॥ ৮ ॥
আমি জানি ফেলুদা কাল অনেক রাত অবধি ঘুমোয়নি। আমি আর লালমোহনবাবুও জেগে ছিলাম প্রায় এগারোটা অবধি। তড়িৎবাবুর মতো একজন আশ্চর্য বুদ্ধিমান লোক কী বিশ্রীভাবে ও কী রহস্যজনকভাবে মারা গেলেন সেই নিয়ে আলোচনা করছিলাম। কতকগুলো ব্যাপার যে ফেলুদাকেও রীতিমতো ধাঁধিয়ে দিয়েছিল সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। ফেলুদা নিজেই সেগুলোর একটা লিস্ট করেছিল; সেটা এখানে তুলে দিচ্ছি—
১। তড়িৎবাবু ছাড়া আর কে কাল রাত্রে জঙ্গলে গিয়েছিল? যে গিয়েছিল সে-ই কি তলোয়ার নিয়েছিল? সেই কি খুনী? না সে ছাড়াও আরও কেউ গিয়েছিল? হাল ফ্যাশানের টর্চ কার কাছে আছে?
২। প্রথম রাত্রে মহীতোষবাবু কার সঙ্গে ধমকের সুরে কথা বলছিলেন?
৩। দেবতোষবাবু কাল মহীতোষবাবু সম্পর্কে কী ঘটনা বলতে যাচ্ছিলেন, সে সময় মহীতোষবাবু এসে তাঁকে ডেকে নিয়ে গেলেন?
৪। দেবতোষবাবু সেদিন যুধিষ্ঠিরের রথের কথাটা বললেন কেন? সেটা কি পাগলের প্রলাপ, না তার কোনও মানে আছে?
৫। শশাঙ্কবাবু এত চুপচাপ কেন? সেটা কি ওঁর স্বভাব, না বিশেষ কোনও কারণে উনি চুপ মেরে গেছেন?
লালমোহনবাবু সব শুনেটুনে বললেন, ‘মশাই, আমি কিন্তু একটি লোককে মোটেই ভরসার চোখে দেখতে পারছি না। ওই দাদা ব্যক্তিটি পাগল হতে পারেন, কিন্তু ওঁর হাতের কব্জিটা দেখেছেন? মহীতোষবাবুর চেয়েও চওড়া। আর কালাপাহাড়ের উপর যা আক্রোশ দেখলাম, কাউকে কালাপাহাড় মনে করে ধাঁ করে একটা তলোয়ারের ঘা বসিয়ে দেওয়া কিছুই আশ্চর্য না।’
কথাটা শুনে ফেলুদা কিছুক্ষণ লালমোহনবাবুর দিকে চেয়ে থেকে বলল, ‘আমার সঙ্গে মিশে আপনার কল্পনাশক্তি ও পর্যবেক্ষণক্ষমতা যে যুগপৎ বেড়ে চলেছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। দেবতোষবাবু যে তলোয়ারের আঘাতে খুন করার ক্ষমতা রাখেন সেটা আমিও বিশ্বাস করি। তবে তড়িৎবাবুর খুনের পেছনে যে-ধরনের হিসেবি কার্যকলাপের ইঙ্গিত পাওয়া যায়— আদিত্যনারায়ণের আলমারি খুলে তলোয়ার নেওয়া, তড়িৎবাবুকে অনুসরণ করে এতখানি পথ হেঁটে জঙ্গলে যাওয়া—তাও আবার দুর্যোগের রাতে— তারপর অন্ধকারেই তাগ করে তলোয়ার চালানো—এটা মনে রাখতে হবে যে এক হাতে টর্চ জ্বেলে অন্য হাতে তলোয়ার চালানো সম্ভব নয়—এই এতগুলো কাজ একজন পাগলের পক্ষে সম্ভব কি না সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আসলে আরেকবার জঙ্গলে গিয়ে অনুসন্ধান না করলে চলছে না। যা ঘটেছে সব তো ওইখানে। কাজেই বাড়িতে বসে শুধু জল্পনা-কল্পনার সাহায্যে বেশি দূর এগোনো যাবে না। এটা ঠিক যে তড়িৎবাবু সংকেতের সমাধান করে গুপ্তধনের সন্ধানেই গিয়েছিলেন। গুপ্তধন নিয়ে সোজা কলকাতায় চলে যাবেন, এটাই ছিল তাঁর প্ল্যান। কিন্তু এমন একটা আরামের চাকরি ছেড়ে গুপ্তধনের প্রতিই বা তাঁর লোভটা গেল কেন? ভদ্রলোককে তো রাজার হালে রেখেছিলেন মহীতোষবাবু। মাইনেও যে ভাল দিতেন সেটা তড়িৎবাবুর জামা-কাপড়, হাতের ঘড়ি, প্রসাধনের জিনিসপত্র ইত্যাদি দেখলেই বোঝা যায়। সিগারেটটাও খেতেন বিলিতি, এই মাগ্গির বাজারে।’
আজ সকাল থেকে আবার মেঘ করে আছে, তবে বৃষ্টি পড়ছে না। জানালা দিয়ে জঙ্গলটা চোখে পড়তেই কেমন যেন গা ছম ছম করে ওঠে। ফেলুদা সবেমাত্র বলেছে একবার মহীতোষবাবুর সঙ্গে দেখা হওয়া উচিত, এমন সময় চাকর এসে খবর দিল— নীচে ডাক পড়েছে। একটা জিপের আওয়াজ কিছুক্ষণ আগেই পেয়েছিলাম। নীচে গিয়ে দেখলাম ইনস্পেক্টর হাজির।
‘আপনি খুশি তো?’ বিশ্বাস ফেলুদাকে দেখেই প্রশ্নটা করলেন।
‘কেন?’
‘একটা রহস্য পেয়ে গেলেন! এই বাড়ি থেকেই অস্ত্র নিয়ে গিয়ে তড়িৎবাবুকে খুন করা হয়েছে, সেটা তো আপনার কাছে একটা জোর খবর, তাই নয় কি?’
‘অস্ত্র নেই মানেই যে সেটা দিয়ে খুন করা হয়েছে, এটা নিশ্চয়ই আপনি মনে করেন না!’
‘আমি তা মনে করব কেন? কিন্তু আপনি তাই ভাবছেন না কি?’
দুজনেই বেশ ভদ্রভাবে কথা বললেও বেশ বুঝতে পারছিলাম যে দুজনের মধ্যে একটা চাপা রেষারেষি চলেছে। কোনও দরকার ছিল না; মিস্টার বিশ্বাসই প্রথম ঠেস দিয়ে কথা বলেছেন। ফেলুদা একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘আমি এখনও কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছইনি। আর আপনি যদি মনে করেন যে আমি খুশি হয়েছি, তা হলে বলতে বাধ্য হব যে আপনার ধারণা ভুল। খুনের ব্যাপারে আমি কোনও দিনই খুশি না। বিশেষ করে তড়িৎবাবুর মতো একজন বুদ্ধিমান লোক এত অল্প বয়সে এভাবে প্রাণ হারাবেন, এতে খুশি হবার কী আছে মিস্টার বিশ্বাস?’
‘বুদ্ধিমান লোক?’ বিশ্বাস ঠাট্টার সুরে বললেন। ‘বুদ্ধিমান লোকের এমন মতিভ্রম হবে কেন যে রাত দুপুরে বাঘের জঙ্গলে যাবে সফর করতে? এর কোনও সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেন আপনি, মিস্টার মিত্তির?’
‘পারি।’
আমরা ছাড়া ঘরে তিনজন লোক— মহীতোষবাবু, বিশ্বাস আর শশাঙ্কবাবু। তিনজনেই ফেলুদার কথায় যেন তটস্থ হয়ে ওর দিকে চাইল। ফেলুদা বলল, ‘তড়িৎবাবুর জঙ্গলে যাবার একটা পরিষ্কার কারণ ছিল।’ এবার ফেলুদা মহীতোষবাবুর দিকে চাইল। ‘আপনার সংকেতের মানে আমি বার করেছি মহীতোষবাবু— তবে আমারও আগে করেছিলেন তড়িৎ সেনগুপ্ত। কাজেই বাঘছালটা ওঁরই প্রাপ্য ছিল। আমার বিশ্বাস উনি জঙ্গলে গিয়েছিলেন গুপ্তধনের সন্ধানে।’
মহীতোষবাবুর চোখ কপালে উঠে গেছে দেখে ফেলুদা তাকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল। ফোক্লা ফকিরের গাছের কথা শুনে মহীতোষবাবু অবাক হয়ে বললেন, ‘কই, ও রকম কোনও গাছ আছে বলে তো জানি না।’
‘কিন্তু আপনার দাদা যে বললেন ছেলেবেলায় আপনারা ওখানে চড়ুইভাতি করতে যেতেন, আপনার ঠাকুরদার সঙ্গে?’
‘দাদা বললেন?’ মহীতোষবাবুর কথায় পরিষ্কার ব্যঙ্গের সুর। ‘দাদা যা বলেন তার কতটা সত্যি কতটা কল্পনা তা আপনি জানেন? আপনি ভুলে যাচ্ছেন যে দাদার মাথার ঠিক নেই।’
ফেলুদা চুপ করে গেল। দেবতোষবাবুর মাথার ব্যারাম নিয়ে তারই আপন ভাইয়ের সঙ্গে সে কীভাবে তর্ক করবে?
এদিকে মহীতোষবাবু কিন্তু বেশ ফ্যাকাশে হয়ে গেছেন। হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, ‘তার মানে তড়িৎ গুপ্তধন নিয়ে কলকাতায় পালানোর মতলব করছিল। হয়তো আর ফিরেও আসত না। অথচ আমি এর কিছুই জানতে পারিনি।’
মিস্টার বিশ্বাস সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বাঁ হাতের তেলোতে ডান হাত দিয়ে একটা ঘুঁষি মেরে বললেন, ‘যাক, তা হলে ভদ্রলোকের বনে যাবার একটা কারণ পাওয়া গেল। এবার জানা দরকার আততায়ী কে।’
‘এই বাড়িরই লোক তাতে বোধহয় সন্দেহ নেই। আছে কি?’ ফেলুদা একটা ধোঁয়ার রিং ছেড়ে জিজ্ঞেস করল।
মিস্টার বিশ্বাস একটা বাঁকা হাসি হেসে চোখ দুটোকে ছোট ছোট করে বললেন, ‘তা তো বটেই। তবে এ বাড়ির লোক বলতে আপনিও কিন্তু বাদ যাচ্ছেন না, মিস্টার মিত্তির। আপনি নিজে তলোয়ারটা দেখেছিলেন। ওটা হাত করার সুযোগ এ বাড়ির অন্য বাসিন্দাদের যেমন ছিল, তেমনই আপনারও ছিল। আপনি তড়িৎবাবুকে আগে থেকে জানতেন কি না, তার প্রতি আপনার কোনও আক্রোশ ছিল কি না, সে সব কিন্তু কিছুই জানা যায়নি।’
মিস্টার বিশ্বাসের কথায় ফেলুদা আর একটা ধোঁয়ার রিং ছেড়ে বলল, ‘কেবল দুটো জিনিস সকলেই জানে। এক, আমি এখানে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছি, এমনিতে আসার কথা ছিল না; দুই, তড়িৎবাবু যে ছুরির আঘাতে মরে থাকতে পারেন সেদিকে আমিই প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করি। না হলে তাকে বাঘের শিকার বলেই চালিয়ে দেওয়া হচ্ছিল।’
মিস্টার বিশ্বাস এবার একটা হালকা হাসি হেসে বললেন, ‘আপনি আমার কথাটা এত সিরিয়াসলি নিচ্ছেন কেন? ভয় নেই, আমাদের লক্ষ্য আপনার দিকে নয়, অন্য দিকে।’
লক্ষ করলাম যে, কথাটা বলার পর বিশ্বাস আর মহীতোষবাবুর মধ্যে, যাকে বলে দৃষ্টি বিনিময়, সে রকম একটা ব্যাপার ঘটে গেল— বোধহয় এক সেকেন্ডের জন্য। ফেলুদা বলল, ‘আপনি কালকে যে কথাটা বলেছিলেন, সেটা এখনও বলছেন তো?’
‘কী কথা?’ জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার বিশ্বাস।
‘আমি আমার ইচ্ছেমতো অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে পারি তো?’
‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। কেবল আমার আর আপনার কাজটা ক্ল্যাশ না করলেই ভাল। কেউ কারুর বাধা সৃষ্টি করলেই কিন্তু মুশকিল হবে।’
‘সেটার বোধহয় কোনও সম্ভাবনা নেই। আমি জঙ্গলের দিকটাতেই তদন্ত চালাব প্রধানত। সে ব্যাপারে বোধহয় আপনার খুব একটা উৎসাহ নেই।’
‘এনিথিং ইউ লাইক’—বললেন মিস্টার বিশ্বাস।
এবার ফেলুদা মহীতোষবাবুর দিকে ফিরল।
‘দেবতোষবাবুর সঙ্গে কথা বলে কোনও ফল হবে না বলছেন?’
মহীতোষবাবু অধৈর্য হলেন কি না জানি না, তবে মনে হল একবার যেন ওঁর চওড়া চোয়ালের হাড়টা একটু শক্ত হল। পরমুহূর্তেই আবার স্বাভাবিক হয়ে শান্ত গম্ভীর গলায় বললেন, ‘দাদার শরীরটা কাল থেকে একটু বেশি খারাপ হয়েছে। ওঁকে ডিসটার্ব করাটা ঠিক হবে না।’
ফেলুদা ছাইদানে সিগারেট ফেলে দিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে বলল, ‘আমি তো আর অনির্দিষ্টকাল আপনার অতিথি হয়ে থাকতে পারি না, বা থাকতে চাইও না। কালই আমাদের মেয়াদের শেষ দিন। আপনাকে বলেছিলাম একবার জঙ্গলে যেতে চাই। আপনি যদি একটু মাধবলালকে বলে দেন, আর আপনার একটা জিপ…’
দুটোর ব্যবস্থাই হয়ে গেল। এখন সাড়ে আটটা। ঠিক হল আমরা দশটা নাগাদ বেরিয়ে পড়ব। জঙ্গলে ঘোরার জন্য হান্টিং বুট ছিল আমার আর ফেলুদার; আমরা দুজনেই সেগুলো বার করে পরে নিলাম, যদিও জানি যে আমাকে হয়তো জিপ থেকে নামতেই দেবে না। আমার ধারণা ছিল লালমোহনবাবু হয়তো নিজে থেকেই নামতে চাইবেন না, কিন্তু এখন লালমোহনবাবুর হাবভাব দেখে বেশ অবাক লাগল। বাথরুমে গিয়ে ধুতি ছেড়ে খাকি প্যান্ট পরে এলেন, আর বাক্স থেকে একটা জবরদস্ত বুট জুতো বার করে নিয়ে সেটা পরতে লাগলেন। ফেলুদা ব্যাপারটা শুধু একবার আড়চোখে দেখে নিল, মুখে কিছু বলল না।
‘আচ্ছা, বাঘের চাহনি শুনেছি নাকি সাংঘাতিক ব্যাপার? সত্যি নাকি মশাই?’ বুট পায়ে দিয়ে মেঝের উপর মিলিটারি মেজাজে পায়চারি করতে করতে প্রশ্ন করলেন লালমোহনবাবু। ফেলুদা তৈরি হয়ে জানালার ধারে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, এখন শুধু জিপ আর শিকারির অপেক্ষা। সে লালমোহনবাবুর প্রশ্নের জবাবে বলল, ‘তা তো বটেই; তবে শিকারিরা এটাও বলে যে বাঘ নাকি মানুষকে ভয় পায়। একজন লোক যদি বাঘ দেখলে পরে তার চোখে চোখ রেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, তা হলে বাঘ নাকি উল্টো-মুখে ঘুরে চলে যায়। আর শুধু চাহনিতে যদি কাজ না দেয়, তা হলে হাত-পা ছুঁড়ে চেঁচাতে পারলেও নাকি একই ফল হয়।’
‘কিন্তু ম্যান-ইটার?’
‘সেখানে আলাদা ব্যাপার।’
‘তাই বলুন। কিন্তু তা হলে আপনি যে…?’
‘আমি যাচ্ছি কেন? তার কারণ দিনের বেলা বাঘ বেরোবার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। যদি বেরোয় তার জন্য বন্দুক তো সঙ্গেই থাকছে। আর তেমন বেগতিক দেখলে জিপ তো রয়েইছে, উঠে পড়লেই হল।’
এর পরে জিপ আসার আগে লালমোহনবাবু শুধু একটা কথাই বলেছিলেন।
‘খুনের ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পারছি না মশাই। একেবারে টোটাল ডার্কনেস।’
ফেলুদা বলল, ‘অন্ধকারটা যাতে না দূর হয় তার জন্য চেষ্টা চলছে লালমোহনবাবু। সেই চেষ্টাকে বিফল করাই হবে আমাদের লক্ষ্য।’