মহাযুদ্ধ
আমার যৌবনের কোলাহলপূর্ণ দিনগুলোতে কোন কিছুই আমার উদ্দাম চেতনাকে এত বেশি সঁতসেঁতে করে দিত না, একমাত্র একটা চিন্তা ছাড়া; সেটা হল— আমি এমন একটা সময়ে জন্মগ্রহণ করেছিলাম যখন নাকি পৃথিবী সুনিশ্চিতভাবে ঠিক করে ফেলেছে যে খ্যাতির মন্দির আর তৈরি করা চলে না। ব্যতিক্রম হিসাবে সম্মান দেখানো হবে একমাত্র ব্যবসায়ী এবং রাষ্ট্রের অফিসারদের। ঐতিহাসিক কর্ম সম্পাদনের ঝড় ইতিমধ্যেই বরাবরের মত থিতিয়ে এসেছে এতটা পরিমাণে যে ভবিষ্যৎ মনে হচ্ছে সঁপে দিয়েছে জাতিদের শান্তিপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, যার থেকে তাকে পুনরুদ্ধার বা সংশোধন করা অসম্ভব। এর সহজ সরল অর্থ হল পরস্পরের সাহায্যে পরস্পরকে শঠতাপূর্ণ প্রতারণা, আত্মরক্ষার্থে ও শক্তির আশ্রয় নেওয়ার ব্যাপারটাই যেন এর বাইরে। ব্যক্তিগতভাবে প্রতিটি দেশকে মনে হচ্ছিল এক একটা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, জোর করে সীমান্ত বাড়ানো আর খদ্দেরের পরস্পরের প্রতি রেয়াত্ যে কোন ছুতানাতায় ব্যাপারটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এবং এর আনুসঙ্গিক পদার্থ হিসাবে উঁচু গলায় গোলমাল অবশ্যই অনুপকারীরা করে চলেছিল। এ ব্যাপারটা নির্দিষ্ট খাতে স্থিরভাবে দিনে দিনে বরাবরের মত বেড়েই চলেছিল। জনসাধারণের অনুমোদন পেয়ে শেষমেষ এটা সমস্ত পৃথিবীটাকে সুবিশাল এক মনিহারী দোকানে পরিণত করে চলেছে। এ দোকানের দেউরিতে সারি সারি স্মারক আবক্ষ মূর্তি সাজানো যা এ মুনাফাখোরদের অমরত্বের সঙ্গে মিলানো, যারা নিজেদের ব্যবসার ক্ষেত্রে অত্যন্ত ধূর্ত এবং সেইসব শাসকশ্রেণীর কর্মচারী যারা নিজেদের অত্যন্ত নির্দোষ বলে জনসাধারণের কাছে নিজেদের তুলে ধরেছে। বিক্রয়রত মানুষগুলো হচ্ছে ইংরেজ এবং শাসনকর্ম চালিয়ে যাওয়া লোকগুলো হল জার্মান। কিন্তু ইহুদীরা তাদের উৎসর্গ করবে এমন ব্যবসাতে যা লাভজনক না হলেও তা হতে হবে এক মালিকের; কারণ তারা প্রকাশ্যে সব সময় চিক্কার করবে যে তারা একেবারেই লাভ করছে না, আর তাদের পকেট থেকেই গুণাগার দিতে হচ্ছে সব সময়। উপরন্তু বিদেশী ভাষায় তাদের জ্ঞান থাকায় এ বাড়তি সুবিধেটুকুও তারা পেয়ে থাকে।
আমি কেন আরো একশ বছর আগে জন্ম নিলাম না? আমি নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করতাম। স্বাধীনতাযুদ্ধের কোন এক সময়ে যখন ব্যবসায়ী না হলেও মানুষকে কিছু মূল্য দেওয়া হত।
এভাবে আমি নিজেকেই ভাগ্যহীন বলে ভাবতাম যে দুর্ভাগ্যের কারণেই আমার এ পৃথিবীতে উপস্থিতি এত দেরিতে হয়েছে এবং একথা ভাবতেও আমার বিরক্তি লাগত যে আমার জীবনটা আমাকে শান্তিপূর্ণ এবং আদেশ মেনে চলে কাটাতে হবে। ছেলে হিসাবে আমি যা-ই হই না কেন, শান্তিবাদী ছিলাম না এবং নিজেকে সেই ধরনের তৈরি করার সমস্ত রকমের প্রচেষ্টা অসারে পরিণত হয়।
তখন দূর দিগন্তে বুয়র যুদ্ধ শুরু হয়েছে। হঠাৎ সংবাদপত্রে তা পড়তাম এবং প্রায় সব টেলিগ্রাম এবং সরকারি ইস্তাহারগুলোকে গোগ্রাসে গিলতাম। সবচেয়ে বেশি আনন্দ লাগত যে দূর থেকে হলেও এ যুদ্ধের আমিও একজন প্রত্যক্ষদর্শী।
যখন রুশ-জাপানী যুদ্ধ শুরু হয়, তখন আমার বয়সও যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি নিজের মধ্যেও বিচার বোধটা তীক্ষ্ম হয়েছে। জাতীয় কারণেই আলোচনার সময়ে আমি জাপানীদের পক্ষ নিতাম। রাশিয়ানদের পরাজয় যে অস্ট্রিয়ায় শ্লাভাজিমের প্রতি সজোরে মুষ্ট্যাঘাত।
ইতিমধ্যে বহু বছর কেটে গেছে যখন আমি মিউনিকে আসি। এখন আমি উপলব্ধি করতে পারি যে আগে যা বিশ্বাস করতাম, যা হল অবক্ষয়ী দেহমনের দ্বারা উৎপন্ন ব্যাধি, যা ঝড়ের পূর্বের শান্ত অবস্থা বজায় রেখেছিল। আমার ভিয়েনার দিনগুলোয় বকা সেই গুমোট ক্ষণিক বিরতির মুঠোয় ধরা পড়েছিল, যা অশনি সংকেতের পূর্ব লক্ষণই প্রদর্শন করেছে। এখানে সেখানে মাঝে মাঝেই বিদ্যুৎ চমক দেখা যেত; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা নৈরাশ্যের অন্ধকারে অতি শীঘ্র মিলিয়ে যেত। এরপরেই বলকানের যুদ্ধ বেঁধে ওঠে, এবং সঙ্গে সঙ্গে তার প্রধান অতিথিরূপে প্রচণ্ড ঘূর্ণিবায়ু প্রবল উত্তেজনাময় ইউরোপকে ঝটিকাগতিতে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এ অতিরিক্ত শান্ত অবস্থায় মানুষ নিজেকে নির্যাতিত এবং ভাবী অমঙ্গলের সূচনা দেখতে পায়। এর তীব্রতা এত বেশি যে আসন্ন আকস্মিক দুর্ঘটনার ধারণাটা একটা অসহিষ্ণু আশায় পরিবর্তিত হয়। তাদের আশা ছিল যে ঈশ্বর তাদের ভাগ্যের বল্লাটাকে নিশ্চয়ই এবার আলগা করে দেবেন এতখানি যে সেই ভাগ্যকে কোন ঘটনাই আর দমন করতে পারবে না। ঠিক এ সময়ে বেশ বড় রকমের একটা বিদ্যুৎ চমক হঠাৎ এসে পৃথিবীটাকে চমকে দেয়। ঝড় ওঠে এবং স্বর্গের বজ্র নির্ঘোষের সঙ্গে মিশে যায় মহাযুদ্ধের কামানের গর্জন ধ্বনি।
আর্চ ডিউক ফ্রানজ ফার্দিনান্দের হত্যা সংবাদ যখন মিউনিকে এসে পৌঁছায়, — আমি সারাটাদিন বাড়িতেই বসে থাকি এবং সত্যি বলতে কি সমস্ত ব্যাপারটাকেই আমি ঠিক অনুধাবন করতে পারি নি। প্রথমে আমি আশংকা করেছিলাম যে কোন অস্ট্রিয়ান জার্মান ছাত্র হয়ত গুলিটা ছুঁড়েছে। হাবুসবুর্গ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী শ্লাভদের প্রতি পক্ষপাতিত্বপূর্ণ কার্যাবলীতে তার ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধ সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তাই আর সে নিজেকে দমন করতে পারেনি। দেশের ভেতরকার শত্রুদের কাছ থেকে জার্মান লোকগুলোকে মুক্ত করার জন্যই হয়ত বা সে এ পথ বেছে নিয়েছে। এ ভুলের মাশুলের গুনাগারটা কী দিতে হবে তা সহজেই কল্পনা করা যায়। এটা আবার নতুন নির্যাতনের একটা ঢেউকেই ডেকে নিয়ে আসবে এবং পৃথিবীর সামনে তা সঠিক বলেই বিবেচিত হবে। কিন্তু অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি সেই গুপ্তঘাতকের নাম জানতে পারি, তাদের পরিচিতি ছিল শ্লাভ হিসেবে। আমি এক হতবুদ্ধিকর অনমনীয় প্রতিহিংসার অবস্থা অনুমান করি,–যা ভাগ্য তাকে নিয়ে যেতে কৃতসংকল্প। শ্লাভদের প্রিয়তম বন্ধু শ্লাভ দেশপ্রেমিকের গুলিতেই বিদ্ধ হয়েছে।
তখনকার ভিয়েনার সরকারের পক্ষে তখন অন্যায় সেই দিনের প্রচলিত ধারা অনুসারে যে চরমপত্র দেওয়া হয়েছিল তাকে দোষী সাব্যস্ত করে। একই ঘটনার এবং অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবীর অন্য কোন সরকারই বিকল্প কোন অবস্থা গ্রহণ করতে পারত না। অস্ট্রিয়ার দক্ষিণ সীমান্তে এক নির্দয় শত্রু সদা সর্বদা উত্তেজনার খোরাক এ দ্বৈত রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে জুগিয়ে চলেছে নিয়মিত বিরতিতে; এবং সে বিরতি ক্রমেই নিকটতর হচ্ছে। এ অধ্যবসায়ের সঙ্গে এখনো কিছুতেই সাম্রাজ্য ধ্বংস না হওয়ার মুহূর্ত পর্যন্ত থামত না। অস্ট্রিয়াতে আশা ছিল বৃদ্ধ সম্রাটের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই সেই মুহূর্তটা এগিয়ে আসবে। একবার এটা করতে পারলেই রাজতন্ত্রের পক্ষে আর কোনরকম শক্ত প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।
কয়েক বছর আগে পর্যন্ত রাষ্ট্র ফ্রানসিস্ যোসেপের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এমনভাবে মিশে গিয়েছিল যে সাধারণ বিরাট জনতার চোখে এ বৃদ্ধ এবং শ্রদ্ধাস্পদ ব্যক্তিত্বের মৃত্যু সম্রাটের মৃত্যুরই তুল্য। সত্যি বলতে কি শ্লাভ নীতির এ কৌশল হল অস্ট্রিয়ান রাষ্ট্র যাতে এ ধারণা পোষণ করে যে সম্রাটের বিরল প্রতিভা এবং আশ্চর্যজনক ঘটনাবলীর জন্যই এ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে। এ ধরনের চাটুকারিতাই হাবুসবুর্গের পছন্দ ছিল। বিশেষত এর সঙ্গে সম্রাটের সত্যিকারের কার্যকলাপের কোন সম্পর্কই ছিল না। এ আরোপিত গৌরবের নিচেকার অন্ধকারে সাবধানে লুকিয়ে রাখা যন্ত্রণাটাকে আর কেউ খুঁজে বার করতে চেষ্টা করেনি। একটা সত্যকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল, মনে হয় ইচ্ছে করেই। যে সম্রাট যত বেশি পরিমাণে তার শাসনকার্যে পদস্থ কর্মচারীদের ওপর নির্ভর করেছে, ততই তারা আরো বেশি করে ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট’ বলে তাকে তুলে ধরেছে; কিন্তু ভাগ্য যখন দরজায় এসে আঘাত করে তার রাজস্বের দাবি জানিয়েছে, তখনই আকস্মিক মহা দুর্ঘটনা নেমে এসেছে।
সেই বৃদ্ধ এবং শ্রদ্ধাস্পদকে বাদ দিয়ে কি অস্ট্রিয়ার সাম্রাজ্যকে কল্পনায় আনা যায়? তা হলে সঙ্গে সঙ্গে কি মারিয়া থেরেমার বিপর্যয় আবার সংঘটিত হবে না?
ভিয়েনার সরকারি বিভাগের পক্ষে সত্যি এটা অন্যায় যে তারাই উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে দেশকে যুদ্ধে নামিয়েছিল, যা হয়ত বা প্রতিরোধ করা অসম্ভব ছিল না। যুদ্ধ অবশ্যই বাধত, তবে দু’এক বছর এটাকে পেছনো গেলেও যেতে পারত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ জার্মান বা অস্ট্রিয়ার কুটনীতিজ্ঞরা কেউ-ই সেই চরম দিনের হিসেবটা করতে পারেনি; সে কারণেই তাদের মুষ্ঠাঘাতও হয়েছে চরম সময়ে।
না। যাদের এ যুদ্ধে নামার ইচ্ছে ছিল, তাদের এর ফলাফল বহনে অস্বীকার করলে চলবে কেন? এর ফলাফল নিশ্চিতভাবেই হল অস্ট্রিয়াকে উৎসর্গ করা। এবং যদি যুদ্ধ, যুদ্ধ হিসেবেও না এসে পড়ত, — তবু সমস্ত জ্ঞাতিসমূহ একসঙ্গে মিলে আমাদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ত, যা হাবুসবুর্গ সাম্রাজ্যকে খণ্ড খণ্ড করে তবে ছাড়ত। সেক্ষেত্রে অবশ্য আমাদের ঠিক করতে হতো আমরা হাবুসবুর্গের পাশে এসে দাঁড়াব, নাকি দূরে সরে থাকব হাতজোড় করে দর্শকের মত, যাতে ভাগ্য তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে যেতে পারে।
আজকে যারা আজকের অমঙ্গলের জন্য সরব এবং তাদের জ্ঞানের আড়ম্বর যুদ্ধের কারণ দর্শাতে ব্যস্ত,–সেই লোকগুলোর সহযোগীতাই এ সাংঘাতিক যুদ্ধের প্রতি দেশ ধাবিত হয়েছিল।
কয়েক যুগ ধরেই জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা ধূর্ত এবং নিচতার সঙ্গে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য আলোড়ন তুলে আসছে। কিন্তু জার্মান সেন্টার পার্টি, যাদের দৃষ্টিভঙ্গীর শেষ কথা হল ধর্ম; তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অস্ট্রিয়া রাষ্ট্রকে সর্বপ্রধান করার,–যেখান থেকে জার্মান নীতি মোড় নিয়েছে।
এ পরিণতির মূখতার জন্ম এখনো হয় নি। যা এসেছে, তা আসতে বাধ্য; এবং কোন কিছুতেই তাকে প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল না। জার্মান সরকারের ভুল হল, একমাত্র শান্তিরক্ষার কারণে যে সমস্ত সুযোগগুলো তাদের স্বপক্ষে ছিল তারও সুযোগ তারা নেয় নি। শুধু পৃথিবী ব্যাপী শান্তির জন্য মৈত্রীর ফাদে পা বাড়িয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর সম্মিলিত শক্তিবর্গের শিকার হয়েছে–যারা জার্মানির এ শান্তি রক্ষার প্রচেষ্টায় বিরোধী ছিল, তারা আটঘাট বেঁধে যুদ্ধকে ডেকে নিয়ে এসেছে।
যদি তল্কালীন ভিয়েনা সরকার তাদের চরমপত্র এতটা তীব্র শর্তাবলী সম্বলিত নাও করত, তবু সেই পরিস্থিতির খুব একটা হেরফের হত বলে মনে হয় না। কিন্তু তা জনসাধারণের ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধ জাগিয়ে তুলত। কারণ সাধারণ জনতার চোখে এ চরমপত্র এমন কিছু নিষ্ঠুর বা অতিরিক্ত ছিল না। যারা আজকে এ সত্যটাকে অস্বীকার করে, তারা হয় নির্বোধ নয় দুর্বল স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন অথবা ইচ্ছে করেই মিথ্যার বেসাতি করা মানুষ।
১৯১৪ সালের যুদ্ধ কোন মতেই জনগণের উপরে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয় নি; সত্যি বলতে কি জনসাধারণই এটা চেয়েছিল।
সাধারণের ভেতরের অনিশ্চয়তাকে একেবারে শেষ করার ধারণার বশবর্তী হয়েই এ চিন্তা করা হয়েছিল। এবং এ সত্যের আলোকে উদ্বুদ্ধ হয়েই দুই লক্ষ জার্মান যুবা স্বেচ্ছায়। এ রঙে নিজেদের রাঙিয়েছে এবং তারা এ সত্যের জন্য তাদের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত উৎসর্গ করতে রাজী ছিল।
আমার কাছে এ মুহূর্তগুলো যৌবনের দিনগুলোয় আমার ওপর চাপিয়ে দেওয়া দুর্দশার বোঝাটার মুক্তির সময় এনে দিয়েছিল। আজকে আমার স্বীকার করতে লজ্জা নেই যে সেই মুহূর্তে আমি উৎসাহের বন্যায় ভেসে গিয়েছিলাম এবং আমার হাঁটু পর্যন্ত ডুবে গিয়েছিল। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ আমাকে আজ পর্যন্ত সে ভার লাঘবের জন্য বাঁচিয়ে রেখেছেন।
এ মুক্তিযুদ্ধ পৃথিবীর ইতিহাসে অসমকরণভাবে ভেঙে পড়েছিল। যে মুহূর্ত থেকে ভাগ্য জাহাজের হাল ধরেছে, জনসাধারণের ভেতরে এ জনমত গড়ে ওঠেছে যে অস্ট্রিয়া অথবা সারভিয়ার ভাগ্য তাকে কোথায় নিয়ে চলেছে। কিন্তু জার্মান জাতির অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়েছিল।
অবশেষে অনেক বছরের অন্ধত্বের পরে লোকে পরিষ্কারভাবে ভবিষ্যতটাকে দেখতে পায়।
সুতরাং মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চাপা স্বরে পরিবর্তে অতিরিক্ত উত্তেজনার প্রাবল্য দেখা দেয়; কারণ এ উল্লাস নিছক বয়ে যাওয়া হঠাৎ উন্মত্ততা ছিল না। পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝাটা অত্যন্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। সেই সময়ে কারোর সবিশেষ ধারণা ছিল না কতদিন ধরে এ যুদ্ধ চলবে। লোকে স্বপ্ন দেখত সৈন্যরা বড়দিনে ঘরে ফিরে আসবে এবং শান্তির সঙ্গে তাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম আবার শুরু করবে।
মানব জাতির চরিত্র হল সে যা বিশ্বাস করে তা-ই আশা করে এবং তার ওপরে পরিপূর্ণ আস্থা রাখে। জনতার এ আচ্ছন্ন করা অনুভূতি ধীরে ধীরে চিরস্থায়ী অনিশ্চয়তায় অবসন্ন হয়ে পড়ে, বিশেষ করে জনসাধারণ যে ব্যাপারগুলোয় বিশেষভাবে জড়িত। সুতরাং কেউ ভাবে নি যে অস্ট্রিয়া সারভিয়ার সংঘর্ষ কুলঙ্গীতে তোলা থাকবে। সেই জন্যই তারা মৌলিক কোন হিসেব নিকেশ আশা করেনি। সেই লক্ষ লক্ষ ইচ্ছুক ব্যক্তিদের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম।
যেইমাত্র সারভিয়া অত্যাচারের সংবাদ এসে মিউনিকে পৌঁছায়,–আমার মনের আকাশে তৎক্ষণাৎ দুটো চিন্তা ভেসে ওঠে : প্রথমত, যুদ্ধ অনিবার্য এবং দ্বিতীয়ত, হাবুসবুর্গ এবার তার মৈত্রী সংঘে স্বাক্ষরের সম্মান দিতে বাধ্য। আমি সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়েছিলাম যে মৈত্রীর বন্ধনের দরুন একদিন জার্মানিকেও যুদ্ধে নামতে হবে এবং প্রথম ধাক্কা তাকেই সামলাতে হবে, অস্ট্রিয়াকে নয়। এ আকস্মিক ঘটনায় আমার মনে হয়েছিল অস্ট্রিয়া তার ঘরোয়া রাজনীতির জন্য মৈত্রীর পক্ষে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু বর্তমানে সে বিপদ কেটে গেছে। পুরনো রাষ্ট্র বাধ্য হয়েছে সংগ্রামে লিপ্ত হতে। স্বেচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছাতেই হোক।
এ সংঘর্ষ সম্পর্কে আমার নিজের ধ্যান ধারণা সহজ এবং স্পষ্ট ছিল। আমার বিশ্বাস এ সংঘর্ষ অস্ট্রিয়ার সারভিয়াকে সন্তুষ্টির জন্য নয়; বরং জার্মানির নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রশ্নটাই যেন বড় হয়ে উঠেছে–জার্মান নীতির শুধু মুক্তির প্রশ্ন এটা নয়, — ভবিষ্যতের প্রশ্নও এ সংঘর্ষের সঙ্গে জড়িত।
বিসমার্কের অসমাপ্ত কাজ এবার শেষ করার পালা। আমাদের পিতৃ-পুরুষেরা বহু নায়কোচিত যুদ্ধে উইসেনবুর্গ থেকে শুরু করে সেদান এবং প্যারিতে যে রক্তক্ষয় করেছে, তার উপযুক্ত হতে হবে আজকের যুবক জার্মানদের। এবং এ সংগ্রামে যদি জার্মানরা জয়ী হতে পারে, তবে আবার জার্মান জাত জাতি হিসেবে পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ জাতিদের সারিতে গিয়ে দাঁড়াবে। একমাত্র তখনই জার্মান সম্রাট তাকে শান্তির ক্ষেত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী বলে দাবি করতে পারে। এবং এ শান্তিরক্ষার জন্য তাদের দৈনন্দিন রুটির বরাদ্দও আর হিসেব করে করতে হবে না।
বালক এবং একজন যুবা হিসেবে আমি প্রায়ই এমন কোন ঘটনা খুঁজে বেড়াতাম যার মাধ্যমে আমার জাতীয়তাবাদী উৎসাহ যে উবে যায়নি তা দেখাতে পারি। জয়ের উল্লাসকে আমার যেন মাঝে মাঝে মনে হত প্রশ্রয়দানকারী পাপী, যদিও এ ধরনের অনুভূতির কোন কারণ দর্শানো আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ এ জয়ধ্বনিতে তাদেরই অধিকার, যাদের ভেতরে নাটকীয়তা নেই বা যেখানে ঈশ্বর জাতিকে সত্যের গন্তব্যে নিয়ে যেতে আদিষ্ট এবং মানুষকে কি তার সেই কঠিন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে? লক্ষ লক্ষ মানুষের মত আমিও এ পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার অনুমতির আনন্দে আনন্দিত ছিলাম। প্রায়ই আমি গান গেয়ে উঠতাম–জার্মান-দেশ হল সবার ওপরে। এবং সঙ্গে সঙ্গে ‘হাইল’ অর্থাৎ ‘জয় হোক’ বলে চিৎকার করতাম। সে সব অনুভূতির সত্যতা নিরূপণের জন্য প্রায়ই আমি অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করে ঈশ্বরের বিচারশালায় উপস্থিত হতাম।
প্রশ্ন থেকেই একটা জিনিস আমার কাছে স্পষ্ট ছিল যে যুদ্ধ বাধলেই, যা আমার কাছে অবশ্যম্ভাবী বলে মনে হয়, আমার বইগুলো তৎক্ষণাৎ ঠেলে একপাশে সরিয়ে রেখে দেব। আমি আরো অনুভব করি যে আমার জায়গা হল সেখানে, যেখান থেকে আমি আমার অন্তরের আহ্বান শুনতে পাচ্ছি।
প্রধানত রাজনৈতিক কারণেই আমি অস্ট্রিয়া ছেড়েছিলাম। এর থেকে কি বেশি বিচারশক্তি সম্পন্ন হতে পারে যা আমার রাজনৈতিক ধ্যান ধারণা পরিবেশ অনুযায়ী যৌক্তিক হতে পারে। এখন সেই যুদ্ধই বেঁধে গেল। হাবুবুর্গের হয়ে যুদ্ধ করার কোন ইচ্ছেই আমার ছিল না, কিন্তু আমার জ্ঞাতিবর্গ এবং সম্রাটের জন্য মৃত্যুকেও আমি পরোয়া করি না।
৩ আগস্ট, ১৯১৪ সালে আমি মহানুভব রাজা তৃতীয় লুইভিগের কাছে ব্যাভেরিয়ার সৈন্যবাহিনীতে যোগদানের অনুমতি প্রার্থনা করে একটা দরখাস্ত করি। তখনকার দিনে সম্রাটই ছিলেন সর্বেসর্বা। এবং দু’একদিনের ভেতরে উত্তরও পেয়ে যাই যে আমার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছে। আমি উত্তরটা পেয়ে কম্পিত হাতে খুলি এবং আজ তা ভাষার দ্বারা প্রকাশ করা অসম্ভব যে আমি যখন পড়ে দেখি আমাকে ব্যাভেরিয়ার সৈন্যবাহিনীতে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমি যে খুব আনন্দিত হয়েছিলাম তাতে সন্দেহ নেই। কয়েকদিনের মধ্যে আমি সেই পোশাক গায়ে চড়াই, যা পরবর্তী ছ’ বছরে আর আমি খুলে রাখিনি।
আমার পক্ষে যা, সব জার্মানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় অধ্যায়ের সূচনা হয়। সেই সগ্রামের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, পেছনের ফেলে আসা স্মৃতির টুকরোগুলো সব বিস্মৃতির গর্ভে লীন হয়ে আসে। সতৃষ্ণ গর্বে আমি সেই দিনগুলোর দিকে ফিরে চাই, বিশেষ করে আমরা যখন সেই উল্লেখযোগ্য ঘটনার দশম বর্ষে পদার্পণের কাছে এসে দাঁড়িয়েছি। আমার সেই যুদ্ধের প্রথম কয়েক সপ্তাহের স্মৃতি সব সময় স্মরণে আসে, যখন ভাগ্য আমাকে সেই নায়কোচিত সংগ্রামে জাতির মধ্যে ঠাঁই দিয়েছিল।
আমার মনের সামনে যখন দৃশ্যপটগুলো খোলা হয়, তখন মনে হয় যেন তা গতকালের ঘটনা। আমার মানস চোখে ভেসে ওঠে সেই দৃশ্যটা, যখন আমি আমার যুবক সহকর্মীদের সঙ্গে কুচকাওয়াজে রত এবং সেটা সীমান্ত ছাড়ার শেষ দিন পর্যন্ত আমরা করে এসেছি।
অন্য সবার মত একটা চিন্তাই আমাকে ভাবিয়ে তুলতো, তাহল আমাদের সীমান্তের যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছতে যদি দেরি হয়ে যায়। মাঝে মাঝে এ চিন্তা আমাকে উদ্বিগ্ন করে তুলত এবং প্রতিটি বিজয় ঘোষণা আমাকে তিক্ততার স্বাদ এনে দিত, যেটা পরবর্তী বিজয় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আরো অনেকটা বেড়ে যেত।
অবশেষে সেই দিনটা উপস্থিত হল যখন আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য মিউনিক ছাড়লাম। জীবনে এ প্রথম আমি রাইন নদী দেখলাম; যখন আমরা পশ্চিমের দিকে অগ্রসর হচ্ছি সেই ঐতিহাসিক নদী চিরাচরিত এবং উদ্যত শক্রর গ্রাস থেকে রক্ষা করার সংকল্পে। সূর্যের প্রথম রশি হালকা কুয়াশা ভেদ করে মাটিতে পড়েছে এবং আমাদের সম্মুখে নীদারভালন্ডের প্রতিমূর্তি প্রকটিত, সৈন্যভর্তি ট্রেনটাই গেয়ে ওঠে,–রাইনের তীরে জেগে উঠলাম। আমি অনুভব করতে পারি যে আমার হৃদয় যেন সে উচ্ছ্বাস আর ধরে রাখতে পারছে না।
এবং তারপরেই এসে উপস্থিত হল ভিজে আর সঁতসেঁতে একটা রাত। সারাটা রাত আমরা নিঃশব্দে এগিয়ে চললাম, কুয়াশা ভেদ করে যেইমাত্র প্রথম সূর্যরশ্মি আমাদের সামনে এসে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে মাথার ওপরে সশব্দে বোমা ফাটার শব্দ। বোমা গোলা আমাদের মধ্যেই এসে পড়তে লাগল এবং তা ভিজে মাটির ওপরে ছত্রাকার। কিন্তু সেই বোমা গোলার ধোঁয়া অপসারিত হওয়ার আগেই দুশো কণ্ঠের সম্মিলিত এক জয়ধ্বনি। এটা মৃত্যুকে আলিঙ্গনের অভিব্যক্তি। তারপরেই শুরু হয় গুলির শিসধ্বনি আর কামানের গর্জন, যোদ্ধাদের চিৎকার চেঁচামেচি আর সমবেত কণ্ঠের গান। জ্বর হলে যেমন চোখ টাটায়, তেমনি টাটাচ্ছে, তবু আমরা এগিয়ে চলেছি। দ্রুতগতিতে। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা যুদ্ধক্ষেত্রের কাছাকাছি এসে পৌঁছাই। পেছনে বীট পালং আর ঘাসের প্রান্তর। সত্বর গানের সুর আমাদের বহুদূরে নিয়ে যায়। ক্রমে ক্রমে সেই গানের সুর নিকটতর হতে শুরু হয়। প্রতিটি সৈন্যদলের থেকে উত্থিত হচ্ছে সেই গানের সুর।
সেই গানের সুর ক্রমশই এগিয়ে আসতে থাকে, উথিত হতে শুরু করে প্রতিটি সৈনিকের কণ্ঠ থেকে। এবং মৃত্যু যখন আমাদের দলের সর্বব্যাপী ধ্বংস করতে উদ্যত, তখনো আমরা পাশের লোকের উদ্দেশ্যে গেয়ে চলেছি : জার্মান, প্রিয় জার্মান দেশ আমরা সবচেয়ে ওপরে, পৃথিবীর সমস্ত দেশের ঊর্ধ্বে।
চারদিন যুদ্ধক্ষেত্রের একটা খানায় কাটিয়ে আমরা ফিরে আসি। এমন কি আমাদের পদক্ষেপও আর আগের মত দীর্ঘ পড়ে না। সতের বছর বয়স্ক বালকদের যেন পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ বলে মনে হয়। এ উল্লিখিত সৈন্যদের কারোরই সমরশিক্ষার পরিপূর্ণতা ছিল না। কিন্তু আমরা অভিজ্ঞ সৈন্যদের মত মরতে জানতাম।
এটা মাত্র আরম্ভ এবং এ জিনিসগুলোকেই আমরা বছরের পর বছর বহন করে নিয়ে। গেছি। ভাবপ্রবল যুদ্ধের উৎসাহের বদলে একটা তীব্র ভীতি তখন জড়িয়ে ধরেছে। উৎসাহ তারপর ধীরে ধীরে কমে আসে এবং আরম্ভের প্রচণ্ড রকমের উৎসাহটা নিভে গিয়ে সব সময় একটা মৃত্যুভয়ের ছায়া সর্বত্র দেখতে থাকি। এমন একটা সময় আসে, যখন পরস্পরের মধ্যে তর্ক বেঁধে যায় একটা প্রশ্ন নিয়ে, কর্তব্যের আহ্বান বড়, নাকি আত্মরক্ষা; এবং আমাকেও সেই তর্কের মধ্য দিয়েই চলতে হয়েছে। মৃত্যু তখন সর্বত্র তার প্রার্থনা জানিয়ে চলেছে, একটা নামহীন কাঠিন্য যাকে বলে বিদ্রোহত্মক মনোভাব দুর্বল শরীরে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে এবং আপ্রাণ চেষ্টা করে সহজাত জ্ঞান বলে অভিহিত হতে। কিন্তু বাস্তবে এটা আর কিছুই নয় — ভয়; যা ব্যক্তিগতভাবে সকলকেই আক্রমণ করে বসেছিল। যত অধিক সংখ্যক কণ্ঠস্বরের পরিণামদর্শিতার কথা ভেবে নিজেদের মনোবল বাড়াবার কথা ভাবি, তত বেশি তার আবেদন নিবেদন স্পষ্ট হয়ে দাঁড়ায়, প্রতিরোধ শক্তিও বেড়ে ওঠে। শেষে একসময় অন্তর্দ্বন্দ্ব শেষ হয় এবং কর্তব্যের আহ্বানে বিজয়ী হয়। ১৯১৫-১৬ সালের পুরো শীতটাই আমাকে এ সগ্রামের মধ্যে দিয়ে কাটাতে হয়েছে। ইচ্ছাশক্তি শেষমেষ প্রভুত্ব বিস্তার করে। প্রথমদিকে আমি এ সংগ্রাম হাসিমুখেই করেছি, বর্তমানে কিন্তু আমার মধ্যে এক শান্তভাব আর স্থির সংকল্প এসেছে এবং যা আমার মনের সহাশক্তির পরিধিও অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। ভাগ্য সম্ভবত এবার তার শেষ পরীক্ষায় হাজিরা দেওয়ার কথা বলতে শুরু করেছে, অবশ্যই আমার মানসিক দৃঢ়তা এবং যৌক্তিকতাকে বাদ দিয়ে। যুবক স্বেচ্ছাসেবকরা বর্তমানে অভিজ্ঞ সৈনিকে পরিণত হয়েছে।
এ একই ধরনের পরিবর্তন সমস্ত সৈন্যদলের মধ্যেই আসে। অবিরত সংগ্রাম এটাকে অভিজ্ঞ এবং শুধু দৃঢ়তা করেনি, শক্তও করেছিল; যার জন্য এটা দৃঢ় বদ্ধ এবং ভয়হীন চিত্তে তার প্রতিটি কার্যকলাপের সম্মুখীন হতে পেরেছে।
একমাত্র বর্তমানেই সেই সৈন্যদলকে বিচার করা সম্ভব। দু-তিন বছর ক্রমাগত সংঘর্ষের পর, এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আরেক যুদ্ধক্ষেত্রে, উন্নত সৈন্যদল এবং অস্ত্রশস্ত্রের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে, অনাহার এবং ক্লান্তি ক্লেশের শেষ সীমায় পৌঁছে, সময় এসেছে যখন একজন সৈনিক তার ব্যক্তিগত সংঘর্ষের মূল্য বুঝতে সক্ষম।
আগামী এক হাজার বছরেও মহাযুদ্ধের জার্মান সৈন্যদের বীরত্ব তারা স্মরণে আনবে এবং তখন ধূসর অতীত থেকে জেগে ওঠা ওমর দৃষ্টি কখনই স্বীকার করবে না। যে এ শিরস্ত্রাণগুলো কখনো ভয়ে সংকুচিত হয়েছে বা স্পষ্টভাবে ভয়ে কথা বলেনি। যতদিন পর্যন্ত জার্মান জাতির অস্তিত্ব থাকবে, তারা এভাবে গর্ববোধ করবে যে এরা তাদের পূর্ব পুরুষের সন্তান।
আমি তখন ছিলাম, একজন সৈনিক, তাই অযথা রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করিনি। এর আরো একটা কারণ হল সময়ও তখন ঠিক এর স্বপক্ষে ছিল না। আমি এখনো পর্যন্ত বিশ্বাস করি যে সাধারণ একটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছেলে আজকের শ্রেষ্ঠসন্তানের চেয়েও অনেক বেশি দেশের সেবা করেছে। আমি অবশ্য শ্রেষ্ঠ সন্তান বলতে গণতান্ত্রিক সদস্যদের বোঝাতে চাইছি। সেইসব তুচ্ছ লোকগুলোর প্রতি আমার তীব্র ঘৃণার একমাত্র কারণ হল, সেই দিনগুলোয় ভাল লোকগুলোর যা বলার থাকত তা শত্রুর মুখের ওপরেই বলত এবং তা বলতে অপারগ থাকলে মুখ বন্ধ করে তাদের কর্তব্য অন্য কিছুতে নিয়োজিত করত। আমি এ রাজনৈতিক বিশারদদের মনে মনে ঘৃণা করতাম এবং আমার যদি কোন উপায় থাকত তবে আমি তাদের নিয়ে একটা শ্রমিক দল তৈরি করতাম যা নাকি তাদের নিজেদের ভেতরের টগবগে সুযোগের প্রতীক্ষাটাকে প্রস্ফুটিত হতে সাহায্য করে তাদের হৃদয়কে পরিপূর্ণ করে দিত; সৎ এবং ভাল মানুষেরা তাহলে এদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হত না।
সেইদিনগুলোয় আমি রাজনীতিকে কোনরকম গুরুত্ব দিতাম না। কিন্তু তা সত্ত্বেও কিছু অভিব্যক্তির ব্যাপারে আমার মতামত প্রকাশ না করে পারিনি, যা শুধু জাতির স্বার্থেই আঘাত হানেনি, তা’ বিশেষ করে সৈনিকদের স্বার্থেরও পরিপন্থী। এর মধ্যে দুটো বিষয়ে আমার প্রচণ্ড রকমের উদ্বিগ্নতা ছিল, যা আমার ধারণায় আমাদের স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকারক।
আমাদের প্রথম পরপর বিজয়গুলির অব্যহত পরেই সংবাদপত্রের একটা বিশেষ গোষ্ঠী জনসাধারণের উৎসাহের আগুনে ফোঁটা ফোঁটা ঠাণ্ডা জল ফেলতে থাকে। প্রথমদিকে বেশি লোকের নজরে ব্যাপারটা আসেনি। সৎ উদ্দেশ্যের ছদ্মবেশে এবং নকল উদ্বিগ্নতার ভাণ দেখিয়েই করা হয়েছে। জনসাধারণকে বোঝানো হয়েছে যে জয়ের বিরাট জয়োৎসব ঠিক এ জায়গাতে সমীচীন নয়। আর শ্রেষ্ঠ একটা জাতির পক্ষে এটা সাজে না। জার্মান সৈনিকের সহিষ্ণুতা এবং শৌর্য হল মেনে নেওয়া সত্য, যার জন্য জয়োৎসবের এ সশব্দে বিদিরণের কোন প্রয়োজনীয়তাও নেই। উপরন্তু, বিদেশীরা জয়ের এ অভিব্যক্তিকে কিভাবে নেবে? এ জান্তব জয়োল্লাসের চেয়ে শান্ত এবং দ্ৰ উপায়ে জয়ের বহিঃপ্রকাশকে কি তারা আরো ভালভাবে গ্রহণ করবে না। সঙ্গে সঙ্গে সংবাদপত্রগুলো এ কথাও প্রচারিত করতে শুরু করে যে, জার্মানদের উচিত স্মরণে রাখা যে যুদ্ধ আমাদের কাজ নয়, সুতরাং জাতিকে ডেকে তাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়াটা আমাদের পক্ষে কিছু লজ্জাস্কর নয়। এ কারণেই আমাদের সৈনিকদের এ সমুজ্জ্বল কাজকে কোনরকমেই অশোভনীয় বিজয়োৎসবের মাধ্যমে কলংকিত করাটা উচিত হবে না। কারণ বহিঃপৃথিবী কিছুতেই ব্যাপারটাকে বুঝে উঠতে পারবে না। উপরন্তু, সত্যিকারের একজন নায়ক নিশুপ বিনয়ের সঙ্গে তার কাজ করে এবং ভুলেও যায়, এর চেয়ে বড় সার্থকতা আর কিসে! মোটামুটি এ ছিল তাদের সতর্কতার উপসংহার।
এসব লোকগুলোর কান ধরে খামচে টেনে এন গলারদড়ির ফাঁস পরানোর পরিবর্তে, যাতে জাতির এ বিজয়োৎসবে ভাটা না পড়ে, এ সমস্ত তথাকথিত নাইটদের কলমকে তুলে ধরাই হয়েছিল, যা ক্রমাগত এ বিজয়োৎসবকে ‘অশোভনীয় এবং মর্যাদাহানিকর বলে চিৎকার করেছে।
সম্ভবতএকজনেরও এ ধারণা ছিল না যে একবার যদি গুণ উৎসাহ কোনরকমে নিভে যায়, তবে তাকে আর কোনক্রমেই আবার প্রজ্জ্বলিত করা সম্ভব নয়, যখন প্রয়োজন পড়বে।
এ উৎসাহও এক প্রকারের সুরামত্ততা এবং তা সযত্নে রাখা উচিত। এ ধরনের উদ্যমের অভাবে কি করে এতবড় একটা যুদ্ধকে সহ্য করা সম্ভব, যা নাকি মনুষ্যত্বের পরিমাপে একটা জাতির পক্ষে বিরাট অক্লান্ত পরিশ্রম করার চাহিদার অপেক্ষা রাখে।
বিশাল জনতার মনস্তত্ত্ব আমি খুব ভালভাবেই বুঝতে পারতাম এবং জানতাম এসব ক্ষেত্রে মহান রুচিজ্ঞান আগুনকে বাতাসের সাহায্যে বাড়িয়ে তুলে লোহাকে গরম রাখতে সমর্থ হবে না। আমার কাছে এটা ভুল যে জনসাধারণের উৎসাহটাকে আরো উঁচু গ্রাম তুলে ধরা হয়নি।
সুতরাং আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না, কেন এ ধরনের নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। অর্থাৎ জনসাধারণের উৎসাহকে ভিজিয়ে দেওয়ার নীতি।
আরেকটা ব্যাপার যা আমাকে অসহিষ্ণু করে তুলেছিল, তা হল মার্কসীয় মতবাদকে যেভাবে গ্রহণ এবং শ্রদ্ধা করা হয়েছিল, আমি ভেবেছিলাম এর কারণ হল মার্কসীয় প্লেগ সম্পর্কে এদের ধারণা ছিল কত অল্প। সবাই বিশ্বাস করত যে দলীয় মতপার্থক্য যুদ্ধের সময়ে দূর করার প্রচেষ্টাই মার্কসীজিমকে এত নরম আর উদার হিসেবে জনসাধারণের কাছে প্রতিফলিত করেছিল।
কিন্তু এখানে তো দলের কোন প্রশ্নই নেই। এখানে হল সেই মতবাদের প্রশ্ন যা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল শুধুমাত্র একটা উদ্দেশ্য নিয়ে অর্থাৎ মানবজাতিকে ধ্বংসের দিকে টেনে নিতে। এ মতবাদের অভিপ্রায়টাকে কেউ বুঝতে পারেনি কারণ আমাদের ইহুদী দলিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ প্রশ্ন কখনো উত্থাপন করেনি; এবং আমাদের উদ্ধত আমলা অফিসাররা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট তালিকার বাইরের কিছু পড়াশুনা করতে রাজী নয়। তাই এ শক্তিশালী বিদ্রোহের স্রোত তাদের পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু যারা বুদ্ধিমান বলে সমাজে পরিগণিত,–তারা কখনো প্রসন্ন দৃষ্টিতে এদিকটায় নজর দেয়নি। এ কারণেই রাষ্ট্রীয় সংগঠন সবসময়েই ব্যক্তিগত মালিকানার সংগঠনের পেছনে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছে। এ ভদ্রসম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে একথাই বলা চলে যে, তাদের মতামত হল : যা আমরা জানি না,–তা নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজনও নেই। ১৯১৪ সালের আগস্ট মাসে জার্মান শ্রমিকেরা মার্কসবাদের ধার ঘেঁষে দাঁড়ায়। এটাই হল বিরাট একটা ভুল। যখন সেই দুর্গের মুহূর্তগুলো এসে উপস্থিত হয়, তখন প্লেগের কবলে পড়ে জার্মান শ্রমিকেরা নড়ে ওঠে। নইলে সগ্রামের জন্য না ছিল তারা ইচ্ছুক, না ছিল তাদের প্রস্তুতি। এবং জনসাধারণের মুখামীও যথেষ্ট পরিমাণেই ছিল যে কারণে তারা মাকর্সবাদ জাতীয় নীতি বলে কল্পনা করত। এটা হল আরো একটু উপযুক্ত উদাহরণ অর্থাৎ যারা তাত্ত্বিক তারা মার্কসবাদ শিক্ষার প্রচলিত ধারাটাকে খতিয়ে দেখেনি। যদি তারা খতিয়ে দেখত, তবে এ ধরনের ভুল কিছুতেই হওয়া সম্ভব ছিল না।
মার্কসবাদ, যার মূল উদ্দেশ্যই ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে সমস্ত অ-ইহুদী রাষ্ট্রকে ধ্বংস করা। ১৯১৪ সালে এটা প্রত্যক্ষ হয় যে কিভাবে জার্মান শ্রমিকবৃন্দকে উঁচু গলায় তিরস্কার করা হয়েছে, যা জাতীয় উৎসাহের থেকে উৎসাহিত হয়ে পিতৃভূমির সঙ্গে মিশে গেছে। কয়েকদিনের মধ্যেই সেই শঠতাপূর্ণ ধোয়ার পর্দা কুখ্যাত জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতার হাল্কা হাওয়ায় মিলিয়ে আসে, এবং হঠাৎ ইহুদী পদস্থ ব্যক্তিরা তাদের নিঃসঙ্গ এবং পরিত্যক্ত বোধ করে। সেই মুর্থ এবং পাগলের কোনরকম পদচিহ্ন রেখে যায়নি; যা গত ষাট বছর ধরে জার্মানদের শরীরে রোগের বীজ ছড়িয়ে আসছে। সত্যি কথা বলতে গেলে, জার্মান শ্রমিকদের পক্ষে এটা অত্যন্ত অমঙ্গল সূচক ছিল। যে মুহূর্তে নেতারা উপলব্ধি করতে পারে যে বিপদ সামনে উপস্থিত যা তাদের টেনে নিচে নামাবে, তারা প্রবঞ্চনার টুপিটা তাদের কানের ওপর টেনে তুলে দেয় যাতে তাদের কেউ চিনতে না পারে। তারা প্রকৃত ঘটনার প্রদর্শনকারী প্রহসনের অভিনেতার ভূমিকা গ্রহণ করে যেন। জাতিয় অভ্যুত্থানের প্রধান দায়িত্ব তাদের ওপরেই ন্যস্ত।
আমার মনে হয় জনসাধারণের আপদ ইহুদী দলের বিরুদ্ধে যথাযোগ্য কাজ শুরু করার সময় এসে গেছে। যে কোনরকম ফলাফলের মুখোমুখি তৈরি রেখেই ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাতে জনসাধারণের ভাগ্য কাটাগাছের ঝোপে ভর্তি জঙ্গলেই পড়ুক বা প্রতিবাদই করুক। আগস্ট ১৮১৪ সালের এক ধাক্কায় শূন্যগর্ভ ইতরগুলো আন্তর্জাতিক সমস্বার্থতায় জার্মান শ্রমিকদের মাথাগুলোকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল, কয়েক সপ্তাহ পরে,–নিজেদের কানে এ নির্বুদ্ধিতার কথা শোনার পরিবর্তে। আমেরিকর তৈরি, বোমাগোলার আওয়াজে কান ঝালাপালা হবার জোগাড়, মাথার ওপরে মুমুর্থ ফাটা এসব বোমাগোলাকে আন্তর্জাতিক সহকর্মী প্রীতির প্রতীক বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে সেই জার্মান শ্রমিকেরা জাতির জন্য রাস্তা আবার আবিষ্কার করেছে, যে কোন সরকারের এটা কর্তব্য–অবশ্যই যে সরকার তাদের লোকদের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী, — এ সুযোগে এসবের নির্দয়ভাবে মুলোৎপাটন করা, যা কিছু জাতির উৎসাহকে অবদমিত করার চেষ্টা করবে।
সুতরাং বিষাক্ত এ সাপেরা আবার তাদের কাজ শুরু করে। এবার অবশ্য আগের চেয়ে আরো বেশি সতর্ক হয়ে, তবে আরো ধ্বংসাত্মক উপায়ে। যখন সৎ লোকেরা বন্ধুত্ব পুনঃস্থাপনের প্রচেষ্টায় রত, ঠিক সেই মুহূর্তে মিথ্যা শপথকারী এসব অপরাধীরা একটা বিদ্রোহের জন্য তৈরি হচ্ছে।
স্বভাবতই আমার মনে তখন দ্বিধা, কোন পথটাকে ঠিক সেই সময়ে বেছে নেওয়া উচিত; কিন্তু এর ফলাফলের যে এতটা ধ্বংসাত্মক হবে তা ভাবিনি।
তবে তাহলে তখন কি করা উচিত? এ সম্ভব চক্রের নেতাদের ধরে চালান দিয়ে জেলে পুরে জাতিকে এদের হাত থেকে মুক্ত করা? সামরিক ব্যবস্থার সাহায্যে এদের একেবারে নির্মূল করে দেওয়া উচিত ছিল। দলবাজী বিলুপ্ত এবং পার্লামেন্টকে প্রয়োজনে বন্দুকের নলের সামনে ধরে তার জ্ঞানবুদ্ধ ফিরিয়ে আনা উচিত ছিল। এর চেয়ে আরো ভাল ব্যবস্থা হত যদি পার্লামেন্টকে ভেঙ্গে দেওয়া হত। এখন যেমন গণতন্ত্র যে কোনও দলকে ইচ্ছে মত ভেঙে দেয়। কিন্তু সে দিনগুলোতে এ কাজের প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি ছিল। কারণ জাতির অস্তিত্বই তখন চরমভাবে বিপন্ন। অবশ্য এ ধরনের উপদেশ একটা প্রশ্ন তুলতে বাধ্য : যন্ত্রের সাহায্যে কি আদর্শের মূলোৎপাটন করা সম্ভব? সার্বজনীন একটা মতবাদকে কি গায়ের জোরে আক্রমণ করা যায়?
সেই সময় এ প্রশ্নটাকে আমি আমার নিজের মনে বার বার জিজ্ঞাসা করেছি। একই ধরনের সমস্যাকে বিশ্লেষণ করে, ইতিহাস থেকে তার নজীর নিয়ে, বিশেষ করে ধর্মের থেকে যাদের উৎপত্তি, আমি নিচের মতামতগুলোয় উপস্থিত হই।
আদর্শ, দার্শনিক মতবাদ এবং কোন সংগ্রাম যার ভিত্ ধর্মের মাটিতে প্রোথিত, সত্যি মিথ্যে যা-ই হোক না কেন, শক্তি দ্বারা তার মূলচ্ছেদ করা একটা নির্দিষ্ট অবস্থার পর সম্ভব নয়, একমাত্র একটা পদ্ধতিতেই তা সম্ভব সেটা হল : এ শক্তি যদি কোন নতুন আদর্শ বা মতবাদের জননকেন্দ্রকে নির্দয়ভাবে নির্মূল করা যায়, এমন কি সেই আদর্শের ধ্বজা ধরে থাকা শেষ মানুষটা অথবা সেই আদশের প্রচলিত ধারাটাকে মুছে দিতে হবে, নইলে তা সব সময়েই চেষ্টা করবে, পেছনে একটা ধারা রেখে যাওয়ার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর ফলাফল হল রাষ্ট্রকে বর্জন করা, তা সাময়িক বা চিরস্থায়ী হোক, রাষ্ট্রের সৌজন্যের পেছনে রাজনৈতিক রহস্য থাকে। কিন্তু অভিজ্ঞতা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে যে এ সমূলোৎপাটন রক্তস্রাবী পদ্ধতিতে কিছু ভাল লোককে এ নির্যাতিত শাসনব্যবস্থায় নিগৃহীত হতে হয়। সত্যি বলতে কি প্রতিটি নির্যাতন যার পেছনে কোন প্রেরণা নেই, তা নীতির দিক থেকে অন্যায় এবং তার দ্বারা কিছুসংখ্যক শ্রেষ্ঠ মানব সন্তানকে আমরা হারাই, এর পরিমাণ সময় সময় এতই বেশি হয়ে দাঁড়ায় যে নির্যাতনটাকে অন্যায় বলে মনে হয়। অনেক ব্যক্তির কাছেই এটা নিছক বিরুদ্ধপক্ষকে দমন করার প্রবণতা, প্রতিটি ব্যাপারেই তারা চেষ্টা করে নির্দয়ভাবে শক্তির দ্বারা বিনাশ করতে।
এভাবে নির্যাতন যত বেড়ে চলে, নির্যাতনের মতবাদটাও তত বৃদ্ধি পায়। নতুন মতবাদের মাধ্যমে এ ব্যবস্থার বিনাশ সম্ভব। কিন্তু এ ব্যবস্থার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এ পদ্ধতির জন্য আমরা জাতির বা রাষ্ট্রের কিছু সংখ্যক শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারাব এবং সে রক্তও তখন প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে, কারণ এ ধরনের আংশিক বা সামগ্রিক পরিষ্কার করার কাজে জাতির শক্তি নিঃশেষের মুখোমুখি এসে দাঁড়াবে। এ ধরনের নীতি সব সময়ই নিরর্থকতায় পর্যবসিত হয় যদি শুরু থেকে এ মতবাদ ছোট্ট গণ্ডীর বাইরে ছড়িয়ে পড়ে।
এসব কারণে এসব ক্ষেত্রৈ অন্যান্য বুদ্ধির মত এ মতবাদকে ভূমিষ্ঠ অবস্থাতেই নির্মূল করা সম্ভব। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেড়ে চলে। বয়সের সঙ্গে এর ভেতরে ঠাঁই নেয় নব্য যুবকেরা–তবে অন্যরূপে এবং অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে।
সুতরাং এ সত্য প্রতিষ্ঠিত যে কোন মতবাদকে নির্মূল করার প্রচেষ্টা, যদি সে প্রচেষ্টার ধর্মীয় কোন ভিত্তিভূমি না থাকে এবং শুধু মতবাদই নয়, — সে ধরনের দল বা পার্টিকে যা এসব মতবাদের দ্বারা সৃষ্ট, অনেক ক্ষেত্রেই উল্টো ফল প্রাপ্তি যোগ ঘটে থাকে। এবং সেগুলো হয় নিচের কারণে?
সে মতবাদ বিস্তারের মুখোমুখি যখন নিছক শক্তির প্রয়োগ হয়, তখন সে শক্তি প্রয়োগ ক্রমাগত এবং একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে হওয়া উচিত। এর মানে গিয়ে দাঁড়ায়, কোন মতবাদকে নিশ্চিহ্ন করতে হলে ক্রমাগত এবং সমানুপাতিক কোন পদ্ধতির প্রয়োজন। সেই মুহূর্তে দ্বিধা দেখা দেবে, এবং সহ্য ক্ষমতার হেরফেরের জন্য শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে শুধুমাত্র সেই মতবাদই যে প্রখর হয়ে উঠবে, তা’ নয়, কিন্তু প্রতিটি নির্যাতন নতুন নতুন সমর্থক জোটাবে যারা এ পদ্ধতিতে নির্যাতিত। পুরনো কর্মীরা আরো তিক্ত হয়ে উঠবে যার দ্বারা এ পদ্ধতিতে নির্যাতিত এবং তাদের মৈত্রীবৃন্দো আরো বেশি শক্তি বৃদ্ধি পাবে। তাই শক্তি যখন প্রয়োগ করা হয়, সাফল্য নির্ভর করে সেই শক্তির ভারসাম্যতার ওপরে। এ অধ্যাবসায় হল আর কিছুই নয়, নির্দিষ্ট ধর্মীয় মতবাদ। শক্তির প্রতিটি রূপ যার পেছনে ধর্মের দোহাই থাকে না, তা এলোমেলো এবং অনির্দিষ্ট হতে বাধ্য। এ ধরনের শক্তির ক্ষেত্রে দেখা যাবে স্থিরতার অভাব, একমাত্র বিশ্বজনীন মতবাদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, যা শ্রেষ্ঠতম হওয়ার পথে চলেছে। ব্যক্তিগত উৎসাহের বহিঃপ্রকাশ হল এ ধরনের শক্তি; সুতরাং সময়ের এবং মানুষের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যার হাতে এর ভার পড়েছে তার চরিত্র এবং ব্যক্তিগত ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে এরও পরিবর্তন ঘটে থাকে।
কিন্তু এটার সম্পর্কে আরো কিছু বলার আছে। প্রতিটি বিশ্বজনীন মতবাদ,–ধর্মীয় বা রাজনৈতিক যা-ই হোক না কেন–অনেক সময়েই আরম্ভ বা শেষ কোথায় তা ধরা। মুস্কিল হয়ে পড়ে, বিরুদ্ধে মতবাদের নেতিবাচক আদর্শের জন্য যত না সংঘর্ষ লাগে, তার চেয়ে অনেক বেশি হয় তার নিজস্ব আদর্শের ইতিবাচক ধ্যান ধারণার কারণে। এ সংঘর্ষের মূল কারণ হল আক্রমণে আত্মরক্ষণে নয়। আর একটা সুবিধে হল এর বস্তুতান্ত্রিকটা কোথায় তা বোঝা যায়, কারণ এ বস্তৃতান্ত্রিকতাই হল এর নিজস্ব আদর্শ। বিপরীতভাবে এটা বলা দুস্কর কখন নেতিবাচক উদ্দেশ্য বিরুদ্ধপক্ষের মতবাদকে ধ্বংস করতে অগ্রসর হবে এবং কার্য সম্পাদন করবে। এ একমাত্র কারণে বিশ্বজনীন মতবাদ হল চরিত্রের দিক থেকে আক্রমণাত্মক, যার ছক নির্দিষ্ট এবং প্রচণ্ড শক্তিশালী ও চরিত্রগতভাবে স্থির; বিশেষ করে যে সর্বজনীন মতবাদ আত্মরক্ষার কারণে বেছে নেওয়া হয়। সেই শক্তি আত্মরক্ষণের জন্যই ব্যবহৃত হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না এর ব্যবহারকারীরা উপযুক্ত এবং নতুন ধর্মীয় মতবাদের প্রচারক বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে।
সংক্ষেপে নিচের ব্যাপারগুলোকে মনে রাখতে হবে : সর্বজনীন মতবাদের বিরুদ্ধে শক্তি নিয়োজিত প্রতিটি যুদ্ধ নিষ্ফলতায় পরিবেশিত হবে, যদি সেই সংঘর্ষ আত্মরক্ষণ ধরনের এবং নতুন কোন ধর্মীয় মতবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত না হয়। একমাত্র বিশ্বজনীন দু’টো মতবাদের ভেতরে দৈহিক শক্তি ক্রমাগত এবং নির্দয়তার সঙ্গে সম্পাদন করা যায়, যা শেষপর্যন্ত নিজের দিকের পাল্লা ভারী করবে। মার্কসবাদের সংঘর্ষে পরাজয়ের কারণ এখানেই।
এ কারণেই বিসমার্কের সমাজ বিরুদ্ধ আইন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, এবং যা ভবিষ্যতেও ব্যর্থ হতে বাধ্য। নতুন কোন সার্বজনীন মতবাদের ভিতই ছিল না যার উন্নতির ও অগ্রসরতার দরুন এ সংঘর্ষকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। বলা যেতে পারে শাসকবৃন্দ বা আইনকানুন বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত শাসনব্যবস্থার ভিত্তিভূমি যার থেকে জীবন মৃত্যুর যুদ্ধের শক্তি আহরণ করা সম্ভব। যা একমাত্র উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী পণ্ডিত মূর্বদের চিৎকারেই প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।
এর প্রধান কারণ হল, এর পেছনে পর্যাপ্ত পরিমাণে ধর্মীয় কারণ ছিল না যার জন্য বিসমার্ক ব্যর্থ হয়েছিলেন তার সামাজিক আইনগুলোর বিচার এবং মেনে নেওয়ার জন্য এমন কোন গোষ্ঠীর কাছে যারা নিজেরাই মার্কসবাদের ফল বিশেষ। এভাবে সেই লৌহ সম্রাট যখন তার নিজের ভাগ্যকে মার্কর্সতত্ত্বের মধ্যবিত্তশ্রেণীর গণতন্ত্রের দিকে চালনা করে, তখন পুরো ব্যাপারটাই একটা হাস্যকর পর্যায়ে এসে দাঁড়ায়। সে বাগানের পরিচর্যার জন্য তার উদ্দেশ্য থেকে সরে আসে। কিন্তু এটা হল সার্বজনীন মতবাদের বিফলতার কারণ যা একদা মানুষকে আকর্ষণ করেছিল এবং যে ভিত্তিভূমি থেকে তাকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। এভাবে বিসমার্কের প্রচার পদ্ধতির ফলাফলটা সত্যই বিলাপের কারণ।
যতই আমি তকালীন সরকারের সোশ্যাল ডেমোক্রাসির প্রতি মনোভাব পবির্তনের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করি, ঠিক যা মার্কসবাদের বিরুদ্ধে সমিতিবদ্ধ হবে, ততই আমি বেশি করে উপলব্ধি করি যে এ মতবাদের বদলে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে কোন মতবাদ থাকা উচিত। যদি সোশ্যাল ডেমোক্রাসিকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়, তবে তার পরিবর্তে জনসাধারণকে কি উপহার দেওয়া হবে? এমন একটা আন্দোলনের অস্তিত্ব বর্তমানে নেই যা বিরাট এ কর্মীদলকে আকর্ষণ করতে পারে। এদের অবস্থা নেতৃত্ব ছাড়া যে
নেতৃত্বের অপেক্ষায় এ কর্মীদল অপেক্ষারত। এটা একটা বোকার মত কল্পনা যে আন্তর্জাতিক গোড়ার দল যারা এতদিন ধরে শ্রেণী সংগ্রামে যুক্ত, অবিলম্বে তারা মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সঙ্গে হাত মিলাবে, অথবা আরো একটা শ্রেণী সংঘ গড়বে। এ সংঘগুলোকে আপাতদৃষ্টিতে যতই অসন্তোষের চোখে দেখা হোক— একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এ মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক নেতারা এ শ্রেণীর পার্থক্যকে সামাজিক জীবনের একটা প্রধান অঙ্গ বলে পরিগণিত হত, যদি এটা রাজনৈতিক দিক থেকে তাদের অসুবিধার সৃষ্টি করত। এ সত্যকে যদি তারা অস্বীকার করে, তবে তারা শুধু অপরিণামদর্শীই নয়, মিথ্যাভাষণেও পটু বটে।
বিশেষভাবে বলতে হয়, সবার বোঝা উচিত যে জনসাধারণকে তারা যতটা বোকা মনে করে, সত্যিকারের তারা ততটা বোকা নয়–এ সত্যটাকে রক্ষা করা। রাজনৈতিক ব্যাপারে এটা প্রায়ই মনে হয়ে থাকে যে অনুভব শক্তি জনসাধারণের বুদ্ধিমত্তার চেয়ে অনেক প্রখর। যদিও মতামতের দিক থেকে বলা হয়ে থাকে যে অনুভূতি শক্তির জন্যই আন্তর্জাতিক ব্যাপারে ওরা এত বোকা–এ যুক্তি খণ্ডানো যায় যদি আমরা এ সত্যটাকে বিবেচনা করি যে শান্তিবাদী গণতন্ত্রও কম দুর্বল নয়। যদিও এরা সমস্ত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের থেকে সমর্থক আহরণ করে থাকে, যতদিন পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ নাগরিক সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির সংবাদপত্র যা বলছে তা গোগ্রাসে গিলবে।
সবারই সতর্কভাবে এ বিপরীত সত্যকে বিচার বিশ্লেষণ করা উচিত। এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে এ শ্রেণী সংগ্রামের সঙ্গে আদর্শের কোন সম্পর্ক নেই, যদিও নির্বাচনের সময়ে এ মাদকতাই ওষুধ হিসেবে কাজ করে। আমাদের এ বিশাল জনতা এ শ্রেণী বিষয়ে ভীষণ জেদী। এটা কাব্যের দিবাস্বপ্ন দেখা নয়, এ হল সত্যিকারের বাস্তব অবস্থা। এ মনোবৃত্তি শুধু আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিমান শ্রেণীর মানসিক ধারার পরিচয়ই বহন করে না। এটাও প্রমাণ করে তারা যে পরিবেশে মার্কস নামক প্লেগটা বেড়ে চলেছে তা অনুধাবন করতেও অক্ষম; কারণ মার্কসতত্ত্ব আমরা যা হারিয়েছি তা পুনরুদ্ধার করতে কখনই সক্ষম হবে না।
মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সংগঠন–এ নামে যারা নিজেদের পরিচিতি দিয়েছে–কখনই নিম্নশ্রেণীর ওপরে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না বা তাদের ধারণাটাকে বদলাতে পারবে না। তার কারণ দুটো পৃথিবী ঠিক বিপরীতভাবে দুই মেরুতে দাঁড়িয়ে। এর একটা অংশ প্রাকৃতিক আর অপর অংশ কৃত্রিম উপায়ে দ্বি-খণ্ডিত। এ দুই পক্ষেরই কিন্তু চিন্তাধারা এক, এবং সেটা হল পরস্পরের সঙ্গে পরস্পরের সংঘর্ষ। কিন্তু এ ধরনের সংঘর্ষে নবীনরাই জয়ী হবে, অর্থাৎ মার্কসবাদ।
১৯১৪ সালে সোশ্যাল ডেমোক্রাসির বিরুদ্ধে সংঘর্ষটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। কিন্তু বাস্তবে কোন পরিবর্তনের জন্য কবে এ সংঘর্ষ শেষ হবে, তা নিয়ে দ্বিধা দেখা দেয়। সে জায়গায় জেগে উঠে একটা শূন্যতা।
যুদ্ধের অনেক আগেই আমার ধারণা ছিল, যে কারণে তঙ্কালীন কোন রাজনৈতিক দলেই যোগ দেইনি। যুদ্ধের সময়ে আমার এ মনোভাব আরও দৃঢ় হয় যে সচরাচর পথে সোশ্যাল ডেমোক্রাসির বিরুদ্ধাচারণ অসম্ভব; কারণ তার জন্য এ রকম একটা দলের প্রয়োজন যা শুধু সংসদীয় দল নয়, তার চেয়ে কিছু বেশি। কিন্তু সেরকম কোন দল তখন ছিল না।
আমার অন্তরঙ্গ সহকর্মীদের সঙ্গে এ ব্যাপারটা নিয়ে আমি প্রায়ই আলোচনায় বসতাম। এবং এ সময়েই আমি স্থির প্রত্যয় হই যে ভবিষ্যত জীবনে আমাকে রাজনীতির আসরে ঢুকতে হবে। আমি মাঝে মাঝেই বন্ধুদের যা প্রতিশ্রুতি দিতাম সেটাই আমাকে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করে যুদ্ধের পরে। অবশ্যই আমার পেশাগত কাজের পাশাপাশি। এবং এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত যে এ পথ আমি অনেক চিন্তা-ভাবনার পরেই বেছে নিয়েছিলাম।