০৫. হাসপাতালে গিয়ে বুঝলাম

হাসপাতালে গিয়ে বুঝলাম বাবা এখনও কী ভীষণ জনপ্রিয়। সমস্ত কর্মচারী, ডাক্তার, নার্স সবাই ছুটে এসেছেন। এমনকী রুগিরাও বিছানায় উঠে বসেছেন। স্টেজে বাবার একটা আলাদা নাম আছে। সারা শহরে মাঝে-মাঝে যখন পোস্টার পড়ে তখন সেই নাম দেখা যায়। নামের আগে একটা উপাধি থাকে–নটনারায়ণ চন্দ্রকুমার।

ডাকসাইটে অভিনেতাদের চাল-চলনই আলাদা। কখন মনকে গুটিয়ে রাখতে হয়, কখন ছড়িয়ে দিতে হয়, সবই যেন হাতের মুঠোয়। বাবা সোজা এগিয়ে চললেন দু-সার বেড়ার ফাঁক দিয়ে আমার পেছনে-পেছনে। এখন যেন আমার বেশ গর্ব লাগছে। যার বাবার এত সম্মান তার গর্ব একটু হবে না? হাসপাতালের কেউই জানে না মার কীভাবে লেগেছে। শুধু জানে সাধারণ ঘরের এক মহিলা হাসপাতালে এসেছে। পয়সার তেমন জোর নেই তার, ফ্রি বেডে রয়েছে। পেয়িং বেড বা কেবিনে থাকতে পারেনি। এইটুকুই যা লজ্জার। এত বড় একজন অভিনেতার স্ত্রী, তার তো কেবিনেই থাকা উচিত।

আমি জানতাম না, বাবা শুধু স্টেজেরই বিখ্যাত অভিনেতা নন, জীবনেও কত বড় অভিনেতা। জীবন আর অভিনয় যেন এক করে ফেলেছেন। মায়ের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে চারপাশ একবার ভালো করে দেখে নিলেন। বাবার চারপাশে আমরা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছি। মায়ের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। বিছানার পাশ থেকে সেই স্ট্যান্ড বোতল সব চলে গেছে। ও সবের এখন আর প্রয়োজন নেই। মায়ের মাথার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন সেই ভীষণ খিটখিটে সিস্টার। নরম একটা হাত মায়ের কপালে। বাবাকে দেখে মায়ের কপালে আদর ঢেলে দিচ্ছেন। বাবার প্রতি অনুরাগ তাঁকে মিষ্টি করে তুলেছে। কিছু দূরেই হাসি-হাসি মুখে ডাক্তারবাবু। গলায় স্টেথিসকোপ। এই প্রথম হাসপাতালের ডাক্তারবাবুকে হাসতে দেখলাম।

বাবা বললেন, এ কী? এ তুমি কী করেছ বিরাজ। একটা কেবিনের ব্যবস্থা করতে পারোনি? এইভাবে ফেলে রেখেছ এখানে? ডক্টর কেবিন নেই?

আজ্ঞে হ্যাঁ আছে। আপনি চাইলে না থাকলেও আছে।

প্লিজ আপনি এখুনি আমার স্ত্রীকে একটা কেবিনে সরিয়ে দিন। শি ইজ মাই ইনসপিরেশন। আমার যা কিছু সব ওরই জন্যে।

বাবা কথা কটা বলেই মায়ের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে সামান্য হেলে গিয়ে মায়ের একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিলেন। দু-হাতের মুঠোয় মায়ের হাত। বাবা ঘাড় ঘুরিয়ে মিষ্টি হেসে ধীরে ধীরে জিগ্যেস করলেন, কেমন আছ তুমি?

সত্যি বলছি, আমি এইসব দেখছিলাম একটু দূর থেকে। দেখে মনে হচ্ছিল, আমি কোনও নাটকের হাসপাতাল দৃশ্যে নায়ক-নায়িকার অভিনয় দেখছি। জানি না, কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক! বিরাজকাকু বলেছিলেন, তোর বাবা জীবন আর অভিনয়কে এক করে ফেলেছে। তাই হয়তো হবে। ডাক্তার বললেন, সিস্টার তাহলে ইমিডিয়েটলি রুগিকে কেবিন নাম্বার সিক্সে ট্রানসফার করার ব্যবস্থা করুন। আমি স্যারকে বলে পারমিশান করিয়ে আনছি।

বাবা একহাতে মায়ের একটা হাত ধরেছেন। আর-একটা হাত মায়ের গালে। বিছানার পাশে কোনও রকমে পেছন ঠেকিয়ে বসেছেন। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে দুজনের মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। দুজনে-দুজনের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি বেশ বুঝতে পারছি বাবার দুটো চোখ ছলছল করছে। ভেতরটা কাঁদছে। কী জানি? এও অভিনয় কি না! যে জীবনে জীবন আর অভিনয় এক হয়ে গেছে সে জীবন কেমন যেন বিশ্বাস করা শক্ত। আর অবাক হয়ে এও দেখলুম মায়ের চোখে-মুখে কোনও ঘৃণা নেই, অভিযোগ নেই, রাগ নেই, অভিমান নেই। মায়ের ভাসা ভাসা বড়-বড় চোখ বেয়ে জল নেমে এসেছে মুক্তোর দানার মতো। আমি ভালোবাসার মুখ চিনি। মা যখন ভালোবেসে আমার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়েন সে মুখ তো তখন আমি দেখেছি। মা বাবার দিকে ঠিক সেই মুখে চেয়ে আছেন। আমি পড়েছি কখনও কখনও নীরবতা ভাষার চেয়ে বড়। আজ তা চোখে দেখলাম।

শিখা কখন সরতে সরতে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ভয়ে ভয়ে বাবার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। মা যে কতখানি কার সে জানে না। মা হয়তো জানেন। ডান হাত বাড়িয়ে শিখার হাত ধরেছেন। বড় সুন্দর দৃশ্য। কোথায় লাগে নাটক! একদিকে বাবা, একদিকে মা আর একদিকে শিখা। এর নাম পরিবার। সুখী পরিবার কি না বলতে পারব না। বিরাজকাকু একদিন বলেছিলেন, সুখ মানুষের মনে রে বিনু। বাইরে তার সন্ধান পাওয়া যায় না।

বাবা ডাক্তারবাবুকে জিগ্যেস করলেন, কবে ছাড়বেন?

দু-এক দিনের মধ্যেই।

বাবার মুখটা খুশিখুশি হয়ে উঠল। এও কি অভিনয়। হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। সত্য আর মিথ্যার ব্যবধান কোনও-কোনও জীবনে বড় সংকীর্ণ। আমার কী করার আছে। আমি এক দর্শক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *