আমরা একটু হেঁটে এগিয়ে গেলেই দেখতে পেলাম আমাদের পায়ে চলার পথটি একটা ঘন জঙ্গলের ভেতরে সরু হয়ে ঢুকেছে। জঙ্গলের ওপাশে সার বাঁধা একটানা ঝিঁঝির ডাক কানে এল। সম্ভবত বেশ কিছুকাল যাবত এপথে মানুষের চলাচল নেই। বুনো সবুজের এক ধরনের ঝাঁঝালো গন্ধ এসে নাকে লাগল। নন্দিনী এখানে অরণ্যের একটি আড়াল পেয়ে হঠাৎ আমার হাত ছেড়ে দিয়ে ধপ করে পথের ওপরই বসে পড়ল।
আমি আর চলতে পারছি না।
আমি আর সীমা কোনো কথা না বলে, নন্দিনীর গা ছুঁয়ে তার পাশে বসে পড়লাম। সীমা হঠাৎ ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল, ভগবান আমাদের বাঁচাও।
সীমার কান্নায় নন্দিনীও ফুঁপিয়ে উঠল। আমি দুজনের মুখের দিকে আর তাকাতে না পেরে মাটির দিকে চোখ নামিয়ে চুপ করে থাকলাম। এসময় হঠাৎ বেশ দূরে স্টেনগানের গুলীর আওয়াজ থেমে থেমে বেজে উঠল। আমি মুহূর্তের মধ্যেই বুঝে ফেললাম টহল বোট থেকেই গুলী বিনিময় হচ্ছে। আমি আর মুহূর্তমাত্র দেরি না করে নন্দিনীকে ঠেলে তুললাম, জোরে হাঁটো। দেরি করলে বিপদ হবে।
নন্দিনী আর সীমা উঠেই প্রাণপণ দৌড়াতে লাগল। আমিও এদের পেছন পেছন দৌড় দিলাম। নন্দিনী ও সীমা হাত ধরাধরি করে দৌড়ে যাচ্ছে। আমি আর একটু এগিয়ে গিয়ে নন্দিনীর বাঁ হাতটা ধরলাম। নন্দিনী আমার স্পর্শ পেয়েই হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর আমার গলায় দুহাত জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে ফেলল, আমাকে বাঁচান। আমাকে এরা মেরে ফেলবে।
আমি তাড়াতাড়ি আমার গলা থেকে তার হাত দুটি সরিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বললাম, নন্দিনী শেষ মুহূর্তে মনে সাহস রাখো। নইলে আমরা সবাই ধরা পড়বো। সবাইকে মরতে হবে।
আমার কথা শেষ হবার আগেই সীমা আর্ত চিৎকার করে উপুড় হয়ে রাস্তায় পড়ে গেল। মেশিনগানের শব্দটা খুব দূর থেকে ভেসে আসছে বুঝতে পারলেও আমি নন্দিনীকে এক ধাক্কায় রাস্তার উপর শুইয়ে দিয়ে আর পাশে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম। সীমার হাঁটুটা জবাই করা গাভীর মতো নড়তে লাগল। আমি এক পলক তার দেহের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম সারা শরীর তাজা রক্তে ভেসে গিয়ে এক ধরনের খিচুনীতে কেঁপে কেঁপে উঠছে। গুলী তার কানের একটু ওপরে লেগে বিরাট গর্তের সৃষ্টি করেছে। আমি মুহূর্তেই বুঝতে পারলাম সীমার আর আশা নেই। নন্দিনীও একবার মুখ তুলে সীমার অবস্থাটা দেখে চকিতে বোনের দেহের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। আমি আরো কতক্ষণ চুপচাপ রাস্তার ওপর শুয়ে থেকে কর্তব্য স্থির করলাম। এতক্ষণে সীমার প্রাণপন্দনও স্তব্ধ হয়ে এল। এখন তার শরীরের কোনো অংশই কাঁপছে না। সম্ভবত সীমাদি আর বেঁচে নেই। মেশিনগানের গুলীটা যে আকস্মিকভাবে এবং অতিশয় দুর্ভাগ্যক্রমে তার গায়ে লেগেছে এটা বুঝতে পেরে আমি অত্যন্ত মুষড়ে পড়লাম। আর নিজের বেঁচে থাকতে পারাটাকে মনে মনে ধিক্কার দিয়ে রাস্তার ওপর উঠে দাঁড়ালাম। এখন গুলীর শব্দ আর আসছে না। আমি এগিয়ে গিয়ে নন্দিনীকে সীমার দেহের ওপর থেকে সরিয়ে আনার জন্য হাত বাড়ালাম। নন্দিনী দিদিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে মূৰ্ছা গেছে। তাকে টেনে তুলতে গিয়ে রক্তে ভেজা সীমার কপালে হাত দিলাম। কপালটা এখনও উষ্ণ। নন্দিনীকে টেনে একপাশে সরিয়ে দিয়ে সীমার মুষ্টিবদ্ধ ডানহাতটি হাতে নিয়েই বুঝলাম সীমাদি মারা গেছেন। আমি আর মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে নন্দিনীকে রাস্তার পাশে ঝোপের ভেতর টেনে আনলাম। আমার টানাটানিতে নন্দিনী হঠাৎ ভয়ার্ত চোখদুটি মেলে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকাল। আমি ডাকলাম, নন্দিনী?
নন্দিনী কোনো জবাব দিল না।
নন্দিনী, একটু কষ্ট করে উঠে দাঁড়াও। সামান্য কয়েক গজ পথ পেরিয়ে গেলেই আমরা নিরাপদ হব। নিজের প্রতি একটু ভরসা রেখে উঠে দাঁড়াও নন্দিনী। মনে হচ্ছে শত্রুরা আনিসের দলটাকে শেষ করে দিয়ে এদিকে এগিয়ে আছে। একটু উঠে বস নন্দিনী।
আমার কথায় এক ঝটকায় নন্দিনী উঠে বলল, দিদি?
দিদি আর পৃথিবীতে নেই নন্দিনী।
আমার কথায় হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে নন্দিনী সীমাদির মৃতদেহের দিকে তাকাল।
আমিও আর কোথাও যাব না হাদীদা। ওরা আমাকেও মেরে ফেলুক। আপনি চলে যান। আমার জন্য আর বিপদে পড়বেন না। বলেই নন্দিনী রাস্তার ওপর পড়ে থাকা সীমার দেহটা জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
আমি জানতাম এখন আর এভাবে বসে থাকার উপায় নেই। আমি নন্দিনীর পাশে এসে বসলাম। আমার পেছনে ঝোপের ভেতর থেকে আগের মতোই ঝিঁঝির একটানা শব্দ উঠছে। একটু আগে গুলীর শব্দে ঝোপের ভেতর থেকে এক ধরনের পাখি ঝাঁক বেঁধে উড়ে গিয়েছিল। এখন পাখিগুলোর মাঝ থেকে একটা দুটা দলছাড়া হয়ে আবার ফিরে এসে দারুণ চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে। গাছের ফাঁক-ফোকর থেকে দুপুরের রোদের টুকরো সীমার স্তব্ধ দেহে ও আমাদের মুখে এসে পড়ল। আমি আবার নন্দিনীকে বোঝাতে চাইলাম, নন্দিনী আমার কথাটা শোনো।
নন্দিনী কান্না থামিয়ে আমার দিকে না ফিরেই চুপ করে থাকল। আমি বললাম, নন্দিনী, আমি কী এখানে তোমাকে এভাবে ফেলে কোথাও যেতে পারি? তোমাকে নিয়েই আমাকে এখান থেকে এগোতে হবে।
আমি যাব না।
বুঝতে চেষ্টা করো নন্দিনী। অবুঝ হয়ো না। আমরা এখন একটা সাংঘাতিক যুদ্ধের মধ্যে আছি। এ যুদ্ধে এখন আমরা মার খেলেও একদিন আমরা জিতবোই। বলল, তখন আজকের এই ঘটনার আমি কী কৈফিয়ৎ দেব? আমরা নিজের বিবেকের কাছেই বা আমার জবাবটা কী হবে?
আমি নন্দিনীর পিঠের ওপর গভীর স্নেহে হাত বুলিয়ে দিলাম। নন্দিনী উঠে বসেই প্রশ্ন করল, আমরা কী দিদিকে এভাবে এখানে ফেলেই চলে যাব?
এছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই নন্দিনী। আর আমরা যাকে এতক্ষণ দিদি বলেছি, এখন তিনি আর আমাদের সাথে নেই নন্দিনী। তিনি এখন এই জগতের সকল হিংস্রতার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
আমি নন্দিনীর রক্তে ভেজা চটচটে হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে টেনে আনলাম।
আমার দিদি কোনো সৎকারই পাবে না? আমি একথার কোনো জবাব না দিয়ে নন্দিনীকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করতে লাগলাম। এখন সে একটু কাৎ হয়ে নিজের ভর আমার হাতের উপর রেখে উঠে দাঁড়াল। আমি বললাম, আমরা আমাদের দেশের জন্য আত্মোৎসর্গীকৃত বোনের কোনো সৎকার না করেই চলে যাচ্ছি। আল্লাহ নিশ্চয়ই সীমাদিকে অপমানের হাত থেকে বাঁচাবেন।
হঠাৎ সে আমার গলা থেকে হাত নামিয়ে বলল, চলুন।
আমি কথা না বলে নন্দিনীর পেছনে হাঁটা শুরু করলাম। নন্দিনী মুহূর্তের জন্য একবার মাত্র বোনের উপুড় হয়ে থাকা দেহটার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল। শাড়ির খুঁট দিয়ে চোখ চেপে ধরে আবার মুহূর্তের জন্যে দাঁড়াল। কিন্তু এবার আমি তাকে দাঁড়াতে না দিয়ে এক রকম ঠেলা মেরেই বললাম, আর কোনো কথা না নন্দিনী ঐ সামনের উঁচু টিলাটিই আগরতলার সীমানা। ওখানে না পৌঁছে আমরা আর বিশ্রাম বা ফিরে তাকাব না। মনে রেখ এটুকু পথ সাবধানে পার হতে না পারার জন্যই সীমাদিকে আমরা হারালাম।
নন্দিনী কোনো কথা না বলে তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আমার সাথে পা চালিয়ে চলতে লাগল। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা পাহাড়টার নিচে চলে এলাম। দিন দুপুরেও জায়গাটা আশ্চর্য রকম নিস্তব্ধ। তবে পাহাড়টার গা বেয়ে একটা পায়ে চলার পথ সোজা ওপরের দিকে উঠে গেছে। মুস্কিল হল পথটা লালমাটির ভেজা কাদায় পিচ্ছিল। আমি কোনো মতে পা টিপে উঠতে পারলেও নন্দিনীর পক্ষে তা একেবারেই অসম্ভব মনে হল। রাস্তাটির মুখে এসে আমি নন্দিনীর দিকে তাকালাম। কিন্তু নন্দিনী আমার সন্দেহকে ভ্রূক্ষেপ না করে সোজা পাহাড়ের পথটা বেয়ে খানিকদূর উঠে গেল। খানিক উঠেই পিচ্ছিল লাল কাদায় পা স্থির রাখতে না পেরে সামনের দিকে ঝুঁকে হাত দিয়ে মাটি আঁকড়ে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। আমি বুঝলাম নন্দিনীর মনের জোর বেড়ে গেছে। দেরি না করে আমিও তার পাশে উঠে এলাম।
একটু পরেই আমরা টিলাটার চূড়ায় উঠে এলাম। নন্দিনী কোনোমতে পাহাড়ের চূড়ার সমতলে পৌঁছেই ঘাসের ওপর চিৎ হয়ে চোখ বুজে পড়ে থাকল। আমি এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসলাম। নন্দিনী তার পাশে বসামাত্রই চোখ মেলে একবার আমাকে দেখল, এটা কী ভারতের মাটি?
আমি বললাম, সম্ভবত এ পাহাড়টা ভারতীয় এলাকায়, পাহাড়টার ওপাশে একটা বস্তির মতো দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে ওটাই বামুটিয়া বাজার। আমরা আগরতলায় এসে গেছি নন্দিনী। আর কোনো ভয় নেই।
আমার আশ্বাসে নন্দিনী মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে শিশুর মতো উচ্চস্বরে বিলাপ করতে লাগল। মেয়েরা যেমন মৃত প্রিয়জনের দেহের পাশে লুটিয়ে কাঁদে নন্দিনীর কান্নাটাও সে রকম। সীমাদির দুর্ভাগ্যের বর্ণনা দিয়ে, তার নাম ধরে নন্দিনী বিলাপ করছে। এ ধরনের কান্নার সাথে আমার পরিচয় আছে। আমি নন্দিনীকে থামতে না বলে চুপচাপ বসে রইলাম। আর বিপরীত দিকে তাকিয়ে দেখলাম, যে বস্তি মতন ঘরবাড়িগুলোকে আমি বামুটিয়া বলে ভাবছি সেখানে প্রকৃতপক্ষে কোনো মানুষজন আছে কিনা। একবার মনে হল বস্তির ঘরবাড়িগুলো থেকে যেন আবছা মতন ধোঁয়ার কুণ্ডলী বেরিয়ে আসছে। আবার মনে হল, না, ধোঁয়া দেখাটা আমার চোখের ভুল। মানুষজন থাকলে কাউকে না কাউকে চলাফেলা করতে দেখতাম।
বেশ কিছুক্ষণ আমরা টিলাটার ওপর বসে থাকলাম। এখন অবশ্য নন্দিনীর কান্না থেমেছে। তবে উদাস দৃষ্টিতে উদ্দেশ্যহীন দিগন্তের দিকে সে কী যেন দেখছে। হঠাৎ আমার মনে হল আমরা উভয়েই অত্যন্ত ক্ষুধার্ত। গত দুদিন ধরে আমরা কিছু খাই নি। ঘটনার উত্তেজনায় আমরা যে আমাদের ক্ষুধাপিপাসাও ভুলে গেছি এটা টের পাওয়া মাত্র আমার পেট মোচড় দিতে লাগল। আমি নন্দিনীকে এক রকম জোর করেই ঠেলে দিয়ে বললাম, ওঠো নন্দিনী, চলো নিচের দিকে যাই। আমার খুব ভুখ লেগেছে।
নন্দিনী নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো। আমরা নিচের দিকে নামতে লাগলাম।
.
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা বস্তিটার কাছে চলে এলাম। দূর থেকে জায়গাটাকে আমি বামুটিয়া বাজার বলে ভেবেছিলাম। কিন্তু কাছে এসে মনে হল এটা একটা ফাঁড়ি। দূর থেকে মানুষজন আছে কিনা বোঝা না গেলেও এখানে এগিয়ে বুঝলাম আমাদের লক্ষ্য করে পাহাড়ের ফাঁকে গাছের আড়ালে রাইফেল উঁচানো পাহারাদার রয়েছে। আমরা বস্তিটার সামনে এসে দাঁড়ানো মাত্র কোত্থেকে যেন কয়েকজন সেন্ট্রি এসে আমাদের ঘিরে ফেলল। সবার হাতেই স্টেনগান। সেন্ট্রিদের চেহারা দেখে বুঝলাম এরা স্থানীয় ত্রিপুরা উপজাতির যুবক। এরা কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই আমি বললাম, আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। আমরা সামান্য খাবার ও বিশ্রাম চাই।
একজন সেপাই নন্দিনীর কাদামাখা ক্লান্ত দেহের দিতে তাকিয়ে বলল, মনে হয় এই মহিলার ওপর জুলুম হয়েছে?
আমরা একথার কোনো জবাব দিলাম না। নন্দিনী মাটির দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকলেও একটা হাত বাড়িয়ে আমার কাঁধ চেপে ধরল।
অন্য একজন টিপরা সেপাই বলল, আপনারা এখন কোথায় যেতে চান?
আমি বললাম, বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের যে কোনো কর্মকর্তার কাছে আমাদের পৌঁছে দিন।
তারা এখান থেকে মাইল পাঁচে দূরে আগরতলায় আছে।
আমি বললাম, সেখানেই যাব। তার আগে আমাদের চারটে খেতে দিন।
আমার কথায় এমন একটা অনুনয়ের সুর ফুটে উঠল যে সেপাই চারজনই পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াল। এদের মধ্যে একজন বলল, চলুন আমার সাথে ক্যাম্পে। সেখানে আপনাদের নাম ঠিকানা লিখে দিতে হবে। সেখানেই চারটে খেয়ে নেবেন। আগরতলায় আপনাদের কোন পরিচিত লোক আছে?
আমি বললাম, আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিসি যিনি এখানকার জয় বাংলার সেক্রেটারি তিনি আমার ভগ্নিপতি। নাম হোসেন তৌফিক ইমাম। আমরা সেখানেই যাব।
আমার কথায় সেপাই চারজনই সম্ভবত বুঝতে পারল আমরা দুজন গুরুত্বহীন রিফিউজি নই। এদের নেতা যার সাথে এতক্ষণ কথা হচ্ছিল সে বলল, নাম এন্ট্রি করে আমরা জিপে আপনাদের সেখানে পাঠিয়ে দেব। একটু পরেই আমাদের ক্যাম্পের জিপ আগরতলা যাবে। চলুন।
আমরা সেন্ট্রিদের পেছনে চলতে লাগলাম।
একটু পরেই আমরা ক্যাম্পের প্রবেশ পথে এসে পৌঁছলাম। গেটের পাশে একটা সাদা রং-করা বাঁশের মাথায় ভারতীয় পতাকা উড়ছে। নিশানটা দেখেই কেন জানি না আমার দেহ মন এক সাথে চমকে উঠল। আমি ছবিতেই ইতিপূর্বে অশোকচক্র আঁকা এই তিনরঙা পতাকা দেখেছি। কিংবা হয়তো ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসের সামনে দিয়ে যেতে এক আধবার এই হিন্দুস্তানী নিশান দেখে থাকবো। এখন ভারতের মাটিতে হঠাৎ এই পতাকা উড়তে দেখে অজানা আশংকা বা অনভ্যাসের কারণে বুকটা দুলে উঠল। আমি নন্দিনীর কানের কাছে মুখটা নিয়ে বললাম, নন্দিনী, এরা নাম এন্ট্রির সময় আমাদের পরস্পরের সম্পর্কের কথা জিজ্ঞেস করলে কী বলবো?
যা বলতে হয় আমি বলবো।
বুঝলাম সীমান্ত অতিক্রমের ফলে নন্দিনীর মধ্যে নিরাপত্তা ও আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে। নন্দিনীর দৃঢ়তায় আমার খুব ভালো লাগল। আমি হেঁটে যেতে যেতেই তার হাতটা নিজের হাতে তুলে নিলাম। সে একবার মাত্র পলকের জন্য আমার মুখের দিকে চোখ তুলে আবার দৃষ্টি নামিয়ে ক্যাম্পের বারান্দায় এসে উঠল। এটা ভারতীয় সীমান্ত প্রহরীদের একটা ছোটো ফাঁড়ি। সর্বমোট চারটে দরজার ঘর। সবগুলো ঘরের বারান্দাই সিমেন্টে বাঁধানো। সেপাইরা যে যার ডিউটিতে ব্যস্ত। কেউ আমাদের আগমনকে তেমন পাত্তাই দিল না। মনে হয় আমাদের মতো আগন্তুক এ ক্যাম্পে প্রায় প্রত্যহই আসা-যাওয়া করে। পাহারাদার সেন্ট্রিদের নেতা, যার হুকুমে আমরা এসে ঢুকেছি সেই লোকটি একটা লম্বা টুল দেখিয়ে আমাকে ও নন্দিনীকে বসতে ইঙ্গিত করল। আমরা বসলাম। লোকটি সম্ভবত সঙ্গের সেপাইদের আমাদের জন্য কিছু খাবারের আয়োজন করতে বলল। সেপাই তিনজনই আমাদের বারান্দায় রেখে সামনের একটি ঘরে গিয়ে ঢুকল। আর এদের নেতা আমার দিকে ফিরে বললেন, সামনে একটা কুয়ো আছে। ইচ্ছে করলে হাত পা ধুয়ে নিতে পারেন। আপনারা তো কাদায় মাখামাখি হয়ে আছেন!
আমি ও নন্দিনী কুয়োর পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। এখানে দুটো বালতিতে পানি তোলাই আছে দেখে আমি একটা মগ এনে নিজেই নন্দিনীর হাত ও পায়ের আঠালো লাল মাটির শুকনো কাদা ভিজিয়ে দিতে লাগলাম। উভয়ে হাতমুখ ধুয়ে এসে দেখি সেপাইরা লম্বা টুলের ওপর আমাদের জন্য গরম মোটা রুটি ও কিছু তরকারি রেখে গেছে। টুলের পাশে একজন সেপাই দাঁড়ানো। আমাদের দেখেই বলল, খা’লো।
আমরা বিনা বাক্য ব্যয়ে তার আদেশ পালনে হাত বাড়িয়ে দিলাম। আমার কাছে রুটি ও তরকারি অমৃতের মতো মজাদার মনে হল। নন্দিনীও খাচ্ছে, তবে আমার মতো গোগ্রাসে নয়। আমি দ্রুত আমার থালায় রাখা তিনটি পুরো গমের রুটি তরকারিসহ একরকম গিলে খেয়ে ফেললাম। সেপাইরা গ্লাসের বদলে দুটি আলাদা ঘটিতে পানি দিয়েছে। আমি ঢকঢক কর একঘাটি পানিও খেলাম। মনে হল বহুকাল বুঝি এমন সুস্বাদ খাদ্য ও পানীয় আমার ভাগ্যে জোটে নি।
খাওয়া হয়ে গেলে সেপাইরা আমাদের দুজনকেই তাদের সুবেদারের ঘরে নিয়ে গেল। ভদ্রলোক বাঙালি। ঢোকা মাত্রই বললেন, বসুন। আপনারা ঢাকা থেকে এসেছেন?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
এখানে আপনাদের আশ্রয় দিতে পারে এমন কোনো পরিচিত কেউ কিংবা আত্মীয়-স্বজন আছে?
আছে। বললাম আমি।
তাদের নাম ঠিকানা জানা থাকলে বলুন।
নাম হোসেন তৌফিক ইমাম। ঠিকানা খুঁজে নিতে হবে। আমার ঠিক জানা নেই।
তিনি কী আপনার বন্ধু?
আমার বোন জামাই।
তিনিও ঢাকা থেকে এসেছেন?
না, তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক। সম্ভবত সেখান থেকেই পালিয়ে এসেছেন।
আমার জবাব শুনে সুবেদার ভদ্রলোক তার নাম লেখার রেজিস্ট্রি থেকে মুখ তুলে একবার আমার দিকে তাকালেন।
এবার বলুন আপনার নাম ও পেশা?
সৈয়দ হাদী মীর। লাইব্রেরিয়ান।
সরকারি কর্মচারী?
হ্যাঁ।
বয়েস কত?
বত্রিশ।
আপনারা উভয়ে কী স্বামী স্ত্রী?
আমি জবাব দেবার আগেই নন্দিনী বলল, হ্যাঁ।
ভদ্রলোক আবার মুখ তুলে আমার ও নন্দিনীর দিকে তাকালেন। সরাসরি নন্দিনীকেই প্রশ্ন করলেন, আপনার নাম বলুন?
নন্দিনী একটুও দ্বিধা না করে জবাব দিল, নন্দিনী ভট্টাচার্য।
আপনাদের কী কোর্ট মেরেজ?
না, কোর্ট মেরেজ হবে কেন আমাদের আনুষ্ঠানিক সামাজিক বিয়ে হয়েছে।
আপনি ধর্মান্তর গ্রহণ করে বিয়ে করেছেন?
আমার কোনো ধর্ম ছিল না বলে ধর্মান্তরের প্রয়োজন ছিল না।
নন্দিনী নির্দ্বিধায় মিথ্যে কথা বলে যাচ্ছে। ভদ্রলোক হেসে বললেন, আমার কৌতূহল দেখে রাগ করবেন না। আজকাল ভারতে অহরহই অসবর্ণ বিয়ে হচ্ছে। পাকিস্তানেও যে জাতপাতের বালাই ছিল না এটা জানতাম না। আমিও ব্রাহ্মণ। বলতে দ্বিধা নেই একজন ব্রাহ্মণ কন্যা মুসলমানকে বিয়ে করেছে শুনলে মুখে থু থু দিতে ইচ্ছে করে।
ভদ্রলোকের তীক্ষ্ণ শ্লেষটা আমার গায়ে তীরের মতো বিদ্ধ হল। আমি রেগে গিয়ে কী যেন একটা জবাব দিতে চাইলাম। কিন্তু নন্দিনী আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তুমি চুপ করো।
এ আকস্মিক অযাচিত কথোপকথনের মুহূর্তেও নন্দিনী তার দেমাগ হারায় নি। সে আমাকে তুমি সম্বোধন করে সুবেদারকে নিশ্চিত করল আমরা স্বামী-স্ত্রী। তারপর সুবেদারের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার থুথু দেয়ার ইচ্ছেটা একটু বেশি প্রবল মনে হচ্ছে। অব্রাহ্মণ পুরুষ গ্রহণকারী ব্রাহ্মণ কন্যার সংখ্যা এই মহাভারতে এত অধিক যে সবার মুখে থুথু দিতে গেলে আপনার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে। কতজনকে থুথু দেবেন? আমার দেশে আপনার মতো একজন ধর্ম মর্যাদাবোধ সম্পন্ন ব্রাহ্মণ সন্তান পেলে আমি তার গলায়ই মালা দিতাম। পাইনি বলেই এই ম্লেচ্ছের গলায় মালা দিয়েছি। এখন আমার মুখে থুথু না দিয়ে দয়া করে আমরা যেখানে যাবো সেখানে পাঠিয়ে দিন।
নন্দিনী তার কথাগুলো এমন গুছিয়ে বলল যে আমিও চমকে তার দিকে তাকালাম। উদাসীন তীক্ষ্ণ গ্রীবাভঙ্গি উন্নত করে সে সুবেদারের দিকে তাকিয়ে আছে। সুবেদার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, শহরে পৌঁছার ব্যাপারে আমি কোনো সাহায্য করতে পারব না। আগরতলা এখান থেকে পাঁচ মাইলের পথ। হেঁটে এসেছেন, হেঁটে চলে যান।
আমি ও নন্দিনী কথা না বাড়িয়ে সুবেদারের ঘর থেকে সোজা রাস্তায় এসে উঠলাম। আমি জানি নন্দিনীর হাঁটার ক্ষমতা নেই। রাস্তাটাও জনশূন্য। কিন্তু নন্দিনী কী একটা সাহসের বলে যেন আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, হেঁটেই যাব। তোমার হাঁটতে অসুবিধা না হলে আর দাঁড়িয়ে থেকো না।
আমি নন্দিনীর পেছনে হাঁটা শুরু করেই বললাম, নন্দিনী তুমি আমাকে এখনও তুমি বলছ।
ভালো না লাগলে আপনি বলব।
না না আমি সে কথা বলছি না নন্দিনী। বরং এ ডাকটা আমার খুব আন্তরিক বলেই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে হঠাৎ বিপদগ্রস্ত হয়ে ডাকা না। এ ডাকা আমার প্রাপ্য বলেই তুমি ডাকছ। লোক চক্ষুকে ফাঁকি দেয়ার জন্যেও নয়। পরিণাম কী হবে তা আমি জানি না। তবে আমি তোমাকে ছাড়তে পারব না।
তুমি তোমার স্ত্রীর কথা ভেবে ভয় পাচ্ছো।
আমি বুঝলাম নন্দিনী আমার মানসিক অবস্থাটা ঠিকমতো উপলব্ধি করেই কথা বলছে। আমার পক্ষ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে নন্দিনী আবার বলল, তোমার স্ত্রীর সাথে দেখা হলে আমি আবার তোমাকে আপনি বলে ডাকব। যতক্ষণ তার সাথে তোমার সাক্ষাৎ না হবে ততক্ষণ আমি তোমার স্ত্রী। আমার সাথে স্ত্রীর মতোই আচরণ করবে। আমিও স্ত্রীর কাছে প্রাপ্য সবকিছুই তোমাকে দেব। কেন দেব না? আমার আর কী আছে? সতীত্ব কুমারীত্ব কিছুই তো আমার রইল না। এই যুদ্ধে সব লুট হয়ে গেছে। তোমার সামনেই সব ঘটেছে। আমরা কেউ আমাদের ক্ষতির জন্যে দায়ী নই। এই কথা তো তুমিই সীমাদিকে বলেছিলে। আমি আর আমার পরিণাম নিয়ে চিন্তা করব না। ঈশ্বর যদি মঙ্গলময় হয়ে থাকেন তবে তিনি আমার জন্য মঙ্গলই রাখবেন।
আমি বললাম, নন্দিনী, আমি অত কথা ভাবতে পারছি না। আমার ভয় লাগছে, একথাটাই শুধু বলছিলাম।
আসলে তুমি তোমার বৌয়ের সাথে সাক্ষাতের ভয়ে অস্থির হয়ে পড়েছ। ভাবছো দৈবাৎ যদি তোমার বোনের বাসায় গিয়ে দেখতে পাও তোমার স্ত্রীও সেখানে আছে? তবে আমার কী গতি হবে? আমার সম্বন্ধে কী বলবেন। ভয় নেই যা বলতে হয় আমিই বলব। তোমার বৌ সেখানে থাকলে আমিই তাকে বুঝিয়ে বলব তুমি কিভাবে আমাকে বাঁচিয়ে এতদূর নিয়ে এসেছ। তারপর আমি আমার পথ দেখব। কত মেয়ে নিঃসঙ্গ অবস্থায় দেশ ছেড়ে এদিকে আসে নি? তারা তো আর জলে পড়ে যায় নি। তাদের মতো আমিও ঠিকই নিজের অবস্থা করে ফেলব। আমি ভাবছি তোমার বোন ভগ্নিপতি আত্মীয়দের মধ্যে গিয়ে এই মুহূর্তে কী বলব? তুমি বা কী বলবে? যদি তোমার স্ত্রীর অবর্তমানে আমরা একই সাথে থাকতে চাই। বলো তুমি চাও না?
চাই নন্দিনী। সমস্ত অন্তর থেকে চাই। তোমাকে ছেড়ে এক মুহূর্তও থাকতে চাই না।
তাহলে তোমার স্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের স্বাভাবিকতাও আমাদের মনে রেখেই এগোতে হবে। অর্থাৎ তোমাকে তোমার প্রিয়জনের কাছে ছেড়ে যাওয়ার বিচ্ছেদ। আমার সম্বন্ধে তখন আর একটুও না ভাবা। রাজি?
পথের ওপর থমকে দাঁড়িয়ে নন্দিনী আমার জবাব চাইল। পথে কোনো লোকজন বা যানবাহন নেই। প্রশস্ত পাহাড়ি পথ। চাকার ক্ষতে ভর্তি। দুদিকে ছোটো লাল মাটির পাহাড়ের সারি। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে তরুণ কাঁঠালের অসংখ্য চারা। বৃষ্টির পানিতে পথ ও চাকার গর্তে পানি জমে আছে। পথও তেমন পিছল নয়। কোনোকালে সম্ভবত পথের ওপর কাঁকর বিছানো ছিল। এখন তা মাটির সাথে মেশামেশি হয়ে যাওয়ায় কাদামাটিতে পা পিছলে যাওয়ার সম্ভাবনাকে রহিত করেছে। পথের একপাশে একটা মাইল পোস্টে লেখা, আগরতলা-৭ কিঃ মিঃ।
আমি কোনো জবাব না দিয়ে নন্দিনীর ডান হাতটা নিজের মুঠোর মধ্যে তুলে নিলাম। নন্দিনী আমার মুখের দিকে কতক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি তোমার অবস্থাটা বুঝতে পারছি। একজন কবির জন্য এর চেয়ে বিব্রতকর অবস্থা আর কী হতে পারে? তবে আমিও মিথ্যে বলার বা কোনো কিছু গোপন রাখার পক্ষপাতি নই। আমি তোমাকে ভালবাসি। তোমার স্ত্রী অনুপস্থিত জেনেই আমার মন লুব্ধ হয়ে উঠেছে। এ অন্যায়, এ পাপ জেনেও আমার মন বশ মানছে না। কেন মানছে না আমি জানি না। তাছাড়া গত কয়দিন আমার ওপর যা ঘটেছে তাতে তো আমার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আমার পক্ষে আগের নন্দিনী হয়ে যাওয়াও অসম্ভব। আমার অসহায়তার সাক্ষী তুমি। তুমি আমার অবলম্বন, তুমি কবি। তখন ইচ্ছে করলে তুমি আমাকে পথে ফেলে দিয়ে পালিয়ে আসতে পারতে। তা তুমি পার নি। আমি নারী বলেই পালিয়ে আসতে পার নি এটা আমি বিশ্বাস করতে পারব না। বরং একজন বিপদগ্রস্ত, অসহায় যুবতীকে পশুর হাতে ছেড়ে যাওয়া তোমার পক্ষে সম্ভব হয় নি বলেই নিজের জীবনরক্ষার স্বার্থপরতা তোমাতে ছিল না। আমার জীবনে অতীতে কোনো প্রেমের অভিজ্ঞতা না থাকলেও, আমি বলতে পারি এমন পুরুষকেই মেয়েরা বিশেষ করে কুমারী মেয়েরা প্রেমের জন্য বিনাশর্তে নির্বাচন করে। এমন কী পুরুষটি অন্যের স্বামী হলেও।
আমাকে কী তুমি বিনাশর্তে নির্বাচন করেছ নন্দিনী?
আমার মুঠোয় ধরে থাকা নন্দিনীর হাতটায় চাপ দিয়ে বেশ আবেগকম্পিত গলায় আমি নন্দিনীর স্বীকৃতি পেতে চাইলাম।
বিনাশর্তে অবশ্যি নয়। তোমার স্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ না হওয়া পর্যন্ত।
আমার স্ত্রীর সাথে দেখা হলে তুমি কী করবে নন্দিনী?
তার আগে বল তুমি কী করবে?
এই প্রথম আমি নন্দিনীর হাসি দেখলাম।
যেন কিছুই ঘটে নি নন্দিনীর হাসির মধ্যে তেমনি একটা ঠোঁটচাপা প্রশ্নবোধক কৌতূহলী হাসির ছটা।
গত তিনদিন তিনরাতের সমস্ত ঘটনা, মৃত্যু, উদ্বেগ ও পলায়নের দৃশ্যগুলো আমার চোখে মুহূর্তের মধ্যে ভাসতে লাগল। এর মধ্যে গভীর দুর্ভাবনার রেখা ছাড়া আমি নন্দিনীর চেহারায় অন্য কোনো আশার চিহ্ন দেখি নি। বর্ডারটা পার হওয়ার পরই নন্দিনী যেন একটা কিশোরীর মতো পাল্টে গেছে। তার দেহমনে একটা নির্ভাবনা খেলা করছে। অথচ বর্ডার পার হয়ে আমি মৃত্যুর ভয় থেকে মুক্ত হয়েও কেন জানি ভয়শূন্য কিংবা সন্দেহমুক্ত হতে পারছি না। আমি বললাম, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আমি কী করব।
আমি জানি তুমি কী করবে। নিরপরাধ নির্দোষ মহিলাটির সামনে গেলেই আমার যুক্তিহীন প্রেমের অসারতা তুমি টের পাবে। বেশি ভালো মানুষী করে আমার অসহায়তার কথা বলে তোমার স্ত্রীকে বুঝিয়ে আমাকেও তোমাদের আশ্রয়ে রাখতে চাইবে। তোমার স্ত্রী ও বোন এগিয়ে এসে বলবে, এই বিপদে আপনি কোথায় যাবেন? আমাদের সাথেই থাকুন। একজন বাড়তি মানুষে আমাদের কী অসুবিধা হবে। বরং আপনি থাকলে এদেশে আমাদের উপকারই হবে। এখানকার সামাজিক রীতিনীতিতে আমরা কিছুই জানি না। আপনি আমাদের শিখিয়ে দেবেন যাতে আমরা এদেশের সমাজে মিশতে পারি। আমি শেষ পর্যন্ত থেকে গেলে তুমি হয় তোমার স্ত্রীর ন্যায়সঙ্গত ভালবাসায় তৃপ্ত হয়ে আমাকে একটা আপদ ভাবতে শুরু করবে কিংবা আমার প্রতি অবৈধ প্রেমের আকর্ষণে স্ত্রীকে অবজ্ঞা করতে গিয়ে সংসারটাই ভেঙে ফেলবে। আমিও তোমার প্রতি অন্যায় ভালবাসা ত্যাগ করতে পারব না। এই ঘটবে।
নন্দিনীর কথাগুলো ভারী পাথরের টুকরোর মত, যেন আমার বুকের ওপর ঝরে পড়ল। আমি নন্দিনীর হাত ছেড়ে দিয়ে পথের দুই দিকে নিরুপায়ের মতো একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিলাম। না, আমাদের আশেপাশে দৃশ্য-অদৃশ্য সাহায্যকারী কেউ নেই। শুধু ছোটো পাহাড়গুলোর ওপর থেকে একটা হালকা বৃষ্টির ঝাপটা এসে আমাদের এক পশলা পানিতে ভিজিয়ে দিতে লাগল।
আমি ভাবলাম, নন্দিনী তুমি এতকথাও জানো? আমি কিন্তু তোমাকে একজন কিশোরী বলেই অনুমান করেছিলাম। এখন দেখছি, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনার অসাধারণ অন্তরদৃষ্টি আছে তোমার। তুমি একজন বয়স্কা মহিলার মতো কথাবার্তা বলছ। এত ভবিষ্যৎ জ্ঞান কোথায় পেলে? আমার স্ত্রীকে আগরতলা গেলেই পাবো এমন তো নাও হতে পারে। আমি একটি মাত্র অপরিচিত ছেলের মুখে শুনেছি সে বর্ডার পার হয়ে এসেছে। এটাতো সত্য নাও হতে পারে। সে হয়তো আমাদের দেশের ভিতরেই কোথাও আশ্রয় নিয়েছে। আগের থেকেই দুর্ভাবনায় থাকা কী উচিত হচ্ছে।
এর মানে হল আমার জন্য তুমি তোমার স্ত্রীর সামনাসামনি হওয়ার চিন্তাটাকেও ভয় পাচ্ছো।
আমি তোমাকে ভালবাসি নন্দিনী।
তাহলে মানো যে আমাদের ভালবাসার আসলে কোনো যুক্তি নেই। আমরা নিজেদের এই মুহূর্তের প্রয়োজনে একটা অসঙ্গত বিষয়কে মেনে নিচ্ছি মাত্র। এই মেনে নেয়া তোমার স্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের শর্তে শর্তাধীন। তিনি এলে আমাকে আমার অদৃষ্টের ওপর ছেড়ে দিতে ইতস্তত করবে না এবং মহিলাকে আমার বিষয়ে কোনোদিন কিছু বলবে না।
আমি এ ব্যাপারে তোমাকে কোনো কথা দিতে পারবো না নন্দিনী। আমি অদৃষ্টবাদী, ভাগ্যের ওপর ভরসা রেখে বসে থাকব।
আমার কথার কোনো জবাব দেবার আগেই লাল পাহাড়গুলোর ওপর থেকে বৃষ্টির আরেক পশলা ঝাপটা এসে আমাকে ও নন্দিনীকে সম্পূর্ণ জবজবে করে ভিজিয়ে দিয়ে গেল। পানির স্রোত বইছে দুজনের গায়ে। নন্দিনীর সিক্ত শরীর আব্রু হারিয়ে কাঁপছে। এর মধ্যে একটা গাড়ির শব্দে আমি উৎকর্ণ হয়ে পেছন ফিরে তাকালাম। আমাদের পেছন দিক থেকে একটা জিপ আসছে। আমি হাত তুলে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে রইলাম। মুহূর্তের মধ্যে জিপটা এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। একটা লোক জিপের উইন্ডশীল্ডটা হাত দিয়ে মুছে আমাদের দেখেই ইশারায় গাড়িতে উঠতে বলল। গাড়ির কাছে গেলে চালক দ্রুত হাতে দরজা খুলে দিল। খাকি পোশাকপরা একটি টিপরা ড্রাইভার।
আমি বললাম, দয়া করে আমাদের শহরে পৌঁছে দিন। মানবতার খাতিরে।
ভেতরে এসে বসুন।
লোকটা বাংলা জানে।
আমরা জিপে উঠে দেখি সৈনিকদের ময়লা কাপড়ের একটা বড় গাটরি ছাড়া জিপে অন্য কোনো আরোহী নেই। আমি ও নন্দিনী ভেজা শরীরে চাপাচাপি করে ড্রাইভারের পাশের সীটটায় বসলাম। লোকটা একবার আমাদের দেখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, আমাদের সুবেদার শয়তানটার সাথে কেন তর্ক করতে গেলেন? ওটাতো একটা আস্ত হারামির বাচ্চা।
আমরা তো কোনো তর্ক করি নি তিনিই আমাদের যা তা বলে তাড়িয়ে দিলেন। আমার স্বামী মুসলমান এবং আমি হিন্দু ব্রাহ্মণের কন্যা হয়ে মুসলমান স্বামী গ্রহণ করেছি এই অপরাধে আমাকে অপমানের চূড়ান্ত করলেন।
নন্দিনী জবাব দিল। বৃষ্টি আর গাড়ির ঝাঁকুনিতেও লোকটা কথাগুলো বুঝতে পারল বলেই মনে হল। অকস্মাৎ লোকটা গাড়ি কাঁপিয়ে হেসে উঠে নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল, মুসলমানদের ওপর ঐ বামুনবেটার খুব ঝাল। ওর বোনতো এখানকার এক মুসলিম যুবককে বিয়ে করে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে। ছেলেটি সি. পি. এম করে। এখানকার ইব্রাহিমপুরের দেওয়ানদের ছেলে। খুব উঁচু ঘর। মেয়েটিও ডাক্তার, আমাদের সুবেদার সাহেবের মেজ বোন।
কথাগুলো বলে লোকটা হেসে আমার দিকে ফিরল, আগরতলা জয়বাংলা অফিসে যাবেন?
হ্যাঁ। আমার বোনজামাই এখানকার শরণার্থীর একজন কর্মকর্তা। আমরা জানি না তার বাসা কোথায়? এখন আমাদের অফিসে নামিয়ে দিলেও চলবে। আমরা বাসার ঠিকানা নিয়ে পরে সেখানে যাব।
আমার কথায় ড্রাইভারটি দয়ালু গলায় বলল, এখানকার জয়বাংলার লোকদের সেক্রেটারি মশায়ের বাসা আমি চিনি। প্রায়ই সেখানে আমাদের কর্তাব্যক্তিদের নামাতে যাই। ভদ্রলোকের নাম জানি না, আন্দাজ করি তিনিই আপনার আত্মীয় হবেন। চান তো সেখানেও পৌঁছে দিতে পারি। পরে আমি লন্ড্রিতে কাপড় ধোলাইয়ের জন্য যাব।
আমি বললাম, দয়া করে সেখানেই পৌঁছে দিন।
সেক্রেটারির বাংলার গেটের সামনে যখন জীপটা এসে থামল তখন বৃষ্টি ধরে এসেছে। গেটের দুপাশ থেকে দুজন সশস্ত্র সেন্ট্রি এসে ড্রাইভারকে আমাদের পরিচয় জিজ্ঞেস করলে ড্রাইভার আমার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, এরা সেক্রেটারি মশায়ের আত্মীয়। আজই বর্ডার পার হয়ে এসেছে। সঙ্গে জেনানা আছে।
একজন সেন্ট্রি গাড়ির ভেতর মুখ বাড়িয়ে নন্দিনীকে দেখল। আমার দিকে ফিরে বলল, আপলোক কাঁহাসে আয়া?
আমি বললাম, ঢাকা সে।
আপ দোনোকা পাস কুছ হাতিয়ার হ্যায়?
জি নেহি।
গাড়ি সে নিকাল আইয়ে।
আমি ও নন্দিনী গাড়ি থেকে রাস্তায় নেমে পাশাপাশি দাঁড়ালে সেন্ট্রি দুজন আপদমস্তক আমাদের পরখ করে বলল, অব অন্দর যা সেকতে। যাইয়ে।
আমরা গেট পার হয়ে ভেতরে রওনা হলাম। বিরাট ফাঁকা জায়গা ও বাগান নিয়ে একতলা সাদাবাড়ি। বেলা তখন কটা বাজে আকাশের মেঘলা মেজাজের জন্য আন্দাজ করা না গেলেও দুপুর যে গড়িয়ে যায় নি তা অনুভব করা যায়। রাস্তার দুপাশে গেঁদাফুলের ঝাড় হলুদ পাপড়ির ভারে নুয়ে আছে। পরিবেশটাকে কোলাহল মুখর এলাকা বলে মনে হল না। বাড়িটাতেও মানুষজনের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তবে একটু আগের বৃষ্টির ভেজা ভাবটা ঘাসে, বাগানের ফুলের কেয়ারিতে লেগে আছে। একটা অচেনা, জলসিক্ত আবহাওয়ার গন্ধে পরিবেশটা নিমজ্জিত। আমরা যে বহু কষ্টে, রক্ত, উদ্বেগ, ইজ্জত ও প্রাণহানির বদৌলতে গন্তব্যে এসে পৌঁছেছি সে অনুভূতি একটুও ছিল না। আমরা উভয়েই ধীরে পা ফেলে এগোচ্ছিলাম। তবে নন্দিনীর আগে থেকেই হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। এখন তার পা ফেলাকে এমন নিষ্প্রাণ মনে হচ্ছিল, আমি তার হাত ধরলাম, হাঁটতে কী কষ্ট হচ্ছে নন্দিনী?
না তো।
তবে কী এমন ভাবছ?
কিছু ভাবছি না। আমার এই দশার কথা এদের কাছে বলতে হবে বলে লজ্জা পাচ্ছি।
বলেই নন্দিনী ফুঁপিয়ে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে পথের ওপর দাঁড়িয়ে পড়ল।
এখান থেকে বাড়িটার বৈঠকখানার দরজার চল্লিশ গজের মধ্যে। নীল পর্দা, দরজা জানালায়, বাতাসে দুলছে।
নন্দিনীর ফোঁপানিতে আমার বোনের নাম ধরে চীৎকার করে ডাকতে ইচ্ছে হলেও, আমি নন্দিনীকেই বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, তোমার অসম্মানের কাহিনী আমরা কেন বলতে যাব নন্দিনী? আমি ছাড়া এ ব্যাপারের আর যারা সাক্ষী ছিল তারা কেউ তোমাকে চেনে না, পরিচয় জানে না। তাছাড়া তারা যে বেঁচে আছে তারই বা প্রমাণ কি? যেখানে হানাদারদের সাথে একটা মুখোমুখি লড়াই হয়েছে তা তো আমরা গুলীর শব্দেই বুঝতে পেরেছিলাম। আমার মনে হয় আনিসের গ্রুপ ফিরতে পারে নি। তবে কাকে লজ্জা? কে এসব ঘটনার সাক্ষী?
তোমার বৌ বা বোন আমাকে দেখলেই বুঝতে পারবে। মেয়েরা বুঝতে পারে। সাক্ষী প্রমাণ লাগবে না।
বুঝুক। আমাদের মুখ থেকে আমরা কিছুই বলব না।
তোমার বোন তো তোমাকে আমার ব্যাপার জিজ্ঞেস করবে। আমি কে, আমাকে কোথায় পেলে ইত্যাদি?
আমার বুকের ভেতর মুখ রেখে প্রকাশ্য দিনের মেঘাচ্ছন্ন দুপুরে নন্দিনী বলল।
আমরা একবারও কেউ দেখে ফেলার ভয়ে ভীত হলাম না। একবার ভাবলাম না বাড়ির জানালা দিয়ে কেউ আমার বোন বা স্ত্রী আমাকে এ অবস্থায় অর্থাৎ এক মহিলাকে বুকের ওপর জড়িয়ে ধরে আঙিনায় দাঁড়িয়ে আছি দেখে ফেলতে পারে।
আমি বলব আমি তোমাকে নারায়ণপুর থেকে নিয়ে এসেছি। তোমার বোনও তোমার সঙ্গে ছিল। পথে শত্রুর গুলীতে প্রাণ হারিয়েছে। তুমি আমার, মানে আমাদের সাথেই থাকবে। এতে যদি আমার স্ত্রী বা আত্মীয়রা বিরুপ কিছু ভাবে তবে তুমি আর আমি পথে বেরিয়ে এসে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করব।
আমার কথার আর কোনো জবাব দিল না নন্দিনী। সম্ভবত সে গন্তব্যে পৌঁছে ভেঙে পড়েছে। আমাকে ছেড়ে দিয়ে হাঁটার জন্য পা বাড়াল। আমি তার হাত মুঠোয় ধরে রেখে বাড়িটার বৈঠকখানার দরজায় এসে দাঁড়ালাম। পর্দাটা দুলছে। আমি নন্দিনীর গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে একহাতে পর্দা সরিয়ে ভেতরে তাকাতেই সোফার ওপর বসা আমার ভগ্নিপতির চোখে চোখ পড়ল। তিনি তার পাশে বসা মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ বাঁধা একজন লম্বাচওড়া সুপুরুষ ব্যক্তির সাথে ক্লোজ হয়ে কথা বলছিলেন। আমাদের দেখে চীৎকার করে উঠল, আরে ভাইজান কী করে এলেন? আপনাকে আনতে যাদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলাম তারা তো কেউ ফেরে নি। বর্ডারের কাছে এক লড়াইয়ে সবাই শহীদ হয়ে গেছে। আমরা তো আপনার কথাই আলোচনা করছি। ঐ দলের সাথেই তো আপনার আসার কথা ছিল। আমরা তো ভাবছি আপনিও হয় মারা পড়েছেন কিংবা ধরা পড়ছেন। ইনি ক্যাপ্টেন খালেদ মোশাররফ, পরিচয় ছিল কি?
খালেদ মোশাররফ উঠে এসে আমার সাথে হ্যান্ডশেক করে বললেন, আপনার জন্য আপনার বোন আর বোনজামাই খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। বামুটিয়া স্পটে আমাদের পুরো গ্রুপটাই খতম হয়ে গেছে বলে এক্ষুণি খবর পেয়েছি। তবে পাকিস্তানীদেরও দশ এগারো জন পড়ে গেছে। আমাদের ছেলেগুলো দারুণ সাহসের সাথে লড়েছে।
এদিকে আমার ভগ্নিপতি চেঁচামেচি করে আমার বোনের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে দৌড়ে অন্দরে চলে গেল। আমি নন্দিনীকে টেনে এনে সোফায় বসিয়ে দিলাম। খালেদ মোশাররফ আমার পাশে এসে বসলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কী আনিসের সাথে ছিলেন?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
ঘটনাটা আপনার কাছে পরে জানব। এখন আপনাদের বিশ্রাম দরকার। কয়েকদিন আগের একটা অপারেশনে আমিও মাথায় জখম পেয়েছি। হাঁটলে মাথা ঘোরায়। আপনার আত্মীয়রা আপনার জন্য খুবই চিন্তিত ছিলেন বলে আমি খোঁজ নিতে এসেছি। আপনাদের খুবই সৌভাগ্য যে ক্রস ফায়ারে পড়ে যান নি।
উগ্বেগমুক্ত আনন্দে ক্যাপ্টেন খালেদ মোশাররফ আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমিও তার দৃঢ়চেতা হাতের দিকে হাত এগিয়ে বললাম, আমার এই সঙ্গিনীর বোনের গায়ে গুলী লেগেছিল। মুহূর্তে মুত্যু। পথে লাশ রেখে চলে এসেছি।
বলেন কি?
ক্যাপ্টেন চমকে উঠে নন্দিনীর দিকে তাকালেন।
আপনারা কোথাকার?
এরা ভৈরবের।
নন্দিনী কিছু বলার আগেই আমি জবাব দিলাম।
স্যাড। আপনাদের রিপোর্ট পরে শুনবো। এখন আপনাদের খাওয়া আর বিশ্রাম দরকার।
তার কথা ফুরাবার আগেই আমার বোন পাগলের মতো ছুটে এসে আমার হাত ধরে কান্না শুরু করে দিল, আমি তো ভাবছি আমাদের খবরের কারণেই আপনি আসতে গিয়ে পথে মারা পড়েছেন। ভাবির খবর কি?
জানি না। গত এপ্রিলেই ঢাকা ছেড়ে এসেছে। শুনেছি বর্ডার ক্রস করেছে। এখন কোথায় আছে কী করে বলব।
আমার কথা কেড়ে নিয়ে বোন বলল, এখানে এলে তো আমি জানতাম। সম্ভবত তিনি এদিকে আসেন নি। কতজনের জন্য দুশ্চিন্তা করব। আত্মীয়স্বজন কেউ ঢাকায় নেই। অথচ এখানকার সবগুলো ক্যাম্পই তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি। আমাদের কাউকে পাই। নি। ভাবি যদি এপ্রিলে ঢাকা ছেড়ে থাকেন তবে ভয়ের কিছু নেই। নিরাপদেই কোনো দিক দিয়ে বর্ডার ক্রস করেছেন। আমরা খোঁজ নেব। আপনি ভেতরে আসুন একে নিয়ে। ইনি কী আমাদের আত্মীয়?
আমি বললাম হ্যাঁ।
নন্দিনী মাথা নুইয়ে সোফায় বসেছিল। আমার জবাবে মুখ তুলে একবার আমার বোনকে এক নজর দেখে দৃষ্টি মাটির দিকে নামিয়ে রাখল। আমার বোন পারুল এগিয়ে গিয়ে নন্দিনীর হাত টানল, ভেতরে চলুন।
নন্দিনী উঠে দাঁড়াল। আমি বললাম, যাও নন্দিনী। আমি ক্যাপ্টেন খালেদের সাথে একটু কথা বলেই ভেতরে আসছি।
পারুল নন্দিনীকে সখীর মতো গলায় জড়িয়ে ধরে ভেতরে নিয়ে গেল। আমি খালেদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম, আনিসের দলটা যে মারা পড়েছে তা কী ভাবে জানলেন?
আমরা লোক পাঠিয়েছিলাম। তারা একটু আগে খবর নিয়ে এসেছে। আনিস গুলী খেয়েও অনেকক্ষণ সজ্ঞানে বেঁচেছিল। তার কাছেই আমাদের ইনফরমার পুরো লড়াইটার খবর জেনেছে। ওরা সমানে ভারী মেশিনগানের গুলীতে আনিসের দলকে কাবু করে ফেলে। যেটুকু অবস্টাকল রেখে আনিসরা পাল্টা গুলী চালাচ্ছিল তা হানাদারদের মেশিনগানের সামনে মুহূর্তের মধ্যে উড়ে গিয়ে আনিসদের উদোম করে ফেলে। এ অবস্থায় বাঁচা অসম্ভব। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে আনিসরা হামাগুড়ি ছেড়ে অকস্মাৎ গুলী ছুঁড়তে ছুঁড়তে উঠে দাঁড়ায়। এবং সামনে ব্রাস মেরে দৌড়ে শত্রুদের দিকে মরিয়া হয়ে এগোতে থাকে। এর ফলে আকস্মিক সুইসাইডাল এ্যাটাকের সামনে পড়ে পাঞ্জাবিরা হঠাৎ নিশানা হারিয়ে হতভম্বের মতো দশ বারোজন জায়গা ছেড়ে একটু পিছাতে গিয়ে গুলীবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলে আনিসের গ্রুপ জয়বাংলা ধ্বনি দিয়ে লাফিয়ে ওঠে। ততক্ষণে অবশিষ্ট পাঞ্জাবিরা পজিশন পেয়েই ব্রাস ফায়ারে আমাদের ছেলেদের গুলীবিদ্ধ করে। খুবই মর্মান্তিক। আনিসের উচিত ছিল, শত্রুর হতভম্ভ হওয়ার সুযোগটা পুরোপুরি গ্রহণ করে তার গ্রুপকে মাটিতে শুইয়ে দেওয়া। ক্রলিং পজিশনে থাকলে যুদ্ধটা এভাবে হয়তো শেষ হত না। জিততে না পারলেও নিজেদের এতগুলো প্রাণহানি সম্ভবত এড়ানো যেত।
যুদ্ধের অবস্থাটা ক্যাপ্টেন খালেদ মোশাররফের কথায় আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পেলাম। গত রাত, সকাল এবং দুপুরের সমস্ত ঘটনা আমার চোখের সামনে ভাসতে লাগল। সবকিছু ভেদ করে এসে দাঁড়াল সীমাদির গুলীবিদ্ধ কাতর মুখখানি। রক্তের ছিটায় বুক, চিবুক ও কপালটা সিঁদুরের মতো লাল।
দুশ্চিন্তা ও অসহ্য ঘটনাগুলোর পুনরাবর্তনের হাত থেকে রেহাই পেতে গিয়ে আমি খালেদ মোশাররফকে বললাম, আনিসরা তো আর পেশাদার সৈনিক ছিল না। আপনাদের দক্ষতা এরা কোথায় পাবে? হয়ত সামান্য কয়েকদিনের ট্রেনিংই এদের সম্বল ছিল। পুরোপুরি দক্ষতা না থাকায় হেরে গেল।
খালেদ মোশাররফ হাসলেন, কবি সাহেব, সামনা সামনি যুদ্ধটাও কিন্তু কবিতার আকস্মিক শব্দ পেয়ে যাওয়ার মতোই ব্যাপার। আপনারা যখন লেখেন তখন যেমন জানেন না মিলটা কোন শব্দ দিয়ে ঘটবে। তেমনি প্রকৃত সোলজারও জানে না সাডেন কোন কৌশলে শত্রুরা ধরাশায়ী হবে। শুধু গুলী চালানটা ভালো করে শিখতে পারলেই আত্মরক্ষার কৌশলটাও তার খানিকটা জানা যায়। শত্রুর মুখোমুখি হলে কোনো দক্ষতা বা পূর্ব অভিজ্ঞতার চিত্র সৈনিকদের মনে থাকে না। ফায়ারিংয়ের সামনে দাঁড়ালে অদৃষ্টপূর্ব আত্মরক্ষার অভিজ্ঞতা এসে সৈনিককে সাহায্য করে। যেমন আপনারা না হাতড়েই মিলের উপযুক্ত শব্দটা হঠাৎ পেয়ে যান। যাক, আনিসরা বীরের মতো লড়ে প্রাণ দিয়েছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনি তো দেখি সাহিত্যের খোঁজ খবরও রাখেন?
না, আমি সাহিত্যিক বা কবি নই। তবে আপনাদের কারো কারো লেখা মাঝে মধ্যে পড়ি। তাছাড়া আমার আত্মীয়স্বজনদের কেউ কেউ সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতাও করেন। সেই সুবাদে বাংলাদেশের কবিদের কারো কারো সাথে খানিকটা পরিচিতও। যা হোক, আর কথা নয় আপনি ভেতরে গিয়ে গোসল-খাওয়া শেষ করে একটু বিশ্রাম নিন। বেঁচে থাকলে আবার সাক্ষাৎ হবে।
বেঁচে থাকলে মানে?
মানে, আজ রাতেই আবার ভেতরে যাচ্ছি। ফেরার গ্যারান্টি তো নেই। ফিরলে কথা হবে।
খালেদ উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমি তার হাতটা ধরলাম। মুখের হাসির মতই তার হাতটা উষ্ণ। আমি তার বীরত্বব্যঞ্জক চিবুকের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার ভগ্নিপতি পেছন থেকে বলল, চলুন আপনাকে নিয়ে ভেতরে যাই।
আমি উঠে দাঁড়িয়েও খালেদের হাতটা ধরে থাকলাম। খালেদ হেসে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে আমার ভগ্নিপতিকে সালাম বলে সৈনিককের মতো দীপ্ত পদক্ষেপে ঘরের বাইরে নেমে গেলেন।
আমি ভেতরে গিয়ে দেখি পারুল নন্দিনীকে তার নিজের পাটভাঙা শাড়ি, ব্লাউজ সায়া ইত্যাদি হাতে তুলে দিয়ে গোসলখানায় ঢুকিয়ে দিল। পারুল আমার দিকে ফিরে বলল, ভাই আপনাকে এক কাপ চা এনে দিই?
আমি বললাম, তোমাদের বোধ হয় আর কোনো টয়লেট নেই?
আছে। নোংরা।
তাহলে ততক্ষণে বসে বসে এক কাপ চা-ই খাই।
এক্ষুণি এনে দিচ্ছি। বলে পারুল ভেতরে চলে গেলে নন্দিনী যে গোসলখানায় ঢুকেছিল আমি সেদিকে তাকালাম। ভেতরে অফুরন্ত পানির শব্দ হচ্ছে। বুঝলাম বেশ কিছুকাল পর নন্দিনী পরিতৃপ্তির সাথে সাবান মেখে গোসল করছে। ভয়ানক ক্ষিদেয় আমার পেট জ্বলছিল। এই অসহনীয় ভুখা পেটে পারুলের গরম চায়ের জন্য বসে আছি। পারুল হয়ত আমাদের খাবার ইত্যাদি তাড়াতাড়ি রেঁধে উপস্থিত করার বিলম্বের কথা ভেবেই আমাকে এক কাপ চা দিতে চেয়েছে।
হঠাৎ গোসলখানায় পানির শব্দের সাথে নন্দিনীর ফোঁপানির শব্দ আমার কানে এল। নন্দিনী কাঁদছে। কান্না আর টয়লেটের ঝরণার ঝরঝরানিতে আমি আমার সঙ্গিনীর অসহয়তা, লজ্জা, ক্ষুৎপিপাসায় কাতর শীর্ণ শরীরের ক্লান্তি ও দ্বিধার দুলুনি এবং কিছুকাল আগে আপন সহোদরা বোনের নির্মম হত্যাকান্ডের পৈশাচিক স্মৃতির কথা চিন্তা করলাম। ভাবলাম বেশ কিছুকাল নন্দিনীর মানসিক ক্ষতগুলো থেকে দুঃস্বপ্ন ঝরতে থাকবে। মনে মনে চিন্তা করলাম, এ অবস্থায় আমি সর্বক্ষণ নন্দিনীর সাথে থাকতে পারবো তো?
এর মধ্যে খালেদ মোশাররফকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে পারুলের জামাই ঘরে এসে ঢুকল।
হাদী ভাই, আপনি শেষ পর্যন্ত, ঢাকা থেকে ঠিকমতো আমাদের কাছে এসে পৌঁছলেন?
আমি জামাইয়ের কথার জবাবে হেসে বললাম, ঠিকমতো এসে পৌঁছতে পারি নি ভাই, অনেক লোকসান দিয়ে এ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছি। আপাতত তোমাদের এখানে নিরাপদ। এখন তো আর চোখের সামনে বিভীষিকা দেখছি না।
এখনও আমরা নিরাপদ নই ভাই, এক পরিচিত দুঃশাসন থেকে অপরিচিত আধিপত্যে এসে আত্মসমর্পণ করেছি মাত্র। নিজেকে খুব নিরাপদ ভাববেন না ভাই। আপনি কবি মানুষ, আবেগ দিয়ে বিচার করতে অভ্যস্ত। আমরা কয়দিনে আবেগ বা স্নেহ মমতার সীমা অতিক্রম করে এসেছি। এখানে চলছে সামরিক প্রশিক্ষণ। প্রতিশোধের মন্ত্র ছাড়া এ লড়াইয়ে জেতার সম্ভাবনা খুবই কম। জাতিগতভাবে ক্রোধকে জাগিয়ে তুলতে হবে। এখানে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনার সুযোগ নেই।
কথাগুলো বলতে বলতে আমার ভগ্নিপতি ইমাম আমার পাশে এসে বসল। আমি খাটের ওপর পা তুলে আরাম করে বসলাম। পারুল ধুমায়িত চায়ের পেয়ালা নিয়ে হাজির হল। মনে হল নন্দিনী যেন গত কয়েকদিনের সব রকম দুর্ভাগ্যের আঘাতকে মুছে ফেলে স্নান সেরে এসেছে। তার শরীর থেকে সাবানের গন্ধে ঘর ভরে গেছে। নন্দিনীর শরীরের সপ্রতিভ শান্ত শ্রী আমার বোন পারুলেরও দৃষ্টিতে পড়ল।
বাহ, এ টাঙ্গাইলটায় আপনাকে তো দারুণ মানিয়েছে।
আমি বললাম, স্নানের পর তোমাকে খুব ভালো লাগছে নন্দিনী।
আমার কথায় নন্দিনীর চেহারা একটু সলজ্জ হল। আড়াচোখে আমার বোনকে একটু দেখে নিয়ে বলল, আপনার আয়নার কাছে নিয়ে চলুন। চুলে জট বেঁধে গেছে।
আসুন।
আমাকে গোসলখানায় ঢোকার ইঙ্গিত করে পারুল নন্দিনীকে নিয়ে অন্য ঘরে চলে গেল।
খাওয়ার টেবিলে নন্দিনী খুব উসখুস করতে লাগল। পারুল মাছ ও মাংসের বাটিগুলো বারবার নন্দিনীর দিকে এগিয়ে দিলেও নন্দিনী তেমন কিছুই পাতে তুলল না, আমার বোনকে বলল, আমার শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করছে। আমাকে আর সাধবেন না।
আমার রান্না বোধহয় আপনার রুচছে না। মাছ-মাংস না নিন তো ডাল দিয়ে আরও কয়েক লোকমা মুখে তুলুন। আপনি তো কিছুই খেলেন না।
পারুলের কথায় বোধহয় নন্দিনী লজ্জা পেল।
না না। আপনার রান্নার কোনো তুলনা হয় না। আমরাও যতটা পারি মাছ-মাংস আপনাদের মতই রাঁধি। আমার আসলে শরীরটাই ভালো নেই। মনে হচ্ছে শরীরে একটু আগে বেশি পানি ঢালাটা ঠিক হয় নি। একটু জ্বর বোধ হচ্ছে।
নন্দিনীর কথায় পারুল তার মাথায় বাঁ হাত ছুঁইয়ে চমকে উঠে বলল, হায় আল্লাহ, আপনার তো গা পুড়ে যাচ্ছে। থাক আর খাওয়ার দরকার নেই। চলুন আপনাকে একটা আলাদা কামরায় শুইয়ে দিয়ে আসি।
পারুল উঠে দাঁড়াল। বেসিনে গিয়ে হাত ধুয়ে মুখে পানি দিতে দিতে পারুলকে বলল, আমাকে একটু ধরুন।
আমি খাওয়া ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। নন্দিনী যে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না তা মুহূর্তের মধ্যে আঁচ করতে পেরে এগিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম।
কি হয়েছে নন্দিনী? তোমার কী খুব খারাপ লাগছে?
পারুল আমার দিকে মুখ তুলে বলল, ভাই এর শরীর খুবই দুর্বল। একে নিয়ে আমার সাথে আসুন।
আমি নন্দিনীকে নিয়ে পারুলের সাথে আস্তে আস্তে চলতে লাগলাম। নন্দিনীর হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে দেখে তার সমস্ত ভর আমার নিজের ওপর রেখে তাকে একটা আলাদা কামরায় খাটের ওপর শুইয়ে দিলাম। পারুল একটা হালকা কম্বল এনে নন্দিনীর শরীর ঢেকে দিল। নন্দিনী চোখ মুদে আছে দেখে আমি পারুলকে বললাম, চল আমরা তোর ঘরে গিয়ে বসি। ও একটু ঘুমিয়ে নিক। জাগলে পরে না হয় একজন ডাক্তারকে ডেকে আনার ব্যবস্থা করা যাবে।
আমার কথায় পারুল নিঃশব্দে উঠে এল। ঘরের দুয়ার ভেজিয়ে দিয়ে আমরা বাইরে এলে পারুল বলল, ভাই আমার ভয় হচ্ছে। ভদ্রমহিলার অবস্থা খুবই খারাপ।
আমি বললাম, তুই তো বোন জানিস না গত দুদিন যাবত এর ওপর দিয়ে কী দুর্ভাগ্যের ঝড় গেছে। চোখের সামনে এর দিদি গুলীবিদ্ধ হয়ে ছটফট করে মরেছে। এ অবস্থায় মানুষ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।
ইনি কী হিন্দু?
হ্যাঁ।
আপনি তো বলেছিলেন ইনি আমাদের আত্মীয়?
পারুলের দৃষ্টিতে কৌতূহল। আমি বললাম, হিন্দু বলেই কী আমাদের আত্মীয় হতে পারে না?
আমার কথার কোনো অর্থ বুঝতে না পেরে পারুল সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল।
এখন যখন আপনি নিরাপদ এলাকায় এসে পৌঁছেছেন, এখন আমাদের সকলেরই উচিত ভাবির একটা খোঁজ খবর নেয়া। বেচারী কী বর্ডার ক্রশ করতে পারল না আবার কোনো বিপদ আপদে পড়ল কিছুই তো বুঝতে পারছি না।
আমি আর ভাবতে পারছি না পারুল।
আমার গলা থেকে হাল ছেড়ে দেয়ার মতো কথাগুলো বেরিয়ে পড়ল। পারুল বলল, এই মহিলাকে আপনি কোথায় পেলেন?
রওনা হওয়ার সময় পথে। এরা ভৈরব বাজারের লোক।
একে নিয়ে আপনার বোধহয় একটু মুস্কিল হবে। কারণ আপনাদের জামাইয়ের এ সপ্তাহে আমাদের সকলকে নিয়ে কলকাতায় এ্যাকজাইল গভর্নমেন্টের দপ্তরে যোগ দিতে হবে। কলকাতার আট নম্বর থিয়েটার রোডে বাংলাদেশ সরকারের দপ্তর। বসেছে। সেখান থেকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ন্ত্রিত হবে। এ অবস্থায় আমরা আপনাকে সেখানেই নিয়ে যেতে চাই। এখন এ মহিলার শারীরিক যে অবস্থা তাতে বোধহয় আগরতলায় এর কোনো আত্মীয়স্বজন থাকলে এখানেই রেখে যেতে হবে। তাছাড়া এই যুদ্ধে সেখানে আপনার মতো লেখকের অনেক কাজ।
বুঝলাম। কিন্তু একে এ অবস্থায় পথে রেখে আমি তোদের সাথে যেতে পারব না পারুল। আমি নন্দিনীর কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একে পথে নিঃসঙ্গ ফেলে কোথাও যাবো না।
আমার কথায় পারুল গম্ভীর হয়ে বলল, আমি আপনাদের জামাইয়ের সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করব। তবে আমরা যে একটা যুদ্ধের ভেতর আছি, এটাও আপনাকে বিবেচনা করতে হবে।
পারুলের কথার মধ্যে যুক্তি থাকলেও আমার ভালো লাগল না। আমি বললাম, তোদের ওপর কোনো বোঝা চাপাতে আমি চাই না। তেমন পরিস্থিতি হলে তোরা না হয় আমাকে এখানে রেখেই যাবি। জীবনের নিরাপত্তা যখন পেয়েছি তখন আমার জন্য তোদের আর চিন্তা করতে হবে না।
আপনাকে ফেলে যেতে তো আমরা ডেকে আনি নি। এই যুদ্ধের অভিজ্ঞতার কথা আপনি সঠিক ভাবে বাংলাদেশের তরুণদের কাছে উপস্থিত করবেন। এই আশা নিয়েই আপনাদের জামাই আপনাকে লোক মারফত চিঠি দিয়ে পাঠিয়েছে। তাছাড়া দেশের ভেতর আপনার মতো প্রতিভাবান লোকদেরই হানাদাররা হত্যা করছে। আর একটি কথা, ভাই আপনার সম্বন্ধে আমার স্বামীর খুব উচ্চ ধারণা। আমার কথাটা একটু মনে রাখবেন। বলল পারুল।
আমি বললাম, আমি কী একথা জানি না ভেবেছিস?
তাহলে আমার আর কিছু বলার নেই।
পারুল সরে গেলে আমি নন্দিনীর কামরার দুয়ারে ঝোলোনো পর্দাটা সরালাম। আমার ধারণা ছিল নন্দিনী জ্বরের ঘোরে বেহুঁশ হয়ে ঘুমুচ্ছে। কিন্তু আমার আন্দাজ ঠিক নয়। নন্দিনী গলা পর্যন্ত কম্বল টেনে রেখে কড়িকাঠের দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছে। আমি আস্তে করে ডাকলাম, নন্দিনী।
চমকে গিয়ে নন্দিনী আমার দিকে মুখে ফেরাল।
আমি নন্দিনী, হাদী। একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো। এ বিপদের তোমার শরীরটা ভালো থাকা দরকার।
আমি এগিয়ে গিয়ে খাটের শিথানে নিঃশব্দে বসলাম। হাত বাড়িয়ে তার কপাল ছোঁয়া মাত্রই নন্দিনীর দুচোখের কোণ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। এখন নন্দিনীর গায়ের তাপমাত্রাটা একটু নমনীয় হয়েছে বলে মনে হল। বললাম, তোমার জ্বর ছেড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ঝমঝমিয়ে পানি ছেড়ে গোসলটা তোমার সহ্য হয় নি। তুমি ঘুমাও আমি বৈঠকখানার সোফায় গিয়ে একটু গা এলিয়ে দিই।
আমার কথার কোনো জবাব দিল না নন্দিনী। কিন্তু উঠতে গেলে আমার হাত টেনে ধরল। আমি আবার বিছানার ওপর চুপচাপ বসে পড়লাম। এ সময় হঠাৎ আমার ভগ্নিপতি ইমাম এসে ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করল, ভাই, আপনি নাকি আমাদের সাথে কলকাতা যেতে চাইছেন না? কেন বলুন তো?
আমি বললাম, নন্দিনীকে এ অবস্থায় ফেলে আমি এখন তোমাদের সাথে কীভাবে যাই। আর যাওয়াটাও এখন জরুরি। আমি না হয় কয়েকদিন পর গিয়ে তোমাদের সাথে মিলিত হব।
না, এখানে একবার থেকে গেলে আপনি আর যাবার সুযোগ করতে পারবেন না। এখানে কোথায় থাকবেন, কী করবেন? কষ্টের সীমা থাকবে না আপনাদের। তাছাড়া আমি আপনাকে লোক পাঠিয়ে এনেছি দেশের ভেতরের অনিশ্চিত অবস্থা থেকে বাঁচাতে। আমাদের হাতে আরও তো কয়েকদিন সময় আছে। এর মধ্যে আশা করছি ইনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।
নন্দিনীর দিকে এগিয়ে গিয়ে ইমাম তার কপালে হাত রাখল।
আমি আপনাদের বোঝা হয়ে গেলাম। শরীরটা দুর্বল। তবে জ্বরটা ছেড়ে গেলে আমি যেতে পারব।
বলল নন্দিনী।
ইমাম বলল, এর মধ্যে আপনি সেরে উঠবেন। এই তো আপনার জ্বর এখন তেমন নেই। গাটা একটু গরম। আমরা তো আর হেঁটে বা গাড়িতে যাচ্ছি না। যাবো প্লেনে, আগরতলা থেকে গোহাটি হয়ে কলকাতায়। ইমামের কথায় আশ্বস্ত হয়ে নন্দিনী সকৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে একবার ইমাম ও পরে আমার দিকে তাকাল।