০১. কর্মজীবন আর সংসারজীবন

ডিপ্লোম্যাট – উপন্যাস – নিমাই ভট্টাচার্য

হে দূর হইতে দূর, হে নিকটতম,
যেথায় নিকটে তুমি সেথা তুমি মম;
যেথায় সুদূরে তুমি সেথা আমি তব।

কর্মজীবন আর সংসারজীবনের দুটি গোলপোস্টের মাঝখানে দায়িত্ব কর্তব্যের ফুটবল পেটাতে পেটাতেই অধিকাংশ মধ্যবিত্তের ভবলীলা সাঙ্গ হয়। কিছু মানুষের বিচরণক্ষেত্র আরো বিস্তৃত, আরো রঙিন। কিছুটা বিস্তৃত, কিছুটা রঙিন হওয়া সত্ত্বেও সমাজসংসারে এদের নোঙর বাঁধা। চৌরঙ্গির অলিতে-গলিতে ঘোরাঘুরি বা সন্ধ্যার অন্ধকারে মিউজিয়ামের পাশে লুকিয়ে রিকশা চড়ে যৌবনের অলকানন্দা-অমরাবতী ভ্রমণের মেয়াদ কতটুকু, মীর্জাপুর বা রাসবিহারী অ্যাভিন্যুর ঘরবাড়ি ছেড়ে বোম্বে সেক্স অফিসের মিস সোন্ধিকে নিয়ে মেরিন ড্রাইভ বা চার্চ গেটের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করারই বা স্থায়িত্ব কতক্ষণ?

দিনের আলো ফুরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে লুকিয়ে-চুরিয়ে স্বাধীনতা উপভোগের পর্ব শেষ হয়। সূর্যাস্তের পর সব পাখি ফিরে আসে ঘরে। শনি-মঙ্গল-রাহুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতেই একদিন সব থেমে যায় প্রায় সবার।

ডিপ্লোম্যাট-কূটনীতিবিদরা নিশ্চয়ই স্বতন্ত্র। মীর্জাপুর বা রাসবিহারী অ্যাভিনিউর ছেলে হয়েও সারা দুনিয়ায় তাদের বিচরণ, তাদের সংসার। বিশ্বসংসারের কত রঙ-বেরঙের নারী-পুরুষের সঙ্গে তাদের লেনদেন। দেশে-দেশে ছড়িয়ে থাকে এঁদের স্মৃতি, প্রাণের মানুষ, মনের টুকরো টুকরো স্বপ্ন।

তরুণ মিত্র যেদিন ফরেন সার্ভিসে ঢুকে কূটনীতিবিদদের তালিকায় নিজের নাম জুড়েছিলেন, সেদিন সত্যি উনি তরুণ ছিলেন। সেদিনের পর মিসিসিপি-ভলগা-গঙ্গা বেয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। অনেক জল-ঝড়, অনেক শীত-বসন্ত পিছনে ফেলে এসেছেন।

ফায়ার প্লেসের ধারে রকিং চেয়ারে বসে দোল খেতে খেতে বাকি হুইস্কিটা হঠাৎ গলায় ঢেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তরুণ মিত্র। মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে খালি গেলাসটা হাতে নিয়ে চলে গেলেন স্টাডিতে। অতি পরিচিত পৃথিবীর মানচিত্রের সামনে দাঁড়ালেন। পৃথিবীর সমস্ত মহাদেশ, মহাসাগরের উপর দিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর ল্যান্ডিং এয়ারক্রাফট-এর কমান্ডারের মতো খুঁজতে লাগলেন রানওয়ে। অনেক দিনের অনেক স্মৃতির বোঝা নিয়ে মনের বিমান ল্যান্ড করাতে গিয়ে অনেকগুলো এয়ারপোর্টের অনেক রানওয়ের হাজার হাজার আলো জ্বলে উঠল। দিল্লি…কায়রো…লন্ডন…মস্কো নিউইয়র্ক…হংকং…টোকিও এবং আরো কতত! এক সঙ্গে যেন সমস্ত কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে ল্যান্ডিং সিগন্যাল আর নির্দেশ পেলেন ডিপ্লোম্যাট তরুণ মিত্র।

আরো কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর দুপা ডানপাশে সরে এলেন। চোখের সামনে নজরে পড়ল দিল্লি।

.

সো ইউ হ্যাড অ্যান ইন্টারেস্টিং স্টে ইন ঘানা… পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জয়েন্ট সেক্রেটারি ও ইউনাইটেড নেশনস ডিভিশনের হেড, পরমেশ্বরন হাসতে হাসতে ছোট্ট মন্তব্য করলেন।

তরুণ মিত্র বলল-হ্যাঁ স্যার।

মুহূর্তের জন্য দুজনেই চুপচাপ। তরুণ আবার বলে, আক্ৰায় পোস্টিং পেয়ে মনে মনে বেশ বিরক্ত হয়েছিলাম, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ভালোই…।

পরমেশ্বরন ওয়ারলেস ট্রানসক্রিপ্টের ফাইলটা সরিয়ে রেখে বললেন, ব্ল্যাক আফ্রিকায় পোস্টিং না পেলে কোনো ডিপ্লোম্যাটই ঠিক পুরোপুরি ডিপ্লোম্যাট হতে পারে না।

আজ সত্যি সত্যিই সে-কথা বিশ্বাস করি।

রেঙ্গুন থেকে ঘানা। তরুণ মোটেও খুশি হতে পারেননি! ভেবেছিলেন কন্টিনেন্টে পোস্টিং পাবেন। কিছুদিন আগে ফরেন সার্ভিস ইন্সপেক্টরেটের একজন ডেপুটি সেক্রেটারি রেঙ্গুনের ইন্ডিয়ান এম্বাসী ভিজিট করতে এসে বলেছিলেন, ঠিক মনে নেই, বাট সামওয়ান টোল্ড মী যে তুমি এবার কন্টিনেটে কোনো পোস্টিং পাবে।

ফরেন সার্ভিসের অধিকাংশ নবীন কূটনীতিবিদদের মতো ব্ল্যাক আফ্রিকার নাম শুনেই তরুণের পিত্তি জ্বলে উঠেছিল। একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে স্বয়ং অ্যাম্বাসেডরকে পর্যন্ত মনের কথা জানিয়েছিল। অ্যাম্বাসেডর তরুণের কথা শুনে শুধু মুচকি হেসেছিলেন, মুখে কিছু বলেননি। প্রায় মাসখানেক পরে অ্যাম্বাসেডর একদিন তরুণকে ডেকে বললেন, স্পেশ্যাল সেক্রেটারি তোমাকে ঘানাতেই চান।

সুতরাং আর অযথা বাক্যব্যয় না করে তরুণ কোকো আর সোনার দেশ ঘানায় গিয়েছিল। গিনি উপসাগরের পাড়ের আক্ৰায় কাটিয়েছে তিন বছর। কিন্তু গিনি উপসাগর বা দুরের দক্ষিণ অ্যাটলান্টিক মহাসাগরের গর্জন ছাপিয়ে কানে এসেছে প্রেসিডেন্ট নকুমার তীব্র অহমিকার অসহ্য উল্লাস।

স্নিগ্ধ, শান্ত, বিচিত্র প্রকৃতির ছোট্ট কালো দুরন্ত ছেলে হচ্ছে ঘানা। সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে চলে গিয়েছে তুলনাহীন বালুকাময় বেলাভূমি। সেই সুন্দর সুদীর্ঘ বেলাভূমি কখন যেন হারিয়ে যায় ঘন-কালো বনানীর মধ্যে। এই সীমাহীন অরণ্য আর বালুকাময় বেলাভূমিতেই লুকিয়ে আছে সোনার সংসার। তাই তো নাম ছিল পোণ্ডকোস্ট! পশ্চিম আফ্রিকার সাম্রাজ্যবাদ বিদায় নেবার পর এলো ডেন আর ডাচরা। ফেরিওয়ালা সেজে ব্যবসা করতে এলো ইংরেজ। দেখতে দেখতে একদিন ফেরিওয়ালাই হলো মালিক।

তারপর প্রায় একশ বছর ধরে চলল ইংরেজের লুটপাট। জাহাজ বোঝাই করে নিয়ে গেল ম্যাঙ্গানিজ আর কোকো। শত শত বছরে প্রকৃতির আশীর্বাদে যে বনানী গড়ে উঠেছিল, জাহাজ বোঝাই করে তাও নিয়ে গেল। হাজার হাজার সিন্দুক বোঝাই করে নিয়ে গেল সোনা আর হীরের তাল।

ইংরেজ যখন গোন্ডকোস্টের অনন্ত সম্পদ লুটপাটে মত্ত, তখন সবার অলক্ষে চব্বিশ বছরের এক স্কুলমাস্টার পাড়ি দিলেন আমেরিকা। নিঃসম্বল এই কৃষ্ণকায় রোমান ক্যাথলিক যুবক নিদারুণ শীতের রাতে পার্কের বেঞ্চিতে শুয়ে কাটিয়েছেন। ব্ল্যাক নিগার বলে ধিকৃত হয়েছেন আমেরিকার দ্বারে দ্বারে। কিন্তু তবুও তার সাধনায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি। দুটি ব্যাচিলার্স আর দুটি মাস্টার্স ডিগ্রী নেবার পর এলেন অ্যাটলান্টিকের এপারে, ভর্তি হলেন লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিকসে।

এমনি করে বারো বছরের দীর্ঘ সংগ্রাম ও সাধনার পর ছত্রিশ বছরের নক্রুমা ১৯৪৭ সালে ফিরে এলেন নিজের জন্মভূমিতে। স্বাধীনতা আন্দোলনের নেশায় মাতাল করে তুললেন সত্তর লক্ষ দেশবাসীকে। সত্তর লক্ষ কৃষ্ণকায় সিংহের বজ্রমুষ্টিতে ইংরেজ না পালিয়ে পারল না।

সেদিন এই সত্তর লক্ষ মানুষ হাসিমুখে নিজেদের ভবিষ্যৎ তুলে দিল রাষ্ট্রনায়ক নকুমার হাতে।

ঘানার মানুষগুলো কালো কিন্তু বড় হাসি-খুশি ভরা। আনন্দে মেতে উঠতে বোধ করি এদের জুড়ি নেই সারা আফ্রিকায়। দূরাগত মানুষদের এরা বড় ভালোবাসে, বড় সমাদার করে। নিমন্ত্রণ করে বাদামের সুপ খাওয়ায়।

ঘানায় না গেলে কি তরুণ এসব জানত? জানত না। ঘানায় না গেলে আরো অনেক কিছু জানতে পারত না। আক্রা যে এত সুন্দর, এত আধুনিক শহর, তাও জানত না। অন্তরে অন্তরে নিজেদের ঐতিহ্যের জন্য অস্বাভাবিক গর্ববোধ করা সত্ত্বেও ঘানার মানুষ ভয়ে ভয়ে পশ্চিমী আধুনিকতাকে দূরে ঠেলে রাখেনি। তাই তো আক্ৰায় রয়েছে লারন্দির মত বিখ্যাত নাইটক্লাব।

তিন তিনটি বছর আক্ৰায় কাটিয়ে এসে তরুণের বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই।…

মিঃ পরমেশ্বরন লাইটার দিয়ে সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে হঠাৎ মুখ তুলে তাকালেন। তরুণের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে একটু হাসলেন। প্রশ্ন করলেন, প্রেসিডেন্ট নক্রুমাকে কেমন লাগলো?

অফিসিয়ালি অর আন-অফিসিয়ালি জানতে চাইছেন?

তুমি সত্যি ডিপ্লোম্যাট হয়েছ। টেল মী ইওর পার্সোনাল ওপিনিয়ন।

একজন অসামান্য প্রতিভা, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, তবে…

তবে কি?

যেভাবে চলছেন তাতে কিছুই বলা যায় না।

তার মানে?

প্রায় তিনশো কোটি টাকা ধার নেবার পরও যে দেশের অর্থনীতি টলমল করছে, সেই দেশের প্রেসিডেন্ট যদি উনিশ-কুড়ি লক্ষ টাকা ব্যয়ে নিজের মর্মর-মূতি তৈরি করতে যান, তাহলে দেশের মানুষ কতদিন বরদাস্ত করবে তা বলা কঠিন।

ইউ আর রাইট মাই বয়।

এবার তরুণ হাসিমুখে বলে, তবে স্যার, প্রেসিডেন্ট নক্রুমা হ্যাঁজ এ চার্মিং পার্সোনালিটি। এমন ব্যক্তিত্ব যে কেউটে সাপকেও বশ করতে পারেন।

সাপুড়ে কিন্তু সাপের ছোবলেই মরে, তা জান তো?

দ্যাটস রাইট স্যার।

তরুণ মিত্র সম্পর্কে পরমেশ্বরনের হৃদয়ে বেশ কিছুটা কোমল জায়গা রয়েছে। কনিষ্ঠ সহকর্মীরূপে তরুণকে ভালোবাসার অনেক কারণ আছে। স্মার্ট, হ্যাঁন্ডসাম, ইন্টেলিজেন্ট। যে কোনো কাজের দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। তাছাড়া কুটনৈতিক দুনিয়ার গোপন খবর জোগাড় করতে তরুণের জুড়ি ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসে খুব বেশি নেই।

কেন, সেবার? টোকিও থেকে প্যান আমেরিকান ফ্লাইটে দিল্লি ফেরার পথে দুজন পাকিস্তানী ওর সহযাত্রী ছিলেন। পাকিস্তানী ডিপ্লোম্যাটরা ভাবতে পারেননি তাদের পিছনেই ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসের তরুণ মিত্র বসেছিলেন। ওঁদের কথাবার্তায় তরুণ জানতে পারে, ইউ-এস-এয়ারফোর্সের একদল সিনিয়র অফিসার মাসখানেকের মধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত দেখতে আসবেন। তার কিছুদিনের মধ্যেই কয়েক হাজার অফিসারের কোয়ার্টার তৈরি করা সম্ভব হবে? তাও আবার গিলগিট-পেশোয়ারের মতো জায়গায়!

জহুরীর কাছে কাঁচ আর হীরের পার্থক্য ধরতে যেমন কষ্ট হয় না, বুদ্ধিমান ডিপ্লোম্যাটের কাছেও তেমনি এই সব টুকরো টুকরো খবরের অনেক দাম, অনেক গুরুত্ব। তরুণ বেশ অনুমান করতে পারল পাকিস্তানে নাটকীয় কিছু ঘটছে।

পালামে যখন ল্যান্ড করল তখন সন্ধ্যা সাতটা। অফিস বন্ধ হয়ে গেছে। এয়ারপোর্ট থেকেই জয়েন্ট সেক্রেটারিকে টেলিফোন করল, কিন্তু পেল না। খবরের গুরুত্ব উপলব্ধি করে বিনা দ্বিধায় স্বয়ং ফরেন সেক্রেটারিকেই ফোন করল, স্যার, মাপ করবেন, বাট দেয়ার ইজ সামথিং ভেরী ইম্পর্টান্ট। জয়েন্ট সেক্রেটারিকে না পেয়ে আপনাকেই বিরক্ত করতে বাধ্য হচ্ছি।

পালাম থেকে ট্যাক্সি নিয়ে তরুণ ছুটে গিয়েছিল আকবর রোডে ফরেন সেক্রেটারির বাড়ি। বলেছিল, স্যার, ওঁদের কথা শুনে মনে হলো ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয়। সন্দেহটা আরো গাঢ় হলো যখন দেখলাম ওঁরা ব্যাংককে নেমে সিঙ্গাপুরের প্লেন ধরতে ছুটে গেলেন। আই অ্যাম সিওর ওঁরা কে-এল-এম ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর থেকে কলম্বো হয়ে করাচি গেলেন।

ডিনারের সময় হয়েছিল কিন্তু ডিনার না খেয়েই বাইরে বেরুবার জন্যে তৈরি হলেন ফরেন সেক্রেটারি। ড্রাইভারকে গাড়ি আনার কথা বলে ভিতরের ঘরে গিয়েই প্রাইম মিনিস্টারকে টেলিফোন করে শুধু বললেন, খুব জরুরি ব্যাপার। এক্ষুনি একটু দেখা করতে চাই স্যার।

ফরেন সেক্রেটারি তরুণকে নিয়ে তক্ষুনি প্রাইম মিনিস্টারের কাছে গেলেন। আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে ডিনার খেতে খেতে উঠে এলেন প্রাইম মিনিস্টার। সব শুনে বেশ চিন্তিত হলেন। ছোট্ট একটা মন্তব্য করলেন, ইন্টেলিজেন্স কিছু সন্দেহ করছিল বেশ কিছুকাল ধরেই।

সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর ডাইরেক্টরকে সঙ্গে সঙ্গে ডেকে পাঠানো হলো প্রাইম মিনিস্টার্স হাউসে। তিনজনে মিলে শলাপরামর্শ শুরু হবার আগেই তরুণ বিদায় নিল।

এ খবর ফরেন মিনিস্ট্রির অনেকেই অনেক কাল জানতেন না। পরে অবশ্য অনেকেই জেনেছিলেন। স্ট্যালিনের রাজত্বকালে মস্কোর ইন্ডিয়ান এম্বাসীতে পরমেশ্বরন যখন পলিটিক্যাল কাউন্সেলার, তরুণ তখন তার অধীনে কাজ করেছে এবং একবার নয়, অনেকবার কর্মদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে।

পরমেশ্বরন তরুণকে নিজের কাছে রাখতে পারলে সব চাইতে সুখী হন। সব সময় তা সম্ভব হয় না। তবে ঘানা থেকে ফেরার আগেই তরুণকে ইউনাইটেড নেশনস পাঠাবার ব্যবস্থা করেছিলেন পরমেশ্বরন।

জান তো এবার তুমি ইউনাইটেড নেশনস-এ যাচ্ছো?

হাসি হাসি মুখে তরুণ উত্তর দেয়, হ্যাঁ স্যার।

বছর দুই-তিন ওখানে থাকলে তুমি একটি কমপ্লিট ডিপ্লোম্যাট হবে। পরমেশ্বরন একটু থেমে আবার বলেন, মেন পলিটিক্যাল কমিটিতে কাজ করলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতি তোমার কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে!

টেলিফোন বেজে উঠল। কথা বললেন। রিসিভার নামিয়ে রাখলেন।

তরুণ বলল, মেন পলিটিক্যাল কমিটিতে তো পার্লামেন্টের একজন মেম্বার থাকবেন।

হ্যাঁ, একজন এমপি থাকবেন। তিনি তো তোমাদেরই তৈরি বক্তৃতা শুধু রিডিং পড়বেন। তবে ওঁদের নিয়ে কোনো ঝামেলা হয় না। ওঁরা সরকারি পয়সায় কয়েক মাস নিউইয়র্কে থাকতে পারলেই মহা খুশি। তারপর খবরের কাগজের পাতায় যদি দু প্যারা বক্তৃতা ছাপা হয় তাহলে তো কথাই নেই।

তরুণ মুচকি মুচকি হাসে। বিদেশে থাকবার সময় কয়েকজন ওই ধরনের লোকের দর্শনলাভও হয়েছে ওই সামান্য অভিজ্ঞতাতেই।

যাই হোক সারা পৃথিবীর টপ ডিপ্লোম্যাটদের সঙ্গে মেশবার এমন সুযোগ আর পাবে না। লিফট-এ উঠতে নামতে, ক্যাফেটেরিয়াতে চা-কফি-লাঞ্চ খেতে খেতে দু-চারজন ফরেন মিনিস্টারের সঙ্গে দেখা হবেই।

দিল্লিতে আসতে না আসতেই তরুণ আবার ইউনাইটেড নেশনস-এ যাচ্ছে শুনে অনেকেই চমকে উঠলেন। ডিপ্লোম্যাটদের কাছে এর বিরাট মর্যাদা।

সন্ধের পর কনস্টিটিউশন হাউসের ওই একখানা ঘরের আস্তানায় তরুণ পা দিতে না দিতেই টেলিফোন বেজে উঠল।

কনগ্রাচুলেশনস।

তরুণ চমকে গেল। এরই মধ্যে খবর ছড়িয়ে গেছে? টেলিফোন নামিয়ে রাখতে রাখতে ভাবল, হয়তো কাল ভোরেই দালালের দল হাজির হবে। বলবে, এক্সকিউজ মী স্যার। আপনি তো আবার বিদেশে যাচ্ছেন। আপনার টেপ রেকর্ডার, ট্রানজিস্টার, ক্যামেরা, বাইনোকুলার, ডিনার সেট, ওভার কোট, নাইলন শার্ট ইত্যাদি ইত্যাদি সব কিছু কিনতেই আমরা রাজি।

ভাবতেও গা-টা ঘিনঘিনিয়ে উঠল!

কিন্তু কি করবে? এর নাম দিল্লি। দেওয়ালে গান্ধীর ফটো লটকিয়ে ফ্রীজে বিদায় লুকিয়ে রাখাই এখানকার সামাজিক মর্যাদার অন্যতম নিদর্শন। অতীত দিনের বনেদী বাঙালির বাড়ির বৈঠকখানায় যেমন আলমারি ভর্তি সবুজপত্র দেখা যেত, তেমনি আজকের দিল্লির সম্রান্ত মানুষের ড্রইংরুমে দেখা যায় ওয়াইন গ্লাস আর ডিক্যান্টার-এর প্রদর্শনী। সারা পৃথিবীর মধ্যে দিল্লিই একমাত্র শহর যেখানে ড্রইংরুমে ফ্রীজ রেখে প্রচার করা হয় ঐশ্বর্যের মহিমা।

এসব দেখতে ভারি মজা লাগে তরুণের। কূটনীতিবিদদের কদর সব দেশেই আছে, কিন্তু ভারতবর্ষের মানুষ কূটনীতিবিদ বা এম্বাসীর কর্মী দেখলে একটু যেন বেশি গদগদ হয়ে পড়ে। টাটা কোম্পানি বা বামা শেলের অফিসার এবং ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের চাইতে রেঙ্গুন বা ওয়াশিংটন ভারতীয় দূতাবাসের কেরানীর মর্যাদা এখানে অনেক বেশি। সত্যিকার ডিপ্লোম্যাট হলে তো কথাই নেই! হবে না? ওঁরা যে বিদেশে ঘুরে বেড়ান, টেপ-রেকর্ডার ট্রানজিস্টার-নাইলনের শার্ট আনতে পারেন! ভারতবর্ষের মানুষ নাকি ত্যাগ-তিতিক্ষার আদর্শে দীক্ষিত! অথচ একটা সুইস ঘড়ি বা জাপানী ক্যামেরা দেখলে তো অধিকাংশ মানুষের জিভের জল গড়ায়!

তবে হ্যাংলামিটা যেন দিল্লিতেই বেশি।

গুডমর্নিং।

গুডমর্নিং!

মিস ভরদ্বাজ বলছি। চিনতে পারেন?

মাই গড! যাকে দেখলে অ্যাম্বাসেডররা পর্যন্ত গাড়ি থামিয়ে লিফট দেন, তাকে তরুণ মিত্র ভুলবে?

মিস ভরদ্বাজ কোনো উত্তর দিলেন না। কিন্তু বেশ বোঝা গেল বড় খুশি হয়েছেন। ছোট্ট একটু মিষ্টি হাসির রেশ ভেসে এলো টেলিফোনে।

তরুণ মিত্র আবার বলেন, বলুন কি খবর? কেমন আছেন?

মেনি থ্যাঙ্কস! ভালোই আছি।

ইতালীয়ান এম্বাসির এক ককটেল পার্টিতে মিস ভরদ্বাজের সঙ্গে তরুণ মিত্রের প্রথম আলাপ। ইন্টিরিয়র ডেকরেটর মিস ভরদ্বাজ আজেবাজে খদ্দেরের কাজ পছন্দ করেন না। শুধু বিদেশি ডিপ্লোম্যাটদের কাজ করেন উনি। ইতালীয়ন অ্যাম্বাসেডরের সিটিংরুম ও ড্রইংরুমও ডিজাইন করেছেন মিস ভরদ্বাজ। এ কাজ খুব বেশি দিন করছেন না। নতুন বিজনেস শিকারের আশায় কূটনৈতিক দুনিয়ায় নিত্য ঘোরাঘুরি করছেন।

দিল্লির ইন্টিরিয়র ডেকরেটররা শুধু ড্রইংরুম বা অফিসরুমই সাজিয়ে-গুছিয়ে দেন না, মনে হয় ভালো ভালো খদ্দেরদের মনের অন্দরমহলও সাজিয়ে-গুছিয়ে দিতে ভালোবাসেন। তাছাড়া দেশি বিদেশি ডিপ্লোম্যাটদের সঙ্গে একটু নিবিড় করে মেলামেশায় ওদেরও আরো অনেকের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। মিস ভরদ্বাজ সবে এই পথে পা দিয়েছেন। মিস প্রমীলা কাউলের মতো নাম, যশ, অর্থ, প্রতিপত্তি অর্জনে এখনও অনেক দেরি।

মিস কাউলকে নিয়ে কত বিদেশি ডিপ্লোম্যাট যে বিনিদ্র রজনী যাপন করেন, তার হিসাব দেওয়া মুশকিল। জংপুরার বীরবল রোডে মিস কাউলের ফ্ল্যাটে যান। সকাল, দুপুরে, বিকেলে-যখন ইচ্ছা। সব সময়ই দু-চারজন ডিপ্লোম্যাটকে দেখতে পাবেন। অবশ্য সন্ধের পর মিস কাউলকে আর পাবেন না। পার্টি, ককটেল, ডিনার। সব শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়। একটা, দেড়টা, দুটো, আড়াইটে। উইক-এস্তের পার্টিগুলো থেকে ফিরতে কখনও কখনও আরো দেরি হয়। মিঃ পার্কার, মিঃ বার্গম্যান বা আরো অনেকে অজন্তা-ইলোরা বা খাজুরাহের প্রাণহীন মর্মরমূর্তি দেখতে যাবার সময় প্রাণচঞ্চল মন-মাতানো মিস কাউলকে পাশে না পেলে শান্তি পান না।

দিল্লিবাসী বিদেশি ডিপ্লোম্যাটদের অনেকেই সামারে পাড়ি দেন নিজের নিজের দেশে। বিদেশি কূটনীতিবিদদের চারপাশে রোদন ভরা বসন্ত। মিস কাউলের মতো যাঁরা পার্কারের সঙ্গে একই প্লেনে সামার-কোর্সে যোগ দেবার জন্যে সেই সুদূর সাগর পারের অচিন দেশে যেতে না পারেন, তারা তখন চেমসফোর্ড ক্লাবে বিজনেসম্যান আর কন্ট্রাক্টরদের সঙ্গ দান করেন। হয়তো মুসৌরী বা নৈনীতাল ঘুরে আসেন।

মিস ভরদ্বাজ অবশ্য এখনও বিদেশি ইউনিভার্সিটির সামার কোর্সে যোগ দেবার আমন্ত্রণ পাবার মতো হতে পারেননি। তবে- যাক গে সেসব।

কখনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে, কখনও আবার কিছু না বলেই মিস ভরদ্বাজ তরুণের কাছে আসা-যাওয়া শুরু করলেন।

কি ব্যাপার? তরুণ মিস ভরদ্বাজকে অভ্যর্থনা জানাতে জানাতে প্রশ্ন করে।

কেন, ডিসটার্ব করলাম নাকি?

মাই গড! ব্যাচিলার তরুণ মিত্রের ফ্ল্যাটে আপনার মতো অতিথির বিশেষ আগমন হয় না তো, তাই…।

সো হোয়াট?

তরুণ মিস ভরদ্বাজকে অভ্যর্থনা করে ড্রইংরুমে বসায়। গাড়োয়ালী ভৃত্যকে কফি দিতে বলে।

তরুণের ধারণা দিল্লির মেয়ে আর মাছির চাইতে অসভ্য কিছু হতে পারে না। এরা যে কোথা থেকে কিসের জীবাণু-বীজাণু এনে ছড়িয়ে দেবে, তা কেউ টের পাবে না। মিস ভরদ্বাজ নিবিড়ভাবে মিশতে চাইলেও তরুণ পারে না নিজেকে বিলিয়ে দিতে। মামুলি কথাবার্তা হাসি-ঠাট্টা আর কফির পরই ইতি টানতে চায় সে। এক্সকিউজ মী মিস ভরদ্বাজ, একটা। অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে…। সী ইউ এগেন।

মিস ভরদ্বাজ তবু তরুণের আশেপাশে ভনভন করতে ছাড়ে না। সময় সুযোগ পেলেই হাজির হয়। এমনি করেই একদিন থলি থেকে বেড়ালছানা বেরিয়ে পড়ে।

আই ওয়াজ টয়িং উইথ দি আইডিয়া অফ গোয়িং টু দি স্টেটস।

তরুণ খুশি হয়ে বলে, আমেরিকা যাবেন? খুব ভালো কথা।

কিন্তু…।

কিন্তু আবার কী?

ইউ মাস্ট হেল্প মী।

বলুন না কি সাহায্য করতে হবে?

ইন্ডিয়ান ডেলিগেশনে একটা টেম্পোরারি অ্যাপয়েন্টমেন্ট…।

আই অ্যাম সরি মিস ভরদ্বাজ, ও তো আমার ক্ষমতার বাইরে তাছাড়া…।

তাছাড়া আবার কি?

তরুণ মিত্র মিস ভরদ্বাজকে খুশি করেনি। কিন্তু বছর খানেক পরেই এই অনন্যার দেখা পেয়েছিল নিউইয়র্কে।…

তরুণের ভারি মজা লাগে দিল্লির কথা ভাবতে। আজকের মতো তখন কার্জন রোডে এক্সটারন্যাল অ্যাফেয়ার্স হস্টেল, আশেপাশের এমপিদের বাংলোগুলোকে উপহাস করার জন্য মাথা তুলে দাঁড়াননি। কার্জন রোডের নোংরা সঁতসেঁতে ব্যারাক কনস্টিটিউশন হাউস নাম নিয়ে তখন আভিজাত্যের বড়াই করত। হরেক-রকমের নারী-পুরুষের বাস ছিল, এই কনস্টিটিউশন হাউসে। রাত দশটা সাড়ে দশটায় ডাইনিং হলের সার্ভিস বন্ধ হতো কিন্তু ঘরে ঘরে অমৃতরসধারা পানের উৎসব শুরু হতো তারপরে। সাধারণ মানুষের আসা-যাওয়ার পালা। বন্ধ হতো, শুরু হতো অস্বাভাবিক অসাধারণের আবির্ভাবের পর্ব। সামনের রিসেপশন কাউন্টার এড়িয়ে ওঁরা যাতায়াত করতেন মাঝরাতের আবছা আলোয়। ওই রাতের অন্ধকারে কতজনের সৌভাগ্যসূর্য উঠত, আবার অস্ত যেতো।

চেক ন্যাশনাল ডে-র পার্টি অ্যাটেন্ড করে মিঃ ভোসলের বাড়িতে ডিনার খেয়ে ফিরতে ফিরতে তরুণের অনেক রাত হয়ে গেল। কনস্টিটিউশন হাউসের বড় বড় আলোগুলো তখন নিভে গেছে, ফাঁকা দিল্লি শহরটা প্রায় গ্রামের মতো নিঝুম হয়ে পড়েছে। আবছা আলোতে ঘরের চাবিটা দেখবার সময় স্ফুলিঙ্গের মতো এক টুকরো হাসির ঝলক তরুণের কানে আসতেই

মিস ভরদ্বাজ বললেন, দাউ টু-উক্রেটাস!

তার মানে?

এত সহজ কথাটা বুঝলেন না?

আই অ্যাম সরি মিস ভরদ্বাজ।

ওই আবছা আলোতেই মিস ভরদ্বাজের বিদ্রূপ মাখা হাসি ডিপ্লোম্যাট তরুণ মিত্রের দৃষ্টি এড়াল না। করিডরের পিলারটায় হেলান দিয়ে মিস ভরদ্বাজ বললেন, আপনিও তাহলে মাঝরাতের খদ্দের।

মিথ্যা তর্ক করে সময় নষ্ট করে না তরুণ মিত্র। একটু ভুল হলো মিস ভরদ্বাজ। আপনার মতো আমি মাঝরাতের খদ্দের নই, আমি দোকানদার। খদ্দের আসে কিন্তু ফিরিয়ে দিই।…আচ্ছা, গুড নাইট।

সে রাত্রে তরুণ মিত্র আর কিছু জানতে পারেনি, কিন্তু স্থির জানত মিস ভরদ্বাজ আমেরিকা যাবেনই।

কি করবেন মিস ভরদ্বাজ! শেরওয়ানী-চাপকান পরা পলিটিসিয়ানগুলো যেন এক-একটা নেকড়ে বাঘ। শিকার ধরতে এদের জুড়ি বোধকরি ভূ-ভারতে নেই। জর্ডনের জল না হলে যেমন খ্রিস্টানদের কোনো শুভ কাজ হয় না, আমাদের দেশেও তেমনি পলিটিসিয়ান না হলে কোনো কর্ম বা অপকর্ম সম্ভব নয়। একজিবিশন ওপন করতে এসে বনবিহারীলাল মিস ভরদ্বাজের পিঠ চাপড়ে বললেন, এই ওয়ান্ডারফুল ডেকরেশন করেছে এই সুইট ছোট্ট মেয়েটা!

বাহাদুর শার পর বিহারীলালই দিল্লির সর্বময় অধীশ্বর হয়েছেন। তার এই প্রশংসায় জেনারেল সেক্রেটারি মিসেস খাতুন পর্যন্ত গলে গেলেন, হ জী, এহি লেড়কী আকেলা সব কুছ…

সেই হলো শুরু। শেষ? সেকথা তরুণ মিত্র জানে না। যে দেশে বাঈজীবাড়ি আর ধর্মশালা প্রায় সমান সমান, সে দেশের পবিত্র মাটিতে মিস ভরদ্বাজের কাহিনির যে কোথায় শেষ তা সে জানে না। ডিপ্লোম্যাট তরুণ মনে মনে ভাবে ডিপ্লোম্যাসী রপ্ত করবার জন্য পয়সা খরচা করে জেনেভায় যাবার কোনো অর্থ হয়? দেশের অসংখ্য মেয়েগুলোর সর্বনাশ করেও যারা দেশনেতা বলে পূজ্য, বেবী ফুডে ভেজাল দেবার পরও যাঁরা ধর্মশালা গড়ে হাততালি আদায় করতে পারেন, তাদের চাইতে বড় ডিপ্লোম্যাট আর কোনো দেশে পাওয়া সম্ভব!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *