়ে গেলে আপনি হতভম্ব হবেন না। আমাদের ডিরেকশনে চলবেন।

এবার মুখ না ঘুরিয়েই জবাব দিল আমীন।

আমি মরিয়মের দিকে তাকলে সে হেসে বোরখার নেকাবটা নামিয়ে দিল। এতক্ষণ তার মুখ খোলাই ছিল। আমি তাঁর আবৃত মুখখানা আর দেখতে না পেয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখি পশ্চিমদিকে সূর্য ডুবে যাওয়ার পরও আকাশের রক্তবর্ণ মিলিয়ে যায় নি। দুদিকে বিশাল সবুজ মাঠে আলো নিবে আসাতে সবুজের আস্তরণকে কেমন যেন একট কালচে দেখাচ্ছে। ধান ক্ষেতের ভেতর বা আশেপাশে কোনো কিষাণ বা মানুষজন চোখে পড়ছে না। এখানে পুরো অঞ্চলটাকেই আমার কেমন ভীতসন্ত্রস্ত বলে মনে হল। স্কুটারের শব্দে পথের ওপর থেকে একটা শেয়াল ধান ক্ষেতের আইল ধরে দৌড়ে পালিয়ে গেল। আমি বললাম, চলার সময় বামদিকে শেয়াল দেখলে কী হয়?

যাত্রা শুভ।

বলে মরিয়ম বোরখার ভেতরেই জোরে হেসে ফেলল। মরিয়মের হাসির শব্দে আমি আর আমীনও না হেসে পারলাম না। অনিশ্চিত আশংকার মধ্যে পথ চলতে গেলে মানুষের স্নায়ুর টানটান অবস্থা মানুষকে কতকটা বোকা ও প্রগলভ বানিয়ে ফেলে। আমি আর কথা না বলে চুপ করে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। স্কুটারের হেড লাইট এখনও জ্বালানো হয় নি। অস্পষ্ট আলোয়ই আমীন একমনে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর খোয়া বিছানো অসমান পথে স্কুটার কেবল লাফিয়ে চলতে লাগল। নড়াচড়ায় গাড়ির ভেতরে আমি ও মরিয়ম অস্বস্তিবোধ করছিলাম। আমরা অনবরত পরস্পরের গায়ের ওপর পড়ে যাচ্ছিলাম।

.

রাত আটটার দিকে দর্শনা হল্ট স্টেশনের পেছনে এসে থামলে মরিয়ম বোরখা খুলে হাতের ওপর গুটিয়ে নিয়ে স্কুটার থেকে নামল। আমিও নেমে দাঁড়াতেই আমীন স্কুটারকে একটা গাছের নিচে দাঁড় করিয়ে ফিরে এসে বলল, আসুন আমার পেছনে।

আমরা তার পেছনে পেছনে চললাম। আমীন প্ল্যাটফর্মের দিকে না গিয়ে অন্য একটা ঘুরপথ দিয়ে আমাদের রেল লাইন পার করে একটা ছোটো কোয়ার্টারের সামনে নিয়ে এল। মনে হয় রেলের চতুর্থ শ্রেণীর কোনো কর্মচারীর আবাস। উঠোনে ঢুকে বাড়িতে কোনো লোকজনের সাড়াশব্দ পেলাম না। ঘরের ভেতর থেকে কোনো আলোর আভাসও দেখা যাচ্ছে না।

আমীন উঠোনে আমাদের নিয়ে কতক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে রইল। যেন তার বারান্দায় উঠতে দ্বিধা হচ্ছে। মরিয়ম বলল, আমার ব্যাগে টর্চ আছে, জ্বালব?

আমীন কিছু বলার আগেই মরিয়ম ব্যাগ থেকে টর্চ বের করে আলো ফেলল। ঘরের দরজায় বিশাল একটা তালা ঝুলছে। তালা দেখেই আমীন আতংকিত হয়ে বলল, নিশ্চয়ই কোনো বিপদ ঘটেছে। এখানে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ানো ঠিক হবে না, চলুন।

আমরা উঠোন থেকে বেরুবার মুখেই হন্তদন্ত হয়ে একটি মানুষের ছায়া এসে আমীনের সামনে দাঁড়াল।

আমি রেজা, গুলী করো না।

আমীন ততক্ষণে তার পোশাকের গুপ্তস্থান থেকে পিস্তল বের করে ছায়ার দিকে নল উচিয়ে প্রস্তুত।

রেজা ভাই। কী ব্যাপার?

খুব বিপদ, লোকজন এ কোয়ার্টার থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। রোগী এখন আলিমপুরের আশরাফ হাজির বাড়িতে। লতিফের খিঁচুনি হচ্ছে তাড়াতাড়ি ডাক্তার দরকার। তোমাদের সাথে ডাক্তার কই?

ডাক্তার এখন চুয়াডাঙ্গায় নেই। আমি মরিয়ম রেজা ভাই। বুলেটটা বের করতে পারি কিনা একটু চেষ্টা করে দেখতে দিন।

বলল মরিয়ম।

বেশ, তুমি এক্ষুণি আমীনের সাথে আলিমপুর চলে যাও। সেখানে রোগীর অবস্থাও খুব খারাপ। আর এদিকে হানাদার বাহিনীর একটা গ্রুপ রাজাকারদের সহায়তায় ঘণ্টা খানেক আগে কাস্টম কলোনীতে হামলা চালিয়ে নাসরিনকে ধরে নিয়ে গেছে। পিস্তলটা পেয়েছে। এরা এখন একটা প্রাইমারি স্কুলে আস্তানা গেড়ে আছে। কলোনীতে গেট পাহাদারকে গুলী করে মেরেছে। এরা লতীফদের আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে এসেছে। আমীন আর এক মুহূর্ত দেরি না করে তুমি হাজির বাড়িতে চলে যাও সেখানেই আজ রাতের প্ল্যানটা জানতে পারবে। আমরা রাতেই স্কুলে পাল্টা আক্রমণ করে। মোজাফফর গ্রুপকে খবর দেয়া হয়েছে তারাও এ অপারেশন আমাদের সাথে থাকছে। তাছাড়া ইছামতী পাড়ের বাদুড়িয়া ক্যাম্প থেকে সদ্য পাঠানো মুজিবাদীদের একটা গ্রুপ আমাদের শেল্টারে আছে তারাও আমাদের সাথে এই আক্রমণে রাজি। সব মিলে প্রায় পঞ্চাশ জন। তুমি মরিয়মকে পৌঁছে দিয়ে আমাদের ট্রেনিং ক্যাম্পে ফিরে এস।

বলেই রেজা আমার দিকে ফিরলেন, আপনি আমার সাথে চলুন।

ততক্ষণে মরিয়ম ও আমীন দৌড়ে সামনের দিকে চলতে লাগল। রেজা আমার হাত ধরে টেনে উল্টো দিকে দৌড়ে চলতে ইঙ্গিত করায় আমি তার ছায়ার পেছনে দৌড়াতে লাগলাম।

ঘুটঘুটে অন্ধকারে পথ দেখতে পাচ্ছি না। তবুও আমি প্রাণপণ আলী রেজাকে অনুসরণ করে যাচ্ছি। দশ মিনিট চলার পরই হাঁপাতে লাগলাম। এর মধ্যে অন্ধকার পথে আন্দাজেই আলী রেজা পথ ছেড়ে মাঠের ভেতর নেমে পড়ল।

এখন একটু আস্তে চলতে পারেন। হেঁটে চলুন। আলী রেজাও দৌড় থামিয়ে হেঁটে চলেছেন। আমি এমনিতেই হাঁপিয়ে পড়েছিলাম। এখন আশ্বাস পেয়ে হাঁটতে লাগলাম। মনে হল হাঁটু সমান ধান ক্ষেতের ভেতর দিয়ে চলেছি। ঘাস আর কাদার গন্ধ। মাটি ভেজা বলে জুতো দেবে যাচ্ছে। অন্ধকারে উচ্চিংড়ে আর ফড়িংয়ের লাফালাফি চলছে। কোনো কোনোটা চোখেমুখে এসেও লাগছে। অন্ধকার এমন ভারি যে সামনে আলী রেজার ছায়ামূর্তিটা ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

আপনি মোটামুটি সাহসী লোক কবি সাহেব। আমরা আপনাকে পরীক্ষার জন্য একটা কাজ দিয়ে চুয়াডাঙ্গা পাঠিয়েছিলাম। আপনি সফল হয়েছেন। আপনি এখন থেকে আমার সাথেই থাকবেন। তবে কমপক্ষে সাতদিনের একটা ট্রেনিং সেরে নিতে হবে।

আমার সামনে চলতে চলতে আলী রেজা হঠাৎ নম্র কণ্ঠে কথা বললেন।

আমি বললাম, রেজাভাই, আমি যুদ্ধ করতেই এসেছি। দীর্ঘদিন ট্রেনিং নিতে হলেও আমি তা নেব। আমার কোনো পলিটিক্যাল মোটিভেশন নেই কারণ অতীতে আমি কবিতা লেখা ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সাথেই জড়িত ছিলাম না। আমার এখন একমাত্র ইচ্ছা দেশকে হানাদার মুক্ত করা।

আপনার এ সময়ও কবিতা লিখতে হবে কবি। আপনার কোনো পলিটিক্যাল মোটিভেশনেরও আমি দরকার দেখি না। যেটা দরকার সেটা হল সফিস্টিকেটেড ওয়েপন যা আমরা এই মুহূর্তে ব্যবহার করছি সেসব চালানোর জ্ঞান এবং হাতিয়ার হেফাজতের জরুরি শিক্ষা। এসব বিষয় আমিই আপনাকে শেখাতে পারব। এর জন্য কোনো ট্রেনিং ক্যাম্পে যাওয়ার দরকার নেই। আমি দেশের একজন প্রতিভাবান কবিকে এই যুদ্ধের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ে সাহায্য করতে চাই। এর মধ্যে কোনো কবিতা হয়েছে?

এ পর্যন্ত কবিতা লেখার কোনো পরিবেশ বা অবসর জোটে নি।

আমার কথায় আলী রেজার চলন্ত ছায়াটা একটু দাঁড়াল। আমি তার পাশে যেতেই তিনি পিঠে হাত দিলেন।

এ পরিবেশেই আপনাকে লিখতে হবে। যুদ্ধ কাউকেই অবসর দেয় না কবি।

আমি বললাম, আপনার নির্দেশ আমি পালন করব কমরেড। তবে আজ রাতের অপারেশনে আমাকে আপনার পাশে থাকতে দিন।

এটা আমার পক্ষে খুব দায়িত্বজ্ঞানহীন ডিসিশন হবে।

আমি নাসরিনের এদের হাতে পড়াটা সহ্য করতে পারছি না। এরাতো পশুরও অধম?

নাসরিনের জন্য আমাদের পুরো গ্রুপটাই আজ প্রাণ বাজি রেখেছে। উদ্ধার করা যাবে কিনা জানি না। যদি এর মধ্যে মেয়েটাকে অত্যাচার করে মেরে না ফেলে তবে একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। মেয়েটার বাপ মা বিশ্বাস করে আমার হাতে ওর দেখাশোনার ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত আছে। আমার কথা এটুকুই, এরা নাসরিনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য স্কুলটায় আটকে রেখেছে। এখনও যশোর ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয় নি। সম্ভবত সকালে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার মতলব। আজ রাতেই আমরা নাসরিনকে উদ্ধার করব। জ্যান্ত কিংবা মৃত তা যে অবস্থাতেই হোক।

আমার হাত চেপে ধরে বললেন আলী রেজা।

আমি আবেগের সাথে বললাম, এ অপারেশনে আমি আপনার পাশে থেকে চাক্ষুস সবকিছু দেখতে চাই রেজা ভাই।

আলী রেজা কতক্ষণ নিশ্চুপ ভাবে আমার উষ্ণ, কম্পিত হাতখানি চেপে ধরে রেখে যেন আবেগের শিখায় তার নিজের সিদ্ধান্তকে উত্তপ্ত করে বললেন, আপনি থাকবেন। আমার পাশেই থাকবেন।

আমি খুশিতে চিৎকার করে উঠলাম, জয় বাংলা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *