যে জায়গাটাতে আমি এখন বসে আছি এটার নাম পেরিস্তান। এ জায়গার কথা আমি ছাড়া এ বাড়ির কেউ জানেও না, এখানে কেউ আসতেও পারে না। ছোটোরা এখানে আসবার রাস্তাই খুঁজে পাবে না, আর বড়োদের পেট আটকে যাবে। কারণ, এক জায়গায় এ বাড়ির দেয়ালের কোনা আর পাশের গুদোমখানার দেয়ালের কোনা একেবারে ঘেঁষটে আছে। আর তার নীচে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সরু অন্ধকার একটা নালা।
ভারি ভালো এ জায়গাটা, আঁকড়ে-মাকড়ে একবার পৌঁছুতে পারলে আর ভাবনা নেই, কেউ দেখতে পায় না। সামনে দিয়ে গঙ্গা বয়ে যাচ্ছে, আর মাথার বেশ খানিকটা ওপরে ওদের একতলার চাতাল, ওইখানেই ওদের নাটকের রিহার্সাল হচ্ছে এখন। ওদের পায়ের তলায় এই চমৎকার জায়গাটার কথা ওরা কেউ জানেও না। জানলে আর অমন নিশ্চিন্ত মনে হাত-পা নেড়ে নাটক করতে হত না!
সবচেয়ে খারাপ ওদের ওই প্রকাশদা, অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না। ওদিকে ক্লাস ইলেভেনে উঠেও বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, নাকি লট হয়েছেন। লট কী তা আমি ঠিক জানি না, তবে আমার বড়োকাকিমা যে-রকম করে বললেন, মনে হল নিশ্চয় খুব খারাপ কিছু।
ওই প্রকাশদা সাজছে শিশুপাল, আর ওদের ইস্কুলের অঙ্কের স্যার ব্রজেনদা সাজছে শ্রীকৃষ্ণ। ছোটোকাকা শেখাচ্ছেন– এমনি করে হাত বাড়িয়ে অর্ঘ্যথালা ধরে থাকো ব্রজেন, মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকো। ছোটোকাকা যা বলছেন ব্রজেনদা তাই করছে। ওদিকে প্রকাশদাকে পায় কে! বই দেখে দেখে খুব অপমান-টপমান করছে ব্রজেনদাকে। বইতে যেসব কথা নেই সেসবও ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আমি পেছন থেকে বই দেখে যেমনি সেকথা বলেছি, কী রাগ আমার ওপর। আমার আর কী! এখন যতই অপমান করুক ব্রজেনদাকে, ওর অঙ্কের খাতা দেখবে ওই ব্ৰজেনদাই, তখন নাকি এক হাত নিয়ে নেবে। আমার বড়োকাকার ছেলে বিভুদা বলেছে।
বিভুদাও কম যায় না। আমাকে খালি খালি বলে,
–দ্যাখ, আমিই বলে কয়ে জ্যাঠামশাইকে– জ্যাঠামশাই মানে আমার বাবা চিঠি লিখিয়ে তোকে আনিয়েছি, এখন আমাদের এক বাক্স দাড়ি-গোঁফ না দিলে তোকে কিন্তু পার্ট দেওয়া হবে না।
শুনে আমি অবাক! এক বাক্স দাড়ি-গোঁফ আমি কোথায় পাব? বিভুদা কিছুতেই ছাড়ে না, বলে,
পাব না মানে? কলকাতার দোকানে সব পাওয়া যায়, গত বছরের ভূতুড়ে নাটকের জন্যে তো কলকাতা থেকেই হাড়গোড় ভাড়া করে আনা হয়েছিল। এবছর সব ঝগড়াঝাটির ব্যাপার, মোটে চাঁদা ওঠেনি, কলকাতা থেকে কিছু ভাড়া করে আনা যাবে না। ভালো চাস তো এক বাক্স দাড়ি-গোঁফ দে, নইলে ভোঁদার দল আমাদের ওপর এক হাত নেবে, এ আমি কিছুতেই সইব না বলে রাখলাম। দাড়ি-ঘোঁফ দেব না! ওঃ! ওই তালপাতার শরীরে তো তেজ কম না!!
এই বলে বিভুদা আমার ডান ঘাড়ে একটা রদ্দা মারল। মেরে বলল,
–এটাকে আমি মার বলি না, এটা শুধু মারের নমুনা। দাড়ি-গোঁফ না দিলে আসল মার কাকে বলে টের পাবি, বুঝলি চাঁদ!
বলে আমার গাল টেনে রবারের মতো এই অ্যাত্তখানি লম্বা করে দিল! শেষটা আমি এইখানে এই পেরিস্তানে চলে আসতে বাধ্য হলাম।
বিভুদা মনে ভাবে কী? ম্যালেরিয়া হয়ে নাহয় আমার শরীর খারাপই হয়ে গেছে, কিন্তু তাই বলে আমার বন্ধু বিশের তো আর ম্যালেরিয়া হয়নি। আসবে একটু বাদেই বিশে এখানে, হাঙরমুখো নৌকো বেয়ে ওপার থেকে। কী চালাক বিশে! এখানে পার হলে চাতাল থেকে ওরা দেখে নেবে, তাই গঙ্গার পুলের ওধারে পার হয়ে, নদীর কিনারা ঘেঁষে ঘেঁষে নৌকো চালিয়ে এসে ওই নালাটির ভেতর নৌকোসুদু ঢুকে পড়ে। ওখানে দেয়ালের গায়ে এই বড়ো আংটা লাগানো আছে, তাতে নৌকো বেঁধে বিশে এক লাফে নেমে পড়বে। সঙ্গেসঙ্গে গলার মধ্যে মেঘ ডাকার মতো শব্দ করতে করতে সিংহও লাফিয়ে নামবে।
সিংহ হল আমার বন্ধু বিশের কুকুর। কী চেহারা সিংহের, বাবা! দেখলেই লোকের হাত-পা হিম হয়ে যায়। আমি কিন্তু সিংহকে একটুও ভয় পাই না। ওর এত বড়ো কালো থ্যাবড়া নাকের ওপর হাত বুলিয়ে দিই, আর সিংহ ওর বুড়ো আঙুলের মতো ল্যাজ নেড়ে, নেচে-কুঁদে, আমার মুখ চেটে একাকার করে দেয়।
পোড়া হাঁড়ির মতো এত বড়ো সিংহের মুখটা, টকটকে লাল জিভ ঝুলিয়ে রাখে। কুকুরের ল্যাজ কেটে দিলে ওদের ভীষণ তেজ বাড়ে, তাই সিংহের ল্যাজটা বিশে বেশি করে কেটে দিয়েছে, তাতে খুব বেশি তেজ হয়েছে ওর।
আমার বন্ধু বিশের গায়ে কী জোর! এই এতখানি বুকের ছাতি, হাতের পায়ের গুলি ইটের মতো শক্ত। এতটুকু করে চুল ছাঁটা, তাতে নাকি কুস্তি করতে সুবিধে হয়। হাতাওয়ালা গেঞ্জি আর নীল হাফ-প্যান্ট আর সাদা ক্যাম্বিশের জুতো পরে বিশে যখন নৌকো থেকে লাফিয়ে নামে ওকে একটা পালোয়ানের মতো দেখায়! আমি মেজোকাকিমার কাছ থেকে চেয়ে আমসত্ত্ব নিয়ে আসি, বিশে এলে ভাগ করে খাই। সিংহও আমসত্ত্ব খায়।
আমরা তিন জনে চাতালের তলায় সবুজ ঘাসের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে থাকি, আর গঙ্গার পুলের ওপর দিয়ে চেন ঝুলোতে ঝুলোতে মালগাড়ি যায় টং লিং–টং লিং–টং লিং। পায়ের তলায় তখন কীরকম লাগে যেন। মনে হয় অনেক দূরে কোথাও বিশের সঙ্গে চলে যাই।
বিশের বুকে একটা নীল রঙের কঙ্কালের মুণ্ডু আর তার নীচে দুটো মোটা মোটা মানুষের হাড় ক্রস করে বসানো, এইরকম করে উল্কি দিয়ে আঁকা আছে। দেখে প্রথমটা একটু কীরকম মনে হয়েছিল, ঠিক ভয় না, তবে পেটের ভেতরে প্রজাপতিরা ফড়ফড় করছিল। কিন্তু বিশে বললে,
–যাবি নাকি আমার সঙ্গে সমুদ্রের জাহাজে?
শুনে আমি অবাক। বিশে ডাঁসা পেয়ারাতে এক কামড় দিয়ে বললে,
যাবি তো বল। তোকে আন্দামান ছাড়িয়ে আরও অনেক দূরে নিয়ে যেতে পারি। সেখানে একটা প্রবালের দ্বীপ আছে, তার মাঝখানে মস্ত একটা নীল উপসাগর, সেইখানেই আমাদের আস্তানা। বাইরে থেকে কিছু বুঝবার জো নেই, পাথরে-আড়াল করা সরু নালার মতো পথটা দিয়ে একবার ঢুকলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। নারকেল গাছ জড়িয়ে লতা উঠেছে, তাতে থোলো থোলো কালো আঙুর ঝুলছে, পেড়ে খেলেই হল। পাথরের গায়ে কমলামধুর চাক, মধু উপচে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে, সিংহ পর্যন্ত চেটে খায়। মাথার ওপর লাল-নীল হিরেমন পাখির ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। যাবি তো বল।
যেতে তো খুবই ইচ্ছে করে; কিন্তু মা যে আবার আমাকেই বলেন চিঠি ডাকে দিয়ে আসতে, মুশকিলও আছে ঢের। তার ওপর নিমকি ইস্কুল থেকে ফিরেই বলে, দাদা আমার ঘুড়ি জুড়ে দাও; বাবা বলেন, খবরের কাগজ থেকে এটা-ওটা কেটে রাখতে। বিশের সঙ্গে সমুদ্রের জাহাজে চলে যেতে তো ইচ্ছে করেই, কিন্তু তাহলে এসব করবে কে?
যখন জোয়ার আসে, হুড়হুড় করে নালা দিয়ে জল ভেতরে ঢুকে যায়। বিশের নৌকো এই পাড়িটা অবধি ভেসে ওঠে। সেই সময়ই বিশে আসে। ভাটা পড়লে জল কোথায় নেমে যায়, এক হাঁটু কাদা বেরিয়ে পড়ে, বিশের নৌকো ডাঙার ওপর বসে থাকে, বিশে আর বাঘা তখন চোরা ঘরে বিশ্রাম করে, আমিও আস্তে আস্তে দেয়াল আঁকড়ে মাকড়ে উঠে পড়ি। তারপর বাগানের ধার ঘুরে গিয়ে খিড়কি দিয়ে আবার বাড়িতে ঢুকি। ওরা ভাবে বুঝি বাগানের ঘাটে বসে ছিলাম।
ততক্ষণে হয়তো নাটকের রিহার্সাল শেষ হয়ে গেছে। বড়োরা অনেকেই যে-যার বাড়ি চলে গেছে। বিভুদা, ছোটোকাকা, আরো দু-একজন চাতালের বাঁধানো পাড়ে হাঁড়িমুখ করে বসে ভোঁদার দলের ওপর খুব রাগ দেখাচ্ছেন। আমি আস্তে আস্তে একটা কোনায় এসে বসতেই ছোটোকাকা বললেন,
–অত গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ালে তো চলবে না, চাঁদ! টাকা-পয়সার ব্যবস্থা নেই, কারো পার্ট মুখস্থ হয় না, সাজপোশাকের কী হবে তার ঠিক নেই, তার ওপর আজ আবার এই কাণ্ড! অমন চুপ করে থাকলে তো চলবে না, সবাই মিলে না খাটলে শেষটা কি ভোঁদার দলই এ-বছর কাপ পাবে না কি?
আমি বললাম, আমাকে একটা পার্ট দিলে তবে তো করব।
বিভুদা বললে, না, না, ছোটকা, ওকে কিছু বলাটা ঠিক নয়। ও আমাদের সকলের জন্যে দাড়ি-গোঁফ এনে দেবে।
ছোটোকাকা বললেন, দাড়ি-গোঁফ আর চুল বল।
বিভুদা বললে, ও হ্যাঁ, দাড়ি-গোঁফ আর চুল।
০২.
কী ভালো ভালো সব দাড়ি-গোঁফ দেখেছি লোকদের মুখ থেকে ঝুলে আছে, কিন্তু সেসব আমি পাব কোত্থেকে? তা বিভুদা কিছুতেই বোঝে না। ওদের রিহার্সালে গণ্ডগোল হয়, মেজাজ ওদের বিগড়ে থাকে, তার ঝাল ঝাড়ে আমার ওপর! বলে, খুব বেশি দিন আর নেই চাঁদ, দু-বেলা পেট পুজো আর লবাবি করে ঘুরে বেড়ালে চলবে না। কদ্দূর কী করলি ব?
বলে আমার হাতের কনুইয়ের উপরে দু-আঙুল দিয়ে খিমচে ধরে মাংস টানে। উঃ! কী ব্যথা লাগে, জায়গাটা দড়া পাকিয়ে গোল হয়ে ফুলে ওঠে! তারপর বিভুদা আমার ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে বলে, তোর সব চালাকি জানা আছে আমার!! ভালো মানুষ সেজে থেকে আমাকে বকুনি খাওয়াবার যত ফন্দি। যা না, মার কাছে গিয়ে নালিশ কর্না গিয়ে।
বলে, মেয়েদের মতো সরু গলায় বলতে থাকে, ওঁ কাকিমা, পেঁখো না, বিভুদা আঁমাকে খালি খালি মারে, আঁ আঁ আঁ!– ন্যাকা চৈতোন!
ঠ্যালা খেয়ে আমি দেয়ালের ওপর গিয়ে পড়ি। ঠিক সেই সময় ছোটকা এসে পড়েন, বিভুদাকে বলেন,
–বাস্তবিক বিভু, এ-রকম ফ্যাসাদে তো আগে কখনো পড়তে হয়নি। বড়দার কাছ থেকে কিছু আদায় করতে পারিস-না? নইলে সব যে ভেস্তে যায়। ভোঁদারা শুনছি কাপ পেয়ে কী ফিস্টি দেবে তার তালিকা তৈরি করছে, বড়ো বড়ো চাদা মাছের ফ্রাই, মুরগির কাটলেট, রাবড়ির আইসক্রিম। আমাদের কাকেও নাকি বলা হবে না।
বিভুদা বললে, অথচ নালুর পইতেতে সব এসে দিব্যি খেয়ে গেছে! ছোঃ! তা তুমি ভেবো না ছোটকা, চাঁদ সব এনে দেবে বলেছে, মেক-আপের জন্য আমাদের একটা পয়সা লাগবে না। ড্রেসও যে-যার নিজেরটা বাড়ি থেকে আনলেই ল্যাঠা চুকে যাবে।
ছোটকাও একটু খুশি হয়ে গেলেন।
–যা বলেছিস। নাটক হবে আমাদের পুজোর দালানে, বাঁধানো স্টেজ তো রয়েইছে, মাথার ওপর তারা ফুটফুট করবে, নীচে শতরঞ্জি বিছিয়ে দেবে, পেছনে কতক চেয়ার দেব ক্লাব থেকে এনে। কিন্তু
এই অবধি বলেই ছোটকা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। বিভুদা মহা ব্যস্ত।
-কিন্তু কী, ছোটকা? আবার কিন্তু কীসের? পাট সব মুখস্থ হয়ে যাবে দেখো। ছোটো ছোটো পাঁচটা পাট আমার, তাই মুখস্থ করে ফেলেছি। একটু একটু সাজ বদলে এক এক পাটে নামব, কখনো শুধু গোঁফ, কখনো শুধু দাড়ি, কখনো দাড়ি-গোঁফ দুই, কখনো চাঁচাছোলা, কার সাধ্যি চিনে নেয়– এই চাঁদ, দাড়ি-গোঁফের ব্যবস্থাটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করে ফেল!
আমি বললাম, তা আমাকে তো দুটো-একটা পাট দিতে পার। নিজে পাঁচটা না করে, আমাকে দুটো নাহয় দিলে। কিচ্ছু ভালো মুখস্থ হয়নি তোমার, পড়া-টড়াও তো সব ভুলে যাও কাকিমা বলেছেন!
ততক্ষণ ওদের দলবল এসে গেছে, ছোটকা চাতালের দিকে চললেন, অমনি বিভুদা আমার উপরে লাফিয়ে পড়ে আমার মুঠো মুঠো চুল ছিঁড়ে, কানের লতি টেনে একাকার করে দিল। উঃ, কী খারাপ ছেলে বিভুদা। আমাকে মেরে-টেরে মুখ মুছে দিব্যি রিহার্সালে চলে গেল।
আমি পেরিস্তানে গেলাম। কথাটা বিশেকে না বললেই নয়। বিশে এর একটা হেস্তনেস্ত না করে ছাড়বে না। হয়তো সিংহকে দিয়ে চাটাবে। কুকুরকে কী ভয় পায় বিভুদা! নাকি ছোটোবেলায় ওর খাটে হুলোবেড়াল উঠেছিল, সেই থেকে ও কুকুর দেখলে ভয়ে কাদা হয়ে যায়! একবার সিংহকে যদি দেখে, তবেই ওর হয়ে গেল!
পেরিস্তানের মাথার ওপরটা ঢাকা, ওপরে তাকালে থাম্বার উপরে-বসানো বাড়ির তলাটা দেখা যায়, কিন্তু বাড়ির কোনোখান থেকে এ জায়গা দেখা যায় না!
এখানে দুটো চোরা কুঠরি আছে সেকথা কেউ জানে না। নালা থেকে বাড়ির তলায় ছোটো সিঁড়ি বেয়ে চোরা কুঠরিতে ঢোকা যায় তাও কেউ জানে না। চোরা কুঠরির দেয়ালে পাথরের তাক আছে, পাথরের বেদি আছে, তাতে শোয়া যায়। কেউ সেসবের কথা জানে না। জানে শুধু বিশে আর সিংহ আর আমি। তাকে দু-তিনটে বই রেখেছি, একটা বিস্কুটের টিনে কিছু খাবার রেখেছি। সিংহর কিনা খুব খিদে। আমাদেরও খিদে পায়।
পেরিস্তানের ভেতর দিকটা যেমনি অন্ধকার, বাইরেটা তেমনি আলো, ঢালু হতে হতে নদীতে নেমে গেছে। কত গাছ-গাছলা গজিয়েছে সেখানে, নৌকো করে সামনে দিয়ে গেলেও জায়গাটা তত চোখে পড়ে না। পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকি, কেউ টেরও পায় না।
ভয় খালি ওই রেলের লাইনের খুপরি ঘরটাকে। ওইখানে একটা বিশ্রীমতন লোক থাকে, কী লাল লাল চোখ তার। গাড়ি যাবার সময় একটা সবুজ নিশান নাড়ে আর কোনো কাজ করে না। খুপরি ঘরটা খানিকটা উঁচুতে একটা বাঁকের উপরে। ওর পেছন দিকের জানালাটা খুলে ঝুঁকে দেখলে হয়তো পেরিস্তানের খানিকটা দেখা যেতেও পারে। এই আমার ভয়।
তাহলে আর বিশে আসবে না। লোকের সামনে ও কিছুতেই বেরোয় না। বলে আমাদের দেশের লোকেরা ভালো নয়, ওদের দেশে সব অন্যরকম। ওদের ইস্কুলের বড়ো ছেলেরা কক্ষনো ছোটোদের পেছনে লাগে না। তবে বিশে আজকাল আর স্কুলে যায় না। কেন যাবে? সব ওর শেখা হয়ে গেছে। ওদের দেশের লোকেরা কেউ বই পড়ে পাস করে চাকরি করে না। ওদের দেশে আপিস নেই।
খালি খোলা মাঠ আর গাছপালা আর নদী আর ঘন বন আর একটা পুরোনো আগ্নেয়গিরি আর মাঝখানে খানিকটা সমুদ্র, সেখানে ঢেউ ওঠে না। আর চারদিকে যে-সমুদ্র তার শেষ নেই। তিনতলার সমান ঢেউ দিনরাত শুধু কালো কালো পাথরের উপরে আছড়ে পড়ছে আর চারদিকের জল ফেনিয়ে দুধের মতো সাদা হয়ে উঠছে।
প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম, এমনি সময় কানের কাছে কীসের শব্দে চমকে উঠে বসেছি।
ঝুপ করে অমনি টান হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লাম। কেউ না দেখতে পেলে বাঁচি!
ও কাদের চ্যাঁচামেচি? পেরিস্তানে আবার কে চাঁচাচ্ছে?
মাটি আঁকড়ে কাঠ হয়ে পড়ে আছি, নাকে ঘাস ঢুকছে, গালের উপর দিয়ে অনেকগুলো ঠ্যাংওয়ালা কী যেন হাঁটছে, তবু নড়ছি-চড়ছি না, নিশ্বাস চেপে রাখছি।
কানের কাছ দিয়ে কলকল ছলছল করে নদী বয়ে যাচ্ছে, চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি। ওপারের ঘাটে অন্ধকার জমা হচ্ছে। বুক ঢিপঢিপ করছে।
অন্য লোক যদি পেরিস্তানের কথা জেনে ফেলে তবে আর বিশে আসবে না।
বিভুদাদের বিশে কী ঘেন্নাটাই করে। বলে, ব্যাটার শরীরটা তোর চেয়ে তিন ডবল বড়ো, ওর লজ্জা করে না তোর সঙ্গে লাগতে। তুই কিছু ভাবিস না, একদিন হতভাগাকে দেখে নেব!
কী গায়ে জোর বিশের। কী ভীষণ সাহস! বিভুদাকে এতটুকু ভয় পায় না। বুকে গুমগুম করে কিল মেরে বলে, তুই দেখে নিস রে চাঁদ, ওটাকে কেমন মাটির সঙ্গে একেবারে বিছিয়ে দিই। চালাকি করবার জায়গা পায়নি, ছোটো ছেলের সঙ্গে লাগতে আসা! আচ্ছা, আমিও আছি!
দূরে পুলের ওপর দিয়ে আরেকটা মালগাড়ি চলে গেল, টং লিং টং লিং টং লিং। বিশে মাঝে মাঝে চলন্ত গাড়ি থেকে লাফিয়ে ওঠে-নামে।
আস্তে আস্তে মাথা তুলে উঠে বসলাম। কোথাও কিছু নেই। এই জায়গায় কী অন্ধকার! নদীর ওপর মিটমিট করে কত নৌকোতে বাতি জ্বলছে। ওপারের ঘাটের আলোগুলো থামের মতো লম্বা লম্বা ছায়া ফেলছে। চোখ তুলে চেয়ে দেখি, আমার মাথা থেকে খানিকটা উঁচুতে, ছোটো একটা গর্ত দিয়ে একটুখানি আলো আসছে। একটা টাকার মতো ছোটো একটা গোল ফুটো। বিশে একবার ওদের দ্বীপের আগ্নেয়গিরির বেয়ে উঠে, ওপর থেকে ঝুঁকে দেখেছিল অনেক নীচে টগবগ করে গলন্ত পাথর ফুটছে আর ধোঁয়া উঠছে আর গন্ধকের গন্ধ আসছে।
খচমচ করে গিয়ে উঠলাম ফুটোর ধারে। চোখ লাগিয়ে তাকিয়ে দেখে আমি থ। আরে, ও যে আমাদেরই বাড়ির চাতাল! ওইখানেই তো বিভুদাদের রিহার্সাল চলছে। ছোটোকাকা হাত-পা নেড়ে খুব বকাবকি করছেন। সব দেখা যাচ্ছে, সব শোনা যাচ্ছে। ভারি একটা গোল হচ্ছে।
এমনি সময় দালানের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন নলিনজ্যাঠা, প্রকাশদার বাবা। রাগে মুখটা কী দারুণ লাল দেখাচ্ছে। বড়ো বড়ো পা ফেলে গিয়ে পাকড়ে ধরলেন প্রকাশদার কান! বললেন, ওঃ! আবার লাটক হচ্ছে! লজ্জা নেই হতভাগা, জানিস পরীক্ষায় অঙ্কে দশ পেয়েছিস! চল, একবার বাড়ি চল, পাঁচ বচ্ছরের মধ্যে আর তোকে ছাড়া নয়!
বলে দিব্যি তার কান ধরে নিয়ে চললেন!
ছোটোকাকা এতক্ষণে হাঁ হাঁ করে ছুটে এলেন, ও কী, ও যে আমাদের শিশুপাল!
প্রকাশদার বাবা কাঁধ থেকে ছোটকার হাতটা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন।
বাকিরা যে-যেখানে ছিল সেইখানেই বসে পড়ল! আমিও আস্তে আস্তে নেমে এলাম। নেমে এদিকে তাকাতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। হুড়মুড় করে নালাটা দিয়ে জল ঢুকছে। গাছের সমান উঁচু সব ঢেউ উঠছে। ঢেউগুলোর মাথায় ফেনার ঝুঁটি। বাড়িটার তলা থেকে অদ্ভুত একটা গুমগুম শব্দ বেরুচ্ছে। হাওয়া থেকে অমনি গরমটুকু চলে গিয়ে গায়ে লাগল ঠান্ডা।
বুকটা ধড়ফড় করতে লাগল, নদীটা এই বুঝি হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরে ফেলে। তলাকার সেই সরু নালাটাতে ঘুরে ঘুরে ফেনা হয়ে জল ঢুকছে। আর সে কী গর্জন! তার ওপর দিয়ে যাই কী করে?
বিশেরা দল বেঁধে ঝড়ের রাতে শুশুক মারতে যায়। সমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায় এই তাদের নৌকো ওঠে, আবার ঝপাং করে এই তাদের নৌকো পড়ে। নৌকোর কানা ধরে আঁকড়ে থাকতে হয়। নইলে কে কোথায় ছিটকে পড়বে আর তাদের খুঁজেও পাওয়া যাবে না। একবার একটা তিন-হাত লম্বা চিংড়ি, হঠাৎ নাকে এল ঝড়ের গন্ধ। লাফিয়ে উঠে ফিরে দেখি, নালার মুখে ফেনা-জলে হাবুডুবু খাচ্ছে ও কার ছোটো নৌকো? ও তো বিশের নয়। আমার নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এল।
০৩.
ইস্, নৌকোতে একটা লোকও আছে দেখলাম– দু-হাতে প্রাণপণে নৌকো আঁকড়ে রয়েছে, মাঝে মাঝে ঠ্যাং দুটো নৌকো থেকে আলগা হয়ে ভেসে যাচ্ছে। জলে-ডোবা লোকদের মাথায় ডান্ডা মেরে অজ্ঞান করে তারপর চুল ধরে হিড়হিড় করে ডাঙায় তুলতে হয়। কিন্তু কাছেপিঠে ডান্ডাও নেই, আর চুল ধরে হিড়হিড় করে টানতে হলে তো আমাকে সুষ্ঠু জলে নামতে হয়, তখন আমাকে কে তোলে তার ঠিক কী? সাঁতারও জানিনে। সর্দি লাগার ভয়ে আমাকে জলে নামতে দেওয়া হয় না।
বিশেদের দেশের ছেলে-মেয়েরা হাঁটতে শিখেই ঝপাং ঝপাং জলে পড়ে সাঁতার কাটে। বিশে একবার একটা জাহাজডুবির নৌকো বাঁচিয়েছিল। ঝোড়ো সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওই যেখানে আকাশের সঙ্গে সমুদ্র মেশে, ওইখানে সাঁতরে গিয়ে ঠেলে ঠেলে নৌকোটাকে ওদের দ্বীপের সরুপথ দিয়ে মাঝখানকার স্থির জলে এনে ফেলেছিল। নৌকোতে জন কয়েক বণিক ছিল, তারা বিশেকে ধনরত্ন দিতে চেয়েছিল। তারা প্রাণ হাতে করে ধনরত্নের বাক্স বুকে চেপে আরেকটু হলেই সমুদ্রের নীচে তলিয়ে গিয়েছিল আর কী! তা আর বিশেকে কিছু দিতে চাইবে না? কিন্তু বিশে কিচ্ছু নেয়নি।
এবার চেয়ে দেখি নৌকোটা আরও কাছে এসে গেছে, পাথরের সিঁড়ির এবড়োখেবড়ো ধাপের ওপর থেকে হয়তো চেষ্টা করলে চুলের মুঠি ধরাও যায়। আমাকে দেখে লোকটা হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, ধরো দড়িটা, নৌকো যেন ভেসে না যায়।
বলে একটা মোটা দড়ি ছুঁড়ে দিল। আমি দড়ি আঁকড়ে চোখ বুজে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়লাম। চোখ খুলে দেখি নৌকো ছেড়ে সে এসে ডাঙায় উঠেছে। আমার হাত থেকে দড়ি নিয়ে দেখতে দেখতে দারুণ এক গিঁট দিয়ে দেয়ালের আংটার সঙ্গে নৌকো বেঁধে ফেলল। বলল, মাঝদরিয়ায় এমনি করে বয়ার সঙ্গে নৌকো বাঁধে।
তারপর কুকুরের মতো গা ঝাড়া দিয়ে জল খসিয়ে বললে, উঃফ, আরেকটু হলে মরেই গিয়েছিলাম। বাপ, কালো মাস্টার জলে ডুবে মলো ভাবতেও হাসি পায়! এই, একটা শুকনো কিছু দিতে পার? কান দুটো যে পাতকো হয়ে গেছে, মোটে কিছু শুনতে পাচ্ছি নে।
দিলাম পকেট থেকে ময়লা রুমালটা। লোকটা একবার সেটাকে নেড়েচেড়ে, নাকে তুলে দু-বার শুকে, অমনি পাকিয়ে পাকিয়ে লম্বা একটা খোঁচা বানিয়ে, নিজের কান থেকে রাশিরাশি জল বের করে ফেলল। তারপর বললে, ওয়া! ওয়া! বেড়ে গন্ধ তো তোমার রোমালে, জিভে যে জল এসে গেল।
বললাম সত্যি কথা। রান্নাঘরে গিয়ে বামুনদিদির কাছ থেকে ওতে করে গরম-ভাজা বেগুনি এনেছিলাম। সে বললে, আহা! আছে নাকি কিছুমিছু? খিদেয় যে পেট জ্বলে গেল।
থাকে আমার কাছে সর্বদাই কিছু-না-কিছু। উঠে একবার চোরাকুঠিতে যেতে হল। সেও চলল আমার সঙ্গে সঙ্গে। মোমবাতির আলোতে ঘর দেখে একেবারে হাঁ!
–ই কী! বাড়ির তলায় আবার লুকোনো ঘর কেন? কী কর এসব ঘরে তোমরা?
বললাম, কিছু করি না, আমি ছাড়া কেউ এঘরের কথা জানেও না। আমিও জানতাম না। নেহাত বিভুদা আমাকে দুকান চেপে শূন্যে তুলে মামাবাড়ি দেখাবে বলে তাড়া করেছিল, তাই। আমি পালাতে গিয়ে খিড়কির বাগান দিয়ে পাঁচিলে চড়ে কেমন করে বাড়ির এপাশে চলে এলাম। তারপর একটা জায়গায় পৌঁছোলাম সেটা একেবারে পাশের গুদোমবাড়ির গা ঘেঁষে গেছে। মাঝখানে এতটুকু কঁক, নীচে আবার জল। সেই ফাঁক দিয়ে গলে খানিকটা কার্নিশের মতো দিয়ে হেঁটে একেবারে এখানে এসে গেলাম।
লোকটা বললে, ওয়াঃ!! বেড়ে জায়গাখানি তো! বাড়িটা কি তোমার নাকি?
বললাম, না, মানে আমার ঠাকুরদাদার ঠাকুরদাদার বাবা বাড়িটা বানিয়েছিলেন। এর একটা ইটও ভালো মানুষের পয়সা দিয়ে কেনা হয়নি, বিভুদা বলেছে।
লোকটা বললে, আহা! শুনলেও কান জুড়োয়। তা, এখানে দুটো দিন একটু গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে পারি কি? শত্রুররা বড্ড পেছনে লেগেছে, খালি পেটে ভিজে গায়ে আর কত লড়া যায়?
বিস্কুটের টিন খুলে ওকে ঝুরো নিমকি আর মুড়ির মোয়া খেতে দিলাম। ছোটো বোতলের জলটাও ওকেই দিলাম; বড়োটা রাখলাম, বিশেতে আমাতে আর সিংহতে খাওয়া যাবে। লোকটার পরনে শুধু একটা কালো হাফপ্যান্ট, ভিজে সপসপ করছে। আর একটা হাতওয়ালা গেঞ্জি, গায়ের সঙ্গে লেপটে রয়েছে।
তাকের ওপর থেকে চাদরটা দিলাম। সেইটে পরে প্যান্ট গেঞ্জি নিংড়ে বেদিটার উপর মেলে দিয়ে খেতে বসল। খেতে খেতে বললে, বারে বারে ইদিক-ঊদিক তাকানো কেন?
বললাম, বাইরে যা জলঝড়, ওরা হয়তো এতক্ষণে আমার জন্য খোঁজাখুঁজি লাগিয়ে দিয়েছে। এই জায়গাটা খুঁজে পেলেই তো হয়ে গেল। আমারও একটা লুকোবার জায়গা থাকবে না, বিশেও আর আসবে না!
–বিশে? বিশে আবার কে?
বিশে আমার বন্ধু, হাঙরমুখো নৌকো করে নদীর ওপার থেকে আসে, সঙ্গে থাকে ওর কুকুর, তার নাম সিংহ। এ জায়গাটার নাম পেরিস্তান।
লোকটা ভারি ব্যস্ত হয়ে উঠল।
–বিশে যদি আবার এসে আমাকে দেখে, তাহলে কী হবে?
–হবে আবার কী? ভালোই হবে, ও তোমার শত্রুরদের মেরে পাট করে দেবে। তোমার কোনো ভয় নেই।
–কিন্তু কিন্তু যদি আমার কথা বিশ্বাস না করে?
লোকটা তো আচ্ছা ভীতু। বললাম, না না, কিচ্ছু ভয় নেই। আমি ওকে বলে দেব। তা ছাড়া আজ আর ও আসবেও না। এখন আমি চলি, তুমি চুপচাপ বিশ্রাম করো। অন্য লোক আছে জানলে বিশে কখনো আসে না। পরে আমিই আবার আসব।
আঁকড়ে-মাকড়ে উঠে, খিড়কির বাগান ঘুরে রান্নাঘর দিয়ে বাড়িতে ঢুকলাম। কাকিমারা আমাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন, ও ছেলে! তোমাকে খুঁজে খুঁজে না বাড়িসুষ্ঠু হয়রান!! জলঝড়ে কোথায় ছিলে? ইস্, ভিজে চুপ্পুড় হয়ে গেছ যে! বলি, ছিলে কোথায়?
বললাম, কেন, খিড়কির বাগানে। গাছতলা থেকে নদীর ওপরে ঝড় দেখছিলাম।
–গাছতলা থেকে? কেন? নদী তো ঘর থেকেও দেখা যায়।
-তা দেখা যেতে পারে, এ অন্যরকম দেখা।
বড়োকাকিমা বললেন, যাও-না, তোমার বড়োকাকা তোমার অন্যরকম দেখা বার করবেন।
আস্তে আস্তে বললাম, আর ছোটকা? বিভুদা?
–তারা এসব বিষয় কিছু জানেও না, কেয়ারও করে না। তাদের নাটকের সব্বনাশ হয়ে গেছে বলে যে-যার ঘরে গিয়ে শুয়ে আছে। যাও, এখন কাপড় ছাড়ো তো। বড়োকাকাকে বুঝিয়ে বলব এখন। এমনি ভীতু ছেলে যে অমনি মুখ শুকিয়ে গেছে!
শুনে হাসি পেল। ভীতুরা কি টগবগে ফেনাভরা নালার উপর দিয়ে আধ-হাত সরু জায়গা দিয়ে হাঁটতে পারে?
রান্নাঘরের জলচৌকিটার ওপর বসে বললাম, নাটকের কী সব্বনাশ হয়েছে রে, পুঁটিদি?
পুঁটিদি আমার মেজোপিসির মেয়ে, আমার চেয়ে একটু বড়ো। কী ঝগড়াটে, বাবা! পুঁটিদি বললে, ওমা! তাও জান না? প্রকাশদা-না, রোজ রোজ ব্রজেনদাকে যা নয় তাই বলে অপমান করে! এমনিতে বইতে আছে শিশুপাল শ্রীকৃষ্ণকে যাচ্ছেতাই সব কথা বলছে। ও এমনি খারাপ যে তার সঙ্গে আরও সব জুড়ে জুড়ে দেয়। প্রথমটা নাকি ব্রজেনদা অত টের পাননি, খুব রেগেছেন মনে মনে, কিন্তু ভেবেছেন বলুকগে ছাই, একটু পরেই তো বধ হবে, তখন বাছাধন টেরটা পাবে! তারপর কাল হয়েছে কী, দু-জনার পার্ট-লেখা কাগজ অদলবদল হয়ে গেছে! ব্ৰজেনদা দেখেন অর্ধেক কথা মোটেই পার্টে নেই, প্রকাশদা বানিয়ে বলে, এমনি খারাপ! তখন ব্ৰজেনদা–
পুঁটিদি আরও কীসব বলতে যাচ্ছিল, এমনি সময় বড়োকাকিমার সে কী ধমক, যাও, যাও, আর পাকামো করতে হবে না। একটা লুচিও যার গোল হয় না, তার মুখে আবার বড়োদের নিন্দে! যাও এখান থেকে!
পুঁটিদি সত্যি চলে গেল আর আমিও ভিজে জামা ছাড়তে ঘরে গেলাম।
ঘরে ঢুকেই দেখি লাল লাল চোখ করে বিভুদা আমার খাটের উপরে বসে আছে। তখুনি চলে যাচ্ছিলাম, কিন্তু বিভুদা বললে, চাঁদ, শোন।
আস্তে আস্তে গিয়ে খাটের ওপাশে দাঁড়ালাম। বললাম, কী?
রাগে বিভুদা ফেটে পড়ে আর কী!
কী! কী আবার কী? নাটক বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড় তা জানিস? প্রকাশদা রোজ পার্টের কথা বাড়িয়ে বাড়িয়ে ব্রজেনদাদের অপমান করে, সেই রাগে সকালে ব্রজেনদা জ্যাঠামশায়কে বলে এসেছেন যে এখনও সাবধান হবার সময় আছে। ওদিকে ছেলে নাটক করছেন! এদিকে অঙ্কের পরীক্ষায় যে দশ পেয়েছেন জ্যাঠামশাই কি সে খবর রাখেন? আর যাবে কোথায়, আপিস-ফেরত জ্যাঠামশাই রিহার্সালের মাঝখান থেকে প্রকাশদাকে কান ধরে সারাপথ হাঁটিয়ে বাড়ি নিয়ে গেছেন! সঙ্গে যে অফিসান গাড়িটা রয়েছে সে খেয়ালও নেই! দাড়ি-গোঁফের ব্যবস্থা নেই, শিশুপাল নেই, এখন কী করে নাটক হবে শুনি?
এই না বলে এক লাফে খাট পেরিয়ে ধরেছে আমার টুটি চেপে!
–দাড়ি-গোঁফ কবে এনে দিচ্ছিস বল হতভাগা! না এনে দিলে তোর পেয়ারের ছবি আঁকার খাতার আমি কী করি দেখিস!
পেটের ভিতরে সিঁটকে গেলাম আমি! সত্যি যদি খাতাটা ছিঁড়ে ফেলে! ওতে আমি জল-মানুষদের ছবি এঁকেছি! বললাম, শিশুপালের পার্টটা ইচ্ছে হলে আমাকে দিতে পার।
শুনে বিভুদা আমার টুটি ছেড়ে দিয়ে হেসেই কুটিপাটি!
–সে কী রে চাঁদ? তুই হবি শিশুপাল! শিশুপাল যে একটা বিরাট যোদ্ধা ছিল। তোর তো এই চেহারা! বেড়ালছানার পার্ট থাকলে তোকে দিতাম! ওসব কথা ভুলে যা, দাড়ি-গোঁফের ব্যবস্থা কর। শিশুপালের বিষয় আমরা ভাবব।
আরও হয়তো গাঁট্টা-টাট্টা মারত আমাকে, বলা যায় না, কিন্তু ঠিক সেই সময় ছোটকা এসে আমার খাটের উপরে বসে পড়লেন। বিভুদা হাত নামিয়ে নিল। ছোটকা বললেন, তবে কি শেষটা সত্যি সত্যি ওই ভোঁদার কাছে হার মানতে হবে নাকি? বিকেলে ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে তোর নামে কীসব নিন্দে-টিন্দে করছিল ওরা।
বিভুদা লাফিয়ে উঠল, কী, আমার নামে বলছিল কী শুনি।
না, অত রেগে ওঠবার মতো কিছু নয়। তবে বলছিল যে ওই বিভুটাকে আমরা ঘোড়াই কেয়ার করি, আছে তো শুধু গোঁয়ার্তুমি আর গুন্ডাগিরি কত্তে! ঘটে যে গোবর ছাড়া আর কিছু নেই সে ইস্কুলেই রোজ টের পাওয়া যায়! বটুদাকে নিয়েই যত ভাবনা!
বটুদা মানে ছোটকা। বিভুদা তো রেগে টং!
বেশ তো, তাই যদি হয়, এখন থেকে নাটকের ভাবনা তুমি একাই ভেবো, আমার সঙ্গে পরামর্শ করতে এসো না। আমার দ্বিতীয় পাণ্ডবের পার্টই আমার পক্ষে যথেষ্ট। তা ছাড়া আরও চারটে পার্ট রয়েছে। ওই যথেষ্ট!
ছোটকা থাকতে থাকতে ও ঘর থেকে সরে পড়তে ইচ্ছেও করছিল, আবার ওদের কথাবার্তাটা শেষ পর্যন্ত না শুনে যাইই-বা কী করে? যেরকম সব মেজাজ দেখছি, এর পরে যদি মারামারি লেগে যায়, সেও দেখতে পাব না শেষটা!
ছোটকা বললেন, ওরে বিভু, সম্মুখে বিপদ, এখন কি তাতে আমাতে খাঁচাখেচি শোভা পায়? জানিস, ওরা কর্ণার্জুন করছে, কী সব ভালো ভালো ড্রেস আনিয়েছে। ভবেশ রায় নাকি কর্ণ সাজছে।
বিভুদা অবাক!
–কে ভবেশ রায়? সিনেমার ভবেশ রায়? তবে-না লোক ভাড়া করে আনার নিয়ম নেই, মিনি পয়সায় করতে হবে?
–আরে না রে না, ভাড়া করা নয়। ভোঁদাদের পাশের বাড়ির অজানেশবাবু যে ওর মামা হয়। সে-ই আনিয়েছে। পয়সাকড়ি দিতে হবে না। ড্রেসগুলো ওই সস্তায় করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু দাড়ি-গোঁফ এখনও পৌঁছোয়নি। বুঝলি বিভু, ওরাও চাচাছোলা মুখে রিহার্সাল কচ্ছে! দুটো
স্পাই লাগিয়েছি, তারাই খবর এনে দিচ্ছে। তুই বরং একটা শিশুপালের খবর কর। উঠি বড়দার সেই মক্কেলের বাড়ি গেলে কিছু চাঁদা পাওয়া যায়। জল তো ধরে গেল। কী রে চাঁদ, যাবি নাকি সঙ্গে?
আর বলতে হল না, পাঁচ মিনিটে শুকনো কাপড় পরে আমি ছোটকার সঙ্গে রওনা।
০৪.
মক্কেলের বাড়ি যেতে হলে পুলের মাথা পার হতে হয়। আড় চোখে একবার বাঁকের ধারে আমাদের বাড়িটাকে দেখে নিলাম। গাছ-গাছলায় ঢাকা পুরোনো তিনতলা বাড়ি, চাঁদের আলোতে নদীর ধারে চুপচাপ পড়ে রয়েছে। চাতালটা একেবারে জলের কিনারা ঘেঁষে এগিয়ে রয়েছে, ওরই নীচে এত ব্যাপার কে বলবে! হাসি পেল।
ছোটকা হঠাৎ বললেন, কী রে, নাটক প্রায় ডোবে আর তোর হাসি পাচ্ছে, চাঁদ?
চোখ তুলে চেয়ে দেখি রেলের লাইনের খুপরি ঘরের সেই লোকটা একটা লাল গামছা কেচে টগরফুলের গাছের উপরে মেলে দিচ্ছে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই গম্ভীর মুখ করে একদৃষ্টে এমন করে চেয়ে থাকল যে আমার বুকের ভেতর জোরে জোরে হাতুড়ি পিটতে লাগল। কতখানি দেখতে পায় কে জানে।
ছোটকা বললেন, নাও, অমন ঢিমেতেতালা চালে চললে তো হবে না, সমরেশবাবু এক বার তাসের আড্ডায় বসে গেলে আর কোনো দিকে হুঁশ থাকবে না।
সমরেশবাবুর দলের লোকেরা তখনও এসে জোটেনি, তাই আমাদের দেখে তিনি মহা খুশি। তক্তপোশের কোনায় একটা রোগা লোক বসে ছিল, তাকে দিয়ে আমাদের জন্য পান আনিয়ে বললেন, দ্যাখ বটু, পাঁচ টাকার নয়াপয়সা ভাঙানি দিতে পারিস? এই তাস খেলে খেলেই দেউলে হতে হবে দেখছি।
ছোটকা বললেন, সে আমি এক্ষুনি এনে দিচ্ছি দাদা, কিন্তু তার আগে আপনার সঙ্গে একটু পরামর্শ ছিল। ওই পুজোর নাটক প্রতিযোগিতা নিয়ে
সমরেশবাবু লাফিয়ে উঠলেন, আঁ! আবার ওই পুজোর নাটক? ভোঁদারা আমাদের গোটা বাড়িটার একরকম ছাল ছাড়িয়ে নিচ্ছে ওদের স্টেজ সাজাবে বলে! তোমার বউদির গয়না, বেনারসি কাপড় কিচ্ছু বাদ যাচ্ছে না। একে যদি নাটক বলে তবে বর্গির হাঙ্গামা কাকে বলে বাপ?
দু-চোখ কপালে তুলে ছোটকা বললেন, অমনি ওদের হাতে তুলে দিলেন সব? দেখুন দাদা, এক পাড়াতে মানুষ হয়েছি, একরকম বলতে গেলে ও আমার ভাইয়ের মতো, কিন্তু সেদিন ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে আপনার নামে যেসব কথা বলছিল দাঁড়িয়ে শোনা মুশকিল হচ্ছিল।
সমরেশবাবুর মুখটা অমনি গম্ভীর হয়ে গেল।
কী, বলছিল কী?
–সে আর কানে তুলবেন না দাদা, ওসব লোকদের কথা ধর্তব্যের মধ্যেই নয়।
–তবু শুনিই-না কী বলছিল।
–বলছিল যে ও-রকম ঢের ঢের বড়োলোক দেখেছি, দোকানদারি করে সব এক-একটি চাই হয়েছেন। ঘটে যে শুধু গোবর ছাড়া আর কিছু নেই, সে একবার ওর তাস খেলা দেখলেই বোঝা যায়! আরও কী সব বলছিল। এমনি ছাচোড়! অথচ আপনি ওদেরই সাহায্য করছেন আর আমাদের বাড়ির এতকালের পুরোনো ক্লাবটা যে উঠে যেতে বসেছে সেদিকে ভ্রূক্ষেপও নেই!
রাগে সমরেশবাবুর ঝোলা ঝোলা গোঁফের ধারগুলো মুখের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল। সেগুলোকে বের করে না ফেলেই গুম হয়ে বসে থাকলেন। গিলে ফেললেই তো হয়ে গেল! হঠাৎ সেই রোগা লোকটির দিকে ফিরে চাপা গলায় বললেন, এসব কী শুনছি, নোটো?
নোটো বললে, সব মিছে কথা স্যার। ওই মোটা লোকটার একটা কথাও বিশ্বাস করবেন না। আবার সঙ্গে করে ছোটো ছেলে নিয়ে এসেছে মন গলাবার জন্যে! এবার আমাকে উঠতে হয়, তাহলে চাঁদাটা–
ভীষণ রেগে গেলেন সমরেশবাবু, তক্তপোশে কিল মেরে বললেন, কিচ্ছু দেব না, এক কানাকড়ি চাদা কাকেও দেব না–তুমিও শুনে রাখো বটু– তবে যাদের নাটক সবচেয়ে ভালো হবে তাদের পাঁচশো টাকা বকশিশ দেব।– যাও এখন। বটু, আমার ভাঙানি নয়া পয়সা?
–এই যে আনছি—
বলে এক দৌড়ে ছোটকা কোত্থেকে যেন এই বড়ো এক পুঁটলি নয়া পয়সা এনে দিলেন। আমি তক্তপোশের ধারে রোগা লোকটার পাশে কাঠ হয়ে বসে থাকলাম। কেউ কোনো কথা বলল না।
পথে বেরিয়ে নোটো বললে, দিলেন তো দাদা সব ফেঁসে! আমি অনেকটা পাকিয়ে এনেছিলাম, আজ রাতে কি আপনার না এলেই নয়? ও হ্যাঁ, আপনাদের শিশুপালকে নাকি কান ধরে নিয়ে গেছে?
বোধ হয় ভেবেছিল ছোটকা রেগে যাবেন। ছোটকা কিন্তু হেসে বললেন, এক শিশুপাল গেল, তার বদলে আরও ভালো শিশুপাল আসবে। চুটিয়ে সাজাব স্টেজ, বলবেন গিয়ে ভোঁদাকে। পাঁচশো টাকা যখন সমরেশবাবু দেবে তখন আর ভাবনা কী?
–আহা, ফাস্ট হলে তবে তো!
–ওই একই হল, আমাদের নাটক করা মানেই ফাস্ট হওয়া।
নোটো রেগে হনহনিয়ে এগিয়ে গেল। আমাদের রাস্তায় ঢুকেই ছোটকা বললেন, একটা ভালো শিশুপাল জোগাড় হয় কী করে তাই ভাবছি। দাদাকে বলে দাড়ি-গোঁফের ব্যবস্থাটা করে ফেল শিগগির।
আমি বললাম, তুমি যে এক্ষুনি বললে পাঁচশো টাকা পাচ্ছ, আর ভাবনা নেই।
–নাঃ, তুই নিতান্ত গাধা দেখছি। আরে শত্ত্বরকে ও-রকম বলতে হয়, তাও জানিস না? ওদেরও টানাটানি যাচ্ছে। গত বছর একসঙ্গে কাজ হয়েছিল, অনেক চাদা উঠেছিল। এবার দু-দল হয়েছে, চাদাও ভাগাভাগি। তার উপর ওদের জিনিসপত্রও কিছু কিছু খোয়া গেছে নাকি শুনছি। কারো এখন মাথা ঠিক নেই। খুব সাবধানে এগুনো দরকার।
খুপরি ঘরের লোকটা দেখলাম একটা লণ্ঠন তুলে চারদিকে চেয়ে দেখছে। লণ্ঠন একদিকে লাল কাচ, অন্যদিকে সবুজ কাচ। অনেক দূর থেকে লণ্ঠনটাকে দেখা যায়, তার চারপাশ দিয়ে আলো বেরুচ্ছে, কিন্তু লণ্ঠনটা নিয়ে বেশি দূর দেখা যায় না।
রাস্তায় বৃষ্টির জল জমা হয়েছে, ছোটকা গিয়ে খুপরি ঘরের উঁচু জায়গাটাতে উঠলেন, আমিও পিছনে পিছনে গেলাম। ওখান থেকে একবার দেখা দরকার।
বুকের ভেতরে হঠাৎ ছাৎ করে উঠল, যদি দেখি কালো মাস্টার জলের ধারে পা ঝুলিয়ে বসে আছে! ছোটকা অমনি হই চই করে একটা কাণ্ড বাধাবেন, এদিকের ঘাট থেকে নৌকো নিয়ে ঘুরে ওখানে গিয়ে উপস্থিত হবেন। ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছিলাম, তাকাতে ভয় করছিল। আস্তে আস্তে চোখ ঘুরিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, নাঃ, কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না!
রাত্রে নরম নরম আটার লুচি হয়েছিল, তার সঙ্গে ছোলার ডাল, বেগুনভাজা আর ডিমের ডালনা। বড়োকাকিমা কী ভালো পায়েস করেছিলেন! রান্নাঘরের দাওয়াতে রংচঙে আসনে সারি সারি বসে পাত পেড়ে সবাই খেলাম।
আমাদের খাওয়া হলে ওইখানে কাকিমারা সবাই বসলেন, বড়োরা উঠোনের মস্ত গন্ধরাজ গাছের নীচে তক্তপোশের উপর বসে নাটকের কথা বলতে লাগলেন।
ভোঁদার উপরে বড়োকাকা ছাড়া সকলের কী রাগ! বড়োকাকা পান চিবোত চিবোতে খালি খালি বলতে লাগলেন, তোরা যাই বলিসনা কেন, কাপ নেবে ওরাই। ওদের সঙ্গে তোদের তুলনা! ছোঃ! কী কাজের ছেলে ভোঁদা, আমাদের নতুন দোকানঘরের জন্যে দু-গাড়ি সিমেন্ট পাইয়ে দিয়েছে। দিয়েছি একটা মোটা চাদা। অনেক খুঁটিনাটি জিনিস ওদের কেনা বাকি আছে। বলছিল। কোথায় নাকি সাজের জিনিস আনতে লোক পাঠিয়েছিল, তার কোনো পাত্তা নেই। ভারি ভাবনা ওদের। দেখছিলাম রিহার্সাল, চমৎকার প্লে করছে। শিখে নিলে পারিস।
শুনে কাকিমাদের পর্যন্ত পিত্তি জ্বলে গেল। ছোটকা, মেজোকাকা, বড়দা, মেজদা, বিভুদা সব রেগে উঠে গেল। বড়োকাকা আরেকটু চুন দাঁতে লাগিয়ে বললেন, কী হল? বাবুদের বুঝি রাগ হল? তা তোরাও ওদের মতো ভালো হ-না, তোদেরও প্রশংসা করব। তুই যে বড়ো বসে থাকলি, চাঁদ?
বড়োকাকিমা বললেন, ও তো আর নাটক করছে না, ওর উঠে যাবার কী আছে?
–কেন, ওকে বাদ দিয়েছে কেন? ছোটো পার্টও তো আছে।
-বিভু বলছিল ও তেমন পারবে না, তা ছাড়া পাড়ার পাঁচটা ছোটো ছেলেকে বাদ দিয়ে তো আর ওকে নেওয়া যায় না, এরা কী মনে করবে! হাজার হোক ও থাকে কলকাতায়। তবে বাদ দেওয়া হয়েছে সে আবার কেমন কথা? ও তো বটঠাকুরকে বলে সমস্ত দাড়ি-গোঁফের ব্যবস্থা করছে। সেও তো একটা বড়ো কাজ।
বড়োকাকা অবাক হয়ে গেলেন।
–দাদা দাড়ি-গোঁফ কিনে দেবে, এ তো ভারি আশ্চর্য! এরা নাটক করছে শুনে তো ওকে আসতেই দিচ্ছিল না। নাকি যত রাজ্যের বখা ছেলেদের আড্ডা হবে, এইসব বলছিল। তা বাপু নাটক না হলেও তো আর বখা ছেলেদের এড়াতে পারবি নে, তারাই যখন ওর খুড়ো, ওর দাদা। কী-বলিস চঁদ?
ততক্ষণে কাকিমারা উঠে পড়েছেন, আর বামুনদিদি কঁসিতে করে গোছ গোছ লুচি আর বেগুনভাজা আর ঘরে-করা সন্দেশ, ভাড়ারঘরের সামনে জালের আলমারিতে সকালের জলখাবারের জন্যে তুলে রেখেছে। আমি তখন উঠে গেলাম।
একতলাতেই আমার ঘর। জানলার সামনে গঙ্গা, খাটে শুয়ে সেইদিকে চেয়ে চেয়ে প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। হঠাৎ মনে হল সে লোকটা তো সেই চাট্টি কুচো নিমকি আর একটা মুড়ির মোয়া ছাড়া আর কিছু খায়নি।
অমনি চট করে উঠে পড়লাম। বাড়ি ততক্ষণে নিঝুম হয়ে গেছে। জালের আলমারি থেকে গোটা কুড়ি লুচি, বেগুনভাজা, সন্দেশ এইসব নিয়ে আমার বয়স্কাউটের থলিতে ভরলাম, জলের বোতলে জল ভরলাম। এ তল্লাটে কেউ নেই যে কিছু বলবে। বামুনঠাকরুনের বাড়ি কাছেই, সে রাত দশটায় চলে যায়, চাকররা সারি সারি দালানে শোয়। সামনে বৈঠকখানা ঘরের পাশে ছোটকার ঘর, তার পাশে বিভুদার ঘর। মাঝখানের দরজা খোলা থাকে, বিভুদার বড্ড ভূতের ভয়! অবিশ্যি বলে নাকি রাতে যদি ছোটকাকে বোঙায় ধরে, তাই খুলে রাখে।
খিড়কির দরজা খুলে গেলাম চলে পেরিস্তানে। পিঠে থলি আর জলের বোতল ঝুলছে, গলায় দড়ি-বাঁধা টর্চ, পেনসিলের মতো ছোটো। ছোটোমামা জন্মদিনে দিয়েছিল।
০৫.
বিশে অন্ধকারকে ভয় পায় না। বলে, ভয় আবার কীসের, কেই-বা আমাকে দেখতে পাচ্ছে অন্ধকারে। ওদের দ্বীপের পথে আলো জ্বলে না। চাঁদ না থাকলে হাজার হাজার তারার আলোতে পথঘাট ফুটফুট করে! ওদের দ্বীপের মাঝখানের স্থির জলে বিরাট বিরাট কচ্ছপ থাকে, তারা রাত্রে জল থেকে ডাঙায় উঠে ঘুমোয়, অন্ধকারে বড়ো বড়ো পাথরের মতো দেখায়।
সমুদ্রের ধারে কালো পাথরের উঁচু পাড়ি, তার ধাপে ধাপে বুনো হাঁসদের বাসা। রাত্রে তাদের সাদা সাদা ছায়ার মতো দেখায়। শীতের শেষে দল বেঁধে তারা উত্তর দিকে উড়ে যায়। সমুদ্রের উপর দিয়ে সমানে উড়ে চলে, ভয়ডর নেই।
কিন্তু খিড়কির পাঁচিল বেয়ে কিছুদূর গেলেই দু-বাড়ির ছায়া মিশে সে যে কী দারুণ অন্ধকার তৈরি করে রেখেছে সে আর কী বলব। তার অনেক নীচে জলের শব্দ। সামনে বেল গাছের পাতা বাতাসে খড়খড় করছে।
চলে গেলাম সেখান দিয়ে পেরিস্তানে। লোকটা কপালে হাত দিয়ে জলের দিকে তাকিয়ে বসেছিল। আমাকে দেখে দারুণ চমকে উঠল। সাহস দিয়ে বললাম, এ যে আমি, তোমার কোনো ভয় নেই। তোমার জন্য খাবার এনেছি।
সে খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠল।
–এনেছ? আঃ, বাঁচালে! সর্বদাই আমার কিছু-না-কিছু খাওয়া চাই। নইলে দুব্বল হয়ে যাই। কই, দাও কী এনেছ।
খেতে খেতে বার দুত্তিন আমার দিকে তাকাল। কিন্তু আমি একটু টর্চটা জ্বালতেই ভারি ব্যস্ত হয়ে উঠল।
ও কী কর কত্তা, ও যে একেবারে কঁচড়াপাড়ার ওধার থেকে চোখে পড়বে, অন্ধকারে খোলা চোখের মতো জ্বলজ্বল করবে। ও কাজও কোরো না। দু-দিন একটু হাড় ক-খানিকে জিরিয়ে নিই। পৃথিবীতে যে এমন একটা শান্তির জায়গা আছে, এ আমি ভাবতেও পারিনি। চাট্টি ভোগ করে নিই। তারপর আবার সেই কুমির-কুমির খেলায় নামতে হবে তো! এত বড়ো বাড়ি তোমার, আমাকে একটা চাকর করেও তো রেখে নিতে পার। তবে আমি অন্য চাকরদের সঙ্গে শোবটোব না, আমাকে আলাদা ঘর দিতে হবে। এই ঘরেই আমার চলে যাবে, এর বেশি কিছু আমার দরকার নেই।
লোকটার কথা শুনে আমি অবাক! বললাম, এ বাড়িটা মোটেই আমার না। তা ছাড়া তুমি কী কাজ করতে জান যে চাকর রাখব?
লোকটা ততক্ষণে খাওয়া সেরে, নদীর জলে হাত-মুখ ধুয়ে আমার কাছে এসে বসেছে। বললে, চাকরি কত্তে হলে কাজ জানা চাই একথা তোমাকে কে বললে? আমি খুব ভালো আঁকতে পারি। ওই যারা সব বড়ো বড়ো সোনার মেটেল পায় আর খেতাব পায়, আমি তাদের চেয়েও ভালো আঁকতে পারি।
পার তো তুমি সোনার মেডেল পাও না কেন?
–তার অনেক অসুবিধে আছে কত্তা। আমি তো আর কাগজে আঁকি না।
কাগজে আঁক না তো কীসে আঁক?
–সে আছে সব, কত্তা, বলব একদিন।
দূরে গির্জার ঘড়িতে রাত বারোটা বাজল। উঠে দাঁড়ালাম, এখন ঘুমোতে যেতে হয়। লোকটা হঠাৎ ফিরে আমার পা দুটোকে জড়িয়ে ধরে বলল, দাও কত্তা, দুটো পায়ের ধুলো দিয়ে কেতাখ করে দাও। আহা ঠাই দিয়ে, আহার দিয়ে প্রাণটা বাঁচালে গো। নইলে পরের জিনিস ঘাড়ে করে বয়ে বেড়াচ্ছি, আমাকে এমন বন্ধু কোন দেবতা দিত হ্যাঁ!
.
ঘরে ফিরে এসে শুয়ে শুয়ে লোকটার কথাই ভাবতে লাগলাম। কালোমাস্টার আবার একটা নাম নাকি? নিশ্চয় ছদ্মনাম। বিশেটাও এর মধ্যে আর আসেনি, ও লোকটা যদ্দিন থাকবে আর আসবেও না। উঃ, পাঁচিল চড়ে চড়ে পায়ে কী ব্যথা! বাড়িতে আমাদের বুড়ো চাকর পাঁচুদা রোজ আমার পায়ে তেল মালিশ করে দিত; কিন্তু এখন থেকে আর দিতে দেব না। পাঁচুদা আমার খাবার সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকত, মাছের কাঁটা বেছে দিতে চাইত, দেব ভাগিয়ে। যারা বেশি পুতুপুতু করে মানুষ হয়, বিশে তাদের নাড়ুগোপাল বলে।
ওদের দ্বীপে নাকি চাকর নেই। যে-যার নিজের কাজ নিজে করে। আমি আজকাল রোজ আমার গেঞ্জি কেচে স্নানের ঘরের জানলায় মেলে দিই।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। সকালে ঘুম ভেঙে শুনি রান্নাঘরের দালানে বামুনদিদি মহা রাগমাগ করছে। বাসন মাজে তারিণী, তাকে বলছে, একেবারে বক-নাক্কস গো। রোজ ডুলি খুলে আট-দশখান লুচি খেয়ে নেয়, কিন্তু কাল রাত্তিরে একেবারে এক দিস্তে সাবাড়! ওই বিভুদাদার কপালে অনেক দুঃখু আছে এই আমি বলে দিলাম!
বিভুদাও দালানের ওধারে নিমকাঠি দিয়ে দাঁতন করছিল। কথা শুনে সে তো চটে লাল!
–শুনলে ছোটকা? মোটেই আমি লুচি খাইনি, বামুনদির কথা শোনো একবার! বামুনদিদি ঝনর ঝনর করে বাসন নামাতে নামাতে বলল, না খায়নি। লুচিগুলো কঞ্জুর হয়ে উবে গেছে! কাল দুধের দাঁত পড়তে দেখলুম, আর আজ মুখ থেকে সকাল বেলায় কেমন মিছে কথা বেরুচ্ছে দেখেছ! আজ তোমাকে শুকনো তো দেওয়া হবে দেখো।
দুমদাম করে পা ফেলতে ফেলতে বামুনদিদি লুচি গরম করবে বলে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল। বিভুদা গজর গজর করতে লাগল, আমি স্নানের ঘরে গিয়ে ঢুকলাম।
সত্যিই কোথাও একটা ভালো শিশুপাল পাওয়া গেল না। ছোটকা অনেক বলাতে বড়োকাকা প্রকাশদার বাবাকে বোঝাতে গিয়েছিলেন, তা তিনি নাকের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বড়োকাকিমা বললেন, ওই ব্ৰজেনদাই হল গিয়ে নষ্টের গোড়া, ওকে তোরা পাঁচজনে মিলে দুটো কথা শুনিয়ে দিতে পারিস নে? ও-ই যখন ভাগিয়ে দিয়েছে, ও-ই আনুক-না একটা শিশুপাল!
বিভুদা হই হই করে ছুটে এল, আঃ মা, তুমিই সব ডোবাবে দেখছি! বাইরের ঘরে ব্রজেনদা ছোটকার সঙ্গে ফর্দ করছেন, কথাগুলো ওঁর কানে গেলেই হয়েছে আর কী?
বড়োকাকিমাও রেগে গেলেন, তুই থাম দিকিনি, আমার উপর আর কর্তৃত্ব করতে হবে না! কেন বলব না সত্যি কথা, এক-শো বার বলব।
বিভুদা প্রায় কেঁদে ফেলে আর কী।
–আঃ, মা, কেন বোঝ না যে শুনতে পেলে ব্রজেনদা যদি রেগেমেগে চলে গিয়ে ভোঁদার দলে যোগ দেয়, তখন কি তুমি শ্রীকৃষ্ণ সাজবে নাকি?
সেখানে যারা ছিল সব্বাই হাসতে লাগল। বড়োকাকিমা রেগেই ছিলেন, চেঁচিয়ে বললেন, তা অত হাসবার কী আছে এতে? পারব না নাকি শ্রীকৃষ্ণ সাজতে তোরা ভেবেছিস! জানিস, ইস্কুলের প্রাইজে আমি আওরঙ্গজেব সেজেছিলাম?ইয়া গোপ এঁকে দিয়েছিল, সে আর কিছুতেই ওঠে না। সে যাক গে, কিন্তু তুই শ্রীকৃষ্ণ সাজিস না কেন রে বিভু?
বিভুদা আমতা আমতা করতে লাগল।
–ইয়ে– না– মানে– আমি দ্বিতীয় পাণ্ডব সাজছি কি না–
–আহা, ভারি তো দ্বিতীয় পাণ্ডব সাজছিস, তিন লাইন তো কথা বলতে হবে। ও পার্টটা চাঁদকে দিয়ে, তুই শ্রীকৃষ্ণ সাজলেই পারিস। তুই যখন হলি, দেশ থেকে আমার ধাই-মা তোকে দেখতে এসেছিল। চেয়ে চেয়ে আর চোখ ফেরাতে পারে না। বললে, আহা, ঠিক যেন নীল পদ্মের কুঁড়ি, তেমনি রং, তেমনি ঢং, মানুষ বলে তো মনে হয় না গো! শ্রীকৃষ্ণ তোকেই মানাবে।
বিভুদা ঢোক গিলে বললে, না, মানে, আমি একটু মানে শ্রীকৃষ্ণ বেশ রোগা ছিলেন কিনা– তা ছাড়া চাঁদের পেটে বালিশ বেঁধে দিলেও ওকে ভীমের মতো দেখাবে না। কী লিকপিকে হাত-পাগুলো দেখেছ! গোলমরিচ খেলে হেঁচকি ওঠে!
বলে বড়োকাকিমার সামনে আমার হাতের গুলি সেইরকম করে টেনে দড়কচা বানিয়ে দিল। আমার ভীষণ রাগ হল, বড়োকাকিমার ওপাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম, আহা! তুমি তো কুকুর ভয় পাও; পাণ্ডবদের সঙ্গে যে কুকুরটা স্বর্গে গিয়েছিল, তাকে দেখলে তো তুমি ভয়ে পালিয়ে যেতে! আর আমার বন্ধু বিশের মস্ত পোড়া হাঁড়ির মতো মুখওয়ালা কুকুর সিংহকে দেখলে তো তোমার পতন ও মুচ্ছো হয়ে যাবে! তোমার চোখ উলটে যাবে।
আমার সাহস দেখে দারুণ অবাক হয়ে বিভুদার মুখে আর কথা সরে না! তারপর বললে, বিশে? দেখলে মা, এত বারণ করা সত্ত্বেও পাড়ার বখা ছেলেদের সঙ্গে ভাব করেছে! এবার খারাপ কথা বলতে আর বিড়ি ফুঁকতে শিখতে কদ্দিন! জ্যাঠামশাই শুনলে কী বলবেন বলো তো, তোমাদেরই দোষ দেবেন দেখো!
অমনি বড়োকাকিমা চোখ গোল গোল করে খপ করে আমার কাধ ধরে ফেললেন, কোথায় পালাতে চেষ্টা করছিস, চাঁদ? বিভু যা বলল সেসব কি সত্যি? কে ওই বিশেটা? নাম শুনেই মনে হয় একটা গুন্ডা পালোয়ান কেউ। কোথায় ওর সঙ্গে তোর দেখা হল বল শিগগির। পাড়ার যত সব বয়ে-যাওয়া বাজে ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা! বিশে নিশ্চয় ফণী মিত্তিরদের বাড়ির কেউ?
আমি তো পালাবার পথ পাই নে। রাগের মাথায় বিশের নাম করে ফেলাটা যে কত বড়ো অন্যায় হয়ে গেছে বুঝতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু থামতে পাচ্ছিলাম না। বিভুদাদের কথায় গা জ্বলে যাচ্ছিল। এদিকে বিভুদাও বার বার বলছে, বল, কে ওই বিশে! ওই ভোঁদাদের দলের কেউ নাকি? ওঃ! তাহলে এবার বোঝা গেল ভোঁদারা আমাদের ভেতরকার সব খবর কোত্থেকে পায়! বিশ্বাসঘাতক! স্পাই! গুপ্তচর! টিকটিকি!
শেষটা আমি রেগে চেঁচিয়ে বললাম, না, না, না, না, বিশে তোমাদের পাড়ার কেউ নয়। এ পাড়ার কেউ ওকে চেনেও না, ও মোটেই বখাটে বয়ে-যাওয়া স্পাইনয়। তবে ওর গায়ে ভীষণ জোর, বিভুদাকে ও এক হাতে পটকে দিতে পারে, ও কাউকে ভয় পায় না, ও ও
বড়োকাকিমা বললেন, আহা! ওরকম কচ্ছিস কেন চাঁদ? ওর সঙ্গে তোর কোথায় দেখা হল? তোর বাবা-মা তোকে আজেবাজে কারো সঙ্গে মিশতে দেন না বলেই বলছি।
আমি আবার চেঁচাতে লাগলাম, মোটেই বিশে আজেবাজে লোক নয়! বিশে কী ভালো! হাঙরমুখো নৌকো চেপে কুকুর নিয়ে আসে!
–কোথায় আসে?
পেরিস্তানে।
কাকিমা আর বিভুদা তো হাঁ! পেরিস্তানে? পেরিস্তান আবার কোন জায়গা।
-হ্যাঁরে, তোর শরীর খারাপ লাগছে না তো রে! গত বছরের আগের বছর যে-রকম ম্যালেরিয়াতে ভুগলি, শরীরটাতে সেই ইস্তক আর কিছু নেই!
আমি বললাম, না, বিশে বলেছে খুব ভালো আমার শরীর, ওসব যত রাজ্যের বাজে বানানো কথা! কিছু হয়নি আমার! পুতুপুতু করা ভারি খারাপ!ও-রকম করলে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাব বলে রাখলাম!
এই বলে ফস করে বড়োকাকিমার হাত থেকে গলে বেরিয়ে, একেবারে নিজের ঘরে দরজা দড়াম ও ছিটকিনি! কারো কথায় দরজা খুলিনি, গোঁজ হয়ে অনেক বেলা অবধি ঘরে বসে থাকলাম। তারপরে যে-যার নিজের কাজে চলে গেলে, বাইরেটা চুপচাপ হয়ে গেলে, গুটিগুটি বেরিয়ে এসে একটা গোটা পাঁউরুটি আর দুটো বাসি আলুর চপ আর এক ছড়া কলা ডুলি থেকে বের করে এনে আমার ঘরে লুকিয়ে রাখলাম। বিকেলের জলখাবারের আগে খোঁজ হবে না জানতাম।
আমাকে স্নান করে সকলের সঙ্গে খেতে বসতে দেখে বড়োকাকিমা আর বিভুদা যেমনি অবাক হল, তেমনি হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। ঠিক জব্দ হয়েছে। আমি বাড়ি ছেড়ে পালালে বাবা আর ওদের কাউকে আস্ত রাখবে না! হয়তো এ-বাড়ি থেকেই তাড়াবে! রাখি পিসিমা বলেছে, ঠাকুরদার ঠাকুরদার বাবার তৈরি এই বাড়িটা নাকি বাবার ভাগে পড়েছে, তাই বাবাকে কেউ চটাতে চায় না। আসলে অবিশ্যি রাখি পিসিমার ছেলে হরিশেরই নাকি বাড়িটা পাওয়া উচিত ছিল, কারণ ও বাবার চেয়েও বয়সে বড়ো আর খুব ভালো মাউথ-অর্গান বাজায়।
যাই হোক, আমি আছি দেখে সবাই যেন নিশ্চিন্ত। এমনকী, বিভুদাকে ছোটকা বললেন, চাঁদকে বলেছিস নাকি?
বিভুদা মাথা নাড়ল। ছোটকা বললেন, দেখ চাঁদ, তুই দ্বিতীয় সৈনিক হবি আর অমরেশকে ওই মৃত সৈনিকের পার্টটা দিচ্ছি। ওটা খুব সহজ, বেশি রিহার্সাল লাগবে না, একবার শুধু কোৎ শব্দ করে পড়ে যেতে হবে, তারপর শিশুপাল বধ হওয়া পর্যন্ত, হাত-পা এলিয়ে পড়ে থাকতে হবে।
বিভুদা বললে, আসলে ওই পার্টটাই তোকে দেবার কথা হয়েছিল, বেশ পালক-দেওয়া শিরস্ত্রাণ পরতে পেতিস। কিন্তু ছোটকা বলছে, তুই স্টেজে শুলে ফুটলাইটের ওপর দিয়ে তোকে দেখাই যাবে না, আর অস্ত্রশস্ত্রগুলোও বড্ড বড়ো।
খেয়ে উঠে কাগজে-লেখা পার্টটা পকেটে নিয়ে আবার ঘরে গিয়ে দোর দিলাম। সবাইকে বললাম ঘুম পাচ্ছে, কেউ যেন বিরক্ত না করে। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে, খিড়কির বাগানের দিকে স্নানের ঘরের দরজা খুলে তিন মিনিটে পেরিস্তানে পৌঁছে গেলাম।
দেখলাম কালোমাস্টারের মেজাজ ঠিক নেই বললে, এই অ্যাত্ত বেলা করে ওইরকম শুকনো খাবার আনলে? কই, আমার মাছ তরকারি ভাত কই? নিজে তো একরাশ গিলে এসেছ!
বললাম, অনেক কষ্টে এনেছি। খেতে হয় এই খাও, নয় তো উপোস করে থাকো, আমি চললাম। আমারও মন ভালো নেই।
বলে যেই উঠে দাঁড়িয়েছি, অমনি সে সটাং মাটিতে শুয়ে পড়ে আমার দু-পা জড়িয়ে ধরে বললে, খ্যামা দাও কত্তা, খিদের চোটে অন্যায় বলেছি! নয়তো দু-ঘা লাগিয়ে দাও, কিচ্ছুটি বলব না! কিন্তু আমাকে ছেড়ে যেয়ো না। আমি আবার বসলাম, আর সে সাপটে-সুপটে পাঁউরুটি, চপ, কলা সব খেয়ে ফেলল। ভেবেছিলাম বিকেলের জন্য কিছু রাখবে, তাও রাখল না। শেষটা বললাম, বিকেলে আমার রিহার্সাল আছে, রাতের আগে আসতে পারব না, তুমি বরং জলখাবারের সময় কুচো নিমকি আর মুড়ির মোয়া খেয়ো।
সে যেন আকাশ থেকে পড়ল।
–ওমা! মুড়ির মো আবার কোত্থেকে আসবে? সে তো আমি টিপিন খেয়েছি, তোমার দেরি দেখে!
পকেট থেকে আমার বাঁদর-বিস্কুটের ঠোঙাটা শেষপর্যন্ত দিতে হল। সে মহা খুশি হয়ে তখুনি দুটো বিস্কুট মুখে পুরে বলল, ওয়াঃ! এর সঙ্গে অমৃতের যে কোনো তপাত নেই, কত্তা! ও হ্যাঁ, রিহার্সালের কথা কী বলছিলে? দেখি পাটাখানা; দিয়ে দোব নাকি এইসা এক মওড়া যে সকলের তাক লেগে যাবে!
বললাম, মওড়া আবার কী?
সে তো অবাক!
–ওমা, নাটক করবে, মওড়া জান না? তালিম গো, তালিম! ওই যাকে বলে রিহার্সাল তাই আর কী।
আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম, ও লোকটাই-বা অত কথা জানল কী করে?