যৌনতা
বিবাহই একমাত্র সম্পর্ক যেখানে রক্তের সম্পর্কে সম্পৃক্ত নয় এমন দুটি মানুষ একটি মিলিত জীবনের সূত্রপাত করে। এ ছাড়া এই সম্পর্কের আরও কিছু বৈশিষ্ট্য আছে: এই একটি মাত্র সম্পর্কের শিকড় হল যৌন মিলনে। গাছ যেমন তার শিকড়কে মাটির নীচে প্রচ্ছন্ন রাখে, প্রত্যক্ষ থাকে তার কাণ্ড, শাখা প্রশাখা, পাতা; এবং সেই অদৃশ্য গভীর থেকে রস সংগ্রহ করে ওপরের শাখায় সে ফুল ফোটায়, ফল ফলায়, তার শাখায় ও কোটরে পাখি ও অন্য প্রাণীকে আশ্রয় দেয়, দুটি মানুষের মিলিত জীবনেও এই ব্যাপারটা অমনি চেহারা নেয়। তাদের মূলে যৌন সম্পর্ক থাকে লোকচক্ষুর অন্তরালে; তাদের সংযুক্ত জীবনের শ্রী ও সার্থকতা প্রকাশ্য দৃষ্টিগোচর; তাদের রচিত সংসার-নীড়ে অন্য মানুষ প্রশ্রয় পায়। কর্মে, ত্যাগে, সৌন্দর্যে, আদর্শে তাদের দাম্পত্য সার্থক হয়ে ওঠে। সন্তানে ফলধারণ করে, মনুষ্যজাতির জীবনকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রলম্বিত করে। কিন্তু যেহেতু এই একটি মাত্র সম্বন্ধে ভিত্তি যৌনসম্পর্কে, তাই এর নিজস্ব কিছু শারীরিক সমস্যা থেকে যায়। এ সব মিটিয়ে যখন যুগ্মজীবন শুরু হয় তখনও আগন্তুক উৎপাত, সমালোচনা, পারিবারিক নানা সমস্যায় দাম্পত্য জীবন বিঘ্নিত হতে পারে।
একটি সমস্যা হল সন্তানজন্ম সম্পর্কে। এ দেশে বহু পরিবারে সন্তানজন্মটা আপতিক, তার কোনও মানসিক পূর্বপ্রস্তুতি থাকে না। এবং প্রায়শই এটা মায়ের ক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত, চাপিয়ে দেওয়া। আগন্তুক সন্তানটির জন্য তার সম্মতি বা সাগ্রহ প্রতীক্ষা থাকে না। বহু ক্ষেত্রে বিশেষত, দুঃস্থ পরিবারে শাশুড়ি ও শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়ির অন্যান্য লোকেরা তুরীয় ভাবে বলে থাকে, জীব দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনি। বোঝা সহজ, উক্তিটির পেছনে কোনও বিশ্বাস নেই, বিশ্বাসের ভিত্তিও নেই; জীবটির বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খিদে ও অনাহারের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। আহার দেবার তাগিদ কোনও উপরওয়ালার থাকে না এবং বাবা মা-র ইচ্ছা থাকলেও ক্রমবর্ধমান সন্তানকুলের খাদ্য সংস্থান তারা করতে পারে না। এর পরে দাম্পত্য জীবন প্রায়ই রণক্ষেত্রে পরিণত হয়: স্বামী স্ত্রীর বিরুদ্ধে, সন্তানরা পিতামাতার বিরুদ্ধে যুযুধান হয়ে ওঠে। শুধু জন্মনিয়ন্ত্রণের অভাবে দাম্পত্য বিষিয়ে ওঠে। অবশ্য অনেক পরিবার একান্ত নিষ্ক্রিয় নিয়তিবাদে আচ্ছন্ন হয়ে সবটাই অনিবার্য বলে মেনে নিয়ে দারিদ্র্যের মধ্যে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে চলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সন্তান ধারণের প্রসঙ্গে মায়ের মত আছে কি না সেটা দেখাই হয় না। সন্তান আসবার পর অনেক দম্পতির জীবনে আর একটা সংঘর্ষ দেখা দেয়। সেটা হল সন্তানপালন সম্বন্ধে মতদ্বৈধতা। ছেলেমেয়েকে মানুষ করার অধিকাংশ দায়িত্ব থাকে মায়েরই, অন্তত তারা কৈশোরে পদার্পণ করা পর্যন্ত। কিন্তু শিশুর শৈশব থেকেই তাকে কী ভাবে মানুষ করতে হবে এ সম্বন্ধে শেষ কথা বলার অধিকার থাকে বাবার। কখনও কখনও ছেলে মেয়ে নিজেদের রুচি নিয়ে তর্ক করে এবং ইচ্ছামতো শিক্ষাক্ষেত্র বেছে নেয়। কিন্তু তাদের জন্য কোন খাতে কতটা খরচ করা হবে, তাদের গৃহশিক্ষক ক’জন থাকবে, আদৌ থাকবে কি না, তারা কোন ধরনের বন্ধুবান্ধবের সাহচর্য পাবে, ইত্যাদি বিষয়ে মায়ের মত খুব ক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত স্বীকৃতি পায়। পক্ষপাতিত্বের প্রশ্নও থাকে— ‘মায়ের আদরের, বাবার আদরের’ থাকার শ্রেণিবিভাগ থেকেও কখনও অশান্তি জন্মায়। কতকটা নিরপেক্ষ দৃষ্টি নিশ্চয়ই দু’জনে বসে দু’জনের পক্ষেই আয়ত্ত করা সম্ভব। ঠাণ্ডা মাথায় যুক্তিনির্ভর আলোচনা নিশ্চয়ই দু’জনে বসে করা যায় ও ঐকমত্যে পৌঁছনো যায়। দু’জনের সন্তানপালন সম্বন্ধে মতদ্বৈধতা যদি ছেলেমেয়েরা টের পায় তো অশান্তির ক্ষেত্র বাড়ে। মায়ের মতটা অযৌক্তিক হবেই এমন একটা ধারণা নিয়ে এগোলে অবশ্য কোথাও কোনও সমাধান আসে না। যখন মায়ের শিক্ষাগত মান নিচু, তখনও তাকে ধৈর্য ধরে বিষয়টা বোঝালে অনেকটাই বোঝানো যায়। দাম্পত্যে সমানাধিকার স্বীকৃত থাকলে এ বোঝানো অনেক সহজ হয়।
দাম্পত্য জীবনে নারীকে ব্যক্তি হিসেবে অগ্রাহ্য করা হয়েছে আড়াই হাজার বছর ধরে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ বলে, উত্তম নারীর সংজ্ঞা হল যে স্বামীকে তুষ্ট করে, পুত্রসন্তানের জন্ম দেয় এবং স্বামীর উক্তির প্রতিবাদ করে না।[১] আবার বৌধায়ন ধর্মসূত্রেও এই ধরণের কথা পাই: পুত্রসন্তানই কাম্য, তাই যে স্ত্রী শুধু কন্যার জন্ম দেয় তাকে বারো বছর পরে পরিত্যাগ করা যায়।[২] নিঃসন্তান স্ত্রীকে দশ বছর পরে এবং মৃতবৎসাকে পনেরো বছর পরে ত্যাগ করা যায়।[৩] আপস্তম্ব ধর্মসূত্রও একই কথা বলে।[৪] এবং পরবর্তী কালে মনুসংহিতাতেও অনুরূপ উক্তি পাই।[৫] অর্থাৎ বোধটি ভারতীয়দের চিত্তে সুদূর প্রাচীন কাল থেকেই দৃঢ়প্রোথিত। তবে এই যে ‘প্রজনার্থং মহাভাগা পূজার্হা গৃহদীপ্তয়ঃ’,[৬] এই বোধটি শুধু ভারতবর্ষই নয়, সারা পৃথিবীতেই চলিত ছিল। নিঃসন্তান নারীকে স্বামী পরিত্যাগ করতে পারত, নেহাৎ ত্যাগ না করলেও তাকে অসম্মানে নির্বাসিত করা হত। ইউরোপে কোনও কোনও অঞ্চলে সন্তান ধারণ না করতে পারলে সে নারীকে পরিহার করা হত, অন্তত তাকে খুব নিচু চোখে দেখা হত।
[১. ঐ. ব্রা. (৩:২৪:২৭)
২. বৌ. ধ. সূ. (১:১০:৫১-৫৩)
৩. বৌ. ধ. সু. (২:৪:৬)
৪. আ. ধ. সূ (২:৫:১১-১৪)
৫. মনু (৯:৪)
৬. মনু (৯:২৬); অনুরূপ বাক্য ‘ক্ষেত্রভূতা স্মৃতা নারী বীজভূতঃ স্মৃতঃ পুমান্। পূর্বোক্ত (৯:৩৩)
৭. ‘In some regions she was case off by her husband or was at any rate held in little esteem if she was unable to have children. ‘ The European Family. p. 124 ]
সন্তানহীনতার জন্য এতাবৎকাল শুধু নারীকে দায়ী করে বহু ক্ষেত্রে দাম্পত্য তিক্ত করে দেওয়া হয়েছে, যদিও আজ আমরা জানি, বন্ধ্যা নারীর মতো নিষ্প্রজ পুরুষও আছে, এবং দু’জনেই সুস্থ ও প্রজননে সমর্থ হলেও বহুক্ষেত্রে সন্তান আসে না। আজকের বিজ্ঞান এর কিছু প্রতিকারও করেছে। কিন্তু এ সব জ্ঞান ছিল না বলে নারী বহু অবিচার ভোগ করেছে, সংসারে অনর্থক দোষারোপ নিরুপায় ভাবে সহ্য করেছে। তার একটা কারণ উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত সমাজে নারী সম্পদ উৎপাদন ব্যবস্থার শ্রম থেকে অব্যাহতি পেয়েছে। এখন তার ওপর বর্তেছে সম্পদের উত্তরাধিকারী ভোক্তা উৎপাদন করার দায়িত্বটি।[৮] যে দাম্পত্যে পুত্রসন্তানের জন্ম না হওয়া পর্যন্ত স্ত্রী নিরন্তর আশঙ্কায় ত্রস্ত থাকে— স্বামী তাকে ত্যাগ করে অন্য কাউকে বিয়ে করবে— সে দাম্পত্য তো ততক্ষণ পর্যন্ত নিরন্তর দোলাচল থাকবে। অথচ বিজ্ঞানের গবেষণা বহু দশক আগেই সমাজকে জানিয়েছে যে, নারীর বন্ধ্যাত্ব যেমন সন্তানহীনতার কারণ হতে পারে, পুরুষের নিষ্প্রজত্বও ঠিক ততটা পরিমাণেই সন্তানহীনতার জন্যে দায়ী হতে পারে। আবার দু’জনেই পুরো স্বাভাবিক হলেও শতকরা পঞ্চাশটি ক্ষেত্রে সন্তান আসে না। ঠিক তেমনই কন্যাসন্তান না পুত্র সন্তানের জন্মের মধ্যে মা-বাবা কারওরই কোনও দায়িত্ব বা কৃতিত্ব নেই। ঘটনাটি সম্পূর্ণ আপতিক। তবু সেটা এখনও মানুষের বোধের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়নি। তাই ধনী শিক্ষিত পরিবারে এমনিওসেন্টেসিস চলছে ও ব্যাপক হারে কন্যাভ্রূণ নষ্ট করা হচ্ছে, তথাকথিত ‘চিকিৎসক’-এর সাহায্যে। এখনও আমরা মুখে বলি, ছেলে আর মেয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই, কিন্তু পরিবার ও সমাজের চোখে পুত্রের জননী এখনও কন্যার জননীর ঊর্ধ্বে আসীন। গর্ভে পুত্র না কন্যা আসছে এ ব্যাপারে নারীর দেহটির পর্যন্ত যথার্থ কোনও দায়িত্ব নেই, তবু এই অসমদৃষ্টি। এর ফলে বধূটিকে সইতে হয় গর্ভকালে আতঙ্ক ও কন্যা জন্মে অপমান।
[৮. ‘Whereas the farmer’s and the master’s wife played a decisive part in the production of goods for sale and for every day consumption in the domestic economy, the middle class woman was the first to be restricted to the task of private production.’ পূর্বোক্ত, p. 130]
দাম্পত্য অশান্তির অনেকটা অংশেই নারী সম্পর্কে সমাজের এই তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞাই দায়ী। এমনকী হৃদয়বৃত্তিতেও নারীর ন্যূনতা, ক্রুরতা, কামুকতার কথাও শাস্ত্র বলেছে, যাতে সে অবজ্ঞার পাত্রী হয়। প্রাচীন যুগে একটি প্রচলিত ধারণা ছিল নারী প্রেমে উৎসাহিনী নয়, সে শুধু যৌন মিলনেই আকাঙ্ক্ষিনী। মহাভারতে এ কথা অপ্সরা পঞ্চচূড়াকে দিয়ে বলানো হয়েছে: ‘নারী স্বভাবতই অবিশ্বাসিনী, কামনা ছাড়া কোনও কিছুকেই সে মনে স্থান দেয় না এবং কামনায় উত্তেজিত হয়ে সে না করতে পারে এমন কোনও কাজই নেই।[৯] তারও আগে ঋগ্বেদে স্বয়ং ঊর্বশী তার প্রেমিক পুরূরবাকে বলছে, ‘একটি নারীর জন্য কেন তুমি আত্মহত্যা করবে? কোরো না। নারীর সঙ্গে কোনও বন্ধুত্বই হয় না, এদের হৃদয় নেকড়ে বাঘের মতো।’[১০] লক্ষণীয়, এই দুটি ক্ষেত্রেই নারীর বিরুদ্ধে, তার হৃদয়হীনতাকে প্রতিপাদন করবার ভার নিয়েছে নারীই। এবং মনে রাখতে হবে, এই দুটি অংশেরই রচয়িতা পুরুষ। তবে কেন নারীর বিরুদ্ধে এমন মিথ্যাচার? পুরুষ কি সত্যিই বিশ্বাস করে যে নারী প্রেমে অক্ষম কামনাসর্বস্ব জীবমাত্র? একেবারেই নয়। এই রকম একটি ধারণা— বিশ্বাস নয়— ধারণা ও জনশ্রুতি তৈরি করতে পারলে সমাজে নারীকে ঘৃণ্য প্রতিপন্ন করা সহজ হয়। তা ছাড়া, কামসর্বস্ব নারীই যে পুরুষের পদস্খলনের হেতু এমন একটি মিথ্যা সমাজে চালু থাকলে পুরুষের অনৈতিক জীবন সম্বন্ধে নৈতিক দায়িত্ব অনেক কম। দুটি উক্তিই বসানো হয়েছে অপ্সরার মুখে, যারা স্বর্গবেশ্যা। কিন্তু দুটিতেই আছে সাধারণীকরণ, অর্থাৎ এ ধরনের হৃদয়হীন কামুকতা যে নারীমাত্রেরই স্বভাবসিদ্ধ। এই ধরনের ধারণা এ দেশের যৌথমানসে দীর্ঘকাল ধরে অন্তর্লীন ভাবে বিদ্যমান থাকার ফলে পুরুষের পক্ষে নারীকে অবজ্ঞা করা সহজ হয়েছে। গণমানসে প্রোথিত ধারণা অবচেতনের স্তরে থেকেও দাম্পত্যকে কলুষিত ও বিকৃত করতে পারে এবং করেও। সমান অধিকারের মধ্যে ছিল এর প্রতিকার। ১৭৯২ সালে মেরি উলস্টনক্রাফট লিখেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি যে, পুরুষের একচ্ছত্র অধিকারের দাপট থেকেই নারীর স্বভাবে বহু ভ্রমপ্রমাদ জন্ম নেয়।… স্বাধীনতা পেলে তার চরিত্র অনেক বেশি পরিপূর্ণতা পাবে।[১১] প্রাচীন শাস্ত্রে, এবং নারীর নিকৃষ্টতার এই বোধ নিয়েই পুরুষ বিয়ে করে। আরও দুঃখের বিষয়, নারী নিজেও এই বোধবিশ্বাসের পরিবেশেই লালিত হয়। বারে বারে শোনা যায় তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উচ্চারিত ‘মেয়েমানুষ’ এবং গর্ব ও দম্ভের সঙ্গে উচ্চারিত ‘পুরুষ’। এখন, সবে কিছুকাল ধরে শহরের শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের যৎসামান্য কিছু অংশ নিজেদের এই ধারণা থেকে মুক্ত করে নারীপুরুষের সমানাধিকারের ভিত্তিতে যুগ্মজীবন রচনা করতে উদ্যত হয়েছে।
[৯. মহা. (১৩:৩৮:১১-৩০)
১০. ন বৈ স্ত্রৈণানি সখ্যানি সন্তি সালাবৃকানাং হৃদয়ান্যেতা। ঋগ্বেদ (১০:৯৫:১৫)
১১. A Vindication of the Rights of Women. pp. 214-215]
শুধু আর্থিক স্বাবলম্বিতাতেও এ সুপ্রাচীন বৈষম্যবোধ ঘোচে না। এমনও দেখা যায়, স্ত্রী স্বামীর সমান বা তার চেয়ে বেশি উপার্জন করা সত্ত্বেও গৃহকর্ম ও সন্তানপালনের দায়িত্ব প্রায় সবটাই নিজের ওপর তুলে নিয়েছে। চাষি-বৌ বা মজুরনি সারাদিন বাইরে খেটে ফিরে স্বতন্ত্র উপার্জন থাকা সত্ত্বেও সংসারের যাবতীয় কর্তব্য একাই সমাধা করছে। স্বামী তাকে সাহায্য করতে যাচ্ছে না, স্ত্রী চাইতে সাহস পাচ্ছে না। কাজেই শুধুমাত্র অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র্য নারীকে এই বোধ দিতে পারছে না যে, সে সংসারে পুরুষের সমকক্ষ। এর জন্যে চাই চেতনার মুক্তি। সেটা সময়সাপেক্ষ এবং তার জন্যে চাই দীর্ঘ সচেতন প্রস্তুতি ও সংগ্রাম। এর একটা সূত্রপাত হয়েছে, একটি শুভলক্ষণ খুব মৃদু, প্রায় অলক্ষ্যে হলেও ইদানীং দৃষ্টিগোচর হচ্ছে: কিছু কিছু মুক্তমনা পুরুষ স্ত্রীকে গৃহকর্মে সাহায্য করছেন। সংসারের কাজে সাহায্যকারী দুষ্প্রাপ্য হয়েছে বেশ কিছুকাল ধরেই, ফলে দম্পতির এই পারস্পরিক সাহায্য অত্যাবশ্যক শুধু নয়, অপরিহার্য। কিন্তু বেশ কিছু দাম্পত্যে এই সাহায্যের অভাবে চিড় ধরেছে। মেয়েটি একলাই সন্তান, সংসার, শ্বশুরবাড়ির পরিজনদের পরিচর্যা করবে এই আশা করে ছেলেটি, বলে ‘ও সব তো মেয়েদের কাজ’— এ মেয়েটি বাইরে চাকরি করলেও এই সংসারসেবা সে একাই করবে এমনটাই অপেক্ষিত। এই কাজের বোঝার গুরুভারে ক্লিষ্ট এবং সংসারের কাজে স্বামীর সহযোগিতা না পাওয়ায় যে অসহায়তা ও প্রচ্ছন্ন অত্যাচারের আভাস থাকে তাতে মেয়েটি স্বভাবতই বিরূপ ও ক্ষুব্ধ হয়। মুশকিল হল এই যে, আমাদের শাস্ত্রে, সাহিত্যে, সমাজে এই পারস্পরিক সাহায্যের কোনও নজির নেই বরং উল্টোটাই আছে। মহাভারতের বনপর্বে দ্রৌপদী সত্যভামাকে বলেছিলেন যে, প্রত্যূষে উঠেই সারাদিন তিনি অবিশ্রাম গৃহকর্ম করে চলেন; তাঁর মধ্যরাতের বিশ্রাম পর্যন্ত দায়িত্বের যে ফিরিস্তি তিনি দেন তার সঙ্গে মেলে তাবৎ ধর্মশাস্ত্রে গৃহিণীর দিনচর্যার নির্দেশ। এমন কথাও আছে যে, নারী সর্বদাই গৃহকর্মে ব্যাপৃত থাকলে সে অন্যায় কর্ম থেকে নিরস্ত থাকে। তবে বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে ও ইসলামিক শাস্ত্রেও ঠিক একই রকমের ফিরিস্তি। এর মূলে সব প্রাচীন সমাজেই বিশ্বাস ছিল যে, নিরন্তর কাজের মধ্যে না থাকলে নারী দুশ্চরিত্র হয়ে যাবে, তাকে সে সুযোগ না দেওয়া তার চরিত্র-রক্ষারই একটা উপায়। কিন্তু দাম্পত্যে কাজের ভারের এই অসম বণ্টন নারীকে শরীরে মনে পীড়িত করে এবং এর ফলে যে অশান্তির সৃষ্টি হয় তার কোনও প্রতিকার থাকে না। আরও ক্ষতি হয়: পুত্রকন্যারা বুঝে যায় গৃহকর্ম নারীরই এলাকা, অর্থাৎ ওই অসাম্যের বিষয়টা সঞ্চারিত হয় পরবর্তী প্রজন্মেও।
শাস্ত্র বলে, দুর্ভাষিণী স্ত্রীকে স্বামী এক বছর পরে গয়না কেড়ে নিয়ে ত্যাগ করবে; [১২] রোগিণীকে তিন মাস পরে, সুরাপায়িনী, অপব্যয়িনী, স্বামীদ্রোহিনী ও বন্ধ্যা স্ত্রীকেও ত্যাগ করবে।[১৩] ওই সব ক’টা দোষই স্বামীরও থাকতে পারে, সমাজ তার জন্যে কোনও শাস্তিবিধান করেনি। যেটা অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতা মনে হয় সেটা হল, রোগিণীকে ত্যাগ করার কথা। নিরুপার্জন রোগিণী শারীরিক ও আর্থিক ভাবে সম্পূর্ণ অসহায়, তাকে আশ্রয়, চিকিৎসা, শুশ্রূষা, ভরণপোষণ ও সান্ত্বনা দেওয়ার দায়িত্ব রইল না তার স্বামীর। পরিত্যক্ত রোগিণীর কী উপায় হবে সে সম্বন্ধে শাস্ত্র নীরব। এটা সম্ভব হয়েছিল তার কারণ, বিবাহ ও দাম্পত্য সম্বন্ধে সমাজের যে বোধগত ভিত্তি ছিল তা হল সংসারটা পুরুষের স্বচ্ছন্দ নিরুপদ্রব জীবনযাত্রার জন্যেই, তার কোনও ব্যত্যয় যদি স্ত্রী ঘটায় তা হলে তার জন্যে দরজা খোলা আছে। দুর্ভাষী, সুরাপায়ী, অপব্যয়ী, স্ত্রীদ্রোহী এবং প্রজননে অক্ষম পুরুষ শুধু পুরুষ বলেই গার্হস্থ্য দণ্ডবিধির আওতার বাইরে। বস্তুত এই দু’ মুখো বিধানে বহু দাম্পত্যের ভিত্তিটা গোড়া থেকেই নড়বড়ে হয়। কত অসংখ্য পরিবারে মাতাল, দুশ্চরিত্র, অত্যাচারী, কটুভাষী স্বামী দাপিয়ে প্রতাপ জাহির করে স্ত্রীকে পদানত রাখছে; স্বামীর শারীরিক বৈকল্যে সন্তান না আসলে স্ত্রীকেই নিষ্ঠুর ভাবে নিন্দা করছে স্বামী ও তার পরিজন। এর একটা কারণ, সমস্ত শিক্ষাব্যবস্থায় নারীর অধিকার, ব্যক্তিত্ব তার সামাজিক অধিকার একেবারেই উপেক্ষিত। ফলে তার নিজের ও আশপাশের সকলের ধারণা ও বিশ্বাস জন্মায় যে সে যথার্থই ঊনমানব। দু’মুঠো ভাত ও দু’খানা কাপড়ই তার একমাত্র অধিকার। এই বোধ বিশ্বাসের ফলে তার পুষ্টির কথা পরিবার ভাবে না। এবং সে শুধু প্রাণধারণের মতো খাদ্য ও লজ্জা নিবারণের মতো বস্ত্র পায়। রোগে চিকিৎসা কমই জোটে এবং তার মানসিক বিকাশের জন্য কোনও ভার কেউ নেয় না। এর প্রতিকার হচ্ছে না। দাম্পত্য ভেতরে ভেতরে কবেই ভেঙে গেছে, তার ফাঁপা কাঠামোটাকেই সমাজ দাম্পত্য বলে অভিহিত করছে। ওই ধরনের অত্যাচারী স্বামীর দাপট বহু স্ত্রী অসহায় ভাবে সহ্য করছে। আজ কোথাও কোথাও যে এই অন্যায় অত্যাচারের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে প্রতিকার খুঁজছে এবং পাচ্ছে সেটা একটা আশার কথা।
[১২. মনু (৯/৭৮)
১৩. যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি (১:৭৩)]