০৬. আজ আমার মা বাড়ি ফিরে আসবেন

আজ আমার মা বাড়ি ফিরে আসবেন। বাবা বাইরে গেছেন কয়েক দিনের জন্যে। কল শো আছে উত্তরবঙ্গের কোনও এক শহরে। বিরাজকাকুই দায়িত্ব নিয়েছেন হাসপাতালের সব দেনাপাওনা শোধ করে মাকে নিয়ে আসার। অনেক টাকা লাগবে। জানি না কে সেই টাকা দিচ্ছেন। বাবা না বিরাজকাকু।

হাসপাতাল থেকে ফিরে দুজনে সেদিন অনেক আলোচনা হয়েছে। সে আলোচনা থেকে ভবিষ্যতের কোনও চেহারা দেখেছি বলে মনে হয় না। সবই অনিশ্চিত। বাবা নাকি স্টেজ ছেড়ে যাত্রায় যাবেন। যাত্রায় এখন টাকা উড়ছে। ঐতিহাসিক আর পৌরাণিক পালা কলকাতার বাইরে এখনও নাকি বেশ জমে ওঠে। তা হয়তো হবে। আমি ও সব জানি না। তবে আমার যা মনে হচ্ছে, তা হল, একটা বড়সড়ো বুদবুদ তৈরি হচ্ছে, যে কোনও মুহূর্তে ফাটল বলে। আমার কেবলই মনে হচ্ছে, একটা খারাপ কিছু ঘটবে। সাংঘাতিক একটা ঘটনার মুখোমুখি হতে চলেছি। আমরা সেই জাহাজের যাত্রী যার ক্যাপটেন কম্পাস পড়তে জানেন না। আমার বাবা যখনই কিছু বলেন সবই মনে হয় এক একটি নাটকের সংলাপ। বাবার সমস্ত পরিকল্পনাই রঙিন ফানুসের মতো আকাশে উঠেই হারিয়ে যায়।

আমি সেই কবিতায় পড়েছিলুম, সে কবিতা বোধহয় আমার বাবাকে দেখেই লেখা :

কুশের ফুৎকারজাত বুদ্বুদের স্ফটিকমণ্ডল
চ্ছুরিত বর্ণচ্ছটা অন্তর্হিত হলে মহাকাশে
সনির্বন্ধ শিশু যথা ডুবে যায় অশ্রুর অতলে
বিশ্বের বৈচিত্র্য খোঁজে আপনার ভাবালু বিলাসে।

আমি এখন কবিতায়, উপন্যাসে, নাটকে আমার বাবা আর মাকে খুঁজি। খুঁজি এর শেষ কোথায়? শেষ দৃশ্যের শেষ সংলাপ এক-এক লেখকের কলমে এক-একরকম।

মা এলেন তার ফেলে যাওয়া সংসারে। মাথার চুল রুক্ষ। চোখ দুটো অসম্ভব উজ্জ্বল। বয়েস হয়েছে তবু আমার মা কত সুন্দর! আমার মায়ের পাশে থিয়েটারের সেই জাহানারা মাসি কি দাঁড়াতে পারবেন! তবে কেন ওসব কথা মাঝে-মাঝেই এ-সংসারে ভেসে আসে! কারা রটায়! কাঁদের স্বার্থ আছে এর পেছনে।

বিরাজকাকু বললেন, নিজের সংসার বুঝে নাও। আমি আদুরিকে এনে কয়েকদিন এখানে রাখছি। দিনকতক তুমি কোনও কাজ করবে না। যা করার আদুরি করবে।

আমি পারব। আমি ঠিক হয়ে গেছি।

তুমি বেঠিক কবে ছিলে! তুমি সব পারবে তাও জানি? তবে সেই পারাটা এখনও অন্তত সপ্তাহখানেক বন্ধ রাখতে হবে!

মা বারান্দায় একটা গোল চেয়ারে বসে পড়লেন। সামনেই বড় রাস্তা। লোকজন, গাড়িঘোড়া, দোকানপাট। মা সেই দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন। আমার হঠাৎ মনে হল, আমরা সবাই এক একটা সাজাহান। এই জীবন হল এক-একটি দুর্গ। ঔরংজীব সেই ভাগ্য! সাজাহানদের জীবনের দুর্গে বন্দি করে রেখে সরে পড়েছে। আমাদের ইচ্ছে হল জাহানারা। তাকে সঙ্গী করে সারাদিন যত বিলাপ আর কান্না।

আদুরি এসে গেছে। বিরাজকাকু কয়েকদিন এ-বাড়িতেই থাকবেন। মনে একটা সুখ-সুখ ভাব আনতে চাইছি। আসছে কই? সব ব্যাপারটাই এত অনিশ্চিত, সমুদ্রের বালিতে বালি দিয়েই ঘর তৈরির মতো। এই আছে এই নেই। কার টাকায় কার সংসার কে চালাচ্ছে।

রাতে বিছানার শুয়ে মা জিগ্যেস করলেন, তোর বাবা কবে ফিরবে রে?

মায়ের মন থেকে সে রাতের লজ্জা আর অপমানের ভাবটা এখনও কাটেনি। ছেলে-মেয়ের সামনে মা মাথা উঁচু করে থাকতে চান। সেই মাথা বাবা এমন করে নীচু করে দিয়ে গেছেন! কারুরই গৌরব বাড়েনি। বাইরের চোখে বাবা কত বড়! আমাদের চোখে আজ কত ছোট। মা আর আমরা কোথায় কীভাবে দাঁড়িয়ে আছি, তা আজ খুবই স্পষ্ট।

কাল সকালেই তো আসার কথা আছে মা! সাজাহানের শেষ অভিনয় সামনের রবিবারে। পোস্টার পড়েছে শহরের দেওয়ালে। চ্যারিটি শো।

বিরাজকাকু বারান্দায় বসে আছেন। সিগারেটের আগুন দেখা যাচ্ছে।

মা বললেন, শুয়ে পড়ো এইবার। সারাদিন অনেক খেটেছ।

বিরাজকাকু হঠাৎ গান গেয়ে উঠলেন, সব মিছা কথা ভাবিতে যে ব্যথা, বড় লাগে প্রভু পরাণে। কেন বঞ্চিত হব চরণে।

.

কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। স্বপ্ন দেখছি, বিশাল এক ফঁকা মাঠ। কেউ কোথাও নেই। একটা জল টলটলে দিঘি। চারপাশে লম্বা লম্বা ঘাস। দূর থেকে হেঁটে আসছি। একটা ঝাকড়া গাছ। গোটা কতক ডাল নুয়ে পড়েছে জলের দিকে। গাছের ডালে-ডালে জরি বসানো রেশমের পোশাক ঝুলছে। রাজার পোশাক। ঝলমল করছে রোদের আলোয়। গাছের তলায় পড়ে আছে একটা মুকুট। দু-পাটি জরির কাজ করা নাগরা জুতো। একটা কোমরবন্ধনী পড়ে আছে সাপের মতো এঁকেবেঁকে। আমি ভাবছি এসব কার পোশাক। দিঘির নিথর জলে একটা ঢেউ গোল থেকে গোলাকার হতে হতে তীরের দিকে চলে আসছে। কেউ যেন এইমাত্র ডুব দিয়েছেন। আমি অনেকক্ষণ জলের দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটা মানুষ কতক্ষণ ডুবে থাকতে পারে। ঢেউ মিলিয়ে এল। দু-একটা ফড়িং উড়ছে জলের ওপর নেচে-নেচে। কেউই উঠছে না দেখে ছাড়া পোশাকের দিকে তাকাতেই দুটো পরিচিত জিনিস চোখে পড়ল। এতক্ষণ দেখতে পাইনি। একটা লাল সিগারেটের প্যাকেট, একটা সাদা লাইটার। দুটোই খুব চেনা। বাবা এই সিগারেটই খান। লাইটারটা জাহানারা মাসি বাবাকে জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলেন। আমি চিৎকার করে ডাকলাম–বাবা! আমার ডাক চাপা পড়ে গেল। দূরে মাঠের কিনারা দিয়ে একটা রেল চলেছে গুমগুম শব্দ করে বাঁশি বাজাতে-বাজাতে। আর ঠিক তখনই কোথা থেকে একটা ঝড়ো বাতাস উঠল। গাছের ডাল থেকে পোশাকগুলো একে-একে উড়ে গিয়ে জলে পড়ে ভাসতে লাগল। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে আবার ডাকলাম বাবা!

ঘুমটা ছাঁত করে ভেঙে গেল। সকাল হয়ে গেছে। বেশ সকাল। এখনও কারোর ঘুম ভাঙেনি। মা শুয়ে, পাশে শিখা। মেঝেতে আদুরি। ওপাশের ঘরে বিরাজকাকু। আমি দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালুম। আকাশে সামান্য ভেঁড়া-ঘেঁড়া মেঘ। শরৎ এসে গেছে। মনে হল নীচের রাস্তায় অনেক লোক। আমাকে দেখতে পেয়ে কে একজন বলে উঠলেন–

ওই যে, ওই যে।

আমি অবাক হয়ে রাস্তার দিকে তাকালাম। বেশ কিছু মানুষ। কারুর বগলে ভাঁজ করা বাজারের ব্যাগ। কারুর হাতে খালি দুধের বোতল। আমাকে তাকাতে দেখে একজন প্রশ্ন করলেন কোনও খবর পেলে?

কী খবর?

কখন আসছেন?

কে আসছেন? আমি খুবই অবাক হয়ে গেছি।

কেন তোমরা শোনোনি! ভোরের খবরে রেডিয়োতে বলেছে তো।

কী বলেছে?

জনতা স্তব্ধ হয়ে গেছে। বিরাজকাকু আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, রেলিঙে কনুইয়ের ভর রেখে। বিরাজকাকু জিগ্যেস করলেন, কী খবর? আমরা তো শুনিনি।

সকলেই তখন সমস্বরে বলে উঠলেন, প্রখ্যাত নট চন্দ্রকুমার ও চন্দ্রকুমারী দার্জিলিঙের কাছে পথদুর্ঘটনায় নিহত। আমরা গভীর বেদনার সঙ্গে জানাচ্ছি…।

আর কোনও কথাই আমার কানে এল না। খুব একটা দুঃখ নয়, কেমন একটা বিস্ময়ে মন ছেলে গেল। কী আশ্চর্য স্বপ্ন। কত স্পষ্ট! দিঘির জলে ঢেউ মিলিয়ে আসছে। রাজার পোশাক গাছের ডাল থেকে বাতাসে উড়ে-উড়ে জলে পড়ছে। সাদা একটা সিগারেট লাইটার, লাল একটা সিগারেটের প্যাকেট। কানে ভেসে আসছে, মাঝরাতের স্তব্ধ প্রেক্ষাগৃহ থেকে বাবার কণ্ঠস্বরে সাজাহানের সেই বিখ্যাত সংলাপ–

চেয়ে দেখ এই সন্ধ্যাকালে ওই যমুনার দিকে, দেখ সে কী স্বচ্ছ! চেয়ে দেখ ওই আকাশের দিকে–দেখ সে কী গাঢ়! চেয়ে দেখ ওই কুঞ্জবনের দিকে–দেখ সে কী সুন্দর!

আর চেয়ে দেখ, ওই প্রস্তরীভূত প্রেমা, ওই অনন্ত আক্ষেপের আপ্লুত বিয়োগের অমর কাহিনি আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। এখন দিন, তবু মনে হচ্ছে গভীর রাত। আমার কাঁদতে ইচ্ছে করছে না, বাবারই এক বন্ধু, এক গুণমুগ্ধের মতো বলতে ইচ্ছে করছে–

হিরণ নদীর বিজন উপকূলে
আচম্বিতে পথের অবসান,
পরপারে নাম না-জানা গ্রাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *