রাষ্ট্রবিপ্লব
১৯১৫ সালে শত্রুরা আমাদের সৈন্যদের মধ্যে প্রচারকার্য শুরু করে। ১৯১৬ সাল থেকে ক্রমাগত এটার বিস্তার হতে থাকে, এবং ১৯১৮ সালের শুরুতে এটা ফুলে ফেঁপে বন্যার আকার ধারণ করে। এখন কোন একজনের পক্ষে এ ধর্মান্তরিতের কাজের সুদূর প্রসারী ফলাফলের ধাপ বেয়ে বেয়ে এগনো সহজ। ধীরে ধীরে আমাদের সৈন্যরা শত্রুপক্ষ যেভাবে চায়, ঠিক সেইভাবে চিন্তা করতে শুরু করে। জার্মানদের পক্ষ থেকে এর বিরোধিতা করার জন্য কোনরকম প্রচারকার্যের ব্যবস্থা ছিল না।
জার্মান সৈন্যধ্যক্ষরা মনস্তত্বের দিক থেকে ভুল করত যদি তারা মানসিক শিক্ষা দেওয়ার কাজে হাত দিত। নিশ্চিত ফলপ্রদ ব্যাপার হিসেবে এটা ঘরোয়া নীতি। কারণ তারাই এতে সাফল্য লাভ করতে সক্ষম যারা চার বছর ধরে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে বীরের মত অশেষ কষ্টবরণ করেছে। কিন্তু তখন আমাদের দেশের লোকেরা কি করেছিল? এটা কি বুদ্ধিমত্তার অভাব নাকি বিশ্বাস না থাকার দরুণ এ অসাফল্য?
১৯১৮ সালের গ্রীষ্মের মাঝামাঝি; মারণে নদীর দক্ষিণ তীর থেকে পশ্চাদ অপসারণের পর জার্মান সংবাদপত্র যে নীতি গ্রহণ করেছিল তা এত মোটা এবং অপদার্থ বোকার মত ছিল যে আমি নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করতাম এবং যা দিনের পর দিন আমাকে ক্রুদ্ধই করে তুলেছিল। এটা কি সত্যি যে আমাদের মধ্যে সত্যিকারের সাহসী বলতে কি কেউ-ই ছিল না, যে এ ধরনের পেছন থেকে ছুরি মারার হাত থেকে আমাদের নায়কোচিত সৈন্যদের রক্ষা করতে পারে।
১৯১৪ সালের সে দিনগুলোতে ফ্রান্সে কি হয়েছিল, যখন আমাদের সৈন্যদল সে দেশ আক্রমণ করে একের পর এক যুদ্ধে জিতে এগিয়ে চলেছিল? ইতালির কি হয়েছিল—যখন তাদের সৈন্যদল ইজানো ফ্রন্টে বিধ্বস্ত? ১৯১৮ সালের বসন্তকালে ফ্রান্সে আবার কি হয়েছিল— যখন জার্মান সৈন্যদল ফ্রান্সের সৈন্যদের হটিয়ে দিয়ে মূল ঘাঁটিগুলোকে ঝড়ের গতিতে দখল করে বসেছিল এবং দূর পাল্লার জার্মান কামান সমানে পারীর ওপরে গোলাবর্ষণ করে চলেছিল?
কী করে এসব সৈন্যদলের মাথা উঁচু করা সাহস এবং জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস একটা ফুকারে নির্ভিয়ে দেওয়া হয়েছিল?
কিভাবে তাদের প্রচারকার্য এবং জনসাধারণকে সচেতন করার সুন্দর পদ্ধতিটাকে কাজে না লাগিয়ে যুদ্ধে নিশ্চিত জয়ী সৈন্যদের মাথার ওপরে খড়গাঘাত হেনেছিল।
ইতিমধ্যে আমাদের লোকেরা সেই জায়গায় কি করছিল? কিছুই নয়। বারে বারে আমি রোষান্বিত এবং ক্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম, বিশেষ করে শেষের দিকের সংবাদপত্রগুলো পড়ে যা’তে বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া ছিল কিভাবে তা জনসাধারণ এবং সৈন্যদের মধ্যে জড়তা জাগিয়ে তুলে নিধন যন্ত্র চালিয়ে চলেছে। এ চিন্তায় যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়েছি যে জার্মানদের প্রচারকার্যের ভার যদি আমার হাতে থাকত, (এসব অনুপযুক্ত অপরাধী বিশেষ নির্বোধ ব্যক্তি এবং দুর্বল প্রাণীদের হাতে না থেকে), তবে হয়ত সম্পূর্ণ চিত্রটাই অন্যরকম হত।
সেই মাসগুলোতে আমি অনুভব করেছিলাম যে আমাকে সীমান্তে যুদ্ধরত রেখে ভাগ্য আমার প্রতি বিরূপ খেলা খেলছে; এবং সেখানে দাঁড়িয়ে আমাকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হচ্ছে, সেখানে একটা নিগ্রো বা যে কারোর গুলি এসে আমাকে ইহকালের মত স্তব্ধ করে দিতে পারে, অথচ পিতৃভূমির জন্য অন্য জায়গাতে অনেক বেশি কাজ করতে সক্ষম। আমার নিজেরও যথেষ্ট পরিমাণে আত্মবিশ্বাস বর্তমান যে প্রচারকার্যের ব্যাপারটা আমি সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করতে পারি।
কিন্তু আমার পরিচিত বলতে তো কিছু ছিল না, আট লক্ষ্য সৈন্যের মধ্যে আমি সাধারণ একজন সৈনিক মাত্র। সুতরাং আমার পক্ষে চুপচাপ মুখ বন্ধ রেখে আমাকে যে কর্তব্য সম্পাদনা করতে দিয়েছে সেটা করে যাওয়াই যুক্তিযুক্ত।
১৯১৫ সালের গ্রীষ্মে আমাদের পরিখায় শত্রুপক্ষের প্রথম প্রাচীরপত্র পড়ে; তাদের প্রায় সবই এক ধাচের গল্প। শুধু আঙ্গিকেই যা কিছু একটু পরিবর্তন। গল্পটা হল জার্মানির দুঃখ দিনে দিনে জয়ের সম্ভাবনাটাও মলিন হয়ে আসছে। ঘরের লোকদের শান্তি এবং সন্ধির ইচ্ছা তীব্র হয়ে উঠেছে; কিন্তু সামরিক কর্তৃপক্ষ এবং কাইজারের জন্য তা বোঝার উপায় নেই। সমস্ত পৃথিবী জানত এ যুদ্ধ জার্মান জনসাধারণের জন্য শুধু হয়নি, হয়েছে কাইজারের ইচ্ছায়। তার জন্য জার্মান জনসাধারণও দায়ী নয়। দায়ী যদি কাউকে করতে। হয় তবে সে হল কাইজার; এবং যতদিন না পর্যন্ত পৃথিবীর শান্তির এ শত্রু কাইজারকে দূর করা হবে — ততদিন পর্যন্ত শান্তি আসার কোন উপায়ই নেই।
কিন্তু যুদ্ধ শেষ হলেই উদার এবং গণতান্ত্রিক দেশগুলো জার্মানিকে বন্ধু হিসেবে পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের কাজে সহযোগী করে নেবে। এ কাজটা করা হবে যে মুহূর্তে প্রুশিয়ার সামরিক বাহিনী শেষমেষ সমূলে ধ্বংস হবে।
এসব বক্তব্যকে সচিত্রিত এবং প্রমাণ করার জন্য, সেইসব প্রাচীরপত্রের প্রায়ই ‘বাড়ির চিঠি’ থাকত–যেগুলো শত্রুপক্ষের প্রচারকার্যের যথার্থতা প্রমাণের সহায়ক স্বরূপ। সত্যি বলতে কি, এত সব প্রয়াস দেখে আমরা হাসতাম। প্রাচীরপত্রগুলো পড়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পাঠিয়ে দিতাম, তারপরে পুরো ব্যাপারটাই ভুলে যেতাম–যতদিন পর্যন্ত ভাল একটা হাওয়া আবার পরিখার ভেতরে প্রবাহিত না হত। এসব প্রাচীরপত্রগুলো বিশেষ করে বিমান থেকে ফেলা হত এবং তার জন্য বিশেষ ধরনের বিমানের ব্যবহার করা হত।
এ প্রচারকার্যের একটা মুখাবয়ব অত্যন্ত চমকপ্রদ। ব্যাভেরিয়ান সৈন্যদলের ভেতরে শদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ গড়ে তোলার ক্রমাগত একটা প্রচেষ্টা চলছিল; প্রুশিয় এবং প্রুশিয়ার সৈন্যরাই নাকি এ যুদ্ধ বাধাবার এবং এটাকে জিইয়ে রাখার জন্য মূলত দায়ী। এবং সে কারণেই শত্রুপক্ষের ব্যাভেরিয়ার সৈন্যদলের প্রতি কোনরকম বিরূপতা নেই। কিন্তু তাদের সাহায্য করারও কোন পথ খোলা ছিল না। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা প্রশিয়ানদের স্বার্থরক্ষা করে চলেছে এবং আগুন থেকে তাদের জন্য বাদাম তোলার কাজে নিযুক্ত।
এ ক্রমাগত প্রচারকার্যের ফলাফল ১৯১৫ সালে আমাদের সৈন্যদের ওপর সুদূর প্রসারী হয়। ব্যাভেরিয়ার সৈন্যদের মধ্যে প্রুশিয়ার বিরুদ্ধে যথেষ্ট পরিমাণে বিক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। কিন্তু যারা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, তারা এর কোনরকম প্রতিবাদ করতে সচেষ্ট হয়নি। পুরো ব্যাপারটা একটা ভয়ঙ্কর রকমের অপরাধ বিশেষ। কারণ তৎক্ষণাৎ বা পরে শুধুমাত্র প্রশিয়ানদের কপালেই লাঞ্ছনা জোটে না, সমস্ত জার্মান জাতিকেই সেই দুর্ভাগ্যের অংশ বাধ্য হয়ে বরণ করে নিতে হয়।
এভাবে ১৯১৬ সালের পর থেকে শত্রুপক্ষের প্রচারকার্য অভাবনীয় সফলতা লাভ করতে শুরু করে।
ঠিক এভাবে সৈনিকদের বাড়ি থেকে যেসব চিঠিপত্রাদি আসতে থাকে তার ফলাফল হয় সুদূর প্রসারী। সমস্ত ব্যাপারটা এমন এক অবস্থায় এসে দাঁড়ায় যে শত্রুপক্ষের আর এভাবে প্রচারপত্র ছড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। এবং ঘরের থেকে সাধারণ সৈনিকদের ওপর আসা চাপ কমাতে মুখ শাসকবর্গ কয়েকটা মামুলী সতর্কবাণী উচ্চারণ করা ছাড়া আর কিছুই করেনি। বাড়ির থেকে সেন্টিমেন্টাল বৌ-দের লেখা চিঠির মাধ্যমে বয়ে আনা বিষ সমস্ত সীমান্তটাকে বিষাক্ত করে তোলে। একবারও তারা ভাবেনি যে এর দ্বারা শত্রুপক্ষের জয়ের পথই প্রশস্ত করা হচ্ছে বা তাদের নিজেদের পুরুষদের কাজ প্রলম্বিত এবং দিনে দিনে কষ্টকর হয়ে উঠছে। জার্মান দ্রমহিলাদের লেখা এসব বোকা চিঠিগুলোর মূল্য শয়ে শয়ে বা হাজারে হাজারে প্রাণের বিনিময়ে দিতে হয়।
এভাবে ১৯১৬ সালে বেশ কিছু হতভাগ্যজনক ঘটনাবলীর প্রকাশ পায়। সমস্ত সীমান্তটাই গোমরাতে থাকে, অনেক বিষয়েই অসন্তোষে ফেটে পড়ে,–যার বেশিরভাগই ন্যায় ছিল। একদিকে যখন এরা ক্ষুধার্ত এবং রোগগ্রস্ত, বাড়িতে আত্মীয়স্বজন চরম দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছে, ঠিক তখন অপর একদল মহোৎসব এবং পানোৎসবে মত্ত। হ্যাঁ, এমন কি সীমান্তের অবস্থাও একই প্রকার। যা হওয়াটা কোন রকমেই উচিত হয়নি।
এমন কি যুদ্ধের প্রারম্ভেই সৈনিকদের মধ্যে অসন্তোষের প্রবণতা ছিল; কিন্তু সমালোচনার ধোয়াটা নিজেদের ভেতরের গণ্ডীতেই সীমাবদ্ধ থাকায় তা আর বাইরে প্রকাশের সুযোগ পায়নি। যে এ মুহূর্তে বন্য মোরগের মত বিড় বিড় করে অসন্তোষ প্রকাশ করত, সে-ই মুহূর্ত কয়েক পরে সেই অসন্তোষ চাপা দিয়ে নিচুপে তার কর্তব্যের জায়গায় ফিরে যেত; যেন সবকিছুই স্বাভাবিকভাবে চলছে। যে সৈন্যদল কিছুক্ষণ আগে অসন্তোষে ফেটে পড়েছে, পরের মুহূর্তে সে পরিখায় বসে দাঁত মুখ কামড়ে আক্রমণ চালিয়েছে, যেন জার্মানির ভাগ্য কয়েক শ’গজ কর্দমাক্ত এবং বোমাবিধ্বস্ত মাটির উপরেই নির্ভর করছে। গৌরবোজ্জ্বল সেই পুরনো সৈন্যদল তখনো পরিখা আঁকড়ে পড়ে আছে। আমার নিজের ভাগ্যের হঠাৎ পরিবর্তন আমাকে এমন এক জায়গায় এনে দাঁড় করায় যে সেখান থেকে আমি এ পুরনো সৈন্যদল এবং সদ্য বাড়ি থেকে আসা সৈনিকদলের পার্থক্য বুঝতে পারি। ১৯১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষাশেষি আমি যে সৈন্যদলে ছিলাম, সে দলটাকে শেষে যুদ্ধের জন্য পাঠানো হয়। আমাদের কাছে এটাই ছিল সত্যিকাবের রীতিমত ভারী যুদ্ধ— যেখানে দাঁড়িয়ে আমাদের এ ধারণাই হয় যে, এটাকে যুদ্ধক্ষেত্র বলে প্রকৃত নরক আখ্যা দেওয়াটাই সঠিক।
যদিও সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে অবিরত বোমাবর্ষণের মুখে আমরা স্থির অচঞ্চলভাবে দাঁড়িয়ে থাকি, এ বোমাবর্ষণের ফলে সামান্য যেটুকু জায়গা আমাদের বাধ্য হয়ে পরিত্যাগ করে পিছু হটতে হয়েছে, পরেই আবার দখলও নিয়েছি; যা আর কখনো তাদের আওতায় যায়নি। ১৯১৬ সালের ৭ অক্টোবর আমি আহত হই এবং নেহাত ভাগ্যের জোরে নিজেদের শিবিরে সে আহত অবস্থায় ফিরে আসতে পারি। আমাকে সাহায্যকারী ট্রেনে জার্মানিতে ফেরত পাঠাবার আদেশ আসে।
প্রায় দু’বছর হয়ে গেল আমি বাড়ি ছেড়ে এসেছি; এ পরিবেশে মাত্র দু’টো বছরকে অনন্তকাল বলে মনে হয়। আমি চেষ্টা করেও স্মৃতিতে আনতে পারি না জার্মান লোকেরা সৈনিকের পোশাক ছাড়া দেখতে কি রকম। হারমিসের হাসপাতালে এসে কর্মরতা এক নার্সের গলার স্বর শুনে আমি চমকে উঠি, সে আমার কাছে শুয়ে থাকা একজন আহতের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিল। দু’বছর! এ সুদীর্ঘ দুবছর পরে জার্মান মেয়ের গলার স্বর শুনতে পেলাম।
সেই রিলিফ ট্রেন যত জার্মান সীমান্তের নিকটবর্তী হতে থাকে, তত বেশি চাঞ্চল্য জেগে ওঠে আমাদের ভেতরে। যে পথ ধরে দু’বছর আগে একজন যুবক কর্মী হিসেবে গেছি, সে পথগুলো যেন আমাদের কাছে অতি চেনা–ব্রাসেলস, লোভেন, লিগে; এবং শেষ পর্যন্ত আমরা যেন আমাদের জার্মান ভূমি চিনতে পারি।
১৯১৪ সালের অক্টোবর মাসে আমাদের হৃদয় উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল যখন আমরা এ সীমান্তকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাই। বর্তমানে নৈঃশব্দতা এবং সুগভীর আবেগ মনের ভেতরে সবচেয়ে বেশি মাথা উঁচু করে আছে। প্রত্যেকেই তার নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানায় কারণ যে ভূখণ্ডের জন্যে আমরা প্রাণ পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত ছিলাম, সে ভূখণ্ড আবার আমরা দেখতে পেয়েছি এবং প্রত্যেকেই যেন প্রত্যেকের দিকে লজ্জায় তাকাতে পারছিলাম না। সীমান্তে যুদ্ধে যাওয়ার প্রায় দ্বিতীয় বার্ষিকীতে আমি বার্লিনের কাছে চীলিৎসের হাসপাতালে ভর্তি হই।
কি বিরাট পরিবর্তন! সোমের কদমার্ত যুদ্ধক্ষেত্রের থেকে এ ধরনের বাড়ির ধবধবে সাদা বিছানায়। এ বাড়িতে ঢোকার সময়ে প্রত্যেকেরই দ্বিধা আসে। একমাত্র ধীরে ধীরে সবাই এ নতুন পৃথিবীতে আবার অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। দুর্ভাগ্যবশত সেখানে আরো কতকগুলো বিষয় ছিল যার জন্য এ নতুন জগত আমাদের অতি পরিচিত জগতের থেকে কিছুটা আলাদা ঠেকেছিল।
সীমান্তে সৈনিকদের সে উৎসাহ এখানে একান্তভাবেই অনুপস্থিত। আমিই প্রথম এমন কতগুলো বিষয়ের বিরোধিতা করি যা সীমান্তে কারোর এতদিন জানা ছিল না। বিশেষ করে নিজের কাপুরুষত্ব নিয়ে অহংকার করা। যদিও সীমান্তে অভাব অভিযোগের খামতি ছিল না, তবু আন্দোলন এবং এ অবাধ্যতা ও কাপুরুষতাকে অন্যের কাছে বিরাটভাবে তুলে ধরার প্রচেষ্টাও ছিল না। না, সীমান্তে একজন কাপুরুষ কাপুরুষই ছিল, তার বেশি কিছু নয়। বিশেষ করে তার ভয়টাই অন্যের ভেতরে সংক্রমিত হত। যেমন নায়কোচিত কারোর কাজকর্ম তাকে ঘিরে সবার প্রশংসা কাড়ত। কিন্তু এখানে, এ হাসপাতালে পুরো ব্যাপারটাই অন্যরকমের। গলা উঁচু আন্দোলনকারীরা সত্যিকারের ভাল সৈনিকদের নিয়ে ঠাট্টা পরিহাস করত এবং দুর্বল হাঁটু বিশিষ্ট কাপুরুষদের গৌরবের ঢঙে রাঙানোই ছিল এদের কাজ। কয়েকটা বিচিত্র মানুষ ছিল এ নিন্দুক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা। তাদের মধ্যে একজন তো হাসপাতালে আমার জন্য চালাকি করে কিভাবে কাটা তারে নিজের হাত কেটেছে তার বর্ণনা দিতেই ব্যস্ত। যদিও তার ক্ষত অত্যন্ত সামান্য, কিন্তু তার ধরন-ধারণে মনে হচ্ছিল সে এখানে দীর্ঘদিন ধরেই আছে এবং অনন্তকাল ধরেই থাকবে। কোনরকম শঠতার দ্বারা নিশ্চয়ই এ ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ সর্বনাশাত্মক উদাহরণের ধৃষ্টতা এত প্রচণ্ড রকমের ছিল যে তার অসাধুতাকে সে সাহসের অভিব্যক্তি বলে বর্ণনা দিত যা নাকী সেই সাহসী সৈনিক যে মৃত্যুবরণ করেছে তার চেয়েও অনেক উঁচু। অনেকেই এসব কথাবার্তা চুপচাপ শুনত, কিন্তু বেশিরভাগই তার কথায় সায় দিত।
ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে এটা অসহ্য যে, এ রকমের রাজদ্রোহাত্মক একজন আন্দোলনকারীকে এ ধরনের একটা প্রতিষ্ঠানে থাকতে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কি করার আছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও নিশ্চয়ই জানে লোকটা কে? সত্যি কথা বলতে কি, তারা জানত। তবু এ বিষয়ে তারা কিছু করেনি।
যেমাত্ৰ চলাফেরা করতে সক্ষম হই, আমি বার্লিন বেড়াবার জন্য ছুটি মঞ্জুর করাই।
সর্বত্র তিক্ত চাহিদার ছাপ। লক্ষ লক্ষ কাপুরুষে ভর্তি শহরগুলো অনাহারে কারাচ্ছে। বিভিন্ন হোটেলে, বিশ্রামাগারে একই ধরনের আলোচনা–যা আমাদের হাসপাতালে চলছে। দেখে শুনে আমার এ ধারণাই হয় যে আন্দোলনকারীরা ইচ্ছে করেই এককভাবে এসব জায়গায় জড়িয়ে পড়েছে যাতে তাদের মতামতটাকে সবার সামনে তুলে ধরা সম্ভব হয়।
কিন্তু মিউনিকের অবস্থা এর চেয়েও অনেক বেশি খারাপ। আমাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়ার পর সেখানকার সংরক্ষিত সৈন্যবাহিনীতে পাঠানো হয়। আমার চোখে মিউনিককে যেন অচেনা অজানা একটা শহর বলে মনে হয়। যেখানে যাওয়া যায় সে একই অভিযোগ। অসন্তোষ আর ক্রোধ। এরজন্য অবশ্য কিছু পরিমাণে দায়ী হল অসামরিক অফিসাররা। তারা অপটু অনভিজ্ঞ হাতে সৈন্যদের সঙ্গে ব্যবহার করেছে। তারা কোনদিন যুদ্ধক্ষেত্র দেখেনি এবং সে কারণেই যথাযোগ্যভাবে পুরনো সৈন্যদের সঙ্গে কিভাবে ব্যবহার করতে হয় তা তাদের জানা ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই এসব পুরনো সৈন্যদের মধ্যে চারিত্রিক দিক থেকে নির্দিষ্ট কিছু জিনিস উপস্থিত হয়, যা তারা পরিখার মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পেয়েছিল। এ সংরক্ষিত বাহিনীর পদস্থ কর্মচারীদের পক্ষে তা উপলব্ধি করা সম্ভব ছিল না, অথচ যারা যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়মিত সৈন্যদের সঙ্গে থেকেছে তারা তা বুঝতে পারত; সুতরাং সেই কারণে সে অনেক বেশি সম্মান পেত। এ যোগ্যতা থেকে সংরক্ষিত বাহিনীর অসামরিক পদস্থ কর্মচারীরা বঞ্চিত।
সীমান্তের কর্মরত উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা এ ব্যাপারটাকে বুঝতে পারলেও সংরক্ষিত বাহিনীর কর্মচারীরা ঠিক ব্যাপারটাকে অনুধাবন করে উঠতে পারত না। সুতরাং সাধারণ সৈনিকদের আচারে এ পাথর্ক তাদের চাখে বিরাট হয়ে ধরা দিত। কিন্তু এসব ছাড়াও সাধারণভাবে উৎসাহ বলতে কিছু ছিল না। এক কথায় শোচনীয় অবস্থা। এড়িয়ে যাওয়ার কলাকৌশলটাকেই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ বলে ভাবা হত; আর কাজের প্রতি একাগ্রতা ওদের ভাষায় দুর্বলতা বা গোঁড়ামী ছাড়া কিছু নয়। সরকারি অফিসগুলো ইহুদী কর্মচারীতে ঠাসা ছিল। কমবেশী প্রতিটি কেরানী ইহুদী এবং বলতে গেলে প্রতিটি ইহুদীই ছিল কেরানী। আমি এ বিরাট পছন্দ করা গোষ্ঠী দেখে অবাক হয়ে যেতাম, প্রকৃত সৈনিকদের মধ্যে যাদের উপস্থিতি নেহাত নগণ্য।
ব্যবসায় জগতের অবস্থা আরো ভয়াবহ। এখানে এককথায় ইহুদীদের ওপর পুরো দেশটা প্রচণ্ড রকমের নির্ভরশীল। জোকের মত তারা জাতির শরীর থেকে ধীরে ধীরে রক্ত শুষে নিচ্ছে। যুদ্ধের সময় সুসংগঠিত কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে সমস্ত রকমের জাতীয় ব্যবসার দম বন্ধ করা অবস্থা। যাতে কোনরকম ব্যবসাই মুক্তভাবে না করা যায়।
সব কিছুকে কেন্দ্রীভূত করার বিশেষ প্রয়োজন দেখা দেয়। সুতরাং ১৯১৬-১৭ সালের প্রথম ভাগে বাস্তবিকপক্ষে সমস্ত উৎপাদন ইহুদীদের অর্থনীতির কুক্ষিগত ছিল।
তবে কার বিরুদ্ধে জনসাধারণের এ ক্রোধ? আমি যেন মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছিলাম যে সেদিন সমাগত, যা আকস্মিক বিপদ ডেকে আনবে। যদি না সময় মত এর বিরুদ্ধে কোনরকম ব্যবস্থা নেওয়া না হয়।
যখন ইহুদীরা সমস্ত জাতিকে বিনষ্ট করতে উদ্যত, গুদামঘরের চাবি পকেটে পুরেছে; প্রশিয়ানদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভে ইন্ধন জোগাচ্ছে; এবং সীমান্তে এ বিষাক্ত প্রচারকার্যের বিরুদ্ধে কোনরকম ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে না; এমন কি দেশের ভেতরেও তার প্রতিরোধের কোন ব্যবস্থা নেই। কেউ-ই তখনো বুঝতে সক্ষম নয় যে প্রুশিয়ার ধ্বংস ব্যাভেরিয়ার মুক্তি বা উন্নতি এনে দিতে পারে না। উপরন্তু, একের ধ্বংস অপরকেও সেখানে টেনে নামাবে।
এসব ব্যাপারগুলো আমাকে গভীরভাবে আঘাত করেছিল। কারণ এতে সেই ইহুদীদের চালাকি, জনসাধারণের চিন্তাধারার খাতটাকে তাদের ওপর থেকে অন্যদিকে বইয়ে দেবার প্রয়াস। যখন প্রশিয়ান আর ব্যাভেরিয়ানরা সামান্য বিষয় নিয়ে পরস্পর ঝগড়া বিবাদে রত, ইহুদীরা সে সুযোগে চোখের সামনে দিয়েই তাদের উপজীবিকা ছিনিয়ে নেয়। প্রশিয়ানরা যখন ব্যাভেরিয়ানদের গালাগাল দিতে রত, ঠিক তখনই ইহুদীরা এক সাজানো বিপ্লব বাধিয়ে দিয়ে প্রুশিয়া আর ব্যাভেরিয়া দুটোকেই একসঙ্গে ধ্বংস করে।
একই জার্মান জাতির মধ্যে পরস্পরের এ সামান্য বিষয় নিয়ে এ ঘৃণিত ঝগড়া আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারি না; যার থেকে আমার মনে হয় সীমান্তে ফিরে যাওয়াটাই ভাল। সে কারণে মিউনিক পৌঁছেই আমি চাকরিতে যোগ দেই। ১৯১৭ সালের মার্চের গোড়ার দিকে আমি সীমান্তে আমার পুরনো সৈন্য বাহিনীতে যোগদান করি।
১৯১৭ সালের শেষাশেষি আমার মনে হয় যেন সীমান্তে আমার হতাশার দিনগুলোকে কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। রাশিয়ার ধ্বংসের পর আমাদের সৈন্যবাহিনী তাদের আশা এবং সাহস ফিরে পায়। সবার একই ধারণা হয় যে যুদ্ধ আমাদের স্বপক্ষেই শেষ হবে। আমরা যেন আবার গলা ছেড়ে গান গাইতে পারব। দাঁড়কাকগুলো তাদের কর্কশ চিৎকার বন্ধ করেছে। পিতৃভূমির ভবিষ্যতের প্রতি আশা আবার প্রবল হয়ে ওঠে।
১৯১৭ সালের শরৎকালে ইতালিয়ানদের ধ্বংসের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত চমৎকার হয়। কারণ এ বিজয় এটাই প্রমাণ করে যে রাশিয়া ছাড়াও অন্য সীমান্ত তছনছ করে দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের আছে। এ উৎসাহজনক চিন্তাই সীমান্তের লক্ষ লক্ষ লোকের মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে এবং তারা উৎসাহের সঙ্গে ১৯১৮ সালের বসন্তকালের দিকে তাকিয়ে থাকে। কারণ তখন শত্রুরা যে চরম হতাশায় ভুগছে এ সত্যটা প্রকট হয়ে পড়েছে। শীতকালে সীমান্তটা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি শান্তরূপ ধারণ করে। কিন্তু তা হল ঝড়ের আগের শান্ত অবস্থা, স্তব্ধতা।
ঠিক যখন শেষ আত্মরক্ষার প্রচণ্ড রকমের প্রস্তুতি চলেছে, যা কিনা এ যুদ্ধের শেষ টেনে আনবে, যার জন্য অন্তহীন যানবাহনের সারী মানুষ আর গোলাবারুদ বয়ে আনছে সীমান্তে এবং সৈন্যরা শেষ ও প্রচণ্ড আক্রমণের জন্য তৈরি হচ্ছে, ঠিক তখনই এ যুদ্ধের সময়ে জার্মানি সাংঘাতিক রকমের এক বিশ্বাসঘাতকতার সম্মুখীন হয়।
জার্মানিকৈ কিছুতেই যুদ্ধে জিততে দেওয়া হবে না। ঠিক যে মুহূর্তে বিজয়লক্ষ্মী জার্মানির গলায় মালা পরাতে উদ্যত, তখনই এমন একটা ষড়যন্ত্র করা হয়; একটা প্রচণ্ড মুষ্ঠাঘাতে জার্মানিকে শয্যাশায়ী করে দিয়ে বিজয় থেকে তাকে অনেক দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়। গোলাবারুদ এবং অস্ত্রশস্ত্রের কারখানায় পূর্ণ হরতালের ব্যবস্থা করা হয়।
এ ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য যদি সফল হত তবে জার্মান সীমান্ত ধ্বংস হয়ে পড়ত এবং ভোরভার্ক অর্থাৎ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ইচ্ছে জার্মানি যেন কিছুতেই যুদ্ধে জিততে না পারে, পূর্ণ হত। গোলাবারুদের অভাবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সীমান্ত ভেঙে পড়ত, আত্মসংরক্ষণের কাজও থেমে যেত; এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে মৈত্রীভাব বজায় থাকত। তখন আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থা জার্মানির অর্থনীতিকে পরিচালনা করার সুযোগ পেত–এর মূল উদ্দেশ্যই ছিল জাতীয় অর্থনীতি ব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়ে আন্তর্জাতিক ধনতন্ত্র ব্যবস্থাকে তার জায়গায় কায়েম করা। এবং এ উদ্দেশ্য সত্যি বলতে কি পূর্ণও হয়ে যেত, তারজন্য একদিকের বিশ্বাস প্রবণতা আর অপরদিকের বিশ্বাসঘাতকতাকে ধন্যবাদ।
যাহোক বিস্ফোরক উৎপাদনের কারখানাগুলোর ধর্মঘট শেষপর্যন্ত যা আশা করা গিয়েছিল সেই সাফল্য আনতে পারেনি। বিশেষ করে সীমান্তে গোলাবারুদের অভাব সৃষ্টি করা। কারণ এ ধর্মঘট সৈন্যবাহিনীকে গোলা বারুদের অভাবে সামগ্রিক ধ্বংস ডেকে আনার পক্ষে অতি অল্পদিন ধরে চলেছিল, যা আগে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু নৈতিক দিক থেকে প্রচণ্ডরকম ক্ষতি যে হয়েছিল তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
প্রথমত দেশের লোক যদি জয় না চায়, তবে কিসের জন্য এ সৈন্যবাহিনী যুদ্ধ করে চলেছে? কার জন্য এ আত্মত্যাগ আর অসীম কষ্ট এরা সহ্য করছে? যখন দেশের ভেতরে লোকেরা ধর্মঘট করে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে, তখনো কি সৈন্যরা যুদ্ধ করে যাবে?
১৯১৭–১৮ সালের শীতকালটা এ বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে মৈত্রীর আকাশে কালো মেঘ ঝুলে রয়েছে। প্রায় চার বছর ধরে ক্রমাগত জার্মানির ওপরে আক্রমণের পর আক্রমণ চালানো হয়েছে, তবু তাদের পক্ষে জার্মানিকে মাটিতে শোওয়ানো সম্ভব হয়ে ওঠেনি। যে তাদের ঠেলে দূরে সরিয়ে রেখেছে, — এক হাতে তার নিজেকে রক্ষার নিমিত্ত ঢাল ধরা, অপর হাতে শক্রর সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য তরোয়াল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ শক্ররা এক সময় ধ্বংস হয়, এখন তার পশ্চিমের সঙ্গে যুদ্ধ চালাবার জন্য হাত মুক্ত। অবশ্য এ কাজের জন্য রক্তের নদী বয়ে গেছে; তবু তার দু’হাত এখন মুক্ত, সুতরাং এক হাতে ঢাল আর অপরহাতে অসি ধরে সে এখন পশ্চিম সীমান্তে যুদ্ধ চালাবার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত এবং যেহেতু শত্রুরা জার্মানির আত্মরক্ষণ ভেঙে তছনছ করতে পারেনি, তাই জার্মানিই এখন তাদের প্রতি আক্রমণ করতে শুরু করে। জার্মানির এ জয়ের সম্ভাবনার কাছে শত্রুরা ভয়ে কেঁপে ওঠে।
প্যারিস এবং লন্ডনে একের পর এক সম্মেলন শুরু হয়। এমন কি শত্রুদের প্রচারকার্যও প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। জার্মানির জয়ের আর কোন আশা নেই,–এ প্রচার চালানো আর আগের মত এত সহজ হয় না। একটা স্তব্ধতা সীমান্তে বিরাজ করে। এমন কি সেই স্তব্ধতা শুধু জার্মান সৈন্যদের মধ্যে নয়, বিভিন্ন রাষ্ট্রের সৈনিকদের মধ্যেও তার ছায়া পড়ে। তাদের প্রভুদের প্রগলভতা হঠাৎ বন্ধ হয়। নেমে আসে বিরক্তিকর সত্যের সকাল। জার্মান সৈন্য সম্পর্কে তাদের ধ্যান-ধারণা ততদিনে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। বর্তমানে তাদের অভিমত হল, এ হল এমন এক ধরনের বোকা সমাপ্তি যার ধ্বংস অনিবার্য। কিন্তু বাস্তবে দেখে সে বোকারাই রাশিয়ানদের মৈত্রী ভেঙে এগিয়ে গেছে। পূর্বদিকের আত্মরক্ষণ নীতি, যা নাকি জার্মান সামরিক কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতির কারণে জারী করেছিল, এখন সেটাই অপরপক্ষের চোখে কলাকৌশল বলে ধরা দেয়। তিন বছর ধরে জার্মানরা রাশিয়ার সীমান্তে ঝোপঝাড় ঠেঙিয়ে চলেছে, কিন্তু লাভ বলতে কিছুই হয়নি। এ নিষ্ফল কাজকর্ম ফেলে সবাই মুখ সিটকেছে; কারণ তখন সকলেরই ধারণা ভবিষ্যতে কেবল সৈন্য সংখ্যার জোরেই রাশিয়া এ যুদ্ধে জিতে যাবে। রক্ত ঝরতে ঝরতে জার্মানি ক্ষয়ে যাবে। এবং ঘটনাবলীও এ আশাকেই সমর্থন করেছিল।
১৯১৪ সালের সেপ্টেম্বরের দিনগুলোতে ট্যানেনবার্গের যুদ্ধের পর যখন প্রথম রাশিয়ার অনন্ত যুদ্ধবন্দীর সারি জার্মানির ভেতরে ঢোকে, তখন মনে হয়েছিল এর সম্ভবত আর শেষ নেই; কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল একজন সৈনিক মারা গেলেই তার জায়গায় আরেকজন প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। এ বিশাল সাম্রাজ্যের জারের কাছে এত বিশাল পরিমাণে সৈন্য মজুত যে মনে হয় এ সৈন্যবহিনী অক্ষয়; নতুন নতুন শুরু যেন সেই যুদ্ধ দলের হোতার কাছে সর্বদাই প্রস্তুত।
এ দীর্ঘ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জার্মানি আর কতক্ষণ বুঝতে পারবে? এখনো পর্যন্ত সেই চরম দিন এসে উপস্থিত হয়নি, যখন জার্মানি শেষ যুদ্ধে জয়ী হবে। কিন্তু তখনো তো সেই শেষ যুদ্ধের জন্য রাশিয়ার কাছে প্রচুর সৈন্য মজুত থাকবে। এবং তারপরে? মনুষ্যত্বের পরিমাপে জার্মানির ওপরে রাশিয়ার বিজয় হয়ত বা দেরি হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘদিন পরে হলেও তা আসবে।
রাশিয়াকে ঘিরে যে আশার জাল গড়ে উঠেছিল, তা এখন অন্তর্হিত। যে মৈত্রী এত প্রচুর পরিমাণে রক্তক্ষয় করেছে, তাদের পরস্পরের স্বার্থের ভাণ্ডার নিঃশেষিত। নির্দয় শত্রুর সামনে তারা ভূমিতে শয্যাগ্রহণ করেছে। ভয়বিহ্বলতা এবং হতাশা মৈত্রী রাষ্ট্রের সৈন্যদের মধ্যে তার থাবা প্রসারিত করেছে; এতদিন যারা একটা অন্ধ বিশ্বাসের মোহে আচ্ছন্ন ছিল, তারা এখন আগত বসন্তকে ভয় করছে। কারণ তারা বুঝেছে মাত্র কিছু পরিমাণে শক্তি পশ্চিমের সীমান্তে সংগঠিত করা সত্ত্বেও তারা জার্মানদের পরাজিত করতে পারেনি, সেক্ষেত্রে কী করে এ বিশাল সৈন্যসম্ভারকে পরাজিত করা সম্ভব যেখানে এ অবাক করা দেশের বীরবৃন্দ প্রচণ্ড আক্রমণের জন্য পশ্চিম সীমান্তে জড় হচ্ছে?
দক্ষিণ থেরোলের ঘটনাবলীর ছায়া যেন এখানে প্রতিফলিত। জেনারেল ক্যাডোনার প্রেতেরা যেন হঠাৎ এখানে এসে জড় হয়েছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের সৈন্যদের মুখে তার ছায়া সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত। যুদ্ধ জয়ের আশার চেয়ে হেরে যাওয়ার আশঙ্কাটাই এখন প্রকট।
সে ঠাণ্ডায় রাত্রিগুলোতে, যখন প্রত্যেকেই প্রায় শুনতে পেত জার্মান সৈন্যদের এগিয়ে যাওয়ার প্রতিধ্বনি এবং কম্পিতবক্ষে অপেক্ষা করত সেই দিনটার জন্য, হঠাৎ যেন একটা চোখ ধাঁধানো আলোর ঝলকানি জার্মানিতে জ্বলে ওঠে এবং তার রশিতে শত্রু সীমান্তের বোমা বর্ষণে বিধ্বস্ত জমিগুলোকে দেখিয়ে দেয়।
যখন জার্মান সৈন্যবাহিনী প্রচণ্ড রকমের আক্রমণ চালাবার আদেশ পেয়েছে, ঠিক তখনই জার্মানিতে সর্বাত্মক ধমর্ঘট হয়।
প্রথমে তা সারা পৃথিবী হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল। সে হতবুদ্ধিকর অবস্থার ঘোর কাটলে শত্রুরা আবার প্রচারকার্যে কোমর বেঁধে নেমে পড়ে, এবং শেষ মুহূর্তে তাদের ওপর শিকারী বাজের মত ঝাপিয়ে পড়ে। হঠাৎ একটা উপায়ের রশ্মি নজরে আসে, যার দ্বারা বিভিন্ন রাষ্ট্রের সৈন্যদের ডুবে যাওয়া আত্মবিশ্বাস আবার খুঁজে পায়। জয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, আগামী ঘটনাগুলোর সম্পর্কে অমঙ্গলের পূর্বাভাস এখন একটা দৃঢ় সঙ্কল্পের নিশ্চয়তায় ধরা দেয়। যে সব সৈন্যবাহিনীকে জার্মান আক্রমণের প্রচণ্ডতা সহ্য করতে হয়েছে, যে আক্রমণের প্রচণ্ডতা পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই দেখা গেছে, তারাই এখন শেষ বিচারের রায়ে উদ্দীপিত যে জার্মান ধৃষ্টতার জন্য নয়, বরং অপরপক্ষে আত্মরক্ষণের সহিষ্ণুতারই জয় অবশ্যম্ভাবী। এখন শুধু জার্মানদের তরফ থেকে বেছে নেওয়া কারা জয়ী হবে। কারণ পিতৃভূমিতে তারা বিপ্লব করতে ভালবাসে, জয়ী হতে নয়।
ব্রিটিশ, ফরাসী এবং আমেরিকান সংবাদপত্রগুলো এ বিশ্বাসটাই তাদের পাঠকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয় আর সুচারুরূপে এ প্রচার ব্যবস্থাকে হাজির করা হয় সীমান্তে, তাদের নিজ নিজ সৈন্যবাহিনীর সামনে।
জার্মানিতে বিপ্লব শুরু হয়েছে, সুতরাং মিত্রশক্তির জয় অনিবার্য! এটাই হল পাউল আর টমির আস্থা ফিরিয়ে এনে তাদের নিজেদের পায়ে দাঁড় করানোর সর্বশ্রেষ্ঠ ওষুধ। আমাদের রাইফেল এবং মেশিনগান আবার আগুন ঝরাতে শুরু করে; কিন্তু তা ভয় বিহ্বল শত্রুদের মধ্যে আশঙ্কার সৃষ্টি করে না।
গোলাবারুদের কারখানায় ধর্মঘটের এ হল ফলাফল। শক্র দেশগুলোতে জয়ের বিশ্বাস এভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যা ধীরে ধীরে তাদের হাত শক্ত করে এাং সঙ্গে সঙ্গে মিত্ররাষ্ট্রগুলোর হতাশার ভাবও কেটে যায়। এ ধর্মঘটের ফলে হাজার হাজার জার্মান সৈন্য প্রাণ হারায়। কিন্তু এ ঘৃণ্য কুকর্মের প্ররোচকরা যারা এ ভীরু ধর্মঘট সুসংবদ্ধ করেছিল, তারা ছিল এ বিপ্লবের হোতা।
প্রথমে অপ্রত্যক্ষভাবে মনে হয়েছিল জার্মান সৈন্যদের এসব ঘটনাবলীর প্রতিক্রিয়া তারা সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারবে। এখানে প্রতিরোধের সময়ে শত্রুপক্ষের চারিত্রিক দিক থেকে সৈনিকদের সংঘর্ষশীল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে যায়। তার জায়গায় স্থান নেয় যুদ্ধে জেতার এক ভয়ানক প্রতিজ্ঞা। কারণ মানুষের বিচারের মানদণ্ডে যদি পশ্চিম সীমান্তে জার্মান আক্রমণটাকে কয়েকটা মাস রোখা যায়, তবেই যুদ্ধে জয় অবশ্যম্ভাবী। মিত্রপক্ষের সংসদও এ উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ইঙ্গিত সমর্থন করে বিরাট একটা অঙ্ক প্রচারকার্যের জন্য ব্যয় অনুমোদন করে, যার উদ্দেশ্য ছিল জার্মানির আভ্যন্তরিক শক্তিকে ভেঙে টুকরো টুকরো করা।
এটা আমার ভাগ্যই বলতে হবে যে প্রথম দুটো এবং শেষবারের প্রচণ্ড আক্রমণে অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলাম। এসব ঘটনাবলী আমার জীবনে প্রচণ্ড বিস্ময়ের ছায়া ফেলে,–বিস্ময়কর। কারণ শেষবারের মত যুদ্ধ তার আত্মরক্ষণ নীতি ছেড়ে দিয়ে আক্রমণাত্মক চরিত্র বেছে নেয়, ১৯১৪ সালে যা করা হয়েছিল। জার্মান সৈন্যদের পরিখার বুক থেকে আশ্বাসের নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে এবং তিন বছরের দীর্ঘ ধৈর্যের পরে তারা যেন ডোভায় চড়ে নরকে উপস্থিত হয়; হিসেব চুকোবার দিন সমাগত। আবার সেই কামলিন্দু বিজয়োৎসবের জয়ধ্বনি বিজয়ী সৈন্যদের কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসে। জয়কে তারা অমর সম্মানের সঙ্গে কণ্ঠলগ্না করতে শেষ পর্যন্ত সমর্থ হয়েছে। আবার সেই দেশপ্রেমের সঙ্গীতগুলো সরবে গাওয়া শুরু হয়, এ যেন তাদের অন্তহীন স্বর্গের দিকের রাস্তা, এবং শেষবারের মত ঈশ্বর তার অকৃতজ্ঞ সন্তানদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি হাসে।
১৯১৮ সালের গ্রীষ্মের মাঝামাঝি, গুমোট একটা আবহাওয়া যেন সীমান্তকে ঘিরে ধরে। দেশের অভ্যন্তরে তখন পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়া চলছে। কিন্তু কী নিয়ে? আমরা যতটুকু শুনতে পেরেছি তাতে মনে হয় সীমান্তের বিভিন্ন সৈন্যদলের রকমারী বিষয়ে ঘিরে এ ঝগড়া দানা বেঁধে উঠেছে, যুদ্ধটা একটা হাসির ব্যাপারে দাঁড়িয়ে গেছে। একমাত্র হঠকারী লোকেরাই এখনো জয়ের আশা রাখে। এ যুদ্ধ চালিয়ে যাবার স্বপক্ষে এখন আর জনতা নেই; একমাত্র পুঁজিবাদ এবং সম্রাটই তাদের নিজেদের স্বার্থে এটাকে বয়ে নিয়ে যেতে ইচ্ছুক। এ ধরনের চিন্তাধারাই দেশের অভ্যন্তর থেকে সীমান্তে ভেসে আসত আর আলোড়িত হত।
.
প্রথম প্রথম এ গুজব সামান্যই হয়েছিল। সার্বজনীন মত প্রকাশের মূল্য আমাদের কাছে কতটুকু? এর জন্যেই কি গত চার বছর ধরে আমরা যুদ্ধ করে চলেছি? এটা হল আমাদের বীরদের কবর থেকে ভীরুর মত অপহরণ করা, যে মহৎ কারণে তারা আজ ভূমিশয্যায় শায়িত, তার দাম আর কতটুকু! আমাদের সৈন্যরা ফ্লানডার্সে শ্লোগান তুলেছিল যে ‘সাবর্জনীন মতপ্রকাশ চিরজীবী হোক’–তারা আবার নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। কিন্তু ক্রন্দিত সুরে গেয়ে ওঠে, পৃথিবীতে জার্মানি হল সকলের ওপর। নিচু স্বর হলেও উল্লেখযোগ্য তেমন কোন পরিবর্তন ছিল না। সংখ্যাগরিষ্ঠ যারা এ সার্বজনীন মত প্রকাশের জন্য চিৎকার করছিল, যখন এরা যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়ায়, তারা কিন্তু তখন এতে অনুপস্থিত। এ সব রাজনৈতিক ইতর প্রাণীগুলো সীমান্তে আমাদের কাছে একেবারেই অপরিচিত। সে দিনগুলোতে যেখানে দলে দলে সৎ জার্মানদের জমায়েত, সে জমায়েত এ তথাকথিত ভদ্রসম্প্রদায় থেকে আসা মুষ্টিমেয় সংসদ সদস্যদের দেখা মিলত।
পুরনো সৈন্যদল যারা সীমান্তে যুদ্ধরত, তারা এ নতুন অস্ত্রসম্ভার যা মেসার্স অ্যাবাটি, সাইডম্যান, ব্যর্থ, লীভলেক্ট এবং অন্যান্যদের কাছ থেকে আসত, একেবারেই পছন্দ করত না। আমরা বুঝতে পারতাম না কেন? হঠাৎ এসব কর্তব্যে পরাসুখ ব্যক্তিরা সমস্ত শাসন ক্ষমতাকে নিজের বলে অন্যায় দাবি জানাতে তৎপর হয়ে ওঠে—–যাদের সৈনিকদের প্রতি বিন্দুমাত্র আস্থা নেই।
গোড়া থেকেই আমার নিজের ব্যক্তিগত মতামত স্থির ছিল। আমি অন্যের থেকে বেশি এ রাজনৈতিক নেতাদের চক্রকে অনুসরণ করে এসেছি; যারা বারবার বিশ্বাসঘাতকতা করে এসেছে। আমি অনেক আগেই উপলব্ধি করেছি যে এ কুখ্যাত নাবিকদের কাছে জাতির স্বার্থের ভূমিকা অতিশয় নগণ্য। তারা তাদের নিজেদের পকেট ভর্তি করার ধান্ধাতেই এসব কাজকর্ম করে চলেছে। আমার অভিমত হল, সোজা এদের বুঝিয়ে দেওয়া উচিত। কারণ তারা শান্তিকেই বলি দিতে উদ্যত, এবং প্রয়োজন বোধে ষড়যন্ত্র করে জার্মানিকে পরাজিত করতেও এদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই; অবশ্যই নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে। তাদের ইচ্ছাপূরণ করার অর্থ হল শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থকে একদল চোরের স্বার্থের বিনিময়ে জলাঞ্জলী দেওয়া। তাদের ইচ্ছাকে সমর্থন জানানোর মানে হল জার্মানিকে উৎসর্গ করা।
সৈন্যদলের গরিষ্ঠভাগ এ মতামতই পোষণ করত। কিন্তু নতুন সৈন্য যা বদলী হিসেবে দেশ থেকে আসছে তা দ্রুতগতিতে নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্টতর হতে থাকে। ব্যাপারটা এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়ায়, যখন এ নতুন সৈন্যদের আগমন দলের শক্তিবৃদ্ধি করা দূরে থাকুক, যুদ্ধ করার ক্ষমতাটাকেই কমিয়ে দিতে থাকে। নতুন সগ্রহ করা যুবক সৈন্যদের বেশিরভাগই হল অপদার্থ। অনেক সময়ে এটা বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে পড়ে যে তারা এ একই জাতির সন্তান-যারা ইব্রিস্ ঘিরে রক্তক্ষয়ী সগ্রামে একদিন মেতেছিল।
আগস্ট সেপ্টেম্বরে এ নৈতিকতার মূল্য আরো বেশি দ্রুতগতিতে নিম্নগামী হয়। যদিও শত্রুপক্ষের আক্রমণ আমাদের আগেকার আত্মরক্ষণমূলক যুদ্ধের সঙ্গে কোনরকম তুলনাই চলে না। এ আক্রমণের তুলনায় লোমের এবং ফ্লান্ডার্সের বীভৎস যুদ্ধের ছবি এখনো আমাদের স্মৃতিতে জেগে রয়েছে।
সেপ্টেম্বরের শেষে আমরা তৃতীয়বার সে জায়গাগুলো দখল করি। যা আমরা যখন নতুন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সেনাবাহিনীতে ঢুকেছিলাম, তখন ঝটিকাগতিতে দখল করেছিলাম। কী সুন্দর স্মৃতি!
এখানেই আমাদের যুদ্ধ হয়; সেটা হল ১৯১৪ সালের অক্টোবর এবং নভেম্বর মাস। হৃদয়ে দেশের প্রতি প্রজ্জ্বলিত ভালবাসা এবং কণ্ঠে গান নিয়ে আমাদের তরুণ সেনাদল এগিয়ে চলে দুর্বার গতিতে। যেন তারা নাচের আসরে যোগ দিতে চলেছে। রক্তের ধারা এ ধারণাতেই তারা ঢেলে দেয় যে তা পিতৃভূমির স্বাধীনতারক্ষার এবং অর্জনের কাজে লাগছে।
১৯১৭ সালে দ্বিতীয়বারের মত সেখানে পদার্পণ করি, যেটাকে আমরা পবিত্রভূমি বলে এতদিন গণ্য করে এসেছি। এখানেই সেইসব শ্রেষ্ঠ সহকর্মীরা শায়িত, বয়সের দিক থেকে যারা মাত্র বালক অবস্থা পেরিয়ে এসেছে, সেইসব সৈন্য যারা উজ্জ্বল চোখে বুকভরা দেশপ্রেম নিয়ে মৃত্যুর দিকে ধেয়ে গেছে।
আমাদের মধ্যে যে বয়োজ্যেষ্ঠ, সে সৈন্যদলে গোড়ার থেকেই ছিল। আবেগে আপুত হয়ে পড়ি সেই পবিত্রভূমিতে দাঁড়িয়ে, যেখানে দাঁড়িয়ে একদিন আমরা শপথ নিয়েছিলাম যে মৃত্যু পর্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে কর্তব্যে অবিচল থাকব। তিন বছর আগে সৈন্যদল ঝটিকা গতিতে আক্রমণ করে এ জায়গাটা দখল করেছিল। এখন আবার তাদের ডাক পড়েছে নির্দয় সংঘর্ষের মুখে এটাকে রক্ষা করার।
কিন্তু সপ্তাহ ধরে পদাতিক বাহিনীর বোমা বর্ষণের সাহায্যে ইংরেজ ফ্লান্ডার্সে তাদের আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে গড়ে তোলে। মনে হয় যেন মৃত আত্মাগুলো আবার জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সেনাবাহিনী কাদার তলায় ডুবতে থাকে। বোমার আঘাতে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন তবু পালানো বা ভয় পাওয়ার কোন চিহ্ন তাদের মধ্যে নেই। শুধু দিনের পর দিন তারা সংখ্যায় কমে যেতে থাকে। অবশেষে বৃটিশ তাদের আক্রমণ শুরু করে ৩১শে জুলাই, ১৯১৭ সালে।
আগস্টের শুরুতে আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়, পুরো সৈন্যবাহিনী তখন কমতে কমতে কয়েকটা দলে এসে ঠেকেছে মাত্র, যারা তখনো কাদা কামড়ে পড়ে রয়েছে, তাদের অবস্থা ভূত প্রেতের মত। মানুষ বলে চেনা যায় না।
১৯১৮ সালের শঙ্কালে আমরা তৃতীয় বারের মত সেই ভূমির ওপরে এসে দাঁড়ালাম, যা আমরা ঝড়ের গতিতে ১৯১৪ সালে দখল করেছিলাম। কোমিনস্ গ্রাম; যেটা আগে আমাদের যুদ্ধের পটভূমি হিসেবে কাজ করেছে, এখন সেটাই হয়ে দাঁড়ায় রণক্ষেত্র। যদিও সে গ্রামের চারিদিকের প্রবর্তন অতি নগণ্যই হয়েছে, তবু মানুষগুলো যেন বদলে গেছে একবারেই। এখন তারা রাজনীতি চর্চা করে। সব জায়গার মত এখানেও দেশের ভেতরকার হাওয়া এসে বিষ ছড়িয়েছে। যুবকরা তো এতে পুরোপুরি ডুবেছে। কারণ তারা এখানে এসেছে সোজা দেশ থেকে।
অক্টোবর ১৩-১৪ই রাতে বৃটিশরা ইউসের দক্ষিণ সীমান্তে গ্যাসের সাহায্যে আক্রমণ শুরু করে। তারা হলদে গ্যাস ব্যবহার করেছিল যা আমাদের কাছে নিতান্তই অজানা, অন্ততপক্ষে এ বিষয়ে আমাদের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। আমার ভাগ্যই যেন সেই রাত্রে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের নিমিত্ত নির্দিষ্ট ছিল। ভারভিক্রের দক্ষিণে একটা পাহাড়ের মাথায়, ১৩ই অক্টোবরের সন্ধ্যায়, আমরা গ্যাস বোমার আঘাতে প্রচণ্ড রকমের বিপর্যস্ত হই। প্রায় সারাটা রাত ধরেই এক নাগাড়ে এ বোমাবর্ষণ চলেছিল। মাঝ রাত বরাবর আমাদের মধ্যে বেশ ক’জন মাটিতে লাফিয়ে পড়ে; কিছু আহত, বাকিরা চিরদিনের জন্য ভূমিতে শুয়ে পড়ে। সকালের দিকে আমিও চোখে ব্যথা অনুভব করি। প্রতি পনের মিনিটে ব্যথাটা যেন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। এবং সকাল সাতটার সময় আমার চোখে ভয়ঙ্কর জ্বালা ধরে যখন আমি শেষবারের মত পেছনে ঝুঁকে শেষ গুলিটা শত্রুর দিকে ছুঁড়ি। আমার ভাগ্যই আমাকে এ যুদ্ধে টেনে এনেছে। কয়েক ঘন্টা পরে আমার চোখ দুটো যেন জ্বলন্ত কয়লার মত জ্বলতে থাকে, এবং চারিদিকের দৃশ্যমান সবকিছু আমার কাছে তখন অন্ধকার।
আমাকে পোমেরিনা পেস্ওয়াক হাসপাতালে পাঠানো হয়, যেখানে আমি প্রথম এ বিপ্লবের কথা শুনতে পাই।
দীর্ঘদিন ধরেই হাওয়ায় কিছু ভাসছিল, যা ঠিক স্পষ্ট নয়, কিন্তু অপ্রীতিকর। লোকেরা তখন কানাকানি শুরু করেছে যে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কিছু একটা ঘটতে চলেছে, যদিও আমি কল্পনাতে আনতে পারিনি যে ব্যাপারটা সঠিক কিনা। প্রথমে ভেবেছি গত বসন্তের মত কোন ধর্মঘট হয়ত বা ঘটতে যাচ্ছে। নৌ-বাহিনী থেকে ক্রমাগত অপ্রীতিকর গুজব আসছে, যা নাকি তখন ফুলে ফেঁপে বিস্ফোরিত অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু আমার যেন মনে হল পুরো ঘটনাটাই কয়েকটা নিঃসঙ্গ যুবকের প্রমোদের ব্যাপার। এটা সত্যি যে হাসপাতালে সবাই এ যুদ্ধের সমাপ্তি নিয়ে কথাবার্তা বলছে, এবং তারা আশা করছে যে সেটা খুব বেশি একটা দূরের নয়। কিন্তু কেউ-ই বোধহয় আশা করেনি যে এত তাড়াতাড়ি ফয়সালা হয়ে যাবে। আমার পক্ষে তখন সংবাদপত্র পড়া সম্ভব নয়।
নভেম্বরে সেই উদ্বিগ্নতা আরো বৃদ্ধি পায়। এবং একদিন আমাদের ওপর সর্বনাশা বিধ্বংস নেমে আসে; হ্যাঁ, কোনরকম সতর্কতা ছাড়াই। নাবিকেরা মোটর লরীতে ভর্তি হয়ে এসে আমাদের বিদ্রোহ করার জন্য প্ররোচিত করতে থাকে। আমাদের জাতির সেই ‘স্বাধীনতা, সুন্দর এবং আত্মমর্যাদার’ যুদ্ধে কয়েকটা ইহুদী ছেলে সে দলের নেতা। এদের মধ্যে একটাকেও সীমান্তে কর্মরত অবস্থায় দেখা যায়নি। হাসপাতালের মাধ্যমে যৌন ব্যধিগ্রস্ত বলে পূর্বদেশীয় এ তিনজনকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে তাদের হেঁড়া লাল কাপড়ের টুকরোটাকে পতাকা হিসেবে তারা উড়াচ্ছে।
কয়েকদিন পরে আগের থেকে অনেক সুস্থ বোধ করি। চোখের গোলকে সেই আগেকার ব্যথাটা কমে আসে। ক্রমে ক্রমে আমাকে ঘিরে থাকা চারিদিকের পরিবেশগুলোর উপর থেকে ঝাঁপসা ভাবটা সরে যায়। এখন আমি তাদের মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম। কিন্তু আবার কোন নক্সা প্রস্তুত করতে পারব এ জীবনে এটা আমি আশাই করতে পারিনি। যাহোক প্রয়োজনের ঘণ্টা যখন উপস্থিত, তখন আমি আরোগ্যের পথে চলেছি।
আমার প্রথমে ধারণা হয়েছিল যে এ প্রচণ্ড রকমের উদ্বিগ্নতা সাময়িক ব্যাপার। আমি এ ধারণাটা আমার সহকর্মীদের ভেতরেও ঢুকিয়ে দিতে চেষ্টা করেছি। বিশেষ করে হাসপাতালে আমার ব্যাভেরিয়ার সহকর্মীরা সঙ্গে সঙ্গে এতে সায় দিয়েছে। সব কিছু ছেড়ে দিয়ে তাদের ঝোক কিন্তু বিপ্লবের দিকে। আমি কল্পনাতেও আনতে পারি না যে মিউনিকও এ পাগলামীতে মেতে উঠেছে। কারণ আমার ধারণায় ভিটেবায়ের প্রতি বিশ্বস্ততা কয়েকটা ইহুদীর ইচ্ছা থেকে অনেক বেশি। সুতরাং আমি ভাবতেই পারি না
এটা নিছকই ‘নৌ-বিদ্রোহ’ এবং কয়েকদিনের মধ্যেই এটা চাপা পড়ে যাবে।
অল্প কিছুদিনের মধ্যে আমি জীবনের সবচেয়ে স্তম্ভিত করা খবর পেলাম। গুজবটা ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আমাকে বলা হয়, যে ব্যাপারটাকে আমি এতদিন স্থানীয় একটা ঘটনা বলে ভেবে এসেছি সেটা তা নয়। এটা হল সর্বাত্মক একটা বিপ্লব। এর সঙ্গে সীমান্ত থেকে এ সংবাদও আসে যে তারা আত্মসমর্পণ করতে ইচ্ছুক। এ জিনিস কি কখনো সম্ভব!
১০ই নভেম্বর স্থানীয় ধর্মযাজক হাসপাতাল পরিদর্শনে আসে, যার উদ্দেশ্য ছিল ছোটখাটো একটা বক্তৃতা দেওয়া; এবং এভাবেই আমরা পুরো ঘটনাটা জানতে পারি।
এ বক্তৃতা শোনার পর সঙ্গে সঙ্গে যেন জ্বরের মত আমার শরীরে শিহরণ খেলে যায়। সেই বৃদ্ধযাজক যেন আবেগে কাঁপছে, যখন সে আমাদের জানায় যে হোয়েন ঝোলায়েন আর রাজকীয় মুকুট পরবে না, কারণ পিতৃভূমি এখন গণতান্ত্রিক দেশ; আমরা সবাই যেন সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাই, তিনি যেন এ নতুন ব্যবস্থার প্রতি তার আশীর্বাদ বর্ষণ করেন, এবং আগামী দিনগুলোয় দেশবাসীকে যেন পরিত্যাগ না করেন। সংবাদটা ঘোষণার সময়ে সে সংক্ষেপে রাজার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়। পোমেরিনা থেকে প্রশিয়া পর্যন্ত। বলতে গেলে পিতৃভূমি জার্মানির প্রতি যেভাবে সে তার কর্তব্য করে গেছে, তার জন্য–এরপরেই সে কাঁদতে শুরু করে। সেই জায়গায় জমায়েত মানুষগুলোর ওপর একটা গভীর হতাশা নেমে আসে। আমার দৃঢ় ধারণা একটা চোখের অস্তিত্বও সেখানে ছিল না, যার থেকে অশ্রু না ঝরেছে। আমার কথা বলতে গেলে বলতে হয় আমি সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছিলাম, যখন সেই বৃদ্ধ ধর্মযাজক আবার বলতে শুরু করে যে আমাদের এ দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে এখন ছেদ টানা উচিত। কারণ এ যুদ্ধে আমরা হেরে গেছি, এবং আমরা বর্তমানে বিজয়ীর দয়ার ওপরে নির্ভরশীল। পিতৃভূমিকে এর জন্য ভবিষ্যতে অনেক বড় বোঝা বহন করতে হবে। আমাদের এখন যুদ্ধ বিরতির শর্তগুলোকে মেনে নিয়ে আগেকার শক্রর মহত্বের ওপরে নির্ভর করতে হবে। আমি যখন আমার ঘরে ফিরে আসি, তখন যেন আমার চারিদিকে অন্ধকার ঘিরে ধরেছে। মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা। যন্ত্রণা ভরা মাথাটাকে আমি বালিশ আর কম্বলের মধ্যে সজোরে চেপে ধরি।
আমি আমার মা’র কবরের পাশে যেদিন দাঁড়িয়েছিলাম, তারপরে আর কাঁদিনি। আমার ভাগ্য যত আমার প্রতি বাল্যকালের দিনগুলোয় নিষ্ঠুর নির্মম হয়ে উঠেছে, আমার মানসিক জোরও যেন ততই বেড়ে গেছে। মনে হয়েছে ইস্পাতের মত শক্ত। যুদ্ধের এ বছরগুলোতে যখন মৃত্যু এসে আমার নিকটতম বন্ধু এবং সত্যিকারের সহকর্মীকে ছিনিয়ে নিয়েছে, তখনো তার বিরুদ্ধে অভিযোগের একটা কথাও উচ্চারণ করা আমার মনে হয়েছে চরম পাপ। তারা কি জার্মানির জন্য মরেনি? এবং যুদ্ধের এ ভয়ঙ্কর শেষ কয়েকটা দিনে, যখন বিষাক্ত গ্যাস আমাকে গিলতে উদ্যত, চোখের ভেতরে বাসা বেঁধেছে, চিরদিনের মত অন্ধত্বের ভয় আমাকে ঘিরে ধরেছে। কিন্তু হৃদয়ের বাণী বেরিয়ে এসেছে, হতভাগ্য সহকর্মীরা, তোমরা কি নেকড়ের মত চিৎকার করবে যখন হাজার হাজার অন্যান্যরা তোমাদের চেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। সুতরাং এ দুর্ভাগ্যকে আমি মেনে নিলাম, কারণ ততদিনে আমি বুঝতে পেরেছি এটাই একমাত্র খোলা পথ–এবং একটা জাতির দুর্ভাগ্যের কাছে ব্যক্তিগত কারো দুঃখের কোন মূল্যই নেই।
সুতরাং সমস্ত কিছুই নিস্ফল হয়ে দাঁড়ায়। সমস্ত আত্মোৎসর্গ এবং ক্লেশ, ক্ষুধা এবং তৃষ্ণায় মাসের পর মাস দিন যাপনের গ্লানি, ঘন্টার পর ঘন্টা মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে থাকারও কোন মূল্য নেই। কর্তব্যকার্যে সাড়া দিয়ে যারা মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে তাদের কথা চিন্তা কর–যারা হাজারে হাজারে হৃদয় দিয়ে তাদের পিতৃভূমিকে ভালবেসেছিল, কিন্তু তারা আর কখনই ফিরে আসেনি। কেউ তাদের কবরটাকেও খোলেনি যাতে সেইসব বীরদের আত্মা যা কাদা এবং রক্তের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেগুলো যেন স্বদেশে বাড়িতে ফিরে আসতে পারে, এবং যারা এ ঘৃণ্য বিশ্বাসঘাতকতায় অংশ নিয়েছে, তাদের ওপরে উল্কটরূপে প্রতিশোধ নিতে পারে। এর জন্যই কি সৈন্যরা ১৯১৪ সালের আগস্টে এবং সেপ্টেম্বরের যুদ্ধে মারা গিয়েছিল? এ কারণেই কি যুব দল সেই বছরের শুরকালে পুরনো সৈন্যদলের অনুবর্তী হয়েছিল? এর জন্যই কি সতেরো বছর বয়স্ক ছেলেরা ফ্লার্সের মাটিতে নিজেদের মিশিয়ে দিয়েছিল? এ কি হল জার্মান মেয়েদের পুরস্কার? যারা ভারী হৃদয়ে তাদের ছেলেদের উদ্দেশ্যে শুভ বিদায় জানিয়েছিল; তারা তো আর কোনদিনই ফিরে আসেনি। এসব-ই কি করা হয়েছিল একদল জঘন্য অপরাধীদের হাতে পিতৃভূমিকে তুলে দেবার জন্য?
এর জন্যই কি জার্মান সৈন্যরা উত্তাপে ক্লিষ্ট এবং অন্ধ করা বরফের ঝড়ের মধ্যে যুদ্ধ করেছিল, সহ্য করেছিল অসহ্য ক্ষুধা, তৃষ্ণা আর প্রচণ্ডরকমের শৈত্য, বিদ্রি রাত আর সুদীর্ঘ পদযাত্রা? এর জন্যই কি অবিশ্রান্ত বোমাবর্ষণের নরক-দমবন্ধ করা গ্যাসের আক্রমণে কখনো টলেনি বা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালায়নি? শত্রুদের হাত থেকে পিতৃভূমির রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছে? নিশ্চিতরূপেই এসব বীরেরা সমাধির ওপরে নিচের উত্তীর্ণ লিপি পাবার দাবি রাখে :
পথিক, তুমি যখন জার্মানিতে আসবে, দেশে ফিরে গিয়ে তোমার দেশবাসীকে বল,–আমরা এখনো শুয়ে আছি। যারা পিতৃভূমির সঙ্গে একান্ত এবং নিশ্চিতরূপে তাদের কর্তব্যকর্ম করেছে।
কিন্তু এ উৎসৰ্গতাকেই আমরা কি একমাত্র বিবেচনা করব? জার্মানি কি এ অতীতের একটা দেশের মত এত কম মূল্যবান? ইতিহাসের তার প্রতি কি কোন কর্তব্য নেই? আমরা কি এখনো পর্যন্ত শুধু অতীতের গৌরবের অংশ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকব? আমরা আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের কাছে আমাদের কাজের কি যুক্তি রাখব? এরা হল একদল জঘন্য ধরনের ভ্রষ্ট অপরাধীর দল।
আমি প্রাণপণে চেষ্টা করি (উবৃত্তি করে হলেও) এ বীভৎস ঘটনার কিছু খবরাখবর সংগ্রহ করার। যত বেশি খবরাখবর জোগাড় করি, তত বেশি আমার মাথা রাগে আর। লজ্জায় জ্বলতে থাকে। যে চোখের ব্যথায় আমি কষ্ট পেয়েছি, তার তুলনায় এ ট্র্যাজিডিকে কি আমি আখ্যা দেব?
এ দিনগুলো বহন করা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। বিশেষ করে রাতটা কাটানোই যেন অত্যন্ত কষ্টকর; শত্রুদের দয়ার ওপরে বেঁচে থাকার ধারণাটা একমাত্র মুখ এবং অপরাধী মিথ্যাবাদীরা সঠিক বলে ভাবলেও। সেই রাতগুলোয় আমার ঘৃণা যেন আরো তীব্র হয়ে ওঠে, বিশেষ করে সে ঘৃণার চরমতম প্রকাশ ঘটে সেইসব জঘন্য অপরাধীদের প্রতি।
সে দিনগুলোতে আমার ভাগ্যও যেন আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। পরিবেশ আমাকে বাধ্য করে আমার ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করতে, যা আমাকে রীতিমত উদ্বিগ্ন করে তোলে। এ ভিত্তিভূমির ওপরে কোন কিছু গড়ে তোলার প্রচেষ্টাটাই কি হাস্যকর নয়? অবশেষে আমার মনে হয় এটাই হল অনিবার্য–যা ঘটেছে, যা আমি অনেক আগেই। ভয়ের সঙ্গে ভেবেছিলাম, যদিও তা মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করিনি।
সম্রাট দ্বিতীয় উইলিয়ামই হল প্রথম যে কমিউনিস্ট নেতাদের দিকে বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করেছিল। তারা একহাতে রাজার হাত ধরেছে, অপর হাতে কোমরে গোঁজা ছুরি খুঁজেছে।
ইহুদীদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় আমার কোন উপায়ই ছিল না। তাদের ব্যাপারে উদ্দেশ্যটা হল,–‘হয় অথবা নয়’।
আমার তরফে তখন আমি নিজের মনটাকে স্থির করি যে আমি রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ নেব।
নভেম্বরের শেষাশেষি আমি মিউনিকে ফিরে আসি। আমার বাহিনীর কার্যালয়ে যাই, যা বর্তমানে সৈনিক সমিতির হাতে। পুরো ব্যাপারটা দেখতে গেলে শাসনব্যবস্থা যথেষ্ট অপ্রীতিকর। সুতরাং আমি আমার মনটাকে স্থির করে দেখি যে যত সত্বর সম্ভব আমি সৈন্যবাহিনী ছেড়ে যাব। আমার বিধ্বস্ত যুদ্ধ সহকর্মী আরনেস্ট স্মিডের সঙ্গে আমি ট্রাউনস্টাইলে এবং সেখানে ক্যাম্প না ওঠা পর্যন্ত অবস্থান করি। ১৯১৯ সালের মার্চ মাসে আবার আমরা মিউনিকে ফিরে আসি।
সেখানকার পরিস্থিতি অপরিবর্তনশীল নয়। তা যেন বিপ্লবের দিকে দুনির্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। আইজুনারের মৃত্যু একমাত্র এ অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করেছিল, এবং শেষ পর্যন্ত স্বৈরতন্ত্রে সমিতিকে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করেছিল, অথবা, আরো স্পষ্ট ভাষায় বলতে গেলে এটা ছিল ইহুদী রাষ্ট্রপুঞ্জের নেতৃত্ব, যা বিশ্বাসঘাতকতারই নামান্তর। কিন্তু এটাই ছিল (যারা এ বিপ্লবের পত্তন করেছিল। তাদের চরম লক্ষ্য।
মানসিকতার সেই সন্ধিক্ষণে আমার মনের মধ্যে অনেক রকমের পরিকল্পনা ঘোরাফেরা করছিল। সেই দিনগুলো আমি অবিরত চিন্তা করে কাটিয়েছি যে ঠিক কী করা যেতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত প্রতিটি পরিকল্পনাই পরিত্যক্ত হয়েছে, কারণ নগ্ন সত্য হল আমি জনজীবনে একান্তভাবেই অপরিচিত। সুতরাং যে কোন বিষয়কে এগিয়ে নিয়ে। যাবার জন্য প্রয়োজনীয় প্রথম আবশ্যক জিনিসটাই আমার মধ্যে ছিল না। আমি কেন তৎকালীন কোন দলের নাম লেখাইনি তার কারণ পরে আমি ব্যাখ্যা করব।
নতুন সোভিয়েত বিপ্লব তখন মিউনিকের হাওয়ায় ছড়িয়েছে, আমার প্রথম কাজ হল সেই কেন্দ্রীয় সমিতির অনিষ্টকর চিন্তাভাবনাগুলোকে আকর্ষণ করা। ১৯১৯ সালের ২৭শে এপ্রিলের সকালে আমার গ্রেপ্তার হওয়ার কথা। কিন্তু যে তিনজনকে আমাকে গ্রেপ্তারের জন্য পাঠোনো হয়েছিল তাদের সাহস ছিল না আমার রাইফেলের মুখোমুখি হওয়ার এবং সেই কারণেই তারা উপস্থিত হয়েই সরে পড়েছিল।
মিউনিকের মুক্তির কয়েকদিন পরে আমার ওপর আদেশ আসে তদন্ত কমিশনের সামনে আমাকে উপস্থিত হতে হবে; সেই তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল দ্বিতীয় পদাতিক সৈন্যবাহিনীর বিপ্লবাত্মক কাজকর্মের বিশ্লেষণের জন্য।
এটাই হল রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমার প্রথম আক্রমণ। কয়েক সপ্তাহ বাদে আবার আমার ওপরে আদেশ আসে যে সৈন্যবাহিনীর অন্যান্য সৈনিকদের সঙ্গে আমাকে একটা বক্তৃতামালায় যোগ দিতে হবে। এ বক্তৃতামালার আয়োজনের কারণ হল কিছু নির্দিষ্ট আদর্শ বারবার উচ্চারণ করে সৈনিকদের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া। আমার পক্ষে এ হল একটা সুযোগ যার দ্বারা বিভিন্ন সৈনিকদের সঙ্গে আমি মিলিত হতে পারব, যাদের চিন্তাধারা একই খাতে বইছে এবং যাদের সত্যিকারের পরিস্থিতিটা সম্পর্কে আমি আলোচনা করতে পারি। আমরা সবাই প্রায় একই ধারণার বশবর্তী ছিলাম যে জার্মানিকে আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে কিছুতেই বাঁচানো সম্ভব নয়; বিশেষ করে নভেম্বরের বিশ্বাসঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার কোন উপায়ই নেই,–কেল্ড এবং সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা হল সেই কুখ্যাত নভেম্বরের বিশ্বাসঘাতক। যে বিপুল ক্ষতি হয়ে গেছে, তার পূরণ করা জাতির মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের পক্ষে সম্ভব নয়।
আমাদের সেই ছোট গোষ্ঠীতে আমরা সবাই একটা নতুন দল গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা চালাই। সবচেয়ে যে আদর্শগুলো এ দল গঠনের ব্যাপারে প্রাধান্য পায়, সেগুলোকে ঘিরে পরে জার্মান লেবার পার্টি স্থাপন করা হয়েছিল। এ নতুন আন্দোলনের নামকরণের ব্যাপারে আমরা যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করি যাতে এটা বিশাল জনসাধারণের হৃদয়ে আবেদন জানাতে পারে, কারণ তা না হলে আমাদের সবরকম প্রচেষ্টাই নিষ্ফল হয়ে দাঁড়াবে। এবং সেই কারণেই অনেক ভেবেচিন্তে আমরা নতুন দলের। নামকরণ করেছিলাম। সোশ্যাল রেভ্যুলুসানারী পার্টি। বিশেষ করে আমাদের নতুন দলের সামাজিক চিন্তাধারা সত্যিকারের বৈপ্লবিক ছিল।
কিন্তু এর পেছনে আরো কিছু প্রাথমিক কারণ ছিল। আমার ছোটবেলায় যেসব অর্থনৈতিক কারণগুলোয় ভুগেছি, সেগুলোর উদ্ভব মূলত সামাজিক সমস্যাগুলো থেকে, প্রত্যক্ষ এবং অপ্রত্যক্ষভাবে।
পরবর্তীকালে এ ধ্যান-ধারণাগুলোই আরো বেশি বিস্তৃতি লাভ করেছিল যখন আমি ত্রিপাক্ষিক সম্মিলিত জার্মান-নীতির কথা বিশেষভাবে অনুধাবন করি। এ নীতির জন্যই জার্মানির অর্থনৈতিক অবস্থার ভ্রান্ত মূল্যায়ন সম্ভব হয়েছিল। কারণ ভবিষ্যতে জার্মান জনসাধারণের অবস্থিতির ভুল ধারণার থেকেই এ ভ্রান্ত অর্থনীতির জন্ম হয়েছিল। এসব ধ্যান-ধারণার ভিত্তিভূমি ছিল যে পুঁজি তা হল শ্রমিকদের শ্রমের ফসল এবং একান্তভাবেই শ্রমিকদের দ্বারা উৎপন্ন এবং শ্রমিকদের মতই এটাও মানুষের কার্যক্ষমতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বা গতিরোধ করতে সক্ষম। সুতরাং জাতির স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে, এ পুঁজির রহস্য দেশের মহত্ত্ব, বিশালত্ব, শক্তির ওপরে নির্ভর করে। এক কথায় এটা জাতির ওপরেই নির্ভরশীল এবং সে কারণে দেশের স্বাধীনতাই একমাত্র এ সম্পদকে জাতির স্বার্থে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে আত্মরক্ষা এবং উন্নতির জন্য।
এ আদর্শগুলো মেনে চললে সম্পদের প্রতি দেশের মনোভাব সহজ এবং সরল হয়ে ওঠে। এর একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত যে সম্পদ পুরোপুরি দেশের অভীষ্টসাধক হবে এবং নিজস্ব কোন ক্ষমতাই থাকবে না যার দ্বারা সে জাতিকে শাসন করতে পারে। সুতরাং এর কার্যকারিতা দুটো বিষয়বস্তুর ওপরে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। একদিকে যেমন সে জাতিকে শক্তিশালী এবং মুক্ত অর্থনীতি দেবে, অন্যদিকে শ্রমিকের দাবিগুলোকে রক্ষা করবে।
আগে আমি এত স্পষ্টভাবে সম্পদের পার্থক্য, যা নাকি স্রেফ সৃজনশীল শ্রমিকদের উৎপাদন, তা স্বীকার করে নিইনি। এবং যার অস্তিত্ব ও গতি-প্রকৃতি হল নিছক অর্থনৈতিক অনুধ্যানের ফলাফল। এখানে আমি সত্যিকারের আমার মনকে তাড়া দিয়ে সেইদিকে চালনা করি, যে শক্তির এতদিন আমার মধ্যে অভাব ছিল।
এ প্রয়োজনীয় শক্তি জোগান দেয় একজন, তার বক্তৃতা প্রসঙ্গে আমি আগেই উল্লেখ করেছি। তার নাম হল গটফিড় ফেডার।
জীবনে প্রথমবার আমি স্টক এক্সচেঞ্জও সম্পদ এবং যে সম্পদ ধারকর্জের ব্যাপারে ব্যবহার করা হয়ে থাকে — সে সম্পর্কে শুনি। ফেডারের প্রথম বক্তৃতা শুনেই আমার মস্তিষ্কে একটা ধারণা প্রবাহ খেলে যায়, যা একটা নতুন দল গঠনের পক্ষে অত্যাবশ্যক।
আমার মনে হয় ফেডারের মেধা একদিকে যেমন নির্দয়, অপরদিকে তেমনি স্পষ্টতায় ভরা, অন্ততপক্ষে যেভাবে ফেডার স্টক এক্সচেঞ্জের অন্তর্গত সম্পদের দ্বৈত চরিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেছিল, যার থেকে এটুকু পরিষ্কার বুঝেছিলাম যে এ সম্পদ দেয় সুদের ওপরে নির্ভরশীল। বিশেষ করে গোড়ার প্রশ্নে তার বক্তব্য এত জ্ঞানযুক্ত এবং গভীর যে যারা তাকে সমালোচনা করেছিল, তারাও তাঁর বক্তব্যকে ভাল না বেসে পারেনি। কিন্তু তাদের সন্দেহ ছিল যে এটাকে কাজে লাগানো সম্ভব কিনা। যদিও অন্যান্যরা এটাকে দুর্বল বলে ভেবেছিল, কিন্তু আমার কাছে এটাই ছিল ফেডারের শিক্ষণের সবচেয়ে মূল্যবান অংশ।
যে সব তত্ত্ব তাত্ত্বিকেরা লোকের সামনে তুলে ধরে, সেগুলোকে বাস্তবে কি করে রূপায়ন করতে হবে তা বলে দেওয়া তাদের কাজ নয়। তার কাজ হল সমস্যাটার মুখোমুখি হওয়া; সুতরাং তার লক্ষ্য থাকবে সমাপ্তিতে, কোন পথ বেয়ে গিয়ে তা সমাপ্তিতে উপস্থিত হবে তাতে নয়। সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হল আদর্শটা নির্ভুল কিনা। এটাকে রূপায়িত করা সম্ভব কি অসম্ভব, সেটা আলাদা প্রশ্ন। যে মানুষের কাজ কোন নীতি বা আদর্শ বাতলানো, তাকে ব্যস্ত রেখে সেটাকে সুবিধাজনকভাবে বাস্তবে রূপায়ণ করা সম্ভব কিনা—এ দিকটাই। এর সত্যাসত্যের দিকটা তার বক্তব্য বিষয়ও নয়; যা নাকি দৈনন্দিন ব্যাপারে আলো দেখিয়ে মানুষকে তার অভীষ্ট পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। যে কোন ব্যক্তি একটা বিপ্লবের ছক আঁকে কীভাবে লক্ষ্য পৌঁছাতে হবে ভেবে। বাকিটা হল রাজনৈতিক নেতাদের কাজ। সুতরাং তাত্ত্বিকের কাজ হল চিরসত্যগুলোকে দেখিয়ে দেওয়া, আর রাজনৈতিক নেতাদের দায়িত্ব সেই সত্যগুলোকে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়া।
সেই তাত্ত্বিকের মহান দিক হল তার চিন্তাধারায় কতখানি সত্য উপস্থিত হতে পারে বিমূর্তরূপে। এবং অপরদিকে কর্তব্য হল সেই সত্যকে বাস্তবায়িত করা এবং তাত্ত্বিকের তত্ত্ব কতখানি সত্যের উপর দাঁড়িয়ে আছে, তা নির্ধারণ করা, এ মহত্বতাই রাজনৈতিক নেতাদের সাফল্য এবং উদ্যম এনে দেয়; যা তাকে তার লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করে। কিন্তু রাজনৈতিক দার্শনিকদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছান কখনই সম্ভব নয়। কারণ মানুষের চিন্তাধারা সেই সত্যটাকেই গ্রহণ করে সমাপ্তিটাকে স্ফটিকের মত স্বচ্ছ দেখতে পারে। যদিও সে কোনদিনই পরিপূর্ণ সমাপ্তিতে পৌঁছতে পারবে না, কারণ মানুষের চরিত্র হল দুর্বল এবং অপরিপূর্ণতায় ভরা। সেই বিমূর্ত আদর্শগুলো যত পরিপূর্ণ হবে, তা শক্তিশালী হলেও বাস্তবে তার রূপায়ন ততখানিই অসম্ভব। অন্ততপক্ষে যতক্ষণ পর্যন্ত সেই আদর্শ রূপায়ণের ভার মানুষের ওপরে থাকে। রাজনৈতিক দার্শনিকের সাফল্য বাস্তবে তার পরিকল্পনা কতদূর সফলতা লাভ করেছে তার ওপর নয়; বরং তা নির্ভর করে তাতে কতখানি সত্য উদ্ভাসিত এবং মানুষের উন্নতিকল্পে কতটুকু উদ্যম সেই আদর্শে রয়েছে। এটা যদি অন্যরকম হত, তবে ধর্মের স্রষ্টারা শ্রেষ্ঠ মানব সন্তান বলে কখনোই সম্পূর্ণরূপে বা আংশিকভাবেও বাস্তবে রূপায়িত করা সম্ভব নয়। এমন কি ধর্ম, যেটাকে প্রেমের ধর্ম নামে অভিহিত করা হয়, তার বাস্তবে রূপায়ণ স্রষ্টার ইচ্ছার এতটুকু অংশও নয়, যা ম উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু এর পরিপূর্ণতা হল মানুষের সভ্যতার এবং নৈতিকতার উন্নতির প্রয়াসে।
রাজনৈতিক, দার্শনিক এবং বাস্তবসম্মত রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে প্রচণ্ড ফারাকের কারণ হল একই মানুষের মধ্যে এ দুই গুণের সমন্বয়ের অভাব। বিশেষ করে ছোট ধরনের সফল রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে প্রযোজ্য; যাদের কার্যধারা ঘিরে থাকে সম্ভব সবকিছুকেই সফল করে তোলা; বিসমার্ক বিনীতভাবে যাদের রাজনৈতিক শিল্পী বলে আখ্যা দিয়েছে। এ ধরনের রাজনীতিজ্ঞরা যদি মহান আদর্শগুলোকে পাশ কাটাতে পারে, তবে তাদের সাফল্য সহজে আসবে। এসব কারণে এ ধরনের সাফল্য খুব একটা উপকারে আসে না এবং ক্ষণস্থায়ী হয়। এমন কি লেখকের মৃত্যুর আগেই তা বিলীনও হয়ে যায়। বিশেষভাবে বলতে গেলে রাজনৈতিক নেতাদের কাজ বর্তমান কালের জন্য নয়; কারণ তাদের তাৎক্ষণিক সাফল্যমানেই হল বিরাট সমস্যাগুলোকে পাশ কাটিয়ে দেওয়া, যে সমস্যা এবং আদর্শগুলোর মূল্যায়ণ ভবিষ্যতে হবে।
নৈতিকতার আদর্শকে ভবিষ্যতের পথে অধ্যাবসায়ের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ লাভজনক নয় এবং সর্বোপরি যে এ কাজ করে এবং এ পথ বেয়ে এগিয়ে নিয়ে যায়, তাকে জনসাধারণ খুব কম সময়েই সঠিকভাবে বুঝতে পারে। কারণ তাদের কাছে বীয়ার এবং দুধ অনেক বেশি প্ররোচনামূলক, ভবিষ্যতের কোন দূরদর্শী পরিকল্পনার চেয়ে। এ পরিকল্পনার শুভ দিকটা একমাত্র ভবিষ্যতের গর্ভেই নিহিত এবং তার ফলাফল উত্তর পুরষেরাই ভোগ করতে পারে; এবং উত্তর পুরুষদের জন্যই এ পরিকল্পনার বীজ বপন করা হয়ে থাকে।
কোন নির্দিষ্ট অহঙ্কারের জন্য, যে অহঙ্কারের সঙ্গে মুখামীর রক্তের যোগাযোগ রয়েছে; সেই কারণে রাজনৈতিক নেতারা বিশেষ করে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা পরিহার করে চলে, যার বাস্তব প্রয়োগ বাস্তবিকপক্ষে কষ্টকর। তার জন্য যাতে তাকে জনসাধারণের জনপ্রিয়তা হারাতে না হয়, তাই এসব রাজনৈতিক নেতাদের সাফল্য এবং প্রয়োজন একান্তভাবেই সমকালীন। ভবিষ্যতে এদের কোন সাফল্য থাকে না। কিন্তু এ ব্যাপারটা সংকীর্ণমনাদের কোন চিত্ত চাঞ্চল্য ঘটাতে পারে না, কারণ তারা তো বর্তমানের সাফল্য নিয়েই সন্তুষ্ট।
সংগঠনী শক্তিসম্পন্ন রাজনৈতিক দার্শনিকদের জায়গা একটু ভিন্ন রকমের। তাদের কাজের প্রয়োজনীয়তা ভবিষ্যতের দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝতে হবে। যার জন্য প্রায়ই তাকে শুনতে হয় সে স্বপ্নালু। রাজনৈতিক নেতাদের সাফল্য হল সম্ভাব্যতার শিল্পকে করায়ত্ত করা। রাজনৈতিক কোন আদর্শের প্রতিষ্ঠাতা, যাদের সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে তারা ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করতে পারে, কারণ তাদের ইচ্ছা এবং অসম্ভবতার সম্ভব করার প্রবল ইচ্ছা, তারা সবসময় সমকালীন খ্যাতিকে অস্বীকার করে; কিন্তু তাদের আদর্শ যদি অমর হয় তবে উত্তর পুরুষরা তাদের স্বীকৃতি দেয়।
মানব সভ্যতার এ সুবিশাল বিস্তৃতিতে এটা কদাচিৎ হয়ে থাকে যখন রাজনৈতিক তাত্ত্বিক এবং নেতা–এ দুই গুণের সমন্বয় একজনের মধ্যে দেখা যায়। যত বেশি এ উভয় গুণের সময় দেখা যাবে, তত বেশি সেই রাজনৈতিক নেতাকে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। এ ধরনের লোকেরা তাদের শ্রম সংকীর্ণমনাদের জন্য করে না; তার লক্ষ্যে পৌঁছবার পথ শুধুমাত্র কয়েক জনেই বুঝতে পারে। তার জীবন পৃথকভাবে ভালবাসা এবং ঘৃণার সমন্বয়; সমকালীনদের প্রতিবাদ, যারা সেই মানুষটিকে বুঝতে অক্ষম, তাদের সংঘর্ষ হয় ভবিষ্যত পুরুষদের স্বীকৃতির সঙ্গে, কারণ সে তো তাদের জন্যই কাজ করে যায়।
যে মানুষ ভবিষ্যত পুরুষদের জন্য যত বেশি পরিমাণে কাজ করে, সমকালীনরা তাকে ঠিক ততখানি কম স্বীকৃতি দেয়। সে কারণে তার সগ্রামের পথটাও কঠোর হয়ে ওঠে এবং সাফল্যও ঠিক তত পরিমাণে কম পায়। শতাব্দীর পরিমাপে, যারা তাদের জীবনের শেষ প্রান্তে এ ধরনের আশীর্বাদ ধন্য হয়, তারা জীবনের সায়াহ্নকালে হয়ত বা খ্যাতির এতটুকু পূর্বাভাস পেলেও পেতে পারে। কারণ ইতিহাসের পাতায় তো তারা ম্যারাথন দৌড়বীর বলে চিহ্নিত; সমকালীন খ্যাতির মুকুট জোটে মৃত্যুপথযাত্রী এসব নায়কদের কপালে একেবারে শেষ মুহূর্তে।
তারাই হল মহান নায়ক যারা নাকি তাদের আদর্শ এবং সেই আদর্শের প্রতিষ্ঠার জন্য অবিরত সগ্রাম করে চলে, যদিও সমকাল তাদের স্বীকৃতি দেয় না। তারা হল সেই ধরনের মানুষ যাদের স্মৃতি ভবিষ্যত পুরুষদের হৃদয় আলোকিত করবে। সেই সময়। ব্যক্তিগতভাবে প্রতিটি মানুষ এসব মহান নেতা যারা সমকালীন সমাজের স্বীকৃতি পায়নি, তাদের ক্ষতিপূরণ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। এদের জীবন, আদর্শ এবং কর্মপদ্ধতি তখন প্রচণ্ড শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার সঙ্গে সামনে থাকে।
এ দলে সত্যি বলতে গেলে শুধু মহান রাষ্ট্র নেতারাই পড়ে না, বড় বড় সমাজ সংস্কারকরাও এ দলভুক্ত। ফেডরিক গ্রেট ছাড়াও এমন মানুষ হল মার্টিন লুথার এবং রিচার্ড ভাগনার।
আমি যখন গটফিড ফেডারের প্রথম বক্তৃতা ‘সুদ-দাসত্বের অবলুপ্তি’ শুনি, আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে এখানেই জার্মান ভবিষ্যত বংশধরদের মনুষ্যজ্ঞানের অতীত সত্য লুকিয়ে আছে।
স্টক এক্সচেঞ্জ সম্পদকে যদি জাতির অর্থনৈতিক জীবন থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়, তবেই জার্মান ব্যবসাকে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির প্রভাব থেকে মুক্ত করা সম্ভব। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটার প্রতিও নজর রাখতে হবে যাতে জার্মান অর্থনীতির ওপরে কোন আক্রমণ করা না হয়, কারণ তাহলে জাতির স্বাধীনতার ভিত্তিভূমিটাই বিপন্ন হয়ে পড়বে। আমি পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম জার্মানিতে কি চলেছে। ফেডারের বক্তৃতায় আমি আগামী সংগ্রামে শ্রেণীবদ্ধ কান্নাকে যেন শুনতে পাই।
ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক পরিণাম সম্পর্কে সমস্ত রকমের ধ্যান-ধারণা যা সুদ সম্পদের দাসত্ব থেকে মুক্তি দেবে—এ চিন্তাধারাটাই ভুল। কারণ প্রথম অর্থনৈতিক নীতিগুলো এতদিন পর্যন্ত জার্মান জাতির স্বার্থে সাংঘাতিক রকমের ব্যর্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের জাতির অস্তিত্বরক্ষার স্বার্থে যে ধরনের মনোভাব গ্রহণ করা হয়েছিল এবং যা বিশেষজ্ঞরা দিয়েছিল, উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে রেলওয়ে লাইন বসাবার ব্যাপার। সেই শ্রদ্ধাস্পদ দলের সদস্যরা যে আশঙ্কা করেছিল, তা সঠিকভাবে কেউ-ই উপলব্ধী করতে পারেনি। যারা এ বাষ্পীয় অশ্বের নতুন কমপার্টমেন্টে চড়েছিল, তারা মাথা ঘোরার পীড়ায় ভোগেনি। যারা দেখেছে তারাও অসুস্থ হয়নি এবং বিজ্ঞাপনপত্রের অস্থায়ী কাঠের ফলকগুলো, যেগুলো নতুন আবিষ্কারকে লুকাবার জন্য দাড় করানো হয়েছে, শেষমেষ সেগুলোকে নামিয়ে নেওয়া হয়। একমাত্র অন্ধ যারা এবং যাদের দৃষ্টিশক্তিও অন্ধকারময়, তারাই তথাকথিত বিশেষজ্ঞ হিসেবে রয়ে গেছে। ব্যাপারটা সর্বদাই এরকম।
দ্বিতীয়ত এ ব্যাপারটাকে সর্বদা মনে রাখতে হবে যে কোন আদর্শ বিপদের কারণ হতে পারে যদি এটাকে সমাপ্তি বলে ধরে নেওয়া হয়; যখন সত্যিকারের এটা শেষ নয়। আমার এবং সমস্ত সত্যিকারের জাতীয়তাবাদীদের কাছে মতবাদ বলতে মাত্র একটাই,–জনসাধারণ এবং পিতৃভূমি।
এখন একান্ত প্রয়োজন হল আমাদের অস্তিত্বরক্ষার জন্য সংগ্রাম এবং আমাদের জাতের লোক বৃদ্ধি; এদের সন্তানদের সত্তা বজায় রাখা এবং আমাদের জাতিকে অবিমিশ্র করে রাখা। পিতৃভূমির স্বাধীনতা যাতে বজায় থাকে তার দিকে নজর দেওয়া, অর্থাৎ আমাদের লোকদের ওপর স্রষ্টা যে কর্তব্য চাপিয়ে দিয়েছে তারা যাতে তার সমাধান করতে পারে।
সমস্ত রকম আদর্শ এবং আদর্শবাদীতা, সমস্ত রকমের নীতি এবং জ্ঞানের লক্ষ্য হল এ সমাপ্তিতে পৌঁছানো। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই সবকিছু পরীক্ষা করা উচিত এবং তারপর সেগুলোকে বাস্তবক্ষেত্রে প্রয়োগ বা বাতিল করা সংগত। এভাবে একটা তত্ত্ব শুধু মৃত ধর্ম মতে যাতে পরিণত না হয়; কারণ সেগুলোকে তো জীবনের প্রাত্যহিক কাজকর্মে কাজে লাগাতে হবে।
গটফেড ফেডারের মতামত শুনে আমার মনে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মায় বিষয়টার গভীরে যাওয়ার এবং আমাদের অনুপ্রাণিত করে এমনভাবে প্রশ্নটাকে দেখায় যা আমি আগে ভাবিনি বা সেই ধ্যানধারণার সঙ্গে আমার আগে পরিচয় ছিল না।
আমি আবার পড়তে শুরু করি এবং এভাবে প্রথম আমি সঠিকভাবে বুঝতে পারি সে ইহুদী কার্লমার্কসের উদ্দেশ্য এবং জীবন। তার লেখা ‘দাস ক্যাপিটেল’ বইটার উদ্দেশ্য আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। সে আলোতে আমি এখন পরিষ্কার বুঝতে পারি জাতীয় অর্থনীতির বিরুদ্ধে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের সংগ্রামটা। এ হল আন্তর্জাতিক এবং স্টক এক্সচেঞ্জের সম্পদের নেতৃত্ব পাওয়ার যোগ্য।
আমার জীবনের অন্যান্য দিকে এ বক্তৃতার প্রভাব সুস্পষ্ট ভাবেই পড়েছিল।
একদিন বিতর্কে অংশগ্রহণ করার জন্য আমি আমার নাম লেখালাম। সেই বিতর্কে অংশগ্রহণকারী আরেকজন ভেবেছিল যে সে ইহুদীদের জন্য তৈরি বর্শাটা ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেবে; সেই কারণে সে তাদের পক্ষ অবলম্বন করে দীর্ঘ এক আলোচনায় প্রবেশ করে; এটাকে বিরোধিতা করার জন্যই আমি উঠে দাঁড়াই। সংখ্যাগরিষ্ঠ উপস্থিত সভ্যরা আমার দৃষ্টিভঙ্গিকেই সমর্থন জানায়। এর ফলে মিউনিকে অবস্থিত সৈন্যবাহিনীতে আমি ইনস্ট্রাকসন অফিসারের পদ পাই, মাত্র কদিন পরেই।
সে সময়ের সৈন্যদলের মধ্যে শৃঙ্খলার অভাব ছিল। এরা তখন সৈনিক সমিতির নেতৃত্বের পরের অবস্থার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। একমাত্র সতর্কভাবে এবং ধীরে ধীরে নতুন একটা সামরিক শৃঙ্খলাবোধ এবং বাধ্যতা, স্বেচ্ছাপ্রণোদিত বাধ্যতার জায়গায় চাপিয়ে দিতে পারলে, যাকে কূট আইজনারের বিশৃঙ্খল বাহিনীকে যে আদর্শ সামরিক শৃঙ্খলাবোধ ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল, তা সম্ভব। সৈনিকদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী এবং দেশপ্রেমিকের শিক্ষা ও অনুভূতি জাগিয়ে তোলার প্রয়োজন। এ দু’টোই হল আমার ভবিষ্যত কর্মপন্থা।
আমি আমার কাজ শ্রদ্ধা এবং সম্ভ্রমের সঙ্গে হাতে তুলে নিলাম। এবারে আমার বিরাট শ্রোতাদের কাছে বক্তৃতা দেবার সুযোগ আসে। আমি নিশ্চিত হই, যেটা আগে মাত্র অনুভূতির স্তরে ছিল, সেই বক্তৃতা দেওয়ার একটা সহজাত ক্ষমতা আমার ভেতরে আছে। আমার গলা স্বর প্রক্ষেপণ এতই চমৎকার যে সবাই আমার বক্তৃতা স্পষ্ট শুনতে পারে। অন্ততপক্ষে ছোট্ট ঘরে সমবেত সৈনিকদের তো কোন অসুবিধাই হবার কথা নয়।
এ কাজের চেয়ে পৃথিবীতে আর কোন কাজই আমাকে এতখানি সুখী করতে পারত; সামরিক বাহিনী ছেড়ে দেওয়ার আগে আমার কর্তব্য এমন একটা প্রতিষ্ঠানের প্রতি করতে পেরে আমি আনন্দিত, যে প্রতিষ্ঠানটা আমার হৃদয়ের সবচেয়ে কাছাকাছি,–হ্যাঁ, সেই সামরিক বাহিনী।
আমি বলতে পেরে সুখী যে আমার দেওয়া বক্তৃতাগুলো সফল হয়েছিল। আমার বক্তৃতা দেওয়ার সময়ে শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে আমার দেশবাসীকে তাদের লোকদের এবং পিতৃভূমির কাছাকাছি নিয়ে আসতে পেরেছি।
আমি সৈন্যবাহিনীকে জাতীয়করণ করি; যার দ্বারা সামরিক বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়।
এখানেও আমি আবার বেশ কিছু সহকর্মীর সাক্ষাৎ পাই, যাদের চিন্তাধারার সঙ্গে আমার চিন্তাধারা অভিন্ন। এবং সে কারণে তারা আমার দলে এসে ভেড়ে এবং আমরা নতুন একটা আন্দোলন গড়ে তুলি।