০৭. আদিত্যনারায়ণের ঘরে

॥ ৭ ॥

কানাই চাকরটাই আদিত্যনারায়ণের ঘরে ধুনো দিতে গিয়ে তলোয়ারের অভাবটা লক্ষ করে, আর করেই মহীতোষবাবুকে খবর দেয়। ঘরে অনেক বইপত্তর আছে যেগুলো মহীতোষবাবুর লেখার কাজে দরকার হয়; তাই আর ঘরটায় চাবি দেওয়া হত না। চাকর সবই পুরনো আর বিশ্বাসী। চুরি এ বাড়িতে বহুকাল হয়নি, তাই ও নিয়ে কেউ মাথাও ঘামাত না। তার মানে এই যে, বাড়ির যে-কেউ ইচ্ছে করলে ও তলোয়ার বার করে নিতে পারত।

আলমারিটা খুব ভাল করে পরীক্ষা করেও ফেলুদা কোনও ক্লু বা ওই জাতীয় কিছু পেল না। শুধু তলোয়ারটাই নেই, আর সব যেখানে যেমন ছিল সেইভাবেই আছে।

পরীক্ষা শেষ হলে পর ফেলুদা বলল যে, ও তড়িৎবাবুর শোবার ঘর, আর তড়িৎবাবু যেখানে কাজ করত সেই জায়গাটা একটু দেখতে চায়। —‘তবে তার আগে আপনার মনে কোনওরকম সন্দেহ হচ্ছে কি না সেটা জানতে চাই।’

মহীতোষবাবু কিছুক্ষণ গম্ভীর থেকে মাথা নেড়ে বললেন, ‘তড়িৎকে খুন করার কোনও কারণ থাকতে পারে এমন কোনও লোক তো এখানে আছে বলে মনে হয় না। ওর এমনিতেও মেলামেশা কম ছিল, কাজ নিয়ে থাকত; মাঝে মাঝে হেঁটে বাইরে বেড়াতে যেত। যত দূর জানি, বদ অভ্যাস-টভ্যাসও কিছু ছিল না। আর ঠাকুরদার তলোয়ার দিয়েই যদি তাকে মেরে থাকে তা হলেও তো আমাদের বাড়িরই লোক। নাঃ, আমি তো ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছি না।’

আমরা তিনজনে মহীতোষবাবুর সঙ্গে তড়িৎবাবুর ঘর দেখতে গেলাম। আমাদের ঘরেরই মতো বড় একটা ঘর। আসবাব ছাড়া তড়িৎবাবুর নিজের জিনিসপত্র বলতে নীল রঙের একটা বড় সুটকেস, একটা কাঁধে-ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগ, আলনায় টাঙানো শার্ট প্যান্ট পায়জামা গেঞ্জি তোয়ালে ইত্যাদি, একটা তাকে প্রসাধনের জিনিসপত্র, একটা ছোট টেবিলের উপর রাখা ইংরেজি আর বাংলা কিছু গল্পের বই, একটা অ্যালার্ম ক্লক, একটা সুলেখা ব্লু-ব্ল্যাক কালি, আর দুটো পেনসিল। এ ছাড়া খাটের পাশে একটা টেবিলের উপর রাখা ফ্লাস্‌ক আর জলের গেলাস, আর একটা ছোট ট্রানজিস্টার রেডিয়ো।

সুটকেসটায় চাবি ছিল না। ফেলুদা সেটা খুলতেই দেখা গেল তার মধ্যে খুব পরিপাটি করে কাপড়চোপড় সাজানো রয়েছে। ফেলুদা বলল, ‘ভদ্রলোক কলকাতায় যাবার জন্য তৈরিই হয়ে ছিলেন।’

মিনিট পাঁচেক পরে তড়িৎবাবুর ঘর থেকে আমরা মহীতোষবাবুর আপিস ঘরের দিকে রওনা দিলাম। যাবার পথে ফেলুদা মহীতোষবাবুকে জিজ্ঞেস করল, ‘সেক্রেটারি বলতে ঠিক কী ধরনের কাজ করতেন তড়িৎবাবু, সেটা একটু বলবেন কি?’

মহীতোষবাবু বললেন, ‘চিঠিপত্র লেখার কাজ তো আছেই, তা ছাড়া আমার হাতের লেখা ভাল নয় বলে পাণ্ডুলিপি ও-ই কপি করে দিত। তারপরে প্রুফ দেখত, কলকাতায় গেলে পাবলিশারদের সঙ্গে দেখা করা, কথাবার্তা বলা, এ সবও করত। ইদানীং আমার বংশের ইতিহাস লেখার ব্যাপারে ওকে অনেক পুরনো বই কাগজপত্র দলিল চিঠি ইত্যাদি ঘাঁটতে হয়েছে। সে-সব পড়ে তথ্য নোট করে রাখত।’

‘এগুলো বুঝি সেই সব নোটের খাতা?’ ফেলুদা তড়িৎবাবুর ডেস্কের উপর রাখা গোটা আষ্টেক বড় সাইজের খাতার দিকে দেখাল। মহীতোষবাবু মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললেন।

‘আর এগুলো কি আপনার নতুন শিকার কাহিনীর প্রুফ?’

লম্বা লম্বা কাগজের তাড়া, দেখলেই বোঝা যায় সেগুলো প্রুফ। ফেলুদা এক-তাড়া প্রুফ তুলে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখছিল।

‘প্রুফ-দেখিয়ে হিসেবে কি খুব নির্ভরযোগ্য ছিলেন তড়িৎবাবু?’

প্রশ্নটা শুনে মহীতোষবাবু বেশ অবাক হয়েই বললেন, ‘আমার তো তাই ধারণা। আপনার কি সন্দেহ হচ্ছে?’

‘প্রথম পাতার প্রথম প্যারাগ্রাফেই দুটো ভুল দেখছি শুধরানো হয়নি।’

‘তাই নাকি?’

গর্জন কথাটার রেফ বাদ রয়ে গেছে, আর হরিণের র-য়ে ফুটকি নেই।’

‘আশ্চর্য…আশ্চর্য…’

মহীতোষবাবু অন্যমনস্কভাবে প্রুফের কাগজগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে ফেলুদাকে ফেরত দিয়ে দিলেন।

‘সম্প্রতি তড়িৎবাবুকে কি চিন্তিত বা উদ্বিগ্ন বলে মনে হত আপনার?’ ফেলুদা প্রশ্ন করল।

‘কই, সে রকম তো কিছু লক্ষ করিনি।’

ফেলুদা তড়িৎবাবুর কাজের টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে কী যেন দেখছে। একটা প্যাড খোলা রয়েছে, তার উপর হিজিবিজি লেখা। ফেলুদা প্যাডটা হাতে তুলে নিয়ে কাগজের উপর চোখ রেখে বলল, ‘আপনাদের বংশের ইতিহাস লেখার জন্য কি মহাভারত ঘাঁটার দরকার হচ্ছিল?’

‘কেন বলুন তো?’

‘তড়িৎবাবু এই প্যাডে বোধহয় অন্যমনস্কভাবেই কয়েকটা কথা লিখেছেন। এই যে দেখুন না— অর্জুন, কীচক, নারায়ণী, উত্তর, অশ্বত্থামা। এরা সবই তো মহাভারতের নাম। নারায়ণী হল কৃষ্ণের সেনার নাম। কীচক ছিল বিরাট রাজার শালা, আর উত্তর হল বিরাটের ছেলে, অভিমন্যুর শালা।’

মহীতোষবাবু বললেন, ‘আমার কাজের জন্য ওকে মহাভারত পড়তে হয়নি, তবে ব্যাপারটা কী জানেন, তড়িৎ ছিল বইয়ের পোকা। ঠাকুরদাদার লাইব্রেরিতে কালীপ্রসন্নর মহাভারত রয়েছে। সেটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে থাকতে পারে।’

আমরা মহীতোষবাবুর আপিসঘর থেকে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি, এমন সময় একটা চেনা গুরুগম্ভীর গলায় থিয়েটারের ঢঙে ক’টা কথা কানে এল—

‘সব ধ্বংস হয়ে যাবে…সব ধ্বংস হয়ে যাবে! সত্যের ভিত টলমল করছে, সব ধ্বংস হয়ে যাবে!’

শুধু গলাটাই শুনলাম, মানুষটাকে দেখতে পেলাম না। মহীতোষবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘বৈশাখ মাসটা প্রতি বছরই দাদার এ রকম হয়। তারপর বর্ষা এলে গরমটা কমলে কিছুটা নিশ্চিন্ত।’

আমরা আমাদের ঘরের সামনে পৌঁছে গেছি। ফেলুদা বলল, ‘কাল একবার জঙ্গলে যাব ভাবছিলাম। একটু অনুসন্ধানের প্রয়োজন। আপনি কী বলেন?’

মহীতোষবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘তড়িৎকে যেখানে ফেলে রেখে গিয়েছিল বাঘ, তার কাছাকাছি সে আর আসবে না বলেই তো মনে হয়। বিশেষ করে দিনের বেলা। অন্তত বাঘ সম্বন্ধে আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে। কাজেই আপনারা যদি ওই স্পটের কাছাকাছি থাকেন তা হলে বেশি রিস্‌ক নেই। সত্যি বলতে কী, এ জঙ্গলে যে বড় বাঘ এখনও রয়ে গেছে সেটাই তো আমার কাছে একটা বিরাট বিস্ময়।’

‘সঙ্গে মাধবলালকে পাওয়া যাবে তো? আর একটা জিপ…?

‘নিশ্চয়ই।’

মহীতোষবাবু চলে গেলেন। বললেন, তলোয়ারের খবরটা ইনস্পেক্টর বিশ্বাসকে দিতে হবে।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বিকেলের পর থেকে আকাশের মেঘ একদম কেটে গেছে। লালমোহনবাবু অনেকক্ষণ থেকে চুপচাপ ছিলেন; দেখে মনে হচ্ছিল হয়তো কোনও গল্পের প্লট মাথায় আসছে, কারণ মাঝে মাঝে পকেট থেকে লাল টুকটুকে একটা টাটার ডায়েরি বার করে কী যেন নোট করছিলেন। ঘরে এসে পাখাটা খুলে দিয়ে খাটে বসে বললেন, ‘কীরকম বোনাস পেয়ে গেলেন বলুন। এটা আমারই দৌলতে সেটা স্বীকার করছেন তো?’

‘একশোবার।’

ফেলুদা তড়িৎবাবুর ডেস্কের উপর থেকে সেই মহাভারতের নাম লেখা প্যাডটা আর ‘কোচবিহারের ইতিহাস’ বলে একটা বই নিয়ে এসেছিল। এখন সে খাটে বসে প্যাডের দিকে চেয়ে রয়েছে। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলল, ‘সব ক’টাই মহাভারতের নাম তাতে সন্দেহ নেই, কেবল এই “উত্তর” কথাটা…। উত্তর…উত্তর। উত্তর নামও হতে পারে, উত্তরদিকও হতে পারে, আবার উত্তর মানে উত্তর কাল— পরবর্তীকাল— এও হতে পারে। আবার উত্তর মানে প্রশ্নের উত্তর… জবাব… জবাব…’

ফেলুদা হঠাৎ যেন চমকে উঠল। তারপর খাটের পাশের টেবিলের উপর থেকে নিজের খাতাটা নিয়ে সংকেতের পাতাটা খুলল।

‘দিক পাও ঠিক ঠিক জবাবে। —থ্যাঙ্ক ইউ তড়িৎবাবু। আপনার উত্তর বিরাট রাজার ছেলে হতে পারে— আমার উত্তর হল উত্তরদিক। দিক পাও ঠিক ঠিক জবাবে। অর্থাৎ দিক পাও ঠিক ঠিক উত্তরে। তার মানে উত্তরদিকটাই হল ঠিক দিক। হাত গোন ভাত পাঁচ। পঞ্চান্ন হাত। উত্তরদিকে পঞ্চান্ন হাত। কিন্তু তারপর? ফাল্গুন তাল জোড়, দুই মাঝে ভুঁই ফোঁড়। ফাল্গুন…এই ফাল্গুনটা নিয়েই যত গণ্ড—’

আবার ফেলুদার সেই চমকে উঠে কথা থেমে যাওয়ার ব্যাপার।

‘তড়িৎবাবুর টেবিলের উপর একটা বাংলা অভিধান ছিল না?’ সে চাপা গলায় বলে উঠল।

লালমোহনবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সংসদের অভিধান। লাল রং। আমারও আছে।’

‘ওটা দেখা দরকার।’

ফেলুদার পিছন পিছন আমরাও ছুটলাম মহীতোষবাবুর আপিস ঘরে।

অভিধান খুলে ‘ফাল্গুন’ বার করে ফেলুদার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।

‘ফাল্গুন—ফাল্গুন হল অর্জুনের একটা নাম! আর অর্জুন শুধু পঞ্চপাণ্ডবের একজন নয়, অর্জুন গাছও বটে। এ জঙ্গলে অর্জুন গাছ কালও দেখেছি।’

‘তা হলে ব্যাপারটা কী, দাঁড়াচ্ছে?’ লালমোহনবাবু জিনিসটা ভাল করে না বুঝেও উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন।

‘ফাল্গুন তাল জোড়, দুই মাঝে ভুঁই ফোঁড়। একটা অর্জুন গাছ আর জোড়া তাল গাছের মাঝখানে জমি খুঁড়তে হবে।’

‘কিন্তু সে রকম গাছ কোথায় আছে সেটা জানছেন কী করে?’

ফেলুদা বলল, ‘আরেকটা কোনও বুড়ো গাছের উত্তরে পঞ্চাশ হাত গেলেই পাওয়া যাবে।’

‘আরেব্বাবা, বুড়ো গাছ! বুড়ো গাছ ছাড়া ছোক্‌রা গাছ আছে নাকি এ জঙ্গলে? আর গাছ তো মশাই সব কেটে ফেলেছে। মহীতোষবাবুর নিজেরই তো কাঠের ব্যবসা। এ সংকেত লেখা হয়েছে কদ্দিন আগে? সত্তর পঁচাত্তর বছর হবে না?’

আমরা আমাদের ঘরে ফিরে এসেছি। ফেলুদা আবার চুপ, আবার গম্ভীর। মেঝেতে বাঘছালের দিকে চেয়ে রয়েছে অন্যমনস্কভাবে। প্রায় মিনিটখানেক ওইভাবে থেকে বলল, ‘যা ভাবছি তাই যদি হয়, তা হলে বড় বাঘের ছালটা তড়িৎবাবুরই পাওয়া উচিত ছিল। সংকেত সমাধানের ব্যাপারে তড়িৎ সেনগুপ্ত ফেলু মিত্তিরের চেয়ে কম যায় না। থুড়ি, যেতেন না।’

লালমোহনবাবু বললেন, ‘কিন্তু প্যাডে যে আরও সব মহাভারতের নাম রয়েছে? কীচক, অশ্বত্থামা—এদের সঙ্গে সংকেতের কী সম্পর্ক?’

‘সেই কথাই তো আমিও ভাবছি…’

ফেলুদা আবার প্যাডের দিকে চাইল। তারপর বলল, ‘অবিশ্যি এই কাগজের সব ক’টা নামই যে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত, এটা ভাবার কোনও কারণ নেই। এবং এগুলো যে একই সময় লেখা সেটাও ভাবার কোনও কারণ নেই। এই দেখুন—কীচক আর নারায়ণী ডট পেন দিয়ে লেখা। দেখলেই বুঝতে পারবেন। কালির রং সবই এক বলে মনে হয়, কিন্তু অন্য লেখাগুলোর নীচের দিকের টানগুলো ঈষৎ মোটা— যেটা ডট পেনে কখনো হয় না।’

লালমোহনবাবু প্রায় গোয়েন্দার মতো করে কাগজটার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘তা হলে কীচক আর নারায়ণীর সঙ্গে সংকেতের—’

কথাটা শেষ হবার আগেই দরজার দিক থেকে গম্ভীর গলায় কথা এসে পড়ায় লালমোহনবাবু চমকে উঠে হাত থেকে প্যাডটা ফেলেই দিলেন।

‘কীচকদের নিয়ে কথা হচ্ছে কি?’

দেবতোষবাবু।

পরদা ফাঁক হল। ভদ্রলোক ভিতরে ঢুকে এলেন। আবার সেই বেগুনি ড্রেসিং গাউন। ভদ্রলোকের কি আর কোনও জামা নেই? ফেলুদা বলল, ‘আসুন দেবতোষবাবু, ভিতরে আসুন।’ ভদ্রলোক ফেলুদার কথায় কান না দিয়ে একটা প্রশ্ন করে বসলেন।

‘পৃথুরাজা দীঘির জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছিলেন কেন জান?’

‘আপনি বলুন। আমরা জানি না।’ ফেলুদা বলল।

‘কারণ কীচকদের সংস্পর্শে এসে পাছে ধর্মনাশ হয়, সেই ভয়ে।’

‘কীচক একটা জাতির নাম?’ ফেলুদা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

‘যাযাবর জাতি। জঙ্গলে গেলে একবার একটু খোঁজ করে দেখো তো তারা এখানে আছে কি না! বনমোরগ শিকার করত তীর-ধনুক নিয়ে।’

‘নিশ্চয়ই দেখব খোঁজ করে’, ফেলুদা খুব স্বাভাবিকভাবে বলল। তারপর বলল, ‘আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি কি?’

দেবতোষবাবু কেমন যেন অবাক ফ্যালফ্যালে ভাব করে ফেলুদার দিকে চাইলেন।

‘জিজ্ঞেস করবে? আমাকে তো কেউ জিজ্ঞেস করে না!’

‘আমি করছি। এখানে প্রাচীন গাছ বলতে কোনও বিশেষ গাছ আছে কি? আপনি স্থানীয় ইতিহাস ভাল করে জানেন বলেই আপনাকে জিজ্ঞেস করছি।’

‘প্রাচীন গাছ?’

‘হ্যাঁ। মানে এমন গাছ, যাকে লোকে বুড়ো গাছ বলে জানে।’

‘প্রাচীন গাছ’ শুনে, দেবতোষবাবুর ঘোলাটে চোখ আরও ঘোলাটে হয়ে গিয়েছিল, এখন হঠাৎ জ্বলজ্বল করে উঠল।

‘বুড়ো গাছ? তাই বলো। প্রাচীন গাছ আর বুড়ো গাছ কি এক হল? বুড়ো নাম তো শুধু বয়সে বুড়ো বলে নয়। গাছের গায়ে একটা ফোকর আছে, সেটা দেখতে ঠিক একটা ফোক্‌লাদাঁত বুড়োর হাঁ করা মুখের মতো। সেই গাছের নীচে ঠাকুরদাদার সঙ্গে গিয়ে চড়ুইভাতি করেছি। ঠাকুরদাদা বলতেন ফোক্‌লা ফকিরের গাছ।’

‘গাছটা কী গাছ?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

‘কাটা ঠাকুরানীর মন্দির দেখেছ? সে-ও রাজুর হাত থেকে নিস্তার পায়নি। সেই মন্দিরের পশ্চিমদিকে হল ফোক্‌লা ফকিরের গাছ। অশ্বত্থ গাছ। সেই গাছেই একদিন মহী—’

‘দাদা, চলে এসো!’

দেবতোষবাবু কথা শেষ করতে পারলেন না। কারণ মহীতোষবাবু দরজার বাইরে থেকে তাঁর বাজখাঁই গলায় হাঁক দিয়েছেন। পরদা আবার ফাঁক হল। মহীতোষবাবু গম্ভীর মুখ করে ঘরে ঢুকলেন। বুঝলাম সেই কঠিন মানুষটা আবার বাইরে বেরিয়ে এসেছে।

‘তোমার ওষুধ খাবার কথা; খেয়েছ?’

‘ওষুধ?’

‘মন্মথ দেয়নি?’

দেবতোষবাবুর জন্য একজন আলাদা চাকর আছে, নাম মন্মথ।

‘আমি তো ভাল আছি, আবার ওষুধ কেন? আমার মাথার যন্ত্রণা—’

মহীতোষবাবু তাঁর দাদাকে এক রকম জোর করেই ঘাড় ধরে ঘর থেকে বার করে নিয়ে গেলেন। বাইরে থেকে ছোট ভাইয়ের ধমক শুনতে পেলাম।

‘ভাল আছ কি না-আছ সেটা ডাক্তার বুঝবে। তোমাকে যা ওষুধ দেওয়া হয়েছে, সেটা তুমি খাবে।’

গলা মিলিয়ে এল; আর সেই সঙ্গে পায়ের শব্দও।

‘ভদ্রলোককে সত্যিই কিন্তু আজ অনেকটা স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছিল। মন্তব্য করলেন লালমোহনবাবু। ফেলুদার কানে যেন কথাটা গেলই না। সে আবার বিড়বিড় শুরু করেছে।

‘অশ্বত্থ গাছে…অশ্বত্থ গাছ…অশ্বত্থ…। কিন্তু মুড়ো হয় কেন? মুড়ো হয় বুড়ো গাছ…মুড়ো হয়…’

হঠাৎ হাত থেকে খাতাটা প্রচণ্ড জোরে বিছানায় ফেলে দিয়ে ফেলুদা লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে উঠল—‘হয়! হয়! হয়! হয়!’

‘কী হয়?’ লালমোহনবাবু যথারীতি ভ্যাবাচ্যাকা।

‘বুঝতে পারছেন না? মুড়ো হয় বুড়ো গাছ। তার মানে বুড়ো গাছ, তার মুড়ো, মানে মুণ্ডু, অর্থাৎ গোড়া—হল হয়।’

‘হল হয়? সে আবার কী?’ লালমোহনবাবু আরও হতভম্ব। সত্যি বলতে কী, আমারও মনে হচ্ছিল ফেলুদা একটু আবোল তাবোল বকছে। এবার ফেলুদা যেন বেশ বিরক্ত হয়েই লালমোহনবাবুর দিকে চোখ পাকিয়ে গলা উঁচিয়ে বলল, ‘আপনি না সাহিত্যিক? “হয়” মানে জানেন না? ঘোড়া, ঘোড়া, ঘোড়া। হয় মানে ঘোড়া। হয় মানে অশ্ব। বুড়ো গাছের গোড়া হল অশ্ব। আরও বলতে হবে?’

‘অশ্বত্থ!’ চেঁচিয়ে উঠলেন লালমোহনবাবু।

‘অশ্বত্থ। তড়িৎবাবু অশ্বত্থই লিখেছিলেন এমনি কলম দিয়ে, আর পরে খেয়ালবশত আ-কার আর মা জুড়ে দিয়েছেন ডট পেন দিয়ে। আর আমি ভাবছি মহাভারত। ছি ছি ছি ছি!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *