০৬. টোবিয়াস গ্রেগসনের কেরামতি

পরদিন খবরের কাগজগুলি ছিল ‘ব্রিকসটন রহস্যে’ ভরা। সমস্ত কাগজে র্দীঘ বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে অকেনগুলিতে তার উপরে আবার সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। তাতে এমন কিছু তথ্য ছিল যা আমার কাছে নতুন। এই কেস সম্পর্কে খবরের কাগজের অনেক কাটিং ও উদ্ধৃতি এখন আমার ‘স্ক্র্যাপ-বুকে’ রক্ষিত আছে। এখানে তার কিছু কিছু সংক্ষিপ্ত-সার তুলে দেওয়া হলঃ

‘ডেইলি টেলিগ্রাম’-এ  মন্তব্য করা হয়েছে যে, অপ-রাধের ইতিহাসে এরুপ বিস্ময়কর বৈশিষ্টাপূর্ণ দুঃখজনক ঘটনা কাদচিৎ দেখা যায়। মৃত ব্যক্তির জার্মান নাম, উদ্দেশ্যের অভাব, দেওয়ালে অশুভ লিখন এই সব দেখে মনে হয় রাজনৈতিক শরণার্থী এবং বিপ্লবীরাই এ ঘটনার নায়ক। আমেরিকায় সমাজতন্ত্রীদের অনেক শাখা আছে। মৃত ব্যক্তি নিশ্চয় তাদের কোন অলিখিত আইন লংঘন করেছিল। এবং শেষ পর্যন্ত তারা তাকে খুঁজে বের করেছে। প্রসঙ্গত ভেমগেরিকট, একোয়া টোকনা, কার্বোনারি, মার্কিওনেস ডি ব্রিনভিলিয়ার্স, ডারুইনের মতবাদ, ম্যালথাস-নীত ও র‌্যাটক্লিফ রাজপথে খুনের উল্লেখ করে প্রবন্ধের শেষে সরকারকে ভর্ৎসনা করা হয়েছে এবং ইংলন্ডে বিদেশীদের উপর কড়া নজর রাখবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

‘স্ট্যান্ডার্ড-এ মন্তব্য করা হয়েছে এ ধরনের বেআইনী অত্যাচার সাধারণতঃ উদারনৈতিক সরকারের আমলেই ঘটে থাকে। জনতার মানসিক অস্থিরতা এবং দুর্বলতা থেকেই এদের উদ্ভব। নিহত ব্যক্তি একজন আমেরিকান ভদ্রলোক। কয়েক সপ্তাহ যাবৎ তিনি মহানগরীতে বাস করছিলেন।তিনি কাম্বারওয়েলের অন্তর্গত টকোয়ে টেরেসের ম্যাডাম চাপেন্টিয়ারের বোডিং-হাউসে থাকতেন। এই দেশভ্রমণের সময় তার সঙ্গে ছিলেন ব্যক্তিগত সচিব মিঃ জোসেফ স্ট্যাঙ্গারসন। এ মাসের ৪ তারিখ মঙ্গলবার গৃহকর্ত্রীকে বিদায়-সম্ভাষণ জানিয়ে তারা লিভারপুল এক্সপ্রেস ধরবার উদ্দেশ্যে ইউস্টন স্টেশনে যাত্রা করেন। তারপরেও দুজনকে প্ল্যাটফর্মে দেখা গিয়েছে। সংবাদ অনুসারে, ইউস্টন থেকে অনেক মাইল দুরবর্তী, ব্রিক্সটন রোডের একটি খালি বাড়িতে মিঃ ড্রেবারের মৃতদেহ আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত রহস্যে আবৃত; স্ট্যাঙ্গারসনের গতিবিধি  সম্পর্কে আর কিছুই জানা যায় না। কেমন করে তিনি সেখানে এলেন, বা কেমন করে তার মৃত্যু হল, এসব প্রশ্নই এখনও পর্যন্ত রহস্য আবৃত! স্ট্যাঙ্গারসনের গতিবিধি সম্পর্কেও কিছুই জানা যায় নি। আমরা শুনে ‍সুখী হলাম যে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের মিঃ লেস্ট্রেড ও মিঃ গ্রেগসন এই কেসটি গ্রহণ করেছেন। আশা করা যায় যে এই দুই সুপরিচিতি অফিসার অতি শীঘ্রই এ ব্যাপারে আলোকপাত করবেন।

‘ডেইলি-নিউজ’-এ বলা হয়েছে, অপরাধটি যে রাজ-নৈতিক সেবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। স্বৈরাচর ও সমাজতন্ত্রবোধিতা ইউরোপীয় শাসক শক্তিগুলিকে অনুপ্রাণিত করার ফলে এমন বহুলোক আমাদের দেশে চলে এসেছেন যাঁরা অতীত জীবনের তিক্ত স্মৃতির দ্বাড়া তাড়িত না হলে উচ্চশ্রেণীর নাগরিক হতে পারতেন। ঐসব লোকের মধ্যে এমন একটা কঠোর নিয়ম-নিষ্ঠা প্রচলিত ছিল যেকোনরকমভাবে সেটা লঙ্ঘিত হলেই তার শাস্তি ছিল মৃত্যু। সচিব স্ট্যাঙ্গারসনকে খুঁজে বের করতে এবং মৃতের অতীত জীবনের বিবরণ জানাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। যে বাড়িতে তিনি বাস করেছিলেন তার ঠিকানাটা হস্তগত হওয়ায় একটা বড় কাজ হয়েছে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের মিঃ গ্রেগসনের তীক্ষ্মবৃদ্ধি ও উদ্যমের ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে।

প্রাতরাশে বসে শার্লক হোমস ও আমি সবগুলিই একত্রে পড়লাম। মনে হল, এগুলি যেন তাকে প্রচুর মজার খোরাক জোগাল।

‘আমি তোমাকে বলেছিলাম, যা কিছুই ঘটুক লেস্ট্রেড আর গ্রেগসনই দইটুকু মারবে।’

‘দেখা যাক কি হয়। তার উপরেই তো সব নির্ভর করছে।’

‘হা ভগবান! মোটেই তা নয়। লোকটি ধরা পড়লে ওদের জন্যই ধরা পড়বে, আর সে যদি পালিয়ে যায় সেও ওদের চেষ্টা সত্বেও যাবে। এ হচ্ছে, আমরা জিতলেও ভেড়ের ভেড়ে, হারলেও ভেড়ের ভেড়ে। ওরা যা করবে তাতেই লোক বাহবা দবে। `Un not trouve tlouj-ours un plus sot quil I’ admire’.

‘ব্যাপার কি?’ আমি চেঁচিয়ে বললাম, কারণ ঠিক সেই মুহূর্তে হলেও সিঁড়িতে অনেকগুলো পায়ের শব্দ শোনা গেল। গৃহকর্ত্রীর নানারকম বিরক্তিসূচক বাণীও কানে এল।

আমার সঙ্গী গম্ভীরভাবে বলল, ‘এটা হচ্ছে গোয়েন্দা পুলিশ বাহিনী বেকার স্ট্রীট ডিভিশন।’ তার কথার সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত নোংরা একদল বাউন্ডুলে ছেলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল।

‘সোজা হয়ে দাঁড়াও!’ কর্কশ কণ্ঠে হোমস চেঁচিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে দুটি বাচ্চা বদমাইস কুখ্যাত স্ট্যাচুর মত এক লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ল। ‘ভবিষ্যতে শুধু উইগিন্সকে ভিতরে পাঠাবে খবর দিতে, বাকিরা সব রাস্তায় অপেক্ষা করবে। কোন খবর পেয়েছ উইগিন্স?’

একটা ছেলে জবাব দিল, ‘না স্যার, পাই নি।’

‘পাবে সে আশা আমিও করি নি। কাজ চালিয়ে যাও। এই নাও, তোমাদের পাওনা।’ প্রত্যেককে সে এক শিলিং করে দিল। ‘এখন চলে যাও। এরপর ভাল খবর নিয়ে আসবে।’

সে হাত নাড়তেই তারা সব ইঁদুরের মত লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। পরক্ষণেই রাস্তায়, তাদের কর্কশ গলা শোনা গেল।

হোমস বলল, ‘একজন পুলিশের চাইতে ওদের একটা বাচ্চা ভিখারির কাছ থেকে অনেক বেশী কাজ পাওয়া যায়। সরকারী লোক দেখলেই লোকের ঠোঁট বন্ধ হয়ে যায়। এই বাচ্চাগুলো সব জায়গায় যায়, সব কথা শোনে। ওদের বুদ্ধিও সূঁচের মত তীক্ষ্ম। শুধু প্রয়োজন ওদের গড়ে তোলা।’

আমি প্রশ্ন করলাম, ‘তুমি কি ব্রিক্সটন কেসে ওদের লাগিয়েছে?’

‘হ্যাঁ। একটা জিনিস আমি সঠিক জানতে চাই। অবশ্য সেটা সময়  সাপেক্ষমাত্র। আরে! এখনই কিছু নতুন সংবাদ শুনতে পাব। রাস্তা দিয়ে গ্রেগসন আসছে।তার চোখে-মুখে খুশি উপছে পড়ছে।জানি, এখানেই আসবে। হ্যাঁ, ওই তো দাঁড়িয়েছে। এসে গেছে!’

ঘণ্টটা জোরে বেজে উঠল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গোয়েন্দা-প্রবর এক লাফে তিনটে করে সিঁড়ি পার হয়ে বসবার ঘরে ঢুকল।

হোমসের অনিচ্ছুক হাতটাকে মুচড়ে ধরে চেঁচিয়ে বলল, ‘বন্ধু. আমাকে অভিন্দন জানান। সবকিছু একেবারে দিনের আলোর মত পরিষ্কার করে ফেলেছি।’

সঙ্গীর মুখের উপর একটা দুশ্চিন্তার ছায়া পড়ল। ‘তুমি কি ঠিক পথে চলেছ বলে মনে কর?’ সে জিজ্ঞাসা করল।

‘ঠিক পথ! লোকটাকে হাতকড়া পরিয়ে ফেলেছি।’

‘তার নাম কি?’

মাননীয়া মহারাণীর নৌ-বিভাগের সহকারী লেফ্টেন্যাপ্ট আর্থার চার্পেন্টিয়ার’, মোটা হাত দুটো ঘসতে ঘসতে বুক ফুলিয়ে গ্রেগসন সদম্ভে কথা গুলি বলল।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে শালক হোমস একটুখানি হাসল।

বলল, ‘বস। সিগারেট খাও। কি করে এত কান্ড করলে জানতে কৌতুহল হচ্ছে। হুইস্কি আর জল চাই কি?

গোয়েন্দা জবাব দিল, ‘পেলে মন্দ হত না।’ গত দু’একদিন যা পরিশ্রম গেছে, শরীর একেবারে ভেঙে পড়েছে। শারীরিক পরিশ্রম যত নয়, তার চাইতে বেশী চাপ পড়েছে মনের উপর। মিঃ শালক হোমস, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, কারণ আমরা দুজনেই তো মস্কিষ্কের কারবারী।’

হোমস গম্ভীরভাবে বলল, ‘আমাকে বড় বেশী সম্মান দেওয়া হচ্ছে, যাহোক এরকম একটা সন্তোষজনক ফল কিভাবে লাভ করলে খুলে বল তো শুনি।’

গোয়েন্দাটি চেয়ারে বসে মনের সুখে সিগার টানছিল। হঠাৎ অতি-আনন্দের উচ্ছ্বাসে উরুতে একটা থাপ্পড়ে মেরে বলে উঠল, ‘মজার ব্যাপার কি জানেন, নিজেকে, খুব চালাক ভাবলে কি হবে ঐ বোকা লেস্ট্রেড একেবারেই ভুলপথ ধরেছে। সে খুঁজে বেড়াচ্ছে সচিব স্ট্যাঙ্গারসনকে, অথচ অপারাধের সঙ্গে সে কতটুকু জড়িত? যে শিশু এখনও মায়ের পেটে তার চাইতে বেশী নয়’ এতদিনে সে যে তাকে পাকড়াও করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।’

কথাটা ভাবতেই গ্রেগসনের মনে এমন সুড়সুড়ি লাগল যে হাসতে হাসতে তার দম বন্ধ হবার উপক্রম।

‘তোমার সূত্রটি কেমন করে পেলে?’

‘বলছি, বলছি, সবই বলছি। ডঃ ওয়াটসন, আমরা ছাড়া আর কেউ যেন জানতে  না পারে। এই মার্কিন অতীত ভদ্রলোকের বৃত্তান্ত জানাটাই হল প্রথম সমস্যা। অন্যরা এ অবস্থায় কি করত, না বিজ্ঞাপনের উত্তর আসা বা কেউ এসে স্বেচ্ছায় কোন খবর দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করত। কিন্তু টোবিয়াস গ্রেগসনের কাজের পদ্ধতি সেরকম নয়। আচ্ছা, মৃত লোকটির পাশের টুপিটার কথা মনে আছে?’

হোমস জবাব দিল, হ্যাঁ। ১২৯, কাম্বারওয়েল রোডের জন আন্ডারউড অ্যান্ড সন্স দ্বারা প্রস্তুত।’

গ্রেগসন যেন খুবই মুষড়ে পড়ল। বলল, ‘আপনিও যে সেটা লক্ষ্য করেছেন তা ভাবি নি। আপনি কি সেখানে গিয়েছিলেন?’

‘না।’

‘হ্যাঁ।’ স্বস্তি ভরা গলায় গ্রেগসন বলল, ‘আপাত দৃষ্টিতে যত তু্চ্ছ নয়।’

‘যাহোক, আমি আন্ডারউডের কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম ঐ মাপের ও বিবরণের টুপি সে বিক্রি করেছে কি না। খাতাপত্র ওল্টাতেই পেয়ে গেল। টুপিটা সে পাঠিয়েছিল টর্কোয়ে টেরেসের চার্পেন্টিয়ার্স বোডিং এস্টাব্লিমেন্টের মিঃ ড্রেবারকে। সেখানেই তার ঠিকানাটা পেলাম।’

শালক হোমস আপন মনেই বলে উঠল, ‘চতুর—খুব চতুর!’

গোয়েন্দা বলতে লাগল, ‘তারপরই ম্যাডাম চাপেন্টিয়ারের সঙ্গে দেখা করলাম। তাকে খুবই বিমর্ষ ও বিষণ্ন দেখলাম। তার মেয়েও সেই ঘরেই ছিল—অসাধারণ সুন্দরী মেয়ে। তার চোখে দুটো লাল। তার সঙ্গে কথা বলবার সময় তার ঠোঁট কাঁপছিল। সেটা আমার নজর এড়ায় নি। তখনই আমার সন্দেহ হল। মিঃ শালক হোমস, আপনি তো জানেন, ঠিক সূত্রটি খুঁজে পেলে মনের কিরকম ভাব হয় স্নায়ুতে কিরকম একটা উত্তেজনা দেখা দেয়। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনার প্রাক্তন বোর্ডার ক্লিভল্যান্ডের মিঃ এনক জে, ড্রেবারের রহস্যজনক মৃত্যুর খবর আপনি শুনেছেন কি?’

‘মা ঘাড় নাড়ল। একটা কথাও বলতে পারল না। মেয়েটি কেঁদে উঠল। বুঝলাম, এরা অনেককিছুই জানে।’

‘জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ট্রেন ধরবার জন্য মিঃ ড্রেবার ক’টার সময় আপনাদের এখান থেকে চলে যান?’

‘উত্তেজনাকে চাপা দেবার জন্য ঢোঁক গিলে সে বলল, ‘আটটার সময়। তাঁর সচিব মিঃ স্ট্যাঙ্গারসন বলেছিলেন, দুটো ট্রেন আছে—একটা ৯টা ১৫-তে আর একটা ১১টায়। তিনি প্রথমটাই ধরবেন?’

‘সেই কি তাকে আপনি শেষ দেখেছেন?’

‘প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীলোকটির মুখের ভয়ংকর পরিবর্তন ঘটল। মুখখানা কালিবর্ণ হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড পরে অনেক কষ্টে একটিমাত্র শব্দই সে উচ্চারণ করতে পারল ‘হ্যাঁ,-তখনও তার গলায় স্বর ফ্যাঁসফেঁসে অস্বাভাবিক।’

‘কয়েক মুহূর্তের নীরবতার পরে মেয়েটি শান্ত স্পষ্ট গলায় বলল, ‘মা, মিথ্যার ফল কখনও ভাল হয় না।এই ভদ্রলোকের কাছে সব কথা খুলে বলাই ভাল। মিঃ ড্রেবারকে আমরা আবার দেখেছিলাম।’

‘ঈশ্বর তোকে ক্ষমা করুন।’ দুই হাত শূন্যে তুলে চেয়ারে বসে পরে ম্যাডাম চার্পেন্টিয়ার বলে উঠলো, ‘তোর ভাইকে তুই খুন করেছিস।’

মেয়েটি দৃঢ়স্বরে বলল, ‘আর্থারও চাইত যে আমরা সত্য কথাই বলি।’

‘আমি বললাম, ‘সব কথাই আমাকে খুলে বল। অর্ধেক বলা না বলার চাইতে খারাপ। তাছাড়া , এ ব্যাপারে আমরা কতটা জানি তাও তো তোমরা জান না।’

‘মা কেঁদে বলল, ‘এলিস, তোর মাথার দিব্যি,তাই হোক।’ আমার দিকে ফিরে বলল, ‘স্যার, আপনাকে আমি সব কথাই বলব। আমার ছেলে এই ভয়ংকর ব্যাপারে জড়িয়ে পড়বে এই আশংকাতেই আমি বিহ্বল হয়ে পড়েছি তা মনে করবেন না। সে সম্পূর্ণ নির্দোষ। আমার শুধু ভয়, আপনার চোখে না অন্যদের চোখে তাকে এ ব্যাপারে জড়িত বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সেটা একেবারেই অসম্ভব। তার উন্নত চরিত্র, তার জীবিকা, তার অতীত-সবাই এধরনের কাজের পরিপন্থী।’

‘সে বলল, ‘এলিস, আমাদের একটু একা থাকতে দাও।’ মেয়েটি চলে গেল। সে বলতে লাগল, ‘দেখুন স্যার, সব কথা আপনাকে বলবার ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু মেয়েটা যখন সব ফাঁস করে দিয়েছে, তখন আর গন্ত্যন্তর নেই। বলাই যখন স্থির করেছি, তখন কিছুই বাদ না দিয়ে সবই আপনাকে বলব।’

‘আমি বলক. সেটাই বুদ্ধিমতীর কাজ।’

‘মিঃ ড্রেবার প্রায় তিন সপ্তাহ আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তিনি আর তাঁর সচিব মিঃ স্যাঙ্গারসন ইউরোপ পরিভ্রমণে বেরিয়েছেন। তাঁদের প্রত্যেকটি ট্যাংকের উপর ‘কোপেনহেগেন’ লেবেল আঁটা দেখেছি। তাতে মনে হয় তারা সর্বশেষ সেখানেই ছিলেন। স্ট্যাঙ্গারসন শান্ত, চাপা প্রকৃতির লোক। কিন্তু দুঃখের সঙ্গেই বলছি, তাঁর মালিক সম্পূর্ণ অন্য ধরনের  মানুষ। তাঁর স্বভাব অমার্জিত, চাল-চলন জানোয়ারের মত। যেদিন ও’রা আসেন সেদিন রাতেই ওরা মদে চুর হয়ে পড়েন। পরদিন বেলা বারোটার আগে তাঁর হুঁস হয় না।পরিচারিকাদের সঙ্গে তাঁর চাল-চলনও দৃষ্টিকটু ও বে-আব্রু। সবচাইতে দুঃখের কথা, আমার মেয়ে এলিসকেও তিনি সেই চোখেই দেখতে শুরু করলেন এবং একাধিকবার তাঁকে এমন সব কথা বললেন, সৌভাগ্যবশত যেগুলো বোঝবার মত বয়স তার এখনও হয় নি। একসময় তিনি হাত ধরে টেনে তাকে আলিঙ্গন পর্যন্ত করেন। তার নিজের সচিব এই অভদ্র আচরণের জন্য তাকে তিরস্কার করতে বাধ্য হন।’

‘আমি প্রশ্ন করলাম, ‘এসব আপনি সহ্য করলেন কেন? যখন খুশি বোর্ডারদের তো আপনি ছাড়িয়ে দিতে পারেন বলে আমি জানি।’

‘আমার প্রশ্নে ম্যাডাম চার্পেম্টিয়ারের মুখ লাল হয়ে উঠল। বলল, ঈশ্বরের কৃপায় তার আসার দিনই তাকে নোটিশ দিলেই ভাল করতাম। কিন্তু লোভ বড় দারুণ জিনিস। দিন প্রতি প্রত্যেকে তারা এক পাউন্ড করে দিচ্ছিলেন—সপ্তাহে চৌদ্দ পাউন্ড। তার উপর এখন খদ্দের-পত্তর কম। আমি বিধবা। ছেলেকে নৌ-বিভাগে পাঠাবার খরচও অনেক। তাই টাকাটা হাতছাড়া করতে মন চাইল না। সবই মেনে নিয়েছিলাম।কিন্তু শেষটায় অত্যন্ত বাড়াবাড়ি হওয়ায় আমি তাকে বাড়ি ছাড়বার নোটিশ দিলাম। তাই তিনি চলে গেলেন।’

‘তারপর?’

‘তাকে চলে যেতে দেখে মনটা হাল্কা হল। ছেলে তখন ছুটিতে এসেছে। এসব কথা কিছুই তাকে জানালাম না। কারণ সে খুব বদরাগী, আর বোনকে খুব ভালবাসে। তারা চলে যেতে আমি দরজা বন্ধ করে দিয়ে মনে হল মনের উপর থেকে একটা বোঝা নেমে গেল। কিন্তু হায়! এক ঘণ্টার মধ্যই দরজায় আবার বেল বেজে উঠল। শুনলাম, মিঃ ড্রেবার ফিরে এসেছেন। তিনি খুব উত্তেজিত। মদ খাওয়ার জন্য তাঁর অবস্থা আরও শোচনীয়। যে ঘরে আমি মেয়েকে নিয়ে বসেছিলাম তিনি জোর কর সেই ঘরে ঢুকে ট্রেন পান নি বলে কিছু অবান্তর কথা বললেন। তারপর  এলিসের দিকে ফিরে আমার মুখের উপর তাকে বললেন তার সঙ্গে পালিয়ে যেতে। বললেন, ‘তোমার বয়স হয়েছে, কোন আইন তোমাকে আটকাতে পারে না, আমার অনেক বাড়তি টাকা আছে। ওই বুড়ি মেয়েটার কথা ভেব না। আমার সঙ্গে এখনই সোজা চলে এস। আমি তোমাকে রাণীর মতো রাখব।’ বেচারি এলিস আতংকে ছুটে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই তিনি তার হাত ধরে দরজার দিকে টানতে লাগলেন। আমি চীৎকার করে উঠলাম, আর সেই মুহূর্তে আমার ছেলে আর্থার ঘরে ঢুকল। তারপর কি ঘটল আমি জানি না। আমি নানারকম কটুক্তি ও ধ্বস্তাধ্বস্তির শব্দ শুনেছিলাম। কিন্তু ভয়ে মুখ তুলতে পারি নি।যখন মুখ তুললাম তখন দেখি একটা লাঠি হাতে নিয়ে আর্থার দাঁড়িয়ে হাসছে। আমাকে সে বলল, ‘ভদ্রলোক আর কখনও আমাদের বিরক্ত করবে না। একবার গিয়ে দেখতে হবে তিনি কি করেন।’ বলতে বলতে টুপিটা নিয়ে সে রাস্তায় বেরিয়ে গেল। পরদিন মিঃ ড্রেবারের রহস্যজনক মৃত্যুর খবর শুনলাম।’

‘অনেকবার ঢোঁক গিলে থেমে থেমে ম্যাডাম চার্পেস্টিয়ার যা বলছিলেন হল সেই বিবরণ। সময় সময় সে এত নীচু স্বরে কথা বলছিল যে সব শোনও যায়নি। আমি অবশ্য তার সব কথারই শর্ট-হ্যান্ড নোট নিয়েছি, যাতে কোনরকম ভুলের সম্ভাবনা না থাকে।’

শার্লক হোমস হাই তুলে বলল, ‘খুবই উত্তেজনাপূর্ণ। তারপর কি হল?’

গোয়েন্দা বলতে লাগলেন, ‘ম্যাডাম চার্পেস্টিয়ার থামল। আমি বুঝতে পারলাম সমস্ত ব্যাপারটা একটা পয়েন্টের উপর নির্ভর করছে। একদৃষ্টিতে স্ত্রীলোকটির চোখের দিকে তাকালাম। মেয়েদের ব্যাপারে এটা অনেক সময় খুব কার্যকারী হয়। জানতে চাইলাম, তার ছেলে কখন ফিরেছিল।’

‘আমি জানি না,’ সে জবাব দিল।

‘জানেন না?’

‘না। তার কাছে একটা চাবি থাকে। সেটা দিয়ে দরজা খুলে সে নিজেই বাড়িতে ঢোকে।’

‘আপনি শুতে যাবার পরে?’

‘হ্যাঁ।’

‘আপনি কখন শুতে গিয়েছিলেন?’

‘এগারোটায়।’

‘অর্থাৎ আপনার ছেলে দুঘণ্টা বাইরে ছিল?’

‘হ্যাঁ।’

‘চার বা পাঁচ ঘণ্টাও হতে পারে?’

‘হ্যাঁ।’

‘এত সময় সে কি করছিল?’

‘আমি জানি না।’ সে জবাব দিল। তার ঠোঁট তখন সাদা হয়ে গেছে।

‘অবশ্য এর পরে আর সেখানে কিছু করবার ছিল না। লেফটেন্যান্ট চার্পেন্টিয়ার কোথায় আছে খোঁজ করে দুজন অফিসার সঙ্গে নিয়ে সেখানে গেলাম এবং তাকে গ্রেপ্তার করলাম। তার কাঁধে হাত রেখে যখন তাকে নিঃশব্দে আমাদের সঙ্গে আসতে বললাম, সে উদ্ধৃত সাহসের সঙ্গে বলে উঠল, ‘মনে হচ্ছে ঐ পাজী ড্রেবারের মৃত্যুর জন্য আমাকে গ্রেপ্তার করছেন।’ তখনও আমরা তাকে কিছুই বলি নি। তাই তার পক্ষে ওকথা উল্লেখ করায় আমাদের সন্দেহ আরও বেড়ে গেল।’

‘খুবই স্বাভাবিক’ হোমস বলল।

‘সে যখন ড্রেবারের পিছু নেয় তখন তার হাতে যে ভারী লাঠিটা ছিল বলে তার মা উল্লেখ করেছে, সেটা তখনও তার হাতেই ছিল। ওক কাঠের একটা মুগুরবিশেষ।’

‘তাহলে তোমার বক্তব্যটা কি?’

‘দেখুন, আমার বক্তব্য সে ব্রিক্সটন রোড পর্যন্ত ড্রেবারকে অনূসরণ করে। সেখানে পৌঁছে দুজনের মধ্যে আবার ঝগড়া বাঁধে। সেইসময় ড্রেবারের পেটে লাঠির আঘাত লাগে এবং সে মারা যায়, কিন্তু আঘাতের কোন চিহ্ন মৃতদেহে পড়ে না। বৃষ্টির রাত। কেউ কোথাও ছিল না। চার্পেন্টিয়ার মৃতদেহটাকে টানতে টানতে খালি বাড়িতে নিয়ে যায়। আর মোমবাতি, রক্ত, দেওয়ালের লেখা, এবং আংটি—এসবই পুলিশকে ভুল পথে চালাবার ধোঁকা হতে পারে।’

উৎসাহ দেওয়ার ভঙ্গীতে হোমস বলল, ‘চমৎকার! সত্যি গ্রেগসন, বেশ ভালই চালাচ্ছ। তোমাকে আরও বড় কিছু না বানিয়ে ছাড়ছি না।’

গোয়েন্দা গর্বভরে বলল, ‘সমস্ত ব্যাপারটা বেশ ভালভাবে গুছিয়ে এনেছি বলে আমার খুব গর্ব হচ্ছে। যুবকটি স্বেচ্ছায় একটা বিবৃতি দিয়েছে। বলেছে, কিছুদুর পযন্ত ড্রেবারকে অনুসরণ করবার পর ড্রেবার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তার হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য একটা গাড়িতে উঠে পড়ে। সেখান থেকে বাড়ি ফিরবার পথে একটা পুরনো জাহাজী বন্ধুর সঙ্গে তার দেখা হয় এবং তার সঙ্গে সে অনেকটা পথ হাঁটে। সেই পুরনো জাহাজী বন্ধু কোথায় থাকে জিজ্ঞাসা করা হলে সে কোন সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারে না। আমার তো মনে হয় সব ব্যাপারটাই গাঁটে গাঁটে মিলে যাচ্ছে। লেস্ট্রেড যে ভুল পথে ঘুরে মরছে সেটা ভেবেই আমার আরও বেশী মজা লাগছে। আমার ধারণা, সে বেশী দূর  এগোতেও পারবে না। আরে! সে যে সশরীরে হাজির।’

সত্যি লেস্ট্রেড। আমার যখন কথা বলছিলাম তখন সে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছে। এবার ঘরে ঢুকল। তার হাবভাব এবং পোশাকে সাধারণতঃ যে আড়ম্বর থাকে সেটার যেন অভাব দেখা গেল। তার মুখে বিরক্তি ও গোলযোগের আভাষ। তার পোশাক এলোমেলো ও ময়লা। স্পষ্টই বোঝা গেল, সে শালর্ক হোমসের সঙ্গে পরামর্শ করতে এসেছিল। সহকর্মীকে দেখেই কেমন যেন বিব্রত ও মুহ্যমান হয়ে পড়ল। ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কি করবে বুঝতে না পেরে টুপিটা হাতাতে লাগল। অবশেষে বলল, ‘একটা অসাধারণ কেস—একটা দুর্বোধ্য ব্যাপার।’

গ্রেগসন বিজয়গর্বে বলে উঠল, ‘তোমার তাই মনে হচ্ছে বুঝি! আমি জানতাম তুমি ঐ সিন্ধান্তেই পৌঁছাবে। সচিব মিঃ জোসেফ স্ট্যাঙ্গাসনের খোঁজ পেয়েছ কি?’

লেস্ট্রেড গম্ভীরভাবে বলল, ‘আজ সকাল ছ’টা হ্যালিডেস প্রাইভেট হোটেলে মিঃ জোসেফ স্ট্যাঙ্গারসন খুন হয়েছেন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *