০৭. উনিশশো ষাট সালের তেসরা মে

উনিশশো ষাট সালের তেসরা মে তুরস্কস্থিত মার্কিন বিমান বাহিনীর সদর দপ্তর থেকে একটা ছোট্ট খবর প্রচার করা হলো : আদানা এয়ারবেস থেকে অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের একটা বিমান বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহের জন্য উড়বার পর নিখোঁজ হয়েছে।

আন্তর্জাতিক ওয়্যার সার্ভিসের অসংখ্য চ্যানেলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই এই ছোট্ট খবরটি ছড়িয়ে পড়ল সারা দুনিয়ায়। কিন্তু কেউই বিশেষ গ্রাহা করল না। কোনো কাগজে খবরটা বেরুল, কোনো কাগজে বেরুল না। ডিপ্লোম্যাটরাও বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না।

দুদিন পর পাঁচই মে সুপ্রিম সোভিয়েটের এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নিকিতা ক্রুশ্চভ ঘোষণা করলেন, একটা পরিচয়বিহীন মার্কিন বিমান সোভিয়েট ইউনিয়নের আকাশসীমা লঙ্ঘন করায় গুলি করে নামান হয়েছে।

চমকে উঠল দুনিয়া।

কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ওয়াশিংটন থেকে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হলো, ১৯৫৬ সাল থেকে যে ইউ-টু বিমান পৃথিবী থেকে অনেক উঁচু আবহাওয়া সম্পর্কিত গবেষণার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে, এমনি ওই বিমানের পাইলট তুরস্কের লেক ভ্যান-এর উপর দিয়ে ওড়ার সময় জানায় তার অসিজেন সাপ্লাইতে গণ্ডগোল হচ্ছে। হয়তো এমনি পরিস্থিতিতে বিমানটি রাশিয়ায় ঢুকে পড়ে।

শুধু এইটুকু বলেই ওয়াশিংটন থামল না। ওই একই ঘোষণায় জানাল নিরস্ত্র ওই পাইলটের নাম।

ওয়াশিংটন থেকে মস্কোতে একটা নোট পাঠিয়ে আবহাওয়ার তথ্য সন্ধানী ওই বিমানের বিশদ খবরও জানতে চাইল।

মার্কিন সরকার স্থির ধরে নিয়েছিলেন যে পাইলট ফ্রান্সিস গ্রে পাওয়ার্স বেঁচে নেই। বিমানটিকে গুলি করে নামাবার পর সে বেঁচে থাকতে পারে না।

সেই আশায় ও ভরসায় ৬ মে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে জোর গলায় প্রচার করা হলো, সোভিয়েট আকাশসীমা লঙ্ঘনের কোনো কথাই উঠতে পারে না।

সেই তেসরা মের ঘোষণার পর কুশ্চভ কদিন ধরে শুধু মুচকি মুচকি হাসলেন। সাতই মে আর সে হাসি চেপে রাখতে পারলেন না। সুপ্রিম সোভিয়েটে বক্তৃতা দেবার সময় ইউ-টু বিমানের নাড়িনক্ষত্র জানিয়ে ঘোষণা করলেন, ফ্রান্সিস গ্রে জীবিত ও সোভিয়েট কারাগারে। ফ্রান্সিস গ্রে স্বীকারোক্তি করেছে যে, তার সঙ্গে প্রচুর টাকা, আত্মহত্যার সরঞ্জাম, সোনা, অস্ত্রশস্ত্র ও এক থলি ভর্তি ঘড়ি ও আংটি ছিল।

এই বক্তৃতার শেষে ক্রুশ্চভ নরওয়ে, তুরস্ক ও পাকিস্তানকে সতর্ক করে বললেন, যেসব দেশ থেকে এইসব গোয়েন্দা বিমান উড়বে, তাদের উচিত শিক্ষা দেওয়া হবে।

মার্কিন সরকারকে কঠোরতম ভাষায় নিন্দা করলেও কুশ্চভ প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার সম্পর্কে একটুও কটু কথা বললেন না।

সারা দুনিয়ার ডিপ্লোম্যাটরা ক্রুশ্চভের এই রসিকতা ঠিক হয়তো ধরতে পারলেন না। সবাই ভাবলেন, হয়তো তেমন কিছু হবে না।

সাতই মে ওয়াশিংটন থেকে আবার বিবৃতি। প্রায় প্রত্যক্ষভাবেই তারা স্বীকার করলেন গোয়েন্দা বিমানের অভিযান কাহিনি-তবে ঠিক অনুমতি দেওয়া হয়নি।

এবার শুধু ক্রেমলিনের নেতৃবৃন্দ নয়, সারা দুনিয়ার ডিপ্লোম্যাটরাও মুখ টিপে হাসতে শুরু করলেন। আমেরিকার সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি তাহলে সরকারের বিনা অনুমতিতেই এত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

আর কোনো গত্যন্তর না থাকায় শেষ পর্যন্ত ইউ-টু ফ্লাইট সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার তার ব্যক্তিগত দায়িত্ব ঘোষণা করলেন এগারোই মে।

ওইদিন প্রায় একই সময়ে মস্কোর ফরেন করেসপনডেন্টদের কুশ্চভ নেমন্তন্ন করে ইউ-টু ফ্লাইটের যন্ত্রপাতি সাজ-সরঞ্জাম দেখালেন।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সাইক্লোন উঠল। আমেরিকার দুই দোস্ত-ফরাসি ও ব্রিটিশ সরকার ভাবল যে ওদের দেশের উপর দিয়েও নিশ্চয়ই অমনি গোয়েন্দা বিমান ঘুরে বেড়ায়। জ্ঞাতিশত্রু।

পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। কুশ্চভের ধমক খেয়ে নরওয়ে প্রতিবাদপত্র পাঠাল ওয়াশিংটনে। ব্ল্যাক সী-র এ-পারের তুরস্ক, প্রভুসেবা করতে গিয়ে বিপদের মুখোমুখি হবে ভাবতে পারেনি। মার্কিন সাহায্যে তুরস্ক বেঁচে আছে বলে নরওয়ের মতো প্রতিবাদও পাঠাতে পারল না ওয়াশিংটনে। ফাপরে পড়ল পাকিস্তান। আয়ুর খাঁ একই সঙ্গে কবছর দুধ আর তামাক খাচ্ছিলেন কিন্তু এবার কুশ্চভের ধমক খেয়ে তার পাতলুন ঢিলা হয়ে গেল।

কদিন পরই প্যারিস সামিট! দীর্ঘদিনের পৃথিবীব্যাপী প্রচেষ্টার পর বিশ্বের চার মহাশক্তি বিশ্ব সমস্যার সমাধানের আশায় কদিন পরই প্যারিসে বসবে। তারপর প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার ক্রুশ্চভের আমন্ত্রণে যাবেন সোভিয়েট ইউনিয়ন। এমনি এক বিরাট সম্ভাবনাপূর্ণ মুহূর্তের ঠিক আগে অ্যালান ডালেস পাঠালেন ইউ-টু?

অভাবিত আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন চিন্তাশীল রাষ্ট্রনায়করা। সবার মুখে এক কথা, প্যারিস সামিট হবে তো? কুশ্চভ আসবেন তো?

শেষ পর্যন্ত ওরলি এয়ারপোর্টে এরোফ্লোটের স্পেশ্যাল প্লেন ল্যান্ড করল। হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন শুভ।

আঠারোই মে প্যারিসে সারা দুনিয়ার সাংবাদিকদের একটা গল্প শোনালেন কুশ্চভ।–ছেলেবেলায় বড় গরিব ছিলাম আমরা। আমরা দুঃখী মা একটু দুধ, একটু ক্ষীর অতি যত্নে লুকিয়ে রাখতেন আমাদের দেবার জন্যে। কোথা থেকে একটা বিড়াল এসে ওই দুধ ওই ক্ষীর একটু খেয়ে গেলে মা রাগে দুঃখে জ্বলে উঠতেন। শেষকালে বিড়ালটার মুণ্ডু ধরে ওই ক্ষীরের মধ্যে ঘষে দিতেন। কেন জানেন? বিড়ালটাকে শিক্ষা দেবার জন্য।

গল্পটা বলে ক্রুশ্চভ সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের দেশের মানুষের একটু দুধ, একটু ক্ষীর যে সব ছাবলা বিড়াল চুরি করে খেতে চায়, তাদের শিক্ষা দেবার জন্যে একটু নাক ঘষে দেব। আর কিছু নয়।

শীর্ষ সম্মেলন শুধু বর্জন করেই শান্ত হলেন না কুশ্চভ, প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ারকে সোভিয়েট ইউনিয়ন ভ্রমণ করতে নিষেধ করলেন।

যত সহজে এসব ঘটনাগুলো খবরের কাগজের রিপোর্টাররা লিখতে পারেন, ডিপ্লোম্যাটদের পক্ষে ঠিক তত সহজে এর তালে তালে চলা সহজ নয়! যুদ্ধোত্তর বিশ্ব রাজনীতির সেই স্মরণীয় দিনগুলিতে মস্কো, লন্ডন, প্যারিস, ওয়াশিংটন ও ইউনাইটেড নেশন্‌স্থিত ইন্ডিয়ান ডিপ্লোম্যাটদের দিবারাত্র শুধু ওয়ারলেস ট্রান্সক্রিপ্টের ফাইল নিয়ে কাটাতে হয়েছে।

অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন এমন মহিলার সন্তান, ছেলে না মেয়ে, তা অনেক আধুনিক বৈজ্ঞানিক জানেন বলে দাবি করেন। কিন্তু রাশিয়া বা কুশ্চভের মনে কি আছে তা কেউ বলতে পারেন না। তবুও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিশ্বশান্তি রক্ষার জন্য সোভিয়েট ইউনিয়ন ও ভারতবর্ষ প্রায় একই পথের পথিক। তাই তো দুনিয়ার নানা কোথা থেকে সম্ভাবিত সোভিয়েট পদক্ষেপ সম্পর্কে ভারতীয় দূতাবাসে ঘন ঘন তাগিদ।

বাইরের দুনিয়াকে না জানালেও মস্কো ও ইউনাইটেড নেশনস-এর ইন্ডিয়ান ডিপ্লোম্যাটরা অনুমান করলেন, ক্রুশ্চভ ওইখানেই যবনিকা টানবেন না। নতুন রঙ্গমঞ্চে এবার নাটক শুরু হবে।

মস্কো ও ইউনাইটেড নেশনস থেকে ইন্ডিয়ান ডিপ্লোম্যাটিক মিশন টপ সিক্রেট কোডেড় মেসেজ পাঠালেন দিল্লিতে। সতর্ক করে দেওয়া হলো সম্ভাবিত সোভিয়েটের পদক্ষেপ সম্পর্কে। দিল্লিতে ক্যাবিনেট ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটিতে একবার ওই নোট নিয়ে আলোচনাও হলো। মোটামুটিভাবে ঠিক করা হলো বিশ্বশান্তির জন্য ক্রুশ্চভের আবেদন অগ্রাহ্য করার প্রশ্নই ওঠে না।

তারপর সত্যি একদিন এরোফ্লোটের ইলুসিন চড়ে কুশ্চভ এলেন নিউইয়র্ক, এলেন এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাতিন আমেরিকা থেকে আরো অনেকে। মার্কিন ডিপ্লোম্যাসির রাহুর দশা যেন শেষ হয় না।

ডিপ্লোম্যাট ও সাংবাদিকদের অনেক বিনিদ্র রজনী যাপনের পর এরোফ্লোটের ইসিন আবার জুশ্চভকে নিয়ে নিউইয়র্ক ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের মাটি ছেড়ে আকাশে উড়ল। উড়ল আরো অনেক বিমান। বিদায় নিলেন এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাতিন আমেরিকান নেতৃবৃন্দ।

অনেক দিন পর ডিপ্লোম্যাটরা একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন।

মিশ্র, আর খেও না!

প্লিজ ডোন্ট স্টপ মি টু-নাইট। আই মাস্ট ড্রিংক লাইক ফিস।

ইন্ডিয়ান মিশনের তিন তলার রিসেপশন হলের জানলা দিয়ে মিশ্র একবার বাইরের আকাশটা দেখে নিয়ে তরুণকে বলল, ইজিপশিয়ান গার্ডেনে নাচ দেখতে যাবে?

এত ড্রিংক করার পর কি ইজিপশিয়ান গার্ডেনের বেলি ড্যান্সারদের বেলি দেখার অবস্থা থাকবে?

আই অ্যাম নট এ পিউরিটান লাইক ইউ।

তবু…।

ওই তবু টুব ছেড়ে দাও। আমি তো তুমি নই যে কবে কোনোকালে এক মেয়ের প্রেমে পড়েছি বলে আর কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাব না?

অ্যাম্বাসেডর এদিকে ওদিকে ঘুরতে ঘুরতে মিশ্রের পাশে এসে হাজির হয়ে প্রশ্ন করলেন, মিশ্র আর ইউ হ্যাপি?

গেলাসের বাকি স্কচটুকু গলায় ঢেলে দিয়ে মিশ্র জবাব দিলেন, সো কাইন্ড অফ ইউ স্যার! লাইফে আপনার মতো বস আর স্কচ হুইস্কি পেলে আমি আর কিছু চাই না।

ইন্ডিয়া শো-রুমের মিস মাজিথিয়াকে প্রায় পাশে আবিষ্কার করতেই অ্যাম্বাসেডর সরে গেলেন।

মিশ্র এগিয়ে এলেন, হাউ আর ইউ ডিয়ার ডার্লিং সুইটহার্ট?

বাঁ চোখটা একটু ছোট করে, ডান চোখে একটু ঈষৎ দুষ্টু ইঙ্গিত ফুটিয়ে মিস মাজিথিয়া বললেন, ডোন্ট বি সিলি ইউ নটি বয়!

সুইট ডার্লিং, স্কচ পেলে দুনিয়া ভুলে যাই, আর তোমাকে পেলে স্কচও ভুলে যাই।

মিস মাজিথিয়া তরুণকে বললেন, ডু ইউ বিলিভ হিম, মিস্টার সেনগুপ্ত?

সার্টেনলি আই বিলিভ মাই কলিগ। তরুণ হাসতে হাসতে উত্তর দেয়।

এত বিশ্বাস করবেন না, বিপদে পড়বেন।

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয় তরুণ, যেমন আপনি বিপদে পড়েছেন, তাই না?

হাসতে হাসতে বললেও বিদ্রূপটা কাজে লাগে। মিস মাজিথিয়া স্কচ হুইস্কির গেলাসে চুমুক দিতে দিতে ভিড়ের মধ্যে মিশে যান।

মিস মাজিথিয়াকে অমনভাবে পালিয়ে যেতে দেখে তরুণ না হেসে পারে না। মিশ্রকে নিয়ে নেপথ্যে অনেক আলোচনা, সমালোচনা হয়। কোনো আড্ডাখানায় নিউইয়র্কবাসী দুপাঁচজন ভারতীয় এক হলেই মিশ্রের নিন্দা হবেই। কিছু হাফ বেকার-হাফ এমপ্লয়েড ছোঁকরা তো রেগে বলেই ফেলে, স্কাউড্রেল, ডিবচ, ড্রাংকার্ড।

বলবে না? মিশ্র যে মেয়েদের সাবধান করে সতর্ক করে দেন ওইসব নোংরা ছেলেগুলো সম্পর্কে। মিস যোশী, ইউ আর এ গ্রোন আপ গার্ল। লেখাপড়াও শিখেছ, কিন্তু জীবন সম্পর্কে তোমার চাইতে আমার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। একটু সাবধানে থেকো।

মিস যোশী শুধু বলেছিল, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ।

তখন বয়সটাই এমন যে কারুর উপদেশ শুনতে মন চায় না। আগ্নেয়গিরির মতো দেহের মধ্যে যৌবনের আগুন লুকিয়ে লুকিয়ে টগবগ করে ফুটছে। ফিফথ অ্যাভিনিউ আর টাইমস স্কোয়ারে ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে আগ্নেয়গিরি যেন আর শাসন মানতে চায় না, অধিকাংশ মেয়েরা সে শাসন মানেও না। সে শাসন মানবে কেন? ফিফথ অ্যাভিনিউ-টাইম স্কোয়ার দিয়ে সন্ধ্যার আমেজী পরিবেশে একটু ধীর পদক্ষেপে মিস যশোদা যোশীর মতো মেয়েরা যখন ঘুরে বেড়ায়, তখন কে যেন বার বার কানে কানে ফিস্ ফিস্ করে বলে, বিশ্ব সংসারে এসেছ দুদিনের জন্য। আনন্দ কর, উপভোগ কর। চারিদিকে তাকিয়ে দেখ তোমার মতো মেয়েরা কিভাবে রসের মেলায় পরিণী হয়ে…!

মিশ্রের উপদেশ বেসুরো ঠেকে যশোদার কানে। তবুও যে সে শুনেছে, তার জন্যই মিশ্র কৃতজ্ঞ। যশোদা তো অপমান করেও বলতে পারত, আমি কি করি বা না করি সেটা না অফ ইওর বিজনেস।

ঘরপোড়া গরু যে সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়! মিশ্রও তাই তো এসব মেয়েরা বিদেশে এসে এমন স্বচ্ছন্দ হয়ে ছেলেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করলে ভয় পায়।

.

জান তরুণ, কাল রাত্রে চৌবের বাড়ি থেকে আমার ফিরতে ফিরতে রাত দেড়টা-দুটো হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ খেয়াল হলো সিগারেট নেই। টাইমস্ স্কোয়ারের কাছে গাড়ি পার্ক করে সিগারেট কেনার জন্য দু পা এগিয়েই দেখি দ্যাট স্কাউড্রেল মালহোত্রার সঙ্গে যশোদা…।

তরুণ বলল, ওদের নিয়ে তুমি অত ভাববে না।

বোতলখানেক হুইস্কি খেয়েও মিশ্র বেহুশ হয় না। একবার মাথা নিচু করে কি যেন ভাবেন। না ভেবে যে থাকতে পারি না তাই। ওদের দেখলেই যে আমার অমলার কথা মনে হয়।

হাতের গেলাসটা নামিয়ে রেখে মিশ্র পাথরের মতো নিশ্ৰুপ নিশ্চল হয়ে বসে পড়েন। চোখের জলও গড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে।

তরুণের মনে পড়ল সেই পুরনো দিনের কথা…।

সেকশন অফিসার প্রকাশচন্দ্র প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে তরুণকে খবর দিল, জানেন স্যার, জেনেভা থেকে এক্ষুনি একটা মেসেজ এসেছে, মিশ্র সাহেবের মেয়ে সুইসাইড করেছে।

তরুণ চমকে ওঠে, হোয়াট আর ইউ সেইং? অমলা সুইসাইড করেছে?

পাঁচ হাজার মাইল দূরে ছিলেন মিশ্র। কিন্তু খবরটা ওয়েস্ট ইউরোপিয়ান ডেস্কে আসার সঙ্গে সঙ্গে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল দিল্লি মহারাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঘরে ঘরে। বাইরের দুনিয়ার লোক মিঃ মিশ্রকে নিয়ে অনেক কিছু ভাবলেও ফরেন মিনিস্ট্রির সবাই তাকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, আপনজ্ঞান করে।

যে সমস্যার কথা কাউকে বলা যায় না, মিশ্র সাহেবকে হাসিমুখে সে কথা বলা যায়; যে সমস্যার সমাধান করতে আর কেউ পারবেন না, তাও মিশ্র সাহেব হাসতে হাসতে ঠিক করে দেবেন। সন্ধ্যার পর হুইস্কি না খেয়ে যেমন তিনি থাকতে পারেন না, তেমনি সহকর্মী ও বন্ধুদের উপকার না করেও স্থির থাকতে পারেন না।

লাঞ্চের পর অফিসে এসেই মিশ্র টেলিফোনের বাজার বাজিয়ে হীরালালকে তলব করলেন, চলে আসুন।

মিশ্র তখনও সিগারেট খাচ্ছেন। তিন-চারটে ফাইল নিয়ে হীরালাল ঘরে ঢুকতেই কেমন যেন খটকা লাগল।–কুঁচকে একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখতেই বুঝলেন হীরালাল বেশ চিন্তিত।

হীরালাল মিশ্র সাহেবের সামনে ফাইলগুলো নামিয়ে রাখলেন।

মিঃ মিশ্র সিগারেটের শেষ টানটা দিতে দিতে বাঁকা চোখে আরেকবার হীরালালকে দেখে নিয়ে বললেন, কি হয়েছে তোমার?

না স্যার, তেমন কিছু না।

দেখ হীরালাল, আমার কাছে বলতেও তোমার দ্বিধা হয়?

সকৃতজ্ঞ হীরালাল বলে, আপনার কাছে আর কি দ্বিধা করব। তবে…।

তবে আবার কি? টেল মি ফ্র্যাঙ্কলি হোয়া রং উইথ ইউ?

হীরালাল আর চেপে রাখতে সাহস করে না। জানে এবার না বললে বকুনি খাবে।

কালকেই চিঠি পেয়েছি আবার মেয়েটার শরীর খারাপ হয়েছে, অথচ…।

আপনি তো জানেন আমার ডিক্সনারিতে ইফস্ অ্যান্ড বাট লেখা নেই।

ড্রয়ার থেকে বার্কলে ব্যাঙ্কের চেক বই বের করে একশো পাউন্ডের একটা চেক দিলেন হীরালালকে। পাতিয়ালার ওই অপদার্থ শ্বশুরবাড়িতে মেয়েটাকে আর ফেলে না রেখে এখানেই নিয়ে আসুন।

আপনি আবার…।

ফরেন সার্ভিসে কাজ করে বড় বেশি ফরম্যালিটি করতে শুরু করেছেন। আচ্ছা, আজ যদি আমারই দুতিনটে মেয়ে থাকত?

এরপর কি আর কিছু বলা যায়? না। হীরালাল টেবিলের ওপর ফাইলগুলো রেখে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল!…

কি বললে? ব্যাভেরিয়ান বিয়ার খেতে ইচ্ছা করছে?

তারপর ওই তাজ-এ একটু সিম্পল চিকেন রাইস-এর লাঞ্চ, ছোঁকরা ডিপ্লোম্যাট বড়ুয়া আর্জি পেশ করে।

দ্যাখ ছোঁকরা, তুমি তো জান আমি ডিসআর্মামেন্ট-সামিট-বিগ পাওয়ার রিলেশান্স ডিল করি। সুতরাং এত ছোটখাটো সামান্য বিষয় নিয়ে ভবিষ্যতে আমার কাছে এসো না।

প্রাইমিনিস্টার, ফরেন মিনিস্টার, ফরেন সেক্রেটারি থেকে শুরু করে ক্লার্ক বেয়ারারা পর্যন্ত মিশ্রকে ভালোবাসে। ভালো না বেসে যে উপায় নেই।

সেই মিশ্র সাহেবের আদুরে দুলালী অমলা আত্মহত্যা করেছে শুনে সবাই মর্মাহত হলেন।

বছর খানেক পরে তরুণ মিঃ মিশ্রকে দেখে বিস্মিত না হয়ে পারল না। সন্ধ্যার পর বোতল বোতল মদ গেলেন আর ইয়ং ইন্ডিয়ান মেয়ে দেখলেই বলেন, মনে হয় অমলাও ওদের মতো কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক্ষুনি দৌড়তে দৌড়তে ফিরে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরবে।

অমলা তখন আট-ন বছরের হবে আর কি। মিসেস মিশ্র মারা গেলেন ক্যান্সারে। বহুদিন ধরেই ভুগছিলেন। বিশেষ করে শেষের বছর দুয়েক অমলার সব কিছুই মিশ্র সাহেব করতেন। স্ত্রী মারা যাবার পর মুষড়ে পড়লেও অমলাকে নিয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়েছিলেন।

দেখতে দেখতে অমলা বড় হলো। সেই ছোট্ট কিশোরী অবলা অমলা প্রাণ-চঞ্চলা হয়ে উঠল। দিগন্তবিস্তৃত অতল সমুদ্রের এই ছোট্ট দ্বীপে স্বপ্নের প্রাসাদ গড়ে তুললেন মিশ্র সাহেব।

ঘরে কোনো ভাইবোন-মাকে না পেয়ে সাহচর্যের জন্য অমলা বাইরের দুনিয়ায় তাকিয়েছিল। কত ছেলে, কত মেয়ে ছিল তার বন্ধু। মিঃ মিশ্র বাধা দেননি, বরং উৎসাহ দিতেন। কিন্তু সাহচর্য, বন্ধুত্বের সুযোগ এমন সর্বনাশ!

হ্যাঁ হ্যাঁ তরুণ, ওই ছোঁকরাগুলো দেহের আগুন, যৌবনের জ্বালা, চোখের নেশা চরিতার্থ করার জন্য যদি অমলার মতো ওই যশোদারও চরম সর্বনাশ করে? যদি নিজের লজ্জা লুকোবার জন্য অমলার মতো যশোদাও যদি…।

আর বলতে পারেন না। কাঁপা কাঁপা হাত দুটো দিয়ে জড়িয়ে ধরেন তরুণকে। ছলছল চোখ দুটো জলে ভরে যায়।

একটা বিরাট দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলেন, এই বিশ-বাইশ বছরের মেয়েগুলোকে সুন্দর শাড়ি পরে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ঘুরতে দেখলেই কেবল অমলার কথা মনে হয়।

তরুণ কি জবাব দেবে? কিচ্ছু বলতে পারে না। একটু সন্তানম্নেহ দেবার জন্য এমন কাঙালকে কি বলবে সে? মায়ের কোল খালি করে শিশু সন্তান চলে গেলে সে মা উন্মাদিনী হয়ে ওঠে। মিশ্র সাহেবের মনের মধ্যে অমনি জ্বালা করে দিন-রাত্তির চব্বিশ ঘণ্টা।

আচ্ছা তরুণ, অনেকে তো অন্যের মাকে মা বলে ডাকে, অন্যের বাবাকে বাবা ডাকা যায় না?

এবার তরুণের দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে। আর যেন সে সহ্য করতে পারছে না। শুধু বলে, নিশ্চয়ই ডাকা যায়।

হাসিতে লুটিয়ে পড়েন মিশ্র। ডোন্ট টক ননসেন্স তরুণ। তুমি কি ভেবেছ আমি মাতাল হয়েছি? যা বোঝাবে তাই বুঝব?

ইউ-টু ফ্লাইট, প্যারিস সামিট ও তারপর ইউনাইটেড নেশনস নিয়ে এতদিন ব্যস্ত থাকায় বেশ ভালো ছিলেন মিঃ মিশ্র। একটু অবসর পেয়ে আবার সব অতীত ভিড় করছে ওর কাছে।

পার্টি শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। প্রায় সবাই চলে গেছেন। এক কোণায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মিশ্র তরুণের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন।

ধীরে ধীরে অ্যাম্বাসেডর এসে পাশে দাঁড়ালেন। মিশ্রের কাঁধে হাত রেখে বললেন, কাল কত তারিখ মনে আছে?

টুমরো ইজ টোয়েন্টি সেকেন্ড।

কাল আমার মেয়ে আসছে, তা জান?

সিওর স্যার। বি-ও-এ-সি ফ্লাইট সিক্স-জিরো-ওয়ান।

অ্যাম্বাসেডর খুশিতে হেসে ফেললেন। দ্যাটস রাইট। আমি তো আবার পরশু দিনই জেনেভা যাচ্ছি। সুতরাং ভুলে যেও না টু টেক কেয়ার অফ দ্যাট গার্ল।

নো স্যার, নট অ্যাট অল। মিশ্র এবার একটু মুচকি হাসতে হাসতে বলেন, ইফ আই মে সে ফ্রাঙ্কলি স্যার, রীনা আপনার চাইতে আমাকে বেশি পছন্দ করে।…

অ্যাম্বাসেডর তরুণের কানে কানে বললেন, প্লিজ টেল মিশ্র যে আমি তার জন্য আনন্দিত।

আর কোনো কথা না বলে অ্যাম্বাসেডর বিদায় নিলেন। গুড় নাইট! সী ইউ টুমরো।

গুড নাইট স্যার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *