০৮. মিসির আলি হাসিমুখে বললেন

মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, ‘কি ব্যাপার, আজ খালি হাতে যে! আমার সিগারেট কোথায়?’

মুনির লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল। মিসির আলি বললেন, ‘আজকালের মধ্যে না এলে আমি নিজেই উপস্থিত হতাম তোমার ওখানে।’

‘আমি কোথায় থাকি তা তো আপনি জানেন না।’

‘আগে জানতাম না। এখন জানি। শার্লক হোমসের মতো বুদ্ধি খাটিয়ে বের করেছি। শুনতে চাও?’

‘চাই।’

‘প্রথমে খোঁজ করলাম ইস্টার্ন মার্কেন্টাইলে। দেখা গেল এই নামে কোনো অফিস নেই। তুমি ভুল ইনফরমেশন দিয়েছিলে।

‘ভুল দিই নি। আগে এই নাম ছিল। এখন নাম বদলেছে।

‘যখন দেখলাম অফিস থেকে কোনো সাহায্য পাওয়া যাবে না, তখন পাড়ার ছোট-ছোট পান-বিড়ির দোকানগুলোতে খোঁজ করতে লাগলাম। কারণ তুমি সিগারেট খাও। এইসব দোকানগুলোতে তোমাকে একাধিকবার যেতে হবে।’

‘সিগারেট খাই, কী করে বুঝলেন। আপনার সামনে তো কখনো খাই নি।’

‘তোমার পকেটে দেশলাই দেখেছি। তা ছাড়া যে সিগারেট খায়, সে-ই সাধারণত অন্যকে সিগারেট উপহার দেবার কথা ভাবে।’

‘দোকান থেকেই আমার খোঁজ পেলেন?’

‘হ্যাঁ। মুনির, তুমি চা খাবে?’

‘হ্যাঁ, খাব।’

‘তুমি কথায়-কথায় স্যার বল, আজ এখন পর্যন্ত একবারও বল নি। কারণটা কী?’

‘স্যার, আমি চা খাব।’

মিসির আলি উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। তার মনে হল, ছেলেটি বেশ রসিক। এবং সে সহজ হতে শুরু করেছে। যত সহজ হবে, ততই তাঁর জন্যে ভালো। প্রচুর তথ্য তাঁর দরকার। তথ্য ছাড়া এগুবার কোনো পথ নেই। তিনি নিজে কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারছেন না। ছেলেটির উপরই তাঁকে নির্ভর করতে হবে।

‘আজ আমাকে কিছু বলবে মনে হচ্ছে?’

‘জ্বি, বলব।’

‘বাতি নেভাতে হবে?’

‘না।’

মুনির খুব সহজ ভঙ্গিতে নিজাম সাহেবের বাড়ির ঘটনার কথা বলল। কেমন করে হঠাৎ পট পরিবর্তন হল, সে-সময় তার অনুভূতি কী ছিল, সবই সুন্দর করে গুছিয়ে বলল। শিশুটির দেয়ালে টাঙান ছবিটির কথা, তার পানি চাইবার কথা কিছুই বাদ দিল না। মিসির আলি একটি প্রশ্নও করলেন না। সমস্ত বর্ণনাটা শুনলেন চোখ বন্ধ করে। এক বারও তাকালেন না।

‘তোমার বলা শেষ হয়েছে?’

‘জ্বি।’

‘তোমার বর্ণনা থেকেই মনে হচ্ছিল, বিনু মেয়েটি তোমাকে অভিভূত করেছে। রূপবতী কিশোরী মেয়ে। তার সহজ সরল ব্যবহার, তার যত্ন—এইসব তোমাকে মুগ্ধ করেছে। তাই না?’

‘জ্বি।’

‘তুমি প্রবলভাবে মেয়েটিকে কামনা করেছ। সেই সঙ্গে তার প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করেছ। এই প্রচণ্ড কামনা বা প্রবল আকর্ষণের কারণে তোমার মধ্যে বিভ্রম সৃষ্টি হয়েছে। যার জন্যে মেয়েটিকে তুমি দেখেছ তোমার স্ত্রী হিসেবে। পুরোটাই তোমার কল্পনা। ডে-ড্রীমিং। এক ধরনের ইচ্ছেপূরণ স্বপ্ন।’

‘হতে পারে।’

‘আগের বার তুমি একটি চিঠি নিয়ে এসেছিলে। এবার কিছু আন নি?’

‘না।’

আবার যদি কখনো এ-রকম হয়, একটা জিনিস মনে রাখবে–কিছু একটা হাতে নেবে। খবরের কাগজ হলে খুব ভালো হয়।’

‘খবরের কাগজ দিয়ে কী করবেন?’

‘খবরের কাগজে একটা তারিখ থাকে। এই তারিখটা দেখব। তুমি তোমার অন্য একটা জীবনের কথা বলছ। মনে হচ্ছে দুটো জীবন পাশাপাশি চলছে। সেই জীবনের সময় এবং এই জীবনের সময়ও কি পাশাপাশি?’

‘তার মানে আপনি কি আমার কথা বিশ্বাস করছেন?’

‘না, করছি না। আবার পুরোপুরি অবিশ্বাসও করতে পারছি না। কিছু একটা দাঁড় করাতে হলে আমার প্রচুর তথ্য দরকার। সেইসব তথ্য আমার হাতে নেই। তবে তুমি যে—গল্প বলছ, তার কাছাকাছি গল্প বিভিন্ন উপকথায় চালু আছে।’

‘তাই নাকি?’

‘হ্যাঁ। একটা শুধু তোমাকে বলি। এক লোক পুকুরে গোসল করতে নেমেছে। প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত, গোসল শেষ করে বাসায় গিয়ে খাবে। পানিতে ডুব দিয়ে যেই উঠল ওম্নি সে দেখে, সব কিছু কেমন অন্য রকম লাগছে। সব অচেনা। সে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখল সে নিজেও বদলে গেছে। সে এখন আর পুরুষ নয়। রূপবতী এক যুবতী। সে কাঁপতে কাঁপতে পানি ছেড়ে উঠে এল। এক সওদাগর তখন তাকে দেখতে পেয়ে সঙ্গে নিয়ে গেল। সওদাগরের সঙ্গে তার বিয়ে হল। চারটি ছেলেমেয়ে হল। তারপর একদিন দুপুরে সে সবাইকে নিয়ে গোসল করতে এসেছে। পানিতে ডুব দিয়ে ওঠামাত্র দেখল, সে তার পরিচিত জগতে উঠে এসেছে। আবার সে পুরুষ। সে দ্রুত তার বাড়িতে গেল। স্ত্রী ভাত বেড়ে অপেক্ষা করছে। লোকটির মন গভীর বিষাদে আচ্ছন্ন। বারবার চারটি পুত্র-কন্যার কথা তার মনে পড়ছে। ওরা কোথায় আছে, কী করছে, কে জানে? হয়তো ব্যাকুল হয়ে মাকে খুঁজছে।’

মুনির বলল, ‘এটা তো উপকথা। সত্যি নয়।

‘তা ঠিক। তবে সব গল্পের পেছনেই এক ধরনের ‘সত্যি’ ব্যাপার থাকে। এর পেছনেও কিছু-না-কিছু থাকতে পারে। আমি এইজাতীয় সব গল্প জোগাড় করছি। প্যারালাল ওয়ার্ল্ডজাতীয় যত বই পাচ্ছি পড়ছি।

মুনির ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। মিসির আলি বললেন, ‘তুমি তোমার স্ত্রী হিসেবে যে-মেয়েটিকে দেখেছ, তার বয়স কি ফ্লক-পরা মেয়েটির চেয়ে বেশি মনে হচ্ছিল?’

‘হ্যাঁ, হচ্ছিল।’

‘তোমার শোবার ঘরে জানালায় পর্দা ছিল?’

‘হ্যাঁ, ছিল।’

‘পর্দার রঙ মনে আছে?’

‘জ্বি না।’

‘ঘরের বিছানায় যে-চাদর ছিল, তার রঙ কী?’

‘আমার মনে নেই।’

‘তাহলে ব্যাপারটা স্বপ্ন হবারই সম্ভাবনা। কারণ, শুধু স্বপ্নদৃশ্যগুলোই হয় সাদাকালো।’

‘আমি কিন্তু দেখেছি, ঐ মেয়েটির পরনে নীল রঙের শাড়ি।

‘নিজাম সাহেবের মেয়েটির পরনে নিশ্চয়ই কিছু ছিল। যে-কারণে তুমি ভাবছ তোমার স্বপ্নে দেখা স্ত্রীর গায়ের শাড়িটি নীল।’

মুনির চুপ করে রইল। মিসির আলি বললেন, ‘নিজাম সাহেবের মেয়েটির গায়ে কী ছিল?’

‘ফ্রক বা কামিজাতীয় কিছু।’

‘তার রঙ কী ছিল?’

‘নীল।’

মিসির আলি অল্প হাসলেন। পরমুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘তোমার এই নিয়ে দু’ বার বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল। দু’ বারই তুমি ছিলে ক্লান্ত, বিরক্ত, হতাশ। তাই

না?’

‘জ্বি।’

‘এখন থেকে মাঝে-মাঝে চেষ্টা করে দেখবে, নিজ থেকে ঐ জগতে যেতে পার কি না। যখন একা-একা থাকবে তখন চেষ্টা করবে। ঐ জগতে যেতে চাইবে। ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করবে।’

‘জ্বি আচ্ছা।’

‘কোনো এক জন ভালো নিউরোলজিস্টকে দিয়েও তোমার ব্রেইন ওয়েভগুলো পরীক্ষা করাতে চাই। আমি প্রফেসর আসগর নামে এক নিউরোলজিস্টের সঙ্গে কথাও বলে রেখেছি। তুমি কি কাল বিকেল পাঁচটায় একবার আমার কাছে আসতে পারবে?’

‘পারব। কিন্তু স্যার, নিউরোলজিস্ট তো অনেক টাকা নেবে!

‘সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।’

.

মিসির আলির সে-রাতে ভালো ঘুম হল না। ভয়ংকর একটা স্বপ্ন দেখে রাত তিনটায় ঘুম ভেঙে গেল। বাকি রাতটা জেগে কাটাতে হল। স্বপ্নদৃশ্য নিয়েও প্রচুর চিন্তা করলেন। অবদমিত কামনাই স্বপ্নে উপস্থিত হয়। ব্যাখ্যা সহজ এবং চমৎকার, কিন্তু তবু কোথাও যেন একটা ফাঁকি আছে। কিছু-একটা বাকি থেকে যায়। সেই কিছুর রহস্য কি কোনো দিন ভেদ হবে?

আচ্ছা, পশু-পাখি এরাও কি স্বপ্ন দেখে? অবদমিত কামনা কি তাদের নেই? পশুদের স্বপ্ন কেমন হয়? স্বপ্ন দেখার সময় মানুষের চোখের পাতা কাঁপতে থাকে–বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় তাকে বলে Rapid eye movement (REM), ঐ জাতীয় কম্পন তিনি একটি ঘুমন্ত কুকুরের চোখের পাতায় দেখেছিলেন। সেই কুকুরটি কি তখন স্বপ্ন দেখছিল? জানার কোনো উপায় নেই।

মিসির আলির খানিকটা মন খারাপ হল। এক দিন না এক দিন এইসব রহস্যের সমাধান হবে, কিন্তু তিনি জেনে যেতে পারবেন না। মানুষ স্বল্পায়ু প্রাণী–এটাও একটা গভীর বেদনার ব্যাপার। এত বুদ্ধি নিয়ে সৌরজগতে যে-প্রাণীটি এসেছে, তার কর্মকাল সীমাবদ্ধ।

তিনি বাতি নিভিয়ে ঘুমের চেষ্টা করছেন–লাভ হচ্ছে না। বিচিত্র সব চিন্তা মাথায় আসছে। একটির সঙ্গে অন্যটির কোনো মিল নেই। আবার মিল আছেও। অদৃশ্য যে সুতোয় মিলগুলো গাঁথা, সে-সুতোটির নাম অনন্ত মহাকাল–The eternity.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *