প্ৰেম
দেখা যাচ্ছে যে, বিবাহ ব্যাপারটাই নানা কারণে বড় গোলমেলে। পণ্ডিতরা বলেন, মানুষের সমাজ দীর্ঘ ইতিহাস পেরিয়ে ঐক্যবিবাহে পৌঁছেছে এবং এ ব্যাপারটা যখন বহু সহস্রাব্দ ধরে সুস্থায়ী হয়েছে তখন এইটিই নরনারী সম্পর্কে বিবর্তনের চূড়ান্ত ও অক্ষয় পর্যায়— এক হিসেবে ঐতিহাসিক ভাবে চূড়ান্ত। কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে এটা মোটেই অক্ষয় নয়। প্রথমত, বহু আদিবাসী জীবনে ঐক্যবিবাহ প্রচলিত নয়; তাদের নারী পুরুষ উভয়ই বহুগামী, সন্তানও পিতৃপরিচয়ে পরিচিত নয়। এদের সংখ্যা কম নয়, এবং যেহেতু আমাদের সঙ্গে মেলে না সে হেতু এদের নারীপুরুষ সম্পর্ক বৈধ নয় এমন মনে করবার কোনও কারণ নেই। দীর্ঘকাল ধরেই বহুগামিত্ব— নারী পুরুষ উভয়েরই— সমাজে আচরিত এবং স্বীকৃত। দ্বিতীয়ত, প্রায় অর্ধশতাব্দীরও আগে থেকে ক্যাথলিক জগতে, ইয়োরোপে, উত্তর ও প্রধানত দক্ষিণ আমেরিকাতেই এবং অন্যান্য ক্যাথলিক অধ্যুষিত অঞ্চলে যখন বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে, তখন সরকারি ভাবে অর্থাৎ ধর্মের সংস্থায় পরস্পর বিচ্ছিন্ন না হয়ে নারী পুরুষ পরস্পরের কাছ থেকে এমনিই সরে যাচ্ছে। তারা অন্য সঙ্গী ও সঙ্গিনীর সঙ্গে একত্র বাস করছে। একটা কারণ, বিবাহ বিচ্ছেদের পরে দ্বিতীয় বিবাহ ক্যাথলিক ধর্মে অনুমোদিত নয়। তৃতীয়ত, প্রায় ওই সময় থেকেই বেশ কিছু নারী পুরুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হয়েই একত্র বাস করছে। কারণ, ক্যাথলিকরা বলেন, বিয়ে করলে সে বিয়ে যদি না টেঁকে তো ক্যাথলিক মতে বিচ্ছেদ হলে পর যখন পুনর্বার বিবাহ করা বে-আইনি তখন ওই জটিলতার মধ্যে না ঢুকে ওর মূলোচ্ছেদ করাই ভাল। যে যাকে চায় তার সঙ্গে বাস করুক। যদি বিয়ের পর কোনও দিন তার মধ্যে সাচ্ছন্দ্য বা আনন্দ আর না থাকে তো সরে গেলেই হল। সরে গিয়ে কেউবা একলা থাকে, কেউ ক্রমান্বয়ে সঙ্গী বা সঙ্গিনী পরিবর্তন করে। অনেকেই মনের মতো সঙ্গী বা সঙ্গিনী পায় এবং খুব সুখী হয়। কেউবা বারবার সঙ্গী সঙ্গিনী পরিবর্তন করে চলে, মনের মতো সুখ পায় না, কিংবা কোথাও স্বল্পকালের জন্য সুখ পায় পরে আবার সেটা ফুরিয়ে যায়।
এখনও সমাজে অধিকাংশ মায়ের ক্ষেত্রে বিয়ের ব্যাপারে স্বাতন্ত্র্য কম। অথচ এখনও এ দেশে অধিকাংশ মেয়ের জীবনের পরিণতি দাম্পত্যে। তার বিবাহোত্তর জীবনের সুখ দুঃখ সাচ্ছন্দ্য-অসাচ্ছন্দ্য সবই নির্ভর করে প্রভু অর্থাৎ স্বামীর ওপরে। সে কারণেই স্বামী নির্বাচনের ব্যাপারে তার এমন স্বাধীনতা থাকা উচিত যে, যতক্ষণ না মনোমত স্বামী পায় ততক্ষণ যেন পরিবর্তন করতে পারে। জন স্টুয়ার্ট মিল, প্রায় দেড়শো বছর আগে, ১৮৬৯ সালে বলেছিলেন, ‘যেহেতু তার জীবনের সব কিছুই নির্ভর করছে একটি ভাল প্রভু লাভ করার ওপরে, সেই কারণে তাকে বারবার পরিবর্তন করার স্বাধীনতা দেওয়া উচিত, যে পর্যন্ত না সে তেমন একজনকে পায়।… দাসত্ব সম্বন্ধে স্বাধীনতাই একমাত্র উপশম, যদিও তা-ও পর্যাপ্ত নয়। এ অধিকার প্রত্যাখ্যাত হলে স্ত্রী সম্পূর্ণ ভাবে ক্রীতদাসীতে পরিণত হয়ে যায়।[১] দাম্পত্যে সঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতা নারীর পক্ষে বেশি প্রয়োজন, কেননা সমাজ তাকে নানা ভাবেই পুরুষের অধীন করে রেখেছে; অতএব পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যে প্রভুর কাছ থেকে জীবনে তার নিষ্কৃতি নেই সে তার মনোমত হওয়া অনেক বেশি জরুরি ও বাঞ্ছনীয়। বিশেষত, সমাজ যখন এ স্বাধীনতা পুরুষকে দিয়েছে। কিছুকাল আগেও পুরুষ একাধিক বিবাহ করতে পারত এবং এখনও গণিকালয়ের দ্বার তার কাছে খোলা; পরস্ত্রীর সান্নিধ্যও সে সদর রাস্তায় না পেলেও খিড়কি দরজা দিয়ে পায়। অবশ্যই কিছু বিবাহিত নারীও কখনও কখনও পর-পুরুষের সঙ্গ পায়; কিন্তু একে তো দেশের অধিকাংশ নারীর পক্ষে সে পথে দুস্তর বাধা, তার ওপরে তার কলঙ্কের বোঝাও অনেক অনেক গুরুভার। একটি পরস্ত্রীকামুক পুরুষের চেয়ে এই নারীদের অবস্থা কবির ভাষায়:
বাঁশি বাজে বনে বসন্ত রাগে,
জটিলা, কুটিলা দুয়ারে জাগে।।[২]
[১. ‘Since her all in life depends upon obtaining a good master, she should be allowed to change again and again until she finds one…the free choice of servitude is the only, thorugh a most insufficient alleviation. Its refusal completes the assimilation of the wife to the slave.’ The Subjection of Women, p. 249
২. প্রমথ চৌধুরী: সনেট পঞ্চাশিকা]
বিবাহের উদ্যোগপর্ব থেকে নারীকে নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় রাখা হয়, বিবাহের পরেও পুরুষতন্ত্রে সে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। তার স্বার্থ, তার চিন্তা, সিদ্ধান্ত, আবেগ, অনুরাগ-বিরাগ, এমনকী তার স্বাস্থ্যও পরিবারে গুরুত্ব পায় না। সন্তানপালনে তার ভূমিকা স্বামীর চেয়ে অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ, কিন্তু সে ব্যাপারে তার মতামত উপেক্ষণীয়। সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে রচিত একটি ইংরেজি কাব্যাংশ এখানে প্রযোজ্য:
তারা উত্তর করতে পারে না
তারা প্রশ্ন করতে পারে না
তারা শুধু করে আর মরে।[৩]
[৩. ‘Theirs not to make reply,
Theirs not to reason why,
Theirs but to do and die,’
(Alfred Tennyson: The Charge of the Light Brigade)]
এ বৈষম্য বিবাহিত জীবনের পদে পদে শেষ পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে, এমনকী শিক্ষিত নারীর ক্ষেত্রেও; এবং এ ব্যাপারটা এতই স্বতঃসিদ্ধ যে নারী বা পুরুষ কেউ-ই এর গুরুত্ব সম্বন্ধে যথেষ্ট অবহিত নয়। সোলোমন দেখিয়েছেন, নারী নিজের অবস্থান সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলতে পারত না, স্বামীই ছিল পরিবারের প্রভু, সন্তানরা ও ক্রীতদাসরা ছিল নিম্নবর্গের জীব। শুধুমাত্র পিতার অবর্তমানে মায়ের সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব ছিল। স্ত্রী ছিল স্বামীর অধীনে।[৪]
[৪. ‘ A woman did not question her place; the husband was the family’s head, children and bonded servants were in lower categories, the mother had full authority only in the father’s absence. The wife was subordinate of her husband.’ In the Company of Educated women. p. 2]
বিবাহিত জীবনে পরিবারের বৃহত্তর সমাজের এবং স্বামী স্ত্রী দু’জনের মধ্যেকার বাধা মাঝে মাঝেই দুর্লঙ্ঘ্য হয়ে দাঁড়ায়। তখন বিবাহ দু’জনের কাছেই, কখনও বা একজনেরই কাছে সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে যায়। কেন যে এটা হয় তার বাইরের কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দৃষ্টিগোচর, যেমন আর্থিক অসঙ্গতি, রুচির বৈষম্য, সন্তানপালন সম্বন্ধে মতদ্বৈধতা, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণের পার্থক্য, জীবনের লক্ষ্য ও মূল্যবোধ সম্বন্ধে মতবৈষম্য, পারিবারিক সমালোচনা, স্বামীর নিজের পরিবারের আচরণ ব্যাপারে পক্ষপাতী অন্ধতা, স্ত্রীর আপন পরিবারের প্রতি আনুগত্য বা কর্তব্যবোধ সম্বন্ধে স্বামীর ও শ্বশুরবাড়ির অসহিষ্ণুতা— এই সব, এবং আরও হাজারটা কারণ দু’জনের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করে। যথাকালে অর্থাৎ সূচনাতেই পারস্পরিক আলোচনার মধ্যে এর নিষ্পত্তি না ঘটলে অভিযোগ ক্রমে অনুক্ত থেকে উক্ত এবং মৃদু থেকে দুর্বিষহ কটুতায় পরিণত হয়। তখন পরস্পরকে সহ্য করাই অসম্ভব হয়ে ওঠে, বিয়ের ভিত টলে যায় এবং বিচ্ছেদ যেন অনিবার্য বলে মনে হয়। সূচনায় আলোচনা মতৈক্য থাকলেও পরে বারে বারেই সে ঐক্য ভেঙে যায়, কারণ মানুষের চিত্ত ও জীবনবোধ সচল অততা পরিবর্তনশীল; কাজেই বারে বারেই এ ধরনের আলোচনার প্রয়োজন। এবং এ আলোচনা নিয়ন্ত্রিত হয় ঐকমত্যে পৌঁছবার শুভবুদ্ধি দিয়ে।
এ তো গেল বাইরের কারণ। এ ছাড়াও দুটি মানুষের ভিতরে, যদি প্রেম একদিন থেকেও থাকে তবু, আপাত ভাবে সম্পূর্ণ অকারণেও একদিন তা নিশ্চিহ্ন হয়। মনস্তত্ত্বিকরা বলেন, কারণটা অবিদ্যমান নয়, তবে দুর্লক্ষ্য। তবে ফলটা খুবই স্পষ্ট: প্রেমের মৃত্যু। বোধহয় পূর্বরাগের পরের বিবাহে প্রেমের মৃত্যুর সবটা আর্তি ধরা পড়েছে প্রাচীন ভারতের নারী কবি শীলা ভট্টারিকার একটি বিখ্যাত কবিতায় :
যে আমার কৌমার্য হরণ করেছিল, (পরে) সেই হল বর। সেই রকমই ফুল্ল মালতীর গন্ধ বয়ে আনছে কদম কুসুমের গন্ধবাহী বাতাস। আমিও সেই আমিই আছি, তথাপি (আজ) সেই (সংকেত) স্থলেই মিলনের লীলাবিধিতে এই রেবা নদীর কূলে বেতসকুঞ্জে চিত্ত (কেন যেন) উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেছে।[৫]
[৫. যঃ কৌমারহরঃ স এব হি বরস্তাশ্চৈব চৈত্রক্ষপা-
চোন্মীলিতমালতীসুরভয়ঃ প্রৌঢ়াঃ কাদম্বানিলাঃ। সা চৈবাস্মি তথাপি তত্র সুরতব্যাপারলীলাবিধৌ রেবারোধসি
বেতসীতরুতলে চেতঃ সমুৎকণ্ঠতে।।]
কেন— তা নায়িকাও জানে না। যে-প্রেমের আকুতিতে একদিন কুমারী শরীর প্রেমিককে স্বেচ্ছায় অর্পণ করেছিল সে পরে তাকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছে। সেই পুরনো অভিসারের যে কুঞ্জ রেবানদীর তটে, তেমনই কদম আর মালতীর গন্ধে উদ্দাম সমীরণ, অথচ আজকে মিলনলগ্নে চিত্ত কেন এমন নিরুৎসুক? এমন উদাসীন? কেন, তা কে জানে? প্রেমের অপর এক কবি অমরু-র ‘শতক কাব্যে’ এমনই আর একটি দুর্লভ রত্ন আছে:
যেখানে ভ্রুকুটিরচনাই ছিল ক্রোধের প্রকাশ, চুপ করে থাকা ছিল অত্যাচার, পরস্পরের (দিকে চেয়ে) স্মিতহাসি ছিল অনুনয়, দৃষ্টিপাত ছিল প্রসন্নতা— দেখ, সেই প্রেমের আজ এ কী মৃত্যু: তুমি আমার পায়ে লুণ্ঠিত, তবু এই হতভাগিনীর ক্রোধ যায় না।[৬]
[৬. কোপো যত্র ভ্রূকুটিরচনা নিগ্রহো যত্ৰ মৌনং
যত্ৰন্যোন্যস্মিতমনুনয়ো দৃষ্টিপাতঃ প্রসাদঃ।
তস্য প্রেমণস্তদিদমধুনা বৈশসং পশ্য জাতং
ত্বং পাদান্তে লুঠসি ন চ মে মন্যুমোক্ষঃ খলায়াঃ।।]
বেশি না হলেও আরও কিছু দৃষ্টান্ত আছে কাব্যে সাহিত্যে। কবি বলছেন: ‘যে প্রেম একদা সজীব ও উদ্বেল ছিল সেই প্রেমে নেমে এসেছে বিমুখ ঔদাসীন্য।’ বিদেশি সাহিত্যে প্রেমের মৃত্যুর এই ধরনের বিবরণের অনেক বেশি দৃষ্টান্ত মেলে।
বহু স্থলে তৃতীয় বা তৃতীয়ার সমাগমে পূর্বপ্রেমে ক্লান্তি অনুভূত হয়। নতুনের সম্বন্ধে কৌতূহল, আগ্রহ অধীরতায় পৌঁছয়, দীর্ঘদিনের জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনী গৌণ নিষ্প্রভ হয়ে যায়। আবার কখনও বা অন্য কারও উপস্থিতির আগেই প্রেমে শৈথিল্য দেখা দেয়। ক্লান্ত, পুরনো, একঘেয়ে লাগে পূর্ব-প্রণয়ের সমস্ত অনুষঙ্গকে। তার পরে কখনও নতুন অনুরাগ জন্মায়। কখনও বা জন্মায়ও না, শুধু পুরাতন প্রেম সম্বন্ধে ঔদাসীন্যের মধ্যে দিয়ে নেমে আসে একজীবনের প্রেমের মৃত্যুর সূচনা। যে-পক্ষ এটা অনুভব করে সে কখনও কখনও চিত্তের এই পরিণতিতে ব্যথিত হয়। কালিদাসের বিক্রমোর্বশীয় নাটকে নতুন প্রেমে উজ্জ্বল পুরূরবাও অল্পক্ষণের জন্যে হলেও সত্যই ক্লেশ ভোগ করেছিলেন অনুরাগিণী বধূ ঔশীনরী সম্বন্ধে তাঁর ঔদাস্যে। কিন্তু তখন তাঁর জীবনে সে প্রেমের মৃত্যু ঘটে গেছে, পুরূরবার চিত্তবৈকল্য সেই মৃত্যুর জন্যে শুধু ক্ষণিক শোক। জীবন জটিল, প্রেমের জীবনও বহু দুঃসমাধেয় জটিলতায় আকীর্ণ।
ফলে বিয়ে ভাঙে। কখনও ধীরে ধীরে, কখনও সহসা। তখন দেখা দেয় নতুন কিছু সমস্যা। কিন্তু তার আগে এই ভাঙা সম্বন্ধে শাস্ত্র ও সমাজ কী বলেছে একটু দেখা যাক। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র-তে ‘ধর্মস্থীয়’ প্রকরণে বলা আছে, বিচ্ছেদে অনিচ্ছুক পতিকে যদি স্ত্রী ত্যাগ করে তবে তাকে স্বামী কিছুই দেবে না। বিচ্ছেদে অনিচ্ছুক স্ত্রীকে ত্যাগ করলে তাকে তার যা প্রাপ্য তা দিতে হবে। যদি দু’জনে পরস্পরের প্রতি দ্বেষ পোষণ করে তাহলে সে বিবাহ থেকে দু’জনেই মুক্ত হতে পার।[৭]
[৭. পরস্পরদ্বাষান্মোক্ষঃ। অর্থশাস্ত্র, ধর্মস্থীয়, (৩:১৬)]
তা হলে কৌটিল্য স্বীকার করেছেন যে, যেখানে বিবাহের মানসিক ভিত্তি ভেঙে গেছে, অনুরাগের স্থানে এসেছে বিরাগ, সেখানে পরস্পর পরস্পরকে ত্যাগ করতে পারে। যদিও আগের অংশে আছে বিচ্ছেদে অনিচ্ছুক স্ত্রীকে পুরুষ ত্যাগ করলে কিছু ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দায়িত্ব তার থাকে, কিন্তু বিচ্ছেদে অনিচ্ছুক পুরুষকে স্ত্রী যদি ত্যাগ করে তা হলে সেই স্ত্রীকে খালি হাতেই চলে যেতে হবে। স্পষ্টই এখানে দু’মুখো মানদণ্ড; নারীর বিপক্ষে আইন। কিন্তু লক্ষণীয় এই যে, বিচ্ছেদ অনিচ্ছুক স্বামীকে স্ত্রী ইচ্ছে করলে ত্যাগ করতে পারে। এবং দু’জনেই যদি পরস্পরের প্রতি বিদ্বিষ্ট হয় তা হলে বিচ্ছেদ শাস্ত্র সমর্থিত। কৌটিল্যের সময়ে আইন যেটুকু ন্যায়-নির্ভর ছিল তা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছিল। মনুসংহিতা প্রায় পাঁচশো বছর পরের রচনা। মনুতে নারী তার বহুবিধ অধিকার একে একে হারিয়েছে। মানবাধিকারের দৃষ্টিতে ঊনমানব (মনুতে শুধু সতীদাহই নেই, কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীর জীবস্মৃত হয়ে বেঁচে থাকার নির্দেশ আছে)। মনুতে দেখি উন্মত্ত, পতিত, ক্লীব নিবীর্য, কুষ্ঠরোগাক্রান্ত পতির পরিচর্যায় অনিচ্ছুক স্ত্রীকেও ত্যাগ করা চলবে না; ভরণপোষণের দায় প্রত্যাহার করাও চলবে না। কিন্তু ‘স্ত্রী যদি পাগল, সুরামত্ত, রোগাক্রান্ত পতিকে ত্যাগ করে তা হলে তিন মাস অপেক্ষা করে তার বসনভূষণ কেড়ে নিয়ে তাকে পরিত্যাগ করা উচিত।’ যদি সচ্চরিত্রা বধূ প্রতিকূল অথবা সুরাসক্ত, অত্যাচারী ও অর্থলোভী হয় তবে সে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও অন্য বিবাহ করা বিধেয়। এই দ্বিতীয় বিবাহে ক্রুদ্ধ হয়ে প্রথমা পত্নী যদি বাসগৃহ ত্যাগ করতে উদ্যত হয়, তবে তাকে হয় আটকাতে হবে (টীকায় আছে, দড়ি দিয়ে বেঁধে আটকানোর কথা) নয়তো সমস্ত বৃহৎ পরিবারের সামনে প্রকাশ্যে তাকে ত্যাগ করতে হবে।’ সবিস্ময়ে স্মরণ করি ঋগ্বেদে ঊষার একটি বিশেষণ ‘পুনর্যতী’। সায়ণের ভাষায়, ‘স্বামীকে ত্যাগ করে যে ব্যাভিচারিণী হয়ে ইতস্তত ঘুরে বেড়ায়।’[৯] দেখা যাচ্ছে, স্বামীকে ত্যাগ করার কল্পনা ওই সমাজে অপরিচিত ছিল না। পরে নারীর এই স্বাধীনতা হারিয়ে গেল, কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে অব্যাহতই রইল।
[৮. উন্মত্তং পতিতং ক্লীবমবীজং পাপরোগিণং ন ত্যাগোস্তি দ্বিষন্ত্যাশ্চ ন চ দায়াপবর্তমান।। মনু (৯:৭৯) মদ্যপা সাধুবৃত্তা চ প্রতিকূলা চ যা ভবেৎ। বধিতা বাধিবেত্তব্যা হিংস্রাথঘ্নী চ সর্বদা।। মনু (৯:৮০) আধিবিন্না তু যা নারী নির্গচ্ছেদূষিতা গৃহাৎ। সা সদ্যঃ সংনিরোদ্ধব্যা ত্যাজা বা কুলসংনিধৌ।। মনু (৯:৯৩)
৯. ঋগ্বেদ (৭:৭৬:৩)-র ভাষ্যে, ‘পতিং পরিত্যজ্যেতস্ততঃ সঞ্চয়ন্তী ব্যাভিচরন্তীতি।]
এখানেও ওই দু’মুখো নীতি খুবই স্পষ্ট। যদিও মনুর প্রথম শ্লোকে জুগুপ্সিত অবস্থার স্বামীর পরিচর্যায় অনিচ্ছুক স্ত্রীকে ত্যাগ করবার অধিকার দেওয়া হয়নি। কিন্তু এটা বিস্ময়কর এক উদারতার প্রমাণ, কারণ পরবর্তী পুরাণ সাহিত্যে বারংবার উপদেশ ও উপাখ্যানে ওই রকম স্বামীর সর্বতো ভাবে সেবা করবার নির্দেশই দেওয়া হয়েছে। এবং, দ্বিতীয় শ্লোকে ওই উদারতা প্রত্যাহৃত হয়েছে। পরাশর ধর্মশাস্ত্রে যে সব পরিস্থিতিতে স্ত্রীকে দ্বিতীয়বার বিবাহ করবার অধিকার দেওয়া হয়েছে তারই কিছু ক্ষেত্রে সেই স্ত্রীকে ত্যাগ করবার নির্দেশ এখানে আছে। আবার সতী সাধ্বী নারী সুরায় আসক্ত এবং স্বামীর প্রতি বিদ্বিষ্ট হলে তাকে ত্যাগ করে পুনর্বার বিবাহ করার অধিকার স্বামীকে দেওয়া হল। এ ভাবে লঙ্ঘিতা এবং লাঞ্ছিতা স্ত্রী গৃহত্যাগে উদ্যত হলে তাকে (দড়ি দিয়ে বেঁধে) আটকাতে হবে, নয়তো প্রকাশ্যে পরিজনসমক্ষে তাকে ত্যাগ করতে হবে। মনুর ধর্মশাস্ত্রে স্ত্রীর মন বলে কিছু থাকতে পারে না, বিদ্বেষ থাকলেও মুক্তি অর্থাৎ বিবাহবিচ্ছেদে অধিকার নেই, যে অধিকার কৌটিল্যে ছিল। সমাজ ক্রমে ক্রমে বিবাহকে নারীর পক্ষে কারাগার করে তুলেছে।
বর্তমান আইন কৌটিল্যের মত বিবাহবিচ্ছেদের অবকাশ রেখেছে। কার্যত দুঃসাধ্য হলেও এখন অন্তত মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত নারী আইনত স্বামীকে ত্যাগ করতে পারে। সে নিজে উপার্জন না করলে তার ভরণপোষণের দায়ও থাকে স্বামীর— অন্তত আইনে; যদিও বাস্তবে এটা আদায় করা বহু ক্ষেত্রে খুবই অনিশ্চিত হয়ে দাঁড়ায়। যেটা লক্ষণীয়, তা হল বিবাহ অশান্তির বা কষ্টের হলে তার থেকে আজ নারী পুরুষের মুক্তির উপায় আছে। এখানে যে প্রশ্ন স্বভাবতই ওঠে তা হল, বিচ্ছিন্ন দম্পতির সন্তানদের কী হবে? আইনে কিছুকাল তারা মায়ের কাছেই লালিত হবে, পরে বাবা চাইলে এবং মা না চাইলে বাবার কাছে থাকবে অথবা মা চাইলে মায়ের কাছে থাকবে। দু’জনের কেউই না চাইলে কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাস করবে, ছুটিতে পালা করে মা, বাবার কাছে এসে থাকবে— যদি তারা চায়। প্রকৃতপক্ষে মা বাবা ছাড়া অন্য সহৃদয় আত্মীয়রাও কখনও কখনও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সন্তানদের দায়িত্ব নেন। নিঃসন্তান দম্পতির ক্ষেত্রে প্রশ্নটি ওঠেই না। এ কথা ঠিকই যে, মা-বাবার স্নেহের ও যত্নের পরিবেশে লালিত হওয়ার কোনও বিকল্প নেই, যে সন্তান তা পায় তার বাল্য কৈশোরের স্বাদ-গন্ধই আলাদা। কিন্তু প্রশ্নটা উঠেছে, যেখানে দম্পতির পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত ভেঙে গেছে সেখানে সন্তানকে বাবা-মার ভাঙা দাম্পত্যের দরুন যে মানসিক এবং বাস্তবিক নিরাশ্রয়তা, অসহায়তা, কখনও বা অহেতুক নিগ্রহ এবং তার বন্ধুসমাজের পরিবেশ সন্তানকে যে নিদারুণ মর্মপীড়া ভোগ করতে হয় তা নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। তবে ওই বিশেষ শিশুটির জীবনে অন্য সুখী, পরিপূর্ণ শৈশব কৈশোরের সম্ভাবনা তো ভেঙে গেছে তার জনকজননীর দাম্পত্য ভাঙার সঙ্গে। এখন ওই ভাঙা দাম্পত্যে পূর্ণ সুখী পরিবারের ঠাট বজায় রেখে সন্তানকে সেই পরিবেশে লালন করলেও কিন্তু তার যা পাওয়ার ছিল তা সে পায় না। তবু অনেক ভাঙা পরিবারে এই ঠাট বজায় রাখার সিদ্ধান্ত দম্পতি নেন। যদি বাইরে তার গরমিলের কোনও ঝাঁজ প্রকাশ না পায় তবে, সন্তান মোটামুটি এক ধরনের সুস্থ জীবনই পায়, যদিও তার কৈশোরের স্পর্শকাতর চিত্ত ঠিকই বোঝে যে, আকাশে মেঘ আছে, বাতাসে বিষ। কখনও কখনও, বহির্মুখী চিত্তবৃত্তি থাকলে এতে তার স্থায়ী ক্ষতি হয় না। আবার অন্তর্মুখী চিত্তবৃত্তি থাকলেও কখনও কখনও শিশু স্বতন্ত্র একটি কল্পলোক তৈরি করে, পিতামাতার সাহচর্য-নিরপেক্ষ সেই জগতেই মনে মনে বাস করে। এমন বেশ কিছু মানুষ দেখা যায় যারা ভাঙা সংসারে লালিত। সব জেনে, সব বুঝে বেশ কিছু যন্ত্রণা কষ্ট আত্মস্থ করে এরা মানুষ হয়েছে এবং ওই আত্মিক প্রয়াসে তাদের চরিত্রে এক ভিন্ন ও মূল্যবান মাত্রা সংযুক্ত হয়েছে। আবার এমনও দেখা যায়, মা-বাবার আসন্ন বিচ্ছেদে উন্মাদের মতো বিক্ষিপ্ত হল যে শিশু বা কিশোর কিশোরী, ধীরে ধীরে তারা তাদের নতুন সামাজিক অবস্থানে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে।
মা বাবা যদি স্বভাবে দীন, আত্মকেন্দ্রিক বা স্বার্থপর না হন, তা হলে ওই ঠাট বজায় রাখা সংসারেও শিশুর এক ধরনের নিরাপত্তাবোধ থাকে। যেটা হয়তো বাড়ি থেকে স্থানান্তরিত হয়ে বোর্ডিং হস্টেলে গেলে থাকে না। তা ছাড়া তাকে সামাজিক পারিবেশিক সমালোচনার সম্মুখীনও হয়তে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, শিশুর মানসিক স্বস্তি তার বেড়ে ওঠার পক্ষে অনুকূল ভেবে মা-বাবারা নিজের মতদ্বৈধতা বা বিদ্বেষ চেপে রেখে শিশুর সামনে নির্লিপ্ততার অভিনয় করে চলেন; ফলে শিশু মানসিক ভাবে একটা স্বাস্থ্যকর পরিবেশ লাভ করে। কিন্তু, দম্পতির অন্তর্লোকে ধূমায়িত বিদ্বেষ যদি পারিবারিক পরিমণ্ডলে উদ্গীর্ণ হয় তা হলে ওই ছলনা আর থাকে না।
বহু পরিবারে এই ধরনের পারিবারিক আবহাওয়ায় শিশুদের মর্মান্তিক যন্ত্রণা পেতে দেখা যায়, বেশ কিছু শিশু বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় এবং তার চেয়েও বেশি সংখ্যক শিশু কলহ দ্বন্দ্বের ওই বিষাক্ত পরিবেশে বিকৃত মানসিক গঠন নিয়ে বেড়ে ওঠে। মনশ্চিকিৎসকেরা এ ধরনের মনোবিকারগ্রস্থ শিশুর যে পরিসংখ্যান ও বিবরণ দেন তা ভয়াবহ। তা হলে এর প্রতিকার কী? মা বাবা অন্তর্বিদ্বেষ চেপে গিয়ে সারা জীবন সুখী দম্পতির অভিনয় করে যাবেন? সেটা কি সম্ভব? বাঞ্ছনীয়? সন্তান কি কৈশোরে পৌঁছেও অভিনয়কে অভিনয় বলে চিনতে পারবে না? তার অন্য বন্ধুদের বাড়ির পারিবারিক পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখেও বুঝতে পারবে না যে কোথায় একটা বেসুর বাজছে? একটা বিকল্প হচ্ছে, শিশুটি যাতে বেড়ে ওঠার পথে মোটামুটি অনুকূল একটা পরিবেশ পায় তার ব্যবস্থা করে দু’জনের বিচ্ছিন্ন হওয়া। এখানে অন্য একটি প্রশ্নও থাকে: ওই দুটি নরনারী প্রথম বিবাহে সুখ পায়নি, যে কোনও কারণেই হোক বিয়েটা ভেতর থেকে যখন ভেঙে গেছে তখন কৃত্রিম অভিনয়ে সেটাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা না করে সরাসরি প্রকাশ্যে ভেঙে দেওয়া এবং দু’জনে সম্ভব হলে অন্য সঙ্গী বেছে নিয়ে দ্বিতীয়বার সুখ পাওয়ার চেষ্টা করা উচিৎ। এখনও সমাজ একে ওই দুটি মানুষের স্বার্থপরতার প্রমাণ হিসেবেই দেখে। সে দেখাটা ভুল। যখন বিধবাবিবাহ আন্দোলন হয়, তখন তার মূল মানবিক প্রেরণা উৎস কী ছিল? একটি নিরপরাধ নারীর জীবন যাতে পুনর্বার সুখের সন্ধান পায় তা-ই তো? সে নারীর বয়স চোদ্দ না চব্বিশ না চল্লিশ তা তো আলোচ্য ছিল না। সে সন্তানবতী না নিঃসন্তান তা-ও ত ভাবা হয়নি? তার জীবনটা যেন অকালে শুকিয়ে না যায়, সে যেন দাম্পত্যসুখের সন্ধান পায় এই ছিল সে আন্দোলনের মূল প্রেরণা। অপরপক্ষে, কোনও বিপত্নীকের দ্বিতীয়বার বিবাহ করা নিয়ে সমাজ কখনওই কোনও মন্তব্য করেনি; বরং এ কথা বলেছে, স্ত্রীর মৃত্যুর পরদিনই তার কথা প্রশস্ত এবং বিধেয়। লোকে পোষা কুকুর বেড়ালের মৃত্যুতেও কয়েক দিন মুষড়ে থাকে, এ সমাজে স্ত্রীর স্থান গৃহপালিত জন্তুরও নীচে! কাজেই একবার নির্বাচনে ভুল হলে পুনর্বার নির্বাচন করার অধিকার থাকাই উচিত। প্রথমত এখনও অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রথমবার সঙ্গীকে নির্বাচন করে দেয় পরিবার, সেখানে পাত্র পাত্রীর, বিশেষত কন্যার মত প্রায় উপেক্ষিত। ফলে অন্তত মেয়েদের জন্যে ওই দ্বিতীয়বার সুখের সন্ধান করার পথটা খোলা রাখা বিশেষ প্রয়োজন। মেয়েদের জন্যে বিশেষ করে বলছি এই কারণে যে, পুরুষের পক্ষে সে পথ বরাবরই খোলা থাকছে। বিধিমতে বিবাহিত স্ত্রী সীতাকে রামচন্দ্র বলেছিলেন, ‘তোমাকে আমার আর প্রয়োজন নেই, তুমি যাও’। এখনও বাড়িবাড়ি বহু মেয়ে বাসন মাজতে আসে কারণ, ‘স্বামী নেয় না’। স্বামী না নেওয়ার অধিকারটি পেয়েছে আমাদের ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’ রামের কাছেই। কারণ, বলাই আছে, রামের মতো আচরণ করবে, রাবণের মতো নয় (রামাদিবৎ প্রবর্তিতব্যং ন রাবণাদিবৎ)। এবং অন্তত এ ব্যাপারে অসংখ্য পুরুষ রামের মতোই আচরণ করে। এই পরিত্যক্তা স্ত্রীর দ্বিতীয়বার নতুন জীবনে সুখী হওয়ার মৌলিক অধিকার আছে। বিশেষত, পুরুষ যেখানে হামেশা এক বউ ছেড়ে আবার বিয়ে কিংবা বিয়ে না করেই সংসার পাতে।
প্রায়ই প্রশ্ন ওঠে, বিয়ে ভেঙে যদি দ্বিতীয় সংসারেও সুখ না আসে তা হলে তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম এই ভাবেই কি চলবে? এর উত্তরে বলা যায় আইন যখন বিচ্ছেদের পরে পুনর্বার বিয়ের অধিকার দিয়েছে এবং ক’বার বিয়ে করা চলবে তার কোনও সংখ্যা নির্দেশ করেনি, তখনই তো বারে বারে সুখের সন্ধান করার অধিকার কায়েম হয়েছে। মুশকিল হল, এমন বহু নজির আছে যেখানে দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থবারে সঙ্গী নির্বাচনটি পাকাপাকি সুখের সন্ধান দিয়েছে এবং তার পরের যুগ্মজীবন তিরিশ চল্লিশ বছর অব্যাহত সুখে কেটেছে। এই নির্বাচনের মূল অধিকারটি সংখ্যাসীমা দিয়ে বাঁধতে গেলে এটা সম্ভব হত না। কেউ কেউ বলেন, আরও অনেক নজির আছে যারা বারে বারে পরীক্ষানিরীক্ষা করেও কোথাও স্থিতিলাভ করেনি। তেমন অনেক নারী বহু পরীক্ষানিরীক্ষায় ক্লান্ত হয়ে শেষ জীবনে কখনও বিষণ্ণ, কখনও প্রসন্ন মনে একক জীবনকেই মেনে নিয়েছে। এদের সমাজের বিরুদ্ধে কোনও নালিশ নেই, কারণ নিজের জীবন নিজের মতো পরিচালনা করার স্বাধীনতা এরা সমাজের কাছে পেয়েছিল। সে পরিচালনায় সুখ হয়তো আসেনি, কিন্তু ওই স্বাধীনতাটা ছিল তার মৌলিক অধিকার। এমন কথাও প্রায়ই শোনা যায় যে, শুধুমাত্র নতুনের সন্ধানে ইতস্তত পরিক্রমাই ছিল এই ভাবে বহুবার নতুন জীবন শুরু করার মূল প্রেরণা। হতেই পারে। প্রশ্ন হল, এতে কার কী ক্ষতি হল? ব্যক্তি স্বাধীনতার আমরা তখনই সীমা নির্দেশ করতে পারি যখন তা অন্য কারও পক্ষে ক্ষতিকর। এখানে ওই নিত্যনতুনের সন্ধানে সুখ, দুঃখ, উন্মাদনা, বিষাদ যা-ই আসুক তা তো অন্য কাউকে স্পর্শ করছে না। যার সঙ্গে মিলিত হচ্ছে সে-ও জানে স্থায়িত্বের কোনও প্রতিশ্রুতি সে মিলনে নেই। প্রশ্ন হল, এক বিবাহ বন্ধনেই কি সে প্রতিশ্রুতি ছিল? তা হলে তো ভাঙতই না।
আনুষ্ঠানিক বিবাহ নিয়ে একটা মূল প্রশ্ন থেকে যায়, এর আইনগত ও অনুষ্ঠানগত সমর্থন আজকের সমাজে কতটুকু অবশিষ্ট আছে? অনুষ্ঠান সম্বন্ধে আগেই দেখেছি তা সম্পূর্ণতই পুরুষের অনুকূলে। নারী সে অনুষ্ঠানে সম্পূর্ণ অবজ্ঞাত। প্রাচীনকালে এর হয়তো কারণ একটা ছিল: নারীর উপনয়ন হত না, বেদপাঠে অধিকার ছিল না, ফলে বিবাহের বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণে তার অধিকার স্বীকৃত ছিল না। তা ছাড়াও মধ্যযুগ থেকে বাল্যবিবাহ প্রবর্তিত হওয়ায় কী নারী কী পুরুষ আর সরাসরি মন্ত্রোচ্চারণ করত না, করত দু’পক্ষের পুরোহিত এবং তারাই বর ও বধূকে দিয়ে অপেক্ষিত অনুষ্ঠানগুলি করিয়ে নিতে। যাই হোক, অনুষ্ঠান ক্রমেই একটা নির্জীব বহিরঙ্গে পর্যবসিত হয়েছে। তাতে, বা আইনের রেজিস্ট্রেশনে, যা প্রতিপন্ন হয় তা হল দুটি নারী পুরুষ পরস্পরকে স্বামী স্ত্রী বলে স্বীকার করছে এবং সুখে দুঃখে একত্রবাসের প্রতিজ্ঞা করছে। নিহিতার্থ হল, আইনের অনুমোদন না পেলে এ বন্ধন ভাঙা যাবে না। অর্থাৎ এর মধ্যে একটা বাধ্যবাধকতা এসে পড়ল। যতক্ষণ দুজনের মধ্যেকার আকাশটা আবিল না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত স্বেচ্ছায় দু’জনের সঙ্গকামনা করে এবং তা পেয়ে সুখী হয়। এটা প্রাগ্-বিবাহ প্রেম থাকলে তো হয়ই, বিবাহোত্তর কালে যেখানে দম্পতির মধ্যে প্রেম জন্মেছে সে ক্ষেত্রেও হয়। এ ছাড়াও যেখানে প্রেম নেই, কিন্তু পারিবারিক শ্রদ্ধা, সহিষ্ণুতা, নির্ভরশীলতা, সাহচর্য আছে এবং দু’পক্ষের কারওরই এর বাইরে কোনও প্রত্যাশা নেই, তারা কামনার তৃপ্তি এবং সুখে শান্তিতে সংসারযাত্রা নির্বাহ করেই পরিতৃপ্ত হন, এমন বহু দৃষ্টান্ত দেখা যায়। এই তিনটি ক্ষেত্রেই বন্ধনটি পীড়াদায়ক নয়, বরং পরিতৃপ্ত যুগ্মজীবনের একটা সীমানির্ধারক মাত্র। এ সীমাকে অতিক্রম করলে দম্পতির একজন অন্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতক হয় এবং ওই আনুষ্ঠানিক বা আইনের কাছে উচ্চারিত প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করার অপরাধে অপরাধী হয়।
সমস্যা শুরু হয় এইখানেই। যখন ওই বন্ধন আর ভেতরে সত্য থাকে না তখনই তা উদ্বন্ধনে পরিণত হয়, সংসার হয়ে ওঠে কারাগার এবং জীবনযাত্রা হয়ে ওঠে নরক। কখনও কখনও দু’জনেই, এবং কখনও বা দু’জনের একজন তখন পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে।