সরকারের অপচয় : রাজনৈতিক অর্থনীতি
১. ভূমিকা
প্রখ্যাত মার্কিন রসিক উইল রজার্সকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে তিনি কীভাবে এত মজার মজার ঘটনা খুঁজে বের করেন। উইল রজার্স জবাব দেন, কাজটি খুবই সোজা; আমার কিছুই করতে হয় না। যা করার সরকার তার লোকলস্কর নিয়ে নিজেই করে। আমি শুধু সরকারের কাজ পর্যবেক্ষণ করি। তারপর বিন্দুমাত্র রং না চড়িয়ে যা ঘটে তা-ই বলি। তাতেই সবাই হাসতে থাকে। উইল রজার্সের বক্তব্য অনুসারে যত দিন পৃথিবীতে সরকার নামক প্রতিষ্ঠানটি থাকবে, তত দিন হাসির ঘটনার অভাব হবে না। রসিকপ্রবরের এ বক্তব্য একই সঙ্গে ঠিক ও বেঠিক। ঠিক এ জন্য যে প্রতি মুহূর্তে পৃথিবীর সব সরকারের দ্বারাই অসংখ্য তামাশা ঘটছে। বেঠিক এজন্য যে সরকারের সব কৌতুকপ্রদ কাণ্ড-কীর্তি হাসির ঘটনা নয়। যারা এসব কৌতুকের শিকার তাদের জন্য এসব তামাশা অনেক ক্ষেত্রেই মর্মান্তিক বিয়োগান্ত নাটক। সম্পদের অভাবে সরকার অনেক দুঃখী মানুষের সর্বনিম্ন পর্যায়ের অধিকার ও সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করতে পারে না। অথচ অপচয়ের জন্য সরকারের অর্থের অভাব হয় না। এ কথা ভাবতেও একই সঙ্গে হাসি পায় ও রাগ হয়।
সরকারি অর্থের অপচয় সব দেশেই কম-বেশি ঘটে। তবে যেসব দেশে সরকার ধনী, সেসব দেশে পেল্লায় অপচয়ের সম্ভাবনা বেশি। অপচয়ের কথা উঠলেই প্রথমে উইল রজার্সের জন্মভূমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম মনে পড়ে। শুরুতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিছু সরকারি অপচয়ের উদাহরণ তুলে ধরছি।
ক) নেব্রাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ে পশু চিকিৎসা বিভাগে গবাদিপশুর মূত্রত্যাগের অভ্যাস সম্পর্কে একটি গবেষণা প্রকল্পে মার্কিন সরকার ৩ মিলিয়ন ডলার বা ২৫ কোটি টাকা অনুদান প্রদান করে। যেকোনো প্রাণীর জন্য মূত্র ত্যাগ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ধরনের প্রকল্পে সরকারের অনুদান মোটেও অস্বাভাবিক নয়। তবে এ প্রকল্পের অস্বাভাবিক বিষয় হলো, গবেষণার প্রতিপাদ্য ও তার ফলাফল। গবেষকেরা জানতে চান যে গরু নদী পার হওয়ার সময়, না নদীতে নামার আগে প্রশ্রাব করে না নদী পার হওয়ার পর করে। ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে গবেষণাটি শেষ হওয়ার পর জানা গেল যে প্রকল্পে নিযুক্ত অধিকাংশ পর্যবেক্ষক গরুগুলি কখন নীরবে মূত্র ত্যাগ করে, তা ঠাহর করতে পারেনি (দুষ্ট লোকেরা বলে যে গবেষকদের অনেকে বান্ধবীদের নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলেন যে গরু কী, করছিল সেদিকে তারা খেয়াল রাখতে পারেননি। আবার অনেক গবেষক নদীর ধারেকাছেও যাননি।)। সুতরাং এ সম্পর্কে কিছু জানতে হলে আরেকটি প্রকল্পের প্রয়োজন হবে। বলা বাহুল্য, প্রকল্পটি ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি অপচয়ের নিকৃষ্টতম উদাহরণ হিসেবে সিনেটর প্রক্সমায়ার স্মারক পুরস্কারে ভূষিত হয়।
খ) ২০০৫ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ক্যাটরিনা যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক উপকূলে আঘাত হানে। এ সময় মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে ২৫ লাখ দুর্গত ব্যক্তিকে সাহায্য দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৯ লাখ উপকারভোগী ছিল ভুয়া। হিসাব করে দেখা গেছে, এ ধরনের ভুয়া সাহায্য প্রাপকেরা ২ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ত্রাণের অর্থ দিয়ে অনেকে বিদেশে প্রমোদভ্রমণে গিয়েছে। এমনকি ত্রাণের পয়সায় একজন অস্ত্রোপচার করে লিঙ্গ পরিবর্তন করেছে।
গ) সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর ইরাককে যে সাহায্য দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে ১৩ বিলিয়ন ডলার অপচয় করা হয়েছে। অতিরিক্ত ৭.৮ বিলিয়ন ডলার লাপাত্তা হয়ে গেছে। এভাবে শ্যাম চাচা বা আংকেল স্যামের মোট গচ্চা গেছে ২০.৮ বিলিয়ন ডলার বা ১৮ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা, যা বাংলাদেশের বার্ষিক স্থূল উৎপাদের দ্বিগুণের বেশি।
ঘ) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট দক্ষিণ চীনে পতিতাদের কীভাবে দায়িত্বের সঙ্গে স্বল্প মাত্রায় মদ্য পান করতে হয়, সে সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ২৬ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১৮৩ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। প্রকল্প-প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে চীনে এ গবেষণায় লব্ধ জ্ঞান পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহার করা সম্ভব হতে পারে।
ঙ) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে যেসব সরকারি কেনাকাটা করা হয় তার প্রায় অর্ধেকই ভুয়া ও প্রতারণামূলক। সরকারি ক্রেডিট কার্ড দিয়ে জুয়া খেলার দেনা শোধ করা হয়েছে। মদ কেনা হয়েছে, (বান্ধবীদের) সোনার অলংকারের দাম শোধ করা হয়েছে। এমনকি সরকারি অর্থে নৈশভোজ আয়োজিত হয়েছে। ডাক বিভাগের এক নৈশভোজে মাথাপিছু খরচ হয়েছে ১৬৭ ডলার বা প্রায় ১৪ হাজার টাকা।
চ) যারা কৃষিপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখার জন্য সরকারের নির্দেশে কৃষিজমি পতিত রাখে, তাদের ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের ভর্তুকি দেওয়া হয়। উপশহর এলাকায় যারা লনে ঘাস লাগায়নি তারাও এ সুবিধা দাবি করে ভর্তুকি পেয়েছে।
এ ধরনের অপচয়ের অজস্র উদাহরণ রয়েছে। এখানে একটি বিক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এ চিত্র মোটেও পূর্ণাঙ্গ নয়। তবু ওপরের উদাহরণগুলি থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে মার্কিন সরকারের কর্মকাণ্ডে বিপুল অপচয় রয়েছে। প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি আল গোর দাবি করতেন যে মার্কিন সরকারের ব্যয়ের ৪৮ শতাংশই অপচয় হয়ে থাকে (স্ট্যানবেরি উইলিয়াম ও ফ্রেড টমসন, ১৯৯৫, ৪১৮)।
বাংলাদেশে অপচয়ের পরিমাণ সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য হিসাব না থাকলেও এর ব্যাপকতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দক্ষিণ এশিয়ার একটি জনপ্রিয় প্রবাদ হলো, ‘সরকার কি মাল দরিয়া মে ঢাল’। অনুমান করি, সরকারের মাল এত তছরুপ হয় যে স্থলে তা লুকিয়ে রাখার জায়গা পাওয়া যায় না, তাই নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও ব্রিটিশ শাসকেরা দক্ষিণ aforico 990 fagyst af PWD (Public Works Department) (2/68 অপচয় ও দুর্নীতি দূর করতে পারেনি। তাই উনবিংশ শতাব্দীতে ভারতের ব্রিটিশ শাসকেরা ঠাট্টা করে বলতেন PWD-এর পূর্ণ নাম হলো Plunder Without Danger বা নির্ভয়ে লুট করো (মুন, পেন্ডেরেল, ১৯৮৯, ৮১৯)। স্মরণ করা যেতে পারে যে বর্তমানে প্রকৌশল-সংক্রান্ত যত মন্ত্রণালয় রয়েছে (যথা : সড়ক ও জনপথ, গণপূর্ত, পানি উন্নয়ন বোর্ড, রেলপথ, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন) সবই ছিল সে-সময় গণপূর্ত বিভাগের আওতায়।
অপচয়ের ক্ষেত্রে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে একটি বড় তফাত রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অপচয় অভিন্ন। উন্নত দেশগুলিতে দুর্নীতি ছাড়া অন্যান্য কারণেও অপচয় ঘটে । নেব্রাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবাদিপশুর মূত্রাভ্যাস নিয়ে গবেষণাতে দুর্নীতি ঘটেনি, তবে অপচয় ঘটেছে। অথচ বাংলাদেশে যেখানেই অপচয়ের অভিযোগ ওঠে, সেখানেই দুর্নীতি ঘটে। দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকার ২০১১ সালের ৬ অক্টোবর তারিখের নিম্নলিখিত প্রতিবেদনটি বিবেচনা করুন : ‘বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য সরকার গত বছর বেশ ঘটা করে দেশের ৩৮টি জেলায় যে এক কোটি পাঁচ লাখ এনার্জি সেভিং বাল্ব বিনা মূল্যে বিতরণ করেছিল এর ৮০ শতাংশই নষ্ট হয়ে গেছে বাতি জ্বালানোর এক সপ্তাহের মধ্যে। জলে গেছে ১০৩ কোটি টাকার প্রায় পুরোটাই ভেস্তে গেছে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের সাধের প্রকল্পটির প্রথম পর্ব। অথচ প্রতিটি বাতির আয়ুষ্কাল ছিল ১০০০০ ঘণ্টা যা এক নাগাড়ে চললেও ৪১৬ দিন পর্যন্ত টিকে থাকার কথা। অভিযোগ উঠেছে, দুর্নীতির মাধ্যমে নিম্ন মানের বাল্ব কেনার কারণেই এ কাণ্ড ঘটেছে। রাজধানীসহ বেশ কয়েকটি জেলায় কালের কণ্ঠএর সরেজমিন অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে এমন কথা। এখানে প্রকল্পটির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। প্রকল্পটির দোষে নয়, বরং দুর্নীতির জন্য সরকারের অর্থের নয়-ছয় ঘটল। আরেকটি ঘটনা বিবেচনা করুন। সপ্তম সংসদের স্বাস্থ্যবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদ কমিটি জানায় যে বেশ কয়েকজন সিভিল সার্জন হাসপাতালের জন্য বৈদ্যুতিক বাল্ক ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি বাজারের খুচরা দামের চেয়ে সাড়ে ছয় গুণ থেকে ২৫ গুণ বেশি দামে কিনেছে (বিশ্বব্যাংক, ২০০০, ২৩) এ ধরনের ঘটনা হরহামেশা ঘটছে। বিশ্বব্যাংকের (২০০০) প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে, ১৯৯৭-৯৮ সময়কালে সরকারি হিসাব কমিটি (Public Accounts Committee) ৪৯৭টি নিরীক্ষা-আপত্তি নিষ্পত্তি করে। এসব আপত্তির আর্থিক সংশ্লেষ ছিল ১ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা। ওই সময়ে বিবেচনাধীন আপত্তির সংখ্যা ছিল ৫৬ হাজার ৪১২। ৪১৭টি নিরীক্ষা আপত্তিতে যদি ১ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা জড়িত থাকে, তবে ৫৬ হাজারের বেশি আপত্তির আর্থিক সংশ্লেষ যে বিপুল হবে তা অতি সহজেই অনুমেয়। এ হিসাব করা হয়েছিল ২০০০ সালে। এখন তা অনেক বেড়ে গেছে। তবে নিরীক্ষায় সরকারি অপচয়ের অতি ক্ষুদ্র অংশ ধরা পড়ে। যথাযথ অনুমোদন নিয়ে অপচয় হলে তাকে সরকারি নিরীক্ষায় অপচয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয় না। নিরীক্ষাতে শুধু সরকারি খরচের অনিয়ম সম্পর্কে জানা যায়। কিন্তু সরকারের সম্পদের সব অপচয় নিরীক্ষা-প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হয় না। কাজেই অপ্রতুল উপাত্ত সত্ত্বেও এ কথা অনুমান করা মোটেও শক্ত নয় যে বাংলাদেশে সরকারি অপচয় অবিশ্বাস্যভাবে বিপুল।
বিশ্বব্যাপী সরকারের ভূমিকা সম্প্রসারিত হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে সরকারের ব্যয়ও বাড়ছে। যদিও উগ্র ডানপন্থী নেতারা দাবি করছেন যে তারা সরকারের ব্যয় হ্রাস করছেন, আসলে স্বাস্থ্যসেবা, বেকার ভাতা, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ও প্রতিরক্ষা খাতে খরচ বৃদ্ধির ফলে সরকারের ব্যয় অতি দ্রুত বাড়ছে। ২০০৯ সালে শিল্পোন্নত দেশগুলির স্কুল জাতীয় উৎপাদের ৩৯.৮ শতাংশ ব্যয় করেছে সরকার। অথচ ১৮৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এই হার ছিল ৮ শতাংশ; যুক্তরাজ্যে, ১০ শতাংশ; ফ্রান্সে, ১৫ শতাংশ; সুইডেনে ৬ শতাংশ। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে সরকারের ব্যয় ছিল স্কুল জাতীয় উৎপাদের ১১.৩ শতাংশ। তবে অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে যে শিল্পোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এই ব্যয় দ্রুত বাড়বে। সরকারের ব্যয় যত বাড়বে সরকারের অপচয়ও তত বাড়তে থাকবে। এই প্রেক্ষিতে সরকারের অপচয় নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনার প্রয়োজন রয়েছে।
সরকারে অপচয়ের ব্যাপকতার তুলনায় সমস্যাটি নিয়ে অত্যন্ত অপ্রতুল গবেষণা হয়েছে। এখন পর্যন্ত সরকারের অপচয়ের গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়নি। বর্তমান প্রবন্ধের লক্ষ্য দুটি। প্রথমত, সরকারি অপচয়ের মূল সমস্যাগুলি চিহ্নিত করা। দ্বিতীয়ত, সমস্যাগুলির সমাধান খুঁজে বের করা। প্রবন্ধটি চার ভাগে বিভক্ত। উপক্রমণিকার পর দ্বিতীয় খণ্ডে সরকারের অপচয়ের সংজ্ঞা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় খণ্ডে বিভিন্ন প্রকারের অপচয় চিহ্নিত করা হয়েছে। সর্বশেষ খণ্ডে এই নিবন্ধের মূল বক্তব্যগুলি চিহ্নিত করে সরকারি অপচয়ের সমাধান সম্পর্কে সুপারিশ করা হয়েছে।
২. সরকারি অপচয়ের সংজ্ঞা
অপচয়ের উদাহরণ দেওয়া যত সহজ, তার সংজ্ঞা নির্ধারণ তত সহজ নয়। ইংরেজি ভাষায় অপচয়ের সমার্থবোধক শব্দ হলো waste। এই শব্দটির উৎপত্তি হলো ল্যাটিন শব্দ wastus থেকে, যার শাব্দিক অর্থ হলো জমি পতিত ফেলে রাখা বা কৰ্ষণ না করা। বাংলা অপচয় শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ এর খুবই কাছাকাছি। সুকুমার সেন (২০০৩, ৭) জানাচ্ছেন, অপচয় শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো মূল্যবান দ্রব্য রক্ষা না করা। স্পষ্টতই, মূল্যবান সম্পদের যথাযথ ব্যবহারে ব্যর্থতা (জমি পতিত ফেলে রাখার মতো) অপচয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারে ব্যর্থতাই হচ্ছে অপচয়।
সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সরকারি অপচয়ের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা অত্যন্ত কঠিন। নিম্নলিখিত তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে অপচয়ের সংজ্ঞা নির্ণয় করা যেতে পারে :
• আইনগত
• অর্থনৈতিক
• নৈতিক
আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে অপচয়
আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে অপচয়ের দুটি দিক রয়েছে। প্রথমত, সরকারি ব্যয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন আছে কি না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারি অর্থ ব্যয় করতে হলে সংসদের অনুমোদন লাগে। এই অনুমোদন ছাড়া যেকোনো সরকারি ব্যয় অপচয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশে সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন, ২০০৯-এর ২(৪) ধারায় অপচয়ের নিম্নরূপ সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে : ‘অপচয় অর্থ বার্ষিক বাজেটে যে উদ্দেশ্যে (purpose) অর্থ বরাদ্দ প্রদান করা হইয়াছে সে উদ্দেশ্যে অর্থ ব্যয় বা ব্যবহার না করিয়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে অর্থ ব্যয় বা ব্যবহার করা। দ্বিতীয়ত, সরকারের ব্যয় ও ক্রয়সংক্রান্ত যেসব বিধিবিধান রয়েছে তা অগ্রাহ্য করে যেকোনো ব্যয় করলে তা অপচয় হিসেবে বিবেচিত হয়।
আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে অপচয়ের সংজ্ঞা স্পষ্ট কিন্তু অত্যন্ত সংকীর্ণ। এই সংজ্ঞার দুটি পূর্ব-অনুমান রয়েছে। প্রথমত, অনুমান করা হচ্ছে যে সরকার খারাপ কাজের জন্য অর্থ বরাদ্দ দিলেও তা ব্যয় করলে অপচয় হবে না। বরং সরকার যে উদ্দেশ্যে বরাদ্দ দিয়েছে সে উদ্দেশ্যে ব্যয় না করলে অপচয় হবে। ধরুন, সরকার জেলখানার কয়েদিদের ফাঁসি দেওয়ার জন্য বরাদ্দ দিল। সে অর্থ দিয়ে জেলে হাসপাতাল নির্মাণ করলে তা সরকারি অর্থের অপচয় হবে । কিন্তু উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের আদেশে নির্দোষ ব্যক্তিকে ফাঁসি দিলে আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে অপচয় হবে না। দ্বিতীয়ত, নির্ধারিত উদ্দেশ্যে অর্থ ব্যয় বা ব্যবহার করাই যথেষ্ট। এতে কোনো ফল না পাওয়া গেলে বা উলটো ফল পাওয়া গেলেও ব্যয়টি অপচয় হিসেবে বিবেচিত হবে না।
নৈতিক দিক থেকে এই দুটি অনুমানের একটিও গ্রহণযোগ্য নয়। বাজেটে বরাদ্দ অনুমোদন করেন সংসদ সদস্যরা বা রাজনীতিবিদেরা। এঁরা সব সময় জনস্বার্থে কাজ করেন না; অনেক সময় নিজেদের স্বার্থে কাজ করেন। মার্কিন সাংসদদের সম্পর্কে একটি সুন্দর চুটকি প্রায়ই শোনা যায়। ঘটনাটি হলো, একজন কংগ্রেসম্যান গভীর রাতে সংসদ ভবনের সামনে বিরাট মাঠ পেরিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। এমন সময় তিনি এক ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়েন। ছিনতাইকারী কংগ্রেসম্যানকে বলল, ‘দে ব্যাটা, তোর কাছে যা টাকা আছে তা আমাকে দিয়ে দে।’ কংগ্রেসম্যান বললেন, ‘জানো, তুমি কার সঙ্গে কথা বলছ? আমি একজন কংগ্রেসম্যান।’ ছিনতাইকারী বলল, ‘পিস্তলটা দেখেছিস? উলটাপালটা কিছু করলে শেষ করে দেব। দে, দে, টাকা দে। তোর পকেটের টাকার মালিক তুই নস। আমার মতো করদাতার টাকা তুই মেরেছিস। দে, আমার টাকাই আমাকে ফেরত দে।’
ছিনতাইকারী এই ক্ষেত্রে কিছুটা অতিরঞ্জন করেছে, কিন্তু একেবারে মিথ্যা বলেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাজেট চূড়ান্ত করেন সাংসদেরা। এই ক্ষমতা অপব্যবহার করে অনেক সংসদ সদস্যই নিজের স্বার্থ হাসিল করেন। এই প্রক্রিয়ার নগ্ন প্রকাশ দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাংসদদের নির্বাচনী এলাকায় ব্যয়ের জন্য বিপুল বরাদ্দে। এসব বরাদ্দে একমাত্র বিবেচনা রাজনীতি। এ ধরনের বরাদ্দ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে pork বা শূকর মাংস নামে পরিচিত। এই নাম এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চল থেকে। গৃহযুদ্ধের আগে শ্বেতাঙ্গ প্রভুরা শূকরের মাংসের যেসব অংশ তারা পছন্দ করত না, সেগুলি কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের দিয়ে দিত। দাসরা সে মাংস শুঁটকি করে মটকায় জমিয়ে রাখত। যখন খাওয়া কম পড়ত তখন এগুলি কাজে লাগত। এখনকার নির্বাচনী প্রতিনিধিরাও তাদের এলাকার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ জাতীয় বাজেট থেকে আলাদা করে রাখে। তাই নিজের নির্বাচনী এলাকার জন্য বিশেষ বরাদ্দ পর্ক বা শূকরের মাংস নামে পরিচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজেটে এ সমস্যা অত্যন্ত ব্যাপক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘পর্কের পরিমাণ’ সম্পর্কে তথ্য সারণি ৭.১ এ দেখা যাবে।
সারণি ৭১
মার্কিন বাজেটে ‘পর্কের পরিমাণ’
পর্ক-পদ্ধতিতে বাজেটে যেসব প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়, এগুলি অত্যন্ত নিম্ন মানের। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অর্থের অপচয় ঘটে। এই ব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও ১৯৯১-২০০৬ সময়কালে পর্কের পরিমাণ ও প্রকল্পের সংখ্যা স্ফীত হয়েছে। ২০০৬ সালে পর্কের বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের প্রায় ১.১ শতাংশ। অবশ্য সম্প্রতি এ ধরনের প্রকল্পের বরাদ্দে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা দিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, রাজনীতিবিদেরা ধোয়া তুলসীপাতা নন। বাজেটে ব্যয়ের বরাদ্দ সংসদ অনুমোদন করলেই সব ব্যয় হালাল হয়ে গেল, এ যুক্তি মানা শক্ত। সংসদ যদি অসৎ উদ্দেশ্যে কোনো বরাদ্দ করে, তবে তাকে অপচয় বলে গণ্য করা উচিত। কিন্তু আইন এ কথা মানে না। আইনগত সংজ্ঞায় সঠিক পদ্ধতি মেনে বরাদ্দ ব্যয় করলেই তা বৈধ বিবেচিত হবে।
অপচয়ের আইনগত সংজ্ঞার সুবিধা ও অসুবিধা দুটিই রয়েছে। সুবিধা হলো, এ ব্যবস্থায় ব্যয়ের ওপর জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা সুনিশ্চিত করা সম্ভব। আর অসুবিধা হলো, এ ব্যবস্থা অতি-কেন্দ্রীভূত এবং পরিস্থিতির নিরিখে পরিবর্তনের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত হয়ে পড়ে। প্রতিনিয়ত যথাযথ মূল্যায়ন না করলে এ ব্যবস্থায় অপচয় বাড়তেই থাকবে। এর ফলে গোটা বাজেট-প্রক্রিয়া অকার্যকর হয়ে পড়ে। এ ধরনের ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৩০-এর দশকে ঘটে। মার্কিন সেনাবাহিনীর ইউএস কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্সকে (U.S. Army Corps of Engineers) পানি-সংক্রান্ত অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দেখা যায়, সব সাংসদ তাঁদের নির্বাচনী এলাকায় নতুন নতুন অবকাঠামো দাবি করতে থাকেন। এত অবকাঠামোর অর্থায়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই ফেডারেল নৌপরিবহন আইন, ১৯৩৬ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৩৯ নির্দেশ দেয় যে ব্যয়-উপকার বিশ্লেষণের (Cost-Benefit Analysis) নিরিখে কোনো প্রকল্প গ্রহণযোগ্য না হলে তার অর্থায়ন করা যাবে না।
অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অপচয়
অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যেখানে ব্যয়ের পরিমাণ উপকারের আর্থিক পরিমাপের চেয়ে বেশি, সেখানে অর্থের অপচয় ঘটে। কিন্তু ব্যয়-উপকার বিশ্লেষণের (Cost-Benefit Analysis) কয়েকটি বড় ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। প্রথমত, উপকারের বর্তমান আর্থিক পরিমাপ নির্ভর করে বিকল্প বিনিয়োগের অনুমিত সুদের হার বা discount rate-এর ওপর। যদি সুদের হার কম হয়, তবে প্রকল্প সমাপ্তির অনেক পর যেসব উপকার পাওয়া যায় তার আর্থিক পরিমাপের বর্তমান মূল্য বেশি হবে। যদি সুদের হার বেশি হয়, তবে বর্তমান মূল্যে ভবিষ্যতে প্রাপ্য উপকারের আর্থিক পরিমাপ অনেক কমে যাবে। ধরুন, একটি সেচ প্রকল্পের ফলে ৫০ বছর পর ১০ লাখ টাকার বাড়তি ফসল পাওয়া যাবে। যদি সুদের হার ৬ শতাংশ থাকে, তবে ৫০ বছর পর প্রাপ্ত ১০ লাখ টাকা আজকের ৫৪ হাজার ২৮৮ টাকার সমান। যদি সুদের হার ১২ শতাংশ হয়, তবে ৫০ বছর পরের ১০ লাখ টাকার উপকার বর্তমান মূল্যে ৩ হাজার ৪৬০ টাকার সমান। এই ক্ষেত্রে সুদের হার অর্ধেক হলে ৫০ বছর পরের উপকার ১৫.৬ গুণ বেড়ে যায়। অনেক দেশেই সুদের হার কম ধরে ভবিষ্যৎ উপকারের পরিমাণ ফাপানো হয়।
দ্বিতীয়ত, কোনো প্রকল্পের ফলে ভবিষ্যতে কী উপকার হবে, সে সম্পর্কে অনেক উপাত্ত পাওয়া যায় না। এসব হিসাব অনুমানের ওপর করা হয়। যারা প্রকল্পের সমর্থক, তারা সুবিধাজনক অনুমান ব্যবহার করে উপকারের পরিমাণ অতিরঞ্জিত করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পানি-সংক্রান্ত অবকাঠামোর ব্যয় উপকার বিশ্লেষণ নিয়ে সিনেটর প্রক্সমায়ার (১৯৮০, ৯৩) যথার্থই বলেছেন, ‘The Corps of Engineers under pressure from Congress has become experts in inventing benefits. The fertility a project will immediately bring can be estimated overoptimistically, as with the value of the crop that will rise up ten, twelve or twenty years from now. Recreation benefit may be added.’ (7.7816457 07291 ay ইঞ্জিনিয়ার বাহিনী উপকার আবিষ্কারে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। একটি প্রকল্পে কত উর্বরতা অবিলম্বে বাড়বে তা অতি আশাবাদী অনুমানের ভিত্তিতে হিসাব করা যেতে পারে। ১০, ১২ বা ২০ বছর পর ফসলের মূল্য নিয়ে একই ধরনের অনুমান করা যেতে পারে। এমনকি বিনোদন খাতে উপকারও যোগ করা। যেতে পারে।)। এসব অতিরঞ্জিত হিসাব যে সঠিক নয়, তা এ মুহূর্তে প্রমাণ সম্ভব না-ও হতে পারে।
তৃতীয়ত, অনেক ক্ষেত্রেই ব্যয় কমিয়ে দেখানো হয়। পরিবেশদূষণসহ বহিঃপ্রভাবের (externalities) কুফল ব্যয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় না। অনেক ক্ষেত্রে ইচ্ছে করেই প্রকল্পের ব্যয় কম করে দেখানো হয়। একবার প্রকল্প শুরু হলে তা আর অসম্পূর্ণ রাখা যায় না। বাড়তি ব্যয় করে প্রকল্প সমাপ্ত করতে হয়। এ ঘটনা শুধু বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশেই ঘটে না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এসব প্রবণতা রোধ করা যাচ্ছে না। সিনেটর প্রক্সমায়ার (১৯৮০) দেখিয়েছেন যে সত্তরের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোর অব ইঞ্জিনিয়ারের ১৭৮টি প্রকল্পের মধ্যে ৮৩টি প্রকল্পে (মোট প্রকল্পের ৪৭ শতাংশ) প্রকৃত ব্যয় অনুমোদনের সময় অনুমিত ব্যয়ের দ্বিগুণের বেশি হয়েছে।
ব্যয়-উপকার বিশ্লেষণ, আপাতদৃষ্টিতে আকর্ষণীয় মনে হলেও এবং বাস্তবে এ ধরনের বিশ্লেষণের নিরিখে যাচাই-বাছাই অপচয় হ্রাসে সহায়ক হলেও অপচয় বন্ধের জন্য যথেষ্ট নয়। বরং ব্যয়-উপকার বিশ্লেষণের নামে অনেক সময় অগ্রহণযোগ্য প্রকল্প চালু হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদদের ভূমিকা একটি বহুল প্রচলিত চুটকি মনে করিয়ে দেয়। সেটি এরকম। একবার হিসাবরক্ষকের একটি চাকরির জন্য একজন গণিতজ্ঞ, একজন হিসাবরক্ষক ও একজন অর্থনীতিবিদ সাক্ষাৎকারে হাজির হন। প্রথমে ডাক পড়ল গণিতজ্ঞের । তাকে প্রশ্ন করা হলো, দুইয়ের সঙ্গে দুই যোগ করলে কত হয়? তিনি জবাব দিলেন, ‘চার।’ তাকে আবার জিজ্ঞেস করা হয়, এর কোনো ব্যতিক্রম আছে কি না। তাঁর সাফ জবাব হলো, ‘না।’ এবার হিসাবরক্ষককে ডেকে একই প্রশ্ন করা হয়। তিনি জবাব দিলেন, সাধারণত দুইয়ের সঙ্গে দুই যোগ করলে চার হয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫ অথবা ১০ শতাংশ এদিক-সেদিক হতে পারে। সবশেষে এলেন অর্থনীতিবিদ। তাকে যখন প্রশ্ন করা হলো, দুইয়ের সঙ্গে দুইয়ের যোগফল কত? তিনি নিজের চেয়ার থেকে উঠে প্রশ্নকর্তার কাছে চলে যান এবং তার কানে ফিসফিস করে প্রশ্ন করেন, স্যার, আপনি কত চান? বেশির ভাগ ব্যয়-উপকার বিশ্লেষণে যে ফলাফল প্রকল্পের উদ্যোক্তাদের
খুশি করে, তা-ই অনেক অর্থনীতিবিদ পরিবেশন করে থাকেন।
ব্যয়-উপকার বিশ্লেষণ নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। ব্যয়-উপকার বিশ্লেষণের মান উন্নত করার জন্য প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার পাঁচ থেকে ১০ বছর পর সমাপ্ত প্রকল্পগুলির ব্যয়-উপকার বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে, কোথায় কোথায় ভুল করা হয়েছে। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এ ধরনের বিশ্লেষণের মান বাড়াতে হবে। লাভজনক প্রকল্প নির্বাচনের আরেকটি সহজ উপায় হলো, সম্ভাব্য উপকারভোগীদের মতামত সংগ্রহ করা। যদি উপকারভোগীরা ব্যয়ের অংশ বহনে রাজি হন, তবে বুঝতে হবে যে প্রকল্পটির চাহিদা রয়েছে। জোগানতাড়িত প্রকল্পের পরিবর্তে চাহিদাতাড়িত প্রকল্পের ওপর জোর দেওয়া সমীচীন হবে।
অর্থনীতির একটি বড় দুর্বলতা হলো, অনেক বড় সমস্যা নিয়ে অর্থনীতিবিদেরা একমত নন। এখানে কে শুদ্ধ আর কে ভ্রান্ত তা নির্ণয় করা অত্যন্ত কঠিন। অর্থনীতি হলো একমাত্র শাস্ত্র, যেখানে সম্পূর্ণ বিপরীত। বক্তব্যের জন্য উভয় ঘরানার অর্থনীতিবিদদেরই নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এমনকি একই বছরে বিপরীতধর্মী বক্তব্যের জন্য দুজনকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৪ সালে একই সঙ্গে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান গুনার মিরদাল ও ফ্রিডরিক অগুস্ত ফন হায়েক। হায়েক ছিলেন মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবক্তা। মিরাল নিয়ন্ত্রিত ও নির্দেশ-অর্থনীতির সমর্থক। এঁদের একজনের পরামর্শ সঠিক হলে অন্যজনের বক্তব্য ভুল। তবু তারা দুজন একই সঙ্গে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
অপচয়ের অর্থনৈতিক তাৎপর্য নিয়েও অর্থনীতিবিদেরা বিভক্ত। যদিও দুষ্প্রাপ্য সম্পদের অপব্যবহারের কুফল নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে দ্বিমত নেই, তবু কেইনস ও তার অনুসারীরা মনে করেন যে অর্থনৈতিক মন্দার সময় সরকারের বাড়তি ব্যয় আপাতদৃষ্টিতে অপচয় মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ। কেইনসের অনুগামীরা বলে থাকেন, যদি দেশে বেকার সমস্যা প্রকট হয় এবং কর্মসংস্থানের জন্য ভালো কোনো প্রকল্প না থাকে, তবে সরকার বেকারদের গর্ত খুঁড়তে লাগিয়ে দিতে পারেন। বেকারদের আয় বাড়লে তাদের চাহিদা বাড়বে। এর ফলে উৎপাদন বাড়বে। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নতুন চাকরি সৃষ্টি হবে। গুণক প্রভাবে (Multiplier effects) মন্দার কালো মেঘ কেটে যাবে। যদি গর্ত খুঁড়লেও যথেষ্ট কর্মসংস্থান না হয়, তবে গর্তগুলি ভর্তি করুন এবং আবার নতুন করে গর্ত খুঁড়তে ও ভর্তি করতে থাকুন। একসময় গুণকের জাদুস্পর্শে মন্দা অতীত ইতিহাস হয়ে যাবে। বিনা প্রয়োজনে গর্ত খোঁড়া আর ভর্তি করা অপচয় মনে হতে পারে। কিন্তু কেইনসের মতে, বেকারদের জন্য কাজ সৃষ্টি করে সরকারের তথাকথিত অপচয় অর্থনীতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করে।
কেইনসের অনুগামী নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যানকে সম্প্রতি প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, বিশ্বব্যাপী বিরাজমান বর্তমান মহামন্দার (২০০৮ ২০১২) সমাধান কীভাবে করা যেতে পারে। ক্রুগম্যানের জবাব ছিল, সরকারের খরচ অনেক বাড়াতে হবে। তাকে আবার প্রশ্ন করা হলো, এ ধরনের ব্যয় বৃদ্ধির পক্ষে জনসমর্থন না থাকলে কী করা যাবে? ক্রুগম্যান পরামর্শ দিলেন, সারা পৃথিবীতে গুজব রটিয়ে দিন যে মহাশূন্য থেকে আজব জীবেরা পৃথিবী আক্রমণ করতে আসছে এবং এ আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য কোটি কোটি প্রহরীর প্রয়োজন। এই অজুহাতে একবার চাকরি সৃষ্টি করলে মন্দা কেটে যাবে। যখন ভোটাররা বুঝতে পারবে যে এ গুজব ভিত্তিহীন, তত দিনে মন্দা থাকবে না। এ ধরনের বক্তব্য হাসি-তামাশা নয়। অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এসব বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন অতিশ্রদ্ধেয় অর্থনীতিবিদেরা। কেইনস (১৯৬৪, ১২৯) নিজেই লিখেছেন, ‘Pyramid building, earthquakes, even wars may serve to increase wealth.’ (পিরামিড নির্মাণ, ভূমিকম্প এমনকি যুদ্ধ সম্পদ সৃষ্টি করতে পারে।)। ক্রুগম্যান কেইনস থেকে খুব দূরে যাননি। কেইনস বলেছিলেন যে যুদ্ধ অর্থনীতিকে চাঙা করে। ক্রুগম্যান বলছেন, ভুয়া যুদ্ধের প্রস্তুতিও মন্দা দূর করতে পারে।
উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে কেইনসের অনেক সমর্থক রয়েছেন। তারা সরকারে প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাকরি সৃষ্টির পক্ষে কেইনসের অর্থনৈতিক যুক্তির সঙ্গে নৈতিক যুক্তি যোগ করে থাকেন। তাঁরা বলছেন যে সরকারে অপ্রয়োজনীয় চাকরিও গুণক প্রভাবের (multiplier effects) ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সহায়ক হবে। তার চেয়েও বড় কথা হলো, দেশের মানুষকে বেকারত্বের দুর্বিষহ অভিশাপ থেকে মুক্তি দেওয়া সরকারের পবিত্র নৈতিক দায়িত্ব। কর্মবিহীন পদে বেকারদের চাকরি দিলে একই সঙ্গে অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করা ও বেকার মানুষের মুখে হাসি ফোঁটানো সম্ভব। কাজেই সরকারে উদ্বৃত্ত জনবল নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।
কেইনসের তত্ত্ব ব্যয়-উপকার বিশ্লেষণ পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেনি। এই বক্তব্য গতানুগতিক ব্যয়-উপকার বিশ্লেষণে অন্তর্ভুক্ত করতে হলে শুধু কর্মসংস্থানের উপকার পরিমাপের পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে বাজারদামে উপকারের আর্থিক মূল্য নির্ণয় করা সম্ভব নয়। এসব ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অথবা ছায়ামূল্য (shadow price) ব্যবহার করতে হবে। ছায়ামূল্য চোখে দেখা যায় না, অনুমানের ভিত্তিতে হিসাব করতে হয়। এ ধরনের হিসাব অনেক ক্ষেত্রে ত্রুটিমুক্ত হয় না। উপরন্তু সঠিক ব্যয়-উপকার বিশ্লেষণের জন্য যেসব উপাত্তের প্রয়োজন, তাও পাওয়া যায় না। আশা করা হয় যে ভুল হিসাব সংশোধন করতে করতে একপর্যায়ে নির্ভরযোগ্য হিসাব করা সম্ভব হবে।
তবে অপচয়ের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ আইনভিত্তিক অপচয়ের সংজ্ঞাকে অনেক সম্প্রসারিত করেছে। প্রথমত, অপচয়ের আইনি সংজ্ঞা শুধু সরকারি ব্যয়ে সীমাবদ্ধ। অর্থনৈতিক অপচয়ের সংজ্ঞায় আর্থিক বরাদ্দ ছাড়া অন্যান্য সম্পদও অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। যেমন ধরুন, রেলওয়ের অপচয় নির্ণয় করতে হলে শুধু ব্যয় পর্যালোচনা করলে চলবে না; ইতিপূর্বে ভূমি, রেললাইন, যন্ত্রপাতিসহ সব ধরনের বিনিয়োগের কতটুকু যথাযথ ব্যবহার করা হয়েছে তা বিবেচনায় নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, ব্যয়ের পরিমাণ শুধু বরাদ্দের ভিত্তিতে নির্ণয় করা যাবে না। বহিঃপ্রভাবের মোট ক্ষতিও বিবেচনায় নিতে হবে। তৃতীয়ত, যতক্ষণ একই সম্পদ ব্যবহার করে বাড়তি উপকার সৃষ্টি করা সম্ভব ততক্ষণ পর্যন্ত অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অপচয় থেকে যাবে। স্ট্যানবেরি ও টমসন (১৯৯৫, ৪১৯) তাই বলছেন, ‘In other words, waste is the difference between what we get on average and the best we get in practice.’ (আমরা গড়ে যা পাই আর যা পাওয়া সম্ভব–এই দুইয়ের ব্যবধানই হচ্ছে অপচয়)। আইনি সংজ্ঞায় আদর্শ ও বাস্তবের মধ্যে কোনো ব্যবধান নেই। তাই আইনি সংজ্ঞায় সরকার যে ব্যয় বরাদ্দ করেন তা সঠিকভাবে খরচ করলে। কোনো অপচয় হয় না।
নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অপচয়
অপচয়ের অর্থনৈতিক সংজ্ঞা অপ্রয়োজনীয় কাজে সম্পদ বরাদ্দ চিহ্নিত করে। অপচয়ের আইনি সংজ্ঞায় অননুমোদিত ব্যয় বন্ধের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কিন্তু ব্যয় বরাদ্দ আইনগত ও অর্থনৈতিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য হলেও বাস্তবায়নের ব্যর্থতার ফলে অপচয় ঘটতে পারে। ম্যাককিনসি তাই অপচয়ের নিম্নরূপ সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন, ‘the unnecessary costs that result from inefficient or ineffective practices, systems or controls.’ (অযোগ্য অথবা অকার্যকর রীতিনীতি, ব্যবস্থা অথবা নিয়ন্ত্রণের ফলে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়)। সাধারণত অনুমান করা হয়, ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার ফলে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ঘটে। ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার মূল কারণ পদ্ধতির ত্রুটি নয়। এর মূল কারণ হলো, ব্যবস্থাপকদের নিষ্ঠার ও যত্নের অভাব। ব্যবস্থাপকেরা নিজের সম্পদের যত যত্ন নেন, সরকারের সম্পত্তির তত খোঁজখবর নেন না। ব্যবস্থাপনার চেয়েও বড় সমস্যা এখানে নৈতিক। বাংলাদেশের সাধারণ অর্থনৈতিক বিধির (General Financial Rules) ১০(১) বিধিতে তাই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ‘Every public officer is expected to exercise the same vigilance in respect of expenditure incurred from public moneys as a person of ordinary prudence would exercise in respect of expenditure of his own money.’ (সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে সব গণকর্মকর্তা এমন সতর্কতা অবলম্বন করবেন, যা প্রতিটি কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি নিজের অর্থের বিষয়ে করে থাকেন)। এই নৈতিক দায়িত্ব সব সরকারি কর্মকর্তা পালন করলে অপচয় অনেক কমে যেত। দুর্ভাগ্যবশত, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ দায়িত্ব। প্রতিপালিত হয় না।
ওপরের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, অপচয় একটি বহুমাত্রিক ধারণা। এর তিনটি প্রধান মাত্রার কোনোটিই উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। যদি আইনি অপচয় ঘটতে থাকে, তবে আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। যদি অর্থনৈতিক অপচয় রোধ না করা যায়, তবে সীমিত সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে না। যদি সম্পদ ব্যবহারকারী সরকারি কর্মকর্তাদের নৈতিক আচরণে ঘাটতি থাকে, তবে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, যার ফলে সম্পদের অপব্যবহার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিরোধ করা যাবে না। অপচয়ের তাই কোনো সহজ সংজ্ঞা নির্ধারণ সম্ভব নয়। যখনই অপচয় দেখা যায় তা রোধ করতে হবে। স্ট্যানবেরি ও টমসন। (১৯৯৫) তাই যথার্থই বলেছেন, অপচয়ের সংজ্ঞা নির্ধারণই হচ্ছে অপচয় হ্রাসের প্রথম পদক্ষেপ।
৩. অপচয়ের প্রকারভেদ ও এর তাৎপর্য
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি স্টুয়ার্ট পটার ১৯৬৪ সালে একটি মামলায় অশ্লীলতা সম্পর্কে যা বলেছেন তা অপচয়ের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। জাস্টিস পটার বলেছেন যে অশ্লীলতার সংজ্ঞা কী তা তিনি জানেন না। তবে অশ্লীলতা যখন তার চোখের সামনে পড়ে তখন তিনি তা ঠিকই চিনতে পারেন। অপচয়ের পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা প্রণয়ন দুরূহ হলেও অপচয় ঘটলে তা সহজেই চিহ্নিত করা যায়। তাই অপচয়ের সম্যক উপলব্ধির জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন অপচয়ের বিভিন্ন প্রকার বা রূপ চিহ্নিত করা । স্ট্যানবেরি ও টমসন নিম্নলিখিত নয় প্রকৃতির অপচয় চিহ্নিত করেছেন :
১) কারিগরি দিক থেকে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারে ব্যর্থতা (Technical inefficiency or X-inefficiency) : কারিগরি অদক্ষতা তখনই দেখা দেয়, যখন সর্বনিম্ন খরচে সর্বোচ্চ উৎপাদন অর্জন সম্ভব হয় না। মূলত ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা থেকে এ অপচয়ের উদ্ভব হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বেসরকারি খাত কম ব্যয়ে যে কাজ করতে পারে সরকারি খাতে তা করতে অনেক বেশি খরচ হয়। যেমন ধরুন, ফোর্ড মোটর কোম্পানিতে কেনাকাটার জন্য যে পরিমাণ জনবল লাগে, একই কাজ করতে মার্কিন নৌবাহিনীতে তার চার গুণ লোক লাগে। তার কারণ, ফোর্ড মোটর কোম্পানিতে ক্রয়ের জন্য তিন থেকে সর্বাধিক নয়টি স্তরের অনুমোদনের দরকার। মার্কিন নৌবাহিনীতে একই কাজে গড়ে ৩৫ জন কর্মকর্তার অনুমতি লাগে। এর একটি বড় কারণ হলো, সরকার ও বেসরকারি খাতের লক্ষ্য ও পদ্ধতির মধ্যে বড় ধরনের ফারাক রয়েছে।
২) সঠিক মূল্য নির্ধারণে ব্যর্থতার ফলে সম্পদের অপচয় (Allocative inefficiency or doing too much or too little) : প্রকৃত উৎপাদন ব্যয়ের কম মূল্যে কোনো পণ্য বা সেবা বিক্রয় করলে তা প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যবহৃত হবে এবং তাতে সম্পদের অপচয় ঘটে। আবার মূল্য বেশি নির্ধারণ করলে প্রয়োজনের তুলনায় উৎপাদন কম হবে। এর ফলে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় না।
৩) ভ্রান্ত বিনিয়োগ (Allocative inefficiency or doing the wrong things): সরকারে প্রধানত তিন ধরনের ভ্রান্ত ব্যয় দেখা যায়। প্রথমত, অনেক ব্যয় করা হয় যার ফলে প্রকৃতপক্ষে কারও কোনো লাভ হয় না। ধরুন, সরকার একটি পাঠাগার চালাচ্ছে, যেখানে দিনে গড়ে একজন লোকও যায় না। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি সম্পদের অপচয়। দ্বিতীয়ত, অসম্ভব কিছু করার জন্য অর্থ ব্যয় করা নিছক অপচয়। তৃতীয়ত, সাংসদদের চাপে অনেক সময় নেব্রাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবাদিপশুর মূত্র ত্যাগের অভ্যাসের মতো (ওপরে উল্লেখিত) প্রকল্প নেওয়া হয়।
৪) সরকারি কর্মকাণ্ডের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (Spillover effects) : সরকারের প্রায় সব ধরনের কর্মকাণ্ডেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। যেমন ধরুন, সরকার আয়কর আরোপ করলে এর প্রভাব শুধু কর প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। করদাতাদের হিসাব তৈরির জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। ১৯৯৩ সালের একটি হিসাব থেকে দেখা যায় যে আয়করসংক্রান্ত কাগজপত্র তৈরির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করদাতাদের আয়করের অতিরিক্ত ১৫ হাজার কোটি ডলার ব্যয় করতে হয়েছে। এর একটি বড় অংশ অপ্রয়োজনীয়। এ ছাড়া কর আরোপের ফলে অনেক করদাতা নিরুৎসাহিত হয়ে উৎপাদন কমিয়ে দেন। আবার অনেকে কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য সম্পদের অপচয় করেন। এ ধরনের সব অনভিপ্রেত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অপচয়ের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। আরেকটি হিসাব থেকে দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শেয়ার-সংক্রান্ত আইনকানুন মানতে ৪০ হাজার কোটি ডলার ব্যয় হয়। যেহেতু এসব ব্যয় সরকারের বাজেটে প্রতিফলিত হয় না, সেহেতু অনেকে ধরে নেন যে এ ধরনের কোনো খরচ নেই। এ ধারণা একেবারে ভুল। তাই এ ধরনের অপচয় বিবেচনায় নেওয়া বাঞ্ছনীয়। সরকারের বিধিবিধান এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে সরকারের নিয়ম প্রতিপালনের ব্যয় (Compliance Cost) সর্বনিম্ন পর্যায়ে থাকে।
৫) অলস সম্পদ (idle asset) : সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বিভিন্ন ধরনের সম্পদ রয়েছে। অথচ এসব সম্পদ যথাযথভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। কোথাও কোথাও অব্যবহৃত নগদ অর্থ রয়েছে। এসব অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা হলে সরকারের ঋণের পরিমাণ কমে যেত এবং এতে সরকারের সুদ বাবদ ব্যয় কমে যেত। এই অলস অর্থের জন্য সরকারের সুদ বাবদ অপচয় হচ্ছে। আবার কোনো কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিপুল পরিমাণ অব্যবহৃত জমি রয়েছে। এসব জমি ব্যবহারে ব্যর্থতা সম্পদের অপচয়। কোনো কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনের অনেক বেশি যন্ত্রপাতি ও ব্যবহার্য পণ্য রয়েছে। এতেও সম্পদের অপচয় ঘটে। সরকারের অব্যবহৃত ও অলস সম্পদের ফলে বিপুল পরিমাণ অপচয় হচ্ছে।
৬) দুর্নীতি, প্রতারণা, চুরি ও লাল ফিতা (Corrruption, Fraud, Theft and Red tape) : দুর্নীতি, প্রতারণা ও সরকারি সম্পদের চুরির সঙ্গে অপচয়ের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে অপরাধীদের যা লাভ হয়, তার চেয়ে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয় অনেক বেশি। যদি ঘুষ দিয়ে লাভ না হয়, তবে কেউ ঘুষ দেবে না; তারা রাষ্ট্রের পাওনা রাষ্ট্রকেই শোধ করবে। তাই ঘুষখোরকে ঘুষদাতার জন্য লাভের সুযোগ সৃষ্টি করতে হয়।
দ্বিতীয়ত, দুর্নীতি, প্রতারণা ও চুরি রোধ করতে রাষ্ট্রকে সরকারি ব্যয়ের নজরদারির জন্য প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে হয়। এতে দুই ধরনের অপচয় ঘটে। প্রথমত, নজরদারির জন্য অতিরিক্ত প্রশাসনিক ব্যয় বাড়ে। দ্বিতীয়ত, সরকারি নজরদারিকে কেন্দ্র করে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য দেখা দেয়। লাল ফিতার উৎপত্তি হয় সরকারের কর্মকাণ্ডের জবাবদিহি নিশ্চিতকরণের জন্য সৃষ্ট বিধি ও পদ্ধতি থেকে। একবার কোনো বিধি ও পদ্ধতি সৃষ্টি হলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হলেও তার কোনো পরিবর্তন হয় না। কাজেই কোনো বিধি ও পদ্ধতির প্রয়োজন না থাকলেও তা বহাল থাকে। এসব অপ্রয়োজনীয় বাধানিষেধ সিদ্ধান্ত গ্রহণকে বিলম্বিত করে। যুক্তরাষ্ট্রে হিসাব করে দেখা গেছে যে সরকারের বিধিবিধান প্রয়োগের নজরদারিতে সরকার এক টাকা ব্যয় করলে কাগজপত্র তৈরি করার জন্য বেসরকারি খাতের ব্যয় হয় ১০ টাকা। কাজেই এ খাতে বেসরকারি খাতের অপচয় বিপুল।
৭) ত্রুটিপূর্ণ সরকারি উদ্যোগ (Leaky Bucket): অনেক ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ দিল্লির লাড়ুর মতো। দিল্লির লাড়ু সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, এটি না খেলে দুঃখ থাকবে আবার খেলেও দুঃখ হবে। সরকারকে অনেক ব্যবস্থা নিতে হয়, যা স্পষ্টতই ত্রুটিপূর্ণ, অথচ এসব ব্যবস্থা না নেওয়াও সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। একটি উদাহরণ হলো বেকার ভাতা। যখন বেকারের সংখ্যা বাড়ে তখন তাদের ভাতা না দিলে তাদের জন্য বেঁচে থাকাই একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। আবার বেকার ভাতা পেলে অনেক বেকার কাজ না করে বেকার থাকাই পছন্দ করে। এ ধরনের ব্যক্তিদের জন্য বেকার ভাতা অর্থের অপচয়। অন্যদিকে এ ভাতা তুলে দিলে অনেক যোগ্য সাহায্যপ্রার্থী দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
৮) সরকারি সামাজিক নিরাপত্তা ও ত্রাণ কর্মসূচিতে অপচয় (Wasteful Transfer): সরকার যোগ্য গরিব ও দুস্থ মানুষের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করে। অনেক সময় দেখা যায় যে এসব প্রকল্পে রাজনৈতিক প্রভাব খাঁটিয়ে সচ্ছল ব্যক্তিরা গরিবদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ আত্মসাৎ করে। এই ক্ষেত্রে সম্পদের অপচয় ঘটে।
৯) অনুপার্জিত মুনাফার ফলে অপচয় (Waste Attributable to Rent Seeking): যেকোনো ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকলে অথবা সরকারের অনুমতির প্রয়োজন থাকলে অনুপার্জিত মুনাফার সুযোগ সৃষ্টি হয়। যাদের নাম করে এসব নিয়ন্ত্রণ করা হয় তারা কিন্তু এর ফলে লাভবান হয় না; লাভ কুক্ষিগত করে মধ্যস্বত্বভোগীরা। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, যেখানেই সরকার ‘পারমিট’ বা ‘লাইসেন্স’ প্রবর্তন করে, সেখানেই সরকারি কর্মচারীরা ঘুষ আদায়ের জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। এই নিবন্ধের বিশ্লেষণ থেকে এ কথা স্পষ্ট যে সরকারি অর্থের অপচয় শুধু সরকারের বাজেট বরাদ্দের মধ্যে সীমিত নয়। অপচয়ের ব্যাপকতা বাজেটের চেয়ে অনেক বিস্তৃত। অর্থনীতির পরতে পরতে অপচয় ছড়িয়ে রয়েছে। তবে সামগ্রিক অপচয়ের পরিমাপ নির্ণয় করা অত্যন্ত দুঃসাধ্য। অনেক অপচয়ই দৃশ্যমান নয়। এসব ক্ষেত্রে অপচয়ের পরিমাপ একেবারেই অনুমানের ওপর নির্ভরশীল।
উইলিয়াম স্ট্যানবেরি ও ফ্রেড টমসন কারণের ভিত্তিতে অপচয়কে নয় ভাগে বিভক্ত করেছেন। ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অরিয়ানা বান্দিয়েরা ও তাঁর সহকর্মীরা মনে করেন যে অপচয়ের ফলে কাদের স্বার্থ সিদ্ধি হয় তার ভিত্তিতে অপচয়কে দুই ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। তাদের মতে, দুই ধরনের অপচয় হলো : (১) সক্রিয় অপচয় ও (২) নিষ্ক্রিয় অপচয়। সক্রিয় অপচয় তখনই ঘটে যখন কেউ ইচ্ছে করে লাভের জন্য অপচয় ঘটায়। সরকারি ক্রয়ে দুর্নীতি এই শ্রেণীর অপচয়ের অন্তর্ভুক্ত। নিষ্ক্রিয় অপচয়ে কারও লাভ হয় না। এ ধরনের অপচয় কয়েকটি কারণে ঘটতে পারে। প্রথমত, যারা সরকারি অর্থ। ব্যয় করেন তারা কীভাবে সর্বনিম্ন ব্যয়ে কাজ করতে হয়, তা জানেন না। অর্থাৎ তাদের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। দ্বিতীয়ত, সরকারি কর্মকর্তাদের নিজেদের লাভের সম্ভাবনা থাকলে তারা সরকারি অর্থের অপচয় নিয়ে মাথা ঘামান না। তৃতীয়ত, অপচয় রোধের জন্য সরকারের জারি করা বিধি ও নিয়ন্ত্রণগুলি সিদ্ধান্ত বিলম্বিত করে। সরকারি কর্মকর্তারা অপচয় রোধের চেয়ে বিধিবিধান প্রতিপালনের ওপর বেশি জোর দেন। কাজেই অপচয় হ্রাসের জন্য কেউ উদ্যোগ নিতে সাহস পায় না। অরিয়ানা বান্দিয়েরা ও তাঁর সহকর্মীরা (২০০৯) ইতালিতে ২০০০ থেকে ২০০৫ সময়কালে সরকারি ক্রয়ে সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় অপচয় সম্পর্কে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেন। এই সমীক্ষার মূল বক্তব্যগুলি নিম্নরূপ:
১) ইতালিতে সরকারি কেনাকাটায় অপচয়ের ফলে জাতীয় আয়ের ১.৬ থেকে ২.১ শতাংশ ক্ষতি হয়।
২) অপচয়ের সিংহভাগই নিষ্ক্রিয় অপচয়। এই হিসাব অনুসারে নিষ্ক্রিয় অপচয় হচ্ছে মোট অপচয়ের ৮২ শতাংশ। এর তাৎপর্য হলো যে ইতালিতে সরকারি কেনাকাটায় অপচয়ের মূল কারণ দুর্নীতি নয়। দুর্নীতি অবশ্যই রয়েছে, তবে এ ক্ষেত্রে প্রধান কারণ হলো অদক্ষতা ও অযোগ্যতা।
৩) নিষ্ক্রিয় অপচয় সবচেয়ে বেশি দেখা যায় কেন্দ্রীয় সরকারে। আঞ্চলিক সরকারে নিষ্ক্রিয় অপচয় কেন্দ্রীয় সরকারের নিষ্ক্রিয় অপচয়ের চেয়ে কম। তার চেয়েও কম অপচয় ঘটে স্থানীয় সরকারে। সবচেয়ে কম নিষ্ক্রিয় অপচয় ঘটে বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতালের মতো স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে। এ ধরনের স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তাদের ঐচ্ছিক ক্ষমতা বেশি থাকে। এতে প্রমাণিত হয় যে কর্মকর্তাদের ঐচ্ছিক ক্ষমতা
বাড়ালেই দুর্নীতি বাড়ে না। উপরিউক্ত গবেষণার ফলাফল শুধু ইতালির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, অন্যান্য দেশেও একই ঘটনা ঘটছে। তবে এ সম্পর্কে অন্যান্য দেশের উপাত্তের ভিত্তিতে আরও গবেষণা প্রয়োজন।
উপরিউক্ত বিশ্লেষণগুলিতে যেসব অপচয় চিহ্নিত হয়েছে, সেগুলোর কারণ মোটা দাগে পাঁচ ভাগে চিহ্নিত করা যেতে পারে। প্রথমত, দুর্নীতির কারণে অপচয় ঘটতে পারে। দ্বিতীয়ত, অদক্ষতা ও অযোগ্যতা অপচয়ের জন্ম দিতে পারে। তৃতীয়ত, সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব অপচয় সৃষ্টি করতে পারে। চতুর্থত, অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্পের একই সঙ্গে ভালো ও খারাপ প্রভাব থাকতে পারে। এসব ক্ষেত্রে অপচয়ের ঝুঁকি সত্ত্বেও প্রকল্প নেওয়া হয়। পঞ্চমত, অতিরিক্ত বিধিনিষেধ অপচয়ের কারণ হতে পারে। উপরিউক্ত বিশ্লেষণের একটি প্রধান দুর্বলতা হলো, এখানে রাজনৈতিক অর্থনীতিকে সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য করা হয়েছে।
অনেকে মনে করেন যে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে অদক্ষতা বা ব্যক্তিদের লোভ-লালসা থেকে অপচয়ের সৃষ্টি হয়। বাস্তবতা হলো, বোকামির জন্য নয়, অতিচালাকির জন্যও অনেক সময় অপচয় সৃষ্টি হয়। এসব অপচয় দূর করা। সবচেয়ে দুরূহ।
কোনো অপচয়ই দীর্ঘদিন নিজে নিজে টিকে থাকতে পারে না। ইংরেজিতে একটি আপ্তবাক্যে যথার্থই বলা হয়েছে, কিছু লোককে স্বল্প সময়ের জন্য বোকা বানানো যায়, কিন্তু সব লোককে সব সময় বোকা বানিয়ে রাখা যায় না। কাজেই সাধারণত কোনো অপচয় দীর্ঘদিন টিকে থাকার সম্ভাবনা কম। এর অবশ্য একটি ব্যতিক্রম রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ স্বার্থগোষ্ঠী অপচয় থেকে লাভবান হয়। তারা নিজেদের স্বার্থে অপচয়কে বাঁচিয়ে রাখে। এসব ক্ষেত্রে অপচয় দূর করতে গেলে শক্ত প্রতিরোধ আসে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মনসুর অলসন (১৯৮২) এ ধরনের কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠীর নাম দিয়েছেন distributional coalition বা বণ্টনমূলক জোট। এরা শুধু সক্রিয় অপচয় (যথা–ঘুষ বা দুর্নীতি) থেকেই লাভবান হয় না, এরা নিষ্ক্রিয় অপচয় থেকেও সুবিধা হাসিল করে। অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই অপচয় সৃষ্টি করে। যেমন ধরুন, পল্লি অঞ্চলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একটি নতুন এক্স-রে মেশিন বসানো হলো। দেখা গেল, এই মেশিন কাজ করছে না, যদিও যন্ত্রটি ভালো। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, বেসরকারি খাতের এক্স-রে মেশিনের মালিক তার বাজার রক্ষা করার লক্ষ্যে (যে বাজার সরকারি যন্ত্র কেনার আগে তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল) সরকারি হাসপাতালের যন্ত্রচালককে ঘুষ দেয়, যাতে যন্ত্রটি অচল করে রাখা হয়। আপাতদৃষ্টিতে এ ক্ষেত্রে অপচয় নিষ্ক্রিয় মনে হলেও আসলে এখানে সক্রিয় অপচয় বিরাজ করছে। কাজেই সব সময় সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় অপচয়ের মধ্যে প্রভেদ করা অত্যন্ত শক্ত।
৪. উপসংহার
ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে সরকারের অপচয় মোটেও অভিনব কিছু নয়। দুই হাজার বছর আগে কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্রে সরকারি কর্মচারীদের অপচয় ও সরকারের অর্থ আত্মসাৎ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে লিখেছেন। সরকারি কর্মচারীদের সরকারি অর্থ তছরুপের প্রবণতা লক্ষ করে তিনি লিখেছেন, ‘Just as it is impossible not to taste honey or poison that one may find at the tip of one’s tongue, so it is impossible for one dealing with government funds, not to taste, at least a little bit, of the king’s wealth.’ (জিভের ডগায় মধু অথবা বিষ এলে যেমন না চেটে থাকা যায় না, তেমনি সরকারি অর্থ যারা নাড়াচাড়া করে তারা রাজার সম্পদের ছিটেফোঁটা হলেও না খেয়ে থাকতে পারে না ।)। যারা রাজার সম্পদ মেরে দিয়ে বড় লোক হন, তাদের মৃত্যুদণ্ড প্রদানের পরামর্শ দিয়েছেন কৌটিল্য (১৯৯২)। সরকারের সম্পদ হেফাজতের জন্য কৌটিল্য সবচেয়ে জোর দিয়েছেন হিসাব নিরীক্ষার ওপর। অর্থশাস্ত্রের বিধান হলো, যদি নিরীক্ষক যথাসময়ে তাঁর দায়িত্ব পালন না করেন, তবে নিরীক্ষককে শাস্তি দিতে হবে।
আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও অপচয় রোধের প্রধান অস্ত্র হচ্ছে নিরীক্ষা। অবশ্যই জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য নিরীক্ষার কোনো বিকল্প নেই। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নিরীক্ষার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সংসদকে।
নিরীক্ষা অপচয় বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয়, তবে যথেষ্ট নয়। নিরীক্ষা-ব্যবস্থার কয়েকটি বড় ধরনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রথমত, অপচয় হওয়ার পর নিরীক্ষা হয়। নিরীক্ষা তাই অপচয়ের জন্য শাস্তি দিতে পারে; কিন্তু অপচয় রোধ করতে পারে না। অপচয় ঘটে যাওয়ার পর তা উদ্ঘাটন করে মাত্র। তাই নিরীক্ষকদের সম্পর্কে ঠাট্টা করে বলা হয়ে থাকে, ‘An auditor is someone who arrives after the battle and bayonets all the wounded.’ (নিরীক্ষক হলেন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে রণক্ষেত্রে আবির্ভূত হন ও সব আহত সৈনিকের ওপর বেয়নেট হামলা চালান)। যুদ্ধের ফলাফলের ক্ষেত্রে নিরীক্ষকের কোনো ভূমিকা নেই। তিনি শুধু ঘটনা-উত্তর জবাবদিহির ব্যবস্থা করেন। তবে অপচয় ঘটার আগে তা রোধ করতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ বা internal control ।
দুর্ভাগ্যবশত, উন্নয়নশীল দেশে নিরীক্ষার চেয়েও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ব্যবস্থা অনেক দুর্বল। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের (২০০০) মূল্যায়ন উদ্ধৃত করা যেতে পারে : ‘Perhaps the most important factor accounting for the large number of irregularities and incidence of malfeasance in public expenditure is the failure to comply with a well-structured internal control system. There is apparently a complete breakdown of the internal control mechanism within the administrative system as a whole.’ (সম্ভবত, অনেক অনিয়ম ও অবৈধ ব্যয়ের ঘটনার প্রধান কারণ হচ্ছে একটি সুবিন্যস্ত অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা মেনে চলায় ব্যর্থতা। দৃশ্যত সামগ্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থায় অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে। বিশ্বব্যাংক, ২০০০, ৩)।
সমস্যাটি পদ্ধতির নয়। সমস্যাটি হচ্ছে যারা পদ্ধতি প্রয়োগ করেন, তাঁদের। নৈতিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত ও সাহসী কর্মকর্তা ছাড়া অপচয় রোধ করা কোনোমতেই সম্ভব নয়। অথচ অনেক সরকারই এ ধরনের কর্মকর্তা চান না। তাই ঔপনিবেশিক আমলে যে মানের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা ছিল তার কাছাকাছি ব্যবস্থাও স্বাধীন দেশে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না। যাদের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব, তারা নিজেরাই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। সেপ্টেম্বর ২০১০ থেকে মার্চ ২০১২ সময়কালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের উদ্যোগে পরিচালিত একটি সমীক্ষা থেকে বাংলাদেশে সরকারি অফিসের হিসাবরক্ষণে ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র উদ্ঘাটিত হয়েছে। ঠিকাদারদের বিল পেতে হলে প্রাপ্য অঙ্কের ৫ থেকে ১০ শতাংশ গড়ে উৎকোচ দিতে হয়। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের অবসর ভাতার জন্য ১ থেকে ১০ শতাংশ ঘুষ দিতে হয়। বেতনের নতুন স্কেল পেতে হলে ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ না দিলে দৈনিক ভিত্তিতে নিযুক্ত কর্মচারীরা বেতন পায় না (Financial Express, August 13, 2012)।
নিরীক্ষা-ব্যবস্থাও অপ্রতুল। নিরীক্ষকেরা বাইরের লোক। তাদের পক্ষে কোনো প্রতিষ্ঠানের সব দুর্বলতা অনুমান করা সম্ভব হয় না। এ সম্বন্ধে একটি সুন্দর চুটকি প্রচলিত আছে। একবার একজন নিরীক্ষক একটি কারখানা নিরীক্ষার দায়িত্ব নেন। বাজারে গুজব ছিল যে প্রতিষ্ঠানটি থেকে বিপুল পরিমাণ চুরি হয়। নিরীক্ষক চুরি ধরার জন্য তৎপর হলেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তিনি কোনো অনিয়ম দেখতে পাননি। (অবশ্য সব চোর সতর্ক হয়ে গিয়েছিল)। শুধু বিকেলের দিকে একটি রহস্যজনক ঘটনা দেখতে পান। একটি ঠেলাগাড়ি, যার ওপর একটি অস্বচ্ছ কাপড় দিয়ে কী যেন ঢাকা দেওয়া আছে, তোরণের দিকে যাচ্ছে। নিরীক্ষক সঙ্গে সঙ্গে ঠেলাগাড়িটি তোরণের কাছে আটকে দেন। কিন্তু কাপড় তুলে কিছুই পাওয়া গেল না। বাধ্য হয়ে ঠেলাগাড়িটি ছেড়ে দেওয়া হলো। পরদিন একই ধরনের একটি ঠেলা গাড়ি অস্বচ্ছ কাপড়ে ঢাকা অবস্থায় তোরণের কাছে এল । তাকে আটকিয়ে আবার তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো। কিছুই পাওয়া গেল না। এভাবে একই ঘটনা পর পর সাত দিন ঘটল। অষ্টম দিন নিরীক্ষক কারখানার নিরীক্ষা শেষ করে যখন তার অফিসে ফিরে যাচ্ছিলেন তিনি আবার অস্বচ্ছ কাপড়ে ঢাকা একটি ঠেলাগাড়ি দেখতে পান। তিনি ঠেলাগাড়িটি আটকালেন ও গাড়োয়ানকে বললেন, আমি আপনার গাড়ি আর পরিদর্শন করব না। আমি বুঝতে পারছি আপনি কাপড় দিয়ে ঢেকে কিছু সরাচ্ছেন। কিন্তু কী সরাচ্ছেন বুঝতে পারছি না। হলফ করে বলছি, আমি আপনার কোনো ক্ষতি করব না। আপনার কাছে আমি চিরজীবন কৃতজ্ঞ থাকব, যদি মেহেরবানি করে আপনি কী চুরি করছেন তা আমাকে জানান। গাড়োয়ান একটু হেসে বলল, আমি ঠেলাগাড়ি চুরি করি।’ নিরীক্ষক আদৌ সন্দেহ করেননি যে ঠেলাগাড়িও চুরি হয়। ভেতরের খবর না জানলে অর্থবহ নিরীক্ষা সম্ভব নয়। অপচয় রোধ করার জন্য ভেতরের তথ্য-ফাসকারীদের (whistleblowers) উৎসাহিত করতে হবে, যাতে তারা সব কেলেঙ্কারি প্রকাশ করে দেয়। প্রাতিষ্ঠানিক গোপনীয়তার অবগুণ্ঠন অপসারণ করতে হবে। টেলিফোনে অভিযোগ গ্রহণ করার জন্য জরুরি লাইনের (hotline) ব্যবস্থা করতে হবে।
নিরীক্ষার মানও উন্নত করতে হবে। বর্তমানে নিরীক্ষা প্রধানত সরকারের ব্যয় ও উপকার পর্যালোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। সরকার বিভিন্ন দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানকে শুধু বাজেট বরাদ্দই দেয় না। এসব প্রতিষ্ঠানে সরকার বিপুল সম্পদও (যথা ভূসম্পত্তি, ভৌত অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি) বিনিয়োগ করেছে। সরকারের সম্পদ যথাযথ কাজে লাগছে কি না, তা-ও নিরীক্ষা করতে হবে। যুক্তরাজ্যে সম্পদভিত্তিক হিসাব ও বাজেট-ব্যবস্থা (Resource accounting and audit) নিয়ে নিরীক্ষা চলছে। এ ধরনের কার্যক্রম অন্যান্য দেশেও গ্রহণ করা যেতে পারে। শুধু টাকা যথাযথ ব্যয় হয়েছে কি না তা দেখাই যথেষ্ট নয়; টাকাটা কাজে লাগছে কি না, তা-ও দেখতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন কার্যকারিতা নিরীক্ষা (Performance Audit)। দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন প্রয়োজন। প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার পাঁচ থেকে দশ বছর পর প্রকল্পের টেকসই সক্ষমতা বিশ্লেষণও (Sustainability Analysis) করতে হবে।
অবশ্য এসব নতুন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করার মতো সম্পদ ও অভিজ্ঞ জনবল অনেক উন্নয়নশীল দেশেরই নেই । দুর্ভাগ্যের বিষয়, মান্ধাতার আমলের নিরীক্ষা-ব্যবস্থাও কাজ করছে না। অপচয়ের দীর্ঘদিন পর নিরীক্ষা সম্পন্ন হয়। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধীরা লাপাত্তা হয়ে যায়। প্রশাসনিক অদক্ষতার ফলে নিরীক্ষায় অনিয়ম উদ্ঘাটিত হওয়ার পরও কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয় না। সরকারি হিসাবসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি বেশির ভাগ সময় অকার্যকর থাকে। অপচয় রোধে সংসদকে এগিয়ে আসতে হবে।
ওপরে উল্লেখিত ব্যবস্থাগুলি প্রয়োজনীয়, তবে যথেষ্ট নয়। যেখানে অপচয় কর্মকর্তাদের অদক্ষতা বা অর্থলিপ্সার ফলে ঘটে, সেখানে এসব ব্যবস্থা কাজ করতে পারে। কিন্তু যেখানে কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠী অনুপার্জিত মুনাফার জন্য অপচয় পয়দা করে, সেখানে কারিগরি ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়। কায়েমি স্বার্থবাদীরা তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য মরণপণ লড়াই করবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার। দুর্ভাগ্যবশত রাজনীতিবিদেরাও কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। কাজেই অর্থবহ উদ্যোগের জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সরকারি কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে । এর জন্য স্বেচ্ছাসেবীদের এগিয়ে আসতে হবে। অপচয় সম্পর্কে তথ্য গণমাধ্যমে তুলে ধরতে হবে। তবে দেশভেদে সমাধান ভিন্ন হবে। এ ক্ষেত্রে একটি ছোট বালক তার শিক্ষককে যে উপদেশ দিয়েছিল তা আমাদের মনে রাখতে হবে।
অঙ্কের শিক্ষক ক্লাসে এসে একটি ছোট ছেলেকে প্রশ্ন করল, ‘ধরো, আমি তোমাকে এক টাকা দিলাম। তোমার বাবা তোমাকে আরও একটি টাকা দিলেন। বলো তো, বাবা, তোমার কাছে মোট কত টাকা হলো?
ছেলেটি বলল, ‘এক টাকা।’
শিক্ষক বলল, ‘ভালো করে চিন্তা করে বলো।’
ছেলেটি আবার বলল, ‘এক টাকা।‘’
শিক্ষক রেগে বললেন, ‘তুমি দেখছি অঙ্ক একদম জানো না।’
ছেলেটি বলল, ‘স্যার, আমি অঙ্ক ঠিক জানি। কিন্তু আপনি আমার বাবাকে জানেন না। তিনি কোনো দিন আমাকে এক টাকা দূরে থাক, একটি পয়সাও দেবেন না। আমার কাছে আপনার দেওয়া টাকাটাই থাকবে।’
ছাত্রটি শিক্ষককে মনে করিয়ে দিল, বাবাভেদে যোগফল ভিন্ন হতে পারে। তেমনি দেশভেদে অপচয়ের প্রকৃতি ও সমাধান ভিন্ন হবে, এ কথা ভুলে গেলে চলবে না।
.
উল্লেখিত রচনাবলি (Works Cited)
অলসন, মনসুর (Olson, Mancur)। ১৯৮২। The Rise and Decline of Nations. New Haven: Yale University Press.
কেইনস, জন মেনার্ড (Keynes, John Maynard)। ১৯৬৪। The General Theory of Employment, Interest and Money. New York: Harcourt, Brace and World Inc.
কৌটিল্য (Kautilya)। ১৯৯২। The Arthasastra. Translation L.N. Rangarajan. New Delhi: Penguin Books.
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। ১৯৯৮। General Financial Rules. Dhaka: Finance Division.
বান্দিয়েরা, অরিয়ানা; আন্দ্রিয়া প্ৰাট ও টমাসসা ভ্যালেটি (Bandiera, Oriana; Andrea Prat and Tommaso Valletti)। ২০০৯। ‘Active and Passive Waste in Government Spending: Evidence from a Policy Experiment.’ The American Economic Review. Vol. 99. No. 3.
বিশ্বব্যাংক (World Bank)। ২০০০। Bangladesh: Country Financial Accountbility Asessment. Washington D.C.
মুন, পেন্ডেরেল (Moon, Penderel)। ১৯৮৯। The British Conquest and Dominion of India. London: Duckworth.
স্ট্যানবেরি, উইলিয়াম ও ফ্রেড টমসন (Stanbury, wiliam and Fred Thompson) i dode l ‘Towards a Political Economy of Governent Waste: Firsr Steps Definitions.’ Public Administration Review. Vol. 55. No. 5. (Sept-Oct, 1995)
সেন, সুকুমার। ২০০৩। ব্যুৎপত্তি সিদ্ধার্থ বাঙ্গলা কোষ। কলকাতা : পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি।