০৬. অনেকদিন পার হয়ে গেছে

০৬.

এর মাঝে বেশ অনেকদিন পার হয়ে গেছে। প্রথমদিকে যেরকম সবার ধারণা ছিল ছোট ছোট বাচ্চারা হবে জ্ঞানপিপাসু এবং তারা দিনরাত পড়াশোনা করে কয়েকদিনের মাঝেই সবাই একেকজন ছোটখাটো আইনস্টাইন হয়ে বের হয়ে আসবে দেখা গেল সেটা সত্যি নয়। রাস্তাঘাটে ঘোরাঘুরি করে বড় হওয়া বাচ্চা ছেলেমেয়েদের জীবন সম্পর্কে ধারণা সম্পূর্ণ অন্যরকম। তারা সবাই জানে এই স্কুলের পুরো ব্যাপারটা বড়লোক কয়েকজন মাথা-খারাপ মানুষের খেয়াল। কয়েকদিন পরে তাদের এই খেয়াল ছুটে যাবে এবং তারা তখন আবার আগের মতো রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াবে। কাজেই পথচারী স্কুলের ছোট ছোট ছাত্রছাত্রী এটাকে একটা খেলা হিসেবে নিয়ে সময় কাটাতে আসছে। তবে রীতিমতো আসার জন্যেই হোক বা শিক্ষকদের উৎসাহের জন্যেই হোক বাচ্চা ছেলেমেয়েদের প্রায় সবাই মোটামুটি পড়তে শিখে গেছে। কেউ-কেউ ছোটখাটো ইংরেজি পড়তে পারে, কখনো কখনো বলতেও পারে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল এই বিদ্যাটি ঠিক কী কাজে লাগবে সে-সম্পর্কে তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।

কাজেই পথচারী স্কুলে যারা পড়ান তারা সবসময় সবাইকে পড়াশোনার গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অনেক চেষ্টাচরিত্র করে মোটামুটি সব বাচ্চাকেই পড়াশোনার গুরুত্ব খানিকটা বোঝানো গেছে–কয়েকজন ছাড়া। তাদের মাঝে যে এক নম্বর তার নাম কাউলা। কাউলা যে কারও নাম হতে পারে সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবার কথা না। তবে তাকে দেখে কেউ যদি তার নাম অনুমান করার চেষ্টা করে সম্ভবত কাউলা নামটিই অনুমান করবে, কারণ এই ছেলেটির গায়ের রং কুচকুচে কালো।

রাণুদিদি প্রথম দিনেই কাউকে কাউলা নামে ডাকতে অস্বীকার করলেন। ভুরু কুঁচকে বললেন, “একটি বিশেষণ কার নাম হতে পারে না।”

কাউলা মাথা চুলকে রাণুদিদির দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল রাণুদিদি তাকে বকাবকি করছেন কি না এবং যদি বকাবকি করে থাকেন তা হলে তার কারণটা কী। পরিষ্কার কিছু বুঝতে না পেরে সে দুর্বলভাবে বলল, “কিন্তু আমারে সবাই ডাকে কাউলা।”

“ডাকুক। তাতে কিছু আসে যায় না। কে তোমার এই নাম দিয়েছে? তোমার বাবা?”

“আমার বাবা নাই।”

“তা হলে মা?”

“আমার মাও নাই।”

“তা হলে তোমার এই নামের কোনো যৌক্তিকতা নেই। তোমাকে আমি নতুন নাম দেব। বলল, তোমাকে কী নামে ডাকব?”

ক্লাসে ফাজিল ধরনের একজন বলল, “ময়লা।”

নামটি সত্যি হতে পারত, তাই পুরো ক্লাস হো হো করে হেসে ওঠে। কাউলা ঘুষি পাকিয়ে ফাজিল ছেলেটিকে একবার হুমকি দিয়ে রাণুদিদির দিকে তাকাল। রাণুদিদি হাসি গোপন করে বললেন, “না, ময়লাও কারও নাম হতে পারে না। তার কারণ দুটো। এক : এটাও বিশেষণ। দুই : কোনোদিন যদি সে সাবান দিয়ে স্নান করে ফেলে তা হলে কী হবে?”

কাউলার নামটি কী হতে পারে সেটি নিয়ে খানিকক্ষণ গবেষণা হল এবং তার নতুন নামকরণ করা হল কালাম, আগের নামের কাছাকাছি যেন অভ্যস্ত হতে বেশি সময় না নেয়।

কালাম অত্যন্ত চালাক-চতুর ছেলে। তার সত্যিকারের বয়স কেউ জানে না, দেখে মনে হয় আট থেকে দশের মাঝে হবে। এই বয়সের একটা ছেলে যে এত চালু হতে পারে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতে চায় না। সে যে-কোনো চলন্ত বাসে উঠে বিনা ভাড়ায় যে-কোনো জায়গায় চলে যেতে পারে, ট্রেনের ছাদে বসে সারা দেশ ঘুরে আসতে পারে। চলন্ত লঞ্চ কিংবা স্টিমার থেকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে তীরে চলে আসতে পারে। মাথায় বোঝা নিয়ে দোকানে দোকানে ঘুরে বেড়াতে পারে, পাইকারি দোকান থেকে এককাঁদি কলা কিনে তিনগুণ দামে বিক্রি করে ফেলতে পারে। প্রয়োজন হলে সে হাত বাঁকা করে নুলো শিশুর ভঙ্গি করে নাকি সুরে ভিক্ষা করে কিছু অর্থোপার্জন করে ফেলতে পারে। তার মতো মারপিট বা গালিগালাজ এই এলাকায় কেউ করতে পারে না এবং শুধুমাত্র এই কারণেই এই এলাকার যাবতীয় বাচ্চারা তাকে নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছে। এতরকম গুণ থাকার পরও পড়াশোনা নামক অত্যন্ত সহজ বিষয়টিতে সে কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারে না। কাগজে অর্থহীন আঁকিবুকি করে কেন সেটা দেখে সবাই অর্থহীন শব্দ করে সেটাকে পড়াশোনা নাম দিয়েছে সে এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। পুরো ব্যাপারটা তার কাছে একধরনের কৌতুক ছাড়া আর কিছু না!

প্রতিদিন সকালে কালামকে নিয়ে একধরনের ধস্তাধস্তি হয়। মির্জা মাস্টার বলেন, “কালাম, তুমি বলো। পড়াশোনা কেন করতে হয়?”

কালাম মাথা চুলকে বলে, “স্যার ভুলে গেছি।”

মির্জা মাস্টার হুংকার দিয়ে বলেন, “ভুলে গেছি মানে? এক্ষুনি বলো।”

কালাম মুখ কাঁচুমাচু করে বলে, “পড়াশোনা করলে মনে হয় চোখে কম দেখে। তখন চশমা পরতে হয়। আর চোখে চশমা থাকলে সবাই সালাম দেয়।”

মির্জা মাস্টার তখন হাল ছেড়ে দিয়ে ব্লকবোর্ডে একটা বড় ‘অ’ লিখে বলেন, “এইটা কী?”

কালাম খানিকক্ষণ মাথা চুলকে বলে, “দেখে নৌকার মতো মনে হয় স্যার। কিন্তু ছবিটা ভালো হয় নাই। একটা পাল দেয়া দরকার ছিল।”

মির্জা মাস্টার তখন হুংকার দিয়ে বলেন, “এইটা নৌকা না, এইটা ‘অ’।

কালাম তখন তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বলে, “মনে পড়েছে স্যার। এটাই। অ। অ অ অ।”

পরের দিন দেখা যায় আবার সে ভুলে গেছে।

স্কুলের পড়াশোনার অংশটা কালামের একেবারেই ভালো লাগে না, তবু সে মোটামুটি নিয়মিত আসে, কারণ পড়াশোনা ছাড়াও সেখানে আরও নানারকম দুষ্টুমি করা যায়। সে একেকদিন একেকজনের পিছনে লাগে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের শেষ করে সে এখন বড়দের ধরেছে। গত কয়েকদিন সে যার পেছনে সময় ব্যয় করছে সে হচ্ছে চুনু মিয়া। চুনু মিয়া প্রত্যেকদিন দুপুরবেলা বাচ্চাদের খাবারের জন্যে একঝাঁকা রুটি এবং এক গামলা শবজি নিয়ে আসে। সেদিন কালামের কী মনে হল কে জানে হঠাৎ করে চুনু মিয়ার পায়ের মাঝে নিজের পা ঢুকিয়ে দিল। সাথে সাথে তাল হারিয়ে চুনু মিয়া আছাড় খেয়ে পড়ল, তার শবজি উঠে গেল আকাশে এবং নিচে নেমে আসার সময় সেগুলো এসে পড়ল তার শরীরে। তাকে দেখাতে লাগল বিশাল আধ-খাওয়া একটা শিঙাড়ার মত।

চুনু মিয়া মেঝে থেকে কোনোমতে উঠে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে কালামকে ধরার চেষ্টা করল। তাকে ধরতে পারলে কী হত কেউ জানে না, কিন্তু তাকে ধরা গেল না। কিছুক্ষণের মাঝেই খবর পৌঁছে গেল ক্লাস টিচার মির্জা মাস্টারের কাছে এবং মির্জা মাস্টার কালামকে ডেকে পাঠালেন। মেঘস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “কালাম তুমি চুনু মিয়াকে ল্যাং মেরেছ?”

কালাম মাথা চুলকে বলল, “জি স্যার মেরেছি।”

“কেন মেরেছ?”

“কেমন জানি লোভ হল স্যার। কারও ঠ্যাং দেখলেই আমার ল্যাং মারার ইচ্ছে করে। পায়ের মাঝে কুটকুট করতে থাকে স্যার।”

“পায়ের মাঝে কুটকুট করে?” মির্জা মাস্টার হুংকার দেওয়ার চেষ্টা করলেন কিন্তু বেশি অবাক হয়েছিলেন বলে হুংকারে জোর হল না। বললেন, “খবরদার

আর যদি পা কুটকুট করে ভালো হবে না কিন্তু। আর ল্যাং মারবে?”

কালাম মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। মির্জা মাস্টার আবার জিজ্ঞেস করলেন, “মারবে?”

“জানি না স্যার। হঠাৎ করে লোভ লেগে যায়, তখন স্যার”

“খবরদার তুমি আর চুনু মিয়ার ধারে কাছে আসবে না। চুনু মিয়াকে তুমি আর ছুঁতে পারবে না।”

কালাম একগাল হেসে বলল, “ঠিক আছে স্যার, আমি আর চুন্ন চাচাকে ছোঁব!”

কাজেই কালাম পরের দিন অসতর্ক চুনু মিয়ার পায়ের সামনে একটা কলার ছিলকে ফেলে দিয়ে তাকে আছড়ে ফেলে দিল, আগের দিন থেকে অনেক

জোরে। চুন্নু মিয়া যখন তার মুণ্ডু ছিঁড়ে ফেলার জন্যে তাকে স্কুলের করিডোরে ধাওয়া করতে লাগল, কালাম তারস্বরে চিৎকার করে বলতে লাগল, “ছুঁই নাই, আমি ছুঁই নাই। খোদার কসম ছুঁই নাই!–”

যে-বিষয়টিতে কাউলার অল্পকিছু উৎসাহ দেখা গেল সেটি হচ্ছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের সূত্রে তার সেরকম উৎসাহ নেই–তার উৎসাহ শুধুমাত্র ধ্বংসাত্মক দিকটিতে। রাণুদিদিকে সে যেসব প্রশ্ন করল সেগুলি এরকম:

বোমা বানানো কি খুব কঠিন?
ইলেকট্রিক শক দেওয়ার কোনো যন্ত্র কি আবিষ্কার হয়েছে?
ছাদের উপর থেকে নিচে কারও মাথায় ঢেলা ফেললে কী হয়?
চিমটি দিলে ব্যথা লাগে কেন?
অদৃশ্য হয়ে যাবার কোনো ওষুধ কি আবিষ্কার হয়েছে?
কারও চায়ে কেরোসিন ঢেলে দিলে কী হয়?
চুলে আগুন ধরিয়ে দিলে বোটকা গন্ধ কেন বের হয়?

বিজ্ঞানের প্রতি কালামের এই গভীর ভালোবাসা দেখে রাণুদিদির যতটুকু খুশি হওয়ার কথা ছিল খুব সংগত কারণে তিনি সেরকম খুশি হলেন না, বরং তাকে খুব চিন্তিত দেখা গেল!

রাণুদিদি বরাবরই তার ক্লাসের ছেলেমেয়েদেরকে হাতেকলমে বিজ্ঞান শিখিয়ে এসেছেন। ক্লাসে কালামকে আবিষ্কার করার পর থেকে হঠাৎ করে হাতেকলমে বিজ্ঞান শেখানো ব্যাপারটি তিনি ভয় পেতে শুরু করেছেন। যেমন ধরা যাক, বিদ্যুৎ পরিবাহী এবং অপরিবাহী ব্যাপারটি। যেদিন তিনি ক্লাসে বললেন পানি হচ্ছে বিদ্যুৎ পরিবাহী, তিনি আতঙ্কিত হয়ে দেখলেন সাথে সাথে কালামের মুখে একগাল হাসি ফুটে উঠল। রাণুদিদি চোখ পাকিয়ে বললেন, “কালাম, তুমি দাঁত বের করে হাসছ কেন?

“বিজ্ঞানের একটা পরীক্ষা করব সেটা চিন্তা করে আনন্দ হচ্ছে।”

“কী পরীক্ষা?”

কালাম মাথা নেড়ে বলল, “এখন বলা যাবে না।”

“কেন বলা যাবে না?”

“এখন বললে আপনি জেনে যাবেন, তাহলে আর কোনো মজা থাকবে না?”

রাণুদিদি খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন এবং দেখা গেল তাঁর দুশ্চিন্তা অমূলক নয়। পরের দিন কম্পিউটারের শিক্ষক মহসিন মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে এসে জানাল কালাম এক বালতি লবণগোলা পানি এনে তার কম্পিউটারের মাঝে ঢেলে দিয়েছে। সে নাকি পানির বিদ্যুৎ পরিবাহিতা হাতেকলমে পরীক্ষা করে দেখছিল। কম্পিউটারের মনিটর থেকে আগুনের ফুলকি বের হয়ে এসে একটা বিতিকিচ্ছির ব্যাপারে ঘটেছে। কালামকে জোর করে কম্পিউটার শেখানোর ফলে এরকম হলে সে ভুলেও এই পথে পা মাড়াত না!

কালামের একমাত্র সাফল্য দেখা গেল অঙ্ক ক্লাসে। পাইকারি দোকান থেকে কলা কিনে রেলগাড়ি কিংবা বাসস্টেশনে খুচরো বিক্রি করে করে সে সংখ্যা এবং যোগ-বিয়োেগ খুব ভালো শিখে গেছে। তবে যে-কোনো সমস্যার উত্তর সে টাকাতে দিয়ে থাকে। যেমন, তাকে যখন বলা হয়”করিমের কাছে চারটি বই, রহিমের কাছে তিনটি বই, মোট কতটি বই?” কালাম উত্তরে বলে সাত টাকা! অঙ্কের ঘাঘু শিক্ষক প্রফেসর আলি কালামের মাথা থেকে টাকা রোগ সরিয়ে সাধারণ ছাত্রে পালটানোর চেষ্টা করছেন কিন্তু এখনও খুব লাভ হয়নি। লাভ হবে সেরকম মনে হয় না।

কালামের জন্যে যে-মানুষটির কাজকর্ম খুব বেড়েছে তিনি হচ্ছেন মার্থা রোজারিও। প্রত্যেক দিনই কিছু ছেলেমেয়েকে তার কাছে হাজির করা হয় যাদের হাত বা পায়ের ছাল উঠে গেছে, খানিকটা চুল ছিঁড়ে এসেছে, নাক থেকে রক্ত বের হচ্ছে, পা মচকে গেছে–কখনো কখনো আরও বেশি, এক কান দিয়ে কিছু শুনছে কিংবা ডান পায়ে কোনো অনুভূতি নেই! এই সমস্ত রোগীর বেশিরভাগই কালামের নিজের হাতে তৈরি করা, তারা হয় কালামের নানা ধরনের পরিকল্পনায় অংশ নিয়েছে কিংবা তার দ্বৈতযুদ্ধের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। মার্থা রোজারিও মোটামুটিভাবে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে আছেন, এই ছেলেটিকে কীভাবে ঠিক করা যায় তিনি ভেবে পান না। পড়াশোনা শেষ করে কোনোদিন স্কুল থেকে পাস করে বের হয়ে যাবে তার কোনো আশা নেই, খোঁজ নিয়ে শুনেছেন সে এখনও স্বরবর্ণের প্রথম অক্ষর ‘অ’-তে আটকে আছে।

মির্জা মাস্টার যখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যে পড়াশোনার ব্যাপারটি কালামকে বোঝানো সম্ভব নয় এবং তাকে তার স্বাধীন জীবনেই ছেড়ে দিতে হবে তখন একটা ছোট ঘটনা ঘটল। ঘটনাটি এরকম :

প্রতিদিন সকালে কালামকে স্বরবর্ণের প্রথম অক্ষর ‘অ’ পড়িয়ে পড়িয়ে তিনি মোটামুটি বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন, তাই সেদিন তাকে দ্বিতীয় অক্ষর ‘আ’ শেখানোর চেষ্টা করবেন বলে ঠিক করলেন। ব্ল্যাকবোর্ড বড় করে আ লিখে তিনি কালামকে জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কোন অক্ষর?”

কালাম মাথা চুলকে এবং ঘাড় ঘুরিয়ে নানাভাবে অক্ষরটি পরীক্ষা করে মাথা চুলকে বলল, “আকাশে ঈদের চাঁদ উঠেছে দুইটা বাঁশগাছের মাঝে দেখা যাচ্ছে। তবে ছবিটা বেশি ভালোই হয় নাই, বাঁশগাছ আরও লম্বা হয়।”

মির্জা মাস্টার হুংকার দিয়ে বললেন, “এইটা বাঁশগাছ না। এইটা আ। বলো আমার সাথে, ‘আ’।

যে-কোনো ব্যাপার নিয়ে দুষ্টুমি করা কালামের অভ্যাস। কাজেই এবারেও সে দুষ্টুমি করে বিশাল বড় হাঁ করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল, “আ।”

ঠিক তখন সে শুনল তার কানের কাছে কোথায় জানি কট করে একটা শব্দ হল। শুধু তা-ই না, মুখটা ভোলা অবস্থাতে আটকে গেল, আর বন্ধ হল না।

মির্জা মাস্টার ধমক দিয়ে বললেন, “মুখ হাঁ করে বসে আছ কেন? বন্ধ করো।”

কালাম মিছেই তার মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করল কিন্তু কোনো লাভ হল না, . চোয়ালের কাছে কোথায় জানি পাকাঁপাকি ভাবে কী একটা আটকা গেছে। এই মুখ আর বন্ধ হবে না। হঠাৎ করে, জীবনের প্রথম সে একধরনের আতঙ্ক অনুভব করে।

মির্জা মাস্টার আবার ধমক দিলেন, “মুখ বন্ধ করো।”

কালাম নাক এবং গলা দিয়ে আঁ আঁ জাতীয় একটা শব্দ করে মাথা নেড়ে বোঝানোর চেষ্টা করল সে মুখ বন্ধ করতে পারছে না। মির্জা মাস্টার হঠাৎ করে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাঁর বিশাল দেহ নিয়ে তার কাছে এলেন, চোখ কপালে তুলে বললেন, “কী হয়েছে? মুখ বন্ধ হচ্ছে না?”

কালাম মাথা নাড়ল।

”সর্বনাশ!”

ততক্ষণে ক্লাসের অন্য ছেলেমেয়েরা তাকে ঘিরে ধরেছে। দার্শনিকের মতো একজন গম্ভীর গলায় বলল, “আল্লাহ শাস্তি দিয়েছে স্যার। কালাম সাংঘাতিক পাজি–আল্লাহ সেজন্যে নিজের হাতে শাস্তি দিয়েছে।”

ফরসা করে ফুটফুটে একটা মেয়ে কালামের মুখের ভিতরে তাকিয়ে বলল, “দাঁত মাঝে নাই। দাঁতে পোকা হয়েছে স্যার।”

কালামের দাতে পোকা দেখার জন্যে তখন আরও কয়েকজন তার কাছে এগিয়ে এল। একজন চোখ উজ্জ্বল করে বলল, “দ্যাখ দ্যাখ কালামের আলজিহ্বা দেখা যাচ্ছে!”

তখন কালামের মুখের ভিতরে তার আলজিব দেখার জন্যে আরও অনেক ভিড় করে এল।

দার্শনিকগোছের ছেলেটি আবার তার মাথা নেড়ে বলল, “আল্লাহর কাছ থেকে কেউ ছাড়া পায় না। কালাম এই মুখ দিয়ে গালি দেয় দেখে আল্লাহ মুখের মাঝে শাস্তি দিয়েছে। মুখ আর কোনোদিন বন্ধ হবে না।”

ছোটখাটো একজন উৎসুক ছেলে বলল, “হাত দিয়েও তো মারে, হাতে কিছু হবে না?”

দার্শনিক ছেলেটা গম্ভীর হয়ে বলল, “হবে। হাতপা ভেঙে লুলা হয়ে যাবে। তখন সিনেমা হলের সামনে এসে ভিক্ষা করতে হবে। আল্লাহ কাউকে ছাড়ে না।”

একটি মেয়ে অনেকক্ষণ কালামকে লক্ষ করে বলল, “রাত্রে ঘুমালে মুখে যদি ইঁদুর ঢুকে যায়?”

মির্জা মাস্টার ধমক দিয়ে সব বাচ্চাকে সরিয়ে দিয়ে কালামকে নিয়ে ছুটলেন স্কুলের নার্স মার্থা রোজারিওর কাছে।

মার্থা রোজারিও কালামকে একনজর দেখেই ব্যাপারটা বুঝে গেলেন, এটি খুব অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। মুখের ঠিক জায়গায় চাপ দিয়ে খুব সহজেই আটকে যাওয়া চোয়াল খুলে যায়, কিন্তু তিনি এই অমূল্য সুযোগ এত সহজে হাতছাড়া করতে রাজি হলেন না। কালামকে ঘরের কোণায় একটা চেয়ারে বসিয়ে মির্জা মাস্টার এবং অসংখ্য উৎসাহী দর্শককে বিদেয় করে দিলেন।

মুখ হাঁ করে বসে থাকতে থাকতে কালামের মুখের আশেপাশে ব্যথা করতে শুরু করছে। ব্যাপারটি কী সেটা নিয়ে ভয়টুকু তাকে কাবু করছে আরও বেশি। এটি সত্যি যদি আল্লাহর শাস্তি হয়ে থাকে এবং ধীরে ধীরে হাতপা ভেঙে লুলা হয়ে তাকে যদি সিনেমা হলের সামনে বসে ভিক্ষা করে জীবনটা কাটিয়ে দিতে হয় তখন কী হবে ভেবে সে কোনো কূলকিনারা পাচ্ছিল না।

ভিতরে ভিতরে খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়েও মার্থা রোজারিও মুখে হাসি ফুটিয়ে একটু পরে কালামের কাছে ফিরে এলেন, তার হাতে একটা ফর্ম। কালামকে ফর্মটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “নাও, ফর্মটা ফিলআপ করো। নাম ঠিকানা বয়স, কী সমস্যা লিখে নিচে পড়ে পড়ে ঠিক জায়গায় টিক চিহ্ন দিতে থাকো।”

কালাম বলার চেষ্টা করল, আমি পড়তে পারি না। মুখ পাকাঁপাকি ভোলা থাকায় সেখান থেকে শুধুমাত্র আঁ-আঁ জাতীয় একটা শব্দ বের হল। মার্থা রোজারিও সেটা শুনেই তার কথা বুঝে ফেলার ভান করে বললেন, “কী বললে, কলম নাই? এই নাও কলম।”

কালাম কলম হাতে নিয়ে আবার আকারে ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করল সে পড়তে পারে না, মার্থা রোজারিও আবার বুঝে ফেলার ভান করে বললেন, “হাতের লেখা ভালো না? কোনো সমস্যা নেই। আমি খারাপ হাতের লেখাও পড়তে পারি।”

মার্থা রোজারিও মিষ্টি করে হেসে কালামকে কাগজ-কলম হাতে বসিয়ে রেখে চলে গেলেন। কালাম তার হাতের কাগজের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, কাগজের অর্থহীন আঁকিবুকির মাঝে কী লেখা রয়েছে না জানার জন্যে এই প্রথমবার আফসোস হতে থাকে। মুখ ব্যথায় টনটন করছে, কতক্ষণ তাকে বসে থাকতে হবে এবং তারপর কী হবে চিন্তা করে তার কালঘাম ছুটতে থাকে।

মার্থা রোজারিও কিছুক্ষণের মাঝেই ফিরে এসে অবাক হবার ভান করে বললেন, “সে কী, এখনও কিছু লেখনি?”

কালাম মাথা নাড়ল। মার্থা রোজারিও বললেন, “ঠিক আছে, শুধু নামটা লেখো তা হলেই হবে। তোমার নাম তো কালাম, লেখো সেটা। আমি দেখিয়ে দিই।”

মির্জা মাস্টার প্রায় এক বত্সর চেষ্টা করে যাকে একটা অক্ষর শেখাতে পারেননি মার্থা রোজারিও কয়েক মিনিটে তাকে তার নিজের নাম লিখতে শিখিয়ে দিলেন। তাকে আরও অনেক কিছু শেখানো যেত কিন্তু মার্থা রোজারিও তার চেষ্টা করলেন না, বাচ্চাটির কষ্ট দেখে তার নিজেরও কষ্ট হতে শুরু করেছে। হাতে তোয়ালে পেঁচিয়ে মুখের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে কোথায় জানি চেপে ধরতেই আবার কট করে শব্দ হল এবং সাথে সাথে কালামের চোয়াল দুটি খুলে গিয়ে মুখটি সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল।

কালাম তার মুখে হাত বুলাতে বুলাতে কৃতজ্ঞ চোখে মার্থা রোজারিওর দিকে তাকিয়ে বলল, “জানটা বাঁচালেন আপনি। আমি ভাবছিলাম আর মুখ বন্ধ হবে না! কেমন করে করলেন?”

“পড়াশোনা করো, বড় হয়ে ডাক্তার হও তা হলে দেখবে কেমন করে করা যায়। যাও এখন।”

কালাম সাবধানে কয়েকবার মুখ বন্ধ করে এবং খুলে পরীক্ষা করে বলল, “আমাকে শিখিয়ে দেবেন?”

“কেমন করে মুখ আটকে গেলে খুলতে হয়?”

“না।”

“তাহলে কী?”

কালাম দাঁত বের করে হেসে বলল, “কেমন করে মুখ খোলা থাকলে আটকে দিতে হয়।”

“কেন?”

“তা হলে কী মজা হবে! আমি সবার মুখ খুলে আটকে রাখব। হি হি হি –সব মুখ হাঁ করে বসে থাকবে!”

মার্থা রোজারিও চোখ পাকিয়ে বললেন, “দুষ্ট ছেলে! আমি তা হলে তোমাকে দিয়েই শুরু করি! আসো আমার কাছে–”

.

সাধারণত গল্প উপন্যাসে এরকম সময় দুষ্ট ছেলেরা খুব ভালো হয়ে যায়। পড়াশোনায় মনোযোগ দিয়ে ভালো ছাত্র হয়ে বড় হয়ে দেশের উপকার করে ফেলে। কিন্তু এটা যেহেতু সত্যি ঘটনা এখানে সেরকম কিছুই হল না, কালাম দুই থাকল। খেলার মাঠে সবাইকে ল্যাং মেরে ফেলে দিতে লাগল, ক্লাসে পাশে বসে থাকা ছেলেদের চিমটি কাটতে লাগল, পকেটে করে বিষপিঁপড়া এনে বন্ধুদের ঘাড়ে ছেড়ে দিতে লাগল, কোনো কারণ ছাড়াই ঝগড়া পাকিয়ে মারপিট করতে লাগল।

শুধু মির্জা মাস্টার খুব ছোট একটা পরিবর্তন লক্ষ করলেন, কালাম শেষ পর্যন্ত পড়া শিখতে রাজি হয়েছে। কেউ বিশ্বাস করুক আর না-ই করুক, কালাম স্বরবর্ণ শেষ করে শেষ পর্যন্ত ব্যঞ্জনবর্ণে পা দিয়েছে। মনে হয় এভাবে থাকলে মাসখানেকের মাঝে পড়া শিখে যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *