০৩. সুখের লাগিয়া : সুখ ও অর্থনীতি

০৩. সুখের লাগিয়া : সুখ ও অর্থনীতি

১. ভূমিকা

দেশটির নাম সুখস্থান।

এ রাজ্যে ১০০ জন সুদর্শন যুবক বাস করে। এরা প্রত্যেকে বছরে ১ কোটি টাকা আয় করে। এদের ধনুর্ভঙ্গপণ যে এরা কেউ বিয়ে করবে না। তাই এদের কোনো স্ত্রী নেই। তবে তাদের প্রত্যেকের বাড়িতে একজন করে চাকরানি রয়েছে। প্রতি চাকরানি বছরে ১ লাখ টাকা বেতন পায়। এ রাজ্যে আর কোনো মানুষ নেই। এ দেশে মোট জাতীয় উৎপাদ হচ্ছে ১০১ কোটি টাকা। এদের মাথাপিছু আয় হলো ৫০.৫ লাখ টাকা।

হঠাৎ এ রাজ্যে মদন দেব তশরিফ আনলেন। স্বঘোষিত চিরকুমার যুবকদের শাস্তি দেওয়ার জন্য তিনি তাদের প্রেমের বাণে বিদ্ধ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ১০০ জন যুবক তাদের নিজ নিজ চাকরানির প্রেমে পড়ে গেল ও তাদের বিয়ে করে ফেলল। চাকরানিরা বহুদিন ধরে তাদের মনিবদের আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করছিল। তাই মদন দেবের কল্যাণে বিয়ে হওয়াতে তারা মহাখুশি। তারা বিয়ের আগে যত কাজ করত, নিজের সংসারে তার চেয়ে অনেক বেশি খেদমত করে, যাতে স্বামীরা আগের চেয়ে বেশি সুখে থাকে। স্বামীরাও স্ত্রীদের যত্নে মহাসন্তুষ্ট। তারা তাদের ব্যাংকে বলে দিয়েছে যে স্ত্রীরা তাদের স্বামীর আয়ের অর্ধেক টাকা ব্যাংক থেকে মাসে মাসে তুলতে পারবে। ফলে স্ত্রীরা নিজেদের ইচ্ছমতো দেদার খরচ করছে।

রাজ্যে সবার সুখ বেড়ে গেছে। অথচ রাজ্যের সংখ্যাতত্ত্ববিদেরা বলছেন, রাজ্যে বার্ষিক মাথাপিছু আয় ৫০.৫ লাখ থেকে ৫০ লাখে নেমে গেছে। বিয়ে করার আগে চাকরানিরা বেতন পেত। যদিও স্ত্রী হওয়ার পর একই কাজ তারা আরও অনেক ভালোভাবে ও দরদ দিয়ে করছে, তবু তারা বেতন পায় না। তবে বেতনের চেয়ে অনেক বেশি টাকা স্বামীরা স্ত্রীদের দিচ্ছে। কিন্তু স্ত্রীকে স্বামীর দেওয়া অর্থ জাতীয় আয়ে অন্তর্ভুক্ত হয় না। অথচ গৃহস্বামী চাকরানিকে যে বেতন দেয়, তা জাতীয় আয়ের অংশ। কাজেই সুখস্থান রাজ্যে চাকরানিরা গৃহস্বামীদের বিয়ে করায় রাজ্যের সকলের সুখ বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও মোট জাতীয় উৎপাদ ও মাথাপিছু আয় কমে গেছে।

ধরুন, এক বছর পর এ রাজ্যের ১০০ দম্পতি তাদের বিবাহবার্ষিকীতে নিজেদের নতুন গাড়িতে চড়ে বেড়াতে গেল। ফেরার পথে গাড়ি দুর্ঘটনায় ১০ জন স্ত্রী মারা যায়। ১০ জন স্বামী প্রত্যেকে একটি করে পায়ের আঙুল হারায়। আরও ২০ জন হাসপাতালে দীর্ঘ চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে যায়। সারা বছর রাজ্যের সবাই দুঃখে কাঁদে। এক বছর পর রাজ্যের সংখ্যাতত্ত্ববিদেরা জানালেন যে রাজ্যে মাথাপিছু আয় বেড়ে গেছে; কারণ, ১০ জন স্ত্রী মারা যাওয়াতে জনসংখ্যা কমেছে (এ সময়ে কোনো বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হয়নি) অথচ সব। পুরুষ জীবিত থাকায় (ও কোম্পানি অসুস্থদের পুরো বেতন দেওয়ায়) মোট জাতীয় উৎপাদ কমেনি; বরং বেড়েছে। কেননা, হাসপাতালে মৃতদের সকারকারীদের এবং গাড়ি মেরামতকারী প্রতিষ্ঠানগুলির আয় বেড়েছে। অর্থনীতির ভোজবাজিতে মানুষের দুর্দশা বাড়লেও জাতীয় আয় বেড়ে গেল।

পরের বছর রাজ্যে গুজব রটল যে সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ হলো রাস্তার ঠিকাদারদের দুর্নীতি। এতে রাজ্যে প্রচণ্ড রাজনৈতিক অসন্তোষ দেখা দিল । সেনাবাহিনী-প্রধান ক্ষমতা দখল করে নিল। সেনাবাহিনী রাজ্যের সবাইকে অতিরিক্ত রপ্তানি পণ্য উৎপাদনে বাধ্য করল। রাজ্যে মাথাপিছু আয় ২০ শতাংশ বেড়ে গেল। যদিও রপ্তানি-আয়সহ রাজ্যের মোট উৎপাদের ৫০ শতাংশ সেনাপ্রধান ও তার নয়জন স্যাঙাত আত্মসাৎ করে। এর ফলে রাজ্যের ৯০ শতাংশ লোকের আয় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে যায়। তার মানে গড় আয়ের ভিত্তিতে মানুষের সুখ বেড়েছে। কিন্তু ৯০ শতাংশ লোকের মাথাপিছু আয় ও সুখ কমে গেছে। শুধু ১০ ভাগ লোকের আয় বেড়েছে। এ রাজ্যে এখন কারও পৌষ মাস আর কারও সর্বনাশ।

এভাবে দেখা গেল, সুখস্থান রাজ্যে মানুষের সুখ যখন বাড়ছে মাথাপিছু আয় তখন কমে যাচ্ছে; আর যখন দুঃখ বাড়ছে তখন মাথাপিছু আয়ও বাড়ছে। এ অদ্ভুত কাণ্ড অবশ্য সুখস্থানের সর্বনেশে নিয়মকানুনের জন্য ঘটছে না। দোষ সুখস্থানের নয়, সমস্যা হলো জাতীয় আয় প্রাক্কলনের পদ্ধতিটাতেই রয়েছে অনেক ফাঁক। পৃথিবীর সব দেশেই বর্তমানে মোট জাতীয় উৎপাদের হিসাব নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। ২০০৮ সালে ফ্রান্সের তঙ্কালীন রাষ্ট্রপতি সারকোজি মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদের তাৎপর্য নিয়ে এতই সন্দিহান হয়ে পড়েন যে তিনি জীবন-কুশলতার সূচক হিসেবে জাতীয় আয়ের উপযোগিতা পরীক্ষা করে পরামর্শ দেওয়ার জন্য নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজের (২০০৮) নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করেন। অমর্ত্য সেন এ কমিশনের উপদেষ্টা ছিলেন। এই কমিশন জাতীয় উৎপাদের তিনটি দুর্বলতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। প্রথমত, সব উৎপাদ ও সেবা সঠিক মূল্যে সব সময় জাতীয় উৎপাদের অন্তর্ভুক্ত হয় না। দ্বিতীয়ত, পণ্য ও সেবা উৎপাদন করতে গিয়ে পরিবেশের অথবা সমাজের যে ক্ষতি হয় তা বিবেচনায় না নেওয়াতে জাতীয় উৎপাদের পরিমাণ অতিরঞ্জিত করা হয়। সবশেষে, জাতীয় উৎপাদের হিসেবে শুধু অর্থের পরিমাণের ওপর জোর দেওয়া হয়; কিন্তু জীবন কুশলতার মান সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হয়। জীবনযাত্রার গুণগত মান বিশ্লেষণ করার জন্য জাতীয় উৎপাদের বিষয়-নির্ভর (objective) পরিমাপই যথেষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির মনোনির্ভর (subjective) মূল্যায়নও প্রয়োজন। স্টিগলিজ কমিশনের সুপারিশ হলো যে জীবন-কুশলতা পরিমাপ করার জন্য শুধু জাতীয় উৎপাদের হিসাব করলেই চলবে না। সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাত্রার মান সম্পর্কে ব্যক্তিদের মনোনির্ভর মূল্যায়নও বিবেচনা করতে হবে। সম্প্রতি বিভিন্ন দেশে মোট জাতীয় সুখ পরিমাপ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ভুটান সরকার মোট জাতীয় সুখ বৃদ্ধিকে তাদের জাতীয় লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছে। যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার মতো শিল্পোন্নত দেশগুলিতেও সরকারের উদ্যোগে সুখ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ শুরু হয়েছে।

নাগরিকদের সুখ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহে সম্প্রতি যে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে তা বিংশ শতাব্দীর মূলধারার অর্থনৈতিক তত্ত্বের সঙ্গে মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ঊনবিংশ শতকে অবশ্য উপযোগবাদী (utilitarian) দার্শনিকদের মধ্যে সুখ পরিমাপ করার জন্য প্রচণ্ড আগ্রহ দেখা গিয়েছিল । এজওয়ার্থের মতো কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ আশা করেছিলেন যে মানুষের সুখ পরিমাপক যন্ত্র (hedonometer) আবিষ্কার করাও সম্ভব হবে। (ফ্রে ও অলিয়েস ফ্রঁটজার, ২০০২)। বিশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে লায়োনেল রবিন্স ও জন হিকসের মতো অর্থনীতিবিদেরা প্রমাণ করলেন যে উপযোগ বা মানুষের হিতের ক্রমবাচক বা ordinal (কোনটা আগে ও কোনটা পরে) মূল্যায়ন সম্ভব হলেও সংখ্যাবাচক বা cardinal (তুলনামূলকভাবে কোনটি কত বেশি) মূল্যায়ন সম্ভব নয়। ব্যক্তিভেদে উপযোগের মূল্যায়নে প্রভেদ ঘটে। কাজেই একাধিক ব্যক্তির উপযোগ (যা ভিন্ন ভিন্ন) একসঙ্গে যোগ করা অযৌক্তিক। তাই ব্যক্তির সুখ সম্পর্কে গবেষণা অর্থনীতির মূল স্রোতোধারাতে পরিত্যক্ত হয়। শুধু মনস্তত্ত্ববিদেরা এ বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে যান (ক্যায়নেম্যান, ড্যানিয়েল ও এলেন বি ক্রুগার, ২০০৬)। যদিও অর্থনীতিবিদেরা মনস্তত্ত্ববিদদের এসব গবেষণা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেন। অতি সম্প্রতি অর্থনীতিবিদেরা মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে মনস্তাত্ত্বিক উপাদানগুলির ভূমিকা সম্পর্কে ক্রমশ সজাগ হয়ে উঠছেন। বিশেষ করে, ২০০২ সালে মনস্তত্ত্ববিদ ড্যানিয়েল কায়নেম্যানকে (Daniel Kahneman) অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার প্রদানের পর সুখ সম্পর্কে অর্থনীতিবিদেরা নতুন করে চিন্তাভাবনা করেছেন।

বর্তমান প্রবন্ধের লক্ষ্য হলো সুখ সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ ও মনস্তত্ত্ববিদেরা দুই দশক ধরে যেসব গবেষণা করছেন, তার তাৎপর্য বিশ্লেষণ করা। এই বিশ্লেষণ থেকে সুখ অথবা মানুষের জীবন-কুশলতা বাড়ানোর জন্য গৃহীতব্য ব্যবস্থাগুলি চিহ্নিত করা সম্ভব। প্রবন্ধটি সাতটি খণ্ডে বিভক্ত। দ্বিতীয় খণ্ডে সুখের পরিমাপের প্রচলিত পদ্ধতির তাৎপর্য ও দুর্বলতাগুলি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তৃতীয় খণ্ডে দেশভেদে সুখবোধের তারতম্য সম্পর্কে সমীক্ষার ফলাফল আলোচনা করা হয়েছে। চতুর্থ খণ্ডে ব্যক্তিগত সুখ ও আয়ের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ বিশ্লেষণে দেখা যায়, যেকোনো সময়ে আয় ও সুখের মধ্যে সুস্পষ্ট ধনাত্মক সম্পর্ক রয়েছে। অথচ সময়ের পরিসরে মাথাপিছু আয় বাড়লেও সুখ বাড়ছে না। প্রবন্ধের এই খণ্ডে এ প্রহেলিকার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পঞ্চম খণ্ডে সুখের সঙ্গে সমষ্টিগত স্থিতিশীলতার সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বিশেষ করে, দেখানো হয়েছে যে বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি মানুষের সুখকে প্রভাবিত করে। ষষ্ঠ খণ্ডে রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সুখের সম্পর্কের কারণ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সর্বশেষ খণ্ডে এই নিবন্ধের বক্তব্যগুলির সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করা হয়েছে। এই প্রবন্ধের মূল বক্তব্যের ভিত্তিতে মানুষের সুখ বাড়ানোর জন্য অর্থনৈতিক নীতিমালায় কী ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন সে সম্পর্কেও সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।

২. সুখের পরিমাপ ও তার তাৎপর্য

যারা সুখ নিয়ে গবেষণা করছেন তারা সুখের বিষয়নির্ভর (objective) সংজ্ঞা নিয়ে আদৌ মাথা ঘামাতে রাজি নন। তাঁরা মনে করেন, সুখের ধারণা সম্পূর্ণভাবে মনোনির্ভর (subjective)। কাজেই সুখের ধারণা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হবে। একই সংজ্ঞার নিক্তিতে সবার সুখ মাপতে গেলে তা অনেকের কাছেই দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ যা মাপা হবে তা গবেষকদের কাছে সুখ বলে মনে হলেও ভুক্তভোগীদের জন্য সুখকর না-ও হতে পারে। তবু গবেষণার সুবিধার্থে নেদারল্যান্ডের ইরাসমাস বিশ্ববিদ্যালয়ে World Database of Happiness সুখের নিম্নরূপ সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে : Happiness is defined as the subjective ‘enjoyment of one’s life as a whole. In other words how much one likes the life one leads. Current synonyms are life-satisfaction and ‘subjective well being.’ (‘সুখের সংজ্ঞা হলো ব্যক্তি নিজের মনোনির্ভর মূল্যায়নে সামগ্রিকভাবে যেভাবে জীবন উপভোগ করে। অন্য দিক থেকে দেখলে সুখ অর্থ হচ্ছে ব্যক্তি তার যাপিত জীবন কতটুকু পছন্দ করে। এর সমার্থক শব্দ হচ্ছে জীবন-সন্তুষ্টি ও ব্যক্তিগত মূল্যায়নে কুশলতা। রুট ভিনহোভেন, ২০০৪)। বিভিন্ন দেশে সমীক্ষাতে ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সুখ পরিমাপে যেসব প্রবণতা দেখা যায় তার কিছু কৌতূহলোদ্দীপক উদাহরণ নিচে উল্লেখ করা হলো (ব্রুনো এস ফ্রে ও অলিয়েস স্ট্রটজার, ২০০২)।’

• বয়সভেদে ভিন্নতা : যাদের বয়স কম ও যারা প্রবীণ (অথচ শারীরিকভাবে অসুস্থ নয়) তারা নিজেদের সুখী মনে করে। যাদের বয়স কম তারা না বুঝে সুখী। জীবনের অভিজ্ঞতা তাদের কম। কোনোমতেই তারা হতোদ্যম হয় না। যারা প্রবীণ তারা বুঝেশুনে সুখী। বৃদ্ধ বয়সে মানুষের প্রত্যাশা কমে আসে। তাই জীবনের গোধূলিলগ্নে প্রাপ্তি আর প্রত্যাশার মধ্যে ব্যবধান হ্রাস পায়। এ বয়সের লোকেরা জীবনের চলার পথে ঘা। খেতে খেতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। তাই না পাওয়ার বেদনাবোধ তাদের অপেক্ষাকৃত কম। মধ্যবয়সীদের প্রত্যাশা বেশি। তাই না পাওয়ার দুঃখও তাদের থাকে অনেক বেশি। এ ধরনের ব্যর্থতাতেও তারা অভ্যস্ত নয়। তাই যারা মধ্যবয়সী তারা নিজেদের কম সুখী মনে করে। সবচেয়ে অসুখী হলো ৩০ থেকে ৩৫ বছর বয়স্ক লোকেরা।

• লিঙ্গভেদে ভিন্নতা: মহিলারা পুরুষদের চেয়ে অধিকতর সুখী। মহিলারা অল্পেই তুষ্ট থাকে। অনেক ক্ষেত্রে সমাজ তাদের ছোটকাল থেকেই শিক্ষা দেয় যে পুরুষদের চেয়ে কম অর্জনই তাদের নিয়তি। তাই তারা অল্প নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে। মহিলারা নিজেদের অধিকতর সুখী বলে দাবি করলেও মহিলাদের মধ্যে পুরুষদের চেয়ে মনোবৈকল্যের হার অনেক বেশি। এর একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হলো যে মহিলারা অনেক বেশি আবেগপ্রবণ। এরা যখন নিজেদের সুখী মনে করে, তখন নিজেদের খুবই সুখী মনে করে। যখন দুঃখ বোধ করে তখন তার তীব্রতা পুরুষদের চেয়ে বেশি হয়। কাজেই পুরুষেরা যে ধরনের মানসিক আঘাত সহ্য করতে পারে মেয়েরা তা পারে না।

• বৈবাহিক অবস্থানভেদে ভিন্নতা: বিবাহিতরা অবিবাহিতদের চেয়ে নিজেদের সুখী মনে করে। এ প্রবণতা বিবাহিত পুরুষ ও মহিলা উভয়ের মধ্যেই দেখা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে কার্যকারণ সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিয়ে সুখের কারণ না-ও হতে পারে। এমনও হতে পারে, যারা সুখী তারাই জীবনসাথিদের বিয়েতে আকৃষ্ট করতে পারে। অসুখী ব্যক্তিরা নিঃসঙ্গ হয়, কেউ তাদের বিয়ে করতে চায় না। এ যুক্তি সঠিক হলে বিয়ে সুখের কারণ নয়, বরং সুখী মানুষেরাই বিয়ে করে থাকে।

• শিক্ষা ও সুস্থতাভেদে ভিন্নতা: যারা যত বেশি শিক্ষিত তারা তত বেশি সুখী। যাদের স্বাস্থ্য ভালো তারা অপেক্ষাকৃত সুখী। যারা অসুস্থ তারা জীবন-কুশলতা নিয়ে অসন্তুষ্ট থাকে। অন্যদিকে যারা সুখী তাদের স্বাস্থ্য ভালো থাকে, কারণ তারা দুশ্চিন্তা করে না।

ব্যক্তিভেদে সুখের উৎস ভিন্ন হতে বাধ্য। অবশ্য জীববিজ্ঞানীরা আরেক দফা এগিয়ে গিয়ে বলেন যে, ব্যক্তির সুখের ওপর মানুষের কোনো হাত নেই। সুখ হচ্ছে একটি জৈব চেতনা। এই চেতনার সৃষ্টি হয় মানুষের মস্তিষ্কে। মগজের বা ভাগে সামনের দিকে কপালের সন্নিহিত অংশে সুখের উপলব্ধি উৎপন্ন ও লালিত হয়। (লেয়ার্ড ২০০৫, ১৯) কোনো কারণে মস্তিষ্কের এই অংশ অকার্যকর হয়ে গেলে মানুষের কোনো সুখবোধ থাকে না। এ ধরনের ব্যক্তিরা সব সময়ই হতাশাগ্রস্ত হয়ে থাকে। দুঃখের আধার হচ্ছে মগজের ডান দিকে পেছনের অংশ। এ অংশ ঠিকমতো কাজ না করলে বেদনাবোধের অবলুপ্তি ঘটে। মগজের কোন অংশ অপেক্ষাকৃত সবল তা নির্ভর করে ব্যক্তির জিনের গঠনের ওপর, যা বংশানুক্রমে নির্ধারিত হয়। তাই জীববিজ্ঞানীরা দাবি করেন, সুখ মানুষের আয়ত্তের বাইরে। কোনো কোনো মনস্তত্ত্ববিদ এ মতের সঙ্গে একমত। তারা বলেন, প্রত্যেক মানুষেরই তার ব্যক্তিত্ব ও জিনের গঠনের ভিত্তিতে সুখের একটি নির্ধারিত মাত্রা (set point) রয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে বড় ধরনের কোনো দুর্যোগ (যথা দুর্ঘটনা বা বিবাহবিচ্ছেদ) ঘটলে বা অপ্রত্যাশিত কোনো প্রাপ্তি (যথা লটারি) ঘটলে সুখের নির্ধারিত মাত্রা হতে সাময়িক বিচ্যুতি দেখা দেয়, তবে দীর্ঘ মেয়াদে এসব বিচ্যুতি টিকে থাকে না। সাময়িক বিচ্যুতির প্রভাব কেটে গেলে মানুষের সুখ তার নির্ধারিত মাত্রায় ফিরে আসে। অবশ্য আধুনিক মনোবিজ্ঞানীরা পুরোপুরি এ মত মানেন না। তাঁরা মনে করেন যে ব্যক্তিজীবনে বড় ধরনের সুযোগ বা দুর্যোগের ক্ষেত্রে মানুষ অনেক সময়ই নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়। তবে এই খাপ খাওয়ানোটা, যাকে পোশাকি ভাষায় বলে অভিযোজন, কখনো সম্পূর্ণ হয় না। ব্যক্তির ক্ষেত্রে সুখের নির্ধারিত মাত্রা থেকে বিচ্যুতির কিছু না কিছু প্রভাব থেকে যায়। এর অর্থ হলো, কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনার প্রভাব সম্পূর্ণ মুছে যায় না। সুখের ক্ষেত্রে অভিযোজনের ফলে নাটকীয় পরিবর্তন না হলেও ওঠানামা ঘটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। মানুষ নিজেও মনে করে যে তার পক্ষে সুখের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব। অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক দার্শনিকই মনে করেন যে সুখ বাড়ানোর সচেতন প্রয়াসই অসুখের একটি বড় কারণ।

মনস্তত্ত্ববিদেরা মানুষের ব্যক্তিগত সুখের নিয়ামকগুলি চিহ্নিত করার চেষ্টা করছেন। ১৯৬০-এর দশকে প্রখ্যাত সামাজিক মনস্তত্ত্ববিদ হেডলি ক্যন্ট্রিল ১২টি দেশে সমীক্ষা পরিচালনা করেন। এই ১২টি দেশের মধ্যে উন্নত, উন্নয়নশীল, গণতান্ত্রিক, অগণতান্ত্রিক এবং পাঁচটি মহাদেশের প্রতিটির কমপক্ষে একটি দেশ অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ সমীক্ষার ফলাফল সারণি ৩.১-এ দেখা যাবে।

সারণি ৩.১
ব্যক্তিগত সুখের উপাদানগুলি

ব্যক্তিগত সুখের উপাদানগুলি

সারণি ৩.১ থেকে দেখা যায় যে সুখের সবচেয়ে বড় নিয়ামক হচ্ছে অর্থনৈতিক অবস্থা। ৬০ থেকে ৯৫ শতাংশ মানুষ অর্থনীতিকেই সুখের সবচেয়ে বড় নিয়ামক বলে গণ্য করে থাকে। মানুষ স্বার্থপর, পরার্থপর নয়। অথচ বাঙালি

কবি কামিনী রায় লিখেছেন :

পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও।
তার মত সুখ কোথাও কি আছে?
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।
পরের কারণে মরণেও সুখ
‘সুখ’ ‘সুখ’ করি কেঁদো-না আর
যতই কাঁদিবে ততই ভাবিবে
ততই বাড়িবে হৃদয়-ভার।

সারণি ৩.১ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কবি কামিনী রায় যা-ই নসিহত করুন না কেন, মানুষ পরের কল্যাণ করে সুখ পায় না। তার সুখ তার নিজের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর ও নিজের পরিবারের মঙ্গলের ওপর নির্ভরশীল। মূল্যবোধ ও চরিত্র মাত্র ৯ থেকে ৪২ শতাংশ মানুষের সুখকে প্রভাবান্বিত করতে পারে। অর্থনৈতিক অবস্থা স্বাস্থ্যের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক।

মানুষের সুখ পরিমাপ করার জন্য প্রধানত দুই ধরনের পদ্ধতি রয়েছে। প্রথমত, ঘটনাভিত্তিক মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে উপাত্ত সংগ্রহ। এ ক্ষেত্রে মনস্তত্ত্ববিদেরা চার ধরনের কৌশল অবলম্বন করে থাকেন। একটি কৌশল হলো প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় পর ব্যক্তির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া যন্ত্রের সাহায্যে পরিমাপ করা। আরেকটি কৌশল হচ্ছে সুখের পরিমাপ-সংক্রান্ত সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের দৈনিক ডায়েরি থেকে উপাত্ত সংগ্রহকরণ। তৃতীয় কৌশল হলো, একজন ব্যক্তি দিনে কত সময় অপ্রীতিকর কাজ করেন, সে সম্পর্কে উপাত্ত সংগ্রহ করা। সবশেষে, ব্যক্তির মানসিক প্রতিক্রিয়া নিরূপণ করার জন্য মস্তিষ্কের চিত্র ধারণ করে তার সুখের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতিতে উপাত্ত সংগ্রহ ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। এসব পদ্ধতিতে সরাসরি সুখ পরিমাপ করা সম্ভব হয় না। তাই সমীক্ষা পদ্ধতিতে ব্যক্তিকে প্রশ্ন করে সুখ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা অনেক সহজ।

দ্বিতীয়ত, সমীক্ষা পদ্ধতিতে চার ধরনের কৌশল দেখা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণ সামাজিক সমীক্ষায় নির্বাচিত ব্যক্তিদের নিম্নরূপ প্রশ্ন করা হয় : সবকিছু বিবেচনা করে আপনি কি আজকাল নিজেকে অত্যন্ত সুখী, মোটামুটি সুখী বা খুব সুখী নয় বলে মনে করেন? এই প্রশ্নের উত্তর থেকে এক থেকে তিন মাত্রায় (scale) একটি জনগোষ্ঠীর সুখের পরিমাপ করা হয়। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত বিশ্বমূল্যবোধ সমীক্ষায় নিম্নলিখিত প্রশ্ন করা হয় : ‘সবকিছু বিবেচনা করে আপনি আজকাল আপনার জীবন নিয়ে কতটুকু সন্তুষ্ট?’ এই উত্তর ১ থেকে ১০ মাত্রার মধ্যে প্রকাশ করা হয়। যারা সবচেয়ে অসন্তুষ্ট তাদের প্রতিক্রিয়াকে ১ মাপা হয়, আর যারা সবচেয়ে সুখী তাদের প্রতিক্রিয়াকে ১০ ধরে নেওয়া হয়। ইউরোপে ইয়োরো ব্যারোমিটার সমীক্ষায় উত্তরদাতাদের প্রশ্ন করা হয় : সামগ্রিকভাবে আপনি কি যে জীবন যাপন করছেন তা নিয়ে খুবই সন্তুষ্ট, মোটামুটি সন্তুষ্ট, খুব সন্তুষ্ট নন বা একেবারেই সন্তুষ্ট নন? এই প্রশ্নের ভিত্তিতে এক থেকে চার মাত্রায় জীবন সন্তুষ্টি পরিমাপ করা হয়। জীবন-সন্তুষ্টি সম্পর্কে আরেকটি সমীক্ষায় একটির বদলে তিনটি প্রশ্ন করা হয় এবং উত্তরদাতাদের সুখ এক থেকে সাত মাত্রায় মূল্যায়ন করা হয়।

সুখ বা জীবন-সন্তুষ্টি সম্পর্কে সমীক্ষার একটি সুবিধা হলো, এ ক্ষেত্রে উত্তরদাতাদের মূল্যায়ন সরাসরি জানা যায়। তবে সমীক্ষা-পদ্ধতি নিয়ে কয়েকটি বড় প্রশ্ন রয়েছে। এসব মূল্যায়ন নৈর্ব্যক্তিক নয়। উত্তরদাতার মেজাজ-মর্জি ও প্রেক্ষিতভেদে সুখের মূল্যায়ন ভিন্ন হতে পারে। তাই উত্তরদাতাকে কখন, কীভাবে, কী ভাষায় প্রশ্ন করা হয় তার ওপর অনেক ক্ষেত্রেই মূল্যায়ন নির্ভর করে। সুখ সম্পর্কে সব প্রশ্নের উত্তরই স্মৃতি থেকে দেওয়া হয়। অতীতে যা ঘটে তা সবই সুখদ নয়। সুখ-দুঃখে ও কান্না-হাসিতে নিরন্তর দোলায়িত মানুষের বাস্তব জীবন। জর্জ বার্নাড শ যথার্থই বলেছেন, ‘A lifetime of happiness: no man alive can bear it, it would be hell on earth.’ (সারা জীবন ধরে সুখ : কোনো জীবিত মানুষই তা সইতে পারবে না, এটি হবে মর্ত্যে নরক)। সুখের পর দুঃখ আসে, আবার দুঃখের পর সুখ আসে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সুখ বেশি না দুঃখ বেশি, তা মূল্যায়ন করা শক্ত। এ ধরনের মূল্যায়নের জন্য উত্তরদাতাকে তার অভিজ্ঞতালব্ধ সুখ ও দুঃখের আপেক্ষিক মূল্যায়ন করতে হয়। এ ধরনের মূল্যায়ন ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। তাই এ ধরনের মূল্যায়ন কতটুকু গ্রহণযোগ্য, সে সম্পর্কে প্রশ্ন রয়েছে।

বিভিন্ন সমীক্ষার মাধ্যমে সুখ সম্পর্কে সংগৃহীত উপাত্তের উপযোগিতা মনোবিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করেছেন। ক্যায়নেম্যান ও তার সহযোগীরা (২০০৬) সমীক্ষার ভিত্তিতে সুখ সম্পর্কে সংগৃহীত উপাত্তের গ্রহণযোগ্যতার পক্ষে নিম্নলিখিত যুক্তিগুলি উপস্থাপন করেছেন। প্রথমত, সমীক্ষায় যারা নিজেদের সুখী বলে দাবি করছেন, তাঁদের সুখী হওয়ার সত্যি সত্যি কারণ আছে। অনুসন্ধান করে দেখা গেছে যে যারা সমীক্ষায় নিজেদের অতি সুখী বলে দাবি করেছেন তারা প্রায়ই হাসেন, তাঁদের বন্ধুবান্ধবেরাও মনে করেন যে তারা সুখী, তাদের স্বাস্থ্য ভালো, তাদের আয় বেশি, তারা বহির্মুখী ও মিশুক, তাঁদের আত্মীয়স্বজনও সুখী, তাঁদের ভালো ঘুম হয় এবং তারা ধনাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কথা বলেন। অর্থাৎ সুখী মানুষ সম্পর্কে আমাদের মনে যে ভাবমূর্তি রয়েছে তার সঙ্গে সমীক্ষায় যারা সুখী বলে দাবি করেন তাদের খুবই মিল রয়েছে। কাজেই সুখ-সম্পর্কিত সমীক্ষার ফলাফল বাস্তব বলে মনে হয়। দ্বিতীয়ত, মনস্তাত্ত্বিক গবেষণায় যারা সুখী তারা সুখ সম্পর্কিত সমীক্ষাতেও নিজেদের সুখী বলে দাবি করেন। দৈনিক ডায়েরির ভিত্তিতে যারা সুখী বলে বিবেচিত হন, তাঁরা অতীতের স্মৃতিভিত্তিক মূল্যায়নেও একই ধরনের আচরণ প্রদর্শন করেন। তৃতীয়ত, যারা নিজেদের সুখী বলে দাবি করেন তাদের মগজ পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে তাদের মগজের বাঁ দিকের সম্মুখভাগ অধিকতর সক্রিয়। এ ধরনের উপাত্ত চিকিৎসাশাস্ত্রের ভিত্তিতে সুখ পরিমাপের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সামগ্রিক বিবেচনায় মনস্তত্ত্ববিদেরা সমীক্ষার মাধ্যমে সুখ সম্পর্কে সংগৃহীত উপাত্তকে বৈজ্ঞানিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য বলে মেনে নিয়েছেন।

৩. দেশভেদে সুখের তারতম্য

সুখ সম্পর্কে বিভিন্ন সমীক্ষাতে বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে সুখের তারতম্য নির্ধারণের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে সব দেশে সুখ সম্পর্কে এখন পর্যন্ত যথেষ্ট উপাত্ত সংগৃহীত হয়নি। জীবন-সন্তুষ্টি সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি উপাত্ত সংগ্রহ করেছে ইরাসমাস বিশ্ববিদ্যালয়ের World Database of Happiness। এই সমীক্ষাতে ১৪৯টি দেশে মানুষের জীবন-সন্তুষ্টি নিয়ে তথ্য রয়েছে। এসব তথ্য ২০০০-২০০৯ সময়কালে সংগৃহীত। এই সমীক্ষাতে জীবন-সন্তুষ্টি ১ থেকে ১০ মাত্রায় পরিমাপ করা হয়েছে। যেখানে সন্তুষ্টি সবচেয়ে কম তার মান ১; আর যেখানে সন্তুষ্টি সর্বোচ্চ সেখানে মান ১০। প্রতি দেশের উত্তরদাতাদের গড় মানের ভিত্তিতে দেশের সন্তুষ্টি পরিমাপ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য সারণি ৩.২-এ দেখা যাবে।

সারণি ৩.২
বিশ্বের ১৪৯টি দেশে জীবন-সন্তুষ্টির পরিমাপ, মাথাপিছু আয় ও গড় আমুর প্রত্যাশা, ২০০০-২০০১

বিশ্বের ১৪৯টি দেশে জীবন-সন্তুষ্টির পরিমাপ, মাথাপিছু আয় ও গড় আমুর প্রত্যাশা, ২০০০-২০০১
বিশ্বের ১৪৯টি দেশে জীবন-সন্তুষ্টির পরিমাপ, মাথাপিছু আয় ও গড় আমুর প্রত্যাশা, ২০০০-২০০১
বিশ্বের ১৪৯টি দেশে জীবন-সন্তুষ্টির পরিমাপ, মাথাপিছু আয় ও গড় আমুর প্রত্যাশা, ২০০০-২০০১
বিশ্বের ১৪৯টি দেশে জীবন-সন্তুষ্টির পরিমাপ, মাথাপিছু আয় ও গড় আমুর প্রত্যাশা, ২০০০-২০০১
বিশ্বের ১৪৯টি দেশে জীবন-সন্তুষ্টির পরিমাপ, মাথাপিছু আয় ও গড় আমুর প্রত্যাশা, ২০০০-২০০১

উৎস : (১) প্রথম চারটি স্তম্ভের উপাত্ত : Veenhoven. R. Average happiness in 149 nations 2000-2009. ttp://worlddatabaseofhappiness.eur.nl/hap^nat/findingreports/..
(2) World Bank (2011)

সারণি ৩.২ অনুসারে পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী মানুষেরা মধ্য আমেরিকান দেশ কোস্টারিকাতে থাকে। বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ (০.৩৫৪ শতাংশ) আয়তনবিশিষ্ট এই খুদে রাষ্ট্রে মোট ৫০ লাখ লোক বাস করে। এ দেশে ৯২ শতাংশ লোক খ্রিষ্টান। এ দেশের একমাত্র বিশেষত্ব হচ্ছে যে কোস্টারিকাতে কোনো সেনাবাহিনী নেই। (অবশ্য সুখের সঙ্গে সেনাবাহিনীর অনুপস্থিতির কী সম্পর্ক তা আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না।) পক্ষান্তরে সারণি ৩.২ থেকে দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে অসুখী মানুষেরা বাস করে আফ্রিকার তোগোতে। এর আয়তন বাংলাদেশের প্রায় ৪০ শতাংশ। এ দেশে প্রায় ৭০ লাখ লোক থাকে। এদের বেশির ভাগ স্থানীয় ধর্মে বিশ্বাস করে। তোগোর মাথা পিছু আয় কোস্টারিকার মাথাপিছু আয়ের ৭.৭ শতাংশ। তোগোর গড় আয়ুর প্রত্যাশা কোস্টারিকার চেয়ে প্রায় ২৪ শতাংশ কম।

সারণি ৩.২-এ সুখের মাত্রার সঙ্গে ক্রয়ক্ষমতার সমতাভিত্তিক ডলারে (PPP $) মাথাপিছু আয় ও গড় আয়ুর প্রত্যাশা দেখানো হয়েছে। সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রের গড় সুখের পরিমাপের সঙ্গে মাথাপিছু আয়ের সুস্পষ্ট ধনাত্মক সহগমনের সম্পর্ক রয়েছে। এ দুটি। চলকের সহগাঙ্ক (Correlation coefficient) হচ্ছে ০.৬৩৪। গড় সুখের পরিমাপের সঙ্গে গড় আয়ুর প্রত্যাশার ধনাত্মক সহগমন আরও নিবিড়। এই ক্ষেত্রে সহগাঙ্কের প্রাক্কলন হচ্ছে ০.৭২৯। অবশ্য মাথাপিছু আয় ও গড়। আয়ুর প্রত্যাশার মধ্যেও উচ্চ পর্যায়ের ধনাত্মক সহগমন রয়েছে (এ ক্ষেত্রে সহগাঙ্ক হচ্ছে ০.৬৯১)। এ ধরনের উচ্চ পর্যায়ের সহগমনের একটি বড় কারণ হচ্ছে, যেখানে মাথাপিছু আয় বেশি সেখানে গড় আয়ুর প্রত্যাশাও বেশি হয়। মাথাপিছু আয় বেশি হলে পুষ্টিকর খাদ্য ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা লাভ করা সম্ভব হয়। সারণি ৩.২ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যেসব দেশে মাথাপিছু আয় বেশি সেসব দেশে মানুষ বেশি সুখী। উপরন্তু, যেসব দেশে গড় আয়ুর প্রত্যাশা বেশি, সেসব দেশে মানুষ নিজেকে বেশি সুখী মনে করে।

অবশ্য দেশভেদে ব্যক্তির মনোনির্ভর মূল্যায়নের ভিত্তিতে যে সুখের পরিমাপ করা হয়েছে তার কয়েকটি অন্তর্নিহিত দুর্বলতা রয়েছে। প্রথমত, সুখের মূল্যায়ন উত্তরদাতাদের মূল্যবোধের ওপর নির্ভর করে। এ ধরনের মূল্যবোধ আবার দেশের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিমণ্ডলের ওপর নির্ভরশীল। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, ফরাসিরা জীবন সম্পর্কে সাধারণত নৈরাশ্যবাদী হয়। তারা মনে করে যে বুদ্ধিমান লোকের পক্ষে সুখী হওয়া সম্ভব নয়। বিখ্যাত ফরাসি রাষ্ট্রপতি চার্লস দ্য-গল বলতেন, ‘সুখী ব্যক্তিরা আহাম্মক।’ সুখ সম্পর্কে ফ্রান্সে তাই ব্যাপক বিরূপ ধারণা রয়েছে। ফলে কোস্টারিকা, কলম্বিয়া বা পানামার তুলনায় মাথাপিছু আয় দ্বিগুণের বেশি হওয়া সত্ত্বেও এবং গড় আয়ুর প্রত্যাশা দীর্ঘতর হওয়া সত্ত্বেও ফরাসিরা নিজেদের অপেক্ষাকৃত কম সুখী মনে করে। এর কারণ কি এদের মূল্যবোধ? এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছার মতো উপাত্ত এখনো সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। জাপানিরা অতি বিনয়ী। তাই তারা সুখ নিয়ে বড়াই করা পছন্দ করে না। লক্ষণীয়, সমপর্যায়ের শিল্পোন্নত দেশগুলির তুলনায় সুখের পরিমাপে জাপানের অবস্থান অনেক নিচে। এর কারণও কি জাপানি মূল্যবোধ? পক্ষান্তরে মধ্য ও লাতিন আমেরিকান দেশগুলিতে অর্থনৈতিক দিক থেকে সমপর্যায়ের রাষ্ট্রগুলির তুলনায় সুখের মাত্রা অনেক বেশি। সারণি ৩.২ থেকে দেখা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে সুখী ২০টি দেশের মধ্যে ছয়টিই মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকাতে অবস্থিত। অথচ এই অঞ্চলে মাথাপিছু আয় আহামরি গোছের নয়। এখানেও কি সুখের পরিমাপে মূল্যবোধের প্রতিফলন হয়েছে?

ধর্মীয় মূল্যবোধও সুখের মাত্রার নিয়ামক হতে পারে। সারণি ৩.২ থেকে দেখা যায় যে সবচেয়ে সুখী ৫০টি রাষ্ট্রের মধ্যে ৪৬টি রাষ্ট্রের অধিকাংশ বাসিন্দাই হচ্ছে খ্রিষ্টান। দুটি রাষ্ট্রে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে (সংযুক্ত আরব আমিরাত ও তুর্কমেনিস্তান); একটি ইহুদিপ্রধান (ইসরায়েল) ও একটি বৌদ্ধধর্মাবলম্বী-প্রধান (থাইল্যান্ড)। ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে সুখের সম্পর্ক নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তবে আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায়, খ্রিষ্টানরা অপেক্ষাকৃত বেশি সুখী।

সারণি ৩.২-এর আরেকটি লক্ষণীয় বিশেষত্ব হচ্ছে, ক্ষুদ্র দেশে সুখী লোকের হার বেশি। সবচেয়ে সুখী ১০টি দেশের মধ্যে একটি খুবই ছোট (আইসল্যান্ড); সাতটি দেশে জনসংখ্যা ১ কোটির কম। শুধু দুটি দেশ অপেক্ষাকৃত জনবহুল। কানাডাতে প্রায় ৩.৪ কোটি লোক থাকে আর মেক্সিকোতে রয়েছে ১০ কোটি লোক। সুখের সঙ্গে রাষ্ট্রের জনসংখ্যার আকারের সম্পর্কের কারণ এখনো আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়।

অবশ্য এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, সুখ সম্পর্কে সংগৃহীত উপাত্তগুলি নির্ভরযোগ্য কি না। অনেক গবেষক মনে করেন, সুখ সম্পর্কে সংগৃহীত উপাত্তে সুখের মাত্রা অতিরঞ্জিত হয়ে থাকে। এ ধরনের সমীক্ষা মূলত শহরাঞ্চলে ও সহজে অধিগম্য পল্লি অঞ্চলে পরিচালিত হয়। অথচ অসুখী ব্যক্তিরা অনেক ক্ষেত্রে দুর্গম পল্লি অঞ্চলে বাস করে। তাদের মতামত তাই এ ধরনের সমীক্ষায় প্রতিফলিত হয় না।

বিভিন্ন দেশে মানুষের সুখের মাত্রা তুলনা করার একটি বড় অসুবিধা হলো, সমীক্ষাভেদে একই দেশের সুখের মাত্রায় বড় ধরনের তারতম্য দেখা যায়। সারণি ৩.৩-এ ১০টি সবচেয়ে সুখী দেশ নিয়ে ইরাসমাস বিশ্ববিদ্যালয় ও World Values Survey-এর মূল্যায়নের তুলনা দেখা যাবে ।

সারণি ৩.৩
ইরাসমাস বিশ্ববিদ্যালয়ের সুখ সম্পর্কে সমীক্ষা ও World Values Survey-এর শীর্ষ ১০টি সুখী দেশের অবস্থানের তুলনা

ইরাসমাস বিশ্ববিদ্যালয়ের সুখ সম্পর্কে সমীক্ষা ও World Values Survey-এর শীর্ষ ১০টি সুখী দেশের অবস্থানের তুলনা

উৎস : (১) স্তম্ভ ২-World Database of Happiness, 2000-2009. (২) স্তম্ভ ৩-World Values Survey, 1995-2007.

সারণি ৩.৩ থেকে দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুটি সমীক্ষার মূল্যায়নে যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। তবে তিনটি ক্ষেত্রে (ফিনল্যান্ড, মেক্সিকো ও নরওয়ে) দুটি সমীক্ষার মূল্যায়নে যথেষ্ট ফারাকও রয়েছে।

সুখ সম্পর্কে এখন পর্যন্ত যেসব উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে তার ভিত্তিতে যত প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেছে তার চেয়ে অনেক বেশি নতুন প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। বিশেষ করে, সব দেশের উত্তরদাতাদের বক্তব্য সমরূপ কি না, সে সম্পর্কে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

সুখ সম্পর্কে গবেষণায় শুধু নতুন প্রশ্নই উঠছে না; নতুন নতুন সমীক্ষা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। এখানে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ২০১২ সালের ৭ অক্টোবর বাংলাদেশে দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল : সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ১১তম। অবশ্য সংবাদটি পত্রিকাটির সম্পাদকদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। দুই দিন পর ‘সুখী মানুষের দেশ’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয়তে তাই পত্রিকাটি লিখল : ‘জরিপটি কিছুটা বিভ্রান্তিকরও বটে।’

আসলে জরিপটি কিছুটা নয়, পুরোপুরিই বিভ্রান্তিকর। এ জরিপটি পরিচালনা করে লন্ডনের নিউ ইকোনমিকস ফাউন্ডেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এদের পক্ষ থেকে দুবছর পর পর The Happy Planet Index (সুখী বিশ্বসূচক) নামে একটি সূচকের দেশভিত্তিক পরিমাপ প্রকাশ করা হয়। সূচকটি নিম্নরূপে প্রাক্কলন করা হয়।

Happy Planet Index (সুখী বিশ্ব সূচক) = [Experienced well being (অনুভূত কুশলতা) x Life Expectancy (আয়ুর প্রত্যাশা)] / [Ecological footprint (পরিবেশের ক্ষতি)]

এই সূচকে তিনটি উপাদান রয়েছে। একটি রাষ্ট্রের নাগরিকদের অনুভূত কুশলতা ১ থেকে ১০ মাত্রার মধ্যে পরিমাপ করা হয়। যে রাষ্ট্রে নাগরিকেরা সবচেয়ে সুখী, সে দেশে অনুভূত কুশলতার মাত্রা হলো ১০। যেখানে নাগরিকেরা সবচেয়ে কম সুখী, সেখানে অনুভূত কুশলতার মাত্রা ১। বাংলাদেশে অনুভূত কুশলতার পরিমাপ হচ্ছে ৫.৯। এই সমীক্ষা মোট ১৫১টি দেশে পরিচালিত হয়। ৫২টি দেশের নাগরিকদের মতে, তাদের দেশে সুখের মাত্রা ৫.৯-এর বেশি। তাই এই সমীক্ষার ফলাফল মেনে নিলেও সুখী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ৫৩-এর উর্ধ্বে হয় না।

শুভংকরের ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১১-তে টেনে নেওয়া হয়েছে। এই সূচকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় উপাদানে ফাঁকি রয়েছে। দ্বিতীয় উপাদান হচ্ছে আয়ুর প্রত্যাশা। মানুষ কতটুকু সুখী, তা পরিমাপ করার সময় সে আয়ুর প্রত্যাশাও বিবেচনায় নেয়। কাজেই অন্যান্য সমীক্ষায় একে স্বতন্ত্র উপাদান হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয় না। এতে অবশ্য বাংলাদেশের অবস্থানে বড় ধরনের হেরফের হয়নি। বাংলাদেশের সূচক অতিরঞ্জনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে পরিবেশের ক্ষতি-সম্পর্কিত উপাদান। এই হিসাব সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকেরা করেননি, এ হিসাব করেছেন কতিপয় বিশেষজ্ঞ। সূত্রটি এমনভাবে প্রণীত হয়েছে যে, বিশেষজ্ঞদের মতে, যে দেশে পরিবেশদূষণ কম সে দেশে অনুভূত কুশলতার পরিমাণ বেড়ে যাবে। আর পরিবেশদূষণ বাড়লে অনুভূত কুশলতার পরিমাপ কমে যাবে।

বাংলাদেশের সৌভাগ্য, এই সূচকের বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে কম দূষিত পাঁচটি দেশের একটি। তাই বাংলাদেশের মানুষের মত অনুসারে, সুখী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ৫৩ হলেও, তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের অভিমত বিবেচনা করে বাংলাদেশের অবস্থান ১১-তে টেনে তোলা হয়েছে। যদি প্রমাণিত হয় যে বাংলাদেশে পরিবেশদূষণের হার যুক্তরাষ্ট্রের সমান, তবে সুখী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ৫৩-এর অনেক নিচে নেমে যাবে। আসলে বাংলাদেশে পরিবেশদূষণের মাত্রা অনেক বেশি। বাংলাদেশে ঢাকাসহ শহরসমূহ আন্তর্জাতিক মানে বাসের অযোগ্য।

এ বিশ্লেষণ থেকে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রথমত, সুখ পরিমাপ করার জন্য যেসব সমীক্ষা করা হচ্ছে, তাদের লক্ষ্য ভিন্ন। কাজেই এসব সমীক্ষা একে অপরের সাথে তুলনীয় নয়। ওপরে সারণি ৩.২-এ বিভিন্ন রাষ্ট্রে সুখের যে পরিমাপ উপস্থাপন করা হয়েছে, তা হিসাব করা হয়েছে সেসব রাষ্ট্রের নাগরিকদের জীবন-সন্তুষ্টি বা কুশলতার মূল্যায়নের ভিত্তিতে। এতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সুখের তুলনামূলক বিশ্লেষণ সম্ভব। অথচ Happy Planet Index-এ নাগরিকদের কুশলতার মূল্যায়ন ওই দেশে পরিবেশ অবক্ষয়ের মূল্যায়নের ভিত্তিতে সংশোধন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সুখ শুধু নাগরিকদের দৃষ্টিকোণ থেকে পরিমাপ করা হয়নি; এখানে বৈশ্বিক পরিবেশের দৃষ্টিকোণ থেকে সুখ কতটুকু টেকসই, তা নির্ধারণ করা হয়েছে। Happiness Planet Index তাই সুখ পরিমাপ করে না, মূল্যায়ন করে ‘environmental efficiency of supporting well-being in a given country’ wparts একটি বিশেষ দেশে মানুষের কুশলতা টিকিয়ে রাখার জন্য পরিবেশের কর্মক্ষমতা। কাজেই এ সমীক্ষার ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশে মানুষের সুখের তুলনা সম্ভব নয়।

দ্বিতীয় সমস্যা হলো, এসব সূচক পরিমাপ করার জন্য যে ধরনের উপাত্ত প্রয়োজন, তা সব সময় পাওয়া যায় না। তাই অনেক ক্ষেত্রে জেনেশুনে ত্রুটিপূর্ণ উপাত্তের ভিত্তিতে সূচক পরিমাপ করা হয় । Happy Planet Index এ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো Ecological Footprint বা দেশভিত্তিক পরিবেশের ক্ষতির পরিমাপ । Happy Planet Index: 2012 Report (নিউ ইকোনমিকস ফাউন্ডেশন, ২০১২, ৮) স্পষ্ট স্বীকার করছে যে পরিবেশের ওপর প্রভাব সম্পর্কে যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই, এসব তথ্য সংগ্রহের প্রণালি ত্রুটিপূর্ণ এবং তাতে অনেক ধরনের পরিবেশদূষণ বিবেচনা করা সম্ভব হয়নি। যেহেতু পরিবেশ সম্পর্কে অন্য কোনো প্রামাণ্য তথ্য নেই, তাই ত্রুটিপূর্ণ উপাত্ত দিয়েই কাজ চালানো হচ্ছে।

Happy Planet Index-এ বাংলাদেশে পরিবেশদূষণ অতি নিম্ন পর্যায়ের অনুমান করে সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক ওপরে টেনে তোলা হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ কিন্তু সুখের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান একাদশ দাবি করেনি। বাংলাদেশে পরিবেশদূষণ পৃথিবীর নিম্নতম পর্যায়ে–এ অজুহাতে বাংলাদেশের অবস্থান ৫৩ থেকে ১১-তে তোলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে পরিবেশের সমস্যা অত্যন্ত মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশে পরিবেশদূষণ নিম্নতম পর্যায়ে নয়, বরং অত্যন্ত উচ্চ স্তরে রয়েছে। ভুল সংজ্ঞার ভিত্তিতে ও ভুল উপাত্ত ব্যবহার করে বাংলাদেশে সুখের পরিমাপ ফাঁপানো হয়েছে। গবেষকদের এ ধরনের সমীক্ষা সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে।

৪. ইস্টারলিন প্রহেলিকা (Easterlin Paradox): ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য মানুষের সুখ কেন অব্যাহতভাবে বাড়াচ্ছে না?

কাজী নজরুল ইসলাম বড়াই করে লিখেছেন, ‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান। কারণ হিসেবে বলেছেন, দারিদ্র্য তাকে ‘অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস দিয়েছে’। তবে এ দাবি কখনো করেননি যে দারিদ্র্য তাঁকে সুখ দিয়েছে। বরং তিনি লিখেছেন :

দারিদ্র অসহ
পুত্র হয়ে জায়া হয়ে কাঁদে অহরহ
আমার দুয়ার ধরি। কে বাজাবে বাঁশি?
কোথা পাব অনিন্দিত সুন্দরের হাসি?

দরিদ্র মানুষের মনে সুখ নেই, তাই তাঁর মুখে হাসি বেমানান। বেশির ভাগ মানুষেরই সুখের জন্য চাই অর্থ ও বিত্ত। তাই তো ‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি’।

দেশভেদে সুখের তারতম্যের একটি বড় নিয়ামক হলো মাথাপিছু আয় । তৃতীয় অংশের আলোচনা থেকে দেখা যায় যে ধনী দেশের অধিবাসীদের সুখের মাত্রা উচ্চতর পর্যায়ের। গরিব দেশের মানুষেরা অপেক্ষাকৃত অসুখী হয়। দেশভেদে এ সূত্র যেমন সত্যি, দেশের ভেতরেও শ্রেণীভেদে তা সমভাবে কার্যকর। এই বক্তব্যের সমর্থনে দুই ধরনের উপাত্ত রয়েছে। প্রথমত, দেশভেদে সুখ ও মাথাপিছু আয়ের মধ্যে ধনাত্মক সহগমন লক্ষ করা যায় । ৪৯টি দেশের সুখ ও মাথাপিছু আয়ের সম্পর্ক বিশ্লেষণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে সুখ ও মাথাপিছু আয়ের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট ধনাত্মক সম্পর্ক রয়েছে। তবে সুখের ওপর মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির তাৎক্ষণিক প্রভাব অত্যন্ত নগণ্য। মাথাপিছু আয় ১০ শতাংশ বাড়লে সুখের পরিমাণ (১ থেকে ১০ মাত্রায়) ৩৩৩ ভাগের এক ভাগ বাড়ে। (ব্রুনো এস ফ্রে ও অলিয়েস স্ট্রটজার, ২০০২, ৪১৮)। দ্বিতীয়ত, একই দেশে গরিবদের তুলনায় ধনীরা বেশি সুখী হয়। ১৯৭২-৭৪ ও ১৯৯৪-৯৬ সময়কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আয়ের শ্রেণী অনুসারে গড় সুখের (১ থেকে ৪ মাত্রায়) প্রাক্কলন সারণি ৩.৪-এ দেখা যাবে।

সারণি ৩.৪ থেকে দেখা যাচ্ছে যে নিম্ন-আয়বন্ধনীর ব্যক্তিদের সুখের মাত্রা উচ্চ-আয়বন্ধনীর লোকদের চেয়ে কম। ১৯৯৪ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে যাদের মাথাপিছু আয় ১০ হাজার ডলারের কম, তাদের মাত্র ১৬ শতাংশ নিজেদের অতি সুখী মনে করে। পক্ষান্তরে যাদের মাথাপিছু আয় ৭৫ হাজার ডলারের বেশি, তাদের ৪৪ শতাংশ নিজেদের ‘অতি সুখী’ গণ্য করে থাকে। একই ধরনের প্রবণতা ইউরোপ ও জাপানেও লক্ষ করা যায়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯১ সময়কালে ইউরোপে ইউরো-ব্যারোমিটার সমীক্ষায় দেখা যায়, সর্বোচ্চ আয়বন্ধনীর ব্যক্তিদের ৮৮ শতাংশ ব্যক্তি তাদের জীবন সম্পর্কে খুব অথবা যথেষ্ট সন্তুষ্ট। পক্ষান্তরে সর্বনিম্ন আয়ের এক-চতুর্থাংশ মানুষের মাত্র ৬৬ শতাংশ একই রকম সন্তুষ্ট। কোথাও কোথাও কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও সামগ্রিকভাবে এই প্রবণতা বিশ্বব্যাপী দেখা যাচ্ছে।

সারণি ৩.৪
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আয়ের বন্ধনী অনুসারে সুখের পরিমাপ, ১৯৭২-৭৪ থেকে ১৯৯৪-৯৬

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আয়ের বন্ধনী অনুসারে সুখের পরিমাপ, ১৯৭২-৭৪ থেকে ১৯৯৪-৯৬

উৎস : ব্রুনো এস ফ্রে ও অলিয়েস ফ্রঁটজার (২০০২ JEL)

সামগ্রিকভাবে দেখা যাচ্ছে, ধনী দেশের মানুষেরা গরিব দেশের মানুষদের তুলনায় অধিকতর সুখী। আবার একই দেশের ভেতরে দেখা যাচ্ছে, ধনী ব্যক্তিরা গরিবদের চেয়ে সুখী। এসব উপাত্ত থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়, আয় ও সুখের মধ্যে নিবিড় ধনাত্মক সম্পর্ক রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে উন্নত দেশগুলিতে মাথাপিছু আয় নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। অথচ এই সময়ে সেখানে সুখের মাত্রায় কোনো ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না; বরং কোথাও কোথাও উল্লেখযোগ্য আয় বৃদ্ধি সত্ত্বেও সুখের পরিমাপ কমেছে। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো :

১) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র : ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত সময়কালে সুখ সম্পর্কিত সমীক্ষাগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে আমেরিকানরা ১৯৫০ এর দশকে সবচেয়ে সুখী ছিল, তবে ১৯৪৭-৭৭ সময়কালে সুখের কোনো সুস্পষ্ট প্রবণতা লক্ষ করা যায় না। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে এ সময়ে মাথাপিছু আয়ের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে। ১৯৪৬ থেকে ১৯৯১ সময়কালে ১৯৯৬ সালের স্থিরীকৃত ডলারের মানে যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু আয় ১১ হাজার ডলার থেকে ২৭ হাজার ডলারে উন্নীত হয়। অর্থাৎ ৪৫ বছর সময়কালে এ আয় ১৫০ শতাংশ বাড়ে। মাথাপিছু আয় বেড়ে যাওয়ার ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানে দ্রুত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। মাথাপিছু আয় যখন কম ছিল তখন শৌচাগার ছিল ঘরের বাইরে। আর্থিক সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে লাগোয়া শৌচাগারের চল হয়। ঘরে ঘরে চালু হয় তাপনিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা, কাপড় ধোয়ার যন্ত্র, রঙিন টেলিভিশন, টেলিফোন, হরেক রকম বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি । বাড়ি বাড়ি গাড়ি কেনার ধুম পড়ে যায়। সারা দুনিয়া থেকে। আমদানি করা হয় অজস্র স্বাদু খাদ্যদ্রব্যের উপাদান। সময়ের ব্যবধানে আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সুখ বেড়ে যাওয়ার কথা। অথচ এ সময়কালে মার্কিনদের সুখ কমে যায়। ১৯৫০-এর দশকে শূন্য থেকে তিন মাত্রায় সুখের পরিমাপ ছিল ২.৪। অভাবিতপূর্ব অর্থনৈতিক সাফল্য সত্ত্বেও ১৯৯১ সালে সুখের পরিমাপ ২.২-এ নেমে আসে। আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সুখ বাড়ছে না, হয় স্থিতিশীল থাকছে, নয়তো কমে যাচ্ছে।

২) ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন: ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৯ সময়কালে ইউরোপে নিম্নলিখিত নয়টি দেশে ইউরো-ব্যারোমিটার (Euro-barometer) সুখ সম্পর্কে উপাত্ত সংগ্রহ করে : (১) ডেনমার্ক (২) নেদারল্যান্ডস (৩) বেলজিয়াম (৪) আয়ারল্যান্ড (৫) ব্রিটেন (৬) জার্মানি (৭) ফ্রান্স (৮) গ্রিস এবং (৯) ইতালি। এই সময়ে স্থিরীকৃত মূল্যে মাথাপিছু আয় ২৫ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়ে। অথচ এই সময়ে দুটি দেশে সুখ ও মাথাপিছু আয়ের মধ্যে সংখ্যাতাত্ত্বিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ ঋণাত্মক সহগমন দেখা যায়। অন্যদিকে পাঁচটি দেশে সুখ ও আয়ের মধ্যে সম্পর্ক সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে তাৎপর্যহীন। শুধু দুটি ক্ষেত্রে আয় ও সুখের মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যাতাত্ত্বিক ধনাত্মক সহগমন পরিলক্ষিত হয়। (ইস্টারলিন, ২০০১, ১৩৭-৩৮)। অন্য আরেকটি গবেষণায় দাবি করা হয়, ডেনমার্ক, ইতালি ও জার্মানিতে আয় ও সুখের সম্পর্ক ক্ষীণ হলেও তাৎপর্যপূর্ণভাবে ধনাত্মক। তবে একই সময়ে বেকারত্বের হার, মূল্যস্ফীতির হার হ্রাস

সুখ ও মাথাপিছু আয়ের সম্পর্ক

পাওয়াতে ও আয়ের সুষম বণ্টন ঘটাতে সুখের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। তাই আয় ও সুখের মধ্যে সুস্পষ্ট সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। ইউরোপে সুখ সম্পর্কে প্রাপ্ত বিশ্লেষণগুলি বিবেচনা করলে মনে হয়, সেখানে সময়ের ব্যবধানে আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুখের কোনো লক্ষণীয় তারতম্য ঘটেনি।

৩) জাপান: ১৯৫৮ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত সময়কালে জাপানে মাথাপিছু আয় ছয় গুণ বেড়েছে। ১৯৫৮ সালে ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে জাপানের মাথাপিছু আয় ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১২.৫ শতাংশ। ১৯৮৭ সালে এ হার ৭৫ শতাংশে উন্নীত হয়। ১৯৫৮ সালে ১ শতাংশ পরিবারের গাড়ি ছিল । ১৯৮৭ সালে এই হার ৬০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ১৯৫৮ সালে জাপানে অতি নগণ্যসংখ্যক পরিবারে লাগোয়া শৌচাগার, বৈদ্যুতিক কাপড় ধোয়ার যন্ত্র, ফ্রিজ, টেলিভিশন বা টেলিফোন ছিল। আশির শেষ দিকে এ ধরনের স্থায়ী সেবার সর্বজনীন ব্যবহার সাধারণ মানুষের জীবন সমৃদ্ধ করে। ১৯৫৮ সালে জাপানে জীবন-সন্তুষ্টি পরিমাপ এক থেকে চার মাত্রায় ছিল ২.৭। ১৯৯০ সালে এই পরিমাপ ২.৭-এ অপরিবর্তিত ছিল (ব্রুনো এস ফ্রে ও অলিয়েস স্ট্রটজার, জুন ২০০২)। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, মাথাপিছু আয় এবং বিভিন্ন স্থায়ী ভোগ্যপণ্য ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি সত্ত্বেও সুখের কোনো হেরফের হয়নি।

৪) চীন: ১৯৯৪ থেকে ২০০৫ সময়কালে চীনে অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জিত হয়। স্থিরীকৃত মূল্যে মাথাপিছু আয় ২.৫ গুণ বেড়ে যায় । ১৯৯৪ সালে ৪০ শতাংশ পরিবারের রঙিন টেলিভিশন ছিল; ২০০৫ সালে এ হার ৮৪ শতাংশে উন্নীত হয়। একই সময়ে টেলিফোন ব্যবহারকারীর হার ১০ শতাংশ থেকে ৬৩ শতাংশে উন্নীত হয়। অথচ এই সময়ে জীবন নিয়ে সন্তুষ্টের সংখ্যা ৭৮ শতাংশ থেকে প্রায় ৬৫ শতাংশে নেমে আসে; আর জীবন নিয়ে অসন্তুষ্টের হার ২২ শতাংশ থেকে প্রায় ৪০ শতাংশে উন্নীত হয় (ড্যানিয়েল কায়নেম্যান ও এলেন বি কুগার, ২০০৬)। অর্থাৎ এ কথা স্পষ্ট, চীনের মানুষের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বাড়লেও সুখ বাড়ছে না।

যেকোনো সমাজের দিকে তাকালে দেখতে পাব, মানুষ সুখের জন্য আয় বাড়াতে ব্যস্ত। অথচ বিভিন্ন দেশে দীর্ঘদিন ধরে আয় বাড়া সত্ত্বেও মানুষের সুখ বাড়ছে না। এই প্রহেলিকা প্রথম তুলে ধরেন মার্কিন অর্থনীতিবিদ ইস্টারলিন। তাই একে ইস্টারলিন প্রহেলিকা (Easterlin Paradox) বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই প্রহেলিকার একটি সহজ ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, সুখ ও আয়ের সম্পর্ক সরলরৈখিক নয়। তার মানে এই সম্পর্ক একটি নিরবচ্ছিন্ন সরলরেখায় প্রকাশ করা যাবে না। এ সরলরৈখিক সম্পর্কে একটি বাঁক রয়েছে (রেখাচিত্র-১ দ্রষ্টব্য)। সব দেশেই। সুখের জন্য একটি সর্বনিম্ন গ্রহণযোগ্য আয় রয়েছে। যেখানে মাথাপিছু আয় খুবই কম অর্থাৎ গ্রহণযোগ্য আয়ের নিচে, সেখানে মাথাপিছু আয় বাড়লে সুখ বাড়ে। কিন্তু মাথাপিছু আয় বেড়ে একটি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে উত্তীর্ণ হলে সে ক্ষেত্রে সুখের জন্য আয়ের গুরুত্ব কমে যায়। এ ক্ষেত্রে মাথাপিছু আয় বাড়লে সুখ কমে যায় বা অপরিবর্তিত থাকে।

জীবনযাত্রার গ্রহণযোগ্য মানের জন্য একটি সর্বনিম্ন আয়ের প্রয়োজন রয়েছে। কেউ বলেন, মাথাপিছু ১০ হাজার ডলার আয় থাকলে জীবনযাত্রার গ্রহণযোগ্য মান অর্জন সম্ভব। কেউ বলছেন ২০ হাজার ডলারের কমে এ মান অর্জন করা সম্ভব নয়।

তবে ঐতিহাসিক উপাত্তগুলি অতি নিম্ন আয়ের দেশে মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধি সুখ বাড়ায়–এ প্রতর্ক সমর্থন করে না। উদাহরণস্বরূপ জাপান ও চীনের অভিজ্ঞতা স্মরণ করা যেতে পারে। ১৯৫৮ সালে জাপান মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে ছিল এবং সে মাথাপিছু আয় গ্রহণযোগ্য জীবনযাত্রার জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাই এ পর্যায়ে মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধির ফলে জাপানিদের সুখ বাড়ার কথা। অথচ ১৯৫৮ থেকে ১৯৯০ সময়কালে জাপানে সুখ হয় অপরিবর্তিত ছিল নয়তো কমেছে। ১৯৯৪ সালে চীনে মাথাপিছু আয় ক্রয়ক্ষমতার সমতাভিত্তিক (PPP) ডলারে ছিল ২ হাজার ৫১০ ডলার, যা শ্রীলঙ্কা (৩ হাজার ১৬০ ডলার), ইন্দোনেশিয়া (৩ হাজার ৬০০ ডলার) অথবা ফিলিপাইন্সের (২ হাজার ৭৪০ ডলার) চেয়ে কম। কাজেই চীন সে সময়ে একটি নিম্ন আয়ের দেশ ছিল । এ ধরনের গরিব দেশে আয় বাড়লে সুখ বাড়া অত্যন্ত প্রত্যাশিত। ১৯৯৪ থেকে ২০০৫ সময়কালে চীনে মাথাপিছু আয় ২.৫ গুণ বাড়ে। অথচ চীনে এ সময়ে সুখ কমে গেছে। জাপান ও চীনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, শুধু ধনী দেশের ক্ষেত্রেই নয়, গরিব দেশের ক্ষেত্রেও আয়ের সঙ্গে সুখের কোনো তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্ক নেই।

ইস্টারলিনের মতে, মানুষের সুখ শুধু স্থিরীকৃত মূল্যে বর্তমান আয়ের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে না। সুখের দুটি প্রধান নিয়ামক হচ্ছে : (১) আয়ের সঙ্গে সুখের অভিযোজন এবং (২) আয়ের দিক থেকে সমাজে ব্যক্তির আপেক্ষিক অবস্থান।

মানুষ অভ্যাসের দাস। ব্যক্তির আয় বাড়লে সে নতুন নতুন পণ্য ও সেবা ক্রয় করে। যেমন ধরুন, একজন ব্যক্তির আয় বাড়লে সে নতুন গাড়ি ও বাড়ি কেনে। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই নতুন গাড়ি ও বাড়ির চমক চলে যায়। গাড়ি ও বাড়ি তার অভ্যাসে পরিণত হয়। কিছুদিনের মধ্যেই তার সুখের জন্য পুরোনো বাড়ি-গাড়ি যথেষ্ট থাকে না, আরও বড় বাড়ি ও গাড়ির প্রয়োজন দেখা দেয়। মনস্তত্ত্বে এ প্রক্রিয়াকে বলে অভিযোজন (adaptation)। ব্যক্তিজীবনে নতুন সুখ বেশি দিন টেকে না। যেকোনো নতুন সেবা ও পণ্য গতানুগতিক জীবনে অভিযোজিত হয়ে যায়। ব্যক্তি নতুন সুখে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তাই তার সুখের মাত্রা অপরিবর্তিত রাখার জন্য নতুন নতুন পণ্য ও সেবার প্রয়োজন। তার জন্য দরকার বাড়তি আয় । যতই আয় বাড়তে থাকে মানুষের সাধও বাড়তে থাকে। সাধের শেষ নেই। আয় বাড়িয়েও সব সাধ মেটানো যায় না। সুখের বর্তমান মান ধরে রাখার জন্যই আয় বাড়াতে হয়। তাই কালান্তরে সুখের মাত্রা অপরিবর্তিত রাখার জন্য বাড়তি আয়ের দরকার। এ পরিস্থিতি আজব দেশে এলিসের সঙ্গে তুলনীয়। আজব দেশের নিয়ম হলো : You have to run as fast as you can just to stay where you are. If you want to get anywhere you have to run much faster’. (যেখানে আছ সেখানে থাকতে হলে তোমাকে দৌড়াতে হবে। যদি তুমি কোথাও যেতে চাও, তবে তোমাকে আরও জোরে দৌড়াতে হবে)। সুখের মান অপরিবর্তিত রাখতে হলে উচ্চতর আয়ের। পেছনে দৌড়াতে হবে। এই প্রক্রিয়াকে সমাজবিজ্ঞানীরা আখ্যায়িত করেছেন। hedonic tread-mill’ বা বিদ্যমান সুখের অবস্থানে ঠায় দাঁড়ানোর জন্য দৌড়ের যন্ত্র।

ব্যক্তির সুখ শুধু তার নিজের আয়ের ওপর নির্ভরশীল নয়। তার সুখের একটি নিয়ামক হলো সমাজের অন্যদের আয়ের তুলনায় তার নিজের আয়ের অবস্থান। যদি সমাজের সবার আয় স্থির থাকে এবং একজন বিশেষ ব্যক্তির আয় বাড়ে, তবে নিঃসন্দেহে লোকটির সুখ বাড়বে। যদি সমাজের ও বিশেষ ব্যক্তিটির আয় সমানুপাতিক হারে বাড়ে, তবে কেউই বিশেষ করে পুলকিত হবেন না। পক্ষান্তরে যদি কোনো ব্যক্তির আয় বাড়ে এবং এই বৃদ্ধির হার সমাজের অন্যদের চেয়ে কম হয়, তবে সে ব্যক্তি আয় বাড়া সত্ত্বেও অসুখী হবে। নিজের আয় বেড়ে গেলে সুখ বাড়লেও অন্যদের আয় অপেক্ষাকৃত বেশি বেড়ে গেলে সুখ কমে যায়। আয় বৃদ্ধিজনিত জীবন-সন্তুষ্টি অনেকাংশে কালান্তরে অভিযোজিত হয়। উপরন্তু অনাপেক্ষিক আয় বৃদ্ধি সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তির আপেক্ষিক আয় হ্রাস (অর্থাৎ অন্যদের আয় বেশি বেড়েছে) তার সুখের মাত্রা কমিয়ে দিতে পারে। সামগ্রিকভাবে আয়-বৃদ্ধিজনিত সুখের সময়ের ব্যবধানে অভিযোজনের এবং আয় বৃদ্ধি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীতে ছড়িয়ে পড়ায় আপেক্ষিক ধনবৈষম্য না বাড়ার ফলে কালান্তরে আয় বৃদ্ধি সত্ত্বেও সুখের পরিমাপ বাড়ে না।

কালান্তরে আয় বাড়ছে, অথচ সুখ বাড়ছে না। তবে কেন নিরন্তর মানুষ অর্থের পেছনে দৌড়াচ্ছে? মানুষ কেন নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শিখছে না? অর্থের পেছনে না ঘুরে পরিবারের সঙ্গে বেশি সময় কাটালে অথবা স্বাস্থ্যচর্চা করলে তাদের সুখী হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তবু পরিবার ও স্বাস্থ্যকে অবহেলা করে কেন আয়ের ওপর মানুষ জোর দিচ্ছে? এর কারণ এখনো সুস্পষ্ট নয়। তবে কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ থাকতে পারে। একটি কারণ হতে পারে, সবাই বাড়তি আয়ের জন্য ইঁদুর-দৌড়ে অংশ নিলে যে দৌড়াবে না। সে পিছিয়ে পড়বে। সময়ের ব্যবধানে আয়ের যথেষ্ট ওঠানামা ঘটতে পারে। অন্যদের আয়ের তুলনায় পিছিয়ে পড়ার ভয়ে সবাই তটস্থ থাকে। তাই আয় থেকে যতটুকু সুখ পায় তার চেয়ে অনেক বেশি উদ্যম ও সময় অর্থ উপার্জনের জন্য ব্যয় করে। পরিবারের সঙ্গে কিংবা স্বাস্থ্যচর্চা বা বিনোদনের জন্য একজন ব্যক্তি কত সময় খরচ করবে, এটা তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। কিন্তু অর্থের জন্য সে কতটুকু পরিশ্রম করবে, এটি অনেকাংশে সমাজ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজন পূর্ণকালীন শ্রমিক বছরে প্রায় ২ হাজার ঘণ্টা কাজ করে; অথচ জার্মানিতে ১ হাজার ৬৭০ থেকে ১ হাজার ৬৮০ ঘণ্টা কাজ করে (রিচার্ড লেয়ার্ড, ২০০৫, ৫০)। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীদের সমকক্ষদের সঙ্গে প্রতিযোগী থাকার জন্য ইউরোপিয়ানদের চেয়ে অনেক বেশি দৌড়াতে হয় টাকার পেছনে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে কালান্তরে সুখ কমছে।

৫. সুখের আয়বহির্ভূত অর্থনৈতিক নিয়ামকগুলি

আয়ই সুখের একমাত্র অর্থনৈতিক নিয়ামক নয়। বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি ও সামাজিক অসাম্যও সুখের মাত্রাকে প্রভাবান্বিত করে। বেকারত্ব শুধু একটি অর্থনৈতিক অভিশাপই নয়, বেকারত্ব একই সঙ্গে একটি মানবিক ও সামাজিক দুর্যোগও বটে। বেকারত্ব আত্মসম্মানের সংকট সৃষ্টি করে। যারা চাকরি হারায় তাদের মর্যাদার হানি ঘটে। তারা কর্মক্ষেত্রে সহযোগীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করে। তাদের মানসিক যন্ত্রণার ফলে তাদের মৃত্যুর হার বেড়ে যায়, আত্মহত্যার ও মাদকাসক্তির হার বৃদ্ধি পায়। তাদের পরিবারের মধ্যেও ফাটল দেখা দেয়। উপরন্তু সমাজে মর্যাদার হানি ঘটে। বেকারত্বের মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক মাশুল বেকারত্বের আর্থিক লোকসানের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিকর। ফ্রে ও স্ট্রটজারের (২০০২, ৯৯) মতে, বেকারত্বের ফলে যে পরিমাণ সুখ কমে, তার এক তৃতীয়াংশ ঘটে বেকারত্বের ফলে আয় হ্রাস পাওয়ায় আর দুই-তৃতীয়াংশের জন্য দায়ী হলো মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক ক্ষতি। ব্রিটেনে বেকারত্ব সম্পর্কে গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যে বেকারত্ব যত সুখ হ্রাস করে, অন্য কোনো ঘটনা ব্যক্তির তত ক্ষতি করে না। বেকারত্ব বিবাহবিচ্ছেদের চেয়েও বেদনাদায়ক।

যুক্তরাষ্ট্রের বেকারত্ব সম্পর্কে রোনাল্ড রেগানের একটি সুন্দর চুটকি রয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ‘Recession is when your neighbor loses his job. Depression is when you lose yours. And recovery is when Jimmy Carter loses his.’ (যখন আপনার প্রতিবেশী চাকরি হারান। তখন অর্থনীতিতে পড়তি অবস্থা। যখন আপনার চাকরি চলে যায় তখন অর্থনীতিতে মন্দা। আর যখন জিমি কার্টার তার চাকরি (রাষ্ট্রপতিত্ব) হারান তখন অর্থনীতির নিরাময় ঘটে)। রেগানের রাজনৈতিক বক্তব্য না মেনে। নিলেও এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে মানুষ শুধু তার নিজের বেকারত্ব নিয়েই উদ্বিগ্ন নয়, সে তার প্রতিবেশীদের বেকারত্ব নিয়েও শঙ্কিত থাকে। বেকারত্বের হার বাড়তে থাকলে সমাজে সুখ কমতে থাকে। একটি সমীক্ষাতে সুখের দৃষ্টিকোণ থেকে মোট জনসংখ্যাকে চার ধাপে বিভক্ত করা হয়েছে। (অতিসুখী, মোটামুটি সুখী, তত সুখী নয়, সর্বনিম্ন পর্যায়ের সুখী)। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, বেকারত্বের হার এক শতাংশ বাড়লে প্রতি ধাপের জনসংখ্যার দুই শতাংশ সুখের পরবর্তী ধাপে নেমে যায় (ব্রুনো এস ফ্রে ও ধ্রুটজার, ২০০২ খ, ৪২০)। এর কারণ হলো দেশে বেকারত্বের হার বাড়লে সবাই নিজ নিজ চাকরি হারানোর ভয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। ৪৬টি দেশে ৯০ হাজার ব্যক্তিকে নিয়ে একটি সমীক্ষাতে দেখা যাচ্ছে যে মানুষের সুখের জন্য দুটি উপাদান সবচেয়ে হানিকর। এদের গুরুত্ব সমান। এ দুটি উপাদান হচ্ছে বেকারত্ব ও স্বাস্থ্যহানি (রিচার্ড লেয়ার্ড, ২০০৬, ৬৪)।

মূল্যস্ফীতি : একজন মার্কিন অর্থনীতিবিদ যথার্থই বলেছেন, মানুষ। মূল্যস্ফীতিকে ঘৃণা করে, অথচ মূল্যস্ফীতির কোনো কোনো কারণকে খুবই পছন্দ করে। যেমন ধরুন, সরকার কর না বাড়িয়ে ঘাটতির মাধ্যমে অতিরিক্ত সেবা প্রদান করলে সবাই খুশি হয়; অথচ এ ঘাটতির ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে। মূল্যস্ফীতি বিশেষ করে অর্থনীতিতে অস্থিরতার জন্ম দেয়। বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদই উচ্চ মূল্যস্ফীতির বিপক্ষে। তবে নিম্ন মূল্যস্ফীতি নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। মূল্যস্ফীতি সব অবস্থাতেই স্থির আয়ের আর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রকৃত আয় হ্রাস করে। তবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটলে অনেকের আয় বেড়ে যেতে পারে এবং তার প্রকৃত আয় স্থির থাকতে পারে অথবা বাড়তে পারে। আপাতদৃষ্টিতে তাদের সুখ কমে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে সুখসংক্রান্ত মনস্তাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা যায়, সবাই মনে করে যে মূল্যস্ফীতি তাদের প্রকৃত আয় হ্রাস করছে এবং মূল্যস্ফীতি ক্ষতিকারক। সাধারণ মানুষের মূল্যস্ফীতি নিয়ে তিনটি উদ্বেগ রয়েছে। প্রথমত, সবাই মনে করে যে ভবিষ্যতে মূল্য বাড়তে থাকলে তাদের প্রকৃত আয় কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, মূল্যস্ফীতির ফলে ধনীরা ফুলে-ফেঁপে ওঠে আর গরিবেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তৃতীয়ত, সমাজে বেশির ভাগ মানুষ মনে করে যে মূল্যস্ফীতি অনৈতিক। মেহনতি মানুষকে নিঃস্বতর করে মূল্যস্ফীতি সমাজে অস্থিরতার সৃষ্টি করে। আবার কেউ কেউ মনে করে যে মূল্যস্ফীতি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে।

১৯৭৫-১৯৯১ সময়কালে ইউরোপে পরিচালিত একটি সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, মূল্যস্ফীতি ১ শতাংশ বাড়লে সুখের গড় পরিমাপ (১ থেকে ৪ স্কেলে) ৩.২ থেকে ৩.১ শতাংশে কমে আসে। আপাতদৃষ্টিতে এ প্রভাব ক্ষীণ মনে। হলেও মূল্যস্ফীতির হার লক্ষণীয়ভাবে বাড়লে সুখের ওপর তার সুস্পষ্ট প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। যদি মূল্যস্ফীতির হার ৫ শতাংশ বাড়ে তবে এ ক্ষেত্রে সুখের গড় পরিমাপ ৩.২ থেকে ২.৭ শতাংশে নেমে আসে।

বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি উভয়েই সুখের শত্রু। আশির দশক থেকে মার্কিন রাজনীতিবিদেরা দেশের মানুষের অর্থনৈতিক সুখ মাপার জন্য একটি নতুন সূচক ব্যবহার করছেন। তারা এর নাম দিয়েছেন Misery Index বা দুর্গতির সূচক। এই সূচক হচ্ছে মূল্যস্ফীতির শতকরা হার ও বেকারত্বের শতকরা হারের যোগফল। যদি কোনো দেশে বেকারত্বের হার হয় ১০ শতাংশ ও মূল্যস্ফীতির হার হয় ১০ শতাংশ, তবে দুর্গতির হার হবে ২০ শতাংশ। তবে উন্নত দেশগুলিতে এ হার কমানোর একটি বড় অসুবিধা হলো, যেসব দেশে কর্মসংস্থানের হার অতি উঁচু, সেসব দেশে বেকারত্ব হ্রাস করতে গেলে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যায়। ফলে দুর্গতির হার কমে না। অবশ্য সুখের দৃষ্টিকোণ থেকে দুর্গতির সূচকের একটি বড় দুর্বলতা রয়েছে। এই হারের প্রবক্তারা বিশ্বাস করেন যে মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধি ও বেকারত্বের হার বৃদ্ধি একই মাত্রায় সুখ হ্রাস করে। বাস্তবে বেকারত্ব মূল্যস্ফীতির চেয়ে সুখের জন্য অনেক বেশি হানিকর। ১৯৭৩-১৯৯৮ সময় কালে ইউরোপে সুখ-সম্পর্কিত একটি সমীক্ষা থেকে দেখা যায় ১ শতাংশ মূল্যস্ফীতি যে পরিমাণ সুখ হ্রাস করে, তার ৪.৭ গুণ সুখ নাশ করে ১ শতাংশ বেকারত্বের বৃদ্ধি (রাফায়েল ডি তুল্লা ও রবার্ট ম্যাক্‌-কুলক, ২০০৬, ৩৮)। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি হ্রাসের চেয়ে বেকার সমস্যা হ্রাস অনেক বেশি জরুরি।

ধন-বণ্টনও সুখের একটি নিয়ামক। যারা ধনী তাদের জন্য মূল্যস্ফীতি আদৌ কোনো সমস্যা নয়। অথচ যারা স্থির আয়ের দরিদ্র, মূল্যস্ফীতি তাদের জন্য একটি বড় বালাই। জনসংখ্যার সিংহভাগ সচ্ছল হলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নিদারুণ দুর্গতি সত্ত্বেও সুখের ওপর মূল্যস্ফীতির প্রভাব সীমিত থাকবে। একই কারণে অর্থনৈতিক অসাম্য দূর করার জন্য সম্পদের পুনর্বণ্টন সমাজের সুখ বাড়াতে পারে। সম্পদের পুনর্বণ্টন হলে ধনীরা আর্থিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু যেহেতু তাদের অনেক অর্থ আছে সেহেতু পুনর্বণ্টনের আর্থিক ক্ষতি তাদের তত কষ্টের কারণ হয় না। পক্ষান্তরে পুনর্বণ্টনের ফলে গরিবেরা অল্প লাভবান হলেও অনেক বেশি। সুখী হয়। কাজেই ধনের পুনর্বণ্টন সমাজে সুখ বাড়াতে পারে। পুনর্বণ্টনের সমস্যা অন্যত্র। পুনর্বণ্টনের জন্য করের বোঝা বাড়ানো হলে বিত্তবানরা অতিরিক্ত বিনিয়োগের প্রণোদনা হারিয়ে ফেলতে পারে। এতে সমাজে ধন উৎপাদন কমে যেতে পারে। আয় কমে যাওয়াতে সুখ কমে যেতে পারে। কাজেই ধন পুনর্বণ্টনের আগে এর লাভ ও ক্ষতি দুটি দিকই বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে।

৬. সুখ ও রাজনৈতিক পরিবেশ

প্রখ্যাত মার্কিন রাজনৈতিক নেতা প্যাট্রিক হেনরি দাবি করেছিলেন, ‘Give me liberty or give me death’ (হয় স্বাধীনতা দাও নয় মৃত্যু দাও)। হেনরি বিশ্বাস করতেন যে মানুষের সুখের জন্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা অপরিহার্য। বাঙালি কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন :

স্বাধীনতা হীনতায়      কে বাঁচিতে চায় হে,
কে বাঁচিতে চায়?
দাসত্ব শৃঙ্খল বল       কে পরিবে পায় হে,
কে পরিবে পায়?
কোটিকল্প দাস থাকা       নরকের প্রায় হে,
নরকের প্রায়।
দিনেকের স্বাধীনতা       স্বর্গসুখ তায় হে,
স্বর্গসুখ তায়।

স্বাধীনতার এসব বর্ণনা পড়লে স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে যে স্বাধীনতার সঙ্গে সুখের সত্যি কোনো সম্পর্ক রয়েছে কি না। বিশেষজ্ঞদের মতে তিন ধরনের স্বাধীনতা রয়েছে :

• রাজনৈতিক স্বাধীনতা মানব অধিকার ও জনগণের রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকার প্রদান করে।

• অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়া পণ্য ও সেবার অবাধ উৎপাদন, বণ্টন ও বিনিময় নিশ্চিত করে।

• ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ব্যক্তির নিজ নিজ ধর্ম পালনের সুযোগ, অবাধে চলাচল ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার সংরক্ষণ করে।

১৯৯০-এর দশকে ৩৮টি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সুখ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার সম্পর্ক নিয়ে একটি সমীক্ষা পরিচালিত হয়। এ সমীক্ষাতে সুখের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ধনাত্মক সহগমন পরিলক্ষিত হয়। তবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলির আয়ের প্রভাবও এতে প্রতিফলিত। এই আয়ের প্রভাব বাদ দিলে দরিদ্র দেশগুলির সঙ্গে ধনী দেশগুলির একটি বড় তফাত দেখা যায়। গরিব দেশগুলোতে সুখের সঙ্গে শুধু অর্থনৈতিক স্বাধীনতার তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সুস্পষ্ট সম্পর্ক দেখা যায় না। ধনী দেশগুলির ক্ষেত্রে শুধু অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নয়, তিন ধরনের স্বাধীনতাই তাৎপর্যপূর্ণ।

তবে এ ধরনের সহগমন থেকে বোঝার উপায় নেই যে গণতন্ত্রের কোন উপাদানগুলি জনসাধারণকে সুখী করে। এ সম্পর্কে সুইজারল্যান্ডের গণতন্ত্র সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা করেছেন ফ্রে এবং স্ট্রটজার (২০০২)। তাদের মূল সিদ্ধান্তগুলি নিম্নরূপ :

১) সুইজারল্যান্ডে ২৬টি ক্যান্টন বা প্রশাসনিক এককে বিভিন্ন ধরনের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু আছে। কোথাও কোথাও সরকারের সব আয় ব্যয়সংক্রান্ত বিষয়ে বড় সিদ্ধান্ত গণভভাটের মাধ্যমে নেওয়া হয়। এ ধরনের ব্যবস্থাকে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। আবার কোথাও কোথাও পরোক্ষ গণতন্ত্র চালু রয়েছে, যেখানে ভোটারদের অনুমতি ছাড়াই নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সব সিদ্ধান্ত নেন। সমীক্ষায় দেখা যায়, যেখানে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র রয়েছে সেখানে মানুষ পরোক্ষ গণতান্ত্রিক অঞ্চলের মানুষের চেয়ে সুখী। প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় করের হার কম হয়; সরকারের ঋণ কম হয়; শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বেশি হয়। যেহেতু সাধারণ মানুষ এ ধরনের অঞ্চলে বাস করতে পছন্দ করে, সেহেতু এসব অঞ্চলে জমির দাম বেড়ে যায়।

২) সুইজারল্যান্ডের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, যেখানে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ যত বেশি সেখানে মানুষ তত সুখী। বিকেন্দ্রীকরণ হলে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ সহজ হয়। এখানে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নও ত্বরান্বিত করা সম্ভব। তাই বিকেন্দ্রীকরণ সুখ বাড়িয়ে দেয়।

৭. উপসংহার

সুখ সম্পর্কে দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতদ্বৈধতা রয়েছে। চৈনিক দার্শনিক লাও জু (Lao Tsu) বিশ্বাস করতেন, সক্রিয় উদ্যোগ সুখ আনতে পারে না, নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমেই সুখ অর্জন সম্ভব। অনেকে মনে করেন যে সুখ খুঁজতে গিয়ে ব্যর্থ হলে মানুষ আরও অসুখী হয়। প্রখ্যাত মার্কিন লেখক ন্যাথানিয়েল হথর্ন মনে করেন, সুখ অর্জনের চেষ্টা বৃথা। তিনি লিখেছেন, ‘Happiness is like a butterfly which, when pursued, is always beyond our grasp, but, if you sit down quietly, may alight upon you.’ (সুখ হচ্ছে প্রজাপতির মতো যাকে তাড়া করে ধরা যায় না। তবে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকলে নিজেই আপনার গায়ের ওপর এসে বসবে)। সুখের পেছনে দৌড়ালে সব সময় সুখ মেলে না, অনেক সময় তার বদলে দুঃখ পাওয়া যায়। তাই একজন মার্কিন লেখক লিখেছেন, ‘The search of happiness is one of the chief sources of unhappiness’ (76375 অন্বেষা হচ্ছে দুঃখের একটি বড় কারণ)।

সুখের অন্বেষার ফলাফল যা-ই হোক না কেন, মানুষ প্রতিনিয়ত সুখ খুঁজছে। সুখের উৎস শুধু অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য নয়। অর্থনীতি-বহির্ভূত অনেক উপাদানও সুখের নিয়ামক। সুখ তাই জাতীয় উৎপাদের চেয়ে অনেক ব্যাপক। উপরন্তু সুখ সম্পর্কে ব্যক্তির মূল্যায়নও সহজে সংগ্রহ করা যায় । তাই আশা করা হয়েছিল, ব্যক্তিদের সুখ সম্পর্কে মনোনির্ভর মূল্যায়ন যোগ করলে সহজেই জাতীয় সুখের পরিমাপ করা সম্ভব। এ হিসাব জীবন-কুশলতার পরিমাপ হিসেবে অনেক বেশি নির্ভরশীল হবে। কিন্তু এ আশা সফল হয়নি। জাতীয় সুখের সূচক-সম্পর্কিত প্রাক্কলনের তিনটি প্রধান দুর্বলতা রয়েছে। প্রথমত, সুখের কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। মানুষের যতই আয় বাড়ছে সুখের জন্য উপকরণের চাহিদা ততই বাড়ছে। তাই আয় বৃদ্ধির অনুপাতে সুখ বাড়ে না। উপরন্তু ব্যক্তির সুখ শুধু তার নিজের আয়ের ওপর নির্ভর করে না। অনেকাংশে তা নির্ভর করে সমাজের অন্যদের আয়ের ওপর। অন্যদের আয় কমে গেলে নিজের আয় না বাড়লেও সুখ বেড়ে যেতে পারে। তাই এ ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করে জীবন-কুশলতার অগ্রগতি বা অবনতি পরিমাপ করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, সমাজের সব মানুষের সুখ একসঙ্গে যোগ করা সম্ভব নয়। ব্যক্তিভেদে সুখের নিবিড়তার প্রভেদ ঘটে। ধরুন, লটারিতে আয় হঠাৎ বেড়ে গেলে সবার সুখ একই মাত্রায় বাড়বে না। কারও কারও ক্ষেত্রে বাড়তি আয়ের সুখ অতি তাড়াতাড়ি অভিযোজিত হয়, যার ফলে সুখের পরিবর্তন ক্ষণস্থায়ী হয়। কারও কারও ক্ষেত্রে অভিযোজন সম্পূর্ণ হয়। আবার কারও কারও ক্ষেত্রে অভিযোজন অসম্পূর্ণ থাকে। সে ক্ষেত্রে সুখের পরিমাণ বেশি হয়। যেখানে অভিযোজন সম্পূর্ণ হয়, সেখানে সুখ বৃদ্ধির মাত্রা শূন্যে নেমে আসে। অভিযোজনের মাত্রাভেদে তাই সুখের পরিমাপে বিভিন্ন ব্যক্তির সুখের ওজন ভিন্ন হওয়া উচিত। যদিও বাস্তবে তা সম্ভব হয় না। সামাজিক সুখ প্রাক্কলনে তাই সকলের অভিযোজনের মাত্রা অভিন্ন ও সমান বলে অনুমান করা হয়। এই অনুমান একেবারেই অচল।

তৃতীয়ত, সুখের পরিমাপ করা হয় ব্যক্তির মনোনির্ভর মূল্যায়নের ভিত্তিতে। ব্যক্তি যদি বুঝতে পারে যে তার মূল্যায়নের ভিত্তিতে সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তবে সে তার নিজের ইচ্ছামতো সরকারকে প্রভাবান্বিত করার জন্য মিথ্যা তথ্য প্রদান করতে পারে। এ ধরনের পক্ষপাতদুষ্ট মূল্যায়নের ভিত্তিতে সুখের সঠিক পরিমাপ সম্ভব নয়। সমাজের সুখের পরিমাপ হিসেবে সামাজিক সুখের প্রাক্কলন স্কুল জাতীয় উৎপাদের চেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য নয়।

ফ্রে ও স্ট্রটজার (২০০৬) মনে করেন, সুখ-সম্পর্কিত গবেষণার মূল লক্ষ্য সমাজের সামগ্রিক সুখ বাড়ানো নয়। কারণ সামগ্রিক সুখের হ্রাস-বৃদ্ধির নিখুঁত পরিমাপ করা সম্ভব নয়। সুখ সম্পর্কে গবেষণার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন একটি প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করা, যার মাধ্যমে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের সুখের জন্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এঁদের মতে, প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র মানুষের সুখ বৃদ্ধির জন্য অধিকতর সহায়ক।

ফ্রে ও স্ট্রটজারের বক্তব্য সুইজারল্যান্ডের মতো উন্নত দেশের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে রচিত। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলির বেলায় এ বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সুখ-সম্পর্কিত সমীক্ষায় ধনী ও গরিবদের মধ্যে কোনো তফাত করা হয় না। অথচ গরিবদের সুখ-দুঃখ বুঝতে হলে গরিবদের সরাসরি স্বতন্ত্র প্রশ্নমালার ভিত্তিতে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার সুযোগ দিতে হবে। দীপা নারায়ণ ও অন্যরা (২০০০) সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন, সমীক্ষার মাধ্যমে নয়, শুধু অংশগ্রহণমূলক গবেষণার ভিত্তিতে দরিদ্রদের সুখ দুঃখের উপলব্ধি সম্ভব। এ ধরনের গবেষণার নামকরণ করা হয়েছে দরিদ্রদের কণ্ঠস্বর’ বা Voices of the Poor।

অর্থনীতিতে সুখ-সম্পর্কিত গবেষণার সবচেয়ে বড় অবদান হলো, এর ফলে অর্থনীতিতে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলি অধিকতর প্রাধান্য লাভ করেছে। এ প্রসঙ্গে নিম্নলিখিত সূত্রগুলি সম্পর্কে অর্থনীতিবিদদের আরও সজাগ থাকতে হবে :

• স্থিতাবস্থার (Status quo) প্রতি পক্ষপাত ও লাভ-ক্ষতির ক্ষেত্রে সুখের তারতম্য : একই পরিমাণ লাভ করলে যে পরিমাণ সুখ হয়, ওই পরিমাণ লোকসান করলে তার চেয়ে দুঃখ অনেক বেশি হয়। গবেষকদের নিরীক্ষা থেকে দেখা যায় যে ১০০ ডলার হারালে মানুষের যে কষ্ট হয় সে পরিমাণ সুখ অর্জন করতে ২০০ ডলার লাভ করতে হবে (লেয়ার্ড, ২০০৫, ২২৭)। অর্থাৎ মানুষ যা আছে তা হারাতে চায় না। স্থিতাবস্থার প্রতি মানুষের পক্ষপাত রয়েছে। যারা সুখী তারা তাদের যা আছে তাই নিয়ে খুশি। একজন ইহুদি ধর্মযাজক যথার্থই বলেছেন, ‘Happiness is not having what you want. It is wanting what you have.’ (আপনি যা চান তা অর্জন করলে সুখ আসবে না, বরং সুখী হতে হলে আপনার যা আছে তা-ই চাইতে হবে)।

• ঝুঁকির প্রতি বিতৃষ্ণা : ঝুঁকি নিয়ে লাভ করার চেয়ে লোকসান এড়ানো বেশির ভাগ মানুষের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতির ভাষায় বেশির ভাগ মানুষের ঝুঁকির প্রতি অনীহা রয়েছে। তাই রাষ্ট্র যদি এমন কোনো সংস্কার করে, যার ফলে দীর্ঘ মেয়াদে অনেক বড় লাভ হলেও স্বল্প মেয়াদে কিছুসংখ্যক লোকের ক্ষতি হতে পারে, তাহলে সংস্কারের বিরোধীরা যত সক্রিয় হবেন সংস্কারের সম্ভাব্য উপকারভোগীরা তত সোচ্চার হবেন না। যারা সংস্কারের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তাঁদের সংস্কারের আগে ক্ষতিপূরণ করা হলে সংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বাঁধার আশঙ্কা রয়েছে।

• সুখের জন্য ব্যক্তিসত্তার চেয়ে সামাজিক সত্তার গুরুত্ব অধিক: নিজের আয় বাড়লেই মানুষের সুখ বাড়ে না। অন্যের আয়ের তুলনায় নিজের আয় বাড়লে মানুষের সুখ বাড়ে। সামাজিক মর্যাদা সুখের একটি বড় উপাদান। সামাজিক সম্পর্কও সুখের নিয়ামক। বন্ধুবিচ্ছেদ, বিবাহবিচ্ছেদ, প্রতারণা মানুষের সুখ কমাতে পারে। পক্ষান্তরে সফল পারিবারিক সম্পর্ক মানুষের সুখ বাড়াতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুখ বাড়ানোর জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, পরিবারের সদস্যদের সুবিধামতো কাজের সময় ঠিক করার ব্যবস্থা, কাজের সময় শিশুদের পরিচর্যার সুযোগ ও প্রসবকালীন দীর্ঘ ছুটির উল্লেখ করা যেতে পারে। তবে রাষ্ট্রের পক্ষে ধনবৈষম্য উৎসাহিত করা বিপজ্জনক। অনেকে তাক লাগানো ভোগবিলাস থেকে সুখ-লাভ করলেও অধিকাংশ নাগরিকই এ ধরনের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়। এর ফলে গোটা সমাজে অসন্তোষের দাবানল ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।

• সুখ সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী প্রবণতা : মানুষ একদিকে হিংসুটে, অন্যদিকে সে পরার্থপর। অন্যের তুলনায় আয় বাড়লে যে মানুষ মনে মনে আত্মপ্রসাদ লাভ করে, সে মানুষই পরের দুঃখে কাঁদে।

• বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি : বাড়তি আয় মানুষের সুখ বাড়ায়। তবে শুধু আয় বৃদ্ধিই মানুষের সুখের জন্য যথেষ্ট নয়। বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি মানসিক যন্ত্রণার সৃষ্টি করে। সঙ্গে সঙ্গে এসব ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তাও মানুষের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

• রাষ্ট্র দুর্গতি ও দুঃখ হ্রাস করতে পারে, তবে সুখ বাড়াতে পারে নাঃ দুঃখের ও দুর্গতির কারণ বাইরে থেকে দেখা যায়। রাষ্ট্র অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা পূরণ করে, বেকারত্ব কমিয়ে ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে নাগরিকদের দুর্গতি ও উদ্বেগ কমাতে পারে। কিন্তু মানুষের সুখ বাড়ানোর জন্য তা যথেষ্ট না-ও হতে পারে।

জন বি শিরিন যথার্থই লিখেছেন, ‘Happiness is not in our circumstances but in ourselves. It is not something we see, like a rainbow, or feel, like the heat of a fire. Happiness is something we are.’ (সুখ পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত হয় না, সুখ আমাদের ভেতর থেকে উৎসারিত হয়। সুখ রংধনুর মতো নয় যে তাকে দেখা যাবে, সুখ আগুনের উত্তাপের মতো নয় যে তাকে অনুভব করা যাবে। আমরা নিজেরাই সুখ)। বাইরে থেকে রাষ্ট্র বা সমাজ সুখের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু শুধু ব্যক্তিরাই সুখ সৃষ্টি করতে পারে। মার্কিন রাষ্ট্রনায়ক বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন তাই foresloga, ‘The Constitution only gives people the right to pursue happiness. You have to catch it yourself.’ (সংবিধান নাগরিকদের সুখের পেছনে ছোটার অধিকার দিয়েছে। আপনাকেই সুখকে পাকড়াও করতে হবে)।

সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সুখের সংজ্ঞা নির্ধারণ সম্ভব নয়। ব্যক্তিভেদে সুখের তাৎপর্য ভিন্ন হয়। এ প্রসঙ্গে গোপাল ভাঁড়ের একটি সুন্দর গল্প স্মরণ করা যেতে পারে। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র একদিন গোপালকে প্রশ্ন করলেন, ‘গোপাল, বলো তো, কিসে মানুষের সবচেয়ে বেশি সুখ হয়?’

গোপাল বলল, ‘আজ্ঞে মহারাজ, আমার তো মনে হয় পেট পরিষ্কার হয়ে বাহ্যি করার চেয়ে বড় সুখ পৃথিবীতে নেই।’

মহারাজ খুব খেপে বললেন, ‘গোপাল তুই নিজে নোংরা এবং তোর কথাও নোংরা।’ গোপাল তাড়াতাড়ি বেফাঁস কথার জন্য ক্ষমা চাইল।

এর কয়েক দিন পর মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র গোপালসহ অমাত্যদের নিয়ে সুন্দরবন ভ্রমণে বের হলেন। একদিন মাঝনদীতে যখন সফর করছেন তখন মহারাজার খুব বাহ্যির বেগ পেল। মহারাজ সঙ্গে সঙ্গে হুকুম দিলেন, ‘নৌকা ভেড়াও।’

একজন মাঝি বলে উঠল, “হুজুর একটু অপেক্ষা করুন। একটু আগে এখানে একটা বাঘ দেখা গেছে।

একটু পর মহারাজ হুকুম দিলেন, ‘নৌকা ভেড়াও।’ পাড়ের দিকে নৌকা যেতেই একটি কুমির ভেসে উঠল ।

এবারও নৌকা ভেড়ানো হলো না। মহারাজের ততক্ষণে খুব খারাপ অবস্থা। তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘নৌকা পাড়ে ভেড়াও।’ পাড় কাছে এলে দেখা গেল, জায়গাটি খুবই কর্দমাক্ত। গোপাল কিছু বলতে চাইছিল। মহারাজ কারও কোনো কথা না শুনে কাদায় লাফিয়ে পড়লেন এবং কোনোরকমে পাড়ে উঠে তাঁর কাজকর্ম শেষ করে কর্দমাক্ত অবস্থায় নৌকায় ফিরে এলেন। তারপর স্নান শেষে গোপালকে বললেন, ‘গোপাল, কী যে সুখ লাগছে এখন! তুমি খাঁটি কথা বলেছিলে।’

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের মতো আমরা সকলেই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সুখের বহু বিচিত্র রূপ অনুভব করি ।

.

উল্লেখিত রচনাবলি (Works Cited)

ইস্টারলিন, রিচার্ড (Easterlin, Richard)। ২০০১। Growth Triumphant. Ann Arbor: University of Michigan Press.
–। ২০০৩। Explaining Happiness. Proceedings of the National Academy of Sciences of the United States of America.

ক্যায়নেম্যান, ড্যানিয়েল এবং এলেন বি ক্রুগার (Kahneman, Daniel and Alan B. Krueger) / Rooy 1 ‘Developments in the Measurement of Subjective Well-Being’ The Journal of Economic Perspectives. Vol. 20. No.1.

তেল্লা, রবার্ট ডি এবং রিচার্ড ম্যাককুলক (Tella, Robert D. and Richard MacCulloch)। ২০০৬। ‘Some Lessons of Happiness Data in Economics’. The Journal of Economic Perspectives. Vol. 20. No. 1. 1915, 9 v astas (Narayan, Deepa and others) i 1000 I Can Anyone Hear Us? Oxford: Oxford University Press.

নিউ ইকোনমিকস ফাউন্ডেশন (New Economics Foundation)। ২০১২ ক। Happy Planet Index: 2012 Report, London.

ফ্রে, ব্রুনো এস এবং এলিয়েস স্ট্রুটজার (Frey, Bruno S. and Alois Strutzer)। ২০০২ ক। Happiness and Economics. Princeton: Princeton University Press.

—–। ২০০২ খ। ‘What Can Economists Learn From Happiness Research?’ The Journal of Economic Literature? Vol. XL.

—–। ২০০৬। ‘Should We Maximize National Happiness?’ Proceedings of the Conferece on New Directions in the Study of Happiness. University of Notre Dame.

ভিনহোভেন, রুট (Veenhoven, Ruut) । ২০০৪। ‘World Database on Happiness’ In Glazer W. and others, Challenges for Quality of Life in the Contemporary World. Dordrecht, The Netherlands: Kluwer Academic Publishers.

লেয়ার্ড, রিচার্ড (Layard, Richard) I food Happiness. London: Penguin Books.

স্টিগলিজ, জোসেফ ই ও অন্যান্য (Stiglitz, Joseph E. and Others। ২০০৮। Report of the Commision on the Measurement of Economic Performance and Social Progress. www. Stigliz-sen.fittousi.fr.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *