০৭. গরমটা একটু কমে আসতেই

০৭.

গরমটা একটু কমে আসতেই পথচারী স্কুলে একটা চিঠি এল। আন্তঃস্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতার চিঠি, অংশ নিতে হলে এক্ষুনি চিঠি লিখে তাদের জানাতে হবে। কয়েকজনের হাত ঘুরে চিঠিটা শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছালো রুখসানার হাতে। পথচারী স্কুলের কোনো ফুটবল টিম নেই কিন্তু তাই বলে ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে না সেটা তো হতে পারে না! রুখসানা চিঠি লিখে জানিয়ে দিল তার স্কুলের দুর্ধর্ষ ফুটবলের টিম নিয়ে সে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আসছে।

ফুটবল টিমটা কীভাবে তৈরি করবে সেটা নিয়ে কয়েকদিন ভাবনাচিন্তা করে রুখসানা একদিন খেলার মাঠে সব ছাত্রছাত্রীকে দাঁড় করিয়ে বলল, “তোমরা কারা কারা ফুটবল টিমে নাম দিতে চাও?”

স্কুলের সব ছেলেমেয়ে হাত তুলে দাঁড়াল। যাদের উৎসাহ বেশি তারা দুই হাত তুলে লাফাতে লাগল।

রুখসানা উৎসাহী অসংখ্য ছেলেমেয়ের দিকে তাকিয়ে কীভাবে তাদের মাঝে থেকে মাত্র এগারো বারোজন বেছে নেবে ভেবে পায় না। সাতপাঁচ ভেবে মাঠের মাঝখানে একটা বল রেখে বলল, “একজন একজন করে সবাই বলটাকে কিক করো, যারা সবচেয়ে দূরে নিতে পারবে তাদের মাঝে থেকে টিম তৈরি করা হবে। একেকজনের তিনটা করে চান্স!”

দেখা গেল সবচেয়ে দূরে যারা বল কিক করেছে তাদের মাঝে ছয়জন মেয়ে।

কালাম মেয়েদের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হেসে বলল, “মেয়েলোক কি ফুটবল খেলে? ফুটবল হচ্ছে পুরুষলোকের খেলা! খামাখা বলটাকে এত জোরে লাথি মারলে কেন?”

শক্তসমর্থ একটা মেয়ে কালামকে মুখ ভেংচে বলল, “ইচ্ছে হয়েছে মেরেছি! পরেরবার আরও জোরে মারব।”

রুখসানা গলায় হুইসেল ঝুলিয়ে এদিকে এগিয়ে আসছিল, কালাম তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আপা, মেয়েদের সরিয়ে রাখেন না কেন? তারা তো ফুটবল খেলবে না।”

শক্তসমর্থ মেয়েটি জেদি গলায় বলল, “কেন খেলব না?”

কালাম পেটে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে বলল, “শোনো! মেয়ে হয়ে ফুটবল খেলতে চায়! হিঃ হিঃ হিঃ–”

রুখসানা জেদি মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে ঠিক করে ফেলল পথচারী স্কুলের ফুটবল টিম তৈরি হবে ছেলে আর মেয়ে দিয়ে।

খবরটি যখন স্কুলে প্রচারিত হল সবাই চোখ কপালে তুলে ফেলল। ফারুখ বখত বললেন, “ফুটবল টিমে মেয়ে? বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?”

ফরাসত আলি বললেন, “ডানপিঠে সব ছেলেদের মাঝে বাচ্চা বাচ্চা মেয়েরা খেলবে? ব্যথা পেয়ে গেলে?”

মির্জা মাস্টার বললেন, ফুটবল ক্রিকেট এইসব খেলাই তুলে দেয়া উচিত। ঘরে বসে কেরাম খেলতে পারে। না হয় দাবা।

প্রফেসর আলী বললেন, “রুখসানা মেয়েটাই একটা সমস্যা। এই বয়সী মেয়েদের এরকম দায়িত্ব দেয়াই ঠিক না।”

মহসিন বলল, “একটা জিনিস বললেই তো হয় না, খেলার কমিটি মেয়েদেরকে মাঠে নামতে হবে ভেবেছেন? কক্ষনো না!”

রাণুদিদি মুচকি হেসে বললেন, “দেশের মানুষেরা কি রেডি আছে? এটা তো বিপ্লব!”

মার্থা রোজারিও মাথা চাপড়ে বললেন, “তার মানে আমার ওষুধের বাক্স নিয়ে এখন খেলার মাঠে মাঠে যেতে হবে।”

চুনু মিয়া কান চুলকাতে চুলকাতে পিচিক করে থুতু ফেলে বলল, “মাইয়া লোজনের জায়গা হল পাকঘর। এর বাইরে যাওয়া ঠিক না।”

বিকেলবেলা স্কুলে ছুটির পর সব শিক্ষক খানিকক্ষণ একসাথে বসে কথাবার্তা বলেন। সেখানে রুখসানার সাথে সবার দেখা হয়ে গেল। রুখসানা বলল, “শুনেছেন সবাই, ফুটবল টিমটা ছেলে আর মেয়ে নিয়ে তৈরি করে ফেলেছি।”

সবাই মাথা নেড়ে বলল, “শুনেছি।”

“কী মনে হয় আপনাদের?”

ফারুখ বখত কিল দিয়ে বললেন, “গ্রেট আইডিয়া! আমরা সারা দেশকে দেখিয়ে দেব আমাদের মেয়েরা ছেলেদের থেকে এক আঙুল কম না! চমৎকার কাজ করেছ তুমি! কোনো তুলনা নেই। এরকম নতুন নতুন আইডিয়া না হলে কেমন করে হবে? শোনার পর থেকে আমি একেবারে অভিভূত হয়ে আছি! চমৎকার! ফ্যান্টাস্টিক।”

রাণুদিদি বললেন, “মহসিন বলছিল ফুটবল খেলায় মেয়েদের নামানো নাকি আইন নেই–”

মহসিন টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, “আইন না থাকলে আইন তৈরি করে নেব, ফাজলেমি নাকি?”

রুখসানা বলল, “আমি চিঠিটা দেখেছি, কোথাও লেখা নেই ফুটবল টিমে শুধু ছেলেরা খেলতে পারবে মেয়েরা খেলতে পারবে না।”

“ভেরি গুড!” প্রফেসর আলি তাঁর চশমা ঠিক করে বললেন, “দরকার হলে আমরা হাইকোর্টে যাব। সুপ্রিম কোর্টে যাব।”

চুনু মিয়া কান চুলকাতে চুলকাতে পিচিক করে জানালা দিয়ে বাইরে থুতু ফেলে বলল, “দুনিয়ার সত্যিকারের কাজ খালি মেয়েলোকেরাই করতে পারে–পুরুষমানুষ কোনো কামের না!”

ফুটবল টিমের প্রথম সমস্যাটা দেখা গেল প্রথমদিন বিকালবেলা, সবাই মিলে প্র্যাকটিস শুরু করার সাথে সাথে। কালামের নেতৃত্বে টিমের ছেলে খেলোয়াড়রা এসে গম্ভীর গলায় বলল, যে-দলে মেয়েরা আছে তারা সেই দলে খেলতে রাজি নয়। কালাম ফুটবল টিমের শক্ত প্লেয়ার, সে যদি খেলতে রাজি না হয় ফুটবল টিমের শক্তি অর্ধেক কমে যাবে কাজেই ব্যাপারটি গুরুতর কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু রুখসানাকে বিচলিত হতে দেখা গেল না, উদাস গলায় বলল, “কেউ খেলতে না চাইলে তাকে তো আর জোর করে খেলানো যায় না। তোমরা না খেলতে চাইলে নাই।”

কালাম থতমত খেয়ে বলল, “ফুটবল টিমের কি হবে?”

“যে কয়জন আছে সেই কয়জন নিয়েই টিম হবে।”

“কিন্তু আপা, মার খেয়ে ভূত হয়ে যাবে। বাংলা স্কুলের ছেলেরা কীরকম ফাউল করে জানেন?”

রুখসানা মিষ্টি করে হেসে বলল, “মার খেলে খাবে। কিন্তু মার না খেয়ে কখনো কেউ বড় হয় না।”

“আপা আপনি বুঝতে পারছেন না–”

আমার বোঝার কোন দরকার নেই। তোমরা যদি টিমে থাকতে চাও মাঠের এই মাথা ওই মাথায় দুইবার দৌড়ে আস, আর যদি থাকতে না চাও বাড়ি চলে যাও, সময় নষ্ট কর না।

কালাম আবার চেষ্টা করল, “আপা মেয়েছেলেরা কখনো ফুটবল খেলে না।”

“এখন থেকে খেলবে! আর কোনো কথা আমি শুনতে চাই না।”

কালাম এবং তার দলবল বিদ্রোহ ঘোষণা করে মাঠের এক কোণায় বসে বসে চোরাকাটা চিবুতে থাকল, রুখসানা তাদের পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে মেয়েদের নিয়েই প্র্যাকটিস শুরু করে দিল।

সে মেয়েদের মাঠের মাঝে দৌড়ে নিয়ে বেড়াল, নানাভাবে বল কিক করিয়ে অভ্যাস করাল, একজন আরেকজনকে পাস দেয়া শেখাল, হেড করা শেখাল, বল কেটে নেয়া শেখাল, বল থামানো শেখাল, কর্নার কিক করা শেখাল এবং যেই মেয়েটি গোলকিপার হবে তাকে বল ধরা শেখাল। স্কুলের মাঠে মেয়েরা বল নিয়ে ছোটাছুটি করে খেলছে দেখার জন্যে কিছুক্ষণের মাঝেই চারপাশে ছোটখাটো একটা ভিড় জমে গেল।

কালাম এবং তার দলবল কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝে গিয়েছিল রুখসানা দরকার হলে সত্যি সত্যি শুধু মেয়েদের নিয়েই খেলবে–এরকম মানুষের সাথে জেদ করে খুব লাভ নেই। তা ছাড়া মেয়েগুলিকে দেখে বোঝা যাচ্ছে তারা জানপ্রাণ দিয়ে খেলবে। মেয়েদের নিয়ে টিম হলেও টিমটা খুব খারাপ হবে না। খেলায় হেরে গেলে সব-সময় মেয়েদের দোষ দিতে পারবে, কোনোভাবে জিতে গেলে তো কথাই নেই, সব-সময় বলতে পারবে মেয়েদের নিয়েই হারিয়ে দিলাম, ছেলের টিম হলে তো কথাই ছিল না। কাজেই প্র্যাকটিসের শেষের দিকে একজন একজন করে কালাম এবং তার দলবল মাঠে নেমে এল।

খেলার প্রস্তুতি হিসেবে সবার জন্যে উজ্জ্বল রঙের জার্সি তৈরি করা হল। ছেলেদের জন্যে শার্ট, মেয়েদের জন্যে ফ্রক, সামনে বড় বড় করে লেখা পথচারী স্কুল, পিছনে খেলোয়াড়দের নম্বর।

পথচারী স্কুলের প্রথম খেলাটিই পড়ল সরকারি স্কুলের সাথে। সরকারি স্কুলের ফুটবল টিম অত্যন্ত শক্তিশালী টিম, বড় বড় অফিসারের দুধ মাখন গোশত ফলমূল খাওয়া ছেলেরা সেই স্কুলে পড়ে। তারা পড়াশোনাতে যেরকম ভালো খেলাধুলাতেও সেরকম ভালো। তাদের চেহারা ছবি কথাবার্তা আচার-আচরণও ভালো, কালাম বুঝতে পারল খেলায় জেতার সেটাই হচ্ছে একমাত্র উপায়। যেহেতু, ছেলেগুলি ভদ্রগোছের প্রথমেই কড়া কড়া কয়েকটা ফাউল করে তাদের ভয় দেখিয়ে দিতে হবে। ফাউল কীভাবে করতে হয় তার দলের ছেলেরা খুব ভালো করে জানে। মেয়েদের নিয়েই হচ্ছে মুশকিল–সেটার উপর রুখসানা কোনোরকম ট্রেনিং দেয়নি। শুধু যে ফাউল করা শেখায়নি তা-ই নয়, ফাউল না করার উপর দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে বসেছে।

রুখসানা মেয়েদের যে-ক্ষতি করেছে কালাম সেটা পুনরুদ্ধার করার জন্যে একদিন বিকালে তাদের জ্ঞান দেয়ার চেষ্টা করল। দলের মেয়েদের ডেকে বলল, “আপা তোমাদের যেসব কথা বলেছে সেসব এখন ভুলে যাও। খেলায় যদি জিততে চাও আমার কথা শোনো।”

তেজি ধরনের মেয়েটা বলল, “কী কথা?”

“খেলায় জেতার জন্যে প্রথমে যে-জিনিসটা শিখতে হয় সেটা হচ্ছে ল্যাং।”

“ল্যাং?”

“হ্যাঁ, খেলা চলার পর যখনই দেখবে একজন খুব ভালো খেলছে তাকে ল্যাং মেরে ফেলে দেবে।”

তেজি ধরনের মেয়েটা ভুরু কুঁচকে বলল, “ল্যাং মেরে ফেলে দেব?”

“হ্যাঁ। ব্যাপারটা মোটেও কঠিন না। মনে আছে আমি একদিন চুনু মিয়াকে ল্যাং মেরে ফেলেছিলাম?” কালাম নিজের গৌরবময় অতীতের কথা চিন্তা করে আনন্দে একগাল হেসে ফেলল।

তেজি ধরনের মেয়েটা বলল, “আমরা কখনো ল্যাং মারব না।”

“মারতেই হবে!” কালাম হাতে কিল দিয়ে বলল, “যদি দেখা যায় খেলায় গোলমাল হচ্ছে তখন সবচেয়ে ভালো প্লেয়ারটাকে আউট করে দিতে হয়! এমনভাবে ল্যাং মারতে হয় যেন পা ভেঙে বসে যায়। বসাতেই হবে।”

মেয়েরা মাথা নাড়ল, “কক্ষনো না।”

কালাম অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল, “ঠিক আছে আমার উপরে ছেড়ে দাও, আমি ল্যাং মেরে বসিয়ে দেব।”

যেদিন ফুটবল খেলা সেদিন রুখসানা তার ফুটবল টিম নিয়ে মাঠে হাজির হয়েছে। বাচ্চাগুলিকে আজকে চেনা যায় না, উজ্জ্বল লাল এবং সাদা রঙের জার্সিতে আজকে তাদেরকে আর আলাদা করে গরিব বাচ্চা বলে বোঝা যায় না। কালামকে পর্যন্ত দেখতে মনে হচ্ছে একটি সভ্যভব্য ছেলে, মেয়েদের কথা তো ছেড়েই দেয়া যাক। ফুটফুটে চেহারায় একেকটা মেয়েকে মনে হচ্ছে বুঝি ফুলপরী।

সরকারি স্কুলের ফুটবল টিমের কোচ পথচারী স্কুলের টিম দেখে হতবাক হয়ে গেলেন। তোতলাতে তোতলাতে বললেন, “এই মে-মে-মে-মেয়েরা খেলবে?”

রুখসানা মিষ্টি করে হেসে বলল, “হ্যাঁ।”

“এরা খে-খে-খে-খেলতে পারে?” রুখসানা আরও মিষ্টি করে হেসে বলল, “পারে।”

সরকারি স্কুলের ফুটবলের শিক্ষক এতক্ষণে নিজকে সামলে নিয়েছেন, চোখমুখ লাল করে বললেন, “এটা কোন ধরনের ফাজলেমি?”

“কেন, কী হয়েছে?”

“আমি আপনাদের স্কুলের খেলার টিচারের সাথে কথা বলতে চাই।”

রুখসানা তখনও চেষ্টা করে মুখে হাসি ধরে রেখে বলল, “আমিই খেলার টিচার।”

“আপনি? আপনি একজন মেয়েমানুষ।”

এবারে রুখসানার মুখ থেকে হাসি খানিকটা মুছে গেল, বলল, “তাতে কোনো সমস্যা আছে?”

“অবশ্যই আছে।” মানুষটি এবারে রেগেমেগে বলল, “মেয়েমানুষের জায়গা মাঠে-ঘাটে-ফুটবল ফিল্ডে না। মেয়েমানুষের জায়গা পাকঘরে। মেয়েমানুষ স্বামীর খেদমত করবে আর ঘর-সংসার করবে।”

রুখসানার মুখে যেটুকু হাসি ছিল এবারে সেটাও মুছে গেল। শক্তমুখ করে বলল, “যদি মেয়েরা অন্য কিছু করে তা হলে কী হয়?”

“কী হয় তো দেখতেই পাচ্ছেন–” লোকটা চিৎকার করে কথা বলার সময় খানিকটা থুতু বের হয়ে এল, সেই অবস্থাতেই বলল, “তা হলে মেয়েরা গোল্লায় যায়! আর তার দেখাদেখি আর অন্য দশটা মেয়ের মাথা খাওয়া হয়–আপনি যে রকম খাচ্ছেন!”

রুখসানার মুখ হঠাৎ একেবারে পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেল, কিন্তু সে গলা খুব ঠাণ্ডা রেখে বলল, “এবারে আমার কী মনে হয় শুনবেন?”

লোকটি থতমত খেয়ে বলল, কী মনে হয়?”

“যে-মানুষের বুদ্ধিশুদ্ধি চিন্তাভাবনা আপনার মতো তার জায়গা হচ্ছে নর্দমা!” লোকটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “কী বললেন?”

“আমার কথা বিশ্বাস হল না? এই দেখেন–” বলে কিছু বোঝার আগে রুখসানা এগিয়ে এসে মানুষটাকে ধরে কীভাবে কীভাবে জানি শূন্যে ছুঁড়ে দিল এবং সবাই অবাক হয়ে দেখল মানুষটা শূন্যে উড়ে গিয়ে কাছাকাছি একটা নর্দমাতে গিয়ে পড়ল। নর্দমার ময়লা কাদা ছিটকে এসে লোকটার চোখেমুখে লেগে তাকে দেখাতে থাকে একটি ভয়ের সিনেমার ভূতের মতো। লোকটার খানিকক্ষণ লাগল বুঝতে কী হয়েছে, যখন বুঝতে পারল তখন হাঁসফাঁস করে নর্দমা থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করতে থাকে। রুখসানা কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে আবার মিষ্টি করে হেসে বলল, “মেয়েদের নিয়ে আবার যদি আজেবাজে কথা বলেন তা হলে পরের বার আপনাকে স্ট্রেচারে করে নিতে হবে।”

কালাম কাছেই দাঁড়িয়েছিল, তার মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। মাথা নেড়ে বলল, “আমাদের আপার সাথে তেড়িবেড়ি করা ঠিক না। বন্দুক পিস্তল যেরকম লাইসেন্স করতে হয় আপার দুইটা হাতও সেইরকম লাইসেন্স করা আছে।”

সরকারি স্কুলের ফুটবল শিক্ষকের সাথে রুখসানার ছোট ঘটনার খবরটা খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ে এবং তার ফল হয় ম্যাজিকের মতো। খেলার কর্মকর্তা যারা ছিল সবাই ভান করতে থাকে ফুটবল টিমে মেয়েদের নিয়ে খেলতে আসা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কিছুক্ষণেই মাঠে খেলোয়াড়রা নেমে যায় এবং মাঠের চারপাশে ভিড় জমে ওঠে। পথচারী স্কুলের ছাত্রছাত্রী শিক্ষকেরাও খেলা দেখতে এসেছে–সবাই মাঠের এক পাশে বসেছে। মার্থা রোজারিও তাঁর ওষুধপত্রের বাক্স নিয়ে এসেছেন, চুনু মিয়ার হাতে পানির বোতল এবং লেবুর টুকরা।

খেলা শুরু হল এবং মাঠের চারপাশের মানুষেরা অবাক হয়ে দেখল আট নয় বছরের ফুটফুটে মেয়েরা কী চমৎকার সাবলীলভাবে পায়ে বল নিয়ে ছুটে যাচ্ছে এবং গোলপোস্টের কাছে গিয়ে লম্বা কিক দিয়ে গোল করার চেষ্টা করছে। তাদের দলের ছেলেদের থেকে তারা এতটুকু খারাপ খেলছে না। শক্তসমর্থ তেজি মেয়ে, ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়েও তারা পড়ে থাকছে না, স্প্রিংয়ের পুতুলের মতো আবার লাফিয়ে উঠছে।

খেলা খুব জমে উঠল। সরকারি স্কুলের ছেলেরা অনেকদিন থেকে ফুটবল খেলছে, তার তুলনায় পথচারী স্কুল নতুন। কিন্তু পথচারী স্কুলের ছেলেমেয়েদের উৎসাহ অনেক বেশি, তারা মরণপণ করে খেলছে। তাদের উৎসাহ দিচ্ছে স্কুলের সব কয়জন শিক্ষক–সব কয়জন ছাত্রছাত্রী! মির্জা মাস্টার তার বিশাল শরীর নিয়ে চিৎকার করছেন এবং মাঠের বেশিরভাগ মানুষ খেলা না দেখে তাকে চিৎকার করছে দেখছে। বল যখন পথচারী স্কুলের ছেলেমেয়েদের পা থেকে সরকারি স্কুলের ছেলেদের পায়ে চলে যায় তখন মির্জা মাস্টার ধপ করে একটা চেয়ারে বসে গিয়ে মুখ হাঁ করে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে থাকেন–তখন চিৎকার শুরু করে সরকারি স্কুলের ছেলেরা। প্রথম গোলটি হল দশ মিনিটের মাথায়। সরকারি স্কুলের সেন্টার ফরোয়ার্ডের পা থেকে বল কেড়ে নিল কালাম, পাস করে দিল তেজি মেয়েটিকে, সে মাঠের একপ্রান্ত থেকে একেবারে অন্যপ্রান্তে বল নিয়ে ছুটে গেল, হাফব্যাককে পাশ কাটিয়ে গোলপোস্টের কাছাকাছি এসে একটা টানা কিক। বলটা সোজা গোলপোস্টে ঢুকে গেল এবং সাথে সাথে মাঠের অসংখ্য মানুষ চিৎকার করে ওঠে–’ গো-ও-ও-ও-ও ল’! মির্জা মাস্টার তাঁর বিশাল দেহ নিয়ে থপথপ করে খানিকক্ষণ দৌড়ে বেড়ালেন এবং তাঁর সাথে যোগ দিল আরও অনেক বাচ্চা-কাচ্চা।

আবার খেলা শুরু হল। সরকারি স্কুল এবার আরও চেপে খেলছে। মেয়েদের নিয়ে তৈরি একটা দলের কাছে হেরে যাবে সেটা মেনে নেয়া খুব সোজা নয়। যারা খেলছে তারা হয়তো মেনে নিতে পারে কিন্তু নর্দমা থেকে উঠে আসা তাদের খেলার টিচার সেটা কিছুতেই মেনে নেবে না। মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে সে তার ছেলেদের উদ্দেশে গর্জন করে যাচ্ছে।

খেলার দ্বিতীয় গোলটি দিল কালাম, গোলপোস্টের কাছে মাঠের প্রায় সব খেলোয়াড় বল নিয়ে হুটোপুটি করছিল, তার মাঝে সে হেড করে গোলপোস্টে বল ঢুকিয়ে দিল। উপস্থিত দর্শকদের চিৎকারে মনে হল আশেপাশে বাড়িঘরের জানালার কাঁচ ভেঙে পড়বে।

পথচারী স্কুলের উৎসাহ এবারে খুব বেড়েছে। হাফ টাইমের আগেই তারা দুই দুইটি গোল দিয়ে দিয়েছে, এভাবে খেলে গেলে জিতে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। কালাম তখন বিজয়টি নিশ্চিত করার জন্য সরকারি স্কুলের ভালো একজন সেন্টার ফরোয়ার্ডকে মাঠের মাঝামাঝি ছুটন্ত অবস্থায় পা বাঁধিয়ে ফেলে দিল। ছেলেটি পা-বেঁধে মাঠে ছিটকে পড়ে ব্যথায় চিৎকার করতে থাকে, তাকে ধরাধরি করে মাঠ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। রেফারি কালামকেও লাল কার্ড দেখিয়ে খেলা থেকে বের করে দিল, পরিষ্কার ফাউল, কারও কোনো দ্বিমত নেই।

ব্যথা পাওয়া ছেলেটার জায়গায় এবারে আরেকজন খেলতে আসে, পথচারী স্কুলকে একজন কম নিয়েই খেলতে হবে। খেলা শুরু হওয়ার পর দেখা গেল হঠাৎ করে পথচারী স্কুল আরও ভালো খেলতে পারছে না। দলে একজন কম নিয়ে খেলা খুব সোজা ব্যাপার নয়। বল শুধু তাদের দিকে চেপে আসতে লাগল, তার মাঝে ছয়টি মেয়ে আর চারটি ছেলে কোনোভাবে বলটাকে আটকে রাখতে চেষ্টা করছে। কতক্ষণ আটকে রাখতে পারত কে জানে, কিন্তু তার মাঝে হাফ টাইম হয়ে গেল।

রুখসানা তার স্কুলের ছেলেমেয়েদের নিয়ে মাঠের একপাশে চলে এল, চুন্ন মিয়া সেখানে তার পানির বোতল আর লেবুর টুকরা নিয়ে এসেছে। মার্থা রোজারিও তাঁর ওষুধের বাক্স নিয়ে এসেছেন। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা মুখ হাঁ করে বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ছোটাছুটি করে তাদের মুখ লাল হয়ে আছে। ছেলেমেয়েরা মাঠে পা ছড়িয়ে বসেছে, মার্থা রোজারিও যার যেখানে কেটে ছড়ে গেছে তুলো দিয়ে ঘসে অ্যান্টিসেপটিক লাগাচ্ছেন। রুখসানা সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “খেলায় শেষ পর্যন্ত যাই হোক না কেন, আমার কাছে তোমরা জিতে গেছ। খুব সুন্দর খেলছে সবাই। তোমরা সবাই হচ্ছ বাঘের বাচ্চা!”

তেজি ধরনের মেয়েটা বলল, “একজন ছাড়া!”

“কে?”

“কালাম। সে হচ্ছে শেয়াল।”

সবাই ঘুরে কালামের দিকে তাকাল। কালাম ঠোঁট উলটে বলল, “একট ছোট ফাউল করেছি আর রেফারি–”

রুখসানা বাধা দিয়ে বলল, “বাজে কথা বোলোলা না। তুমি যদি ফাউলটা না করতে আজকে আমরা চোখ বুজে জিতে যেতাম। এখন এদের জান দিয়ে খেলতে হবে।”

কালাম মাথা চুলকে বলল, “আমাকে তো এমনিতেই বের করে দিয়েছে। একটা ঢেলা ছুড়ব নাকি সরকারি স্কুলের টিমে? মাথায় ঠিক করে লাগাতে পারলে—”

রুখসানা শীতল চোখে কালামের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি আর একটা কথা বলেছ কি ঐ গাছটাতে বেঁধে রাখব। আমার কথা বিশ্বাস না হলে একটা কথা বলে দ্যাখো–”

কালাম ভয়ে ভয়ে একবার রুখসানার মুখের দিকে তাকাল, তারপর মুখ বন্ধ করে ফেলল, এতদিনে সে জেনে গেছে রুখসানা একটি বাজে কথাও বলে না!

পথচারী দলের ছেলেমেয়েরা মুখে পানির ঝাঁপটা দিয়ে লেবুর টুকরা মুখে দিয়ে একটু চুষতে-না-চুষতেই হুইসেল বেজে গেল। আবার খেলা শুরু।

পরের অংশটুকু হল একটা অত্যন্ত কঠিন খেলা। সরকারি স্কুলের দল বারবার বল নিয়ে এগিয়ে এল আর বারবার তাদের আটকে দেয়া হল। শক্ত রক্ষাব্যুহ তৈরি করে দাঁড়িয়ে রইল বাচ্চা বাচ্চা কয়েকটা ছেলেমেয়ে। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে তারা বড় হয়, বাসায় কাজ করে, পাতা কুড়িয়ে ঘরে আনে। মানুষের সম্মান ভালোবাসা কখনো পায়নি। আজকে হঠাৎ একমাঠ ভরা মানুষ তাদের পক্ষ হয়ে চিৎকার করছে কেমন করে তার অসম্মান করে?

অনেক চেষ্টা করেও তারা আটকে রাখতে পারল না, একটি গোল হয়ে গেল। সরকারি স্কুলের সেন্টার ফরোয়ার্ড বলটি দিল রাইট আউটকে, রাইট আউট হাফ ব্যাককে পাশ কাটিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। গোলকিপার পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বল ধরার চেষ্টা করল কিন্তু লাভ হল না, ততক্ষণে বল গোলপোস্টে ঢুকে গেছে। সরকারি স্কুলের ছেলেরা আনন্দে চিৎকার করতে থাকে।

রুখসানা হাত তুলে সান্ত্বনা দেয়, এখনও তারা একগোলে এগিয়ে আছে, কোনোমতে আর কিছুক্ষণ আটকে রাখতে পারলে তারা জিতে যাবে।

আবার খেলা শুরু হল, সময় আর কাটতে চায় না। পথচারী স্কুলের ছেলেমেয়েরা সমস্ত শক্তি নিয়ে রুখে দাঁড়াল পাহাড়ের মতো দুর্ভেদ্য একটা রক্ষাব্যুহ তৈরি করল গোলপোস্টের সামনে। সরকারি স্কুল বল নিয়ে এগিয়ে এল বারবার, কিন্তু কিছুতেই ব্যুহ ভেদ করে যেতে পারল না। পাথরের দেয়ালে আঘাত করে মানুষ যেভাবে ফিরে আসে ঠিক সেভাবে ফিরে এল সরকারি স্কুলের দল। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যেতে থাকে, রুখসানা নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকে–আর কয়েক মিনিট, তাহলে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়ে যাবে।

খেলাশেষের হুইসেল বাজামাত্রই সমস্ত মাঠের মানুষ আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। বিশাল দেহ নিয়ে মির্জা মাস্টার নাচতে নাচতে ছুটে এলেন মাঠে, তার পিছু-পিছু প্রফেসর আলি, ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি। মার্থা রোজারিও আর রাণুদিদি নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে লাগলেন। চুনু মিয়া আর মহসিন পানির বোতল নিয়ে ছুটে গেল মাঠে, বাচ্চাদের ঘাড়ে তুলে নিল আনন্দে!

আনন্দটি অবিশ্যি খুবই ক্ষণস্থায়ী ছিল, কারণ মির্জা মাস্টার নাচতে নাচতে মাঠের মাঝখানে ছুটে এসে হঠাৎ নিঃশ্বাস আটকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। তাঁকে হাসপাতালে নিতে হল সেখান থেকে। অ্যাম্বুলেন্স এসেছিল বেশ তাড়াতাড়ি, কিন্তু স্ট্রেচার করে তাঁকে তুলতে গিয়ে যোলোজন মুশকো জোয়ানের একেবারে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল।

.

প্রথমে খেলাটি জেতার পর সবাই ভেবেছিল পথচারী স্কুল বুঝি ফাঁইনাল সেমি ফাঁইনালে উঠে যাবে, গল্প উপন্যাসে সাধারণত সেরকমই হয়। কিন্তু এটা গল্প উপন্যাস নয়, তা-ই দেখা গেল পথচারী স্কুল খুব বেশি দূর এগুতে পারল না। প্রথম খেলার পর সবাই ভেবেছিল অন্তত কালামের বুঝি একটা শিক্ষা হবে, পরের বার উলটোপালটা কিছু করবে না, কিন্তু তার কোনো শিক্ষাই হল না। পরের খেলাতেও খেলার মাঝখানে একজনের পায়ের সাথে পা বাঁধিয়ে তাকে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করল। যখন খুববেশি সুবিধে করতে পারল না তখন হঠাৎ তাকে জাপটে ধরে নাকের মাঝে একটা ঘুষি–একেবারে রক্তারক্তি অবস্থা! মনে হয় খেলাধুলার ব্যাপারটা সে এখনও বুঝে উঠতে পারেনি।

রুখসানা অবিশ্যি হাল ছেড়ে দেয়নি। সে এবারে ক্রিকেট খেলার একটা টিম তৈরি করছে। ছেলে এবং মেয়েদের নিয়ে।

.

পরিশিষ্ট

পথচারী স্কুলের এই গল্প আমি শুনেছি ফরাসত আলির কাছে (যখন তিনি আমাকে এই গল্প বলেছেন তখন ছিল শীতকাল, তার মুখে ছিল দাড়িগোঁফের জঙ্গল)। আমি প্রথম ভেবেছিলাম তিনি বুঝি বানিয়ে বানিয়ে বলছেন (আমি নিজে বানিয়ে বানিয়ে অনেক গল্প করি তাই সব-সময় সন্দেহ হয় অন্যেরাও বুঝি তাই করছে) কিন্তু দেখা গেল আসলে একটি অক্ষরও বানিয়ে বলেননি। শুধু তাই নয়, তাঁর পকেটে স্কুলের সবার ছবি ছিল। স্কুলঘর, শিক্ষক, শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্রী–সবার। কালামের একটা আলাদা ছবি ছিল, ঠিক ছবি তোলার সময় দুষ্টামি করে একটা লাফ দিয়েছে বলে ছবিটা ঝাঁপসা এসেছে, চেহারাটা বোঝা যায় না। মির্জা মাস্টারেরও একটা ছবি ছিল, একটাতে আঁটেনি বলে দুবারে তুলতে হয়েছে।

।ফরাসত আলি পথচারী স্কুলের আরও অনেক গল্প করেছেন, বিজ্ঞান পরীক্ষা নিয়ে সমস্যার গল্প, চুনু মিয়ার ভূতের ভয় পাওয়ার গল্প, হারুন ইঞ্জিনিয়ারের পানির ট্যাংকের গল্প, মহসিনের কম্পিউটারের পাগলামির গল্প আরও কত কী! সবগুলি এখানে লেখা হল না, তা হলে একটা বিশাল উপন্যাস হয়ে যাবে, আজকাল মানুষের বিশাল উপন্যাস পড়ার সময় কোথায়? তা ছাড়া মনে হয় তার সবগুলি মানুষ বিশ্বাসও করবে না, মনে করবে আমি বুঝি বানিয়ে বানিয়ে বলছি।

ফরাসত আলি যাবার আগে আমাকে তার স্কুলে নেমন্তন্ন করে গেছেন। ভাবছি একবার স্বচক্ষে সবাইকে দেখে আসি।

এরকম একটা স্কুল নিজের চোখে না দেখলে কেমন করে হয়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *