০৬-১০. পুরো আধটি ঘণ্টা ধরে

পুরো আধটি ঘণ্টা ধরে আমাকে দ্বিতীয় সৈনিকের পার্ট শেখাল কালো-মাস্টার। বলল, ওতেও হল না, পাখি-পড়া করিয়ে ছেড়ে দেব কেমন দেখো। বাবা! তোমার থেকে কত বড়ো বড়ো বাহাদুরকে অমনি অমনি তৈরি করে দিয়েছি-না! পরে যখন তাদের পাখনা গজাল তখন আর আমার কথা মনে পড়ে না। সে যাক গে, আজ ওই ছাদাটা দিয়ে তোমাদের মওড়া দেখব। দেখো, কালো-মাস্টারের মান রেখো।

একগাল হেসে আমার দিকে তাকিয়ে সে আরও বললে, কী, হল কী কর্তা? আজ মুখটা অমন গোমড়া কেন? কেউ কিছু বলেছে নাকি? বলল তো তার মুণ্ডুটা ছিঁড়ে নিয়ে আসি।

তখন বলতে হল সব কথা–

–দেখো, আমাকে যা খুশি বলুকগে, তাতে আমার ততটা এসে যায় না। কিন্তু বিশেকে নিয়ে ওরা ওভাবে কথা বললে রাগে আমার গা জ্বলে যায়। বিশের বিষয় ওরা কী জানে যে যা-তা বলবে? তাকে দেখেছে কখনো?

কালো-মাস্টার গম্ভীর হয়ে গেল।

-কেউ দেখল না বিশেকে, শুধু একা তোমার সঙ্গে ভাব? হা গো কত্তা, অপরাধ নিয়ো না, কিন্তু অমন লুকিয়ে-চুরিয়ে সে আসেই-বা কেন? ভালোমানুষরা তো বুক ফুলিয়ে সোজা পথে আসে। শেষটা তোমাকে কোনো বিপদে ফেলে দেবে না তো?

শুনে আমি লাফিয়ে উঠলাম, কী যে বল কালো-মাস্টার! তুমি বিশেকে জান না তাই ও-রকম। বলছ। এ-বাড়ির লোকরা এত খারাপ, তা বিশে ওদের সঙ্গে মিশবে কেন? তা ছাড়া ওই সিংহ-না, ও তো খারাপ লোক দেখলেই তাকে কামড়ে-টামড়ে একাকার করে দেয়। কী করে আমাদের বাড়ির লোকদের সঙ্গে মিশবে শুনি? আমার মা কিংবা আমার ছোটোভাই নিমকি হলে অন্য কথা ছিল।

কালো-মাস্টার আমার আর-একটু কাছে ঘেঁষে বসে বলল, ও, তোমার মা ভাই তাহলে ওকে চেনে? তবে তো কোনো ভাবনা নেই!

–না, ঠিক চেনে না, মানে দেখেনি তো কখনো, চিনবে কোত্থেকে! তবে আমি বললেই বুঝবে বিশে কত ভালো। বিশে একবার একলা একটা ডাকাত ধরেছিল তা জান? ওদের দ্বীপের লোকরা সমুদ্রের তলা থেকে মুক্তো তুলে আনে, সেই মুক্তো একটা ঝুলিতে করে বিশে এখানে বিক্রি করতে এনেছিল। প্রাণে ভয় নেই বিশের, রাত্তির বেলায় অন্ধকার গলি দিয়ে একা যাচ্ছে, অমনি ডাকাত এসে দিয়েছে ঝুলিতে টান! আর যাবে কোথায়, অমনি ঘুরে দাঁড়িয়ে ধরেছে বিশে তাকে! ধরেই পিটিয়ে তাকে আধমরা করে ফেলেছে! তারপর তারই গামছা দিয়ে পাছমোড়া করে বেঁধে তাকে থানার উঠোনে ফেলে দিয়ে চলে গিয়েছিল।

শুনে কালো-মাস্টারের চোখ ছানাবড়া!

–আঁ! অমনি ফেলে দিয়ে গেল? দারোগার কাছে জিম্মে করে দিল না? আবার যে ডাকাতি করবে।

–আরে না না, তাকে নাকে খত দিইয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিল আর কখনো এমন কাজ করবে, করলে ওকে চুলচেরা করে দেওয়া হবে বলে শাসিয়ে রাখল। পাগল নাকি, আর ডাকাতি করে সে! বিশের ওই অসুরের মতো চেহারা দেখেই তার হয়ে গেছে! বিভুদা থেকে থেকে আমাকে ক্যাংলা বলে ডাকে, কিন্তু আমার বন্ধু বিশের সঙ্গে শুধু বিভুদা কেন, ছোটকা বিভুদা বড়দা মেজদা সবাই মিলেও পেরে উঠবে না।

এই বলে উঠে যাচ্ছি এমন সময় কালো-মাস্টার আমার হাতদুটো ধরে বললে, ও কত্তা, ওই শিশুপালের পার্টটা কে করবে বললে না?

–বলব আবার কী? লোকই পাওয়া যাচ্ছে না।

-কেন, তোমার ছোটকা সবাইকে শেখাচ্ছেন, উনি নিজে করেন না কেন?

 –আহা, ছোটকা করবেন কী করে? ওঁর যে কিছুই মনে থাকে না, উনি পার্ট মুখস্থ করবেন কী করে? উনি তো রোজ বাজার থেকে ভুলে গিয়ে যা-তা আনেন বলে রাগারাগি হয়। কিছু মনে থাকে না বলেই তো কোনো কাজও করেন না। বড়োকাকা কারবার দেখতে বলেন, তা উনি হিসেব রাখতেও ভুলে গেছেন বলে সেখানে যান না। উনি পার্ট করবেন কী করে?

কালো-মাস্টার তখন বললে, তা হলে তোমার বন্ধু বিশেকে পার্টটা দাও না কেন!

-না না, তাই কখনো হয়?

–কেন, ও বুঝি থিয়েটার কত্তে পারে না?

ভারি বিরক্ত লাগল। এমন বোকার মতো কথা বলে লোকটা! বললাম, তা পারবে না কেন? এসব সামান্য পার্ট করা ওর পক্ষে কিছুই নয়। জানো, ওকে একবার শত্রুরা আর একটু হলেই ধরেছিল, তখন ও শত্রুদের সর্দার সেজে ওদের নাকের সামনে দিয়ে চলে এসেছিল। কেউ টেরও পায়নি! বললাম-না, ও এ বাড়ির লোকদের সঙ্গে মিশবেই না, তা নাটক করবে কী করে?

চলে এলাম আবার নিজের ঘরে। তারপর সেদিনকার রিহার্সালে সে কী ঝগড়াঝাটি! ভোঁদার দলের দু-জন লোক মজা দেখতে এসেছিল নাকি! দিয়েছে বিভুদা তাদের মেরে অপমান করে তাড়িয়ে। এসব অবশ্যি আমার চোখে দেখা নয়। রিহার্সাল শুরু হবে এমনি সময় ছোটকা হন্তদন্ত হয়ে চাতালে এসে বললেন, কই, নগা আর ভোলা আসেনি এখনও?

ব্যস, কারও মুখে আর কথাটি নেই। ছোটকা ব্যস্ত হয়ে ইদিক-উদিক ঘোরাফেরা করতে করতে বলতে লাগলেন, কী মুশকিল! ওরা দুজনেই শিশুপালের পার্ট করেছে, তাই এত খোশামুদি করে কান্তা কেবিনে চা-চপ খাইয়ে রাজি করিয়ে এলাম; ব্যস্, এখন কারো পাত্তা নেই! তুই এক বার নগাদের বাড়িতে যা দিকিনি বিভু, ওর পার্ট একেবারে মুখস্থ হয়ে আছে–যা তো চট করে।

বিভুদা বললে, যা তো আবার কী? দু-জনেই শিশুপাল সাজবে নাকি?

–আহা, তা কেন! এক জন সাজবে শিশুপাল, অন্য জনকে দ্বিতীয় পাণ্ডব করে দেব বলে এসেছি।

বিভুদা তো থ! দ্বিতীয় পাণ্ডব?

—হ্যাঁ, তাতে অত অবাক হবার কী আছে? তোকে তেমন মানাচ্ছিল না, তা ছাড়া তোর তো আরও চারটে পার্ট আছে। আর অন্য দিকেও অনেক কাজ থাকবে, লোকজন আসবে

বিভুদা থমথমে মুখ করে বললে, সেগুলো তো আর ঠিক কথা-বলা পার্ট নয়, শুধু সেজে গুঁজে ঘুরে বেড়ানো আর মাঝে মাঝে যে আজ্ঞে বলা। সে আমার দরকার নেই, আমি চলি।

ছোটকা ভারি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ও আবার কী বিভু? দু-জনকেই পার্ট না দিলে যে কেউই আসবে না। তুই বাড়ির ছেলে তুই এইটুকু ছাড়তে পারবি নে? ওসব পারিসও না তো ভালো!

শুনে বিভুদা রেগেমেগে চলে যায় আর কী! বড়দা মেজদা তখন মাঝখানে পড়ে বললে, আরে, অত রাগারাগির কী আছে রে বিভু? মেরে তো ওদের তাড়িয়েই দিয়েছিস, ওরা তো আর পার্ট কত্তে আসছে না!

ছোটকা শুনে হতভম্ব!

–মেরে তাড়িয়ে দিযেছে! তার মানে? আমি তাদের বলে-কয়ে পাঠালাম, রাত্রে খেয়ে যাবে বললাম, ওদের জন্য পরোটা কাবাব কিনে আনলাম, আর এখন মেরে তাড়িয়ে দিলেই হল কি না! যা, ফিরিয়ে আনগে যা।

বলে আগুনের ভাঁটার মতো চোখ করে কোমরে হাত দিয়ে বিভুদার সামনে গিয়ে ছোটকা দাঁড়ালেন। বাবা! দেখে আমারই কেমন বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। এক বার তাকিয়ে বাড়ির ভিতের গায়ের ফুটোটার দিকেও তাকালাম, কালো-মাস্টার আছে তো ঠিক? বাইরে থেকে কিছু বুঝবার জো নেই।

আরও সব ছিল আশেপাশে। সব নিয়ে একুশটা কথা-বলা পার্ট, তা ছাড়া দাঁড়ানো পার্ট, জনতা– সে এক ব্যাপার! চাতালে তোক ধরে না। অথচ কারো পার্ট মুখস্থ নেই, ড্রেসের কিছু ঠিক নেই, দাড়ি-গোঁফ নেই, আর সবচেয়ে খারাপ হল শিশুপাল নেই। তারপর বিভুদা যদি রেগেমেগে দলবল নিয়ে চলে যায়, তাহলে তো আমার দ্বিতীয় সৈনিক সাজা ওইখানেই হয়ে গেল!

বড়দা, মেজদা, কুটুবাবু, ঘনাদা, ঘনাদার মামা আরও কারা কারা ছিল। তারা সবাই মিলে বললে, আহা, বটু ছাড়ান দাও, ছাড়ান দাও, যা হবার তা হয়ে গেছে, এখন একটু চায়ের ব্যবস্থা করো দিকিনি। ততক্ষণ রিহার্সাল চলুক, তুমি বরং নিজেই শিশুপালের পার্টটা পড়ে দাও-না।

 চমকে গেলাম। এ যে একেবারে কালো-মাস্টারের মুখের কথা। ছোটকা আমতা আমতা করে বললেন, না, মানে, আমি কী করে পড়ব, স্টেজ-ম্যানেজার কে হবে তাহলে?

আমি বললাম, কেন, বড়োকাকিমা হবেন। উনি তো সব জানেন।

অমনি বিভুদা পারলে আমাকে মারে আর কী!

–যা যা, তোকে অত ফোঁপরদালালি কত্তে হবে না। দাড়ি-গোঁফের কী ব্যবস্থা করেছিস? ঘাবড়ে চুপসে আমি এতটুকু হয়ে গেলাম। আমাকেই যে আবার দাড়ি-গোঁফ আনতে হবে তা মনে ছিল না। আবার মনে হল কালো-মাস্টার তো সবই শুনছে, তার সামনে আমাকে যা-তা বলবে আর আমি কিছু বলব না! চেঁচিয়ে বললাম, হা হা, বলেছি যখন তখন নিশ্চয়ই এনে দেব কোথাও থেকে।

ছোটকা তো হাঁ। বিভুদা বললে, কোথাও থেকে মানে? দাড়ি-গোঁফ কি গাছে হয় যে তুলে আনলেই হল? জ্যাঠামশাইকে লিখেছিস?

উঠে পড়ে বিভুদাকে বললাম, তুমি তোমার নিজের কাজ করো দেখি! দাড়ি-গোঁফ পেলেই হল তো!

ছোটকা বললেন, আঃ বিভু, কেবল ওর পেছনে লাগা। এখন কালকের মধ্যে একটা শিশুপাল ঠিক না হলে তো নাটক বন্ধ করে দিতে হবে! তুই এক বার নগা ভোলার কাছে গিয়ে পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে ফিরিয়ে আনবি কি না বল!

বিভুদা বললে, সে আমি পারব না। এক চড়েই যাদের জিভ বেরিয়ে যায়, তাদের পায়ে আমি ধরতে পারব না।

–তাহলে কী হবে? আমিই একবার চেষ্টা করে দেখব না কি?

বিভুদা দারুণ রেগে গেল, দেখো ছোটকা, যা ইচ্ছে তাই করে করে তোমার বড্ড বাড় বেড়ে গেছে দেখছি। আমার পার্ট যদি অন্য কাউকে দাও, তোমার নাটক কেমন করে হয় দেখব। এক্ষুনি খনা, নন্টু, বাচন, ভুবন, সব্বাইকে নিয়ে ভোঁদার দলে চলে যাবনা! কী রে, তোরা আমার সঙ্গে আছিস তো?

অমনি তারা সবাই চেঁচাতে লাগল, হা ওস্তাদ, আমরা সঙ্গে আছি, আমাদের চপ-কাটলেট খাওয়াও।

ব্ৰজেনদা এবার গম্ভীর মুখে এগিয়ে এলেন, দেখো, নাটক সত্যি হবে কিনা বলল। রোজ সন্ধ্যেবেলা প্রাইভেট টুইশন বন্ধ রেখে আসব, আর ঝগড়াঝাটি ছাড়া আর কিচ্ছু হবে না যদি, তো থাক গে, আমার কাজ নেই।

ছোটকা ওঁর হাত ধরে বললেন, যাস নে ভাই, পরোটা-কাবাবগুলো না খেয়ে যাস নে।

শেষপর্যন্ত রিহার্সাল শুরু হল। ছোটকা শিশুপালের পার্ট ভুলভাল করে পড়তে লাগলেন। আমি কালো-মাস্টার যেমন শিখিয়ে দিয়েছিল তেমনি করে বলে যেতে লাগলাম। শেষের দিকে বড়োকাকা এসেছিলেন শুনে বললেন, বা! বা! তুই যদি আরও এক গজ লম্বা হতিস তো। তোকেই শিশুপাল করে দিতাম।

ছোটকা বিরক্ত হয়ে বললেন, থামো মেজদা, ঠাট্টার সময় ইয়ার্কি ভালো লাগে না।

০৭.

অনেক রাত্রে কালো-মাস্টারের খাবার নিয়ে গুটিগুটি পেরিস্তানে গেলাম। সে তো ওই খাবার দেখেই রেগে কই! বলে, খিদেয় পেট জ্বলে গেল, আর এই অর্ধেক রাত কাবার করে শুধু ক্ষীর আর পাঁউরুটি আর কলা আনলে! আমার মাংস-ভাত কই?

 আমি ভেবেছিলাম দেখা হলেই বুঝি কালো-মাস্টার আমার অভিনয়ের সুখ্যাতি করবে; তা নয়, উলটে আবার রাগ দেখানো হচ্ছে! বললাম, কত কষ্ট করে আনতে হয়, তা তো জান না। ভাত পাব কোথায় শুনি? ডুলি খুলে যা পাই তাই আনি। তাই নিয়ে আবার কত কথা হয়। কত রাগারাগি! তা ছাড়া ভাতের চেয়ে আটা-ময়দা খাওয়া অনেক ভালো।

কালো-মাস্টার মুখের গ্রাস নামিয়ে রেখে বললে, কে বলেছে পাঁউরুটি আটা-ময়দার তৈরি? পষ্ট দেখতে পাচ্ছি শুধু কতকগুলো ফুটো দিয়ে তৈরি। ময়দা দিয়ে কতকগুলো ফুটো একসঙ্গে জুড়ে দিয়েছে, সে কখনো খাওয়া যায়?

বলে আবার চোখের কোণ দিয়ে আমার মুখটা চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল। আমি ঘাসের উপর ওর পাশে বসে বললাম, দেখো, একটা কাজ করলেই তো পার। রাত্রে এদিকে কেউ থাকে না, তুমি তোমার নৌকোটা করে আস্তে আস্তে তীরের কাছ দিয়ে দিয়ে গিয়ে কান্তা কেবিন থেকে মাংস-ভাত খাও না কেন? ওদের নিজেদের ছোটো ঘাট আছে। অনেক মাঝি ওখানে এসে, রান্নাঘরের পেছনে জলের ধারে বসে অ্যাও বড়ো বড়ো থালায় করে ভাত খেয়ে যায় দেখেছি। লাল লঙ্কা দিয়ে ভাত মেখে খায়। সামনে নৌকা বাঁধা থাকে–

কালো-মাস্টার হঠাৎ হাত দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরল, আর বোলো না, কত্তা, জিভে জল ঝরতে লেগেছে। কান্তা কেবিনটা কোথায়?

কিন্তু কান্তা কেবিনে যাবার পথে একটা বিপদ আছে। মাঝখানে পড়ে ওই রেলের লাইনের সেই লোকটার খুপরি ঘর। সে যদি একবার টের পায়! টং লিং–টং লিং টং লিং করে লম্বা একটা মালগাড়ি পুল পার হতে লাগল। দেখি লোকটা তার সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে লাল-সবুজ লণ্ঠন তুলে ধরেছে আর বার বার এদিকে তাকাচ্ছে। কিছু দেখা যায় না জানি, তবু খানিকটা সরে বসলাম।

কালো-মাস্টার বললে, বেশি পহা চাইবে না তো? আমার বড় টানাটানি যাচ্ছে এখন। অথচ দেশের বাড়িতে সোনাদানা গড়াগড়ি যায়। এই গোছ গোছ কাঁসার থালা, তার এক-একটারই ওজন হবে আড়াই সের, আর আমি কিনা একটা ছেঁড়া খবরের কাগজের টুকরোতে একটা নোংরা হাতলভাঙা পেয়ালা বসিয়ে, শুকনো পাঁউরুটি চিবুচ্ছি!

এই বলে এক টুকরো পাঁউরুটি ছিঁড়ে ক্ষীরে ডুবিয়ে জবজবে করে নিয়ে মুখে পুরল। কাল হবে একচোট ওই ক্ষীর নিয়ে। নাকি মালপো হবে বলে তুলে রাখা হয়েছে। রোজ বামুনদিদি বিভুদাকে বকাবকি করে, ও আর কদ্দিন সইবে? পাহারা-টাহারা দিয়ে একাকার করবে, তখন খাবার আনাই দায় হবে।

কালো-মাস্টারকে বললাম, পয়সা আমি কিছু তোমাকে দিতে পারি। দুটো পুজোবার্ষিক কেনবার জন্য মা আমাকে পাঁচ টাকা বারো আনা দিয়েছেন, তার খানিকটা তুমি নিতে পার।

সে তো গেল রেগে।

–ওঃ, একটা দুঃখী মানুষকে দু-বেলা দুমুঠো অখাদ্য দিতে বুঝি ভারি কষ্ট হচ্ছে? থাক তবে, আমি উপোস করেই থাকি!– আচ্ছা, ওদের ওই রান্নাঘরের পেছন দিকটা বেশ নির্জন তো? বাবুরা আশা করি সেখানে আসেটাসে না মানে আমাকে ওরা একবার ধরলে তো আর আস্ত রাখবে না!

বললাম, আরে না, না, অত ভয় কীসের? জান, আমার বন্ধু বিশেকে একবার কুমিরে ধরেছিল। তবু বিশে ভয় পায়নি, এমনি করে কুমিরের দুটি চোয়াল ধরে টেনে হাঁ-টাকে বড়ো করে দিয়ে কামড় ছাড়িয়ে চলে এসেছিল।

কালো-মাস্টার বললে, সে কী! মারল না কুমিরটাকে? আবার শেষটা কাকে ধরবে। নরমাংসের আস্বাদ পেয়েছে!

–আহা! কুমিরের কামড়ে আইডিন দিতে হবে না বুঝি? মারবার সময় কোথায়? তা ছাড়া কামড় ছাড়াবার সময় এমনি জোরে চাড় দিতে হয়েছিল যে তাইতেই কুমিরটা একেবারে মরে গেছল।

কালো-মাস্টার বললে, সাহস দাও তো একটা কথা বলি। আচ্ছা ওই আনাড়িটা কে, ওই যে ভজকট করে শিশুপাল করছিল?

–ওই তো আমার ছোটকা, উনি তো শিশুপাল করবেন না।

পারবেই না তো করবে কোত্থেকে! –আচ্ছা তুমি দাড়ি-গোঁফ দিচ্ছ তাহলে? আমি সব শুনেছি।

আমি আর কী করি, চুপ করে জলের দিকে চেয়ে থাকলাম। হাঙররা এলে ওদের গায়ের সবটা জলের নীচে থাকে, কিচ্ছু দেখা যায় না, খালি ওদের তিনকোনা পাখনাটা জলের উপর ভেসে থাকে, আর তাই দেখে মাঝিমাল্লারা সাবধান হয়ে চলাফেরা করে।

কালো-মাস্টার আমাকে একটা ঠেলা দিয়ে বললে, কই, কিছু বলছ না যে? দাড়ি-গোঁফ কোত্থেকে কিনছ?– ও কী, মুখ ঢাকছ কেন, কাঁদছ নাকি?

নাক টেনে বললাম, না, কঁদব কেন? আমি তো বিশের বন্ধু। কিন্তু ওই বিভুদা সারাক্ষণ খালি খালি বলে দাড়ি-গোঁফ এনে দে, দাড়ি-গোঁফের কী ব্যবস্থা কল্পি– আর খুব জোরে মারে। এই দেখো, হাতের গুলি টেনে নীল করে দিয়েছে।

কালো-মাস্টারের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল, একটা আঙুল দিয়ে আমার ব্যথার উপর হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আমি হেসে বললাম, ও কিছুনা, ও সেরে যাবে। বিশেদের হাত-পা কেটে গেলে ওরা পাথর দিয়ে গাদাফুলের পাতা ঘেঁচে ব্যথার উপর লাগায়, হাড়ভাঙার ডগা বেটে মাখে, একেবারে সেরে যায়। কিন্তু দাড়ি-গোঁফ আমি কোথায় পাব? কিনতে নাকি অনেক টাকা লাগে। বাবা থিয়েটার ভালোবাসেন না। বাবা তো টাকা দেবেন না। শুনলে হয়তো আমার থিয়েটার করাই বন্ধ করে দেবেন।

কালো-মাস্টার নদীর দিকে তাকিয়ে বললে, দাড়ি-গোঁফ তা ভাড়াও পাওয়া যায়।

পাঁচ টাকায় পাওয়া যাবে? তোমাকে মাংস-ভাত খাবার বারো আনা দিলে আমার কাছে যে পাঁচ টাকা থাকবে তাই দিয়ে কি পাওয়া যাবে?

–বাঃ, পুজোবার্ষিক কিনবে না? কী সুন্দর চকচকে মলাট দেয়া থাকে! কিনবে না? না কিনলে তোমার মা কী বলবেন?

মা কাছে থাকলে তো কোনো ভাবনাই ছিল না, এক্ষুনি দাড়ি-গোঁফের ব্যবস্থা করে দিতেন। পরীক্ষার সময় মা আমাকে অঙ্ক বুঝিয়ে দেন, আর মুরগির স্টু বেঁধে খাওয়ান। ঘরে এলেই কীরকম একটা ভালো গন্ধ পাই।

কালো-মাস্টার বললে, ও কত্তা, মার কথা মনে পড়ে কষ্ট হচ্ছে বুঝি? তা মা কাছে না থাকতে পারে, কালো-মাস্টার তো আছে। পয়সাকড়ির জন্য তুমি ভেব না, আমার যা আছে তাইতেই আমার কিছুদিন হেসেখেলে চলে যাবে!

এই বলে ট্যাক থেকে একটা ছোটো কালো থলি বের করে, তার মুখ খুলে, হাতের তেলোয় এতএত পয়সাকড়ি ঢেলে দেখাল। আমি তো অবাক!

–ও কালো-মাস্টার, এত তুমি কোথায় পেলে? ওই দিয়ে তো তুমি সারাজীবন সুখে থাকতে। পার!

কালো-মাস্টার বললে, দেখো, কাল তোমার পুজোবার্ষিক কিনে ফেলল। তার একটা আমাকে পড়তে দিয়ো, কেমন? এখানে একা একা পড়ে থাকি। বাইরে এসে জলের ধারে পা ডুবিয়ে যে বসে থাকব তারও জো নেই, যদি কেউ দেখে ফেলে!– আচ্ছা রেলের ধারের ওই খুপরিঘরের . গোঁফওয়ালা লোকটাকে দেখেছ?

শুনে আমার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। কালো-মাস্টার বললে, উঃ, ওর দিকে তাকানো যায় না। কাজকাম নেই, সারাদিন শুধু খাই আর খাই! জান, ব্যাটা মাঝে মাঝে উঠে একটা নিশান নেড়ে দেয়, তা ছাড়া সারাক্ষণ শুধু খাবার তালেই আছে! কাটছে বাটছে রাঁধছে, তারপর খাচ্ছে, বাসন মাজছে, পান খাচ্ছে! ওইসব কত্তে কত্তে আরেক বার খাবার সময় হয়ে যাচ্ছে! কত আর সইব, একদিন তেড়েফুঁড়ে গিয়ে ওর খাবারে যদি ভাগ না বসাই–ও কী কত্তা, মুখটা এমন কচ্ছ কেন? ভয় পেলে নাকি?

ভয়? বিশের বন্ধুর আবার ভয়? বললাম, না না, ভয়, তবে অন্য লোকের খাবার কক্ষনো খেতে হয় না। বলল, তুমি ওর কাছে যাবে না?

কালো-মাস্টার বললে, না, না, কত্তা, কিচ্ছু ভেব না। আমি জানি তুমি কত কষ্ট করে আমাকে এখানে লুকিয়ে রেখেছ, আমার জন্য খাবার আনছ, আমি আছি বলে তোমার বন্ধু বিশে আসতে পাচ্ছে না। আমি নিতান্ত নেমকহারাম নই, কত্তা। আজ অনেক রাত হল গে, যাও, শুয়ে পড়ো! এই আমি কথা দিলাম, তোমার দাড়ি-গোঁফের আর শিশুপালের ব্যবস্থা আমি করে দেব। এখন অনেক রাত, তুমি শোও গে।

আঃ, শুনে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। গুটিগুটি চলে এলাম। পাঁচিল দিয়ে খিড়কি বাগানে, খিড়কি বাগান থেকে জানালা দিয়ে আমার স্নানের ঘরে, সেখান থেকে আমার শোবার ঘরের মধ্যে।

ঘরে ঢুকে জুতোটা খুলে খাটে সবে বসেছি, এমনি সময় মনে হল কে আমার দরজা ঠেলছে! আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। দাঁতে ছোরা কামড়ে ধরে, খোঁচা খোঁচা চুল লাল চোখ, একটা লোক যদি এবার এসে ঘরে ঢোকে?– বিশে হলে কী করত?

খাট থেকে নেমে, ঘরের আলো জ্বেলে, দরজার ছিটকিনি খুলে দিলাম, হুড়মুড় করে ছোটকা আমার ঘরে ঢুকলেন, কী ঘুম রে বাবা তোর! সেই কখন থেকে দরজা ঠেলছি, সাড়াশব্দ দিচ্ছিস নে! জোরে ডাকতে পারছি না, পাছে বিভুকাকড়াবিছে শুনতে পায়। শোন, নাটক করে কাপটা পেতে পারলে, এশহরে আর আমি মুখ দেখাতে পারব না। এটা তো বুঝিস? শোন, একটা কাজ করে দিস তো একটা খুব ভালো জিনিস দেব তোকে।

আমি বললাম, কী ভালো জিনিস?

ছোটকা গেলেন রেগে। চাপা গলায় বললেন, এমনি দেখে মনে হয় বুঝি গাল টিপলে দুধ বেরুবে। অথচ ভেতরে ভেতরে এত বিষয়বুদ্ধি! যা, তোকে দুটো টাকা দেব।

আমি বললাম, দু-টাকা আমি চাইও না, আর তোমার নেইও। তুমি তো বড়োকাকিমার কাছ থেকে এক টাকা চাচ্ছিলে চা খাবার সময়।

 ছোটকা বললেন, আচ্ছা, আচ্ছা, তোকে একটা ভালো পেনসিলকাটা দেব। এবার হল তো?

আমি বললাম, কোন পেনসিলকাটাটা? ওই যেটা বিভুদা নেয়নি, সেটাতে তো শিষ ভেঙে যায়।

 ছোটকা বললেন, কী মুশকিল! আচ্ছা, তোকে একজোড়া সাদা খরগোশ এনে দোব, আমার বন্ধু জীবনের বাড়ি থেকে। তা হলে হবে তো?

বললাম, ইস্ সত্যি দেবে তো?

–আরে হা! হা! আমার কাজটা করে দে তো আগে।

–বলো, কী কাজ?

–তোর ওই বিশেটিকে রাজি করিয়ে শিশুপালের পাট করাতে হবে। তোর কথায় তো মনে হয় ও সব পারে।

শুনে কাঠ হয়ে গেলাম।

–বিশে তো করবে না ছোটকা।

–আহা, তাকে রাজি করাতে হবে। নইলে কী বলছি? তাকে একবারটি আমার কাছে এনে দিতে পারবি তো? নাকি তাও না?

 আমি চুপ করে থাকলাম। ছোটকা উঠে পড়ে বললেন, তবে থাকগে। কাল সবাইকে বলে দিই যে নাটক হবে না।

–ও মা! নাটক না হলে আমি দ্বিতীয় সৈনিক হব কী করে? ব্যস্ত হয়ে বললাম, না, না, ছোটকা, দেখি একবার চেষ্টা করে।

০৮.

সকালে মার কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়ে কী যে ভালো লাগল। মা লিখেছেন পুজোর ক-দিন নিমকিকে নিয়ে এখানে কাটিয়ে যাবেন, বিভুদাদের নাটক দেখবেন। নিমকিও চিঠির কোনা দিয়ে এত বড়ো কাগ এঁকে দিয়েছে। কতদিন নিমকিকে দেখিনি। বিশেকে নিমকির কথা বলেছি; রাত্রে একা উঠতে ভয় পায়, আমাকে সঙ্গে যেতে হয় এসব কথা বলেছি। বিশে বলেছে ওকে সাহসী করতে হবে। নিমকি এখানে এলে বেশ হবে, সাহসী করবার জন্য ওকে পেরিস্তানে নিয়ে যাব। ওই সরু জায়গাটা একবার পার হতে পারলেই ও সাহসী হয়ে যাবে।

কিন্তু মাকে কিছু বলা যাবে না, বড়োরা বড্ড কথা জিজ্ঞেস করে। তা ছাড়া বিশের কথা শুনলে কী বলবেন কে জানে! হয়তো বলবেন, ওকে ওপরে নিয়ে আয়, আমাদের সঙ্গে চা-জলখাবার খাবে।

বিশে চা খায় না। সিংহকে দিলে হয়তো খেত, কিন্তু বিশে দেয় না। মা তো সিংহকে দেখলে ভয় পাবেন। মা কুকুর ভালোবাসেন না, বলেন ওরা নাকি ভারি নোংরা। একবার বাবা একটা কুকুরবাচ্চা এনেছিলেন; আপিসের সায়েব দিয়েছিল ছোট্ট, হলদে রঙের, ঝাঁকড়া চুল, কুতকুতে চোখ, বাবার কোলে চড়ে এসেছিল। মা দেখেই প্রায় মুচ্ছো যাবার জোগাড়! বললেন, এক্ষুনি ফিরিয়ে দিয়ে এসে ওটাকে। কে ওকে খাওয়াবে, চান করাবে, ময়লা পরিষ্কার করবে শুনি? জগুর যা ঘঁচিবাই, আর আমি তো ছোঁবও না– ও কী করছ, কাছে এনো না বলছি– উঃ!

বলে মা হাত-পা এলিয়ে সোফার ওপর পড়েই গেলেন।

কত করে বললাম নিমকি আর বাবা আর আমি ওর দেখাশুনো করব, সে কিছুতেই কিছু হল। শেষটা বাবা সত্যি সত্যি হরেনকাকাদের বাড়িতে কুকুরটাকে দিয়ে এলেন। ইস, ওদের বাড়ি গিয়ে দেখেছি কুকুরটা ওদের হাত-পা চাটে! সিংহ রোজ আমার নাকমুখ চেটে দেয়, আমি একটুও ভয় পাই না।

সকালের জলখাবার খেয়ে যে-যার কাজে গেলে দেখি একটা তেলেভাজাওয়ালা ঝাঁকা নামিয়ে খিড়কি দোরের ধারে বসেছে। পাঁচিলের ওপর দিয়ে এক ঠোঙা কিনলাম, কিছু মুড়ি কিনলাম ওর কাছেই ছিল। লোকটা খুব খুশি, মাথায় আঁকা তুলতে তুলতে বলতে লাগল, খেয়ে দেখো খোকাবাবু, সারাজীবন জিভ চুলকুবে।

খুব ইচ্ছে করছিল তবু একটাও খাইনি, মা বারণ করেন।

পেরিস্তানে গিয়ে দেখি চোরাঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। অনেক ধাক্কাধাক্কি করবার পর কালো-মাস্টার বেরিয়ে এসে বলল, কী, লাগিয়েছ কী বলো তো? পাড়া ডেকে এখানে এনে জড়ো করবে নাকি?

তারপর আমার হাতে ঠোঙা দেখে খুশি হয়ে বলল, ও কী, এনেছ কী? আহা, বেঁচে থাকো বাপ, এক-শো বছর পরমাই হোক।

এই বলে পেঁয়াজি, বেগুনি, ফুলুরি একটা করে মুখে পোরে আর একমুঠো মুড়ি খায়। আমার তাই দেখে দেখে জিভের জলে পেট ঢাক!

খেয়েদেয়ে কালো-মাস্টার নালার জলে হাত ধুয়ে আমাকে বললে, দেখবে এসো, কী ব্যবস্থা করেছি।

বলে আমাকে চোরাঘরে নিয়ে গেল।

দেখে আমার মাথাটাথা ঘুরে একাকার। দেখলাম ঘরের মাঝখানকার বেদিটার ওপরে সারি সারি দাড়ি-গোঁফ সাজানো। লম্বা দাড়ি, বেঁটে দাড়ি, খোঁচা দাড়ি, ছুঁচলো দাড়ি, চারকোনা দাড়ি, সোজা দাড়ি, কোঁকড়া দাড়ি, লাল দাড়ি, কালো দাড়ি, সাদা দাড়ি, হলদে দাড়ি, ছাগল-দাড়ি, দোভাগা দাড়ি। আর সে কী গোঁফ! বুরুশ গোঁফ, পাকানো গোঁফ, ঝোলা গোঁফ, শজারু গোঁফ, বেড়াল গোঁফ, মাঝখানে চাচাছোলা দু-ধারে গোঁফ, দু-ধারে চঁচাছোলা মাঝখানে গোঁফ, প্রজাপতি গোঁফ, মশার মতো গোঁফ।

দেখে দেখে আর আমার চোখ ফেরে না! এত গোঁফ দিয়ে যে আমাদের সারাজীবন সুখে কেটে যাবে। গলা দিয়ে আমার কথা। বেরোয় না, শেষটা ভাঙা গলায়। বললাম, কোথায় পেলে কালো মাস্টার? খেতে পাও না, গোঁফ-দাড়ি কোথায় পেলে?

কালো-মাস্টার বললে, আমার। নৌকোর ভেতরটা এই দিয়ে ভরে ছিল যে। জলে ভিজে জাবড়া হয়ে এর সঙ্গে ও এঁটে ছিল, এর রং। গড়িয়ে ওর গায়ে লেগে ছিল। এতদিন ধরে রাত জেগে না ঘুমিয়ে না খেয়ে

আড়চোখে একবার আমার দিকে চেয়ে আবার বলতে লাগল, না ঘুমিয়ে, আধপেটা খেয়ে, জট ছাড়িয়ে, রং ধোলাই করে, তেল মাখিয়ে, পাতা কেটে, কোকড়া আঁচড়িয়ে, তবে সে-না ভোল ফিরিয়েছি। এখন এরকম বলা যেতে পারে এরা আমারই হাতে তৈরি। নেবে এগুলো? তাহলে কিন্তু আমার একটা কথা রাখতে হবে।

দাড়ি-গোঁফের উপরে উপুড় হয়ে পড়ে দেখতে লাগলাম। আহা, ওই লালচে পাকানো গোঁফ-জোড়াটি দ্বিতীয় সৈনিকের গোঁফই বটে। হাত বাড়িয়ে আস্তে আস্তে ছুঁতে গেলাম, ফোঁস করে উঠল কালো-মাস্টার।

অবাক হয়ে চেয়ে দেখি এই একটু আগে মুড়ির সঙ্গে তেলেভাজা খেয়ে যার মুখ হাসিতে ভরে ছিল এখন তার অন্য রূপ। পিঠ-বাঁকানো বনবেড়ালের সঙ্গে আর তার কোনো তফাত নেই। চিবিয়ে চিবিয়ে বললে, খবরদার, ওতে হাত দিস নে বলছি। অধম্মের কাজ করে, প্রাণ হাতে করে ওর জন্য আমি বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে পর্যন্ত গা ঢাকা দিয়ে আছি। ছুঁয়ো না বলছি। আগে বলো আমি যা বলব তাই হবে!

ছুটে পালাতে যাচ্ছি, খপ করে আমার হাতের কবজি ধরে ফেলে কালো-মাস্টার বললে, ওঃ! বিশেষ বন্ধু বুঝি বিপদের সময় পালিয়ে যায়! আমি কোথাকার একটা কালো-মাস্টার আমি প্রাণ তুচ্ছ করে দাড়ি-গোঁফ আগলে আছি, খেতে পাই নে, ভালো একটা বিছানা পাই নে, এই আমি যার চারটে বালিশ আর দুটো বড়ো পাশবালিশ না হলে ঘুম হত না–আর দরকারের সময় তুমি দিব্যি চম্পট দিচ্ছ! বিশে শুনলে কী বলবে শুনি?

ব্যস্ত হয়ে বললাম, ইয়ে– না– চলে তো যাচ্ছিলাম না।

সে বললে, তাও ভালো। তবে শোনো, এই দাড়ি-গোঁফ সব তোমাকে দেব, কিন্তু তার বদলে বিশে সাজবে শিশুপাল।

আমার মুখে কথাটি নেই। কালো-মাস্টার আমার দিকে চেয়ে বললে, কী বলতে চাইছিলে বলেই ফেলল। বিশে থিয়েটার করবে না, এই তো? আহা, তুমিও যেমন! আরে আমিই বিশে হয়ে শিশুপাল সাজব, তাও বুঝলে না?

উঃ, বাঁচা গেল! মনটা হালকা হয়ে গেল।

–কিন্তু

কালো-মাস্টার বললে, এর মধ্যে আবার কিন্তু কী? এতে কার কী অসুবিধেটা হচ্ছে শুনি? আমি এখান থেকে না যাওয়া পর্যন্ত বিশে আসছে না এটা তো ঠিক? কাজেই সে কোন গোলমাল করতে পারবে না। তোমার ছোটকারা তো যেমন করে তোক একটা শিশুপাল পেলেই খুশি! তাহলে আর আপত্তিটা কোথায়? আমার জীবনের আশা শিশুপাল সাজব।

বললাম, কিন্তু তোমার শত্রুরা যদি তোমাকে ধরে ফেলে?

কালো-মাস্টার এত জোরে হো-হো করে হেসে উঠল যে আমার ভয় হতে লাগল ওপর থেকে যদি ওরা শুনে ফেলে! কালো-মাস্টার বললে, কিছু মনে কোরো না, আমি যাকে শিশুপাল সাজাব অন্য লোকে তাকে চিনে ফেলবে এ কথা শুনলেও হাসি পায়। কেউ চিনবে না, বুঝলে। আমি শিশুপাল সাজলে আমি আর আমি থাকবনা, সত্যি করে শিশুপাল হয়ে যাব, এও কি বলে দিতে হবে? জানো মণি পালকে এমন জটায়ু সাজিয়েছিলাম যে অনেকদিন পর্যন্ত তার মুখ থেকে কিচিরমিচির ছাড়া কোনো শব্দ বেরুত না।

বললাম, পারবে তো কালো-মাস্টার? পার্ট দেখলে না, রিহার্সাল করলে না, শেষটা সব ডোবাবে না তো?

তাই শুনে সে হাত-পা ছুঁড়ে তখুনি শিশুপালের পার্ট আগাগোড়া এমন চমৎকার বলে যেতে লাগল যে আর আমার কোনো আপত্তিই থাকল না। শুধু ওকে ওই বিশে বলে চালানোতেই যা মুশকিল। সে বুঝিয়ে বললে, বুঝলে, আগে আমি বিশে সাজব। তারপর ওই বিশে শিশুপাল সাজবে। এতে অসুবিধেটা কোথায় বুঝলাম না।

বললাম, বিশের বুকে মড়া মানুষের খুলির নীচে ক্রশ করা হাড় উল্কি করা আছে।

–তা আছে তো তাতে হয়েছে কী? আমিও সবুজ কালি দিয়ে চমৎকার মড়া মানুষের খুলির নীচে ক্রশ করা হাড় আমার বুকে এঁকে নেব। ওসব বাজে কথা রাখো। এখন বলো বিশে আমার চেয়ে কোন দিক দিয়ে ভালো।

বললাম, ইয়ে, বিশের মুখটা

-কী মুখটা? আমি দাড়ি কামিয়ে পাউডার মেখে নিলেও বিশের মুখটা ভালো? বাজে কথা বোলো না, বলো আর কীসে ভালো।

বললাম, কী লম্বা-চওড়া বিশে, হাতের পায়ের গুল কী শক্ত! সঙ্গে সিংহ থাকে।

 কালো-মাস্টার তো অবাক।

–সিংহ থাকে! এই সেদিন-না বললে কুকুর থাকে?

-আহা, ওই একই, কুকুরের নামই সিংহ।

 –কুকুরের নাম সিংহ হবে কেন?

–আহা চট কেন, রিহার্সালের সময় সিংহকে বাড়িতে রেখে আসব। আর হাতের পায়ের গুল যে বলছ, কী এমন মন্দ আমার হাতের পায়ের গুল?

 এই বলে হাত-পা বেঁকিয়ে মাস্ল ফুলিয়ে আমাকে আবার দেখাতে লাগল। দেখে হাসি পেল, কীসে আর কীসে! বললাম, দেখো, তুমি যাই বলনা কেন–

সে আর অপেক্ষা না করে দাড়ি-গোঁফগুলোকে জড়ো করতে লাগল। দ্বিতীয় সৈনিকের গোঁফে যেই হাত দিয়েছে আমি বললাম, কথায় কথায় রাগ কর কেন? দেখি একবার ছোটকার সঙ্গে কথা বলে।

কালো-মাস্টার ছুটে এসে আমার পা দুটো জড়িয়ে ধরল। বলল, দাও বাপ, চাট্টি পায়ের ধুলো দিয়ে কেতাত্থ করে দাও।

ঘরে ফিরে এসে ভেবে দেখলাম এতে খুব সুবিধেই হয়ে যায়। শুধু মিথ্যে করে বিশের নামে কালো-মাস্টারকে চালাতে খারাপ লাগছিল। তবে বিশে যে এতে কিছু মনে করবে না এ আমার খুব জানা ছিল। কারণ যদিও বিশে লোকের সামনে বেরোয় না আর আমাদের বাড়ির লোকদের ভারি ঘেন্না করে, তবু সে কথা তো আর এরা কেউ জানে না। ওরা ভাবে বিশে বুঝি এ-পাড়ার কাছাকাছি কোথাকার একটা বখা ছেলে। তবে আর কালো-মাস্টারকে বিশে বলতে ক্ষতি কী? আমি অবিশ্যি ওকে কালো-মাস্টারই বলব, বিশে বলে ডাকতে পারব না কক্ষনো।

দুপুরে খিচুড়ির সঙ্গে সাত-রকমের ভাজা হয়েছিল। খেতে খেতে সবার সামনেই বললাম, দাড়ি-গোঁফের একটা ব্যবস্থা করেছি ছোটকা, আর বিশে শিশুপালের পার্ট করতে রাজি হয়েছে।

তাই-না শুনে যে যার পিঁড়ি ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বড়োকাকিমার হাতা থেকে আমার পাতে দুটো বড়ো বড়ো মাছের ডিমের বড়া পড়ে গেল। একা বড়োকাকা আর আমি বসে থাকলাম।

 বড়োকাকা খিচুড়ির সঙ্গে কাঁচালঙ্কার কুচিভাজা মাখতে মাখতে বললেন, দাদাকে শেষ পর্যন্ত মত করালি বুঝি? বাবা, আমি বলতে গেলে সে কী রাগ, পারলে থিয়েটার বন্ধ করে দেয়!

আমার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। ডিমের বড়া গলা দিয়ে নামতে চায় না। ছোটকা বললেন, ও কী, চুপ করে রইলি যে? বিশে কখন আসবে?

–বিশে সকলের সঙ্গে এখন রিহার্সাল করতে চাইছে না। আজ অন্যরা চলে গেলে পরে তোমার আর বিভুদার কাছে পার্ট অভ্যাস করে যাবে বলেছে। পরশু একেবারে সবার সঙ্গে রিহার্সাল করবে।

ছোটকা একগাল হেসে বললেন, আঃ, বাঁচালি চাঁদ! মাথা থেকে একটা এক-শো মন বোঝা নামল। হারে, সে ভালো করবে তো?

–ভালো করবে তো মানে? সে ব্ৰজেনদাকেও শেখাতে পারে। জানো, একবার

বিভুদা হাঁড়িমুখ করে বলল, থাক, এখন আর তার গুণের ব্যাখ্যান কত্তে হবে না। পার্ট দিচ্ছি। ওই তার পক্ষে যথেষ্ট। আর দাড়ি-গোঁফ কখন পাচ্ছি? যদি এর মধ্যে কোনো চালাকি থাকে

ছোটকা এক ধমক দিলেন, ঢের হয়েছে বিভু, নিজের এদিকে দুটো কথা বলতে গেলেই জিভ বেরিয়ে যায় আবার তেড়িবেড়ি!

বিভুদাও বললে, তুমিও থামো দিকিনি! নিজে তো লেখা কাগজ সামনে ধরেও যা খেল। দেখাও—

ছোটকা বললেন, আহা, সে আমার কিছু মনে থাকে না বলে। তা ছাড়া প্রযোজক কবে আবার অভিনয় করে?

বড়োকাকা বললেন, এখন যে-যার জায়গায় বসে খেয়ে নাও দিকিনি। হারে চাঁদ, দাড়ি গোঁফগুলো পাওয়া যাবে কখন? আমাকে আবার সাজ গোছাবার ভার দিয়েছে কিনা!

 আমি বললাম, আজ সবাই চলে গেলে বিশে যখন আসবে, ওকে বলে দেব কাল পরশু একদিন সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। ওকে কিন্তু রাত্রে এখানে খেয়ে যেতে বলেছি বড়োকাকা।

ছোটকা বললেন, হ্যাঁ, হা, অবিশ্যি খাবে। আজ আমাদের বড়ো ভালো দিন– পোলাও মাংসের ব্যবস্থা কচ্ছি, দেখ-না।

০৯.

রাতের পোলাও-মাংসের কথা শুনে কালো-মাস্টার সেদিন দুপুরে পাঁউরুটি খেতে আপত্তি করল না। শুধু বললে, হা কত্তা, কাপড়চোপড় নেই, তা মওড়াতে পরব কী?

বললাম, সে একটা ব্যবস্থা করে ফেলব। আমার পাঞ্জাবি পাজামা তোমার হবে না?

সত্যি কথা বলতে কী কালো-মাস্টার মাথায় আমার চেয়ে খুব বেশি লম্বা নয়; রোগা লিকলিকে– ওকে বিশে বলে কী করে যে চালাব তাই ভেবে পাচ্ছিলাম না। ভাগ্যিস বিশেকে কেউ চোখে দেখেনি! এই ছ-ফুট উঁচু ষণ্ডা জোয়ান, হাঁক দিলে গঙ্গার ওপার থেকে শোনা যায়। ওদের দেশে ছোটো ছোটো নানা রকমের আগ্নেয়গিরি আছে, তার এক-একটার চুড়োয় চড়ে ডেকে ডেকে অন্য চুডোর লোকদের সঙ্গে ওরা কথা কয়। দূর থেকে জাহাজ আসছে দেখতে পেলে অমনি জানান দেয়। সেইরকম গলাও বিশের।

টং লিং টং লিং টং লিং করে লম্বা একটা মালগাড়ি পুলের ওপর চড়ল আর সেই গুঁফো লোকটা অমনি সবুজ নিশান হাতে করে এগিয়ে দাঁড়াল। আমিও বাড়ির ছায়াতে আর একটু সেঁদিয়ে গিয়ে অবাক হয়ে বললাম, ও কী কালো-মাস্টার, সবুজ কালি, তুলি-কলম দিয়ে কী করবে? ছবি আঁকবে নাকি?

এই বলে ওর পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম।

ও খুশি হয়ে বলল, ছবিই বটে। জানো কত্তা, সারাজীবন কত যে ছবি এঁকেছি তার ঠিকানা নেই; কত কদাকারকে সুন্দর করেছি, সুন্দরকে করেছি কদাকার! কত বুড়োকে হোকরা বানিয়েছি, ছোকরাকে বুড়ো! কত পালোয়ানকে রোগা বানিয়েছি, রোগাকে পালোয়ান! বিশে হওয়া আমার পক্ষে কী আর অমন শক্ত কথা! এই দেখো, বিশে হওয়ার আমার আর কতটুকু বাকি আছে।

এই বলে আধময়লা গেঞ্জিটাকে খুলে ফেলল। চেয়ে দেখি ওর হাড় জিরজিরে বুকের ওপর সবুজ কালি দিয়ে মড়ার মাথা আঁকা, তার নীচে দুটো হাড় ক্রশ করে বসানো, সে যে মানুষের হাড় সে আর কাউকে বলে দিতে হবে না!

এত ভালো ছবি আঁকে কালো-মাস্টার এ আমি ভাবতেও পারিনি। বললাম, আমার বুকেও ওইরকম এঁকে দাও-না, কালো-মাস্টার!

বলে জামাটা খুলে বসলাম।

কালো-মাস্টার জিভ কেটে বললে, ছি, কী যে বল কত্তা! বিশের বুকে যে উল্কি আঁকা সে কি যার-তার বুকে শোভা পায়? এসো, বরং জোড়া হাঁসের নীচে পদ্মফুল করে দিই।

তাই দিল কালো-মাস্টার। ঠান্ডা ঠান্ডা তুলিকালির টানে কী যে আরাম লাগল! হয়ে গেলে কালো-মাস্টার বললে, দেখো, স্নানের সময় যেন জল না লাগে।

কালো-মাস্টারের যেমন কথা। দু-তিন দিন স্নানই করব না ঠিক করেছি। জামা গায়ে দিয়ে ওপরে যাবার সময়ে ওকে আর এক বার সাবধান করে দিলাম, খুব সাবধান, কালো-মাস্টার, তুমি যে এখানে আছ কেউ যেন টের না পায়। বিশেষ করে খুপরিঘরের ওই লোকটা। জলের ধারে পা ঝুলিয়ে ও-রকম করে বসে থাক কেন? ও তোমাকে একবার দেখতে পেলেই হয়ে গেল। তোমার শিশুপাল সাজা এ আমি বলে দিলাম।

তাই শুনে কালো-মাস্টার একেবারে চোরাকুঠরির ভিতরে গিয়ে বেদিটার উপরে টান হয়ে শুয়ে পড়ল। আমিও আস্তে আস্তে উপরে এসে নিজের ঘরে শুয়ে পড়লাম। একটু ভাবনাও হচ্ছিল, কী জানি ওই লোকটাকে বিশে বলে চালাতে গিয়ে শেষটা না কোনো ফ্যাসাদে পড়ি। বাবা যদি কোনোরকমে টের পান তাহলেই তো গেছি!

বিকেলে কালো-মাস্টারকে আনাই দেখি এক ব্যাপার! সে কিছুতেই পাঁচিলে চড়ে নালার ওপর দিয়ে যেতে পারল না। খালি নীচের দিকে তাকায় আর ওর মাথা ঘোরে। শেষটা ও-পথ ছেড়ে দিলাম। তা ছাড়া সরু জায়গাটাতে হয়তো ওর পেটটা গলতই না। কারণ এদিকে রোগা হলে কী হবে, ওদিকে এই ক-দিনে দিব্যি এক নাহাপাতিয়া বাগিয়েছে।

 অগত্যা সন্ধ্যে লাগলে পর নৌকো বের করে কান্তা কেবিনের একটু আগে গাছগাছড়ায় আড়াল-করা একটা আঘাটায় নামলাম দুজনে। কালো-মাস্টার জলকে বিশ্বাস করে না, নৌকো টেনে ডাঙায় তুলে কারখানার উঁচু পাঁচিলের গা ঘেঁষে ঝোঁপের পেছনে লুকিয়ে রাখল। সেখান থেকে অন্ধকার গলি দিয়ে হেঁটে গেলে আমাদের বাড়িটা বেশি দূরে নয়। গুফো লোকটা রুটি সেঁকছিল, কিছুই লক্ষ করল না।

চাতালে ছোটকা, বিভুদা, ব্রজেনবাবু সবাই ব্যস্ত হয়ে পায়চারি করছেন আর ঘন ঘন ঘড়ি দেখছেন। আমাদের দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তারপর কালো-মাস্টার আলোর নীচে এসে। দাঁড়াতেই মুখে কারো কথা সরে না। ছোটকা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ইয়ে, এই নাকি সেই অসাধারণ বিশে? আশ্চর্য তো। ইয়ে, কী বলে, ও পারবে তো পাট করতে, চাঁদ? নাকি এখনও বল, সব বন্ধ করে দিই।

চেয়ে দেখি কালো-মাস্টারকে ঠিক একটা চোরের মতো দেখাচ্ছে। আমার একটা হাতকাটা খাকি শার্ট আর নীল হাফপ্যান্টের তলা থেকে রোগা-রোগা কালো ঠ্যাং বেরিয়ে রয়েছে, সোজা তাকাচ্ছে না কারো দিকে, সারা গায়ে যেন একটা কেমন ভয় ভয় ভাব, দেখলে পিত্তি জ্বলে যায়। মুখ দেখলে মনে হয় ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না। যেন চোরের হদ্দ।

এগিয়ে এসে বললাম, আচ্ছা ছোটকা, রিহার্সালের পর পোলাও-মাংস খাওয়া তো? বিশে, পার্ট বল।

আর বলতে হল না, কালো-মাস্টার চোখের সামনে বদলে গেল। আলোর নীচে এসে আগাগোড়া শিশুপালের পার্ট বলে যেতে লাগল, আর শুধু শিশুপাল কেন, শ্রীকৃষ্ণ, যুধিষ্ঠির গলা বদলে বদলে সবার পার্ট করে যেতে লাগল্প। শুনে সকলে হাঁ, মুখে কারো কথা সরে না। প্রত্যেকটা পার্ট এত অসম্ভব ভালো করে বলে গেল যে আমি সুষ্ঠু অবাক। বলে তো ছবি আঁকে, অথচ এত ভালো থিয়েটার করে! আশ্চর্য বটে।

কুড়ি মিনিট ধরে ও একাই বলে গেল, তারপর সে অঙ্কটাকে শেষ করে তবে থামল। ছোটকা অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ছি ছি, তোমাদের লজ্জাও করে না।

আর-একটু হলেই হয়েছিল আর কী, বিভুদার দল উঠে দাঁড়িয়েছিল পর্যন্ত, এমন সময় কালো মাস্টার হাতজোড় করে বললে, আপনাদের সকলের সঙ্গে নাটক কত্তে পারাটাকেই আমি সৌভাগ্য বলে মনে করি, নইলে আমার এত কাজের মধ্যে আবার নাটক করার সময় কোথায়? তাহলে গোড়া থেকে আবার শুরু হোক, কেমন?

আর কথাটি নেই, অমনি যে-যার জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল, যাদের পার্ট শেখা হয়নি তারাও দেখি হাতে একটু সময় পেলেই মুখস্থ করতে লেগে গেছে। অন্যদিন সব পালাই পালাই করে, আজ রাত এগারোটা বেজে গেল সেদিকে কারো খেয়ালই নেই। তারপর সে কী খাওয়া, অনেকদিন বাদে প্রাণ ভরে কালো-মাস্টার খেয়ে নিল। শেষে আসর ভেঙে গেল, যে-যার বাড়ি গেল, কালো-মাস্টারও মুখে দুটো পান পুরে পথ ধরল।

 ছোটকা বার বার বলতে লাগলেন, কাল যেন ছটার মধ্যে আসে– সবাইকে তৈরি করে নিতে হবে তো!

উঃফ! এতক্ষণে আমার বুকের ঢিপঢিপুনি থামল। সে মোড় ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেলে বড়োকাকা বললেন, আশ্চর্য! এ-রকম তো আমি ভাবতেও পারিনি! ওকে কোথায় পেলি রে চাঁদ?

আমি তো পালাবার পথ পাই নে। বিভুদা এসে বললে, এসব থিয়েটারি লোকদের সঙ্গে মিশিস কেন রে হতভাগা?

আমি তো অবাক, এ আবার কেমন। কথা! বিপদের সময় উদ্ধার করে দিচ্ছে বলে কোথায় খুশি হবে, না উলটে ধমকানো হচ্ছে! বললাম, হিংসে হচ্ছে। বুঝি? তা ওকে ভালো না লাগে তো চলে যেতে বললেই পার। আমিই তো বলে-কয়ে এনেছি। ও কি সহজে রাজি হয়!

ছোটকা বললেন, তুমি থামো তো বিভু, নিজে মরা সৈনিকের পার্ট করতে পর্যন্ত ভুল কর, তোমার মুখে ওসব কথা শোভা পায় না। বাবা! ভাগ্যিস বিশেকে পাওয়া গেল, তাই ভোঁদার। দলের নাকের তলা থেকে কেমন কাপ ছিনিয়ে আনি দেখো। আর রাত নয়, যা চাঁদ, শুয়ে পড়, কাল আবার আর-একটা দিন আছে তো।

শুলাম বটে, ঘুম আসে না কিছুতেই। কতরকম যে ভাবনা– কালো-মাস্টার ঠিকমতো পৌঁছেছে তো, বিশে বলে ওকে চালাচ্ছি, শেষটা সব ফেঁসে না যায়। যাগে, আর ভেবে কী হবে আর তো কটা দিন। ছোটকা ওকে রোজ রাত্রে খেয়ে যেতে বলেছে, ওর উৎসাহ দেখে কে! আর আশ্চর্য যে অন্য যারা এতদিন ঝিমিয়ে পড়ছিল, তারাও সবাই তড়বড়িয়ে জেগে উঠেছে। আমার তো নিজের পার্ট আগেই মুখস্থ হয়ে গেছিল, এখন অন্য অন্য ছোটো পার্টগুলো সব মুখস্থ করে নিলাম। বলা তো যায় না, লোকের কেমন হঠাৎ হঠাৎ অসুখ করে, মরেও যায় কত লোকে। তখন তো আর ওসব সামান্য কারণে নাটক বন্ধ করে দেওয়া যাবে না!

হঠাৎ মনে হল শিশুপালই যে শুধু পাওয়া গেছে তা তো নয়, দাড়ি-গোঁফেরও একটা ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কী যে আরাম লাগল সে আর কী বলব! আবার সঙ্গেসঙ্গে ভয়ে হাত-পা হিম হয়ে গেল। এই কিছুক্ষণ আগেই নাটক ভেস্তে যাচ্ছিল আর এরই মধ্যে সব ব্যবস্থা হয়ে গেল, মায় কালো-মাস্টারের খাওয়ার কথাটা পর্যন্ত। যাবার আগে ছোটকা বড়কার কাছ থেকে পাঁচ টাকা চেয়ে ওর হাতে গুঁজে দিলেন। কালো-মাস্টার একেবারে গলে জল। পরে একলা পেয়ে আমি ওর কানে কানে ব্যস্ত হয়ে বললাম, ও দিয়ে কী হবে কালো-মাস্টার? আবার যেন দোকানে টোকানে যেয়ো না।

সে একগাল হেসে বললে, অত ভয় করলে কি আমাদের চলে কত্তা? তোমার কোনো ভয় নেই, স্যান্ডো আমার জন্য খাবার কিনে এনে দেবে।

–স্যান্ডো! সে আবার কে?

–ওমা, স্যান্ডোকে চেন না? ওই যে গো রেলে কাজ করে, ঝুলো গোঁফ, খুপরিঘরে নিশেন নাড়ে।

–তুমি ওকে চেন নাকি?

–বাঃ, ওকে চিনব না! তুমি তো সারাদিন আমাকে একা ফেলে নিজে মজা মার, আমি সে-সময়টা কী করে কাটাই ভেবেছ কখনো? কথা না বলে কেউ থাকতে পারে? তাই ওর সঙ্গে ভাব করেছি, তাতে অন্যায়টা কী হল শুনি?

আমি বললাম, তাহলে আমাদের লুকোনো ঘরের কথা ওকে জানিয়েছ, পেরিস্তানের কথাও বলেছ?

কালো-মাস্টার যেন আকাশ থেকে পড়ল। আচ্ছা, আমাকে কী ভাব বলো দিকিনি কত্তা? তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ, আমি কখনো অমন কাজ কত্তে পারি? তোমার কোনো ভয় নেই, ওকে বলেছি– আমি কারখানা-বাড়ির পাহারাওয়ালা, দিনরাত আমার ডিউটি থাকে, তাই খাবার কেনবার সময় পাই না। সারাটা জীবন বুদ্ধি ভেজে খেইছি, আর এখন একটা বাইরের লোকের কাছে সব ভেস্তে দোব! আমি সে ছেলে নই!

শুনে আমি অবাক!

–কিন্তু এরই মধ্যে এত কথা হয়ে গেছে?

–আরে শুধু কি তাই? ও আমার জিনিসপত্তর যখন যা দরকার কিনে রাখবে, আমি গিয়ে নিয়ে আসব। এতে ভয়ের কিছু নেই সেটা তো মান?

বললাম, আর তার বদলে তুমি কী করবে?

কালো-মাস্টার বললে, মুখটা অমন ব্যাজার করে কথা কইছ কেন? তার বদলে ওকে বারোটা কার্ড পাইয়ে দোব বলেছি, ওর বন্ধুদের নিয়ে এসে আমাদের থিয়েটার দেখে যাবে। কথা তো এই। তোমাকে কোনো বিপদে ফেলব না, প্রাণ থাকতে কালো-মাস্টার। যাই, ছোটকা বড়কার কাছে বিদেয় নিয়ে পা বাড়াই।

বলে চলে গেল তো কালো-মাস্টার কিন্তু আমার যে কত কথাই মনে হতে লাগল! প্রথম থেকেই কালো-মাস্টারকে বিশে বলে চালানোটা ঠিক হল কিনা ভেবেই পেলাম না। বিশে জানতে পারলে কী বলবে?

দূর থেকে শুনতে পেলাম পুলের ওপর দিয়ে মালগাড়ি যাচ্ছে টং লিং টং লিং টং লিং–। আওয়াজটা ক্রমে দূরে সরে যেতে লাগল আর আমিও কখন ঘুমিয়ে পড়লাম টের পেলাম না।

১০.

মা নিমকিকে নিয়ে আমাদের নাটক দেখতে আসবেন। বাবাও নাকি আসবেন, বড়ো পিসিমা গিয়ে কী সব বুঝিয়ে এসেছেন, তাই নাকি বাবা আমার নাটক করা দেখতে আসবেন। এখন দাড়ি-গোঁফের কথা উঠলেই তো আমি গেছি। পরদিন আমার ভাবনার কথা শুনে কালো-মাস্টার দাড়ি-গোঁফের বাক্সটা লুকিয়ে এনে ছোটকার কাছে জমা করে দিল। বলল, সাবধানে রাখবেন স্যার, এর ওপর মেলা লোকের নজর।

ছোটকা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, সে কী বিশু, এসব কী তবে চাঁদের আনা নয়?

কালো-মাস্টার হেসে বললে, জিনিস চেনেন না তাই ওকথা বলছেন। এসব জিনিস আজকাল হয়ই না, তা ও পাবে কোত্থেকে? না স্যার, এসব আমারই জিনিস। কতকাল ধরে যে এদের তেল মাখিয়ে, আঁচড়ে, কুঁকড়ে, হাত বুলিয়ে, আঠা জুড়ে, ঘুচে কুঁড়ে এইরকম চেহারা বানিয়েছি সে আর কী বলব। এগুলোকে আর এখন নকল চুলদাড়ি বলা চলে না, এগুলোকে মানুষের চুলদাড়ি বলা চলে– একদিক দিয়ে আমারই চুল-দাড়ি-গোঁফ বলতে পারেন। এদের একটা চুল ছিড়লে আমার গায়ে লাগে। আর, হ্যাঁ স্যার, আমার কিন্তু একটা আবেদন ছিল।

ছোটকা বললেন, তা বলেই ফেলোনা, থামলে কেন? কিছু পয়সাকড়ির দরকার বুঝি? শোন চাঁদ, আমার দেরাজের টানাতে

কালো-মাস্টার জিভ কেটে হাতজোড় করে বলল, না, না, ও কী কথা স্যার! আপনার কাছ থেকে আর পহা নিলে আমার যে পাপ হবে। বলছিলাম কী, আমার জীবনে অনেকরকম ঝামেলা আছে কিনা, তা আমার শিশুপাল সাজার কথাটা একটু গোপন রাখবেন স্যার, নইলে শেষটা টানাটানি পড়ে যাবে, হয়তো শেষপর্যন্ত দেখবেন নাটকের দিনেই আমি ফেরারি।

ছোটকার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল, তাই কখনো হয়? তাহলে যে আমাদের সব্বনাশ হয়ে যাবে! আমি ভোঁদাদের কর্ণার্জুন রিহার্সাল দেখে এসেছি, বুঝলে, পাশের বাড়ির ঘুলঘুলি দিয়ে। একেবারে রাবিশ! সাজপোশাকের ওপর দিয়ে মেরে দেবে ভেবেছে, কেউ একবর্ণ নাটক কত্তে পারে না, ওই সিনেমা আক্টরটা তো স্রেফ একটি মাকাল ফল! ওদের নাকের ডগা দিয়ে কাপ নিয়ে বেরিয়ে যাব। যারা যারা প্রতিযোগিতায় নামছে সবাইকে কার্ড পাঠাচ্ছি, বিশু, ভোঁদারা এসে দেখে যাক নাটক কাকে বলে! ওদেরও নাকি দাড়ি-গোঁফের কষ্ট।

কালো-মাস্টার বললে, তা আর হবে না? কার সঙ্গে লাগতে এসেছে ভুললে চলবে কেন? আমাকেও বারোটা কার্ড দেবেন স্যার। আর ইয়ে, স্যার, ওরা রিহার্সালে এলে কিন্তু আমি নাটক কত্তে পারব না। প্রাণ হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াই, চারদিকে শত্রুর গিজগিজ করছে, এখানে আসা যাওয়াই একটা ভাবনার কারণ হয়ে উঠেছে

ছোটকা খানিকক্ষণ অবাক হয়ে শুনলেন, তারপর বলে উঠলেন, ওঃ! এতক্ষণে বুঝেছি, বিশু। তুমি নিশ্চয় কোনো নামকরা কেউ, নাম ভঁড়িয়ে নাটক করছ। পাছে কেউ চিনে ফেলে তাই এত ভাবনা। এবারে বুঝেছি।

কালো-মাস্টার বললে, শুধু চিনে ফেলবে না, স্যার, দড়ি দিয়ে বেঁধে ধরে নিয়ে যাবে, এই আমি বলে রাখলাম।

ছোটকা ওর পিঠ চাপড়ে বললেন, বিশু, তোমার কোনো ভাবনা নেই। আমি তোমাকে এমনি লুকিয়ে রাখব যে চাঁদ ছাড়া এ বাড়ির কেউ অবধি জানতে পারবে না। দেখো, চাতালের পাশের ঘরটা আমাদের লাইব্রেরি, ওর দরজাও ভোলা হয় না, এমনি সব পড়ুয়া এ-বাড়ির লোকরা। ওর চাবি আমার কাছে থাকে। ওর পাশেই আমার চানের ঘর, মাঝখানে দরজা আছে। তুমি ওই লাইব্রেরি ঘরে থাকবে, আমার চানের ঘরে চানটান করবে, কাকপক্ষী টের পাবে না। রিহার্সালেও কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। এবার নিশ্চিন্দি তো?

কালো-মাস্টার বললে, আর আমার খাবার?

ছোটকা বললেন, বাঃ, সে আবার একটা কথা হল নাকি! আমার খাবার আমার ঘরে দিয়ে যেতে বলব, কান্তা কেবিন থেকে চপকাটলেট আনব, দু-জনে ভাগ করে খাব।

এর পর কালো-মাস্টার আর কোনো আপত্তিই করল না। কিন্তু আমার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল– কোত্থেকে-না আবার কোন নতুন বিপদ হয়! মনে হতে লাগল, এতে কেমন যেন বিশেকে ছোটো করা হচ্ছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু কালো-মাস্টারও খুব খুশি, ওকে নিয়ে আর আমাকেও ভাবতে হবে না, আমার পেরিস্তানও নিরাপদ।

কালো-মাস্টার আরও বললে, একটু বেশি রাত করে আসব, স্যার, তা হলে! এই চাতাল দিয়ে ঘুরে আসব, আপনি লাইব্রেরি ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে রেখে শুয়ে পড়বেন।

খাওয়া-দাওয়ার পর টর্চ নিয়ে গেলাম একবার পেরিস্তানে। কালো-মাস্টার আমাকে দেখে চমকে-টমকে একাকার। বললাম, আবার এখানে এলে কেন। থেকে গেলেই পারতে।

কালো-মাস্টার বললে, না কত্তা, এসেছি ভালোই করেছি। নৌকোটাকে তো ঝোঁপের পেছনে ফেলে রাখা যায় না। এখানে রাখাও ঠিক নয়, তাই লুকিয়েছি কারখানা বাড়ির ঘাটের নীচের আড়ালে। তা ছাড়া

–কী তা ছাড়া?

–তা ছাড়া আজ বোধ হয় বিকেলে তোমার সত্যিকার বিশে তার সিংহকে নিয়ে এসে থাকবে।

আমি এমনি চমকে গেলাম যে আর-একটু হলে পড়েই যাচ্ছিলাম। বললাম, অসম্ভব, বিশে আসতেই পারে না!

কালো-মাস্টার কোনো কথা না বলে, আমার হাতের টর্চটা নিয়ে সিঁড়ির ধাপের কাছে মাটির ওপর আলো ফেলল। দেখলাম বড়ো বড়ো থাবার দাগ। সঙ্গে মানুষের জুতোপরা পায়ের ছাপও আছে। বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেল।

–তুমি কোনো জিনিসপত্র এখানে ফেলে রাখনি তো, কালো-মাস্টার?

কালো-মাস্টার বললে, খেপেছ? তাপ্পর তাই দেখে আমার সন্ধান পাক আর কী! আমার থাকবার মধ্যে ছিল তো ওই দাড়ি-গোঁফ, সেও তোমার ছোটকার কাছে সঁপে দিয়েছি। দেখতে পার, তোমার চোরা ঘর খাঁ-খাঁ করছে, তোমার ওই জলের বোতল আর খাবারের টিন ছাড়া কোত্থাও কিচ্ছু নেই। এখানে খুঁজলে কালো-মাস্টারের চিহ্নটুকু পাওয়া যাবে না। তুমি এবার যাও দিকিনি ঘরে, আমিও অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে তোমাদের লাইব্রেরি ঘরে গিয়ে সেঁদোই। ও-রকম কালো মুখ কেন গা? একটু আনন্দ করো, এই দেখো কেমন তোমার পেরিস্তান ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছি। আমারই জন্য তোমার বন্ধু বিশে আসে না, সে কি আমি বুঝিনি ভেবেছ? এবার তাকে খবর দাও, সে এসে দেখে যাক পেরিস্তানের এতটুকু ক্ষতি করিনি।

কালো-মাস্টারের দেখি মহাফুর্তি, থাবার দাগ আমাকে একবার দেখিয়েই সে-বিষয় ভুলে গেছে, আমার কিন্তু আত্মাপাখি খাঁচাছাড়া। ও কথাটা বিভুদার কাছে শেখা। খালি মনে হতে লাগল কোথাও একটা গলদ থেকে যাচ্ছে, তাই থেকে এখনও অনেক বিপদের সম্ভাবনা আছে।

উপরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। কালো-মাস্টারও ভাটার কাদা ভেঙে নদীর ধার দিয়ে রওনা দিল। ওকে নিয়ে আর আমার কোনো ভাবনাই রইল না। কেবলই বড়ো বড়ো থাবার দাগের কথা মনে হতে লাগল। ও যে সিংহের থাবা হতে পারে না সে আমি জানতাম… তবে কার?

হঠাৎ চমকে উঠে বসলাম। যদি পুলিশের ডালকুত্তোর হয়? যদি কালো-মাস্টারের শত্রুরা ওর পেছনে ডালকুত্তো লাগিয়ে থাকে? আবার শুলাম… তাও তো হবার জো নেই, জলের ওপর দিয়ে শুকে শুকে কুকুর তো আসতে পারে না! আমি জলে নামি না বটে, মা-বাবা বলেন জলে নামলে গায়ে ঠান্ডা লেগে আমার সর্দি হবে, সেই সর্দি বুকে বসে আমার নিউমোনিয়া হবে। কিন্তু বিশেদের ছোটো ছেলেরা হাঁটা শেখার আগেই নাকি সাঁতার শেখে। দেশ জুড়ে গায়ের শিরার মতো সুন্দর সুন্দর সব নদী, তাতে ওরা দিনরাত হেঁটে বেড়ায় পথঘাটের চেয়ে নদীর জলে হাঁটতেই ওদের সুবিধে লাগে। ওদের পেছনে কেউ ডালকুত্তো লাগালেও ওদের ধরতে পারে না। জল পেলেই ওরা জলে নেমে পড়ে, জলের ওপর দিয়ে ডালকুত্তো ওদের গন্ধ পায় না।

 শুঁকে শুঁকে কারো খোঁজে ডালকুত্তো পেরিস্তানে আসেনি। পেরিস্তানের গন্ধই আলাদা। ওর শব্দও আলাদা, মানুষের গলার স্বর নেই ওখানে, খালি নদীর কলকল, ছলছল, মাঝে মাঝে দাঁড় বাইবার ছপাত ছপাত, আর দূরে পুলের ওপর থেকে টং লিং টং লিং টং লিং।

এখন আমার ঘর থেকেও শুনতে পেলাম টং লিং টং লিং টং লিং কোনো ভয় নেই, কোনো ভয় নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *